গবাদি প্রাণির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা

গবাদিপ্রাণির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা

গবাদিপ্রাণির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” ইউনিট – ১২ , পাঠ – ১২.২। গবাদিপ্তানির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা গবাদি প্রাণির বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য যেসব উপাদান দরকার সেসব উপাদানকে গবাদি প্রাণির খাদ্য উপাদান বলে। গৃহপালিত প্রাণির খাদ্য উপাদান ছয়টি। যথা- শর্করা, আমিষ, চর্বি বা স্নেহপদার্থ, খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ও পানি।

গবাদিপ্রাণির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা

 

খাদ্যে উপাদান সমূহের কাজ:

শর্করা খাদ্য:

যেসব খাদ্য উপাদান প্রাণী দেহে শক্তির যোগান দেয় তাকে শ্বেতসার বা শর্করা বলে। অতিরিক্ত শ্বেতসার শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হয়।

কাজ:

১. দেহে শক্তি উৎপাদন ও সরবারাহ করা। |

২. স্নেহ পদার্থ দহনে সহায়তা করা।

৩. খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধি করা।

৪. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা।

৫. পরিপাকে সহায়তা করা।

উৎস– ধান, গম, ভুট্টা, গমের ভূষি, আলু, ডাল, ঝোল গুড়, উন্নতমানের খড়, চালের কুঁড়া ইত্যাদি ।

 

আমিষ খাদ্য:

যে খাদ্য উপকরণ শরীরে মাংস বৃদ্ধির কাজ করে তাকে আমিষ বলে। এটি বিভিন্ন ধরনের এমাইনো এসিডের সমন্বয়ে গঠিত।

কাজ

১. নতুন কোষ তৈরি এবাং পুরাতন ও ভেঙ্গে যাওয়া কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করা।

২. শক্তি সরবরাহ করা।

৩. দেহকে সুস্থ সবল কর্মক্ষম রাখা।

৪. এমাইনো এসিডের চাহিদা পূরণ করা।

৫. মাংসপেশি গঠনে সহায়তা করা।

৬. শরীরের ক্ষয়পুরণ ও বৃদ্ধি সাধন করা।

৭. রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করা।

৮. শিং, পশম, ক্ষুর ইত্যাদি গঠন ও বৃদ্ধি করা।

উৎস: শুটকি মাছের গুড়া, রক্ত, ডালজাতীয় শস্যদানা, গম, খৈল, ডালের ভূষি ইত্যাদি।

 

স্নেহ পদার্থ বা চর্বি জাতিয় খাদ্য:

চর্বি ফ্যাটি এসিডের সমন্বয়ে গঠিত এমন এক উপাদান যা শে^তসার এবং আমিষের চেয়ে ২.২৫ গুন বেশি শক্তি সরবরাহ
করে থাকে।

কাজ

১. দেহে তাপ ও কর্মশক্তি উৎপাদন ও সরবরাহ করা।

২. চামড়ার মসৃণতা রক্ষা ও চর্মরোগ প্রতিরোধ করা।

৩. শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করা।

৪. মাংসের স্বাদ ও উপযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।

৫. পশমের নিচে মোমের মত আবরণ তৈরি করা। ৬. দেহে সঞ্চিত খাদ্যের উৎস হিসেবে কাজ করা।

উৎস: খৈল, ডাল, সয়াবিন, বাদাম, নারিকেল, সূর্যমুখি, মাছের তেল, দুধ ইত্যাদি।

খনিজ পদার্থ:

অজৈব পদার্থসমূহ খনিজ উপাদান।

কাজ

১. নতুন কলা উৎপাদনে সহায়তা করা।

২. দেহের অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা।

৩. হাড় ও দাঁতের গঠন ঠিক রাখা।

৪. রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করা।

৫. মাংসপেশীর টান, উত্তেজনা ও স্নায়ুত্ব স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখা।

৬. শর্করা বিপাক ও স্নেহ পদার্থ দহনে সহায়তা করা।

৭. প্রোটিন তৈরি ও কোষ বিভাজনে সহায়তা করা।

৮. হজমে সহায়তা করা।

উৎস: কাঁচা সবুজ ঘাস, লবণ, আয়োডিনযুক্ত শুটকি মাছের গুড়া, হাড়ের গুড়া, চুনাপাথর ইত্যাদি।

