Category Archives: কৃষি

কৃষি গুরুকুলের “কৃষি” সেকশন হলো জ্ঞানের ভাণ্ডার যেখানে কৃষির ইতিহাস, ঐতিহ্য, আধুনিক গবেষণা ও কৃষি বিষয়ক অথরিটি প্রবন্ধসমূহ প্রকাশিত হয়। এখানে পাঠকরা কৃষি সম্পর্কিত মৌলিক তথ্য, উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ও সমৃদ্ধ কনটেন্ট খুঁজে পাবেন।

লাল শাক চাষ পদ্ধতি

লাল শাক চাষ পদ্ধতি , বাংলাদেশে লাল শাক অত‌্যন্ত জনপ্রিয়। এ কারণে দেশের প্রায় সকল অঞ্চলে লাল শাক চাষ হয়। লাল শাক অত‌্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার। একইসাথে এটি অত‌্যন্ত সুস্বাদু। এ কারণে ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই এই শাক জনপ্রিয়। ইংরেজিতে একে Red Amaranth বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম Anaranthus oleraceus. রান্নার পর গাঢ় লাল রঙ ধারণ করে লাল শাক। বাণিজ্যিকভিত্তিতে লাল শাক চাষ ও বাজারজাত করার মাধ‌্যমে যে কেউ নিজের কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করতে পারেন।

লাল শাক চাষ পদ্ধতি

লাল শাকের জাত :

লাল শাকের বিভিন্ন জাতের মধ‌্যে আলতা পেটি ২০, রক্ত লাল, বারি লালশাক ১, ললিতা, রক্তরাঙ্গা, পিংকি কুইন, রক্তজবা ও স্থানীয় জাতই উল্লেখযোগ‌্য।

লাল শাক চাষের সময় :

বছরের সব সময়েই লাল শাক চাষ করা যায়। তবে ভাদ্র থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত দেশব‌্যাপী সবচেয়ে বেশি চাষ হয় লাল শাকের।

লাল শাক চাষের জন্য মাটির প্রকৃতি :

প্রায় সব ধরনের মাটিতে লাল শাকের উৎপাদন হয়। তবে বেলে দোঁ-আশ থেকে এঁটেল দোঁ-আশ মাটিতে ভালো ফলন হয়। তাছাড়া যেখানে পানি জমে না, এমন জমি লাল শাক চাষের জন্য উপযোগী।

লাল শাকের বীজবপন পদ্ধতি :

জমি ভাল করে চাষ ও মই দিয়ে সমান করার পর ১ ভাগ বীজের সাথে ৯ ভাগ শুকনা ছাই মিশিয়ে হালকাভাবে ছিটিয়ে লাল শাকের বীজ বুনতে হয়। লাইন করে অথবা সারি করে বুনতে হলে ১৫ থেকে ২০ সেন্টমিটার দূরে দূরে বেড বানাতে হবে। এরপর কাঠি দিয়ে ১.৫ থেকে ২.০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত গভীর করে বীজ বুনতে হয়। পরে সেসব বীজ মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

 

 

লাল শাকে সার প্রয়োগ :

গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে লাল শাক চাষের জমিতে প্রয়োজন মতো জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকে। জৈব সারের পাশাপাশি অন‌্যান‌্য সারের প্রয়োগও করতে হবে।

সারের পরিমাণ :

সার এক শতকে হেক্টর প্রতি
গোবর ৪০ কেজি ১০ টন
ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম ১২৫ কেজি
টিএসপি ৩০০ গ্রাম ৭৫ কেজি
এমওপি ৪০০ গ্রাম ১০০ কেজি

 

সার প্রয়োগের নিয়ম :

বীজ বোনার আগেই সব ধরনের সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে এতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং সার জমির প্রতিটি ইঞ্চিতে সমানভাবে ছড়িয়ে যায়। যে কারণে পুরো জমি থেকেই সমানহারে সুপুষ্ট আবাদ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

লাল শাকের পরিচর্যা :

জমিতে চারা গজানোর পর তা ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে। যেসব স্থানে বীজের পরিমাণ বেশি পড়ে, সেখানে চারার পরিমাণ ঘন হয়। এসব ঘন জায়গা থেকে চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে।

বীজ ছিটিয়ে বোনা হলে প্রতি বর্গমিটারে ১০০ থেকে ১৪০টি গাছ রাখলে ভালো হয়। সারিতে বোনা হলে প্রতি লাইনে ৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে গাছ রাখলে লাল শাকের ফলন ভালো হয়। ৪-৫ দিন পর পর জমিতে সেচ দিতে পারলে দ্রুত বাড়ে লাল শাকের চারা। তবে মাঝে মাঝেই জমির আগাছা পরিষ্কার করে মাটি আলগা করে দিতে হবে।

লাল শাকের রোগবালাই ও প্রতিকার :

লাল শাকের রোগবালাইয়ের মধ‌্যে প্রধানত দুটি রোগই দেখা যায়। এর মধ‌্যে একটি হলো শুয়া পোকার আক্রমণ, অপরটি মরিচা রোগ।


লাল শাকে শুয়া পোকার আক্রমণ:

লাল শাকের রোগবালাইয়ের মধ‌্যে প্রধান শত্রু হলো শুয়া পোকা। এ পোকা গাছের পাতা খেয়ে ফেলে। তাই আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। এ পোকার হাত থেকে ফসল বাঁচাতে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি, রক্সিয়ন ৪০ ইসি, ইকালাক্স ২৫ ইসি ওষুধগুলোর যেকোন একটি হেক্টর প্রতি ১.১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।


লাল শাকে মরিচা রোগ আক্রমণ :

লাল শাকের অন‌্যতম রোগের আরেকটি হলো মরিচা রোগ। শুধুমাত্র শিকড় ছাড়া গাছের সকল অংশই এ রোগে আক্রান্ত হয়। পাতার নিচে সাদা অথবা হলুদ দাগ দেখতে পাওয়া যায়। পরে সেগুলো লালচে বা মরিচা রং ধারণ করে। এতে পাতা মরে যায়। এ রোগের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম ডাইথেন এম – ৪৫ ওষুধ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

লাল শাকের ফলন :

নিয়ম মেনে এবং সঠিক পরিচর্যা করলে প্রতি শতকে ৩০ থেকে ৪০ কেজি এবং হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ৬ টন শাক পাওয়া সম্ভব।

লাল শাকের ফসল সংগ্রহ :

বীজ বোনার ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে শাক খাওয়ার উপযুক্ত হয়। একসাথে শাক সংগ্রহ না করে ধীরে ধীরে সংগ্রহ করা ভালো। তবে বাণিজ‌্যিকভাবে শাক চাষ করলে অনেক কৃষক একবারেই জমির সব শাক তুলে ফেলতে পারেন। এতে আরেকটি ফসল চাষে জমি প্রস্তুত করতে সুবিধা হবে।

 

লাল শাকের পুষ্টিগুণ :

লালশাকে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ অন্য শাকের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। দাঁতের সুস্থতা, হাড় গঠন, গর্ভবতী এবং প্রসূতি মায়েদের দৈনিক ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণে লাল শাক উপকারী। লাল শাকে থাকা প্রচুর ভিটামিন দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধিতে ব‌্যাপক উপকারী। লালশাকে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার বা আঁশ থাকে, যা হজমে সাহায্য করে ফলে স্বাভাবিকভাবেই বদ-হজমের আশঙ্কা কমে। রক্তশূন্যতা রোধ করতে লাল শাক অত‌্যন্ত উপকারী। লাল শাকের এন্টি অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। কিডনি ভালো রাখতে ও কিডনি পরিষ্কার রাখতে লাল শাক খুব ভালো কাজ করে। চুলের স্বাস্থ্যের জন্য লাল শাক অনেক উপকারী। লাল শাক রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।

 

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ , ধান ক্ষেতে নির্দিষ্ট সময় ধরে বর্ষার পানি জমে থাকে যা নিঃসন্দেহে মাছ চাষের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ। ধান ক্ষেতে ব্যবহৃত সার, গোবর ইত্যাদি, পানি ও মাটির সাথে মিশে প্রাকৃতিকভাবে খাবার তৈরি করে যা মাছ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধানক্ষেতে মাছ চাষের প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন চাষি ধান উৎপাদনের সাথে সাথে বাড়তি আয়ও পেতে পারে । আমন ও বোরো দুই মৌসুমেই ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা সম্ভব । তবে আমন মৌসুমে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ বেশী লাভজনক ।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

সেচ সুবিধার আওতাধীন যে সমস্ত ধান জমি রয়েছে সেসকল জমিতে স্বল্প ব্যয়ে এবং স্বল্প পরিশ্রমে ধানের পাশাপাশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। ধান ক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শুধু অর্থই যোগান দেয় না সেই সাথে তাদের পুষ্টিও নিশ্চিত করে।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সুবিধা:

  • একই জমি থেকে ধানের সাথে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মাছ পাওয়া যায় সুতরাং জমির সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব।
  • ধান ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে এবং অনিষ্টকারী পোনা-মাকড় মাছ খায়ে ফেলে। ফলে ধানক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
  • মাছের চলাফেরার মাধ্যমে ক্ষেতের কাদামাটি উলটপালট হয় ফলে জমি হতে ধানের পক্ষে অধিকতর পুষ্টি গ্রহণযোগ্য হয়।
  • মাছের বিষ্টা সার হিসাবে ধান ক্ষেতের উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে।

ধান ক্ষেতে চাষ পদ্ধতি:

সাধারণত: দুই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা যায়:

১. ধানের সাথে মাছের চাষ:

  • একই জমিতে ধান ও মাছ একত্রে চাষ করা হয়।
  • আমন মৌসুমে মাঝারি উঁচু জমিতে যেখানে ৪-৬ মাস বৃষ্টি পানি জমে থাকে সেখানে ধানের সাথে মাছ চাষ করা যায়।
  • বোরো মৌসুমে সেচ সুবিধার আওতাধীন জমিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।

 

২. ধানের পরে মাছের চাষ

  • বাংলাদেশের যে সমস্ত জমি বর্ষাকালে প্লাবিত হয় এবং রোপা আমন চাষ করা হয় না সেখানে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়।

মাছ চাষের জন্য জমি নির্বাচন:

  • সব ধান ক্ষেত মাছ চাষের জন্য উপযোগী নয়। ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সফলতা নির্ভর করে জমি নির্বাচনের ওপর। জমি নির্বাচনের সময় নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জমি নির্বাচনের সময় বিবেচনাধীন বিষয়গুলো:-
  • সাধারণত: দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ এবং এটেল মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা এবং উর্বরা শক্তি বেশি বিধায় এসব মাটির জমি ধানক্ষেতে মাছ চাষের জন্য উপযোগী।
  • অতি উঁচু অর্থাৎ পানি ধরে রাখাতে পারে না এবং অধিক নিচু জমি অর্থাৎ সহজেই প্লাবিত হয় সেসব জমি মাছ চাষের অনুপযোগী।
  • বন্যার পানি প্রবেশ করে না এরূপ উঁচু জমিই মাছ চাষের উপযোগী।
  • বোরো মৌসুমে চাষের ক্ষেত্রে সেচের সুবন্দোবস্ত থাকতে হবে।

ধান ক্ষেত প্রস্তুতকরণ:

  • যথাযথভাবে চাষ ও মই দিয়ে ধান চাষের প্রচলিত নিয়মে জমি প্রস্তুত করতে হবে। এতে একদিকে যেমন ক্ষেত আগাছামুক্ত হবে তেমনি জমি কাদা হয়ে ধান রোপণের উপযুক্ত হবে।
  • ক্ষেতের চারপাশের আইল কমপক্ষে ০.৩ মিটার বা ১ ফুট উঁচু ও ১ ফুট চওড়া করে তৈরি করতে হবে। তবে আইলের উচ্চতা নির্ভর করবে জমির অবস্থানের ওপর।
  • জমির যে অংশ অপেক্ষাকৃত ঢালু সে অংশে জমির শতকরা ২-৩ ভাগ এলাকা জুড়ে কমপক্ষে২-৩ ফুট গভীর একটি ডোবা খনন করতে হবে, যা ক্ষেতের কোণায়, পাশে বা মধ্যে হতেপারে ।
  • শুঙ্ক বা খরা মৌসুমে অথবা অন্য কোনও কারণে জমির পানি শুকিয়ে গেলে উক্ত গর্ত মাছের জন্য সাময়িক আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
  • জমি তৈরির জন্য প্রচলিত নিয়মেই জমিতে সার, গোবর ইত্যাদি প্রয়োগ করে ধান রোপণ করতে হবে।

ধানের জাত নির্বাচন:

ধানের জাত নির্বাচনে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে:-

  • সমন্বিত ধান-মাছ চাষের ক্ষেত্রে যে জাতের ধান বেশী পানি সহ্য করার ক্ষমতা রাখে এবং ফলনও বেশি সেই জাত নির্বাচন করতে হবে।
  • আমন মৌসুমের জন্য বি আর-৩ (বিপব), বি আর-১১ (মুক্তা), বি আর-১৪ (গাজী) এবং বোরো মৌসুমের জন্য বি আর-১৪ ও বি আর-১৬ ইত্যাদি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উপযোগী।
  • ধানের সাথে মাছের চাষের জন্য ধানের চারা অবশ্যই সারিবদ্ধভাবে রোপণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেমি. এবং গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. রাখাতে হবে।

মাছের প্রজাতি নির্বাচন:

মাছের প্রজাতি নির্বাচন লক্ষণীয় বিষয়সমূহ:-

  • অগভীর পানিতে চাষ করা যায় এমন প্রজাতির মাছ নির্বাচন করতে হবে।
  • কম অক্সিজেনে বাঁচতে পারে এমন প্রজাতির মাছ।
  • দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির মাছ নির্বাচন করতে হবে। যেমন- রাজপুঁটি, মিরর কার্প, মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়া ইত্যাদি ।

মাছের পোনা মজুত:

  • ধান ক্ষেতে ধান রোপণের পরপরই পোনা মজুদ করতে হয় না, রোপণের পর ধানের চারা মাটিতে শিকড় মেলে শক্ত হতে ও ধানের কুশী গজাতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে । এ জন্য১৫-২০ দিন পর ধান ক্ষেতে মাছের পোনা মজুদ করতে হয়।
  • জমিতে কমপক্ষে ১০-১৫ সেমি. পানি থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১৫-২০টি ৫-৭ সেমি.আকারের রাজপুঁটি/মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়া/ মিরর কার্পের পোনা ছাড়তে হবে।
  • উভয় জাতের মাছ একত্রে চাষ করার ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৮টি রাজপুঁটি ও ৭টি মিরর কার্পের পোনা ছাড়া যেতে পারে।
  • সকালে অথবা বিকালে অর্থাৎ যখন পানি ঠাণ্ডা থাকে তখন ক্ষেতে পোনা মজুদ করা উচিত। এ নিয়মে পোনা মজুত করলে ধান চাষকালীন সময়ের অর্থাৎ ১০০-১২০ দিনের মধ্যেই মাছ খাওয়ার ও বিক্রয়ের উপযোগী হয়ে থাকে।
  • মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়ার মিশ্র চাষ না করে একক চাষ করতে হবে।

ধান ক্ষেতে পানি ব্যবস্থাপনা:

  • মাছ ধান ক্ষেতে থাকা অবস্থায় সবসময় পানি থাকতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষেতে পানির গভীরতা ১০-১৫ সেমি. থাকতে পারে, তবে মাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে পানির গভীরতা বাড়াতে হবে।
  • যদি কোনও সময় বাইরে থেকে পানি সরবরাহের প্রয়োজন হয়, তখন পুকুর বা ভূগর্ভস্থ পানিসরবরাহ করতে হবে।
  • ইঁদুর, কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাণী যাতে আইলে গর্ত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি জমে ক্ষেত প্লাবিত হওয়ার আশংকা থাকলে অপেক্ষাকৃত ঢালু অংশে আইলের কিছু জায়গা ভেঙে বাঁশের বানা বা ছাঁকনিযুক্ত পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে।
  • ধান ক্ষেতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাবারই মাছের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। তবে প্রাকৃতিক খাবারের অপর্যাপ্ততা পরিলক্ষিত হলে প্রয়োজনবোধে মাছের খাবার হিসেবে ক্ষুদি পানা বাচালের কুঁড়া সরবরাহ করা যেতে পারে।
  • প্রচলিত নিয়মে জৈব বা অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতিতে পোকা-মাকড় দমন করা যেতে পারে।
  • ধান ক্ষেতের মাছকে ডোবা বা নালায় স্থানান্তরের পর প্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের পর বৃষ্টি হলে ৫-৭ দিন পর মাছগুলোকে ক্ষেতে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। আর যদি বৃষ্টি না হয় সে ক্ষেত্রে ৫-৭ দিন পর সেচের মাধ্যমে পুনরায় মাছকে সমস্ত জমিতে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের উপযুক্ত সময় হলো বিকেল বেলা কারণ এ সময় ধানের পাতা শুঙ্ক থাকে।
  • পাশের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানো হলে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কীটনাশক মিশ্রিত পানি কোনক্রমেই মাছের ক্ষেতে প্রবেশ না করে।
  • ধান রক্ষার জন্য জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হলে মাছকে আইলের সাহায্যে গর্তে আটকে রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত গরম বা খরার সময় ক্ষেতে গর্তের পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য গর্তের কিছু অংশে কচুরিপানা রাখতে হবে ।
  • ক্ষেতের পানির প্রয়োজনের তুলনায় কমে গেলে দ্রুত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

ধান ক্ষেতে মাছ আহরণ:

  • ধান পাকার পর ক্ষেতের পানি কমিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা নিতে হবে, এসময় মাছ আস্তে আস্তে ডোবায় চলে যাবে এবং মাছ ধরতে হবে।
  • ধান ক্ষেতে সমন্বিত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে ৩-৪ মাসে হেক্টরপ্রতি ৩২৫-৩৫০ কেজি মাছ এবং ২.০-২.৫ টন মাছের ফলন পাওয়া যায়।
  • অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ধানের সাথে মাছ চাষ করলে ধানের ফলন গড়ে প্রায় শতকরা১৫ ভাগ বেশি হয়। এতে চাষিরা অধিক মুনাফা অর্জন করে থাকে।

পরামর্শ:

  • ধান ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারে সর্তক থাকতে হবে।
  • অতি বৃষ্টিতে যেন ধান ক্ষেত প্লাবিত না হয় অথবা খরায় ধান ক্ষেত শুকিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • চাষিকে দৈনিক সকাল-বিকালে ধানক্ষেত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

 

সঠিক নিয়মে বনসাই তৈরির পদ্ধতি

সঠিক নিয়মে বনসাই তৈরির পদ্ধতি , এখন আমাদের দেশেও  উন্নত মানের বনসাই তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের বনসাই রয়েছে। ব্রুম, রুটওভার রক, ফরমাল, ইনফরমাল, রুট অ্যাক্সপোজ, ইনফরমাল আব্রাইট, টুইনট্রাংক, টৃপলট্রাংক, মাল্টি ট্রাংক, ফরেস্ট, ডেপ্টউড, ল্যান্ডস্ক্যাপ, প্লানটিং, লিটারেটি ইত্যাদি।

সঠিক নিয়মে বনসাই তৈরির পদ্ধতি

ফরমাল বনসাইয়ের ক্ষেত্রে ডালপালাগুলোর নিয়মিত শয্যাবিন্যাস দেখা যায়। যেটা ইনফরমাল বনসাইয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ডালপালাগুলো এলোমেলো হয়। ইনফরমাল আব্রাইট জাতীয় ইনফরমাল বনসাইয়ের মতো। তবে তা হেলানো ঝুলানো অবস্থায় থাকে।

বনসাই তৈরির পদ্ধতি 

চারা তৈরি:

সাধারণত বনসাইয়ের চারা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতে হয়। বীজ সংগ্রহ করেও চারা তৈরি করে নিতে পারেন। যেসব প্রজাতির বীজ পাওয়া যায় না, সেসব উদ্ভিদের অঙ্গজ পদ্ধতি অবলম্বন করে চারা তৈরি করতে হয়। বীজ সংগ্রহ করেও চারা তৈরি করে নিতে পারেন। অর্থাৎ কাটিং, ঝড় বিভাজন, তেউড় বিভাজন, দাবা কলম, গুটি কলম, চোখ কলম প্রভৃতি পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে চারা তৈরি করে নিতে হয়। টব বাছাই ক্যাসকেটড বা উঁচু বনসাই ছাড়া সবরকম বনসাইয়ের জন্য ছোট বাটির টব উত্তম। টবের আকার হওয়া উচিত গাছের শাখা-প্রশাখাসহ তার বিস্তারের চেয়ে কিছুটা ছোট। আকৃতি দৃষ্টিনন্দন হওয়া চাই। টবের আকৃতি সবসময় বৃত্তাকার হতে হবে এমন নয়, আয়তাকার, বর্গাকার কিংবা ত্রিভুজাকারও হতে পারে।

টবে সার মাটি প্রয়োগ

প্রথমে বিভিন্ন জাতের বনসাইয়ের জন্য আলাদাভাবে মাটি তৈরি করতে হয়। মাটি তৈরির ক্ষেত্রে জৈব সারের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। সব ক্ষেত্রেই দোআশ বা পলি মাটি ব্যবহার করা হয়। বনসাই টবের জন্য মাটি তৈরি করা খুব সহজ। প্রধানত দোআঁশ মাটির সঙ্গে জৈবসার মিশিয়ে বনসাইয়ের মাটি তৈরি করা হয় নিম্নোক্তভাবে:

দোআঁশ মাটি

পরিমাণ মতো, কম্পোস্ট- ১/২ কেজি হাড় গুঁড়ো ৫০ গ্রাম, খড়ি মাটি গুঁড়ো ৫০ গ্রাম, ইট গুঁড়ো ১৩০ গ্রাম, কাঠের ছাই ৭৫গ্রাম।

চারা লাগানো

কাটিং গুটি কলম বা বীজের চারা বনসাইয়ে সার-মাটি ভরে যথারীতি লাগাতে হবে। টবে জল নিষ্কাশনের ছিদ্রের ওপর ইটের কুচির পরিবর্তে এক টুকরো তারের জালি রেখে তা কিছু কাঁকর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তারপর যথারীতি সার-মাটি ভরে চারা লাগাতে হবে।

বনসাই তৈরির ধাপ

বনসাই তৈরির জন্য কাণ্ড, শেকড়, শাখা-প্রশাখা ও পাতার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাই যথেষ্ট নয়। টবের ছোট গাছে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা বয়োবৃদ্ধ গাছের সুঠাম ভঙ্গিমায় আনার চেষ্টা করতে হবে।

শাখা বাছাই

বনসাইকে যে মডেলের রূপ দেওয়া হবে তা স্থির করে শাখা বাছাই করা দরকার। জোড়া পাতার কক্ষ থেকে কান্ডের দু’পাশে দু’টি শাখা গজায়। বাছাই পদ্ধতি অনুসারে এর একটিকে রাখতে হবে। নিচেরটি ডানদিকে রাখলে তার ওপরেরটি বামদিকে রাখতে হবে। আসলে বনসাইয়ের কাণ্ডের রূপ সামনের দিকে কোন শাখা থাকবে না। থাকবে কেবল ডান ও বাম দিকে এবং পেছনে কাণ্ডের মাথার দিকেও শাখা থাকতে হবে।

শাখা ছাঁটাই

প্রায়শই বনসাইয়ের বয়স ৩-৪ বছর হলে তখন প্রুনিংয়ের প্রয়োজন হয়। বাছাই করা মোটা শাখাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটতে হয়। এর জন্য যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা উচিত তার নাম কনকেভ কাটিং প্লায়ারস এর কাটার ধরন পৃথক। কাটার স্থানের চারদিক থেকে ছাল বেড়ে তাড়াতাড়ি তা ঢেকে দেয়। বন সাই পরিচর্যার জন্য স্পেশাল যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় শুধুমাত্র সেই গুলিই ব্যবহার করুন।

তার বাঁধা

কাণ্ড বা শাখাকে সুন্দর, সুঠাম ভঙ্গিমায় আনতে যেসব কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করা হয় তার বাঁধা তাদের মধ্যে অন্যতম। সরল শাখায় তার জড়িয়ে আঁকাবাঁকা রূপ দেয়া যায়। কাণ্ডের জন্য মোটা তার ও শাখার জন্য সরু তার প্রয়োজন। সাধারণত এজন্য তামার তার ব্যবহার করা হয়। অনেকে গ্যালভানাইজিংয়ের তারও ব্যবহার করেন। মনে রাখা দরকার, তার জড়ানোর ফলে গাছ বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তার খোলার পর গাছকে ছায়ায় বা হালকা ছায়ায় অন্তত সপ্তাহখানেক রাখা দরকার। প্রয়োজন বোধে দু’তিনবার তার জড়ানো যেতে পারে; কিন্তু তা অন্তত ছয় মাস অন্তর হওয়া দরকার। বনসাই তৈরির জন্য উপযুক্ত প্রজাতির গাছ যেমন বট, পাকু, হিজল, অশ্বথ, ডুমুর, ডালিম, কদম, বাগানবিলাস, বোতল ব্রাশ, নিম, জামরুল ও তেঁতুল ইত্যাদি।

ভালো বনসাইয়ের বৈশিষ্ট্য

গাছের সামনের চেয়ে পেছনের দিকে প্রচুর পাতা থাকতে হবে। এতে করে গাছের গভীরতা বোঝা যাবে।  

শেকড়

প্রকৃতিতে যেমন গাছের শেকড় মাটির উপরে কিছুটা থাকে, বনসাইয়ের ক্ষেত্রেও তা থাকা দরকার। ধীরে ধীরে উপরের দিকে যত উঠবে তত চিকন হবে। মূল কান্ডটি সবচেয়ে মোটা হবে। দুই-তৃতীয়াংশ সামনে থেকে দেখা যাবে।

শাখা-প্রশাখা

গাছের উচ্চতা থেকে অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে ডালপালা থাকবে। নিচ থেকে প্রথম ডালটি সবচেয়ে মোটা হবে। এভাবে উপরের দিকে ডাল ক্রমান্বয়ে চিকন হবে।

গাছের বহিরাকৃতি

গাছের বহিরাকৃতি অনেকটা ত্রিভুজাকার হবে। ক্ষেত্রবিশেষে গোলাকারও হতে পারে।

পাত্র

বনসাইয়ের টব বা পাত্র পরিষ্কার ও নিখুঁত হবে। টবের রঙ গাছের রঙ কিংবা ফুল, ফল ও পাতার রঙের সঙ্গে মানানসই হতে হবে। বনসাইয়ের পাত্র অপরিচ্ছন্ন থাকলে মশাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ হতে পারে।

মনে রাখবেন-

বনসাইয়ের স্টাইল নানা ধরনের হয়। তবে মূলত পাঁচটি স্টাইল।

ফরমাল আপ রাইট

এই রীতির গাছগুলো চারদিকে সমানভাবে ডালপালা ছড়িয়ে উপরে ওঠে।

ইনফরমাল আপ রাইট

এ রীতির গাছও উপরে ওঠে তবে ডালপালা সাধারণের মতো অত বিন্যস্ত নয়, একটু এলোমেলো।

কাসকেড

কাসকেড রীতির গাছগুলো টবের সীমানা ছাড়িয়ে ঝরনার মতো নিচের দিকে গড়িয়ে নামে। সেমিকাসডেক বা অর্ধকাসকেড রীতির গাছ টবের প্রান্তসীমায় এসে আটকে যায়। একমাত্র কাসকেড ও সেমিকাসকেড বনসাইতে উঁচু পট/টব ব্যবহার করা হয়।

রুট ওভার রক

পাথরের ওপর যে বনসাই লাগানো হয় তাকে বলে রুট ওভার রক ।

এ ছাড়াও লিটার্চিক, টুইন ট্রাঙ্ক, মাল্টি ট্রাঙ্ক, রাফট ইত্যাদি নানা স্টাইলের বনসাই হয়ে থাকে।

এখন অনেকেই বনসাই করছেন। ঢাকার বেশ কয়েকটি অভিজাত দোকান থেকে আপনি বনসাই কিনতে পারবেন। কিছু কিছু নার্সারিতেও বনসাই কিংবা বনসাই করার উপযুক্ত গাছ পাওয়া যায়। দুই-তিনশ টাকা থেকে কয়েক হাজার টাকা দামের বনসাই দোকানে বা নার্সারিতে কিনতে পাবেন। গত বৃক্ষমেলায় লাখ টাকার উপরে একাধিক বনসাই উঠেছিল। তবে বনসাই শুধু কিনলেই হবে না, তাকে চিনতে এবং রক্ষণাবেক্ষনও করতে হবে। মনে রাখতে হবে, গাছের বৃদ্ধি কখনো থেমে থাকে না, কাজেই যে অবস্থায় আপনি বনসাইটি কিনলেন তা কোনো স্থায়ী অবস্থা নয়। প্রতি বছরই গাছে নতুন ডালপালা আসবে, শেকড় বাড়বে এবং আপনার বনসাইয়ের চেহারা পাল্টাবে

 

বাদাম চাষের সহজ ও সঠিক পদ্ধতি

বাদাম চাষের সহজ ও সঠিক পদ্ধতি , চীনা বাদাম একটি বহুল জনপ্রিয় খাদ্য। কাচা ও ভাজা- উভয় অবস্থায়ই চীনা বাদাম খাওয়া যায়। এর ব্যবহার সর্বাধিক। চানাচুর, মাখন, কেক, বিস্কুট, তরকারি হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভর্তা হিসেবেও এটি খাওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া বাদাম থেকে তেল ও তৈরি হয়ে থাকে। চীনা বাদাম উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ। এর ফ্যাট রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এক কথায় চীনা বাদামের পুষ্টিগুণ অনেক।

বাদাম চাষের সহজ ও সঠিক পদ্ধতি

আজ আমরা আপনাদের সাথে চীনা বাদাম চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই চীনা বাদাম চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন। চলুন দেখে নিন চীনা বাদাম চাষের পদ্ধতি বিস্তারিত:-

মাটি

চীনা বাদাম চাষের জন্য দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি বেশি উপযোগী। চীনা বাদাম যাতে সহজেই মাটি ভেদ করে যেতে পারে তার জন্য মাটি সুনিষ্কাশিত হতে হবে এই জন্য হালকা বেলে দোআঁশ মাটি বিশেষ উপযোগী।

বীজ বপনের সময়

সাধারণত এপ্রিল মাস থেকে ‍জুন মাসের মাঝামাঝি সময় চীনা বাদাম চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। তবে রবি মৌসুমে চাষ করতে হলে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বীজ বপন করা যায়।

বীজের পরিমাণ

বাদাম চাষে বীজের পরিমাণ বাদামের জাতের ওপর নির্ভর করে থাকে। সাধারণত এক হেক্টর জমির জন্য খোসসহ বাদাম ৯৫-১০০ কেজি প্রয়োজন হয়ে থাকে।

জমি তৈরি

উন্নত ফলন পেতে হলে জমি ভালো ভাবে চাষ দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। জমিতে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। জমিতে নালা তৈরি করে দিতে হবে সেচ ব্যবস্থার সুবিধার জন্য।

বীজ বপন পদ্ধতি

বীজ বপন করার আগে চীনা বাদাম থেকে ভালো করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। খোসা ছাড়ানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন বীজের ওপরের পাতলা পর্দা নষ্ট না হয়ে যায়। খোসা ছাড়ানোর পর পরই বীজ বপন করে দেওয়া উচিত কারণ তখন বীজটা টাটকা থাকে। তবে খোসা ছাড়ানোর ২-৫ দিনের মধ্যে বীজ বপন করা যাবে। বাদামের বীজ সাধারণত সারিতে বপন করা উচিত। এক সারি থেকে আরেক সারির দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি এবং এক বীজ থেকে আরেক বীজের দূরত্ব হবে ১৫ সেমি। বীজ বপন করতে হবে ৫ সেমি গভীর করে। জমিতে বীজ বপন করার সময় পর্যাপ্ত রস থাকতে হবে। যদি মাটিতে রসের পরিমাণ কম থাকে তাহলে জল সেচ দিতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনা

ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে। চীনা বাদাম চাষে এক হেক্টর জমিতে ৫-৭ টন পচা গোবর, ইউরিয়া ২০-৩০ কেজি, টিএসপি ১৫০-১৭০ কেজি, এমওপি ৮০-৯০ কেজি, জিপসাম ১৬০-১৮০ কেজি প্রয়োজন হয়ে থাকে।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি

জমি শেষ বার চাষ করার সময় বীজ বপন করার আগে জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক ছাড়া বাকি সব সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে বীজ বপন করার ৪০-৫০ দিন পর যখন গাছে ফুল আসবে। তবে জমিতে অনুবীজ সার ও প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই সার প্রয়োগ করতে হবে এক কেজি বীজের জন্য ৭০ গ্রাম। তবে অনুবীজ সার প্রয়োগ করলে জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করার দরকার হয় না। সার প্রয়োগ করার পর প্রয়োজনে জল সেচ দিতে হবে।

সেচ ব্যবস্থা

উন্নত ফলন পেতে হলে জমিতে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। জমির অবস্থা বুঝে সেচ দিতে হবে জমিতে। খারাপ মৌসুমে একবার সেচ দিতে হবে। যদি চর এলাকায় চীনা’ বাদাম চাষ করা হয়ে থাকে তাহলে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে রবি মৌসুমে সেচ দিতে হবে। কারণ তখন মাটিতে রস শুকিয়ে যায়। তখন ১-২টি সেচ দিতে হবে।

আগাছা দমন

জমির আগাছা ভালো করে ছাটাই করে দিতে হবে। বীজ বপন করার ১৫-২০ দিন পর একবার নিড়ানি দিতে হবে। প্রয়োজনে মাটি হালকা কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে। মাটি যদি বেশি শক্ত হয়ে যায় তাহলে গাছে ফুল ধরার আগে গাছের গোঁড়ায় মাটি চেপে দিতে হবে।

 

রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা

জমিতে যদি রোগ আক্রমণ করে থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। চীনা’ বাদাম চাষে সাধারণত বিছা পোকা, উইপোকা আক্রমণ করে থাকে। বিছাপোকা আক্রমণ করলে ডায়াজিনন ৬০ ইসি এক লিটার জলের সাথে এক মিলি পরিমাণ মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করতে হবে। উইপোকা আক্রমণ করলে জমিতে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিতে হবে। এছাড়া চীনা’ বাদাম গাছে পাতার দাগ রোগ দেখা যায় ও পাতায় মরিচা রোগ দেখা যায়। জমিতে রোগ আক্রমণ করলে উপযুক্ত ছত্রাক নাশক স্প্রে করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ

বাদাম পরিপক্ব হওয়ার পর তা সংগ্রহ করতে হবে। গাছের পাতা যখন হলুদ হয়ে যাবে এবং গাছের নিচের দিকের পাতা যখন ঝরে পড়তে শুরু করবে তখন ফল সংগ্রহ করতে হবে। এ সময় একটি বা দুটি গাছের গোঁড়ার মাটি খুঁড়ে বাদামের রং পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তারপর বাদাম সংগ্রহ করতে হবে। বাদাম সংগ্রহের পর ৩-৪ দিন ভালো করে রোদে শুকাতে হবে।

ফলন

সঠিক উপায়ে চাষ করতে পারলে এক হেক্টর জমি থেকে ২-২.৫ টন চীনা’ বাদাম পাওয়া যেতে পারে।

 

বাঁশ চাষ পদ্ধতি

বাঁশ চাষ পদ্ধতি নিয়ে আজকের আলোচনা। বাঁশ চাষ বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা যায়। বর্তমানে কাটিং ও কঞ্চি কলম পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ করে বিভিন্ন জেলার কৃষকরা সফলতার মুখ দেখছেন। সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ। নিম্নে কঞ্চি কলম পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ বর্ণিত হলো-

বাঁশ চাষ পদ্ধতি

বাঁশের কঞ্চি কলম সংগ্রহ:

কলম কাটার জন্য সুস্থ, সবল, অপেক্ষাকৃত মোটা আকৃতির এক বছর বা তার কম বয়সের বাঁশ নির্বাচন করতে হবে। বাঁশের গা ঘেঁষে আঙ্গুলের মতো মোটা কঞ্চি হাত করাত দিয়ে কেটে সংগ্রহ করতে হবে। কঞ্চির গোঁড়া হতে ৩-৫ গিট বা দেড় হাত লম্বা করে কঞ্চি কলম কাটতে হবে। সংগৃহীত কঞ্চিগুলি নার্সারি বেডে লাগানোর পূর্ব পর্যন্ত ভেজা চট দিয়ে মুড়িয়ে রাখুন অথবা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। কার্তিক-মাঘ (অক্টোবর – ফেব্রুয়ারি) মাস বাদে সারা বছরই কঞ্চি কলম করা যাবে। ফাল্গুন-আশ্বিন (মার্চ -সেপ্টেম্বর ) মাস কঞ্চি কলম কাটার উপযুক্ত সময়।

বাঁশ চাষের জন্য বালির বেড তৈরি:

চার ফুট চওড়া এবং প্রয়োজন মতো লম্বা বালির বেড তৈরি করতে হবে। বালির বেডের উচ্চতা বা পুরুত্ব কমপক্ষে ১০ ইঞ্চি হতে হবে। বালি সব রকমের আবর্জনামুক্ত হতে হবে। বালির বেডের কিনার বাঁধার জন্য চারদিকে  ইট বা তরজা ব্যবহার করতে হবে অথবা সমতল মাটিতে বেডের আকৃতিতে মাটি কেটে আয়তকার ১০ ইঞ্চি গভীরতার ব্লক তৈরি করতে হবে। মাটিতে কাটা ব্লকটি বালি দিয়ে ভরে দিতে হবে।

বাঁশ চাষের জন্য বালির বেডে কঞ্চি কলম রোপণ:

বালির বেডে কঞ্চিগুলি ২-৩ ইঞ্চি দূরত্বে সারিবদ্ধভাবে ৩-৫ ইঞ্চি গভীরে ভালোভাবে বালি চেপে লাগাতে হবে। বেডে কঞ্চি রোপণের পর হতে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত দিনে ২-৩ বার ঝরনা দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যেই কঞ্চিতে নতুন শাখা-প্রশাখা ও পাতা গজিয়ে সম্পূর্ণ বেড সবুজ আকার ধারণ করবে এবং কঞ্চি-কলমের গোঁড়ায় যথেষ্ট শিকড় গজাবে। তখন বেডে ধীরে ধীরে পানি সেচের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।

বাঁশের কলম স্থানান্তর ও রোপণ:

শিকড়যুক্ত কলম পলিথিন ব্যাগ বা উপযুক্ত পাত্রে ৩:১ অনুপাতে মাটি-গোবর মিশ্রণের মধ্যে স্থানান্তর করতে হবে। প্রতিটি ব্যাগ বা পাত্রে একটি করে শিকড় গজানো কঞ্চি কলম স্থানান্তর করতে হবে। ৭-১০ দিন কলমটি ছায়ায় রাখতে হবে। এ সময় নিয়মিত দিনে একবার পানি দিতে হবে। এরপর ব্যাগগুলি সারিবদ্ধ ভাবে বেডে সাজিয়ে রাখতে হবে। মাঠে রোপণের পূর্ব পর্যন্ত ব্যাগের আগাছা বাছাই করতে ও পরিমিত পানি দিতে হবে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ১৫-২০ ফুট দূরত্বে ১.৫ X ১.৫ X ১.৫ ফুট গর্তে কঞ্চি কলম মাঠে লাগিয়ে দিতে হবে। চার বছরে একটি কঞ্চি কলম ঝাড়ে পরিণত হবে এবং ছয় বছর হলে ঝাড় হতে বাঁশ আহরণ করা যাবে।

বাঁশের ঝাড় ব্যবস্থাপনা:

বাঁশঝাড়ের উন্নত ব্যবস্থাপনা করে খুব কম খরচে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ উৎপাদন করা যায় ও অধিক সবল বাঁশ পাওয়া যায়। বাঁশঝাড় ব্যবস্থাপনা দ্বারা সুস্থ-সবল ও পুষ্ট বাঁশ উৎপাদন করে ভালো বাজার মূল্য পাওয়া যায়। পরিচর্যার ফলে ঝাড় থেকে বেশি সংখ্যক বাঁশ পাওয়া সম্ভব। এতে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়ও বাড়ানো সম্ভব।

বাঁশের ঝাড় পরিষ্কারকরণ:

বাঁশঝাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত। ময়লা-আবর্জনা, পাতা, খড়কুটো, পচা বা রোগাক্রান্ত বাঁশ, কঞ্চি, কোঁড়ল ঝাড় থেকে নিয়মিতভাবে অপসারণ করতে হবে। চারা, কঞ্চি, মুথা বা অফসেট মাটিতে লাগানোর পর প্রথম ১ -২ বছর চিকন ও সরু বাঁশ গজায়, যা মরে গিয়ে ঝাড়ে গাদাগাদি করে থাকে। গাদাগাদি করে থাকা চিকন ও মরা বাঁশ অপসারণ করে ফেলতে হবে। প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হালকা নিয়ন্ত্রিত আগুন  দিয়ে ঝাড় এলাকার আবর্জনা ও শুকনো পাতা পুড়িয়ে দিতে হবে। এতে ঝাড়ে অনুকূল স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হবে যা প্রচুর নতুন কোঁড়ল মাটি থেকে বের হয়ে স্বাস্থ্যবান ঝাড় সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।

বাঁশের ঝাড়ে নতুন মাটি প্রয়োগ:

সাধারণত প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখ মাসে বাঁশের কোঁড়ল গজায়। তাই প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ঝাড়ের গোঁড়ায় নতুন মাটি দেওয়া উচিত। এতে কোঁড়ল দ্রুত বেড়ে উঠবে ও সুস্থ বাঁশ পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত বা পুরাতন ঝাড়ের মাটি কখনও ব্যবহার করা যাবে না। এতে সুস্থ বাঁশ ঝাড়ে রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা থাকে।

বাঁশে সার প্রয়োগ:

মাঝারি আকারের ঝাড়ের গোঁড়ায় প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ১০০-১২৫ গ্রাম ইউরিয়া, সমপরিমাণ ফসফেট  ও ৫০-৬৫ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। ঝাড়ের চারিদিকে মাটিতে ১৮ ইঞ্চি চওড়া ও ২৪ ইঞ্চি গভীর নালা কেটে সেই নালায় সার প্রয়োগের পর নালাটি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর বৃষ্টি না হলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে।

বাঁশে পানি সেচ:

খরা মৌসুমে চারা গাছ সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধি পায় না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মারাও যায়। তাই প্রথম কয়েক বছর নতুন ঝাড়ে পরিমিত পানি সেচ দেওয়া প্রয়োজন। এক সপ্তাহে পর পর এক বা দুই কলস পানি  বাঁশের চারার গোঁড়ায় ঢেলে দিয়ে ছন বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

বাঁশ পাতলাকরণ:

বাঁশের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট জায়গা প্রয়োজন। অতিরিক্ত কঞ্চি বা পচা ও আঘাতপ্রাপ্ত বাঁশ নিয়মিত কাটা উচিত। ঝাড় থেকে বাঁশ এমনভাবে কাটতে হবে যেন একটি থেকে অন্যটি ৬-১০ ইঞ্চি দূরে থাকে।

আগাছা, মরা/ পচা বাঁশ ও পুরনো মোথা অপসারণ:

আগাছাপূর্ণ স্থানে ঝাড় থেকে নতুন বাঁশ সহজে গজাতে পারে না অথবা সরু ও দুর্বল বাঁশ গজায়। কোন কোন সময় আগাছার চাপে চারা বাঁশ মারা যায়। তাই নতুন বাঁশঝাড় আগাছা মুক্ত রাখা উচিত। এছাড়া মাথাপচা রোগে আক্রান্ত মরা ও পচা বাঁশ ঝাড় থেকে সরিয়ে পুড়িয়ে ফেলা উচিত। আবার পুরাতন পরিত্যক্ত মোথা থেকে প্রকৃতপক্ষে কোন কোঁড়ল বের হয় না বরং জায়গা নষ্ট করে বাধা সৃষ্টি করে। তাই বয়স্ক বাঁশঝাড়ের পুরাতন মোথা সাবল দিয়ে কেটে অপসারণ করলে বাঁশঝাড় আবার অনেকটা নতুন জীবন লাভ করে।

বাঁশ আহরণ:

বাঁশের কোঁড়ল বের হওয়ার পর ৩ মাসের মধ্যে একটি বাঁশ পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং এরপর আর বাড়ে না। বর্ষায় যে কোঁড়ল বের হয় তা আশ্বিন-কার্তিক মাসের মধ্যে পূর্ণ উচ্চতা প্রাপ্ত হয়। ঝাড়ের ফলন ও স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করলে একটি বাড়িতে কমপক্ষে তিনটি বাঁশঝাড় লাগাতে হবে। একটি বাঁশ পাকতে তিন বছর সময় লাগে। প্রতি বছরই বাঁশ ঝাড় থেকে পাকা বাঁশ আহরণ করতে হবে। তাহলে গুনগত দিক দিয়েও ভালো বাঁশ পাওয়া যাবে।

ঝাড় থেকে বাঁশ কাটা ও টেনে বের করার সময় যে সব বিষয়ে যত্নবান হওয়া উচিত তা হলো:-

বাঁশে কঞ্চি বেশি থাকলে, গোঁড়ার দিকের কঞ্চিগুলো আগে কেটে ফেলতে হবে। এতে ঝাড় থেকে কাটা বাঁশ টেনে বের করা সহজ হবে। কাজ শেষে কাটা কঞ্চি ও ডালপালা পরিষ্কার করে দিতে হবে।

কোনও নির্দিষ্ট ঝাড় থেকে বয়স্ক বাঁশের ৩ ভাগের ২ ভাগ বাঁশ কাটতে হবে। অর্থাৎ একটি ঝাড়ে ১০টি বয়স্ক বাঁশ থাকলে ৫-৬টি কাটা যাবে। এমনভাবে বাঁশ সংগ্রহ করুন যেন থেকে যাওয়া বয়স্ক বাঁশ পুরো ঝাড়ে ছড়িয়ে থেকে ঝাড়টিকে ঝড়-বাদলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

প্রতিটি বাঁশ গোঁড়া থেকে কাটতে হবে। মাটির কাছাকাছি গিটের ঠিক ওপরে তেরছা করে কেটে বাঁশটিকে গোঁড়া থেকে আলাদা করতে হবে। এতে বাঁশের অপচয় হয় না। এ ছাড়া ফেলে আসা গোঁড়ার অবশিষ্টাংশে বৃষ্টির পানি জমে পোকা-মাকড় বা ছত্রাকের আবাসস্থলে পরিণত হওয়ার সুযোগ থাকে না।

বাঁশ গজানোর মৌসুমে (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস) কখনও বাঁশ কাটা উচিত নয়। এতে কাটার সময় সদ্যজাত বাঁশের কোঁড়ল ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বাঁশ কাটার উপযুক্ত সময়। এ সময় বাঁশে সঞ্চিত খাদ্যের অর্থাৎ শর্করা জাতীয় পদার্থের পরিমাণ কম থাকে বলে কাটা বাঁশে ঘুণে ধরার সম্ভাবনা কম থাকে।

যে বছর ঝাড়ে ফুল ও বীজ হয় সে বছর ঝাড়ের বাঁশ কাটা উচিত নয়। বাঁশ ফুল হলে ঝাড়ের সব বাঁশ মরে যায়। পাকা বীজ থেকে বাঁশের চারা তৈরি করে নতুন বাঁশ বাগান করা সম্ভব। তাই বীজ সংগ্রহের পরে বাঁশ কেটে ফেলা যেতে পারে।

মূলী বাঁশের ফল/ বীজ সংগ্রহ: মূলী বাঁশ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক বনজ সম্পদ। প্রাকৃতিক নিয়মে মূলী বাঁশে ৪০-৫০ বছর পর পর ফুল আসে। মূলী বাঁশের ফুল ও ফল ধরা ব্যাপক এলাকা জুড়ে ৪-৫ বছর স্থায়ী হয়। ১-২ বছর ব্যাপক হারে ফল হয়। ব্যাপক হারে ফুল ও ফল হওয়ার পর মূলী বাঁশের ঝাড় সম্পূর্ণ মরে যায়। মূলী বাঁশের ফলটিই বীজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

ফল/বীজের আকৃতি: মূলীর ফল/বীজ দেখতে অনেকটা বড় আকারের পিয়াজের মতো, উপরের দিক একটু চিকন ও লম্বা। পরিপক্ব বীজ শক্ত এবং সাধারণত হালকা বাদামি রঙের হয়। ফুল আসার বছর সমূহে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মূলী বাঁশে ফুল আসে। মে-জুন মাসে মূলী বাঁশের ফুল পরিপক্ব হয়। ফল পাকলে বাঁশটিকে হালকাভাবে নাড়া দিলে পরিপক্ব ফল মাটিতে পড়বে। ঝরে পড়া পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে। পরিপক্ব বীজ/ফল এর আয়ুষ্কাল মাত্র ১-২ সপ্তাহ। সংগৃহীত ফল/বীজ সরাসরি মাঠে রোপণ করতে হবে।

বাঁশ রোপণ পদ্ধতি:

৪-৫ ফুট দূরত্বে দাঁ বা কোদাল দিয়ে মাটিতে ৪ x ৬ ইঞ্চি মাপের গর্ত করতে হবে। ফলটি আড়াআড়িভাবে গর্তে রোপণ করে সামান্য মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

বাঁশ কোথায় রোপণ করতে হবে:

পাহাড়ি ঢাল ও উপরিভাগে মূলীর বীজ রোপণ করতে হবে। বসতবাড়ির আশে-পাশে একটু উঁচু জায়গায় এবং ছড়ার পাড়ে মূলী বাঁশের বীজ লাগাতে হবে। বর্ষার পানিতে ডুবে যায় এমন জায়গায় মূলীর বীজ রোপণ করতে হবে। অনুকূল পরিবেশে ৫-১০ দিনের মধ্যে বীজ থেকে চারা গজায়।

বাঁশের বীজতলার পরিচর্যা:

বীজ রোপণের পর বৃষ্টি না হলে হালকা পানি দেওয়ার ব্যবস্থা। প্রয়োজনে রোপিত স্থানটি ঘেরার ব্যবস্থা করতে হবে।

বাঁশের চারার পরিচর্যা:

মাঠে রোপিত বীজ ও কচি চারা ইঁদুর ও সজারু থেকে রক্ষা করতে হবে। কচি চারাকে গরু-ছাগল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। কোন জায়গায় চারা মরে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে পুনরায় চারা রোপণ করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ ঝাড়ে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি বছর বাঁশ ঝাড়ের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। বীজ থেকে গজানো একটি চারা ৪-৫ বছরে একটি পূর্ণ ঝাড়ে পরিণত হয়ে থাকে।

বাঁশের মড়ক দমন ব্যবস্থা:

বাঁশের ঝাড়ে বাঁশের আগা মরা রোগ: এ রোগের জন্য দায়ী এক ধরনের ছত্রাক যা মাটিতে বাস করে। সাধারণত বরাক বা বড় বাঁশ, মাকলা বাঁশ, তল্লা বাঁশ এবং বাইজ্যা বাঁশ ঝাড়ে এ রোগ মড়ক আকারে দেখা যায়।

বাঁশের রোগের লক্ষণ:

প্রাথমিক অবস্থায় নতুন কোঁড়ল আক্রান্ত হলে কোঁড়লের আগা বাদামি-ধূসর রঙের হয়ে সব খোলস ঝড়ে পড়ে। এক সময় আগা পচে ধীরে ধীরে বাঁশটি শুকিয়ে যায়। কম বয়সি বাড়ন্ত বাঁশ আক্রান্ত হলে এর মাথায় বাদামি-ধূসর রঙের দাগ দেখা যায় এবং আক্রান্ত বাঁশের সকল খোলসপত্র ঝড়ে পড়ে। এক সময় আগা পচে ভেঙে পড়ে বা ঝুলে থাকে।

আক্রান্ত অংশের নিচের গিট থেকে অসংখ্য কঞ্চি বের হয়। পরবর্তীতে রোগ নিচের দিকে আগাতে থাকে এবং এক সময় পুরো বাঁশটি নষ্ট হয়ে যায়।

বয়স্ক বাঁশে এ রোগ দেখা দিলে আগা পচে যায়, ফলে বাঁশের মাথা ভেঙ্গে পড়ে। দূর থেকে এ ধরনের ঝাড়কে মাথাশূন্য ও আগুনে ঝলসানো বাঁশ ঝাড় বলে মনে হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পুরো বাঁশঝাড়ই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

বাঁশের রোগের বিস্তার:

রোগাক্রান্ত মুথা বা রোগাক্রান্ত বাঁশের কঞ্চিকলমের চারা ব্যবহার করলে; আক্রান্ত বাঁশ ঝাড়ের মাটি ব্যবহার করলে; ঝাড়ের গোঁড়ায় নতুন মাটি না দিলে; গোঁড়ায় জমে থাকা পাতা ও আবর্জনা সরিয়ে না ফেললে; বাঁশ ঝাড়ে কীট-পতঙ্গ (বিশেষ করে পিঁপড়া) বেশি থাকলে এই রোগ দ্রুত ছড়ায়।

বাঁশের রোগ প্রতিরোধ:

সকল আক্রান্ত বাঁশ ঝাড় থেকে কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বাঁশ গজানোর আগে গোঁড়ায় জমে থাকা কঞ্চি, আবর্জনা, শুকনো পাতা, আক্রান্ত বাঁশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। (আগুন দেওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে আশপাশের বাড়ি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়)। প্রতি বছর নতুন বাঁশ গজানোর পূর্বে চৈত্র-বৈশাখ মাসে বাঁশ ঝাড়ের গোঁড়ায় নতুন মাটি দিতে হবে। পুরানো বাঁশ ঝাড়ের মাটি ব্যবহার না করে পুকুরের তলার মাটি অথবা দূরের পলিযুক্ত মাটি ব্যবহার করতে হবে। ২০ গ্রাম ডায়থেন/ইণ্ডোফিল এম-৪৫ প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে ঝাড়ের গোঁড়ার মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। ৩-৪ হাত লম্বা হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায়ই ওষুধ স্প্রে করে নতুন কোঁড়লগুলো ভিজিয়ে দিতে হবে।

 

ধনিয়া চাষের সরল ও সঠিক পদ্ধতি

ধনিয়া চাষের সরল ও সঠিক পদ্ধতি , ধনিয়া সাধারণত মসলা জাতীয় ফসল। বাসা বাড়িতে এটি রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর ফলের জন্য চাষ করা হলেও এর পাতা ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাবারের স্বাদ বাড়াতে ধনিয়া পাতার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এর সবুজ পাতা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। ধনিয়া পাতা চাটনি, স্যুপ, ভর্তা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ধনিয়া চাষের সরল ও সঠিক পদ্ধতি

আজ আমরা আপনাদের সাথে ধনিয়া চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই ধনিয়া চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন। চলুন দেখে নিন ধনিয়া চাষের বিস্তারিত:-

মাটি ও জলবায়ু

সাধারণত সব ধরনের মাটিতেই ধনিয়া চাষ হয়ে থাকে। তবে ধনিয়া চাষের জন্য বেলে দোআঁশ বা এটেল দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। জমিতে প্রয়োজনীয় জল নিকাশেন ব্যবস্থা রাখতে হবে।

বীজ বপনের সময়

ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ধনিয়া বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।

বীজ বপনের সময়

ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ধনিয়া বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।

জমি তৈরি

উন্নত ফলন পেতে হলে জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। জমিতে মাটির প্রকৃতি অনুযায়ী ৪-৬টি চাষ ও মই দিতে হবে।

বীজের হার

সাধারণত এক হেক্টর জমিতে ৮ কেজি ধনিয়ার বীজের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

বীজ বপন

বীজ বপন করার আগে বীজকে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। বীজ যদি ছিটিয়ে বপন করা হয় তাহলে পরিমাণ বেশি লাগে। যদি ধনিয়া মিশ্র ফসল হিসেবে জমিতে বপন করা হয় তাহলে ৪-৫ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়ে থাকে।

বীজ বপনের পদ্ধতি

বীজ বপন করার আগে জমিতে বেড তৈরি করে নিতে হবে। বেডের মাঝখানে নালা তৈরি করতে হবে। নালার আকার হবে ৪০-৫০ সেমি। জমি তৈরি করার সময় মাটির সাথে জৈব পদার্থ মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপন করার আগে ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে তাহলে বীজ দ্বারা বাহিত রোগ থেকে চারা কে রক্ষা করা যাবে। বীজ দুইভাবে বপন করা যায়।

ছিটিয়ে ও বপন করা যায় আবার লাইনে ও বীজ বপন করা যায়। ছিটিয়ে বীজ বপন করার পর জমিতে হালকা মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। লাইন করে বীজ বোনার ক্ষেত্রে জমিতে লাইন করতে হবে। এক লাইন থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব হবে ৩০ সেমি। লাইনের গভীরতা হবে ১.৫ সেমি। বীজ বপন করার পর মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। চারা গজানোর পর ১০-১৫ দিন পরে একটি করে চারা গাছ রেখে বাকি সব চারা তুলে ফেলতে হবে।

সার প্রয়োগ

উন্নত ফলন পেতে হলে জমিতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে মাটিতে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সারের পাশাপাশি মাটিতে অন্যান্য সার ও প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে গোবর ৮-১০ টন, ইউরিয়া ২৮০-৩১০ কেজি, টিএসপি ১১০-১৩০ কেজি, এমপি ৯০-১১০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি আবর্জনা পচা সার ও ব্যবহার করা যেতে পারে।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি

জমি তৈরি করার সময় জমিতে অর্ধেক পরিমাণ গোবর সার, সম্পূর্ণ টিএসপি ও অর্ধেক এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক সার চারা রোপণ করার ৭ দিন পর মাদায় মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর চারা রোপণ করতে হবে। ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক এমপি সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণ করার ৮-১০ দিন পর প্রথম কিস্তি দিতে হবে এবং চারা লাগানোর ৩০-৫০ দিন পর বাকি সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগ করার পর প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।

সেচ ব্যবস্থা

জমিতে প্রয়োজনীয় সেচ প্রয়োগ করতে হবে। শুকনো মৌসুমে জমিতে সেচ দিতে হবে। তবে জমিতে যেন জল জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে নালা তৈরি করে দিতে হবে যেন অতিরিক্ত জল বের হয়ে যায়।

অন্যান্যা পরিচর্যা

ধনিয়া যদি পাতার জন্য চাষ করা হয়ে থাকে তাহলে জমিতে গাছ পাতলা করে দিতে হবে। চারা বড় হওয়ার ১০-১৫ দিন পর একটি সারিতে ৫ সেমি পর পর একটি করে চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হবে। আর যদি বীজের জন্য চাষ করা হয়ে থাকে তাহলে এক লাইনে ১০ সেমি পর পর চারা রাখতে হবে। গাছের গোড়া সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

জমিতে আগাছা জমে থাকলে তা নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রতিবার সেচ দেওয়ার পর জমিতে জো থাকা অবস্থায় মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে।

রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা

জমিতে রোগ ও পোকা আক্রমণ করলে প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক ও বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ

ধনিয়া যদি পাতা ফসল সংগ্রহ করা হয় তাহলে চারা রোপন করার ৩০-৩৫ দিনের মধ্যেই সংগ্রহ করা যাবে। আর যদি বীজের জন্য রোপণ করা হয়ে থাকে তাহলে ১১০-১২০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যাবে। গাছ যখন সম্পূর্ণভাবে পাকে এবং গাছ সবুজ থাকে তখন বীজ সংগ্রহ করা যায়।

ফলন

সঠিকভাবে চাষ করতে পারলে এক শতক জমি থেকে ১৫-২০ কেজি পাতা পাওয়া যায়। আর যদি বীজ সংগ্রহ করা হয় তাহলে ৮-১০ কেজি বীজ পাওয়া যায়।

 

ধান চাষ সম্পর্কিত সকল তথ্য

ধান চাষ পদ্ধতির বিস্তারিত নিয়ে তথ্য সূত্র অপেক্ষাকৃত কম। তথ্যগুলো নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাঠককে একাধিক সাইটে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে মেলাতে হয়। তাই আমরা চেষ্টা করেছি ধান চাষ সম্পর্কিত সকল তথ্য একটি জায়গায় নিয়ে আসতে। আশা করি আপনাদের সাহায্য করবে।

ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। তাই এর সাথে দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত । ঘন বসতিপূর্ণ এ দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে, অপরদিকে বাড়িঘর, কলকারখানা, হাট-বাজার, সড়ক-জনপথ স্থাপন এবং নদী ভাঙন ইত্যাদি কারণে আবাদি জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। তদুপরি রয়েছে খরা, বন্যা, জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, শৈত্য প্রবাহ ও শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে বেশি ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য ।

 

ধান চাষ

 

ধান চাষ

বাংলাদেশ পৃথিবীর ধান উৎপাদনকারী দেশ গুলোর মধ্যে চতুর্থ হলেও এখানকার হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৪.২ টন। চীন, জাপান ও কোরিয়ায় এ ফলন হেক্টর প্রতি ৬-৬.৫ টন। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে ধানের ফলন বাড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সনাতন জাতের ধান এবং মান্ধাতার আমলের আবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। এজন্য প্রয়োজন উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন।

বাংলাদেশে ১৯৬৮ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) থেকে প্রথম উফশী জাতের ধান (আইআর ৮) মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদ শুরু হয়। খাটো আকৃতির এ উফশী ধান থেকে প্রতি হেক্টরে ৫-৬ টন (বিঘাপ্রতি ১৮-২১ মণ) ফলন পাওয়া যায়। তখন থেকে উফশী ধান লোকমুখে ইরি ধান নামে পরিচিতি লাভ করে । বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৌসুম ও পরিবেশ উপযোগী উফশী ধানের জাত এবং ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ফসল, মাটি, পানি, সার ইত্যাদি বিষয়ক কলা-কৌশল উদ্ভাবন করছে।

বর্তমানে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাত দেশের মোট ধানি জমির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগে চাষাবাদ করা হচ্ছে এবং এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯০ ভাগ । ব্রি ধান এভাবে ইরি ধানের ̄স্থলাভিষিক্ত হয়েছে । আমাদের সৃষ্ট ওয়েব সাইটে ধানের উন্নত জাত ও এদের উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে তথ্য দেয়া আছে । আমরা আশা করি এসব তথ্য প্রয়োগ করে ব্যবহারকারীগণ উপকৃত হবেন।

 

 

বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ধানের চাষ করা হয়। এর মধ্যে ধানের জমি শতকরা ১১ ভাগ আউশ, ৪৮ ভাগ আমন ও ৪১ ভাগ বোরো ধান চাষ করা হয়। কিন্তু উৎপাদনের দিক থেকে বোরো শতকরা ৪৮ ভাগ, আমন ৪২ ভাগ ও আউশ ১০ ভাগ। বোরো মৌসুমে ধান চাষ হয় সবচেয়ে বেশি এবং আউশে সবচেয়ে কম। তিন মৌসুমে ধান চাষ প্রায় একই রকম। জমি নিবার্চন আউশ ধান চাষের জন্য উঁচু, মাঝারি উঁচু ও নিচু জমি উপযোগী। মাটির বুনট পলি দোঁআশ, পলি এঁটেল ও এেঁটল হলে ভালো।

মাঝারি উঁচু ও নিচু জমিতে রোপা আমন চাষ করা যায়। তবে সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে উঁচু জমিতেও রোপা আমন ধান চাষ করা যায়। দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ ও এঁটেল মাটি আমন ধান চাষের জন্য উপযোগী। ভারী বুননের মাটি যার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং যে মাটি অর্ধ—জলাবস্থায় উপযোগী তা বোরো ধান চাষের জন্য উত্তম। মাটিতে ৪০৬০% কর্দম কনা থাকলে ভাল হয়। সেচের ব্যবস্থা থাকলে উঁচু, মাঝারি উঁচু এবং নিচু যে কোন জমিতেই বোরো ধান চাষ করা যায়। মাটির অম্লমান ৫.০ হতে ৬.০ হলে ভাল।

 

মৌসুম অনুযায়ী ধানের চাষ:

চাষাবাদের মৌসুম অনুযায়ী ধানের চাষ তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন :

১. আউশ ধান (Aus rice): খরিপ ১ মৌসুমে এ ধান মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত চাষ করা হয়।

২. আমন ধান (Aman rice): খরিপ ২ মৌসুমে জুন থেকে ডিসেম্বর মাসে পর্যন্ত চাষ করা হয়।

৩. বোরো ধান (Boro rice): রবি মৌসুমে নভেম্বর থেকে মে মাসে এ ধান চাষ করা হয়।

বাংলাদেশের মোট ধানী জমির শতকরা প্রায় ১১ ভাগ জমিতে আউশ, ৪১ ভাগ জমিতে বোরো ও ৪৮ ভাগ জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। উৎপাদন হয় বোরোতে শতকরা প্রায় ৪৮ ভাগ, আমান ৪২ ভাগ ও আউশে ১০ ভাগ। বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদনশীলতা বেশি।

জলবায়ু ব্যাপক ও বি¯তৃত জলবায়ুতে ধান চাষ করা যায়। ধান চাষের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ২০—৩৫ক্কসে. ডিগ্রি। এর মধ্যে বীজ অংকুরোদগমের জন্য ৩০—৩৫ক্ক সেন্টিগ্রেড। অঙ্গজ বৃদ্ধির জন্য ২৫—৩১ক্কসে. পুস্পায়নের জন্য ৩০—৩৩ক্কসে. এবং পরিপক্কতার জন্য ২০—২৯ক্ক তাপমাত্রা উপযোগী। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭৫—৯৫%।

মাঝারি বৃষ্টিপাত ও উজ্জ্বল সূর্যালোক ধান চাষের জন্য প্রয়োজন। বৃষ্টিপাত কম হলে সেচের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ করতে হয়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৪০% এর কম ও ৯৫% এর বেশি হলে পুস্পায়ন ব্যহত হয়। মাটি ও ভূমি বন্ধুরতা ভারী বুনটের মাটি যার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং যে মাটি অর্ধজলাবস্থার উপযোগী তা ধান চাষের জন্য ভালো। তবে দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিও ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। মাটিতে ৪০—৬০% কর্দম কনা থাকলে ভালো হয়। সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থা থাকলে যে কোন মাটিতেই ধান চাষ করা যায়। উঁচু, মাঝারি উঁচু ও নিচু সব ধরনের জমিতেই ধান চাষ করা যায়। তবে মাঝারি উঁচু জমি উত্তম। মাটির অম্লমান ৫.০—৬.০ উত্তম।

 

ধান চাষের জন্য জমি নির্বাচন:

ধানের ফলন সব ধরনের জমিতে ভাল হয় না । মাঝারি নিচু ও নিচু জমিতে ধানের ফলন সবচেয়ে ভাল হয়। মাঝারি উঁচু জমিতেও ধান চাষ করা হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে পানি সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। এঁটেল ও পলি দো-আঁশ মাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী।

 

ধানের জাত নির্বাচন:

কৃষি পরিবেশিক অবস্থা এবং রোপনের সময়ের উপর ভিত্তি করে ধানের জাত নিবার্চন করতে হয়। রোপা আউশ ধান চাষের জন্য বিআর ২৬ (শ্রাবনী) ও ব্রিধান ৪৮ এবং অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে ব্রিধান ২৭ নিবার্চন করতে হয়। বোনা আউশ ধান বৃষ্টিবহুল এলাকার জন্য বিআর ২১ (নিয়ামত), বিআর ২৪ (রহমত) ও ব্রিধান ২৭ এবং খরাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রিধান ৪২ এবং ব্রিধান ৪৩ নিবার্চন করতে হয়। নিচু জমির জন্য জলমগ্নতা সহনশীল জাত যেমন ব্রিধান ৫১, ব্রিধান ৫২, বৃষ্টি নির্ভর রোপা আমনের জন্য খরাসহিষ্ণু জাত যেমন ব্রিধান ৫৫; নাবী আমনের জন্য বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রিধান ৪৬; লবনাক্ততা সহনশীল জাত ব্রিধান ৪০, ব্রিধান ৪১, ব্রিধান ৫৩, ব্রিধান ৫৫; সুগন্ধি চালের জন্য বিআর ৫, ব্রিধান ৩৪, ব্রিধান ৫০ ইত্যাদি।

আগাম বোরো ধানের জাত শীতসহিষ্ণু হলে ভালো যেমন ব্রিধান ৩৬; হাওড় অঞ্চলের জন্য বিআর ১৭, বিআর ১৮, বিআর ১৯ ভালো; লবনাক্ততা সহিষ্ণুজাত যেমন ব্রি—ধান ৫৫, ব্রিধান ৬১, ব্রিধান ৬৭, বিনাধান ৮, বিনাধান ১০, বিনাধান ১১, বিনাধান ১২, বিনাধান ১৩, বিনাধান ১৪ ও বিনাধান ১৫। এছাড়া বিশেষ পুষ্টিগুন সম্পন্ন জাত যেমন জিংক সমৃদ্ধ জাত ব্রিধান ৬২, ব্রিধান ৬৩, উচ্চমাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ জাত ব্রিধান ৬৬।

বাংলাদেশে তিন জাতের ধান আছে।

১। স্থানীয় জাত : টেপি, গিরবি, দুধসর, বতিশাইল ইত্যাদি।

২। স্থানীয় উন্নত জাত : হবিগঞ্জ, কটকতারা, পাজাম, কালিজিরা, হাসিকলমি, নাইজার শাইল, লতিশাইল, বিনাশাইল ইত্যাদি।

৩। উচ্চ ফলনশীল জাত : মুক্তা, ময়না, শাহজালাল, মঙ্গল, নিজামী ইত্যাদি।

 

ধানের স্থানীয় জাতের বৈশিষ্ট্য :

১. এ জাত সাধারণত নির্দিষ্ট এলাকায় চাষ করা হয়।

২. ধান গাছ লম্বা হয় তাই হেলে পড়ে।

৩. পাতা লম্বাটে, হেলে পড়ে।

৪. কান্ড নরম এবং কুশির সংখ্যা কম।

৫. রোগ ও পোকা মাকড় আক্রমনের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।

৬. এ জাতের ফলন কম, হেক্টর প্রতি ১.৫—২.৫ টন।

৭. জীবনকাল বেশি।

৮. মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করার ক্ষমতা কম।

 

স্থানীয় জাতের উদাহরণ:

আউশ মৌসুমে : কটকতারা, হাসিকলমি, ধারিয়াল
আমন মৌসুমে : হরিনমুদা, লাল মোটা, সাদা মোটা, কালিজিরা
বোরো মৌসুমে : দুধসর, বাজাইল, হবিগঞ্জ ইত্যাদি

 

ধানের উচ্চ ফলনশীল জাতের বৈশিষ্ট্য:

নিচে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধানের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো :

১। ধান গাছ খাটো ও শক্ত হয় এবং সহজে হেলে পড়ে না।

২। ধান গাছের পাতা ঘন সবুজ ও পুরু থাকে।

৩। পাতাগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে যে একটি অন্যটিকে ঢেকে রাখে না। এতে আলো-বাতাস প্রতিটি পাতা সমানভাবে পায় এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য বেশি তৈরি হয়।

৪। গাছ মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে।

৫। জমি থেকে উৎপাদিত ধানের ওজন ও খড়ের ওজন প্রায় সমান হয় অর্থাৎ ১৪১

৬। পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ কম হয়।

৭। পাকার সময়ও কিছু কিছু ধান সবুজ থাকে।

 

বাংলাদেশে মোট ৮১টি উফশী জাত রয়েছে যার মধ্যে ৭৫টি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট এবং ১৬টি বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে। নিচের তালিকাতে এর জাতগুলির নাম, জন্মানোর মৌসুম, গড় জীবনকাল, গড় ফলন এবং চালের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:

 

 

 

 

ধানের বীজ বাছাই ও চারা তৈরি:

দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশাতে হবে। এবার ১০ কেজি বীজ ঐ পানিতে দিয়ে নাড়তে হবে। পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে। আর অপুষ্ট ও হালকা বীজ পানির ওপরে ভেসে উঠবে। হাত অথবা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। ভারী বীজ নিচ থেকে তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। ইউরিয়া মিশানো পানি সার হিসেবে বীজতলায় ব্যবহার করা যেতে পারে।

দোআঁশ ও এেঁটল মাটি যেখানে প্রচুর আলো বাতাস আছে এমন জমি বীজতলার জন্য উপযোগী। বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। তবে অনুর্বর জমি হলে প্রতি বর্গমিটার ২ কেজি হারে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এর পর জমিতে ৫৬ সে.মি. পানি দিয়ে দু—তিনটি চাষ ও মই দিয়ে ৭—১০ দিন পানি বদ্ধ অবস্থায় রেখে দিতে হবে। জমিতে ব্যবহৃত জৈব সার পচে গেলে পুনরায় চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। একটি আদর্শ বীজতলায় ৪টি বেড থাকবে। প্রতিটি জমির দৈর্ঘ্য বরাবর এক মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে এবং দু—বেডের মাঝে ২৫—৩০ সে.মি. ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে।

বেডের উপরের মাটি কাঠ বা বাঁশ দিয়ে সমান করে নিতে হয়। বেডের মধ্যবতীর্ নালা সেচ ও নিস্কাশন এবং চারার পরিচযার্র জন্য ব্যবহৃত হয়।

 

 

ধানের বীজের পরিমাণ:

চারা তৈরির জন্য প্রতি কাঠা বীজতলায় ২.৫-৩.০ কেজি বীজ বুনতে হয়। এক কাঠা বীজতলার চারা দিয়ে ২০ কাঠা জমিতে ধানের চারা রোপণ করা যায়।

 

ধানের বীজ শোধন:

ধানের বীজে যাতে রোগজীবাণু না থাকে সেজন্য ওষুধ দ্বারা শোধন করে নিতে হয়। প্রতি কেজি ধান বীজ ৩০ গ্রাম এগ্লোসান জি এন বা ২০ গ্রাম এপ্রোসান এম ৪ ওষুধ দ্বারা শোধন করতে হয়।

 

 

বিভিন্ন ধানের বীজ

 

 

ধানের বীজ বাছাইয়ের জন্য করণীয়:

  • দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশাতে হবে।
  • এবার ১০ কেজি বীজ ঐ পানিতে দিয়ে নাড়তে হবে।
  • পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে এবং অপুষ্ট ও হালকা বীজ পানির উপরে ভেসে উঠবে।
  • হাত অথবা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
  • ভারী বীজ নিচ থেকে তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। ইউরিয়া মিশানো পানি সার হিসাবে বীজতলায় ব্যবহার করা যেতে পারে।

 

ধানের বীজতলার ধরণ:

দো-আঁশ ও এটেল মাটি বীজতলার জন্য ভাল। জমি অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি হারে জৈব সার মেশানো যেতে পারে। এরপর জমিতে ৫-৬ সেমি পানি দিয়ে ২/৩টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে। আগাছা ও খড় ইত্যাদি পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১মি চওড়া বেড তৈরি করতে হবে।

দু’বেডের মাঝে ২৫-৩০ সেমি জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। নির্ধারিত জমির দু’পাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। এরপর ওপরের মাটি ভালভাবে সমান করে ৩/৪ ঘণ্টা পর বীজ বোনা উচিত।

মৌসুম ভেদে ধানের চারা উৎপাদনের জন্য চার ধরনের বীজতলা তৈরি করা যায়। যেমন:

১। শুকনা বীজতলা;

২। ভেজা বা কাদাময় বীজতলা

৩। ভাসমান বীজতলা:

৪। দাপোগ বীজতলা।

উঁচু ও দো-আঁশ মাটি সম্পন্ন জমিতে শুকনা বীজতলা এবং নিচু ও এঁটেল মাটি সম্পন্ন জমিতে। ভিজা বীজতলা তৈরি করা হয়। আর বন্যাকবলিত এলাকায় ভাসমান ও দাপোগ বীজতলা তৈরি করা হয়। প্রচুর আলো-বাতাস থাকে ও বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে ডুবে যাবে না এমন জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়।

 

শুকনা বীজতলা

 

 

এখানে শুকনা ও ভিজা বীজতলা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

শুকনা বীজতলা:

জমিতে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে ও সমান করতে হবে। মাটিতে অবশ্যই রস থাকতে হবে যাতে বীজ ভালোভাবে গজাতে পারে। প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। এর আগে জমি থেকে আগাছা বেছে ফেলতে হবে এবং পরিমাণ মতো পচা গোবর সার বা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে।

বীজতলায় রসায়নিক সার ব্যবহার না করাই উত্তম। হালকা বুনটের মাটি হলে ১১/২-২ টন জৈবসার দিলে ভালো হয়। বীজতলার মাপ- বীজতলার বেডের দৈর্ঘ্য বেডের গ্রন্থ।

= সুবিধামত লম্বা

= ১২৫ সে.মি

জমির আইল বা বেডের মাঝখানের দূরত্ব প্রতি দুই বেডের মাঝখানের দূরত্ব

২৫ সে.মি

৫০ সে. মি

এতে চারার পরিচর্যা ও অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে সুবিধা হয়। প্রতি দুই বেডের মাঝখানের মাটি তুলে নিয়ে বেডের উপর সমান করে দিতে হয়। এতে বেড উঁচু হয়। এরপর বীজ বেডের উপর সমানভাবে ছিটিয়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে নিতে হয়।

 

শুকনা ও ভিজা মাটিতে কর্ষণ ও বীজতলা তৈরি

 

 

ভেজা বা কাদাময় বীজতলা:

এক্ষেত্রে জমিতে পানি দিয়ে ২-৩ টি চাষ ও মই দেয়ার পর ৬-৭ দিন ফেলে রাখতে হয়।। এতে জমির আগাছা, খড়কুটা ইত্যাদি পড়ে গিয়ে সারে পরিণত হয়। এরপর আবার ২-৩ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি থকথকে কাদাময় করতে হয়। ভিজা বীজতলায় বীজ বাড়িতে গজিয়ে নিয়ে বুনা ভাল। এক্ষেত্রেও বীজতলার মাপ একনা বীজতলার মতোই।

 

শুকনা ও ভিজা মাটিতে কর্ষণ ও বীজতলা তৈরি

 

উর্বর দোআঁশ ও এেঁটল দোআঁশ মাটি এ বীজতলার জন্য উত্তম। জমিতে দাড়ানো পানি থাকলে ভাল তা না হলে সেচের মাধ্যমে ৫—৬ সে.মি. পানি দিয়ে ২—৩ বার চাষ ও মই দিয়ে এক সপ্তাহ পানিসহ রেখে দিতে হয়। এর ফলে আগাছা ও খড় পচে যাবে। এরপর আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদাময় বীজতলা তৈরি করতে হয়। শুকনো বীজতলার মতো করেই বেড তৈরি করতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বীজতলায় কাদা বেশি না হয়। কাদা বেশি হলে বীজ ডুবে যাবে এবং বীজ ভালভাবে গজাবে না। এ রকম অবস্থা হলে বেড তৈরির ৩—৪ ঘন্টা পর বীজ বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে জাগ দেয়া অংকুরিত বীজ বপন করতে হয়।

 

ভাসমান বীজতলা:

আমন মৌসুমে বিশেষ অবস্থার মোকাবেলার জন্য ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। বন্যাজনিত কারনে বীজতলা করার জায়গা পাওয়া না গেলে ভাসমান বীজতলায় চারা উৎপন্ন করা যায়। বন্যাকবলিত জমি, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির উপর বাঁশের মাচা বা কলাগাছের ভেলা তৈরি করে তার উপর ২—৩ সে.মি. উঁচু কাদার প্রলেপ দিয়ে কাদাময় বীজতলার মত ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যায়। এ বীজতলায় কাদাময় বীজতলার মতই অংকুরিত বীজ বুনতে হয়। বীজতলা যাতে বন্যার পানিতে ভেসে না যায় এজন্য এটি খুটির সাথে বেঁধে রাখতে হয়।

ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয় মূলত কচুরিপানাসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ভেলার ওপর মাটি দিয়ে। ধানের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার পর এই ভাসমান বীজতলায় ছিটিয়ে দিতে হয়। সেখানে জমিতে রোপণের উপযোগী চারা উৎপাদন হতে ২০ থেকে ২৫ দিন লাগে। পরে চারাগুলো জমিতে রোপণ করা হয়।

বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ একটি দেশ। প্রায় প্রতিবছরই এখানে বন্যা হয়। তখন বন্যার কারণে অনেক এলাকার বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া ঝড়, অতিবৃষ্টি এবং জোয়ারের পানিতেও বহু বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এতে করে যথাসময়ে ফসল উৎপাদনে বিলম্ব হয়। দেখা দেয় ফসলের ঘাটতি। ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক কৃষকেরা। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভাসমান বীজতলা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

১০ মিটারের একটি ভাসমান বীজতলায় এক কেজি অঙ্কুরিত বীজ ছিটানো সম্ভব। এ থেকে উৎপাদিত চারা এক বিঘা জমিতে রোপণ করা সম্ভব। পানির ওপর ভেসে থাকার কারণে এই বীজতলায় পানি সেচেরও দরকার হয় না। দেশের অনেক জেলায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করে ধানের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। এ বীজতলায় ধানের চারা উৎপাদন ছাড়াও পেঁপে, লাউ, কুমড়া, বেগুন, করলাসহ বিভিন্ন সবজির চারাও উৎপাদন সম্ভব। দেশের অনেক কৃষক ভাসমান বীজতলায় সবজির চারা উৎপাদন করে লাভবান হয়েছেন।

 

ভাসমান বীজতলা

 

ডাপোগ বা দাপোগ বীজতলা :

বন্যাকবলিত এলাকায় চারা উৎপাদনের আরেকটি কৌশল হলো ডাপোগ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পাকা অথবা কাঁচা বারান্দা, করিডোর, বাড়ির উঠান অথবা যে কোন শুকনো জায়গায় ডাপোগ বীজতলা তৈরি করা যায়। এ পদ্ধতিতে নিধার্রিত স্থানে চারিদিকে মাটি, ইট, কাঠ বা কলাগাছের বাকল দিয়ে ঘিরে নিতে হবে। তারপর কলাপাতা বা পলিথিন বিছিয়ে তার উপর ঘন করে অংকুরিত বীজ বপন করতে হয়। বীজে সঞ্চিত খাদ্যই চারার প্রাথমিক খাবার। তাই এই চারার বয়স ১৫—১৮ দিন হলেই রোপন করতে হয়। এ বীজতলায় মাটি থাকে না তাই ৫—৬ ঘন্টা পর পর পানি দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি পানি জমে না থাকে।

বাড়ির উঠান বা যে কোনো শুকনো জায়গায় অথবা কাদাময় সমতল জমিতে পলিথিন, কাঠ অথবা কলাগাছের বাকল দিয়ে তৈরি চৌকোনা ঘরের মতো করে তার মধ্যে অঙ্কুরিত বীজ ছড়িয়ে দিতে হয়। এ বীজতলায় মাটি থেকে চারাগাছ কোনোরূপ খাদ্য বা পানি গ্রহণ করতে পারে না বলে বীজতলায় প্রয়োজন মাফিক পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজতলায় প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ৩ কেজি অঙ্কুরিত বীজ দিতে হয়। এভাবে প্রস্তুতকৃত ২ থেকে ৩ বর্গমিটার দাপোগ বীজতলা থেকে উৎপাদিত চারা দিয়ে এক বিঘা জমি রোপণ করা যায়। দাপোগ বীজতলার প্রস্থ প্রায় ১.৫ মিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রয়োজনমতো নিতে হবে।

এভাবে করা বীজতলা থেকে ১৪ থেকে ১৫ দিন বয়সের চারা জমিতে রোপণ করতে হবে। চারার বয়স বাড়ার সাথে সাথে চারার গুণগতমান নষ্ট হতে থাকে। চারার বয়স কম থাকে বলে অনেক সময় চারার মৃত্যুহার কিছুটা বেশি থাকে। সেজন্য চারা রোপণের সময় প্রতি গোছায় ৪ থেকে ৫টি চারা দিলে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠা যায়। দাপোগের চারার উচ্চতা কম থাকে বলে জমিতে লাগানোর সময় এমন পরিমাণ পানি রাখতে হবে যাতে করে চারা পানির নিচে ডুবে না যায়। এক্ষেত্রে রোপিত চারার সব পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা অন্যসব চারার মতোই হবে। দাপোগ পদ্ধতিতে লাগানো চারা পরবর্তীতে অন্যান্য স্বাভাবিক চারার মতোই ফলন দেয়।

 

দাপোগ বীজতলা

 

ধানের বীজ শোধন ও জাগ দেওয়ার পদ্ধতি:

বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পরিপুষ্ট হলে সাধারণভাবে শোধন না করলেও চলে। তবে শোধনের জন্য ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবাণুমুক্ত হয়। বীজ যদি দাগমুক্ত হয় এবং বাকানি আক্রমণের আশঙ্কা থাকে তাহলে কারবেনডাজিম-জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করা যায়। ক্ষেতে ২-৩ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে ১ কেজি পরিমাণ বীজ পানিতে ডুবিয়ে নাড়াচাড়া করে ১২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর বীজ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে।

এভাবে শোধনকৃত বীজ বাঁশের টুকরি বা ড্রামে ২/৩ পরত শুকনো খর বিছিয়ে তার উপর বীজের ব্যাগ রাখুন এবং আরও ২/৩ পরত শুকনো খর দিয়ে ভালভাবে চেপে তার উপর ইট বা কোন ভারী জিনিস দিয়ে চাপ দিয়ে রাখুন। এভাবে জাগ দিলে আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘণ্টা, বোরো মৌসুমে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভাল বীজের অঙ্কুর বের হবে এবং বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হবে।

ধানের বীজ শোধন

 

আদর্শ বীজতলা তৈরির নিয়ম:

দো-আঁশ ও এটেল মাটি বীজতলার জন্য ভাল। জমি অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি হারে জৈব সার মেশানো যেতে পারে। এরপর জমিতে ৫-৬ সে.মি. পানি দিয়ে ২/৩টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে। আগাছা ও খড় ইত্যাদি পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১ মি. চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। দু’বেডের মাঝে ২৫-৩০ সে.মি. জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। নির্ধারিত জমির দু’পাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। এরপর ওপরের মাটি ভালভাবে সমান করে ৩/৪ ঘণ্টা পর বীজ বোনা উচিত।

 

বীজতলায় বীজ বপনের আদর্শ পদ্ধতি:

প্রতি বর্গমিটার বেডে ৮০-১০০ গ্রাম বীজ বোনা দরকার। বপনের সময় থেকে ৪/৫ দিন পাহারা দিয়ে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং নালা ভর্তি পানি রাখতে হবে।

বীজতলায় বীজ বপনের সময় রোপা পদ্ধতিতে আউশ ধান চাষের জন্য এপ্রিল মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। চারার বয়স ২০—২৫ দিন হলে মূল জমিতে রোপন করতে হয়। বোনা আউশ ধানের বীজ মধ্য মার্চ থেকে মে এর প্রথম সপ্তাহে জমিতে বপন করতে হয়। রোপা আউশ চাষের জন্য বীজতলায় মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজতলায় বীজ ফেলতে হয়। রোপা আমন ধান ১৫ই জুলাই হতে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত মুল জমিতে রোপন করা হয়। কাজেই রোপন সময়ের একমাস আগে বীজতলায় বীজ বুনতে হবে যেন রোপনের সময় চারার বয়স ২৫—৩০ দিন হয়।

বোরো ধানের ক্ষেত্রে নভেম্বর—ডিসেম্বর মাসে বীজতলায় বীজ ফেলতে হয় এবং চারার বয়স ৪০—৪৫ দিন হরে রোপন করতে হয়। বীজের পরিমান বীজের পরিমান নির্ভর করে বপন অথবা রোপন দূরত্ব, বীজের আকার ও আয়তন ইত্যাদির উপর। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সে.মি. হলে বীজ প্রয়োজন ৫০—৬০ কেজি/হেক্টর। ডিবলিং পদ্ধতিতে বপনের ক্ষেত্রে ২৫ সে.মি. দূরে দূরে সারি ও ২০ সে.মি. দূরে দূরে বীজ বপন করলে বীজের প্রয়োজন হয় ৩০—৩৫ কেজি/হেক্টর।

রোপা আউশের জন্য বীজতলায় চারা তৈরিতে বীজের প্রয়োজন ২০—৩০ কেজি/হেক্টর। বীজ বাছাই ভালো ফলনের জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে ভালো বীজ। বপনের জন্য সুস্থ ও পুষ্ট বীজ নিবার্চন করতে হবে। এজন্য দশ লিটার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে নিয়ে এ দ্রবনে ১০ কেজি বীজ ছেড়ে হাত দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দিয়ে পুষ্ট বীজ নীচে জমা হবে।

অপুষ্ট হাল্কা বীজ ভেসে উঠবে। ভারীগুলো ভালোভাবে পরিস্কার পানিতে ৩—৪ বার ধুয়ে নিতে হবে। বীজ শোধন ও জাগ দেওয়া বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পরিপুষ্ট হলে সাধারণভাবে শোধন না করলেও চলে। তবে শোধনের জন্য ৫২—৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবানুমুক্ত হয়। বীজ শোধনের জন্য ২—৩ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে এক কেজি পরিমান বীজ ডুবিয়ে ১২ ঘন্টা রেখে দিতে হয়।

এরপর বীজ পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হয়। আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘন্টা বা দুই দিন ও বোরো মৌসুমে ৭২ ঘন্টা বা তিন দিনের বীজের অংকুর বের হয় এবং তা বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হয়। বীজতলায় বীজ বপন শুকনো বীজতলার জন্য প্রতি বর্গমিটার ১৫০ গ্রাম শুকনো বীজ বুনতে হয়। বীজ ছিটিয়ে বোনার পর বীজগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ভেজা বীজতলায় প্রতি বর্গমিটার ৮০—১০০ গ্রাম হারে বীজ বপন করতে হয়। এক বর্গমিটার বীজতলার চারা দিয়ে ২০—৩০ বর্গমিটার রোপন করা যায়। তবে ডাপোগ বীজতলায় ঘন করে বীজ বুনতে হয় প্রতি বর্গমিটারে ২.৫৩.০ কেজি বীজ।

শুকনো বীজতলায় শুকনো বীজ বুনতে হয়। কিন্তু অন্যগুলিতে অংকুরিত বীজ বুনতে হয়। এজন্য বীজ জাগ দেয়ার প্রয়োজন হয়। ভেজা বীজতলায় বীজ বপনের পর ৪—৫ দিন পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হয়। বীজতলার পরিচযার্ বীজতলায় নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে এবং আগাছা দমন করতে হবে। চারা হলদে হলে প্রতি বর্গমিটার ৭ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পরও চারা সবুজ না হলে সালফারের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম হারে জিপসাম সার ছিটিয়ে দিতে হবে। এছাড়া বীজতলায় পোকামাকড় ও রোগবালাই এর উপদ্রব হলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

জমি তৈরিজমির জো অবস্থা থাকলে মার্চ—এপ্রিল মাসে আউশ ধানের বীজ বপন করা যায়। জমিতে প্রয়োজনমত পানি দিয়ে ২—৩টি চাষ ও মই দিয়ে জমি কাদাময় করতে হয়। আউশ ধানে আগাছার প্রকোপ বেশি হয় বলে প্রথম চাষের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচে যাবে। রোপা আউশের জন্য মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি বা সেচের পানির সহায়তায় কর্দমাক্ত করে জমি প্রস্তুত করতে হয়।

রোপা আমনের জন্য মধ্য জুন থেকে মধ্য আগস্ট এ সময়ের মধ্যে বৃষ্টি বা সেচের পানির সাহায্যে জমি প্রস্তুত করা হয়। বোরো ধানের জন্য মধ্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারী এ সময়ের মধ্যে সেচের পানির সাহায্যে থকথকে কর্দমাক্ত করে জমি তৈরি করতে হয়। জমি তৈরির সময় জমির উপরিভাগ ভালভাবে সমতল করতে হয় যাতে সেচের পানি সব জায়গায় পৌছে।

 

অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় ধানের বীজতলার যত্ন:

শৈত্য প্রবাহের সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে দিলে, বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিলে, প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিলে ধানের চারা ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়।

 

ধানের বীজতলার সাধারণ পরিচর্যা:

বীজতলায় সব সময় নালা ভর্তি পানি রাখা উচিত। বীজ গজানোর ৪-৫ দিন পর বেডের ওপর ২-৩ সে.মি. পানি রাখলে আগাছা ও পাখির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

 

চাৱা উঠানো ও সংরক্ষণ:

জাত ও মৌসুম ভেদে ২৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা ভালো। চারা তোলার পূর্বে বীজতলাতে পানি সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নেয়া ভালো। এতে চারা তুলতে সুবিধা হয়। চারা তোলার সময় যাতে গোড়া বা কাজ ভেজে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চারা তোলার পর তা ছোট ছোট আঁটি আকারে বেঁধে নিতে হয়।

বীজতলা থেকে চারা তোলার পর পর মূল জমিতে লাগানো সম্ভব না হলে চারার আঁটি ছায়ার মধ্যে ছিপছিপে পানিতে রেখে দিতে হয়।

 

ধানের চারা উঠানোর সময় বা বহন করার সময় সতর্কতা:

বীজতলায় বেশি করে পানি দিয়ে বেডের মাটি নরম করে নিতে হবে যাতে চারা উঠানোর সময় শেকড় বা কাণ্ড মুচড়ে বা ভেঙে না যায়। বস্তাবন্দী করে ধানের চারা কোনক্রমেই বহন করা উচিত নয়।

 

ধান রোপণ

 

ধানের চারা রোপণ:

রোপণের জন্য জমি তৈরি:

মাটির প্রকারভেদে ৩-৫ বার চাষ ও মই দিলেই জমি তৈরি হয়ে মাটি থকথকে কাদাময় হয়। জমি উঁচুনিচু থাকলে মই ও কোদাল দিয়ে সমান করে নিতে হবে।

রোপা আউশ ও আমনের চারা ২০—২৫ দিন বয়সে লাগাতে হয়। কিন্তু বোরোর ক্ষেত্রে একটু বেশি বয়সের ৪০—৪৫ দিনের চারা রোপন করতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০—২৫ সে.মি ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫—২০ সে.মি। চারা মাটির ২—৩ সে.মি. গভীরে রোপন করতে হয়। এর চেয়ে বেশি গভীরতা হলে গাছে কুশি উৎপাদন কমে যায়। সারি করে চারা লাগালে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা সহজ হয়।

 

চারার বয়স ও রোপণ পদ্ধতি:

আউশে ২০-২৫ দিনের, রোপা আমনে ২৫-৩০ দিনের এবং বোরোতে ৩৫-৪৫ দিনের চারা রোপণ করা উচিত। এক হেক্টর জমিতে ৮-১০ কেজি বীজের চারা লাগে। প্রতি গুছিতে ১টি সতেজ চারা রোপণ করাই যথেষ্ট। তবে চারার বয়স একটু বেশি হলে প্রতি গুছিতে ২-৩টি চারা রোপণ করা যেতে পারে। সারিতে চারা রোপণ করার সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০-২৫ সে.মি. এবং প্রতি গুছির দূরত্ব ১৫-২০ সে.মি. হওয়াই উত্তম।

সমান জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় চারা রোপণ করতে হয়। লম্বা রশির সাহায্যে সোজা সারি করে চারা রোপণ করা উত্তম। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০-২৫ সে.মি. এবং সারিতে গুছি থেকে জহির দূরত্ব হবে ১৫-২০ সে.মি.। প্রতিটি হিতে ২-৩টি চারা দিতে হয়। দেরিতে রোপণ করলে চারার সংখ্যা বেশি ও ঘন করে লাগাতে হয়।

 

ধান চাষে দ্বি-রোপণ পদ্ধতি:

জলাবদ্ধতা পূর্ববর্তী ফসলের কর্তন বিলম্বিত হলে বা অন্য কোন কারণে যদি রোপণের জন্য নির্ধারিত জমিতে রোপণ বিলম্বিত হয় তবে বেশি বয়সের চারা ব্যবহারের পরিবর্তে দ্বি-রোপণ পদ্ধতিতে ধান রোপণ একটি ভাল প্রযুক্তি। এ পদ্ধতিতে ধানের চারা বীজতলা হতে উত্তোলন করে অন্য জমিতে ঘন করে ১০-১০ সে.মি. দূরত্বে সাময়িকভাবে রোপণ করা হয়, আমন মৌসুমে ২৫-৩০ দিন পর এবং বোরো মৌসুমে ৩০-৪০ দিন পর আবার উত্তোলন করে মূল জমিতে ২০-২০ সে.মি. দূরত্বে দ্বি-রোপণ করা হয়।

 

ধান চাষে সার ব্যবস্থাপনা

সারের মাত্রা আবহাওয়া, মাটি, ধানের জাত, জীবনকাল, ফলন দেয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। ভালো ফলনের জন্য সময়মত ও পরিমানমত সার প্রয়োগ করতে হয়। নিচে মৌসুম ভেদে ধানের বিভিন্ন জাতের সারের পরিমান দেয়া হলো:

জমির উর্বরতার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা নির্ধারন করা হয়। এছাড়া জমিতে গোবর বা আর্বজনা পচা সার হেক্টর প্রতি ৮—১০ টন ব্যবহার করা হলে রাসায়নিক সারের মাত্রা প্রায় অর্ধেক নামিয়ে আনা সম্ভব। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সব সার জমি তৈরির সময় শেষে চাষের পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয় বলে ইউরিয়া সার ধাপে ধাপে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সারকে সমান তিনভাগে ভাগ করে চারা রোপনের ১০—১৫, ৩০—৩৫ ও ৪৫—৫০ দিন পর জমিতে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় নিম্নের বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখতে হবে :

১ / সার দেয়ার সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা প্রয়োজন, শুকনো জমিতে অথবা অতিরিক্ত পানি থাকলে সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
২/ সারের উপরি প্রয়োগের পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করলে অথবা হাত দিয়ে মিশিয়ে দিলে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
৩/ শেষ কিস্তির সার ধানের কাইচথোড় আসার ৫—৭ দিন আগে প্রয়োগ করা উচিত।
৪/ ইউরিয়া সারের প্রভাব পরবতীর্ ফসলে থাকে না বলে প্রত্যেক ফসলেই মাত্রানুযায়ী ইউরিয়া ব্যবহার করতে হবে।
৫/ ইউরিয়া প্রয়োগের পরও ধান গাছ যদি হলদে দেখায় তবে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এ অবস্থায় জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

ভালো ফলন পেতে চাইলে অবশ্যই জমিতে সার দিতে হবে। এছাড়া উচ্চফলনশীল ধানের জাত মাটি থেকে বেশি পরিমাণে খাদ্যের উপাদান গ্রহন করে বিধায় সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। গোবর বা আবর্জনা পচা জাতীয় জৈব সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।।

ইউরিয়া ব্যতীত সকল রাসায়নিক সার যেমন- টিএসপি, এমপি, জিপসাম, না প্রভৃতি। জমিতে শেষ চাষ দেয়ার আগে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার চারা রোপণ করার পর ও কিস্তিতে ছিটিয়ে প্রযোগ করতে হয়। এবার দেখা যাক শতক প্রতি সারের পরিমাণ কি?

 

জাত ও মৌসুম ছাড়া সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মারও কিছু কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয়। যেমন:

১। পাহাড়ের পানভূমির মাটি ও লাল বেলে মাটিতে এমপি সার নেতৃতণ দিতে হয়।

২। গঙ্গাবাহিত পলিমাটি ও সেচ প্রকল্প এলাকার মাটিতে লক্ষা সার বেশি পরিমাণে নিতে হয়।

৩। হাওড় এলাকার মাটিতে সার কম পরিমাণে দিতে হয়।

৪। স্থানীয় জাতের ধানে সারের পরিমাণ অর্ধেক দিলেই চলে।

৫। পূর্ববর্তী ফসলে প্রতিটি সার সঠিক পরিমাণে প্রয়োগ হয়ে থাকলে উপস্থিত ফসলে প্রতিটি সারের অর্ধেক পরিমাণ ব্যবহার করলেই চলে।

৬। পূর্ববর্তী ফসলে দস্তা সার ব্যবহার হয়ে থাকলে পরবর্তী ২টি ফসলে আর এ সার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।

৭। বেলে মাটিতে এম পি সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়।

৮। কোন জমিতে সবুজ সার ফসলের চাষ হলে পরবর্তী ফসলে ইউরিয়া সার ৪০-৫০% কমিয়ে ব্যবহার করলেও চলে।

 

ধান চাষে সার প্রয়োগে

 

ধান চাষে সার প্রয়োগের নিয়মাবলী:

ধান গাছের বাড়-বাড়তির বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন মাত্রায় নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। প্রথম দিকের কুশি গজানোর সময় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে তা থেকে গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন গ্রহণ করে কার্যকরী কুশির সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। সর্বোচ্চ কুশি উৎপাদন থেকে কাইচথোর আসা অবধি গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন পেলে প্রতি ছড়ায় পুষ্ট ধানের সংখ্যা বাড়ে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার যেমন টিএসপি, মিউরেট অব পটাশ, জিপসাম, জিংক সালফেট মাত্রানুযায়ী জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে।

তবে বেলে মাটিতে পটাশ সার দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। তিন ভাগের দুই ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং এক-তৃতীয়াংশ কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার ব্যবহার করা সম্ভব হলে তা প্রথম চাষের সময়ই জমিতে সমভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জৈব সার খরিফ মৌসুমে ব্যবহার করাই শ্রেয়।

 

ধানে গন্ধক ও দস্তা সার প্রয়োগের সময়:

ইউরিয়া সার প্রয়োগ করার পরও ধান গাছ যদি হলদে থাকে এবং বাড়-বাড়তি কম হয় তাহলে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। সেক্ষেত্রে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ হিসাবে জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। অত:পর বিঘা প্রতি ৮ কেজি জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

 

দস্তা সার

 

ইউরিয়া সার ব্যবস্থাপনায় এলসিসি ব্যবহার:

লিফ কালার চার্ট বা এলসিসি প্লাস্টিকের তৈরি চার রং-বিশিষ্ট একটি স্কেল। এলসিসি পদ্ধতি অবলম্বন করলে ধান গাছের চাহিদানুযায়ী ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যায়। ফলে ইউরিয়া সারের খরচ কমানো ও অপচয় রোধ করা যায় এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, এলসিসি ব্যবহারে শতকরা ২০-২৫ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় করা যায়।

 

ইউরিয়া সার

 

গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের বিভিন্ন দিক:

গুটি ইউরিয়া হল, ইউরিয়া সার দিয়ে তৈরি বড় আকারের গুটি যা দেখতে ন্যাপথালিন ট্যাবলেটের মত। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে সারের কার্যকারিতা শতকরা ২০-২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরিয়া সার পরিমাণে কম লাগে। আবার গুটি ইউরিয়া জমিতে একবারই প্রয়োগ করতে হয়।

এরপর সব সময় গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী নাইট্রোজেন সরবরাহ থাকায় গাছের কোন সুপ্ত ক্ষুধা থাকে না। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পূর্ব শর্ত হল, ধান রোপণ করতে হবে সারিবদ্ধভাবে। সারি থেকে সারি এবং গোছা থকে গোছার দূরত্ব হবে ২০ সে.মি.। বোরো মৌসুমে চারা রোপণের ১০-১৫ দিন এবং আউশ ও আমন মৌসুমে চারা রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যে প্রতি ৪ গোছার মাঝখানে ৩-৪ ইঞ্চি কাদার গভীরে গুটি পুঁতে দিতে হবে।

 

গুটি ইউরিয়া

 

অঞ্চল-ভিত্তিক পরিমিত সার প্রয়োগ:

কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-ভিত্তিক (৩০টি) থানা নির্দেশিকায় উল্লেখিত নিয়মানুযায়ী সার-এর পরিমাণ ও নির্দেশনা অনুযায়ী সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।

 

ধান চাষে আগাছা ব্যবস্থাপনা:

আগাছা ফসলের একটি মারাত্মক শত্রু। আগাছা ফসলের ক্ষেতে অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ যেমন শ্যামা, ছেঁচড়া, হলদে মুথা ইত্যাদি। যে উদ্ভিদ ভুল জায়গায় জন্মেছে যেমন ধান ক্ষেতে পাট গাছ। আগাছা ধান গাছের আলো, পানি ও খাদ্য উপাদানের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং ফসলের ক্ষতি করে।

 

ধান ক্ষেতে আগাছা

 

আগাছার প্রকার:

জীবনকালের ভিত্তিতে: বর্ষজীবী (শ্যামা, বথুয়া), দ্বি-বর্ষজীবী (বন্য গাজর) এবং বহুবর্ষজীবী (দূর্বা, ভেদাইল)। পাতা ও কাণ্ডের আকৃতির ভিত্তিতে: ঘাস-জাতীয় (শ্যামা, ক্ষুদে শ্যামা, দূর্বা, আরাইল, গৈচা, ফুলকা ঘাস, মনা ঘাস, ঝরা ধান), সেজ(Sedge)(হলদে মুথা, বড় চুচা, ছেঁচড়া, জয়না, পানি সেজ) ও চওড়া পাতা-জাতীয় (পানি কচু, শুষনি শাক, ঝিল মরিচ, পানি লং, পানি ডোগা, চাঁদমালা, হেলেঞ্চা, ঘেঁচু, বড় পানা, ক্ষুদে পানা ও কচুরি পানা)।

 

আগাছা দমনের পদ্ধতিসমুহ:

(ক)হাত বাছাই

(খ)রাইচ উইডার ও

(গ)আগাছানাশক-এর যে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে আগাছা দমন করা যায়। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মীদের সাথে পরামর্শক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

আগাছানাশক ব্যবহারে সতর্কতা:

(ক)সঠিক আগাছানাশক নির্বাচন,

(খ)সঠিক মাত্রায় আগাছানাশক প্রয়োগ,

(গ)সঠিক সময়ে আগাছানাশক প্রয়োগ,

(ঘ)সঠিক প্রয়োগ পদ্ধতির অনুসরণ,

(ঙ)সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার অনুসরণ,

(চ)আগাছা-নাশকের বোতলে সঠিক নির্দেশনা পালন এবং

(ছ)স্থানীয় কৃষি কর্মীদের পরামর্শ মেনে চলা।

 

আগাছা-নাশক ব্যবহারের সঠিক সময়:

(ক)আগাছা-নাশকের কার্যকারিতা পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল।

(খ)প্রয়োগের সময়-ভিত্তিক আগাছা-নাশক ভিন্ন ভিন্ন:

(১) “গজানোর পূর্বে” (Pre-emergence), আগাছা গজানোর পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে,

(২) “গজানোর পরে” (Post-emergence), আগাছা জন্মানোর পর প্রয়োগ করতে হবে,

(৩) “গজানোর পর পর” (Early post-emergence, আগাছা জন্মানোর পর পরই প্রয়োগ করতে হবে এবং

(৪) সরকারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকৃত আগাছা-নাশকের বোতল/প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশাবলী ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সর্বদা মেনে চলতে হবে।

 

গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের আওতাধীন ক্যানালের মাধ্যমে সেচ

 

ধান চাষে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা

ধান চাষে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার:

ধান চাষে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধানের জমিতে সব সময় দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ১০-১২ দিন পর্যন্ত ছিপছিপে পানি রাখতে হবে যাতে রোপণ-কৃত চারায় সহজে নতুন শিকড় গজাতে পারে। এরপর কম পানি রাখলেও চলবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ধানগাছ যেন খরা কবলিত না হয়।

রোপা ধানে সবসময় দাড়ানো পানি রাখার দরকার নেই। চারা রোপনের পর ৬—৭ সে.মি. পানি রাখতে হবে। চারা রোপনের ৬—৭ দিন পর্যন্ত ৩—৫ সে.মি. সেচ দিলে আগাছা দমন হয়। কুশি উৎপাদন পর্যায়ে ২—৩ সে.মি. এবং থোর আসার সময় ৭—১০ সে.মি. সেচ দেয়া উত্তম। দানা পুষ্ট হওয়া শুরু হলে আর সেচ দিতে হয় না।

রোপা আমন সাধারণত বৃষ্টি নির্ভর। আমন মৌসুমে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির পানি যেন সরাসরি জমির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে না পারে এজন্য উচু আইল তৈরি করে দিতে হয়। কারণ বৃষ্টির পানি জমির পুষ্টি উপাদান ধুয়ে নিয়ে যায়। বর্তমানে পরিবর্তিত জলবায়ুতে বৃষ্টির সময় কাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেখা যায় রোপনের সময় বৃষ্টির পানির অভাবে জমি তৈরি করা যায় না অথবা অতি বৃষ্টির জন্য জমিতে অনেক দাড়ানো পানি থাকে যার জন্য চারা রোপন করা যায় না। বর্তমানে রোপা আমনে সম্পূরক সেচ বিশেষ করে শীষ উদগম থেকে দানা পুষ্ট হওয়া পর্যন্ত সময়ে প্রয়োগ করে ফসল ফলানো হয়। এতে ফলন বেড়ে যায়।

মাঠ পর্যায়ে কৃষক বোরো ধান চাষে ২৫—৩০ বার সেচ প্রদান করে যা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত। বোরো ধান চাষে একবার ৫—৭ সে.মি. পানি দেয়ার পর জমিতে দাড়ানো পানি শেষ হওয়ার তিন দিন পর পুনরায় সেচ দিলে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পানি কম লাগে। বোরো চাষে পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে (অডউ) সেচ দিলে গাছে মূলের বৃদ্ধি ভালো হয় ও সেচ খরচ ও কমানো যায়।

আগাছা দমন সাধারণত বোরো ও রোপা আমনের চেয়ে আউশ মৌসুমে বিশেষ করে বোনা আউশে আগাছার উপদ্রব বেশি হয়। এজন্য আউশ মৌসুমে প্রথম বৃষ্টিপাতের পর জমিতে দু—একটি চাষ দিয়ে পতিত রাখলে আগাছার বীজ গজিয়ে উঠে। কিছুদিন পর পুনরায় মই দিয়ে ধান বপন করলে আগাছার উপদ্রব কম হয়। রোপা জমিতে ৫—১০ সে.মি. পানি রাখলে জমিতে আগাছা কম হয়। বোরো ধানে দাড়ানো পানি থাকে বলে আগাছার উপদ্রব কম হয়। তারপরও আগাছা হলে আগাছা পরিস্কার করতে হয়। আগাছা পরিস্কারের সময় হাত দিয়ে মাটি নেড়ে দিলে বাতাস চলাচলের সুযোগ পায় যা গাছের মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।

জমিতে দাড়ানো পানি না থাকলে আগাছার প্রকোপ বেড়ে যায়। সারিতে রোপনকৃত রোপা আমনে জাপানি রাইস উইডার দিয়ে আগাছা দমন করা যায়। আগাছানাশক প্রয়োগ করেও আগাছা দমন করা যায়। ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণ ধানের শিষের শতকরা ৮০—৯০ ভাগ অংশের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে এবং ধানের রং সোনালি হলে ধান কাটতে হয়।

ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য ধান পরিপক্ক হবার পরপরই যত দ্রুত সম্ভব ধান কাটতে হবে। এরপর মাড়াই করে খড়কুটা বেছে পরিস্কার করে ধান পরপর ৪—৫ দিন শুকাতে হবে। শুকানোর সময় ধানের আর্দ্রতা ১২% এ চলে আসলে চিটা, আবর্জনা, ভাঙ্গা ধান, ধুলাবালি পরিস্কার করে নিতে হবে। এরপর ধান ছায়ায় ঠান্ডা করে ড্রামে, মটকায়, পলিকোটেড বায়ুরোধক পাত্রে রাখতে হবে।

ফলন মৌসুম ভেদে ধানের ফলন ভিন্ন হয়। বোরো মৌসুমে ধানের ফলন সবচেয়ে বেশি ও আউশ মৌসুমে সবচেয়ে কম। উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরোতে গড়ে হেক্টর প্রতি ৫—৬ টন, রোপা আমনে ৪—৫ টন এবং আউশে ৩—৪ টন।

বৃষ্টি-নির্ভর রোপা আমন এলাকায় জমির আইল ১৫ সে.মি. উঁচু রাখলে অনেকাংশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায় যা খরা থেকে ফসলকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। এরপরও যদি ধান ফসল খরা কবলিত হয় তাহলে প্রয়োজন মাফিক সম্পূরক সেচ দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, খরা কবলিত ধানের চেয়ে সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় ১ টন বেশি হয়।

 

ধান চাষে সেচ

 

সেচের পানির অপচয় রোধ:

বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে সাধারণত মাটির নালা দিয়ে সেচ দেয়া হয়। ফলে ফসলের জমি ও সেচের পানি উভয়েরই অপচয় হয়। এ অপচয় রোধকল্পে পিভিসি অথবা প্লাস্টিক পাইপ ব্যবহার করে পানির অপব্যবহার ও অপচয় রোধ করা যায়। এ পদ্ধতিতে সেচ দিলে পানির অপচয় কমানোর সাথে সেচের খরচও কমানো যায়। গভীর/অগভীর নলকূপ থেকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সেচ দিলে একই পরিমাণ পানি দিয়ে কাঁচা নালার তুলনায় শতকরা প্রায় ৪০-৪২ ভাগ বেশি জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব।  বোরো মৌসুমে ধান আবাদে পানি সাশ্রয়ী আর একটি পদ্ধতির নাম অলটারনেট ওয়েটিং এন্ড ড্রাইং (AWD)।

এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ চলবে জাত ভেদে ৪০-৫০ দিন পর্যন্ত। যখনই গাছে থোড় দেখা দেবে তখন থেকে দানা শক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষেতে স্বাভাবিক ২-৫ সে.মি. পানি রাখতে হবে। এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে সেচের পানি, জ্বালানি ও সময় সাশ্রয় হয় এবং উৎপাদন খরচও হ্রাস পায়।

 

সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে জমিতে সেচ

 

ধান চাষে অনিষ্টকারী পোকা ও মেরুদন্ডী প্রাণী ব্যবস্থাপনা:

ধান ফসলে বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ দেখা যায়। যেমন- সবুজ পাতা ফড়িং, মাজরা পোকা, পামরী পোকা, গান্ধী পোকা, গল মাছি, শীষ কাটা লেদা পোকা ইত্যাদি। জমিতে গাছের ডাল বা বাশের কঞ্চি পুঁতে দিলে সেখানে পাখি বসে এবং পোকা ধরে খায়। তাছাড়া প্রতিরোধী ফসলের জাত ও বিভিন্ন দমন পদ্ধতি দ্বারা পোকা দমন করা যায়। তবে দ্রুত দর্শনের ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিচে একটি তালিকা দেয়া হলো ।

 

 

রোগ দমন ধান ফসলে বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। যেমন- কান্ড পচা রোগ, টুংরো রোগ, বাদামী দাগ রোগ, উফরা রোগ, ট্রাস্ট রোগ ইত্যাদি। এসব রোগ সঠিক সময়ে দমন করতে না পারলে ফলন যথেষ্ট কমে যায়। বীজ শোষন, আগাছা দমন ও সুষম সার প্রয়োগে বিভিন্ন রোগ দমন হয়। এছাড়া প্রতিরোধী জাত যেমন- মালা ও গাজী জাতের ধানে বাদামী দাগ রোগ কম হয়। বিভিন্ন রোগনাশক যেমন- কুপ্রাভিট ৫০, হিমোসান ৫০ ইত্যাদি প্রয়োগ করে ও রোগ দমন করা যায়।

 

ধানের রোগ ব্যবস্থাপনা:

নিবিড় চাষাবাদের কারণে ধান ফসলে বিভিন্ন প্রকার রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন রোগ-বালাই ধানের ক্ষতি করে এবং ফলন কমিয়ে দেয়। এজন্য রোগ শনাক্ত করে তার জন্য ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।

 

ধানের টুংরো রোগ:

ভাইরাসজনিত রোগ। সবুজ পাতাফড়িং এ রোগের বাহক। চারা অবস্থা থেকে গাছে ফুল ফোটা পর্যন্ত সময়ে এ রোগ দেখা দিতে পারে। ধানের ক্ষেতে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় গাছের পাতা হলুদ বা কমলা রঙ ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে সালফার বা নাইট্রোজেন সারের ঘাটতিজনিত কারণে এবং ঠাণ্ডার প্রকোপে এরূপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে সমস্ত জমির ধান বিক্ষিপ্তভাবে না হয়ে সমভাবে হলুদাভ বা কমলা রঙ ধারণ করে। গাছের বাড়-বাড়তি ও কুশি কমে যায় ফলে আক্রান্ত গাছ সুস্থ গাছের তুলনায় খাটো হয়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

রোগের প্রাথমিক অবস্থায় রোগাক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন। আগাম বীজতলায় বিশেষ করে আমন ধান কাটার সময়, বোরোর বীজতলায় সবুজ পাতাফড়িং দেখা গেলে হাতজাল বা কীটনাশক প্রয়োগ করে দমনের ব্যবস্থা নিন।

নিবিড় ধান চাষ এলাকায় ভলান্টিয়ার রাইস/রেটুন ধান তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন অথবা জমিতে চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিন। আলোক-ফাঁদ ব্যবহার করে বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলুন। সবুজ পাতাফড়িং দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

 

ধানের ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া:

চারা রোপণের ১৫-২০ দিনের মধ্যে এবং বয়স্ক ধান গাছে এ রোগ দেখা যায়। আক্রান্ত চারা গাছের গোড়া পচে যায়, পাতা নেতিয়ে পড়ে হলুদাভ হয়ে মারা যায়। এ অবস্থাকে কৃসেক বলে। রোগাক্রান্ত কাণ্ডের গোড়ায় চাপ দিলে আঠালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ বের হয়। বয়স্ক গাছে সাধারণত থোড় অবস্থা থেকে পাতাপোড়া লক্ষণ দেখা যায়। প্রথমে পাতার অগ্রভাগ থেকে কিনারা বরাবর আক্রান্ত হয়ে নিচের দিকে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত অংশ প্রথমে জলছাপ এবং পরে হলুদাভ হয়ে খড়ের রং ধারণ করে।

ক্রমশ সম্পূর্ণ পাতাটাই শুকিয়ে মরে যায়। অতিমাত্রায় ইউরিয়া সারের ব্যবহার, শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ো আবহাওয়া এ রোগ বিস্তারে সাহায্য করে।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন। রোগ দেখা দিলে প্রতি বিঘায় অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করুন। ঝড়-বৃষ্টি এবং রোগ দেখা দেওয়ার পর ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রাখুন। কৃসেক হলে আক্রান্ত জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিন। রোগাক্রান্ত জমির ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন।

ধানের উফরা রোগ:

কৃমিজনিত রোগ। কৃমি ধানগাছের কচি পাতা ও খোলের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে। কৃমি গাছের রস শোষণ করায় প্রথমে পাতার গোড়ায় ছিটেফোঁটা সাদা দাগ দেখা যায়। ক্রমান্বয়ে সে দাগ বাদামি রঙের হয়ে পুরো আগাটাই শুকিয়ে মরে যায়। আক্রমণের প্রকোপ বেশি হলে গাছে বাড়-বাড়তি কমে যায়। থোড় অবস্থায় আক্রমণ করলে থোড়ের মধ্যে শিষ মোচড়ানো অবস্থায় থেকে যায়। ফলে শিষ বের হতে পারে না।

কৃমি পরিত্যক্ত নাড়া, খড়কুটো এবং ঘাসে এমনকি মাটিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেঁচে থাকে।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

রোগ দেখা দিলে হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি হারে ফুরাডান ৫জি অথবা কিউরেটার ৫জি প্রয়োগ করুন। রোগাক্রান্ত জমির ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন। সম্ভব হলে জমি চাষ দিয়ে ১৫-২০ দিন ফেলে রাখুন। আক্রান্ত জমিতে বীজতলা করা উচিৎ নয়। ধানের পর ধান আবাদ না করে অন্য ফসলের চাষ করুন। জলী আমন ধানে আক্রান্ত জমিতে কারবেনডাজিম ২% হারে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।

 

ধানের ব্লাস্ট রোগ:

ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ পাতায় হলে পাতা ব্লাস্ট, গিটে হলে গিট ব্লাস্ট ও শিষে হলে শিষ ব্লাস্ট বলা হয়। পাতায় ব্লাস্ট হলে পাতায় ছোট ছোট ডিম্বাকৃতির দাগের সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে দাগ বড় হয়ে দু’প্রান্ত লম্বা হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে।

দাগের চার ধারে বাদামি ও মাঝের অংশ সাদা বা ছাই বর্ণ ধারণ করে। অনেকগুলো দাগ একত্রে মিশে গিয়ে পুরো পাতা মরে যায়। এ রোগের কারণে জমির সমস্ত ধান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

এ রোগ বোরো মৌসুমে বেশি হয়। গিট ব্লাস্ট এবং শিষ ব্লাস্ট হলে গিট ও শিষের গোড়া কালো হয়ে যায় ও ভেঙে পড়ে এবং ধান চিটা হয়ে যায়। রাতে ঠান্ডা, দিনে গরম, রাতে শিশির পড়া এবং সকালে কুয়াশা থাকলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করুন। জমিতে পানি ধরে রাখুন। রোগমুক্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করুন। সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করুন। আক্রান্ত জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রেখে প্রতি হেক্টরে ৪০০ গ্রাম ট্রপার, জিল বা নেটিভো ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করুন।

সকল সুগন্ধি ধান, হাইব্র্রিড ধান এবং লবণ-সহনশীল ধানে ফুল আসার সময় নিম্নচাপ দেখা দিলে উল্লিখিত ছত্রাকনাশক আগাম স্প্রে করতে হবে।

 

ধানের খোলপোড়া রোগ:

ছত্রাকজনিত রোগ। ধান গাছের কুশি গজানোর সময় হতে রোগটি দেখা যায়। প্রথমে খোলে ধূসর জলছাপের মত দাগ পড়ে। দাগের মাঝখানে ধূসর হয় এবং কিনারা বাদামি রঙের রেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। দাগ আস্তে আস্তে বড় হয়ে সমস্ত খোলে ও পাতায় অনকেটা গোখরো সাপের চামড়ার মত চক্কর দেখা যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া, বেশি মাত্রায় ইউরিয়ার ব্যবহার ও ঘন করে চারা রোপন এ রোগ বিস্তারে সহায়তা করে।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

জমিতে শেষ মই দেয়ার পর পানিতে ভাসমান আবর্জনা সুতি কাপড় দিয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন। পটাশ সার সমান দু’কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সার প্রয়োগের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করুন।

নেটিভো, ফলিকুর, কনটাফ, হেক্সাকোনাজল খোলপোড়া রোগ দমনে কার্যকর ছত্রাকনাশক। আক্রান্ত ধানগাছের চারপাশের কয়েকটি সুস্থ গুছিসহ বিকেলে গাছের উপরিভাগে এটি স্প্রে করুন। ছত্রাকনাশকের মাত্রা লেবেলে দেখে নিন। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন।

 

ধানের বাকানি রোগ:

ছত্রাকজনিত রোগ। আক্রান্ত কুশি দ্রুত বেড়ে অন্য গাছের তুলনায় লম্বা ও লিকলিকে হয়ে যায় এবং হালকা সবুজ রঙের হয়। গাছের গোড়ার দিকে পানির উপরের গিঁট থেকে শিকড় বের হয়। ধীরে ধীরে আক্রান্ত গাছ মরে যায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

রোগাক্রান্ত কুশি তুলে ফেলুন। এ রোগ বীজবাহিত। তাই বীজ শোধন করতে পারলে ভাল হয়। এ জন্য কারবেনডাজিম গ্রুপের যেকোনও ছত্রাকনাশকের ৩ গ্রাম ওষুধ ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে অঙ্কুরিত বীজে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া একই পরিমাণ ওষুধ দিয়ে সারা রাত চারা শোধন করেও ভাল ফল পাওয়া যায়।

 

ধানের বাদামি দাগ:

ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ হলে পাতায় প্রথমে ছোট ছোট বাদামি দাগ দেখা যায়। দাগের মাঝখানটা হালকা বাদামি রঙের হয়। অনেক সময় দাগের চারদিকে হলুদ আভা দেখা যায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করুন। ইউরিয়া ও পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করুন। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন। পর্যায়ক্রমে জমিতে পানি সেচ দিন এবং জমি শুকিয়ে নিন। আক্রান্ত জমিতে শিষ বের হওয়ার পর ৬০ গ্রাম পটাশ ও ৬০ গ্রাম থিওভিট/কমুলাস ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫শতক জমিতে স্প্রে করলে ধানে বাদামি দাগ কম হয়। কারবেনডাজিম-জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে (বীজ ০.৩% দ্রবণে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে) বীজ শোধন করুন।

 

ধানের খোল পচা:

ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ ধানগাছের ডিগপাতার খোলে হয়। রোগের শুরুতে ডিগপাতার খোলের ওপরের অংশে গোলাকার বা অনিয়মিত আকারের বাদামি দাগ দেখা যায়। আস্তে আস্তে দাগটি বড় হতে থাকে এবং গাঢ় ধূসর রঙ ধারণ করে। এ অবস্থায় অনেক সময় শিষ বের হতে পারে না অথবা রোগের প্রকোপ অনুযায়ী আংশিক বের হয় এবং বেশিরভাগ ধান কালো ও চিটা হয়ে যায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

আক্রান্ত খড়কুটো জমিতে পুড়িয়ে ফেলুন। সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করুন। খোলপোড়া রোগের ছত্রাকনাশক এ রোগের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করুন।

 

ধানের লক্ষ্মীর গু রোগ:

ছত্রাকজনিত রোগ। ধান পাকার সময় এ রোগ দেখা যায়। ছত্রাক ধানের বাড়ন্ত চালকে নষ্ট করে বড় গুটিকার সৃষ্টি করে। গুটিকার ভিতরের অংশ হলদে-কমলা রঙ এবং বহিরাবরণ সবুজ যা আস্তে আস্তে কালো হয়ে যায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

এ রোগ ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে ভাল উপায় হল রোগাক্রান্ত শিষ তুলে ফেলা ও মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার না করা।

 

ধানের পাতা লালচে রেখা রোগ:

ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। ব্যাকটেরিয়া পাতার ক্ষত দিয়ে প্রবেশ করে এবং শিরার মধ্যবর্তী স্থানে সরু রেখার জন্ম দেয়। আস্তে আস্তে রেখা বড় হয়ে লালচে রঙ ধারণ করে। পাতা সূর্যের বিপরীতে ধরলে দাগের ভেতর দিয়ে স্বচ্ছ আলো দেখা যায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

এ রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বীজ শোধন করা দরকার, আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করা উচিত নয় এবং নাড়া পুড়িয়ে ফেলা দরকার।

 

ধান অনিষ্টকারী পোকা ও প্রাণী নিয়ন্ত্রণ:

নিবিড় চাষাবাদের কারণে ফসলে পোকার প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন পোকার প্রাদুর্ভাব বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের উপায়সমূহ একে একে নিম্নে বর্ণনা করা হল:

 

মাজরা পোকা

 

মাজরা পোকা ব্যবস্থাপনা (Stem borer):

মাজরা পোকার আক্রমণ ফুল ফোঁটার আগে হলে মরা ডিল এবং ফুল ফোঁটার পরে হলে সাদা শিষ বের হয়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

  • ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলুন।
  • আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা (মথ) সংগ্রহ করে দমন করুন।
  • ধান ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির সাহায্য নিন।
  • পরজীবী (বন্ধু) পোকা মাজরা পোকার ডিম নষ্ট করে ফেলে। সুতরাং যথাসম্ভব কীটনাশক প্রয়োগ বিলম্বিত করুন।
  • জমিতে শতকরা ১০-১৫ ভাগ মরা ডিগ অথবা শতকরা ৫ ভাগ সাদা শিষ দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করুন। আমন ধান কাটার পর চাষ দিয়ে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে বা পুড়িয়ে ফেলুন।

 

ধানের নলিমাছি বা গলমাছি

 

নলিমাছি বা গলমাচি ব্যবস্থাপনা (Gall midge):

এই মাছির দ ধানগাছের বাড়ন্ত কুশিতে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত কুশি পেঁয়াজ পাতার মত হয়ে যায়। ফলে কুশিতে আর শিষ হয় না।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

  • রোপণের পর নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করুন।
  • আলোক-ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণবয়স্ক পোকা দমন করুন।
  • জমিতে শতকরা ৫ ভাগ পেয়াজ পাতার লক্ষণ দেখা গেলে কীটনাশক ব্যবহার করুন।

 

ধানের পামরি পোকা

 

পামরি পোকা ব্যবস্থাপনা (Rice hispa):

পামরি পোকার কীড়া পাতার ভেতরে সুড়ঙ্গ করে সবুজ অংশ খায়, আর পূর্ণবয়স্ক পোকা পাতার সবুজ অংশ কুরে কুরে খায়। এভাবে খাওয়ার ফলে পাতা সাদা দেখায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

  • হাতজাল বা মশারির কাপড় দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলুন।
  • জমিতে শতকরা ৩৫ ভাগ পাতার ক্ষতি হলে অথবা প্রতি গোছায় চারটি পূর্ণ বয়স্ক পোকা অথবা প্রতি কুশিতে ৫টি কীড়া থাকলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

 

পাতা মোড়ানো পোকা

 

পাতা মোড়ানো পোকা ব্যবস্থাপনা (Leaf roller):

পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া গাছের পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে পাতার ভিতরের সবুজ অংশ খায়। খুব বেশি ক্ষতি করলে পাতা পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

  • আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
  • ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন।
  • গাছে থোড় আসার সময় বা ঠিক তার আগে যদি শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

 

ধানের চুঙ্গি পোকা

 

চুঙ্গি পোকা ব্যবস্থাপনা (Rice caseworm):

চুঙ্গি পোকা পাতার উপরের অংশ কেটে ছোট ছোট চুঙ্গি তৈরি করে ভেতরে থাকে। আক্রান্ত ক্ষেতে গাছের পাতা সাদা দেখায় এবং পাতার উপরের অংশ কাটা থাকে। দিনের চুঙ্গিগুলো পানিতে ভাসতে থাকে।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

  • আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
  • পানি থেকে হাতজাল দিয়ে চুঙ্গিসহ কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করুন।
  • জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

 

ধানের লেদা পোকা

 

লেদা পোকা ব্যবস্থাপনা (Swarming caterpillar):

এ পোকার কীড়া পাতার পাশ থেকে কেটে এমনভাবে খায় যে কেবল ধানগাছের কাণ্ড অবশিষ্ট থাকে। সাধারণত: শুকনো জমিতে এ পোকার আক্রমণের আশঙ্কা বেশি।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

  • ধান কাটার পর জমি চাষ দিয়ে রাখুন অথবা নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন।
  • আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
  • ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন।
  • জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

 

ধানের মাঠে ঘাসফড়িং:

ঘাসফড়িং পাতার পাশ থেকে শিরা পর্যন্ত খায়। জমিতে অধিক সংখ্যায় আক্রমণ করলে এদেরকে পঙ্গপাল বলা হয়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

হাতজাল বা মশারির কাপড় দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলুন। ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন। জমির শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

 

ধানের মাঠে লম্বাশুড় উরচুঙ্গা:

এ পোকা ধানের পাতা এমনভাবে খায় যে পাতার কিনারা ও শিরা বাকি থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত পাতা ঝাঁঝরা হয়ে যায়।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন। আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পূর্ণবয়স্ক উরচুঙ্গা দমন করুন। জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

 

ধানের মাঠে সবুজ পাতাফড়িং:

সবুজ পাতাফড়িং ধানের পাতার রস শুষে খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ও গাছ খাটো হয়ে যায়। এ পোকা টুংরো ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা দমন করুন। হাতজালের প্রতি টানে যদি একটি সবুজ পাতাফড়িং পাওয়া যায় এবং আশেপাশে টুংরো রোগাক্রান্ত ধান গাছ থাকে তাহলে বীজতলায় বা জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

 

ধানের মাঠে বাদামি গাছফড়িং:

বাদামি গাছফড়িং ধানগাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়। ফলে গাছ পুড়ে যাওয়ার রং ধারণ করে মরে যায় তখন একে বলা হয় ‘হপার বার্ন’ বা ‘ফড়িং পোড়া’।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

বোরো মৌসুমে ফেব্রুয়ারি এবং আমন মৌসুমে অগাস্ট মাস থেকে নিয়মিত ধান গাছের গোড়ায় পোকার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন। এ সময় ডিম পাড়তে আসা লম্বা পাখাবিশিষ্ট ফড়িং আলোক-ফাঁদের সাহায্যে দমন করুন। ধানের চারা ঘন করে না লাগিয়ে পাতলা করে রোপণ করলে গাছ প্রচুর আলো বাতাস পায়; ফলে পোকার বংশ বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে।

 

ধানের মাঠে ইঁদুর দমন:

ইঁদুর ধান গাছের কুশি কেটে দেয়। ধান পাকলে ধানের ছড়া কেটে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে জমা রাখে।

ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:

জমির আইল ও সেচ নিষ্কাশন নালা কম সংখ্যক ও চিকন রাখতে হবে। একটি এলাকায় যথাসম্ভব একই সময় ধান রোপণ ও কর্তন করা যায় এমনভাবে চাষ করতে হবে। ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন করুন। বিষটোপ, যেমন-ব্রমাডিওলন দিয়ে ইঁদুর দমন করা যায়।

 

ধান কাটা

 

ধান ফসল কর্তন, মাড়াই ও সংরক্ষণ:

শীথের উপরের অর্ধেক দানার শতকরা ৮০ ভাগ এবং নিচের অর্ধেক নানার শতকরা ২০ ভাগ শক্ত হলে ধান কাটার উপযুক্ত সময় হয়। তাছাড়া কিছু কিছু ধান সোনালী রং ধারণ করে এবং নীলের মতন ছেলে পড়ে। এমতাবস্থান কেটে আঁটি বেঁধে পরিষ্কার জানালার দিয়ে প্যাডেল প্রেসার বা গরু দিয়ে বা পিটিয়ে মাড়াই করতে হয়। এরপর কেড়ে পরিষ্কার করে ৩- ৪ বার ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়।

 

অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শিষ ভেঙে যায়, শিষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। শিষের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাড়াই করা উচিত। কাঁচা খলার উপর ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নিন। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে।

মাড়াই করা ধান অন্তত ৪-৫ দিন রোদে ভালভাবে শুকানোর পর যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে এবং এমতাবস্থায় গুদামজাত ও আর্দ্রতা-রোধক গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে।

 

ওলকচু চাষ করার পদ্ধতি

ওলকচু চাষ করার পদ্ধতি , ওলকচুর চাষ পদ্ধতি সঠিকভাবে না জানার কারণে চাষিরা তাদের কাঙ্খিত ফলন পান না। ওল মাটির নিচে জন্মানো একটি সবজি। আমাদের দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই ওলকচুর চাষ হয়ে থাকে। ওল কচুতে পুষ্টি ও ওষুধি গুণ উভয়ই বিদ্যমান। ওল কচু তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। আসুন জেনে নেই ওলকচু চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে-

ওলকচু চাষ করার পদ্ধতি

জলবায়ু ও মাটির গুণাগুণ

ওলকচুর জমিতে অবশ্যই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ছায়া থাকলে ভালো হয় না। ওল কচুর গাছ ভালোভাবে বৃদ্ধির জন্য ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও বার্ষিক ১০০-১৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। মাটির নির্বাচনের ক্ষেত্রে এঁটেল দোআঁশ,  দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি ওলকচু চাষের জন্য উপযোগী।

ওলকচুর জাত

বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের ওলকচুর চাষ করা হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে ‘মাদ্রাজি’ জাতের ওলকচু উৎকৃষ্ট মানের। তবে আমাদের দেশে এখনও ওলকচুর তেমন কোনও নির্দিষ্ট জাত আবিষ্কার করা যায়নি।

জমি তৈরি ও চারা রোপণ

ওলকচু চাষের জন্য প্রথমেই মাটি ভালোভাবে চাষ করে নিতে হবে ও মই দিয়ে মটি ঝুরঝুরে করে মই দিয়ে মাটি চেপে দিতে হবে। মাঘ মাসের মাঝামাঝি ও ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি ওলকচুর বীজ বপনের জন্য উপযুক্ত সময়। প্রয়োজনে মধ্য-চৈত্র থেকে মধ্য-বৈশাখ মাসেও লাগানো যায়। তবে এরপরে রোপণ করলে ফলন কমে যায়।

জমি থেকে সাধারণত কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ওল তোলা শুরু হয়। তখন ওলের চারপাশে যে মুখি জন্মে সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে। এসব মুখি থেকেই চাকি তৈরি হয়। চাকির আকার যত বড় হয় ওল তত বড় হয়।

ওলকচু চাষে সার প্রয়োগ

ওলকচুর চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর প্রতি শতক জমির জন্য ১.২ কেজি টিএসপি, ০.৫ কেজি গোবর ও ০.৩ কেজি ইউরিয়া সার মাটির সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। প্রতি গর্তের মাটিতে কী পরিমাণ সার মেশাতে হবে তা নির্ভর করে একরপ্রতি গর্তের সংখ্যার ওপর। সারের মাত্রা একর প্রতি ৩০ কেজি ইউরিয়া, ১২০ কেজি টিএসপি, ৫০ কেজি এমওপি। সার মেশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে।

সারের মাত্রা

সারের মাত্রা একর প্রতি ৩০ কেজি ইউরিয়া, ১২০ কেজি এসএসপি, ৫০ কেজি এমওপি। প্রতি গর্তের মাটিতে কী পরিমাণ সার মিশাতে হবে তা নির্ভর করবে একর প্রতি গর্তের সংখ্যার ওপর। মোট সারের পরিমাণকে একর প্রতি গর্তের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গর্ত প্রতি সারের পরিমাণ বের করে নিতে হবে। সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। ভরাট করার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে ভালো ‘জো’ থাকে। ভরাটের পর গর্তের মুখ মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু করে ঢিবির মতো করে দিতে হবে।

এতে সুবিধা হলো, গর্তের মধ্যে অনেক সময় বৃষ্টির জল জমে ‘চাকি’ পচে যায়। ঢিবি তৈরির ফলে এ সম্ভাবনা কমে যায়। ‘চাকি’ থেকে মাটির ওপরে চারা বেরিয়ে আসতে বেশ সময় লাগে। তাই এ সময় সব জমি খড় বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রাখলে ভালো হয়। জমিতে সালফারের অভাব থাকলে একরপ্রতি ২০ কেজি জিপসাম সার এবং সুযোগ থাকলে ১০০ কেজি ছাই ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়।

চারা গজানোর পর চারা যাতে ভালোভাবে মাটির ওপরে পাতা ছড়াতে পারে সে জন্য কচুরিপানা বা খড় মুখের কাছে সামান্য আলগা করে ঢেকে দিতে হবে। চারা গজানোর এক মাস পর একর প্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি এমওপি সার সেচের পর গাছের চারপাশে খড় বা কচুরিপানার নিচে দিতে হবে। কিছু দিন পর গোড়ার মাটি হালকা করে কুপিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে এতে শিকড় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ‘চাকি’ ক্রমশ ওপরের দিকে বাড়তে থাকে। অনেকেই বলে থাকেন, ওলের আকার-আকৃতি অনেকটা গর্তের আকারের ওপর নির্ভর করে।

ওলকচু চাষে সেচ ও পানি নিষ্কাশন

ওলকচু চাষে প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থাও করতে হবে। বীজ লাগানোর পরে যদি বৃষ্টিপাত না হয় তবে সেচ দিতে হবে। দুই সারি বা প্রতি সারির পাশ দিয়ে হালকা নালা তৈরি করে দিতে হবে যাতে সহজেই বৃষ্টির পানি যেতে পারে। ওলের জমিতে পানি জমতে দেয়া যাবে না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ওলকচু চাষে  আগাছা ও নিড়ানি

ওলকচু চাষে সময়মত আগাছা দমন ও নিড়ানি দিতে হবে। ধান, গমের খড় বা কচুরিপানা দ্বারা আচ্ছাদন দিয়ে ফলন অনেক গুণ বৃদ্ধি করা যায় এবং সহজেই আগাছা দমন করা যায়। চারা গজানোর পর আগাছা দমন করতে হবে।

ওলকচু চাষে পোকামাকড় ও রোগদমন

ওলকচুর কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই দ্বারা তেমন আক্রান্ত হয় না । তবে মাঝে মধ্যে ওলকচুতে লিম্ফ ব্লাইট কলার রট ও মোজাইক রোগ দেখা দেয়। আবার গোঁড়া পচা রোগ ওলের প্রধান ক্ষতিকর রোগ। চাকি লাগানোর আগে ছত্রাকনাশক ব্যাভিস্টিন (Bavistin) দিয়ে তা শোধন করে নিলে এ রোগ কম হয়। কচু মুখি কার্তিক মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাসের দিকে পরিপক্ব হয়ে থাকে। ওলকচু লাগানোর পর প্রায় ৭ থেকে ১২ মাস পর সংগ্রহ করা যায়। গোড়ার মাটি সরিয়ে ওল সংগ্রহ করা যায়।

 

শালগম চাষের সহজ ও সঠিক পদ্ধতি

শালগম চাষের সহজ ও সঠিক পদ্ধতি , শালগম কমবেশি সবার কাছেই পরিচিত। এটি সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় উপযোগী। কম তাপমাত্রায় এটি ভালো জন্মে। এই গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রচুর আলো দরকার হয়ে থাকে। তাপমাত্রা বেশি হলে ফসলের মান কমে যায়। স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। মূল আঁশময় হয়ে যায়। আবার বেশি বৃষ্টিপাত ও শালগম চাষের জন্য ক্ষতিকর। আজ আপনাদের সাথে শালগম চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই শালগম চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন:

শালগম চাষের সহজ ও সঠিক পদ্ধতি

 

শালগম চাষের জন্য জমি ও মাটি:

শালগম চাষে জমি অধিক আলো যুক্ত হতে হবে। শালগম চাষে সাধারণত বেলে দোআঁশ মাটি বেশি উপযোগী।

শালগম চাষের সময়:

শালগম চাষ করার উপযুক্ত সময় হলো রবি মৌসুম। শালগম গাছ বৃষ্টিপাত সহ্য করতে পারে না। চারা কচি অবস্থায় যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই শালগম এমন সময় চাষ করতে হবে যখন বৃষ্টি পাত না হয়। সাধারণত নভেম্বর মাসের প্রথম থেকে ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত শালগমের বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।

শালগম চাষের জন্য জমি তৈরি:

জমিতে বীজ বপন করার আগে জমি ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হবে। জমিতে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। তারপর বীজ বপন করতে হবে।

শালগম চাষের জন্য বীজ প্রস্তুত:

উন্নত ফলন পেতে হলে ভালো মানের বীজ বাছাই করতে হবে। বীজগুলো ৫% লবণের দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তাহলে নিম্নমানের বীজগুলো ভেসে উঠবে এবং ভালো বীজগুলো দ্রবণের নিচে থাকবে। এভাবে ভালো বীজ বাছাই করা যাবে।

শালগম চাষের জন্য বীজ শোধন:

বীজ বপন করার আগে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ শোধন করে নিলে বীজ বাহিত রোগ দ্বারা ফসল আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। বীজগুলো প্রথমে একটু বেশি গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর একবারে খুব ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া বীজগুলো পটাসিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট দ্রবণেও ভিজিয়ে নিয়ে শোধন করা যাবে।

শালগম চাষের জন্য বীজ বপন:

বীজ বপন করে আবার চারা রোপণ করে শালগমের চাষ করা যায়। তবে চারা রোপণ করতে গেলে অনেক সময় প্রধান শেকড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই চারা রোপণ পদ্ধতি না ব্যবহার করাই ভালো। ভালো মানের বীজ বপন করার ৪০-৫০ দিনের মধ্যেই ফসল সংগ্রহের উপযোগী হয়ে থাকে। বীজ সারিতে বপন করতে হবে। এক সারি থেকে আরেক সারির দূরত্ব হবে ৩০ সেমি। এক চারা থেকে আরেক চারার দূরত্ব হবে ২০ সেমি।

শালগম চাষের জন্য বীজের হার:

বীজ বপন করলে এক শতক জমিতে ১২ গ্রাম চারা প্রয়োজন হতে পারে। চারা রোপণ করলে এক শতক জমিতে ২.৫ গ্রাম চারা করা যেতে পারে।

শালগম চাষের জন্য সার ব্যবস্থাপনা:

উন্নত ফলন পেতে হলে জমিতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে। এক হেক্টর জমিতে গোবর দিতে হবে ১০ টন, ইউরিয়া সার ১৫০ কেজি, টিএসপি দিতে হবে ১২৫ কেজি, পটাশ দিতে হবে ১৭৫ কেজি। তবে যদি আগাম জাত চাষ করা হয়ে থাকে তাহলে ফসল লাগানোর সময় সব সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। আর নাবি জাত চাষ করলে ইউরিয়া সার ও পটাশ সার জমিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপন করার ৩০ দিন পর প্রথম কিস্তি সার প্রয়োগ করতে হবে। তখন ইউরিয়া দিতে হবে ১৫০ গ্রাম ও এমওপি দিতে হবে ১৫০ গ্রাম। আর বীজ বপন করার ৪৫ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি দিতে হবে আরও ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১৫০ গ্রাম এমওপি। প্রতিবার সার প্রয়োগ করার পর জমিতে সেচ দিতে হবে।

শালগম চাষে সেচ প্রয়োগ:

উন্নত ফলন পেতে হলে জমিতে সেচ দিতে হবে। সেচ দেওয়ার পর জমিতে জো আসলে মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। জমিতে চারা রোপণ করার পর প্রয়োজন অনুযায়ী এক সপ্তাহে দুটি সেচ দিতে হবে। তারপর ৭-১০ দিন পর পর সেচ দিলে হবে। জমিতে সেচ ঠিকমত দিতে হবে কারণ ফসলের আর্দ্রতা মাটির আর্দ্রতার ওপর নির্ভর করে। জমিতে জলের পরিমাণ কম হলে ফলগুলো তিতা স্বাদ যুক্ত হয়ে যেতে পারে। আবার পানি বেশি হলে ফলের স্বাদ নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং পানি জলময় হয়ে যেতে পারে। তাই শালগম চাষে মাটিতে জলের পরিমাণ ঠিক রাখা খুব জরুরি।

আগাছা দমন: জমির আগাছা ঠিক মত পরিষ্কার করে দিতে হবে। জমিতে আগাছা জমে থাকলে ফসলের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। জমি নিড়ানি দিয়ে গোঁড়া আলগা করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গোঁড়ায় মাটি দিয়ে দিতে হবে।

রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা: শালগম চাষে কাটুই পোকা ক্ষতিকারক। এ পোকা চারা গাছ কেটে নষ্ট করে ফেলে। তাই এ পোকা দমন করার জন্য ৫ লিটার জলে ১.৫ চা চামচ পরিমাণ ডায়াজিনন নিয়ে মিশাতে হবে। তারপর তা স্প্রে করতে হবে জমিতে। এ ছাড়া জাব পোকা, শুয়ো পোকা ও গাছের পাতা খেয়ে পাতা নষ্ট করে ফেলে। এর জন্য ম্যালাথিয়ন পরিমিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ: শালগম বেশি পরিপক্ব হয়ে গেলে বাজারে আনা যাবে না। তখন সে সব শালগমের মূল আঁশ যুক্ত হয়ে যায় এবং ফসল স্বাদহীন হয়ে যায়। সাধারণত বীজ বপন করার ৪৫-৬০ দিনের মধ্যেই শালগম খাওয়ার উপযু্ক্ত হয়ে থাকে।

শালগম এর ফলন:

এক শতক জমিতে প্রায় ১০০-১২০ কেজি শালগম এর ফলন হয়ে থাকে।

ধুন্দল চাষ পদ্ধতি ও জাত পরিচিতি

ধুন্দল চাষ পদ্ধতি ও জাত পরিচিতি , বাংলাদেশে ধুন্দল (Sponse gourd) চাষ করা হয় সাধারণত সবজি হিসেবে খাওয়ার জন্য। যার বৈজ্ঞানিক নাম Luffa cylindrica এবং পরিবার Cucurbitaceae। আমাদের দেশে দুই ধরনের ধুন্দল পাওয়া যায়। একটি হলো সাধারণত আমরা যেটা খাই। এর শাঁস তিতা নয়, সুস্বাদু এবং নরম। অন্যটি হলো বন্য ধুন্দল, যাকে তিতপল্লা বলা হয়। এর পাকা ফল শুকিয়ে স্পঞ্জের মতো গায়ে সাবান মাখার খোসা তৈরি করা হয়।

ধুন্দল চাষ পদ্ধতি ও জাত পরিচিতি

ধুন্দল চাষ প্রক্রিয়া:

ধুন্দল চাষের জমি:

ধুন্দল চাষে জমির প্রথম শর্ত হচ্ছে উঁচু, পানি জমে থাকে না, গাছের কোনও ছায়া থাকে না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ ধুন্দুল চাষের জন্য উত্তম। মাটি উর্বর এবং সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ধুন্দল চাষের জন্য বীজের পরিমাণ:

বিঘা প্রতি ৩৩০-৪০০ গ্রাম (শতক প্রতি ১০-১২ গ্রাম) বীজের প্রয়োজন।

ধুন্দল চাষের জন্য জমি প্রস্তুতকরণ:

জমি ৩- ৪ বার ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে ধুন্দুল চাষের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। জমির মাটি ভালো করে আগাছামুক্ত ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। এরপর ১ ফুট গভীর, ২.৫ ফুট লম্বা এবং ২.০ ফুট চওড়া করে মাদা তৈরি করতে হবে। এক মাদা থেকে অপর মাদার দূরত্ব হবে ৮-১০ ফুট। জমির চেয়ে মাদা কমপক্ষে ৫-৬ ইঞ্চি উঁচু করে তৈরি করতে হবে।

ধুন্দলের বীজ বপন:

বীজ বোনার আগে দেড় থেকে দুদিন ভিজিয়ে রেখে মাদা প্রতি ৪-৫টি বীজ।

ধুন্দল চাষে সার ব্যবস্থাপনা:

ধুন্দলের ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি শতাংশ (ডেসিমাল) জমির জন্য নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে:-

ধুন্দল চাষের জন্য সার প্রয়োগ পদ্ধতি:

সমুদয় গোবর, অর্ধেক টিএসপি ও পটাশ শেষ চাষের সময়। বাকি টিএসপি, পটাশ, সম্পূর্ণ জিপসাম ও অর্ধেক ইউরিয়া মাদার গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

ধুন্দল চাষে অন্যান্য প্রযুক্তি:

ধুন্দল চাষে সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা:

মাটির অবস্থার ওপর ভিত্তি করে জমিতে সেচ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে জমিতে যেন অতিরিক্ত পানি না জমে থাকে। থাকলে তা বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

ধুন্দল পরিচর্যা:

প্রতি মাদায় ৩-৪টি সুস্থ-সবল গাছ রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে। গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে জমিতে গাছের গোঁড়ার পাশে বাঁশের কুঞ্চী বা কাটি পুতে দিতে হবে। যাতে করে মাচায় বা জাংলায় সহজে উঠতে পারে। জমিতে মাচা ৩-৪ ফুট উঁচু করে দিলে ভালো হয়। জমিতে আগাছা জন্মালে পরিষ্কার করে দিতে হবে। ১৫-২০ দিন র পর প্রতি মাদায় ৫০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

ধুন্দল চাষে পোকামাকড় ও রোগবালাই:

ধুন্দলের গাছে অনেক ধরনের রোগ হয়ে থাকে। রোগাক্রান্ত ও মরা পাতা সংগ্রহ করে পুঁতে ফেলতে হবে। ফল ছিদ্রকারী পোকা ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এ পোকার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। চারা অবস্থায় রেড পাম্পকিন বিটিল চারার পাতা ঝাঁঝরা করে খেয়ে ক্ষতি করে। চারার কচি পাতা ও মাথা খেয়ে এরা ক্ষতি করে। ছাই ছিটিয়ে বা মশারির জাল দিয়ে বীজতলায় চারা ঢেকে রেখে এ পোকার আক্রমণ হতে রক্ষা করা যায়। এ ছাড়া কাঁটালে পোকাও গাছে আক্রমণ করে থাকে।

ধুন্দল ফল সংগ্রহ:

বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ শুরু করা যায়। শরৎকাল পর্যন্ত ধুন্দল তোলা যায়। ফল বোঁটা কেটে সংগ্রহ করতে হবে। খাওয়ার জন্য কচি থাকতেই সবুজ রঙের ধুন্দল তুলতে হবে। খোসা শক্ত হয়ে এলে তা আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।

ধুন্দল ফলন:

রোগমুক্ত, উন্নত জাতের বীজ, আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও সঠিক নিয়ম অনুযায়ী চাষ করলে শতক প্রতি ১২০-১৪০ কেজি এবং একরপ্রতি ১২-১৪ টন ফলন পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও হেক্টর প্রতি ৫০ হাজার ধুন্দুল উৎপাদন করা সম্ভব।