 

খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন:

ভিটামিন শরীরে খুবই অল্প পরিমাণে দরকার হয় এবং এর অভাবে শরীরে অপুষ্টিজনিত রোগ দেখা দেয়।

কাজ

১. রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করা এবং শরীর সুস্থ রাখা।

২. দেহের বিপাকীয় কাজে সহায়তা করা।

৩. শক্তির সঞ্চালনে সহায়তা করা।

৪. গবাদি প্রাণির হাড় ও দাঁতের গঠন স্বাভাবিক রাখা।

৫. ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের পরিশোষণ ও সংরক্ষণে সহায়তা করে।

উৎস: কত্রিমভাৃ বে তৈরি ভিটামিন, ফলমূল, শাক—সবজি, কাঁচা ঘাস ইত্যাদি।

 

পানি

পানি খাদ্যের একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ।

কাজ

১. খাদ্যেকে দ্রবীভূত ও শোষণ করতে সহায়তা করা।

২. দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা এবং খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করা।

৩. খাদ্যের বাহক হিসেবে কাজ করা।

৪. অভি¯্রবণীয় চাপ বজায় রাখতে সহায়তা করা।

৫. শ^সনে সহায়তা করা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা।

৬. বিভিন্ন প্রকার এনজাইম পরিবহনে সহায়তা করা।

৭. গবাদি প্রাণির ভারবহনকারী কলাকে স্থিতিস্থাপক ও দৃঢ়তা প্রদান করা।

৮. দেহাভ্যন্তরের বিভিন্ন প্রকার বর্জ্য পদার্থ নিঃসরণে সহায়তা করা।

উৎস: খাদ্য মধ্যস্থিত পানি, টিউবওয়েলের পানি, নদী—নালা, পুকুর ও খালবিলের পানি, কাঁচা ঘাস ইত্যাদি।

 

সুষম খাদ্যের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব:

যেসব খাদ্যে পশুর সকল অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান উপযুক্ত পরিমাণে ও অনুপাতে থাকে তাকে সুষম খাদ্য বলে। গৃহপালিত প্রাণির দেহ গঠন, কর্মক্ষমতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। সুষম খাদ্যে আমিষ শর্করা, স্নেহপদার্থ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ উপস্থিত থাকে। সুষম খাদ্য না দিলে গবাদি প্রাণি অপুষ্টিতে ভোগে, এতে গবাদি প্রাণি দুর্বল হয়ে যায় , কাজ করার ক্ষমতা লোপ পায়, দুধ উৎপাদন কমে যায় এবং রোগাক্রান্ত হয়।

সুষম খাদ্যের গুরত্ব:

গবাদি প্রাণিকে সুষম খাদ্য খাওয়ালে

১. গবাদি প্রাণি সুস্থ ও সবল হয়।

২. গবাদি প্রাণির স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

৩. গবাদি প্রাণির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

৪. গবাদি প্রাণির মাংস ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে।

৫. গবাদি প্রাণির বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে।

৬. খামারের সার্বিক লাভ হয়।

৭. গবাদি প্রাণির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।

৮. গবাদি প্রাণি হতে প্রাপ্ত দ্রব্যের (মাংস, দুধ, ও অন্যান্য উপজাত) গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।

৯. গবাদিপ্রাণির রোগব্যাধি কম হয়।

১০. কম সময়ে বড় আকারের সুস্থ ও সবল গরু পাওয়া যায়।

 

সুষম খাদ্যের বৈশিষ্ট্য:

* সুষম খাদ্য সুস্বাদু হবে।
* সব ধরনের খাদ্য উপাদান সুষম অনুপাতে থাকবে।

 

সুষম খাদ্য তৈরির উপকরণ ও নিয়মাবলি:

সবুজ কাঁচা ঘাস ও দানাদার খাদ্য সুষম খাদ্যের অন্তভূর্ক্ত। গবাদিপ্রাণির সুষম খাদ্য উপকরণ এবং সুষম খাদ্য তৈরির নিয়মাবলি নিচে উল্লেখ করা হল।

খড়:

* খড় হল আঁশযুক্ত খাদ্য। একটি দেশী গরুকে দৈনিক ৩—৪ কেজি শুকনা খড় খাওয়াতে হবে।

* খড় ছোট ছোট করে কেটে বড় চাড়ির মধ্যে পানি বা ভাতের মাড়ে ভিজিয়ে তাতে প্রয়োজনীয় দানাদার খাদ্য ও ৩০০—৪০০ গ্রাম ঝোলাগুড় মিশিয়ে খাওয়ালে খড়ের পুষ্টিমান বৃদ্ধি পায়।

* তাছাড়া ইউরিয়ার সাথে খড় প্রক্রিয়াজাতকরণ করে খাওয়ানো যায়।

 

সবুজ কাঁচা ঘাস:

* গবাদি প্রাণির প্রধান খাদ্য সবুজ কাঁচা ঘাস। সবুজ কাঁচা ঘাস আঁশযুক্ত খাদ্য।

* দেশীয় একটি গরুকে দৈনিক ১০—১২ কেজি এবং উন্নত জাতের একটি বড় গরুকে দৈনিক ১২—১৫ কেজি সবুজ কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হয়।

* গাভী পালন করে তার থেকে বেশি দুধ পেতে হলে তাকে অবশ্যই প্রচুর কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে।

* উন্নত জাতের কাঁচা ঘাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— নেপিয়ার, পারা, ভূট্টা, সরগাম, জার্মান, গিনি, সিগনাল, ওটস ইত্যাদি। এদের ফলন পুষ্টিমান বেশি থাকে।

* কাঁচা ঘাসের অভাব হলে গবাদি প্রাণিকে গাছের সবুজ পাতা, বিভিন্ন রকমের লতাপাতা, তরকারির খোসা ও ফলমূলের উচ্ছিষ্ট অংশ খাওয়ানো যায়।

* বিভিন্ন জাতের ডুমুর, ডেউয়া, মান্দার, ইপিল—ইপিল গাছের পাতা গবাদি প্রাণিকে খাওয়ানো যায়।

* এ ছাড়া এ সকল সবুজ কাঁচা ঘাস সমূহ দ্বারা সাইলেজ, হে প্রভৃতি তৈরি করেও গবাদিপ্রাণিকে খাওয়ানো যায়। সাধারণত অমৌসুমে অথার্ৎ যখন কাঁচা ঘাসের অভাব দেখা দেয় তখন সাইলেজ বা হে খাওয়ানো হয়।

দানাদার খাদ্য:

শুষ্ক অবস্থায় যেসব খাদ্যে শতকরা ১৮ ভাগের কম আঁশ এবং শতকরা ৬০ ভাগের চেয়ে বেশি সামগ্রিক পরিপাচ্য পুষ্টি থাকে সেসব খাদ্যসমূহকে দানাদার খাদ্য বলে। খড় ও কাঁচা ঘাসের পাশাপাশি পুষ্টিকর দানাদার জাতীয় খাদ্য গবাদি প্রাণির বিশেষ করে দুগ্ধ প্রদানকারী গাভীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। ১০০ কেজি দানাদার খাদ্য তৈরির উপকরণ ও পরিমাণের একটি তালিকা নিচে দেয়া হল।

এছাড়াও প্রতি ১.৫ কেজি অতিরিক্ত দুধ উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত ০.৫ কেজি দানাদার খাদ্য খাওয়াতে হবে।

পানি

পানি জীবদেহের জন্য অত্যাবশ্যক, কেননা জীবদেহের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই পানি। খাদ্য পরিপাকসহ জীবদেহের সমস্ত জৈবিক কাযার্বলি সম্পাদনের জন্য পানি অত্যাবশ্যক উপাদান। এজন্য গবাদি প্রাণিকে দৈনিক প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি পান করাতে হবে।

 

খাদ্য প্রদানের নীতিমালা:

নিচে গবাদি প্রাণিকে খাওয়ানোর একটি থাম্ব রুল দেয়া হল। বিভিন্ন ধরনের গবাদি প্রাণিকে রেশন তৈরির জন্য নিম্নলিখিত নিয়মগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।

উৎস: মোঃ আব্দুর রাজ্জাক মিয়া, ২০০৮।

বিঃদ্রঃ দানাদার খাদ্যের ১% লবণ ও ১ % জীবাণুমুক্ত হাড়ের গুঁড়া এবং পযার্প্ত পরিমাণে পরিষ্কার পানি সরবরাহ করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *