Category Archives: বাউবি উচ্চ মাধ্যমিক

বাউবি উচ্চ মাধ্যমিক

ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ইকোসিস্টেম

ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ইকোসিস্টেম , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ১ নং ইউনিটের ১.৫ নং পাঠ।

ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ইকোসিস্টেম

কোন জীবই পৃথিবীতে অবিমিশ্র অবস্থায় বাস করতে পারে না। প্রায় সকল জীবই একদিকে তার পরিবেশ অন্যদিকে অন্যান্য জীবের সাথে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। বিভিন্ন জাতের জীবের এরূপ সমষ্টিগত বসবাসরীতিকে জীব—স¤প্রদায়  বলে। আবার জীব—সম্প্রদায় এবং অজৈব পরিবেশের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া—বিক্রিয়া দ্বারা একটি অবিচ্ছেদ্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয় যার নাম ইকোসিস্টেম। এ.জি. টেনসলি (১৯৩৫) নামে একজন বৃটিশ পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। পরে সুকাচেভ নামক একজন রুশ পরিবেশ বিজ্ঞানী এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ইকোসিস্টেম হচ্ছে একটি গতিময় পদ্ধতি যেখানে জীব ও জড় উপাদানের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়াবিক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের গঠন ও কার্যের পরিবর্তন ঘটছে।

 

ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা :

ইকোসিস্টেম (Ecosystem) একটি ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা প্রতিশব্দ বাস্তুতন্ত্র। বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম হচ্ছে জৈব, অজৈব পদার্থ ও বিভিন্ন জীবসমন্বিত এমন প্রাকৃতিক একক যেখানে বিভিন্ন জীবসমষ্টি পরস্পরের সাথে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে।

ই. পি. ওডামের মতে:

ইকোসিস্টেম বলতে জীব, প্রকৃতি ও তাদের আনুষঙ্গিক উপাদানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিক্রিয়ার মূল কার্যকর একককে বুঝায়। কিন্তু, এস. মাথাভান (১৯৭৪) এর মতে, জীব ও তার পরিবেশ নিজেদের মধ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া—বিক্রিয়ার পদ্ধতিকে ইকোসিস্টেম বলে।

 

 

 

 

ইকোসিস্টেমের কার্য পদ্ধতি :

ইকোসিস্টেমে উদ্ভিদ, প্রাণী ও তাদের পরিবেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত সম্পদ সৃষ্টি ও বিনিময় ঘটছে। এই প্রক্রিয়াকে সম্পদের আবর্তন (ঈুপষরহম ড়ভ সধঃবৎরধষং) বলে। এই আবর্তন প্রক্রিয়ায় সকল শক্তির উৎস সূর্য। একমাত্র সবুজ উদ্ভিদ সৌর শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম। এভাবে সঞ্চিত শক্তি খাদ্য হিসেবে এক জীব থেকে অন্য জীবে স্থানান্তর হয় এবং সেখান থেকে আবার অন্য জীবে স্থানান্তরিত হতে থাকে। প্রতিটি খাদ্য স্থানান্তরের ধাপকে খাদ্য স্তর (ঞৎড়ঢ়যরপ ষবাবষ) বলে। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরেই অবশ্য কিছুটা শক্তির অপচয় ঘটে। এই সমগ্র পদ্ধতির নাম শক্তির প্রবাহ (ঋষড়ি ড়ভ বহবৎমু)। ইকোসিস্টেমে জীব ও জড়ের মধ্যে শক্তি প্রবাহ বহমান থাকায় একে গতিশীল বলে মনে করা হয়।

 

ইকোসিস্টেমের উপাদান :

কার্যপ্রণালির দিক বিবেচনায় ইকোসিস্টেমের উপাদান সম হকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এর এক দিকে রয়েছে অটোট্রফিক বা স্বভোজী যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপন্ন করতে সমর্থ, যেমনঃ সবুজ উদ্ভিদ। আবার অন্যদিকে আছে হিটারোট্রফিক বা পরভোজী যারা খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না বলে খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল, যেমনঃ মানুষসহ অন্যান্য সকল প্রাণী। কিন্তু গঠনগত দিক বিবেচনায় ইকোসিস্টেমের উপাদানগুলিকে জড় ও জৈবিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

 

১। জড় উপাদান: 

ইকোসিস্টেমের জড় উপাদানগুলো সাধারণত দু’ধরনের হয়ে থাকে। এর একদিকে রয়েছে মাটি, পানি, খাদ্য, কার্বন—ডাই—অক্সাইড, নাইট্রেজেন, ফসফরাস, প্রভৃতি মৌলিক ও যৌগ দ্রব্যসমূহ এবং অন্যদিকে রয়েছে আলো, তাপ ইত্যাদি শক্তিসমূহ। এগুলি উদ্ভিদ দ্বারা গৃহীত হয় এবং সূর্যালোকের সাহায্যে খাদ্যে রূপান্তরিত হয়। আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীবের সাহায্যে মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ পঁচনের ফলে পুনরায় মাটি ও বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়াকে জীব—ভূ—রাসায়নিক চক্র (ইরড়মবড়পযবসরপধষ পুপষব) বলা হয়। তবে প্রতিটি উপাদানেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং স্থান—কালভেদে পরিবর্তনশীল যা জীবের প্রাচুর্য ও বিস্তৃতিকে প্রভাবিত করে।

 

২। জৈবিক উপাদান:

পরিবেশের জৈবিক উপাদানসমূহকে চারটি প্রধান অংশে ভাগ করা যায়, এরা হচ্ছে উৎপাদক, খাদক, বিয়োজক ও রূপান্তরক।

(ক) উৎপাদক 

এরা সাধারণভাবে নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে পারে। এজন্য এদরেকে বলা হয় স্বভোজী (অঁঃড়ঃৎড়ঢ়যং)। সবুজ উদ্ভিদ পত্রস্থ ক্লোরোফিলের সাহায্যে সৌর শক্তিকে পানি ও কার্বন—ডাই—অক্সাইডযোগে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে জৈব খাদ্য উৎপাদন করে। এই খাদ্য উদ্ভিদ নিজে ব্যবহার করে এবং অন্যদের খাদ্যের যোগান দেয়। সবুজ উদ্ভিদ ছাড়াও কিছু কেমোসিনথেটিক ব্যাকটেরিয়া এবং বেগুনি রংএর ক্যারোটিনযুক্ত ব্যাকটেরিয়া সূর্যালোক ও যৌগিক পদার্থের উপস্থিতিতে নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে। এজন্য এদেরকেও প্রাথমিক উৎপাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

(খ) খাদক 

যে সকল জীব নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে না বরং খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎপাদকের উপর নির্ভরশীল তাদেরকে খাদক বলে। যে সকল প্রাণী একমাত্র উদ্ভিদকেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদেরকে প্রাথমিক খাদক বলে। যেমনঃ ফড়িং, প্রজাপতি, কীট—পতঙ্গ, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হরিণ, খরগোশ ইত্যাদি। আবার কিছু প্রাণী আছে যারা সরাসরি খাদ্য হিসেবে উদ্ভিদ গ্রহণ না করে তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে। সেইজন্য এদেরকে দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদক বা গৌণ খাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যেমনঃ ব্যাঙ, সাপ, কাক, চিল ইত্যাদি প্রাণী। আবার কিছু কিছু মাংসাশী প্রাণী আছে যারা অন্য প্রাণীকতৃর্ক খাদ্যরূপে গৃহীত হয় না। এদেরকে সর্বোচ্চ খাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেমনঃ বাঘ, সিংহ, বাজপাখি, কুমির, হাঙ্গর ইত্যাদি। কিছু কিছু প্রাণী আছে যারা অবশ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়কেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে থাকে। এদেরকে বলা হয় সর্বভূক প্রাণী, যেমনঃ মানুষ।

(গ) বিয়োজক

যে সকল অণুজীব মৃত জীবদেহে অবস্থিত জৈব পদার্থগুলিকে ধাপে ধাপে ভেঙ্গে সরল পদার্থে রূপান্তরিত করে তাদেরকে বিয়োজক বলে। যে সকল অণুজীব মৃত জীবদেহে অবস্থিত জৈব পদার্থগুলিকে ধাপে ধাপে ভেঙ্গে সরল পদার্থে রূপাš রিত করে তাদেরকে বিয়োজক বলে। ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া বিয়োজকের পর্যায়ভুক্ত। এদের প্রভাবেই প্রাণীদেহের জৈব পদার্থগুলি উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী অজৈব পদার্থে রূপাš রিত হয়। বিয়োজকদেরকে অনেক সময় খাদক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কেননা জৈব পদার্থকে সরল পদার্থে পরিণত করার সময় এরা জৈব পদার্থ থেকে শক্তি সঞ্চয় করে থাকে।

 

(ঘ) রূপান্তরক 

যে সকল ব্যাকটেরিয়া পঁচনের ফলে উৎপন্ন বস্তুর উপর ক্রিয়ার দ্বারা সেগুলিকে জৈব ও অজৈব পদার্থে রূপান্তরিত করে তাদেরকে রূপান্তরক বা ট্রান্সফরমার বলে। বিয়োজক ও ট্রান্সফরমারগুলো ইকোসিস্টেমের গতিময়তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এদের ক্রিয়া—কর্মের ফলেই জৈব ও অজৈব উপাদানসমূহ জৈব—ভূ—রাসায়নিক চক্রের মাধ্যমে আদি অবস্থানে ফিরে যায়। অন্যথায়, পৃথিবীর সকল ইকোসিস্টেমই মৃত জৈব উপাদানের আধিক্যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেত।

 

খাদ্য – শিকল 

প্রকৃতিতে একমাত্র সবুজ উদ্ভিদই নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে অর্থাৎ তারা স্বভোজী। অন্যসব জীবকে খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপরই নির্ভর করতে হয়। উদ্ভিদ যে খাদ্য তৈরি করে তার কিছু অংশ নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করে, বাকি অংশ তার দেহে সঞ্চিত করে রাখে। এই সঞ্চিত খাদ্যই তৃণভোজী প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার মাংসাশী প্রাণীরা তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এভাবে সকল জীব খাদ্য ও খাদক সম্পর্ক স্থাপন করে ইকোসিস্টেমে শক্তি প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখে এবং এর মধ্য দিয়ে উৎপাদক ও সর্বোচ্চ খাদক পর্যন্ত খাদ্যের যে ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয় তার নাম খাদ্য—শিকল ।

 

একটি খাদ্য—শিকলে উৎপাদকের সাথে কয়েকটি পর্যন্ত খাদক স্তর থাকতে পারে, তবে সর্বোচ্চ খাদককে কোন প্রাণী খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে না। প্রকৃতিতে সাধারণত তিন ধরনের খাদ্য—শিকল দেখা যায়—

(১) শিকারজীবী শিকল :

এই খাদ্য—শিকলে উৎপাদক থেকে প্রথমে ছোট প্রাণী, পরে ক্রমান্বয়ে বড় প্রাণী যুক্ত হয়। যেমনঃ

  • ঘাস
  • ফড়িং
  • ব্যাঙ
  • সাপ

(২) পরজীবী শিকল :

এখানে বড় জীব থেকে ক্রমান্বয়ে ছোট জীবের মধ্যে খাদ্য—শিকল গড়ে উঠে, যেমনঃ

  • মানুষ
  • মশা
  • ম্যালেরিয়ার জীবাণু

(৩) মৃতজীবী শিকল :

এখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃতদেহের উপর ভিত্তি করে খাদ্য—শিকল গড়ে ওঠে, যেমনঃ

  • মৃতদেহ
  • ছত্রাক
  • কেঁচো

 

খাদ্য – জাল 

প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমে খাদ্য—শিকলগুলো সকল সময় সরল পথে চলে না অর্থাৎ প্রয়োজনবোধে প্রাণীর খাদ্য স্তরের পারস্পরিক বিনিময় ঘটে। যেমনঃ একটি কাক সরাসরি গাছের ফলকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে অথবা তৃণভোজী কীট—পতঙ্গকে খাদ্য হিসেবে বেছে নিতে অথবা কীট—পতঙ্গকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণকারী অন্য কোন প্রাণীকেও তার খাদ্য—সামগ্রীর অšর্Íভূক্ত করতে পারে। এভাবে একটি ইকোসিস্টেমে বিভিন্ন খাদ্য—শিকলের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় ও সংযুক্তির মাধ্যমে যে জটিল সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার নাম খাদ্য—জাল। সাধারণত খাদ্য—জালে উৎপাদকের সংখ্যা অধিক থাকলেও খাদকের সংখ্যা প্রতিস্তরে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে থাকে।

চিত্র ১.২—২ খাদ্য—জাল

 

যে কোন ইকোসিস্টেমে প্রাথমিক উৎপাদক প্রথম স্তরের খাদক, দ্বিতীয় স্তরের খাদক, তৃতীয় স্তরের খাদক এবং এভাবে সর্বোচ্চ খাদকের সংখ্যা ভর এবং শক্তির মধ্যে কোন না কোন ভাবে একটি সম্পর্ক বজায় থাকে। খাদ্যস্তরগুলির মধ্যে এই সম্পর্ককে লৈখিক চিত্র অঙ্কন দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব, যা ইকোলোজিক্যাল পিরামিড নামে পরিচিত। ইকোলোজিক্যাল পিরামিডগুলো তিন ধরনের হয়ে থাকে (ক) সংখ্যার পিরামিড, (খ) জীবভরের পিরামিড এবং (গ) শক্তির পিরামিড। সংখ্যা ও জীবভরের পিরামিডের আকৃতি খাড়া বা উল্টানো অথবা অন্য কোন ধরনের হতে পারে, কিন্তু শক্তির পিরামিড সর্বদাই খাড়া আকৃতির হয়ে থাকে।


ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মঙ্গলের জন্যই ইকোসিস্টেম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। সবুজ উদ্ভিদ ঈঙ২, পানি, খাদ্য উপাদান ইত্যাদি ব্যবহার করে সূর্যালোকের সাহায্যে শ্বেতসারজাতীয় খাদ্য উৎপাদন করছে। এই উৎপাদনের ফলেই উদ্ভিদের আঙ্গিক ও দৈহিক বৃদ্ধি ঘটছে। মানুষসহ সকল প্রাণীর জীবনচক্র চালু রাখার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খাদ্য হিসেবে উদ্ভিদকর্তৃক উৎপাদিত উপাদানের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়। এ কারণেই সব ধরনের ইকোসিস্টেম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা এত তাৎপর্যপূর্ণ।

 

পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা

পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা- নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ১ এর ১.১ নং পাঠ।

পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা

 

পরিবেশের ধারণা পরিবেশ কথাটি বহুলভাবে ব্যবহৃত, যেমনঃ সামাজিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি আরও অনেক পরিবেশ। তবে পরিবেশ বিজ্ঞান জীব বিজ্ঞানেরই একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ও আধুনিকতম সংকলন যেখানে জীবের সাথে তার পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিজ্ঞানের যে শাখা জীবের পারিপার্শি¦কতার সাথে জীবকূলের প্রতিটি পারস্পরিক ক্রিয়া—বিক্রিয়া নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করে তাই পরিবেশ বিজ্ঞান।

পরিবেশের সাথে প্রাণীজগতের সম্পর্ক নিয়ে আলোচিত বিদ্যাকে ইকোলজি বলা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী পরিবেশের নানাবিধ সংজ্ঞা দিয়েছেন। যার উৎপত্তি ও বিস্তৃতি ব্যাপক বিধায় স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে বহুল প্রচলিত ও সমাদৃত কয়েকটি সংজ্ঞা এখানে দেওয়া গেল।

 

পরিবেশ বিজ্ঞানের সংজ্ঞা :

(১) জৈব ও অজৈব পরিবেশের সাথে প্রাণীর অনাবিল সম্পর্ককেই পরিবেশ বিজ্ঞান বলে,  হেকেল, ১৮৬৯।

(২) পরিবেশের সাথে জীবের সম্পর্ক নিয়ে যে বিজ্ঞান অনুসন্ধান চালায় তাই পরিবেশ বিজ্ঞান। এটি জ্ঞানের এমন একটি দর্শন যেখানে জীবজগতকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়  উডবারি, ১৯৫৫।

(৩) জীবক লের প্রাচুর্য ও বিস্তার সম্পর্কিত সুনিদিষ্ট গবেষণাই পরিবেশ বিজ্ঞান  এন্ড্রিয়ার্থা, ১৯৬১।

(৪) পরিবেশ বিজ্ঞান হচ্ছে পরিবেশের আন্তঃক্রিয়াদির অধ্যয়ন যা জীবের বিস্তার, উৎপাদন প্রাচুর্য ও অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে এবং মঙ্গল সাধন করে  পেট্রিডিস, ১৯৬৮।

(৫) প্রকৃতির গঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে অধ্যয়নই হচ্ছে পরিবেশ বিজ্ঞান  ওডাম, ১৯৭১।

(৬) জীবের প্রাচুর্য ও বণ্টন নির্ণয়কারী আন্তঃক্রিয়াদির বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনাই হচ্ছে পরিবেশ বিজ্ঞান  ক্রেব, ১৯৭২।

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর সার সংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, আমাদের চার পাশে যা কিছু আছে এবং যা কিছুই আমাদের জীবনধারাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তাই আমাদের পরিবেশ।

 

পরিবেশের উপাদান :

সাধারণভাবে পরিবেশ বলতে জীবের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেই বুঝায়। তবে পরিবেশ আসলে একটি জটিল পদ্ধতি যা বহুবিধ উপাদানের সমষ্টি নিয়ে গঠিত। বাহ্যিক যে সকল বস্তু বা উপাদান জীবকে ঘিরে রেখেছে এবং যা জীবকে তার বিকাশ ও বিস্তারে প্রভাবিত করে তাই পরিবেশের উপাদান। এই উপাদানগুলো সজীব ও জড় উভয়বিধই হতে পারে। পরিবেশের মৌলিক উপাদানসমূহকে পরবতীর্ পৃষ্ঠায় ছকে দেখানো হলো।

 

পরিবেশের উপাদানসমূহের আন্তঃক্রিয়া:

প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশেষ কোন একক উপাদানের চেয়ে উপাদানসমুহের সমষ্টিগত প্রভাব জীবের উপর বেশি অবদান রাখে। এর কারণ এই যে, উপাদানগুলো পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। পরিবেশের কোন একটি উপাদানের তারতম্য ঘটলে অন্য উপাদানের ক্রিয়াকান্ডও তাদ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায় যা ঐড়ষড়পড়বহড়ঃরপ প্রভাব বলে খ্যাত। যেমনঃ সূর্যালোকের প্রখরতা বাড়লে উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার বৃদ্ধি পায়। প্রস্বেদন হার বাড়লে বিপাকীয় কাজ প্রভাবিত হয় ইত্যাদি।

বিভিন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী পরিবেশের উপাদানগত শ্রেণিবিন্যাস বিভিন্নভাবে দিয়ে থাকলেও অধিকাংশের মতে চারটি ভাগের উপরই প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে।

১। জলবায়ুগত উপাদান

(ক) আলো :

এ পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবনকে কার্যকর রাখার জন্য সকল শক্তির উৎস সৌর শক্তি। সবুজ উদ্ভিদ পত্রস্থ ক্লোরোফিলের সাহায্যে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আলোকশক্তি শোষণ করে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে এবং শর্করাজাতীয় খাদ্য উৎপাদন করে তাকে সালোক—সংশ্লেষণ বলে।

সালোক—সংশ্লেষণ বিবর্জিত উদ্ভিদের অস্তিত্ব যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি উদ্ভিদ ছাড়া অন্য প্রাণীর জীবন ধারণও প্রায় অসম্ভব। আর এসবই হচ্ছে আলোক শক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সালোক—সংশে­ষণ ছাড়াও উদ্ভিদের গঠন, আকৃতি, পত্রবিন্যাস, পাতার পুরুত্ব, ক্লোরোফিলের পরিমাণ, প্রস্বেদন, পুষ্পায়ন এবং আরও বহুবিধ জৈবিক কার্যাবলী আলো দ্বারা সংঘটিত বা প্রভাবিত হয়। পৃথিবীতে পতিত আলোক রশ্মির তীব্রতা ও স্থায়ীত্ব, ঋতুভেদ, অক্ষাংশ, ভূমির ঢাল ও দিক, বায়ুমন্ডলের স্বচ্ছতা, আর্দ্রতা, কুয়াশা, মেঘ ইত্যাদি উপকরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

যে সকল উদ্ভিদ তীব্র আলোতে ভাল জন্মে (যেমনঃ ধান, পাট, গম, আম, তূলা ইত্যাদি) তাদেরকে আলো পছন্দকারি উদ্ভিদ বা হেলিওফাইট বলে। আবার যে সকল উদ্ভিদ ছায়াযুক্ত স্থানে জন্মানো পছন্দ করে (যেমনঃ ফার্ণ, পান, বনের নিম্নস্তরের লতাগুল্ম ইত্যাদি) তাদেরকে ছায়া পছন্দকারি উদ্ভিদ বা সাইওফাইটস বলে।

(খ) তাপমাত্রা :

উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে তাপমাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সকল বিপাকীয় কার্যক্রম, যেমনঃ সালোক—সংশ্লেষণ, শ্বসন, পরিশোষণ, অঙ্কুরোদগম, প্রস্বেদন, অভিস্রবন ইত্যাদি পরিবেশীয় তাপমাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাপমাত্রা কম বা বেশি হলে বিপাকীয় কার্যাবলীর উপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বেঁচে থাকার জন্য সকল উদ্ভিদের একটি সর্বোচ্চ শ্বসণ , পরিমিত  ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রয়েছে, যাকে কার্ডিনাল তাপমাত্রা বলা হয়। কোন আবাসস্থলে উদ্ভিদের বিস্তৃতি তার কার্ডিনাল তাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

যেমনঃ ধান গাছের অভিযোজন সর্বোচ্চ ৪০০ সে. এবং সর্বনিম্ন ৫০ সে. তাপমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ কিন্তু পরিমিত বা অনুকূল তাপমাত্রা ২০—৩০০ সে. এর মধ্যে। তাই উদ্ভিদের ভৌগলিক বিস্তৃতি তাপমাত্রার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাপমাত্রার তারতম্যের উপর নির্ভর করে উদ্ভিদসম হকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ঃ

(১) মেগাথার্ম — যে সকল উদ্ভিদ অতি উচ্চ তাপমাত্রা সম্পন্ন অঞ্চলে জন্মায়।

(২) মেসোথার্ম — এরা মূলত উষ্ণ প্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ। তবে বাৎসরিক ঋতুভেদে অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতাও সহ্য করতে পারে।

(৩) মাইক্রোথার্ম — এরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উদ্ভিদ বলে বছরের বেশির ভাগ সময়ই অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতা সহ্য করতে পারে।

(৪) হেকিস্টোথার্ম — এরা মেরু অঞ্চলের উদ্ভিদ, সারা বছর নিম্ন তাপমাত্রা সহনশীল।

অনুশীলন  ঃ আলো ও তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাস করুন। আপনার পরিচিত উদ্ভিদগুলোকে উল্লিখিত শ্রেণিবিন্যাসে বিভক্ত করুন।

বায়ুতে অবস্থিত ঈঙ২ গ্যাস উদ্ভিদের সালোক—সংশ্লেষণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে এর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য
দায়ী।

 

(গ) বায়ু :

বায়ু প্রবাহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিস্তৃতি প্রভাবিত করে। অনেক উদ্ভিদের বীজ একস্থান হতে অন্যস্থানে বায়ু দ্বারা স্থানান্তরিত হয়ে উদ্ভিদের বংশ বিস্তার ঘটায়। বহু উদ্ভিদের পরাগায়ণ বায়ুর মাধ্যমে হয়ে থাকে। মৃদু বায়ুতে উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার কম। কিন্তু প্রবল বায়ুতে তা বৃদ্ধি পেয়ে উদ্ভিদের পানির চাহিদা বাড়িয়ে তোলে। প্রবল বায়ু দ্বারা সংঘটিত জটিলতার মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের আকৃতিগত বিকৃতি, ভেঙ্গে পড়া, ঘর্ষণজনিত ক্ষতিসাধন, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি। এ ছাড়া বহু রোগের জীবাণু বায়ুবাহিত হয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর রোগের কারণ ঘটায়। বায়ুতে অবস্থিত ঈঙ২ গ্যাস উদ্ভিদের সালোক—সংশ্লেষণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে এর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য দায়ী।

 

(ঘ) বায়ুর আর্দ্রতা :

বায়ুর জলীয় আর্দ্রতাকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। কোন বায়ুতে অবস্থিত জলীয়—বাষ্পের বর্তমান অবস্থা এবং একই বায়ু সম্পৃক্ত হলে কতটুকু জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা রাখে তার অনুপাতকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বলে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা শতকরা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা কম—বেশির সাথে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও কম—বেশি হয়। উষ্ণতা বাড়লে আপেক্ষিক আর্দ্রতা কমে। আবার উষ্ণতা কমলে আপেক্ষিক আপেক্ষিক আর্দ্রতা উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার নিয়ন্ত্রণ করে বলে কোন্ অঞ্চলে কী ধরনের উদ্ভিদ জন্মাবে তা সে অঞ্চলের আপেক্ষিক আর্দ্রতার ওপর বহুলাংশে ি নর্ভরশীল।

আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার নিয়ন্ত্রণ করে বলে কোন্ অঞ্চলে কী ধরনের উদ্ভিদ জন্মাবে তা সে অঞ্চলের আপেক্ষিক আর্দ্রতার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। অনেক উদ্ভিদ আছে যারা শুষ্ক আবহাওয়ায় সংবেদনশীল কিন্তু আর্দ্র আবহাওয়ায় সহজেই জন্মাতে পারে। এদেরকে হাইগ্রোফাইটস বলে। যেমনঃ রাস্না, ঢেঁকিশাক ইত্যাদি।

 

(ঙ) বৃষ্টিপাত ও পানি :

উদ্ভিদ জীবনে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় যাবতীয় কার্যক্রম পানির মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। পানি সালোক—সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার অন্যতম উপাদান। পানির অবর্তমানে উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া চলতে পারে না। আর খাদ্য উৎপাদন ছাড়া উদ্ভিদের বেঁচে থাকার কথাই ভাবা যায় না। একারণেই পরিবেশীয় অন্যান্য উপাদান অপেক্ষা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদ বিস্তারের ক্ষেত্রে পানির তাৎপর্য অনেক বেশি।

কোন স্থানে উদ্ভিদের ধরন, ি বকাশ, বিস্তৃতি, ইত্যাদি নির্ভর করে সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ও পানির প্রাপ্যতার ওপর। কোন স্থানে উদ্ভিদের ধরন, বিকাশ, বিস্তৃতি, ইত্যাদি নির্ভর করে সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ও পানির প্রাপ্যতার উপর। আবার কোন এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নির্ভর করে অনেকটা উক্ত এলাকা সাগরের কতটা নিকটবর্তী, সাগর থেকে ভূমির দিকে প্রবাহিত বায়ুর গতিধারা, বায়ুতে জলীয় বাষ্পের প্রাচুর্যতা, অক্ষাংশ ইত্যাদির উপর। নিরক্ষীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বাধিক, পক্ষান্তরে মেরুঅঞ্চলের বৃষ্টিপাত সর্বনিম্ন।

 

উদ্ভিদ বাসস্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পানির প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে উদ্ভিদকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় :

 

(১) জলজ উদ্ভিদ :

যে সকল উদ্ভিদ জলজ পরিবেশে আংশিক বা সব সময় জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে জলজ উদ্ভিদ বলে। এরা নিমজ্জিত বা ভাসমান, মুক্ত বা নোঙ্গরাবদ্ধ হতে পারে, যেমনঃ কচুরীপানা, হাইড্রিলা, শেওলা, শাপলা ইত্যাদি। উভচর উদ্ভিদও জলজ উদ্ভিদের গোত্রেই পড়ে, যেমনঃ কলমী শাক এদের মূলকান্ড সুগঠিত নয়। অভিস্রবন চাপও খুব কম।

 

(২) সাধারণ উদ্ভিদ :

যে সকল উদ্ভিদ মাটিতে পরিমিত পানি থাকা অবস্থায় জন্মে তাদেরকে সাধারণ উদ্ভিদ বলে। এদের জীবন ধারণের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর প্রয়োজন। এদের জন্য জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা কোনটাই সহনীয় নয়, যেমনঃ গম, সরিষা, আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি। এদের মূল, কান্ড, শাখা—প্রশাখা সুগঠিত। অভিযোজন চাপ স্বাভাবিক।

(৩) মরুজ উদ্ভিদ :

যে সকল উদ্ভিদ শুষ্ক মাটিতে অথবা খুব কম বৃষ্টিপাত সম্পন্ন অঞ্চলে জন্মে তাদেরকে মরুজ উদ্ভিদ বলে। কম বৃষ্টিপাতসম্পন্ন এলাকায় জন্মে বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের পাতা, কান্ড, মূল, অভ্যন্তরীণ ও শারীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে প্রচুর রূপান্তর হয়ে থাকে। এদের উদাহরণ হচ্ছে — ফণিমনসা, ক্যাকটাস, করবি, খেজুর, ঝাউ, ঘৃত কুমারী ইত্যাদি।জোয়ার ভাটা বিধৌত সমুদ্রতীরবর্তী এ ধরনের উদ্ভিদকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলে, যেমনঃ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনের সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, গোলপাতা ইত্যাদি।

 

(৪) লোনা মাটির উদ্ভিদ :

যে সকল উদ্ভিদ লবণাক্ত পানি বা মাটিতে জন্মে তাদেরকে লোনা মাটির উদ্ভিদ বলে। এ সকল উদ্ভিদের পাতা প্রায়ই রসালো এবং ভূগর্ভস্থ মল ূ থেকে মাটির উপরে খাড়াভাবে শ্বাস—মূল দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জরায়ুজ—অঙ্কুরোদগম ঘটে এবং উচ্চ অভিস্রবন চাপ বিদ্যমান। জোয়ার ভাটা বিধৌত সমুদ্র তীরবর্তী এ ধরনের উদ্ভিদকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলে, যেমনঃ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনের সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, গোলপাতা ইত্যাদি।

২। মৃত্তিকাগত উপাদান

পরিবেশের মৃত্তিকাগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলী। মাটির গঠন, বুনট ইত্যাদি ভৌত গুণাবলী এবং মাটির অম্লত্ব, ক্ষারত্ব, লবণাক্ততা, খাদ্য উপাদান ইত্যাদি রাসায়নিক উপাদান দ্বারা উদ্ভিদের বর্ধন, বিকাশ ও বিস্তৃতি বহুলভাবে প্রভাবিত। মাটির পানি ধারণক্ষমতা তার ভৌত গুণাবলীর উপর নির্ভরশীল। অপরপক্ষে উদ্ভিদের খাদ্য সরবরাহের পরিমাণ মাটির রাসায়নিক গুণাবলীর উপর নির্ভরশীল। তাই সব মাটিতেই সব
উদ্ভিদ ভাল জন্মে না যেমনঃ ভারি মাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী, অপর দিকে হালকা দো— অঁাশ মাটি আখ, গম, সরিষা, ইত্যাদি চাষের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত।

 

৩। স্থান সংক্রান্ত উপাদান

স্থান সংক্রান্ত উপাদানের মধ্যে রয়েছে

(ক) ভূমির উচ্চতা ও বন্ধুরতা

(খ) অক্ষাংশ এবং

(গ) ভূমির ঢাল ও দিক।

(ক) ভূমির উচ্চতা ও বন্ধুরতা ঃ সাগর—পৃষ্ঠ থেকে ভূমি কত উচ্চতায় অবস্থিত অথবা ভূমির উপরিভাগের বন্ধুরতার ধরন উদ্ভিদ জীবনকে প্রভাবিত করে। কারণ এ দ্বারা আলো ও পানির প্রাপ্যতা এবং স্থানীয় জলবায়ু বহুলাংশে নির্ভরশীল।

(খ) অক্ষাংশ ঃ অক্ষাংশের অবস্থান, স্থানীয় জলবায়ু, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আলোর পরিমাণ ইত্যাদি আবহাওয়াগত উপাদানের নির্দেশক এবং এসবকিছু দ্বারাই উদ্ভিদ ও প্রাণী বিস্তার প্রভাবিত হয়। পৃথিবীর নিম্ন অক্ষাংশের মরু অঞ্চল উচ্চ তাপ ও পানির অভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী। আবার উচ্চ অক্ষাংশের মেরু অঞ্চল তীব্র শীত ও বরফজনিত কারণে বসবাসের অনুপযোগী।

(গ) ভূমির ঢাল ও দিক ঃ ভূমির ঢাল ও দিকের প্রভাব উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর বেশি অনুভূত হয় মধ্য ও উচ্চ অক্ষাংশে। নিম্ন অক্ষাংশে এর তেমন কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। কারণ সূর্য সারা বৎসরই এখানে লম্বভাবে কিরণ দিয়ে থাকে। ভূমির ঢালের মাত্রাও এখানে গুরুত্বপর্ণ, কারণ ু ঢালের পরিমাণ বেশি খাড়া হলে পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে তা উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য অনুকল নয়।

 

জৈবিক উপাদান

জীবকূলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রভাবকেই জৈবিক কারণ বলে। পরিবেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সকল প্রাণীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় বায়ুর যে ঈঙ২ গ্রহণ করে তা প্রাণীর শ্বসনজাত। পক্ষান্তরে প্রাণী নিঃশ্বাসের সাথে যে ঙ২ গ্রহণ করে তা উদ্ভিদের সালোক—সংশে­ষণ প্রক্রিয়ার উপজাত। প্রকৃতিতে উদ্ভিদ কর্তৃক ব্যবহৃত নাইট্রোজেনঘটিত খাদ্য ব্যাকটেরিয়া ও নীলাভ—সবুজ শৈবাল দ্বারা মাটিতে ধারণকৃত। তাছাড়া জীবকূলের মধ্যে রয়েছে সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা, মিথোজীবীতা, পরজীবীতা, পরাশ্রয়ীতা, ইত্যাদির মতো আরও অনেক ক্রিয়া কর্ম যা জীব সম্পর্কীয় উপাদানেরই অংশবিশেষ।

 

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.১ নং পাঠ।

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

কৃষি উন্নয়নে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অবদান অনস্বীকার্য। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সেসব দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শুধু শ্রম শক্তির লাঘবই করেনি বরং ফসলের উৎপাদন খরচ কমিয়ে তার ফলন ও গুনাগুণ বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। অল্প শ্রম, অল্প সময়, অল্প ব্যয় ও অধিক দক্ষতার সাথে খামারে কাজ করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে তুলনায় বাংলাদেশ এখনও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় রয়ে গেছে।

অল্প শ্রম, অল্প সময়, অল্প ব্যয় ও অধিক দক্ষতার সাথে খামারে কাজ করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জনসংখ্যার ক্রম বৃদ্ধির ফলে ফসলের জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। এই ক্রমবর্ধমান বাড়তি মুখের খাবার যোগান দিতে সীমিত জমিতে প্রচলিত শস্য চাষ রীতি পরিবর্তন করে উৎপাদন বর্ধক শস্য চাষ রীতি অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণসহ উন্নত চাষাবাদ প্রণালী অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

১৯২৮ সন হতে এ উপমহাদেশে আংশিক খামার যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। ১৯২৮ সনের “রাজকীয় কৃষি কমিশন”, ১৯৪৫ সনের “দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধানী কমিশন”, ১৯৫১ সনের “পাকিস্তান কৃষি অনুসন্ধানী কমিটি”, ১৯৬০ সনের “খাদ্য ও কৃষি কমিশন” এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা উত্তরকালে “খামার যান্ত্রিকীকরণ কমিটি” দেশে ভূমি কর্ষণ, সেচ ও শস্য সংরক্ষণ এ তিন বিষয়ে বিশেষভাবে যান্ত্রিকীকরণের সুপারিশ করে।

 

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কী?

কৃষিক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজে যন্ত্র শক্তির ব্যবহারকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। কৃষিক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজে যন্ত্রশক্তির ব্যবহারকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। এক্ষেত্রে যন্ত্রশক্তি বলতে মেশিন এবং ইঞ্জিন উভয়কে বোঝায়। যান্ত্রিকীকরণ দু’ধরনের হতে পারে পর্ণ এবং আংশিক। কৃষি ক্ষেত্রে সমুদয় কার্যাদি যখন যূ ন্ত্রশক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় তখন তাকে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ বলা হয়। পক্ষান্তরে ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ কতকগুলো কাজ যন্ত্রের সাহায্যে সম্পন্ন করলে তাকে আংশিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। বাংলাদেশের আবহাওয়া, কৃষকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় বর্তমানে এখানে আংশিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে।

 

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। সুবিধা, অসুবিধা এবং আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে দেশে কোন কোন ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব আছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

 

বীজ উৎপাদন খামারের জন্য

বীজ কৃষির অন্যতম প্রধান উপকরণ। উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় বিবিধ কারণে বীজের মান কমে যেতে পারে। এসব কাজ সাফল্যজনকভাবে কৃষি যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিভিন্ন বীজ বর্ধন খামারে অনায়াসে করা যেতে পারে।

 

কৃষি গবেষণাগারের জন্য

বিভিন্ন কৃষি গবেষণাগার এবং কৃষি শিক্ষার বিদ্যাপিঠে অবশ্যই বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ ও ব্যবহার থাকতে হবে। কৃষি উন্নয়নে চাই উপযুক্ত প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের এবং কৃষি শিক্ষায় ছাত্রদের শিক্ষিত করে তুলতে গবেষণাগার ও বিদ্যাপিঠে কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

 

কৃষক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য যন্ত্রপাতি :

কৃষক পর্যায়ে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার সম্ভব:

ক. জমি চাষ

বাংলাদেশে বছরে তিনবার জমি চাষের ব্যস্ত সময় লক্ষ্য করা যায় ।

* মার্চের প্রথম সপ্তাহ হতে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ।

* জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ হতে আগষ্টের তৃতীয় সপ্তাহ।

* নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য জানুয়ারী পর্যন্ত ।

দেশে বর্তমানে চাষের বলদের অভাব শতকরা ৪০ ভাগ এবং বছরের ব্যস্ত সময়ে এ অভাব দাঁড়ায় ৭০ ভাগে। দেশে বর্তমানে চাষের বলদের অভাব শতকরা ৪০ ভাগ এবং উপরোক্ত ব্যস্ত সময়ে এ অভাব দাঁড়ায় ৭০ ভাগে। গরুর ভাল জাত, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব, চারণভূমির অভাব এবং বিভিন্ন সময়ের বন্যায় গবাদি পশুর মৃত্যুর ফলে কৃষিক্ষেত্রে পশুশক্তির অভাব বেড়েই চলছে। তাছাড়া যে সকল কৃষকের চাষের বলদ আছে তারা দু’ফসলের মধ্যবর্তী এত কম সময়ে তড়িঘড়ি করে সঠিকভাবে জমি চাষ করতে পারেনা। ফলে ফসলের ফলনও ভাল হয়না। এসব কারণে দেশে পাওয়ার টিলারের চাহিদা বেড়েই চলছে।

পাওয়ার টিলার ব্যবহারের ফলে ব্যস্ত সময়ে জমি চাষ করতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা বরং অল্প সময়ে কৃষক বেশি গভীরতায় জমি চাষ করে বেশি ফলন পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বীজ বর্ধন খামার ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটে এবং কিছু সংখ্যক ধনী কৃষক তাদের খামারে বিভিন্নঅশ্বশক্তির ট্রাক্টর প্লাউ ব্যবহার করছে এবং দিন দিন এদের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

 

খ. বীজ বপন

বীজ বপন করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট হতে বীজ বপন যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছে যা গবেষণাগারে, বীজ বর্ধন খামারে এবং কৃষকের মাঠে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি কৃষকেরা এখন বীজ বপন যন্ত্র সরবরাহের জন্য আবেদন জানাচ্ছে।

 

গ.আগাছা দমন

আগাছা দমনের বিভিন্ন নিড়ানী যন্ত্র যেমন জাপানী ধান নিড়ানীযন্ত্র কৃষকেরা এখন নিজেদের ফসলী জমিতে ব্যাপক হারে ব্যবহার করছে। হ্যাম্পর‌্যাক, গার্ডেন র‌্যাক ইত্যাদিও আজকাল আগাছা দমনের জন্য কিচেন গার্ডেনে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

ঘ. সেচ প্রয়োগ

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করেছে বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি। ফসলের পানির চাহিদা মেটাতে দেশীয় সেচ পদ্ধতি অতিরিক্ত ফসল ফলানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করেছে বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে খাল, বিল, নদী এবং ভূ—গর্ভ হতে পানি তুলে ফসলের জমিতে দেয়া হচ্ছে এবং সেচের আওতায় দিন দিন ফসলী জমির পরিমাণ বাড়ছে।

বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি যা এদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো হলো নলকূপ, ট্রেডেল পাম্প, পাওয়ার পাম্প, অগভীর নলকূপ এবং গভীর নলকূপ, ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর বা অগভীর নলকূপ তাদের নির্ধারিত সেচের আওতাভূক্ত জমিতে সেচ দিতে পারছেনা।

এ ক্ষেত্রে পাওয়ার পাম্প দক্ষতার সাথে নদী বা বিল হতে জমিতে সেচ দিতে পারে। সেচের আওতায় জমির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকেরা বেশি পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করছে। ফলে রবি মৌসুমে অন্যান্য ফসল বিশেষ করে ডাল ও মশলা জাতীয় ফসলের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে যদিও ফসলের নিবিড়তা বাড়ছে কিন্তু অন্য ফসলের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে যার ফলে এসব ফসল বিদেশ থেকে আমদানি করে চাহিদা মিটাতে হচ্ছে ।

দেশের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে হলে বেশি পরিমাণে জমি সেচের আওতায় আনতে হবে। আর তাই সেচ যন্ত্রপাতির চাহিদা এদেশে বাড়তেই থাকবে। ফসল উৎপাদনে সেচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। অতএব কৃষি যান্ত্রিকীকরণের এ উপকরণটি বিশেষ করে ফসল উৎপাদনে সেচ যন্ত্রপাতির গুরূত্ব অপরিসীম।

ঙ. ফসল সংরক্ষণ

আগাছা, রোগ ও পোকা—মাকড়ের আক্রমণ হতে জমির ফসল রক্ষার জন্য হস্ত চালিত ও শক্তিচালিত বিভিন্ন স্প্রেয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে এদের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। বর্তমানে এসব যন্ত্রপাতি আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে। উঁচু গাছে ঔষধ দেবার জন্য উচ্চ চাপের স্প্রেয়ার তৈরি করা হয়েছে যা দেশের উত্তরাঞ্চলের আম বাগানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ বিস্তীর্ণ এলাকায় কীটনাশক বা আপদনাশক প্রয়োগের জন্য ছোট ছোট উড়োজাহাজ ব্যবহার করে থাকে।

 

চ. মাড়াই ও প্রক্রিয়াকরণ

আউশ ও বোরো ধান কাটার পর বৃষ্টি হলে অনেক সময় মাড়াই কাজের বিঘ্ন ঘটে। পদচালিত মাড়াই যন্ত্র (চধফফষব ঃযৎবংযবৎ) এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ মাড়াই যন্ত্র তৈরি হচ্ছে। যেখানে আগে গরু দিয়ে মাড়াই কাজ করা হতো, গরু কমে যাওয়ায় এসব কাজ এখন পদচালিত মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়। শুধু তাই নয়, গম মাড়াই যন্ত্রের উদ্ভাবনের চেষ্টাও দেশে চল্ছে। ধান, সরিষা ও মশলা যেগুলো ঢেঁকি কিংবা ঘানির সাহায্যে ভাঙ্গানো হতো এখন এসব কাজ মেশিনের সাহায্যে করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এখন এসব মিল চালু হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সম্ভাব্য বেকারত্ব।


কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বড় সুবিধা এই যে অল্প সময়ে, কম শ্রমিক দিয়ে, দক্ষতার সাথে, কম খরচে অধিক ফসল ফলানো সম্ভব। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সম্ভাব্য বেকারত্ব। দেশের অর্ধেকেরও বেশি শ্রমিক কৃষি শিল্পে নিয়োজিত। দেশে কৃষি ক্ষেত্রে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ হলে অধিকাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলদেশে আংশিক যান্ত্রিকীকরণই শ্রেয়। দেশের পরিবেশের কথা বিবেচনা করে দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি কৃষি ক্ষেত্রে বেশি লাগসই হবে বলে বিবেচিত। তাই কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

শুধু তাই নয় এসব যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ যেন সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায় সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তাই দেশে খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কারখানা করতে হবে নতুবা যেসব কৃষি যš পাতি বিদেশ হতে আমদানি করা হয় তাদের খুচরা যন্ত্রাংশও যেন কৃষক সব সময় হাতের কাছে পায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।

 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফসলের অবদান

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফসলের অবদান – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ১ এর ১.৬ নং পাঠ।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফসলের অবদান

 

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের মানুষের প্রধান পেশা হলো কৃষি অর্থাৎ ফসল উৎপাদন। বাংলাদেশের শতকরা ৬৮.৫ ভাগ মানুষ এ পেশায় নিয়োজিত এবং দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩৫% আসে কৃষি থেকে। জাতীয় আয়ের সিংহভাগই (৩৯.৩৭%) যোগান দেয় এই কৃষি খাত (বি.বি.এস. ১৯৯৪)।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশে ফসলী জমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সত্তর এর দশকে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল প্রায় এক একর। বর্তমানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ০.২৫ একর। এই ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করছে এদেশের বিভিন্ন ফসল। জমির পরিমাণ হ্রাস পেলেও ধান ও গমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে খাদ্য ঘাটতি গত বিশ বছর ধরে একই পর্যায়ে রয়েছে। বিগত ১৯৫০—৫১ অর্থ বছরে এদেশে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬২ লক্ষ টন। বিগত তিন দশকে দেশের খাদ্য উৎপাদনে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। ১৯৬০—৬১ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৯৭ লক্ষ টনে উন্নীত হয়।

১৯৮৯—৯০ সনে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৬৪ লাক্ষ টনে । অর্থাৎ ২৯ বছরে এদেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুন বেড়েছে। এসময় খাদ্য শস্যের প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ২.২০ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছিল ২.২৮ ভাগ। ১৯৯২—৯৩ অর্থ বছরে খাদ্য শস্যের উৎপাদন দাঁড়ায় ১ কোটি ৭২ লক্ষ টনে। উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আমাদের খাদ্য ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এসব তথ্য থেকে দেখা যায় খাদ্য শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি না হলে ক্রমহ্রাসমান জমিতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পরণ সম্ভব হতো না। কৃষিতে উন্নত ূ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের ফলেই তা সম্ভব হচ্ছে।

তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফসল খুবই গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের প্রধান ফসলগুলো হলো, ধান, গম, পাট, আখ, তামাক, চা, আলু, ডাল ও তৈল জাতীয় শস্য।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফসল এর অবদান:

ধান

বর্তমানে ৩৯টি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে যার প্রায় অধিকাংশই কৃষক পর্যায়ে মাঠে চাষ করা হয়।
বাংলাদেশে ধানের জমির পরিমাণ কমলেও প্রতি একক জমিতে এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে ধানের উৎপাদন হার ছিল হেক্টরপ্রতি ২—৩ টন আর এখন তা ৫—৬ টনে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে ৩৯টি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে যার প্রায় অধিকাংশই কৃষক পর্যায়ে মাঠে চাষ করা হয়। ১৯৭০ সালে চালের উৎপাদন ছিল প্রায় ১০ মিলিয়ন টন বর্তমানে তা প্রায় ১৯ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। এর পরও এদেশে চালের ঘাটতি রয়েছে যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

 

গম

দানা জাতীয় খাদ্য শস্যের মধ্যে ধানের পরই গমের স্থান। গম বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব একটা ভূমিকা না রাখলেও ধানের সহকারী খাদ্য হিসেবে গম তার স্থান করে নিয়েছে। দেশে বেশি পরিমাণে জমি সেচের আওতায় আসার ফলে এবং গমের চেয়ে বাঙালিরা ভাত বেশি পছন্দ করে বিধায় বর্তমানে গমের জমির পরিমাণ এবং উৎপাদন দুই—ই স্থিতিশীল হয়ে আসছে। গমের ফলন বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনষ্টিটিউট অদ্যাবধী ১৬টি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত উদ্ভাবন করেছে এবং কৃষকের মাঠে এগুলোর প্রায় সব ক’টি চাষ করা হচ্ছে। ১৯৯৭—৯৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৮০.৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন গম উৎপন্ন হয়েছে।

 

পাট

পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। বর্তমানে বিশ্ব বাজারে পাটের চহিদা কমে যাওয়ায় তার দামও কমে গেছে; ফলে পাট চাষে কৃষকদের উৎসাহ কমে গেছে। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ বিশ্বের ৬৯টি দেশে পাট রপ্তানি করত । উৎপাদিত পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ৭০% বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে ৭০ লক্ষ বেল পাট উৎপন্ন হ’তো যা বর্তমানে এসে ঠেকেছে ৪০ লক্ষ বেলে। ১৯৯২—৯৩ অর্থবছরের মার্চ ’৯৩ পর্যন্ত ৭৮৮ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা পাটজাত দ্রব্য এবং ২২৪ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা কাঁচা পাট রপ্তানি করে আয় হয়।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ১৬% আয় হয় পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে। বর্তমানে ঔষধ ও পোষাক শিল্পের প্যাকেজিংয়ের জন্য প্রায় ১১ শ’ কোটি টাকা মূল্যের ১ লক্ষ ৪ হাজার টন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল গ্রেড কাগজ আমদানি হচ্ছে। পাটজাত দ্রব্য দিয়ে এ কাগজ তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব। জুটন (৭০% পাট + ৩০% সুতা) তৈরি করতে এখন পাটের আঁশ ব্যবহৃত হচ্ছে। নদীর বাঁধ ভাঙ্গন রোধে চটের বস্তা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।

চা

চা বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল। চা বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল। ১৯৯৭—৯৮ সনে চা বাগানের আওতায় জমির পরিমাণ ছিল ৪৮.৫ হাজার হেক্টর এবং উৎপাদন ছিল ৫০.৫ হাজার মেট্রিক টন। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এর প্রায় অর্ধেক পরিমাণ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। চা রপ্তানি করে ১৯৮৮—৮৯ অর্থ বছরে আয় হয়েছে ১২০৮ মিলিয়ন টাকা, ১৯৮৯—৯০ অর্থবছরে ১২০১ মিলিয়ন টাকা, ১৯৯০—৯১ অর্থবছরে ১৫৪৪ মিলিয়ন টাকা, ১৯৯১—৯২ অর্থবছরে ১২৯৬ মিলিয়ন টাকা। বংলাদেশে চা এর উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে।

 

আখ

আখ বাংলাদেশের চিনি ও গুড় উৎপাদনকারী প্রধান অর্থকরী ফসল। আখ বাংলাদেশের চিনি ও গুড় উৎপাদনকারী প্রধান অর্থকরী ফসল। বর্তমানে দেশে ১,৭৪,০০০ হেক্টর জমিতে আখ উৎপন্ন হয় এবং বাৎসরিক গড় উৎপাদন ৭২—৭৬ লক্ষ টন। উৎপাদিত আখের ২৩ লক্ষ টন ব্যবহৃত হয় চিনি উৎপদনের জন্য এবং ৩১ লক্ষ টন আখ ব্যবহৃত হয় গুড় উৎপাদনের জন্য।

বাকী আখ বীজ হিসেবে ও চিবিয়ে খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। দেশে বর্তমানে চিনি ও গুড় উৎপাদনের পরিমাণ যথাক্রমে ১.৯ লক্ষ এবং ৩ লক্ষ টন। দেশে বাৎসরিক ৩ লক্ষ টন চিনি এবং ৬ লক্ষ টন গুড়ের চহিদা মিটাতে ১ কোটি ১০ লক্ষ টন আখ উৎপাদন প্রয়োজন। আখের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইক্ষু গবেষণা ইনষ্টিটিউট ২৩ টি উচ্চ ফলনশীল ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশে চিনির চাহিদা মিটানোর জন্য প্রতিবছর প্রায় এক লক্ষ টন চিনি আমদানি করতে হয়।

 

তামাক

তামাক বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ের অন্যতম উৎস। বাংলাদেশে বর্তমানে ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৩৬ হাজার মেট্রিক টন তামাক উৎপন্ন হয় যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটাতে সক্ষম।

 

ডাল জাতীয় শস্য

দেশে ডাল জাতীয় শস্যের চাহিদার প্রায় বেশির ভাগই বর্তমানে আমদানি করতে হয়। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ডাল জাতীয় শস্যের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন কমে গেছে। দেশে সেচের আওতায় জমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে কৃষকেরা এখন সে জমিতে ডালের পরিবর্তে ধান চাষ করছে তবে ডালের ফলন বৃদ্ধির জন্য সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি ইনষ্টিটিউট বেশ কয়েক জাতের মসুর, ছোলা, মুগ ও মাষ কলাইয়ের উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।

 

তৈলবীজ জাতীয় শস্য

সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তৈলবীজ জাতীয় শস্য। বর্তমানে তৈলবীজ জাতীয় শস্য হিসেবে দেশে সয়াবীনের চাষ হচ্ছে এবং সয়াবীন চাষের উজ্জ্বল সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু সয়াবীন ক্রাস করার মেশিন না থাকায় আমাদের তেলের ঘাটতি মিটাতে প্রতি বছর ৩ থেকে ৬ হাজার মিলিয়ন টাকার সয়াবীন তৈল বিদেশ হ’তে আমদানি করতে হয়। এদেশে তৈল বীজ জাতীয় ফসলের জমির পরিমাণ স্থিতিশীল রয়েছে। তৈলবীজ শস্যের ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের কৃষি গবেষনা প্রতিষ্ঠান সমূহ সরিষার ১০টি, চীনাবাদামের ৬টি, গর্জনতিলের ৩টি ও তিষির ১টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলো চাষের আওতাভূক্ত জমির পরিমাণ বাড়াতে পারলে তৈল আমাদানির পরিমাণ কমে আসবে এবং
দেশের অর্থনীতিতেও যথেষ্ট অবদান রাখবে।

অন্যান্য:

রাবার দেশে রাবার উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঁচা রাবার আমদানি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং এ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। বর্তমান (১৯৯৪—৯৫) অর্থ বছরে এই সাশ্রয়ের পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা। বিভিন্ন রাবার বাগান হ’তে বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার টন কাঁচা রাবার উৎপাদন হচ্ছে যা দিয়ে দেশের ২৫০টি রাবার জাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মোট বার্ষিক চাহিদার ৩০% মিটানো সম্ভব হচ্ছে। ফুল, ফল ও শাকসব্জি ঢাকায় বর্তমানে প্রতিদিন ৫ লক্ষ টাকা মূল্যের তাজা ফুল বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশে ফুল এখন বাণিজ্যিক পণ্য। ঢাকায় বর্তমানে প্রতিদিন ৫ লক্ষ টাকা মূল্যের তাজা ফুল বিক্রি হচ্ছে । দেশে বর্তমানে ২ হাজার বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে্ । প্রায় ১৫ হাজার লোক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ফুল ব্যবসার সাথে জড়িত। ১৯৯৩—৯৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১২ লক্ষ টাকা ম ল্যের তাজা ফুল সৌদি আরবে রপ্তানি করে। ফলের উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং যে পরিমাণ উৎপন্ন হচ্ছে তাতে দেশের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।

কাঁঠালসহ কিছু ফল বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে । বর্তমানে বাংলাদেশ হ’তে ১৫টিরও অধিক দেশে ৪৮ প্রকারের শাকসব্জি রপ্তানি হচ্ছে । ১৯৯২—৯৩ অর্থবছরে ৩১৩.৫ মিলিয়ন টাকার এবং ১৯৯৩—৯৪ অর্থবছরে ৩২৩.৫ মিলিয়ন টাকার সব্জি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। দেশে সব্জি উৎপাদন করার লক্ষ্যে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহ বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে।

উপরের আলোচনা হ’তে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশ কৃষির উপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে এদেশের ফসলসমূহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, সুষ্ঠু পরিল্পনার অভাব, কৃষি নীতিমালা বাস্তবায়নে অসফলতা, কৃষকদের অজ্ঞতা ও দারিদ্র, গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে যোগাযোগের অভাব ইত্যাদিই প্রধান কারণ। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফসলের অবদান আরোও বাড়বে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

 

কৃষি উপকরণ ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ, আর কৃষির অগ্রগতি নির্ভর করে আধুনিক ও উপযোগী কৃষি উপকরণের যথাযথ ব্যবহারের উপর। কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি উপকরণের সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য। তবে বাস্তবে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই এসব উপকরণ ব্যবহারে নানা সমস্যা, অসচেতনতা ও সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।

আজকের পাঠে আমরা “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের ইউনিট ১-এর ১.৫ নম্বর পাঠ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষি উপকরণের বর্তমান ব্যবহারিক অবস্থা, এর সুবিধা-অসুবিধা, কৃষকের সচেতনতা ও সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নিয়ে আলোচনা করব। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা জানতে পারব, কীভাবে কৃষি উপকরণের কার্যকর ব্যবহার কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষি উপকরণ ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা

 

কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশে, উপকরণ বলতে সেই সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রকে বুঝানো হয় যা কোনো বস্তু তৈরি বা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। কৃষি ক্ষেত্রে, ফসল উৎপাদনের জন্য সরাসরি যে সকল জিনিসপত্র প্রয়োজন, সেগুলোকে কৃষি উপকরণ বলা হয়। কৃষি উপকরণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:

১. অবস্তুগত উপকরণ
২. বস্তুগত উপকরণ

অবস্তুগত উপকরণ হলো শ্রমিক বা মানুষ, গরু-মহিষ, এবং যান্ত্রিক শক্তি। আর বস্তুগত উপকরণ হলো বীজ, সার, পানি, ও আপদনাশক। এখানে আমরা বিশেষভাবে বস্তুগত উপকরণ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ফসল উৎপাদনের জন্য নিজেরা সংরক্ষিত বীজ ব্যবহার করেন। তবে উন্নত জাতের বীজ সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বি.এ.ডি.সি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বি.এ.ডি.সি তাদের বীজবর্ধন খামার থেকে বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাতের বীজ উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে বিক্রয় করে থাকে। প্রয়োজন অনুসারে তারা বিদেশ থেকেও বীজ আমদানী করে থাকে, যদিও সরবরাহ এখনও চাহিদার তুলনায় কম।

বি.এ.ডি.সি কর্তৃক বিক্রয়কৃত বিভিন্ন বীজের পরিসংখ্যান (ছক-১) থেকে দেখা যায়, ধান (আউশ, আমন, বোরো), গম, গোল আলু, সরিষা এবং শীতকালীন শাকসবজির বীজ প্রধানত সরবরাহ করা হয়। ১৯৯২-৯৩ সালের মধ্যে আউশ ধানের বীজ বিক্রয় কিছুটা কমলেও আমন ধানের বীজ বিক্রয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, গম, গোল আলু, সরিষা ও শীতকালীন শাকসবজির বীজ বিক্রয় পূর্বের তুলনায় কম। এ থেকে ধারণা করা যায় যে কৃষকেরা নিজেদের উৎপাদিত বীজই বেশি ব্যবহার করছেন।

ছক: বি..ডি.সি কর্তৃক বিক্রীত উন্নত বীজের পরিমাণ (১৯৯২৯৩)

ফসলের নাম বীজ বিক্রয়ের পরিমাণ (কেজি) পূর্ববর্তী বছরের তুলনা
আউশ ধান ৫১৮,০৮৪ কম হয়েছে
আমন ধান ৩,৫৯,৪৩,৪৩১ বৃদ্ধি পেয়েছে
বোরো ধান ৭,৪৫,৭৪০ বৃদ্ধি পেয়েছে
গম ৯৬ কম হয়েছে
গোল আলু ৬৭,৫৯৬ কম হয়েছে
সরিষা ৫০,২৯৬ কম হয়েছে
শীতকালীন শাক-সবজি ৫১৯ কম হয়েছে

 

সার

ফসলের জমিতে আমরা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করি, যেমন ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট, সুপার ফসফেট, মিউরেট অব পটাশ, জিঙ্ক সালফেট, সালফার ইত্যাদি। এসব সারের মধ্যে কিছু আমাদের দেশের কারখানায় উৎপাদিত হয়, আবার কিছু আমদানি করে আনা হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমদানির পাশাপাশি দেশে রাসায়নিক শিল্প সংস্থাগুলোও সার উৎপাদন করে থাকে।

নীচের ছক (ছক—২) থেকে দেখা যায়, ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে সারের ব্যবহার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে তা কিছুটা কমে গেছে। ১৯৯০-৯১, ১৯৯১-৯২ এবং ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে মোট সারের ব্যবহার ছিল যথাক্রমে ১৯,৯৪,১৬০; ২১,২৭,০০৪; এবং ২০,৩৪,৭৯২ মেট্রিক টন।

সেচ

বাংলাদেশে মোট ফসলী জমির পরিমাণ প্রায় ১৩.৭ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা হয় মোট ফসলী জমির ১৯.৪৬ শতাংশে এবং গতানুগতিক পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা হয় ৪.৪৬ শতাংশ জমিতে। বাকি ৭৬.৩% জমি এখনও সেচের আওতায় আসতে পারেনি।

যদিও বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়, তবে বৃষ্টির অসম বণ্টনের কারণে রবি মৌসুমের বিশেষ ফসল যেমন বোরো ধান, গম, গোল আলু ইত্যাদির জন্য সেচ প্রদান অপরিহার্য। সেচের আওতায় আরও বেশি জমি আনতে পারলে খাদ্য ঘাটতি অনেক কমে যাবে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে দেশে সেচের পরিমাণ ও প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছকে (ছক—৩) প্রদর্শিত হয়েছে।

আপদনাশক

ফসলকে বিভিন্ন প্রকার আপদ থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের আপদনাশক ব্যবহার করা হয়। ফসলের শত্রু হিসেবে কাজ করে আগাছা, পোকামাকড়, রোগ জীবাণু, ইঁদুর এবং গুদামে আক্রমণকারী অন্যান্য প্রাণী। এসব ক্ষতিকারক উপাদানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন ধরনের আপদনাশক ব্যবহৃত হয়, যা ফসলের উৎপাদনশীলতা ও গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করে।

 

 

কৃষিতে পোকা-মাকড়, রোগ-বালাই, আগাছা ও ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাক্রমে কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ও রোডেন্টিসাইড ব্যবহার করা হয়। এগুলো পাউডার, তরল এবং দানাদার আকারে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে এসব আপদনাশকের ব্যবহার ক্রমবর্ধমান।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে মোট ৭৩০৭.২২ মেট্রিক টন আপদনাশক ব্যবহৃত হয়েছিল, যা ১৯৯৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬৪০.৪৯ মেট্রিক টনে। ১৯৯৪ সালের প্রথম ছয় মাসে এককালে ৪৭৪৪.৮ মেট্রিক টন আপদনাশক ব্যবহৃত হয়েছে।

ছক: বাংলাদেশে আপদনাশকের ব্যবহার (মেট্রিক টন)

বছর ব্যবহৃত আপদনাশকের পরিমাণ (মেট্রিক টন)
১৯৯২ ৭৩০৭.২২
১৯৯৩ ৭৬৪০.৪৯
১৯৯৪ (ছয় মাস) ৪৭৪৪.৮

 

ভূমির ব্যবহার ও ফসল পরিসংখ্যান

ভূমির ব্যবহার ও ফসল পরিসংখ্যান – কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ বিষয়ের একটি পাঠ। এই পাঠটি ১ নং ইউনিটের ১.৪ নং পাঠ।

 

ভূমির ব্যবহার ও ফসল পরিসংখ্যান , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ 

 

বাংলাদেশে মোট জমির পরিমাণ প্রায় ১,৪৯,০০,০০০ হেক্টর (বি.বি.এস. ২০০০) । এ দেশের ভূভাগ বিভিন্ন খাতে ব্যবহৃত হেয়েছ।

এগুলো হলো ঃ

১। বনভূমি

২। আবাদের অনুপোযোগী জমি বাংলাদেশে মোট জমির পরিমাণ প্রায় ১,৪৯,০০,০০০ হেক্টর

৩। আবাদযোগ্য বা চাষযোগ্য জমি

 

আবাদযোগ্য জমিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা ঃ

ক) আবাদযোগ্য বা চাষযোগ্য পতিত জমি

খ) চাষকৃত ফসলী জমি ।

চাষকৃত ফসলী জমিকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো ঃ র) বর্তমান বা চলতি পতিত জমি প্রকৃত ফসলী জমি প্রকৃত ফসলী জমিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা ঃ

ধ) এক ফসলী জমি

ন) দ্বি—ফসলী জমি

প) ত্রি—ফসলী জমি

বাংলাদেশে প্রায় ২৬,২৮,০০০ হেক্টর জমিতে বন রয়েছে যা মোট স্থলভাগের প্রায় শতকরা ১৮ ভাগের মত। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোন দেশের ২৫% বনাঞ্চল থাকা উচিত।

১। বনভূমি বাংলাদেশে প্রায় ২৬,২৮,০০০ হেক্টর জমিতে বন রয়েছে যা মোট ভূমির প্রায় শতকরা ১৮ ভাগের মত (বি.বি.এস. ২০০০)। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোন দেশের ২৫% বনাঞ্চল থাকা উচিত। বনভূমির দিক হ’তে প্রধান পাঁচটি বৃহত্তর জেলা হচ্ছে— পার্বত্য চট্টগাম, খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং টাঙ্গাইল। যে সব জেলায় মোটেই বনাঞ্চল নেই সেগুলো হচ্ছে বৃহত্তর ফরিদপুর, যাশোর, কুষ্টিয়া, বগুড়া ও পাবনা। সাধারনভাবেই এদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ কম তারপরেও যেভাবে অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত উপায়ে বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে তা যদি রোধ না করা হয় তবে ভবিষ্যতে এ দেশ মরুভূমিতে পরিণত হ’তে পারে যার কিছু আলামত এখনই দেশের উত্তরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে।

২। আবাদের অনুপোযোগী জমি এ জমিতে বাড়ীঘর, হাট—বাজার, শহর—বন্দর, অফিস—আদালত, স্কুল—কলেজ, মস্জিদ—মন্দির, মাদ্রাসা ইত্যাদি অবস্থিত। এর পরিমাণ প্রায় ৩৪,১৫,০০০ হেক্টর যা মোট জমির শতকরা প্রায় ২৩ ভাগ (বি.বি.এস. ২০০০)।

৩। আবাদযোগ্য জমি চাষযোগ্য পতিত জমি, চলতি পতিত জমি ও প্রকৃত ফসলী জমির পরিমাণের সমষ্টি হলো আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। আবাদযোগ্য বা চাষযোগ্য জমি বলতে প্রকৃতপক্ষে কতটুকু জমিতে ফসল আবাদ করা সম্ভব তাকে বুঝায়। চাষযোগ্য পতিত জমি, চলতি পতিত জমি ও প্রকৃত ফসলী জমির পরিমাণের সমষ্টি হলো আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। আরও সহজভাবে বলা যায়

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০০০ অনুসারে এ দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৮,০৩,২৩৯ হেক্টর। নিম্নে এর অন্যান্য শ্রেণীবিভাগগুলো আলোচনা করা হলো ঃ

(ক) আবাদযোগ্য বা চাষযোগ্য পতিত জমি:

বাড়ী—ঘর, হাট—বাজার, অফিস—আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ—মন্দির ইত্যাদির আশেপাশে কিছু জমি পতিত থাকে যা কিছুটা যত্ন নিলেই চাষাবাদের আওতায় আনা যায়। এরূপ জমিকে আবাদযোগ্য পতিত জমি বলে এবং এর পরিমাণ প্রায় ৩ লক্ষ হেক্টর যা মোট জমির শতকরা প্রায় ২ ভাগ। এরূপ পতিত জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে।

 

(খ) চাষকৃত ফসলী জমি চাষকৃত ফসলী জমি:

বলতে বুঝায় যে জমি চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। চাষকৃত ফসলী জমি = আবাদযোগ্য জমি Ñ আবাদযোগ্য পতিত জমি। অন্য কথায়, চাষকৃত ফসলী জমি = চলতি পতিত জমি + প্রকৃত ফসলী জমি। এর পরিমাণ প্রায় ৮৫ লক্ষ হেক্টর, যা মোট জমির শতকরা প্রায় ৫৭ ভাগ।

 

(গ) চলতি বা বর্তমান পতিত জমি:

অন্যান্য বছর আবাদ করা হলেও কোন কারণে আলোচ্য বছরে কমপক্ষে এক মৌসুমের জন্যও আবাদ করা না হলে তাকে চলতি বা বর্তমান পতিত জমি বলে। কারণগুলো হ’তে পারে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, বীজের অভাব ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রায় ৩.৪৯ লক্ষ হেক্টর চলতি পতিত জমি আছে যা কমিয়ে শুন্যতে আনতে হবে। এর পরিমাণ মোট জমির শতকরা প্রায় ২.৩৪ ভাগ।

(ঘ) প্রকৃত ফসলী জমি:

এক, দ্বি এবং ত্রি—ফসলী জমির যোগফলই হলো প্রকৃত ফসলী জমি। আমাদের দেশের প্রায় ৮১.৩৮ লক্ষ হেক্টর জমি প্রকৃত ফসলী জমির আওতাভূক্ত। এক, দ্বি এবং ত্রি—ফসলী জমির যোগফলই হলো প্রকৃত ফসলী জমি। আমাদের দেশের প্রায় ৮১.৩৮ লক্ষ হেক্টর জমি প্রকৃত ফসলী জমির আওতাভূক্ত। এর পরিমাণ মোট জমির শতকরা প্রায় ৫৪.৬১ ভাগ।

(ঙ) এক ফসলী জমি:

যে জমিতে সারা বছর একটি মাত্র ফসল জন্মানো হয় তাকে এক—ফসলী জমি বলে। আমাদের দেশে এক ফসলী জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ লক্ষ হেক্টর। এরূপ জমির পরিমাণ ক্রমশঃ কমে আসছে। এর পরিমাণ প্রকৃত ফসলী জমির শতকরা প্রায় ৩৭ ভাগ।

(চ) দ্বি ফসলী জমি:

যে জমিতে বছরে দুটি ফসল জন্মানো হয় তাকে দ্বি—ফসলী জমি বলে। এদেশে দ্বি—ফসলী জমির পরিমাণ ৪১.৪৮ লক্ষ হেক্টরেরও বেশি। এ জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এর পরিমাণ প্রকৃত ফসলী জমির শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ।

(ছ) ত্রি—ফসলী জমি:

যে জমিতে বছরে তিনটি ফসল জন্মানো হয় তাকে ত্রি—ফসলী জমি বলে । আমাদের দেশে বর্তমানে ত্রি—ফসলী জমির পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর। নতুন নতুন প্রযুক্তি, জাতের উদ্ভব, কৃষি উপকরণ এবং সেচ সুবিধা বৃদ্ধির ফলে এর পরিমাণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। এটি প্রকৃত ফসলী জমির শতকরা প্রায় ১২ ভাগ। সর্বমোট ফসলী জমি সর্বমোট ফসলী জমি = এক ফসলী জমি + (দ্বি—ফসলী জমি ২) + (ত্রি—ফসলী জমি৩)।

খরিপ—১, খরিপ—২ এবং রবি মৌসুম মিলিয়ে এক বছরে সর্বমোট যে পরিমাণ জমিতে আবাদ করা হয় তাই সর্বমোট ফসলী জমি। সর্বমোট ফসলী জমি = এক ফসলী জমি + (দ্বি—ফসলী জমি ী ২) + (ত্রিফসলী জমি ী ৩)। বাংলাদেশে মোট ফসলী জমির পরিমাণ প্রায় ১,৪২,৭৮,১৩৮ হেক্টর (বি.বি.এস.
২০০০)।

কোন দেশের মোট কী পরিমাণ জমিতে কী কী ফসল আবাদ করা হয, সেগুলোর মোট উৎপাদন কত এবং প্রতি হেক্টরে সেগুলোর উৎপাদনের পরিমাণ এবং তার হিসাব সম্বন্ধীয় প্রতিবেদনকে ফসল পরিসংখ্যান বলে। দেশে কোন বছর কী পরিমাণ ধান, গম, পাট, আখ, তামাক, ডাল ও তৈল জাতীয় এবং অন্যান্য ফসল উৎপন্ন হয় তা একমাত্র ফসল পরিসংখ্যান হ’তে পাওয়া সম্ভব।

ধানের জমির মধ্যে আমন ধান ৫৮৪৩.৭ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপন্ন হয় যা মোট ধানী জমির শতকরা ৫৭ ভাগ। নিম্নের ছক (২) হ’তে দেখা যায় যে ধানই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জমিতে জন্মে। ধানের জমির মধ্যে আমন ধান ৫৮৪৩.৭ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপন্ন হয় যা মোট ধানী জমির শতকরা ৫৭ ভাগ। বোরো ধান উৎপন্ন হয় ২৫৮০.৩ হাজার হেক্টরে এবং আউশ ধান ১৬৪৯.৪ হাজার হেক্টরে। মোট ধানী জমির শতকরা ২৫.৫ ও ১৬.৪ ভাগে যথাক্রমে বোরো ও আউশ ধান উৎপন্ন হয়।

বর্তমানে (১৯৯৩’৯৪) সর্বমোট ১০০৭৩.৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধান উৎপন্ন হয় এবং মোট উৎপাদনের পরিমাণ ১৮৩০২ হাজার মেট্রিক টন। গত কয়েক বছরের খতিয়ান হ’তে দেখা যায় যে গম চাষের জমির পরিমাণ মোটামুটি স্থিতিশীল। বর্তমানে ৮৮২.২ হাজার হেক্টর জমিতে গম উৎপাদন করা হয় এবং উৎপাদনের পরিমাণ ১৯০৮ হাজার মেট্রিক টন। আন্তজার্তিক বাজারে পাটের মূল্য কমে যাওয়ায় পাট চাষের জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৭৭.৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হচ্ছে এবং উৎপাদনের পরিমাণ ৮১২ হাজার মেট্রিক টন।

বর্তমানে ১৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে ৬৯৫১ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপন্ন হচ্ছে। তামাক অর্থকরী ফসল। তামাক উৎপাদনের জমি এবং উৎপাদন মোটামুটি স্থিতিশীল। ডাল ফসল ও তৈলবীজ ফসলের উৎপাদন ও জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে এবং এ দু’টি ফসলই এখন মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ হ’তে আমদানী করতে হয়। বর্তমানে ৫৪৬.৭ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ডাল ফসল এবং ৫১১.৫ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন তৈলবীজ ফসলের চাষ করা হয এবং উৎপাদনের পরিমাণ যথাক্রমে ৪১৭ ও ৭০০ হাজার মেট্রিক টন।

ছক — ২ ঃ প্রধান প্রধান ফসলের আবাদকৃত জমির পরিমাণ ও উৎপাদন ।

 

 

গাছপালা ও জীবজন্তুর উপর জলবায়ুর প্রভাব

গাছপালা ও জীবজন্তুর উপর জলবায়ুর প্রভাব – কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ বিষয়ের একটি পাঠ। এই পাঠটি ১ নং ইউনিটের ১.৩ নং পাঠ। জলবায়ুর উপর নির্ভর করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ জন্মে এবং বিভিন্ন জীবজন্তু বাস করে। কোন জীব এককভাবে প্রকৃতিতে থাকতে পারেনা। সাধারণত বিভিন্ন গোত্রের জীবসমূহ সমষ্টিগতভাবে একস্থানে বাস করে। বেশির ভাগ জীব সম্প্রদায় উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমষ্টি দ্বারা গঠিত। একেক অঞ্চলে একেক ধরণের গাছপালা ও জীবজন্তু পরিলক্ষিত হয় যা ঐ অঞ্চলের পরিবেশতন্ত্র বা ইকোসিষ্টেমের উপর নির্ভরশীল।

 

গাছপালা ও জীবজন্তুর উপর জলবায়ুর প্রভাব

 

 

বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈচিত্র ও উদ্ভিদ ধরণের উপর নির্ভর করে একে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যেতে পারে।

১। গঙ্গা নদীর বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল

২। চিরহরিৎ পত্রঝরা অরণাঞ্চল

৩। পত্রঝরা অরণ্যাঞ্চল

৪। ম্যানগ্রোভ অরণ্যাঞ্চল

 

গঙ্গানদীর বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল

দেশের প বার্ঞ্চলের কিছু অনুচ্চ পাহাড় ও টিলা ব্যতিত প্রায় সমগ্র বাংলাদেশই একটি বিস্তীর্ণ সমভূমি। দেশের পূবার্ঞ্চলের কিছু অনুচ্চ পাহাড় ও টিলা ব্যতিত প্রায় সমগ্র বাংলাদেশই একটি বিস্তীর্ণ সমভূমি। বিভিন্ন নদ—নদী ও এদের শাখা প্রশাখা জালের মত সমগ্র দেশে ছড়িয়ে আছে। দেশের সমভূমি অঞ্চল এসব নদী ও শাখা নদী বিধৌত পলি দ্বারা গঠিত। এ অঞ্চলের উদ্ভিদসম হকে তিনভাগে করা যায়। যেমন— জলজ উদ্ভিদ, অনাবাদী জমির গাছপালা এবং আবাদী জমির ফসল।

বর্ষাকালে যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় তখন বিল, হাওর ও পুকুরে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ জন্মে। এরা হলো পাতাশেওলা, পাতাঝাঁঝি, কচুরিপানা, শাপলা, পদ¥, ক্ষুদে পানা, টোপা পানা, গুঁড়িপানা, সিঙ্গারা, ইত্যাদি। হাওর, বিল ও পুকুরের কিনারায় সঁ্যাতসেঁতে মাটিতে নলখাগড়া, কলমী, হেলেঞ্চা, পানি মরিচ, বাত শোলা, ইত্যাদি উদ্ভিদ দেখা যায়। এদের জন্ম ও বংশ বৃদ্ধি এ মৌসুমেই বেশি।

বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, ব্যাঙ, সাপ এসব জলাশয়ে বাস করে। বৃষ্টির পানিতে যখন চারিদিক ভরে যায় তখন এসব প্রাণীরাও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পরে। এসময়ই এদের প্রজনন সময়। বর্ষাকালে যখন নীচু জমি পানিতে ভরে যায় তখন বিভিন্ন প্রাণী বাড়ীর আশে পাশে উঁচু জায়গায় চলে আসে। শীতকালে এসব হাওরে বিভিন্ন দেশ হ’তে অতিথি পাখিরা এসে ভীড় করে এবং বর্ষা আসার সাথে সাথে এরা চলে যায়।

আবাদযোগ্য জমি ছাড়া বাড়ীর আশে পাশে, রেল লাইন ও রাস্তার পার্শ্বে, নদীর ধার ও অন্যান্য সাধারণ জায়গায় বিভিন্ন ঔষধী, গুল্ম ও অন্যান্য উদ্ভিদ দেখা যায়। এদের জন্ম ও বৃদ্ধি আবহাওয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এসব স্থানে যে সকল উদ্ভিদ জন্মে এগুলো হলো — শ্বেতদ্রোন, ক্রোটন, শাকনটে, কাটানটে, হাতীশুড়, ধুতুরা, পানি মরিচ, শিয়াল মতি, কচু, ঘাঘরা ইত্যাদি। এদের কোনটা খরিপ মৌসুমে আবার কোনটা রবি মৌসুমে জন্মে। এছাড়া কিছু কিছু ফসল উভয় মৌসুমেও চাষ করা হয় এবং নারিকেল, তাল, সুপারি, খেজুর, ইত্যাদি বাড়ীর আশেপাশে বা রাস্তার ধারে দেখা যায়। ছায়া প্রদানকারী বৃক্ষ হিসেবে তেতুল, বট, ইত্যাদি গ্রাম বাংলার হাট বাজারে নজরে পড়ে।

দেশের উত্তর—পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষেতের আইলে বা রাস্তার ধারে প্রচুর বাবলা গাছ চোখে পড়ে। উর্বর মাটি ও আবহাওয়া ফসল উৎপাদনের জন্য অনুকূল হওয়ায় সমতলভূমি অঞ্চলে সারা বছরই বিভিন্ন ফসল জন্মে। জলবায়ু ও আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে এখানে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ফসল জন্মে থাকে।

কোন কোন ফসল খরিপ মৌসুমে ভাল জন্মে আবার কোনটা শুধু রবি মৌসুমেই হয় আবার কিছু কিছু ফসল উভয় মৌসুমেই জন্মে। বাঁশ, আম, জাম, নারিকেল, আতা, লেবু, কলা, লিচু, বেল, কাঁঠাল, পেয়ারা, জাম্বুরা, ইত্যাদি ফলের গাছ প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই দেখা যায়।

বাড়ীর আশে পাশের ঝোপ বা ঝাড়ে শিয়াল, বেজি, খরগোশ, সাপ, গুইসাপ, কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল, খাটাস এবং নানা রকম পাখি দেখা যায়। শীতকালে এরা দূরবতীর্ স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। কিন্তু বর্ষাকালে এরা বাড়ীর আশে—পাশে উঁচু স্থানে চলে আসে। কিছু কিছু প্রাণী যেমন— সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি শীতকালে গর্তে থাকে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত বাড়ার সাথে সাথে তারা গর্ত থেকে বের হয়ে আসে।

 

চিরহরিৎ ও পাতাঝরা বনাঞ্চল

চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলার পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থিত বনাঞ্চল এ অঞ্চলের অন্তর্গত। এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। উদ্ভিদের ধরনের উপর ভিত্তিকরে এ এলাকার উদ্ভিদসম হকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে— চিরহরিৎ, পাতাঝরা, বাঁশ ঝাড় ও তৃণ ভূমি। চিরহরিৎ উদ্ভিদের মধ্যে গর্জন, বৈলাম, মেহগিনি, শিরিষ, জারুল,অর্জুন, বট, অশোক, ইত্যাদির বিভিন্ন প্রজাতি বর্তমান। এ ছাড়া বিভিন্ন আরোহী উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে ফার্ণ, মস, অর্কিড, ইত্যাদি।

পাতাঝরা বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে সেগুন, চালতা ও গামারি। বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশও এখানে প্রচুর জন্মে। ফাঁকা জায়গায় যেখানে বৃক্ষের সংখ্যা কম সেখানে প্রচুর ঘাস জন্মে। পাহাড়ের ঢালে চা, আনারস ও কলার চাষ করা হয়। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জঙ্গল পরিষ্কার করে উপজাতীয় লোকেরা এখানে ঝুম পদ্ধতিতে জমি চাষ করে। চট্টগ্রামের দক্ষিনাঞ্চলে রাবারের চাষ হয়। বিভিন্ন প্রজাতির বন্য জীবজন্তু এ বনাঞ্চলে বাস করে। এদের মধ্যে বন্যহাতী, শুকর, চিতাবাঘ, গয়াল, বনগরু, বনরুই, সজারু, বানর, হনুমান, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ বিশেষ করে অজগর সাপ প্রধান। ফসল পাকার সময় হাতী, শুকর, বানর, টিয়াপাখি পাহাড়ী জঙ্গল থেকে নেমে এসে ফসলের ক্ষতি করে থাকে।

 

পাতাঝরা বনাঞ্চল

পাতাঝরা বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজির মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই শালগাছ। সমুদ্রের উপকলবর্তী লবণাক্ত মাটি জোয়ার ভাটার কারণে সব সময়ই ভিজা থাকে এবং এখানে যে বিশেষ ধরনের বনাঞ্চল গড়ে উঠেছে তাই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল নামে পরিচিত।


এ বনাঞ্চল দেশের মধ্যবতীর্ ও উত্তরাঞ্চলে অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টিপাত এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো অবস্থায় আছে। ভাওয়ালের গড়, মধুপুরের গড়, গাড়ো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বনাঞ্চল, শেরপুরের রাংটিয়া বনাঞ্চল, বরেন্দ্র বনাঞ্চল এবং কুমিল্লার শাল বিহার এ অঞ্চলের অন্তর্গত। এসব বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজির মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই শালগাছ। এসব বনাঞ্চলে বৃষ্টিপাত অপেক্ষাকৃত বেশি।

বিভিন্ন প্রকার জীবজন্তু ও পশুপাখির সমন্বয়ে এসব শালবন গঠিত। শীতকালে এসব বনাঞ্চলে গাছের পাতা ঝরে যায় এবং বসš কালে নতুন পাতা গজাতে শুরু করে। বন্য প্রাণীর মধ্যে বানর, খরগোশ, শিয়াল, বনবিড়াল, খাটাস, বেজি, কাঁঠবিড়ালী, শুকর, বাদুর, গুইসাপ, আঞ্জিনা, দাড়াশ সাপ, গোখরা সাপ, ইত্যাদি দেখা যায়। জঙ্গলের মাঝখানে বাইদে বর্ষাকালে কই, শিং, মাগুর, পঁুটি, লাটা, ডানকানা, টেংরা, বাইম, রাঙা, গুতুম ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়।

 

ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল

সমুদ্রের উপকলবর্তী লবণাক্ত মাটি জোয়ার ভাটার কারণে সব সময়ই ভিজা থাকে এবং এখানে যে বিশেষ ধরনের বনাঞ্চল গড়ে উঠেছে তাই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল নামে পরিচিত। বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের ২০০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে ৩৫ বর্গমাইল পটুয়াখালী জেলার দক্ষিন—পশ্চিমাঞ্চল ও বাকি অংশ খুলনা জেলার দক্ষিন অঞ্চল নিয়ে গঠিত এবং পূর্বে বালেশ্বর, পশ্চিমে রায় মঙ্গল নদী ও দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। এখানকার জলবায়ু আর্দ্র এবং সর্বদা পানি পায় বলে এ অঞ্চলের গাছপালা চিরহরিৎ।

এ অঞ্চলের বনাঞ্চল সুন্দরবন নামে পরিচিত। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে কম লবনাক্ত এলাকায় সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, গোল—পাতা, হারগোজা, ইত্যাদি বৃক্ষ জন্মে। বেশি লবণাক্ত এলাকায় গেওয়া, গোরান ও ভেনা গাছ ভাল জন্মে।
পৃথিবীর বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দর বনে বাস করে। শীতকালে বাঘ পানি খাবার জন্য নদীর তীর ধরে নিচে নেমে আসে। মধু ও গোলপাতা সংগ্রহের সময় যারা এসময় সুন্দর বনে যায় প্রায়ই তারা বাঘ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বানর, হনুমান, চিতাবাঘ, বনগরু, গয়াল, হরিন, শুকর এবং নদীতে কুমির, কচ্ছপ, ইত্যাদি বসবাসের জন্য এখানকার জলবায়ু অত্যন্ত চমৎকার। তাছাড়া সমুদ্র অঞ্চলে তিমি ও সুন্দরবনের অরন্যে ময়ূর বাস করে।

আমাদের দেশে দু’ধরনের পাখি দেখা যায়। কিছু কিছু পাখি এদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর সাথে মিশে স্থায়ীভাবে বাস করে আবার কিছু পাখি কিছুদিনের জন্য অতিথি হয়ে এদেশে আসে। সাধারণতঃ শীতের প্রারম্ভে এদেশের বড় বড় জলাশয়ে এদের আগমন ন্তু হয় এবং শীত শেষে বষার্র প্রারম্ভে এরা ফিরে যায়। আমাদের দেশের পাখিরা হলো কবুতর, হারকলা, ঘুঘু, টিয়া, ময়না, কোকিল, বউ কথা কও, চাতক, বিভিন্ন প্রজাতির বক, হারগিলা, মাছরাঙ্গা, জল কবুতর, বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, কোরা, ডাহুক, চিল, শকুন, গাংচিল, বনেশ, মাছমরাল, পেঁচা, কাঠ ঠুকরা, বুলবুলি, চড়ূই, কাক, সাতভাই, বাবুই, টুনটুনি, শ্যামা, দোয়েল, ফিঙ্গে ইত্যাদি।

এদের কোনটা বাড়ীতে, কোনটা বাড়ীর আশে—পাশের বাগানে, কোনটা বড় গাছের ডালে কোনটা জঙ্গলে বাস করে। মৌসুম ও আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের চলাফেরা এবং আচার আচরণেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

জলবায়ু ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে এদেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন বিভিন্ন গাছ পালা জন্মে তেমনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন জীবজন্তু ও পশু—পাখির বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। জীব জন্তু যে অঞ্চলে নিরাপদ আশ্রয় ও বসবাসের পরিবেশ ভাল পায় সেখানেই তারা দলবদ্ধভাবে বাস করে। শীতকালে বিভিন্ন জীবজন্তু ও পাখিরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে কিন্তু বর্ষাকালে যখন চারিদিকে পানি উঠে তখন তারা বাড়ির আশে—পাশ উঁচু জায়গায় চলে আসে। অনেক প্রজাতির জীবজন্তু বর্ষাকালে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করে অথচ শীতকালে তাদের তেমন দেখা যায় না।

 

 

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান – কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ বিষয়ের একটি পাঠ। এই পাঠটি ১ নং ইউনিটের ১.২ নং পাঠ।

 

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান

 

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশ বিষুব রেখার ২০.৩৪ ডিগ্রি থেকে ২৬.৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.০১ ডিগ্রি থেকে ৯২.৪১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় অবস্থিত দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট্ট দেশ। এর আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার (বি. বি. এস. ১৯৯৪)। বাংলাদেশের কিছু এলাকা অবনিরক্ষীয় এবং কিছু এলাকা নিরক্ষীয় অঞ্চলে অবস্থিত। বাংলাদেশের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা ও মায়ানমার, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনির হাট, গাইবান্ধা, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুর হাট জেলাসমহ অবনিরক্ষীয় ূ অঞ্চলের অন্তর্গত।


অন্যদিকে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম, ক*বাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি জেলাসমূহ নিরক্ষীয় অঞ্চলের অন্তভুর্ক্ত। বাংলাদেশের উপকূল রেখার বর্তমান দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৪৩ কিলোমিটার। এই উপকূল ক*বাজারের দক্ষিন হ’তে রায়মঙ্গল নদীর মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের উপকূলভাগে হাতিয়া, সন্দীপ, ভোলা, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সেন্টমার্টিন প্রভৃতি দ্বীপ রয়েছে।
আবহাওয়া ও জলবায়ু

কোন নির্দিষ্ট সময়ে কোন নির্দিষ্ট স্থানের বায়ু মন্ডলে যে অবস্থা বিরাজ করে ঐ অবস্থাকে সেই স্থানের উক্ত সময়ের আবহাওয়া বলে। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, সূর্যালোক, আর্দ্রতা, বায়ুর গতি, কূয়াশা, তুষারপাত প্রভৃতি হলো আবহাওয়ার উপাদান। বায়ুমন্ডলের অবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয় এবং ফলে আবহাওয়াও প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে। কোন স্থানের বা অঞ্চলের অন্ততঃ ২৫ বৎসরের

আবহাওয়ার গড়কে ঐ স্থানের বা অঞ্চলের জলবায়ু বলে। কোন সময়ই যে জলবায়ুর উলে­খযোগ্য পরিবর্তন হয়না তাকে সমভাবাপন্ন জলবায়ু বলে। কোন স্থানে বছরের অধিকাংশ সময় বৃষ্টিপাতযুক্ত হলে ঐ স্থানের জলবায়ু আর্দ্র হয়। অত্যাধিক ঠান্ডাও নয় আবার অত্যধিক উষ্ণও নয় এরূপ জলবায়ুকে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু বলে। যে স্থানে গ্রীষ্ম কালে অত্যাধিক গরম ও শীতকালে অত্যাধিক শীত, এরূপ স্থানের জলবায়ুকে চরমভাবাপন্ন জলবায়ু বলে। সমুদ্র উপকুলবর্তী স্থানগুলোর জলবায়ু মৃদুভাবাপন্ন। এতে শীত ও গ্রীষ্মের তারতম্য কম থাকে।

 

তাপমাত্রা:

তাপের আদি উৎস হলো সূর্য। সূর্য থেকে বিকিরণের মাধ্যমে তাপ বায়ুমন্ডল ভেদ করে আসার পথে নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এ তাপ বহুলাংশে কমে যায়। সূর্য হ’তে বিকিরিত যে তাপ পৃথিবীতে আসে তাকে সৌরতাপ বলে যা বিভিন্নভাবে বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করে। সৌরতাপ পৃথিবীর স্থল ও জলভাগে পতিত হওয়ায় ভূ—পৃষ্ট উত্তপ্ত হয়। পরে ভূ—ত্বক এ তাপ বিকিরন করায় বায়ুমন্ডল পূনরায় উত্তপ্ত হয়। বাংলাদেশের তাপমাত্রা মোটামুটি উষ্ণ। দেশের অধিকাংশ অঞ্চল সমতল ভূমি (৮৭%) হওয়ায় এবং দক্ষিনে সমুদ্র, উত্তরে হিমালয় পর্বত থাকায় এদেশে তত শীত বা গরম অনুভূত হয় না। তবে খরিপ মৌসুমে রবি মৌসুম অপেক্ষা তাপমাত্রা বেশি। খরিপ মৌসুমে তাপমাত্রা সাধারণতঃ ২৪ক্ক সেলসিয়াস হ’তে ৩৫ক্ক সেলসিয়াস এর মধ্যে থাকে।

তবে কোন কোন সময় এ তাপমাত্রা ৪৩ক্ক সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে থাকে। তাপমাত্রা দেশের দক্ষিনাঞ্চল হ’তে উত্তরাঞ্চলে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা ৭ক্ক সেলসিয়াস থেকে ২৭ক্ক সেলসিয়াস পর্যন্ত দেখা যায়। দক্ষিনের সমুদ্র উপকূল থেকে এ তাপমাত্রা উত্তর দিকে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এ সময় দেশের উত্তরাঞ্চলের কোন কোন জেলায় তাপমাত্রা ৪ক্ক সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসে। দেশের উত্তরাঞ্চলে খরিপ মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি হয় আবার রবি মৌসুমে এখানে তাপমাত্রা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম থাকে। এ অঞ্চলে কম তাপমাত্রা বেশি দিন থাকে বলে কিছু কিছু ফসল যেমন: গম এখানে ভাল জন্মে।

 

তাপমাত্রার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নিম্নলিখিত তিনটি  অঞ্চলে ভাগ করা যায়:

 

উত্তর অঞ্চল:

খরিপ মৌসুমে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হয় বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায়। ১৯৯২ সনে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪৩ক্ক সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। মধ্যম অঞ্চল বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলা সমূহে মধ্যম তাপমাত্রা বিরাজমান থাকে। খরিপ মৌসুমে এখানে সর্বোচ্চ ৩৮—৩৯ক্ক সেলসিয়াস তাপমাত্রা হয়ে থাকে।

 

দক্ষিণ—পূর্বাঞ্চল:

বৃহত্তর বরিশাল, কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলাসমূহে খরিপ মৌসুমে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হয়। এসময় এসব অঞ্চলে ৩৪— ৩৫ক্ক সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজমান থাকে। বৃষ্টিপাত বারিমন্ডল থেকে বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত প্রচুর পরিমানে জলীয় বাষ্প বায়ুতে ভেসে বেড়ায়। বায়ুর জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা তাপমাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোন কারণে বায়ুমন্ডলের

তাপমাত্রা ১০ক্ক সেলসিয়াস এর নিচে নেমে এলে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় ভূ—পৃষ্ঠে নেমে আসে যা বৃষ্টিপাত নামে পরিচিত। খরিপ মৌসুমে বাংলাদেশে দক্ষিন—পশ্চিম দিক থেকে মৌসুমি বায়ু বঙ্গপোসাগরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় ফলে এই মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। রবি মৌসুমে বায়ু উত্তর—পূর্ব দিকে অবস্থিত পর্বত অঞ্চল হ’তে প্রবাহিত হয় বলে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশের মোট বৃষ্টিপাতের পাঁচ ভাগের চারভাগই হয় বর্ষাকালে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় জুনজুলাই মাসে। তবে এই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দেশের পূর্বদিক হ’তে পশ্চিম দিকে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।

১৯৯২ সনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও সিলেটে যথাক্রমে ২২৪১ এবং ৩৫০৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ঘটে যা অন্যান্য জেলার তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয় রাজশাহী জেলায় যা মাত্র ৮৪৯ মিলিমিটার। সিলেট জেলার লালখালে বৎসরে দেশের সবার্পেক্ষা বেশি বৃষ্টিপাত হয় (৬৪৯৬ মিমি.) এবং সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয় রাজশাহী জেলার লালপুরে (১১৯৯ মিমি.)। দেশের বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত ২২২ মিমি কিন্তু নভেম্বর হ’তে মার্চ মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় মাত্র ৩০ মিলিমিটার। দেশে বৃষ্টিপাত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া সত্ত্বেও সময়মত ও পরিমাণ মত না হওয়ায় প্রত্যেক বৎসরেই জমিতে প্রয়োজনীয় রসের অভাবে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং রবি মৌসুমে সেচ ছাড়া সাফল্যজনকভাবে কোন ফসল করা সম্ভব হয়না।

বৃষ্টিাপাতের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে নিম্নলিখিত তিনভাগে ভাগ করা যায় —

* কম বৃষ্টিপাত অঞ্চল — বৃহত্তর রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চল।

* মাঝারী বৃষ্টিপাত অঞ্চল — বৃহত্তর ঢাকা ও খুলনা অঞ্চল।

* বেশি বৃষ্টিপাত অঞ্চল — বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল। আপেক্ষিক আর্দ্রতা

কোন নির্দিষ্ট উষ্ণতায় ও চাপে কোন নিদ্দির্ষ্ট আয়তনের বায়ুতে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প আছে এবং একই উষ্ণতায় ও চাপে ঐ পরিমাণ বায়ুকে সম্পৃক্ত করতে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্পের প্রয়োজন হয় —এ দু’য়ের
অনুপাতকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বলে।

বায়ুতে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতিকে আর্দ্রতা বলে। কোন স্থানের আর্দ্রতা সেই স্থানের বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল। কোন নির্দিষ্ট উষ্ণতায় ও চাপে কোন নিদ্দির্ষ্ট আয়তনের বায়ুতে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প আছে এবং একই উষ্ণতায় ও চাপে ঐ পরিমাণ বায়ুকে সম্পৃক্ত করতে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্পের প্রয়োজন হয় —এ দু’য়ের অনুপাতকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বলে। আপেক্ষিক আর্দ্রতাকে শতকরা (%) হারে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে বর্ষাকালে আর্দ্রতা শীতকাল অপেক্ষা বেশি। কারণ এ সময় তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং নদী—নালা পানিতে ভরাট থাকায় বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়।

উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার জন্য এ দেশ পাট উৎপাদনের জন্য বেশি উপযোগী। বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে সাধারণতঃ শতকরা ৭০—৮০ ভাগ আপেক্ষিক আর্দ্রতা দেখা যায়। এই আর্দ্রতা দিনের প্রারম্ভে বেশি থাকে। সূর্যের আলো সূর্যের আলো না থাকলে পৃথিবী এমন সবুজ সুন্দর থাকত না। সূর্যের আলোক শক্তিকে ব্যবহার করে সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য তৈরী করে যার উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষসহ সকল প্রাণী নির্ভরশীল। সব গাছের জন্য সূর্যের প্রত্যক্ষ আলো বাঞ্ছনীয় নয়। চা, পান ইত্যাদি গাছের জন্য ঈষৎ ছায়ার ব্যবস্থা থাকা ভাল। সরাসরি সূর্যের আলো এসব গাছের পাতা ঝলসিয়ে দেয়।

এজন্য চা বা পানের জমিতে যথাক্রমে শিম^ জাতীয় গাছ ও পাটশোলা কিংবা খড়কুটা দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করা হয়। আবার কোন কোন ফসল যেমন: হলূদ ছায়াযুক্ত স্থানে ভাল জন্মে। দিনের দৈর্ঘ্য যে সমস্ত উদ্ভিদ একটি নির্দিষ্টি দিন দৈর্ঘ্য বা তার আগে শীষ, ফুল, ফল বা বীজ উৎপন্ন করে তাদেরকে ছোট উদ্ভিদ বলে।

দিনের দৈর্ঘ্যের উপর আলো ও তাপমাত্রার পরিমাণ নির্ভর করে। শীতকালে ক্ষুদ্রতম দিন ১০ ঘন্টা এবং বর্ষাকলে বৃহত্তম দিন প্রায় ১৪ ঘন্টা হয়ে থাকে। দিন বড় হলে আলোর পরিমাণ বেশি হয় যদি আকাশে মেঘ না থাকে এবং কম হলে আলোর পরিমাণ কমে যায়। বড় দিন বা আলো অনেক উদ্ভিদের ফুল ও বীজ উৎপাদন ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। উদ্ভিদ জীবনের উপর এ বিশেষ প্রক্রিয়া তথা যৌন বংশ বৃদ্ধির উপর আলোর এরূপ প্রভাব বিস্তারকে ফটোপিরিয়ডিজম বলে। গাছের জন্ম এবং বৃদ্ধির উপর দিনের দৈর্ঘে্যর সরাসরি প্রভাব রয়েছে।

কিছু কিছু গাছপালা আলোক সংবেদনশীল আবার কোন কোন গাছপালা আলোক সংবেদনশীল নয়। আলোক সংবেদনশীল গাছ ফটো পিরিয়ড কতৃর্ক প্রভাবান্বিত হয়। কিন্তু যে সকল গাছ আলোক সংবেদনশীল নয় তারা ফটো পিরিয়ড কতৃর্ক প্রভাবান্বিত হয় না। ফটো পিরিয়ডের উপর ভিত্তি করে আলোক সংবেদনশীল গাছকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যথা — ১। ছোট দিন উদ্ভিদ এবং ২। বড় দিন উদ্ভিদ ।

 

ফটো পিরিয়ডের উপর ভিত্তি করে আলোক সংবেদনশীল গাছ:

ছোট দিন উদ্ভিদ

যে সমস্ত উদ্ভিদ একটি নির্দিষ্টি দিন দৈর্ঘ্য বা তার আগে শীষ, ফুল, ফল বা বীজ উৎপন্ন করে তাদেরকে ছোট দিন উদ্ভিদ বলে। এই দিন দৈর্ঘ্য বিভিন্ন ফসল বা গাছের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হ’তে পারে
এবং একে ক্রিটিক্যাল দিন দৈর্ঘ্য (ঈৎরঃরপধষ ফধু ষবহমঃয) বলে। ছোট দিন উদ্ভিদ ক্রিটিক্যাল দিন
দৈর্ঘ্য বা ফটো পিরিয়ডের পরে ফুল ফল দেয় না। যেমন — পাট, সয়াবীন, ইত্যাদি।

যে সমস্ত উদ্ভিদ কেবল মাত্র কোন নির্দিষ্ট দিন দৈর্ঘে্যর পরেই ফুল, ফল দেয় তাদেরকে বড় দিন উদ্ভিদ বলে।

 

বড় দিন উদ্ভিদ

যে সমস্ত উদ্ভিদ কেবল মাত্র কোন নির্দিষ্ট দিন দৈর্ঘে্যর পরেই ফুল, ফল দেয় তাদেরকে বড় দিন উদ্ভিদ বলে। নির্দিষ্ট ফটো পিরিয়ডের পূর্বে এসকল উদ্ভিদ কোন ক্রমেই ফুল, ফল দেয় না। দিন নিরপেক্ষ উদ্ভিদকোন কোন উদ্ভিদ দিন নিরপেক্ষ। দিন নিরপেক্ষ উদ্ভিদের ফুল, ফল উৎপাদনে ফটো পিরিয়ডের কোন প্রভাব নেই। বড় দিন উদ্ভিদের ফুল, ফল গ্রীষ্মকালে এবং ছোট দিন উদ্ভিদের ফুল ফল শীত ও বসন্তকালে আসে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মাসের দিনের দৈর্ঘ্য নিম্নে দেয়া হলো।

বায়ু প্রবাহ বায়ু মন্ডলের তাপমাত্রার পার্থক্যের ফলে সৃষ্ট বায়ুমন্ডলীয় চাপের পার্থক্যের কারণে প্রায় প্রতি মুহূর্তে বায়ু একস্থান হ’তে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে। বায়ুর এই স্থানান্তরকে বায়ু প্রবাহ বলে। বাংলাদেশে প্রধানতঃ দু‘ধরনের বায়ু প্রবাহ দেখা যায়। যথা ঃ ১। সাময়িক (ঝবধংড়হধষ) এবং ২। অনিয়মিত বায়ু প্রবাহ। সাময়িক বায়ু প্রবাহের মধ্যে এদেশে স্থল বায়ু, সমুদ্র বায়ু এবং মৌসুমি বায়ু উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে অনিয়মিত বায়ু প্রবাহের মধ্যে সাইক্লোন বা ঘুর্ণিঝড়, কালবৈশাখী এবং টর্নেডোর নাম করা যেতে পারে।

শীতকালে মৌসুমি বায়ু উত্তর পূর্ব—দিক হ’তে প্রবাহিত হয় এবং এ বায়ুর গতিবেগ কম এবং কোনরূপ জলীয় বাষ্প থাকেনা ফলে এ বায়ু প্রবাহের ফলে কোন বৃষ্টিপাতও হয় না। মার্চ—এপ্রিল মাসে এদেশে কালবৈশাখী আঘাত হানে এবং জানমালের বেশ ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। জুন—সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ—পশ্চিম দিক হ’তে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এ বায়ু সমুদ্র হ’তে প্রচুর জলীয় বাষ্প বয়ে আনে এবং এসময় দেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়। অক্টোবর—নভেম্বর মাসে সমুদ্র উপকূলবতীর্ অঞ্চলে সাধারনতঃ সাইক্লোন ও জলোচ্ছাস হয়ে থাকে। বঙ্গোপসাগরের তীরে শেষরাতে ও ভোরের দিকে স্থলভাগ হ’তে স্থলবায়ু সমুদ্রের দিকে এবং অপরাহ্নে সমুদ্র থেকে সুমুদ্র বায়ু স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়।

কৃষি মৌসুম বাংলা বছরে ২ মাসে এক ঋতু হয়। এগুলো হচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। কিন্তু কোন ফসলই দুই মাসে তার জীবন চক্র সম্পন্ন করতে পারেনা। তাই কৃষি কাজের সুবিধার্থে সমস্ত বছরকে প্রধানতঃ দুটি কৃষি মৌসুমে ভাগ করা হয়েছে —

* রবি মৌসুম
* খরিপ মৌসুম ।

রবি মৌসুম

নভেম্বর মাসে রবি মৌসুম শুরু হয় এবং শেষ হয় ফেব্রুয়ারী মাসে। যে সকল ফসলের জীবনকাল সম্পূর্ণ বা অধিকাংশ সময় এ মৌসুমে অতিবাহিত করে সেগুলোকে রবিশস্য বলে। যেমন— তামাক, গোল আলু, গম, মসুর, খেসারী, ছোলা ইত্যাদি।

 

খরিপ মৌসুম

খরিপ মৌসুম শুরু হয় মার্চ মাসে এবং শেষ হয় অক্টোবর মাসে। যে সকল ফসলের জীবন চক্রের সম্পূর্ণ বা অধিকাংশ সময় এই মৌসুমে অতিবাহিত হয় সেগুলোকে খরিপ শস্য বলে। যেমন— আউশ ধান, পাট এবং বিভিন্ন গ্রীষ্মকালীন শাক—সব্জি। খরিপ মৌসুমকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা ঃ—

খরিপ—১ একে প্রাক খরিপ মৌসুমও বলা হয়। খরিপ—১ মার্চ মাসে শুরু হয়ে জুন মাসে শেষ হয়।

খরিপ—২ জুলাই মাসে শুরু হয় এবং অক্টোবর মাসে শেষ হয়। রবি মৌসুমে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতা কম থাকে। দিন ছোট হয় এবং রাত বড় থাকে। এসময় মৌসুমি বায়ু উত্তর—পূর্ব দিক হ’তে প্রবাহিত হয় বলে দেশে বৃষ্টিপাত কম হয়। রবি ফসলের মধ্যে উলে­খযোগ্য হলো রবি সব্জি যেমন— আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, লাউ, গম, সরিষা, তিষি, চীনাবাদাম ও ডাল জাতীয় ফসল।

খরিপ মৌসুমে তাপমাত্রা , বৃষ্টিপাত এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে। দিন বড় ও রাত ছোট হয়। দক্ষিন—পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহের ফলে এসময় দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। খরিপ ফসলের মধ্যে রয়েছে ঢঁ্যাড়স, পুইশাক, আউশ ধান, ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পরে যে, কেবল একবষীর্ ফসল সম হকেই রবি এবং খরিপ ফসল অনুযায়ী ভাগ করা সম্ভব।

 

 

কৃষির ধারণা ও গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের ভূমির প্রকৃতি

কৃষির ধারণা ও গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের ভূমির প্রকৃতি – কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ বিষয়ের একটি পাঠ। এই পাঠটি ১ নং ইউনিটের ১.১ নং পাঠ।কৃষিকে ইংরেজীতে “Agriculture” এবং ল্যাটিনে “Agricultura” বলে। দু’টি ল্যাটিন শব্দ ‘Ager’ এবং cultura’ এর সমন্বয়ে “Agriculture” বা কৃষি গঠিত। ‘Ager’ অর্থ জমি এবং ‘cultura’ অর্থ চাষ করা। তাই শাব্দিক অর্থে কৃষি হলো জমি চাষ করে ফসল দু’টি ল্যাটিন শব্দ ‘Ager’ এবং cultura’ এর সমন্বয়ে “Agriculture” বা কৃষি গঠিত । ‘Ager’ অর্থ জমি এবং ‘Cultura’ অর্থ চাষ করা। তাই শাব্দিক অর্থে কৃষি হ’লো জমি চাষ করে ফসল উৎপাদন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে কৃষি সম্বন্ধে মানুষের সীমিত ধারণারও বিস্তৃতি ঘটেছে।

কৃষির ধারণা ও গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের ভূমির প্রকৃতি

 

 

বর্তমানে কৃষি বলতে ভূমি কর্ষণ তথা জমি প্রস্তুতকরণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার শস্য, ফল—মূল, গাছ—পালা, শাক—সব্জি ও ফুল, পশু ও পশুজাত দ্রব্য এবং মৎস্য উৎপাদনকে বুঝানো হয়। শুধু কৃষিতত্বই (Agronomy) কৃষি বিজ্ঞান নয়। যে সকল বিদ্যার ব্যবহার দ্বারা উৎপাদন কায্যর্ সম্পন্ন হয়ে থাকে সে সবগুলোই কৃষি বিজ্ঞানের অন্তভূর্ক্ত। আর সেগুলো হচ্ছে শস্য উৎপাদন (Crop production), পশুপালন (Animal Husbandry), পশু চিকিৎসা (Veterinary science), কৃষি প্রকৌশল (Agricultural engineering), কৃষি অর্থনীতি (Agricultural economics) এবং তৎসংশি­ষ্ট বিষয়াদি। এক কথায় মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ঔষধ এবং সার্বিক মঙ্গলার্থে প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদান গুলো উৎপাদনে প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই কৃষি বিজ্ঞান।

কৃষি মানুষের মৌলিক চাহিদাবলী যথা খাদ্য, বস্ত্র , আশ্রয়ের মৌলিক উপাদান গুলোর যোগান দেয়। কৃষি মানুষের মৌলিক চাহিদাবলী যথা খাদ্য, বস্ত্র , আশ্রয়ের মৌলিক উপাদানগুলোর যোগান দেয়। কৃষির উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। কৃষি বাংলাদেশের জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির মেরুদন্ড। “জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধি হলো গাছের ন্যায়। কৃষি হলো তার মূল, শিল্প তার শাখা এবং বাণিজ্য তার পাতা। মূলে ক্ষত দেখা দিলে তা সমস্ত গাছটিকে ধ্বংস করে দেয়”Ñ চীনা এ প্রবাদটি কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রযোজ্য । বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি সুষ্ঠু কৃষি উন্নয়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। মানুষের অস্তিত্বের সাথে জড়িত

কৃষির গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

  • মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ হলো খাদ্যÑ যা কৃষি থেকে আসে।
  • কৃষি শিল্পের কাঁচামালের প্রধান উৎস ।
  • কৃষি দেশের রাজস্বের প্রধান উৎস।
  • কৃষি মানুষের জীবিকার উৎস ।
  • কৃষি পণ্য আমদানি রপ্তানির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে ।
  • কৃষি জ্বালানির উৎস।
  • বাসস্থান ও আসবাবপত্র তৈরিতে কৃষির অবদান অনস্বীকার্য।

জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কৃষির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মানুষকে বেেঁচ থাকার জন্য কৃষি পণ্যের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হ’তে হয়। অতএব কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম।

 

 

বাংলাদেশের ভূমির প্রকৃতি:

সাধারণভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৮৭ ভাগ সমতলভূমি তবে ভূতলের সমতা একইরূপ নয়। ভূতলের সমতার ভিত্তিতে সমগ্র বাংলাদেশকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো :

১। উঁচু ভূমি

উঁচু ভূমি অঞ্চলের মৃত্তিকা প্রাচীন পলল দ্বারা গঠিত হওয়ায় একে “প্রাচীন পলল ভূমি” নামেও অভিহিত করা হয়। এখানকার মাটি লাল বর্ণের ও কঙ্কর যুক্ত। এরূপ জমিতে বর্ষার পানি জমে না। আইল দিয়ে পানি আটকিয়ে ফসল উৎপন্ন করা হয়। মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় অঞ্চল, রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুরের অন্তর্গত বরেন্দ্র অঞ্চল, কুমিল্লার লালমাই অঞ্চল এবং সিলেটের টিলা অঞ্চল নিয়ে উঁচু ভূমি গঠিত। এ অঞ্চলের মৃত্তিকা প্রাচীন পলল দ্বারা গঠিত হওয়ায় একে “প্রাচীন পলল ভূমি” নামেও অভিহিত করা হয়। এখানকার মাটি লাল বর্ণের ও কঙ্কর যুক্ত। এখানে সাধারনত গজারি, শাল, চা, নানা রকম ফল, রোপা আমন ধান, বিভিন্ন শাক—সব্জি ভাল জন্মে। উঁচু ভূমির মোট আয়তন ২৩,৩০০ বর্গ কিলোমিটার।

২। মধ্যম ভূমি

এই অঞ্চলে জমির পানি আইল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহের কিছু অংশ, ঢাকার উত্তরাংশ, বরিশাল, ও সিলেটের কিছু অংশ, কুমিল­া, নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের পূবার্ঞ্চল নিয়ে মধ্যম ভুমি গঠিত। আউশ ধান, আমন ধান ও পাট এ অঞ্চলের প্রধান ফসল। এর মোট আয়তন ৬২,১৩৩ বর্গ কিলোমিটার।

৩। নিচু ভূমি

এ অঞ্চলে বর্ষাকালে সাধারণতঃ ৩—৪ ফুট পানি হয় এবং কোন কোন সময় পানির উচ্চতা দাঁড়ায় ১০১২ ফুট। পাবনা ও ফরিদপুর জেলার অধিকাংশ অঞ্চল, ঢাকা জেলার দক্ষিনাংশ, কুমিল্লা ও নোয়াখালি জেলাদ্বয়ের পশ্চিমাংশ, বগুড়া, খুলনা ও সিলেটের কিছু অংশ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। ছিটিয়ে বোনা আমন, আউশ, পাট ও রবিশস্য এ অঞ্চলের প্রধান ফসল। এর মোট আয়তন ৩৪,৯৫০ বর্গ কিলোমিটার।

৪। অত্যন্ত নিচু জমি

দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বিল, হাওর ও নদী নালার তীরবর্তী এলাকাসমূহ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। বর্ষাকলে এ অঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং বিরাট হ্রদের মত দেখায়। বর্ষাকালে এসমস্ত এলাকায় পানির গভীরতা ৩০ ফুট পর্যন্ত হ’তে পারে কিন্তু শীতকালে মধ্যস্থান ব্যাতিত অন্যস্থান শুকিয়ে যায়। রবি মৌসুমে সেচের সাহায্যে এখানে বোরো ধান করা যায়। এ অঞ্চলের আয়তন ৪,১৪২ বর্গ কিলোমিটার।

৫। পাহাড়ি অঞ্চল

পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম জেলার কিয়দংশ, কুমিল্লা জেলার লালমাই অঞ্চল, সিলেট জেলার দক্ষিণপূর্বাংশ, নোয়াখালি জেলার উত্তর পূবার্ংশ এবং ময়মনসিংহ জেলার উত্তর—পূর্বাংশ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। অনেকগুলো ছোট বড় পাহাড়, টিলা এবং এদের পাদভূমি নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগামের পাহাড়িয়া অঞ্চলই বাংলাদেশের একমাত্র বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকা। এখানকার পাহাড়ের সর্বোচ্চ চুড়া কিয়োক্রাডাং এর উচ্চতা ১,২৩২ মিটার। প্রায় সমস্ত অঞ্চলই বন জঙ্গলে আবৃত। এখানে আনারস, কাঁঠাল ভাল হয়। আয়তন ১৮,১২২ বর্গ কিলোমিটার।

 

 

 

বাচ্চা ফোটানোর জন্য ডিম বাছাইকরণ ও ডিম ফোটানো পদ্ধতি

বাচ্চা ফোটানোর জন্য ডিম বাছাইকরণ ও ডিম ফোটানো পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করবো আজ। এই পাঠটি কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র এর ৮ নং ইউনিটের ৮.২ নম্বর পাঠ। এখানে আলোচনা করা হয়েছে ডিম থেকে সন্তোষজনক হারে স্বাস্থ্যবান ও উৎপাদনশীল বাচ্চা পাওয়ার জন্য কিভাবে সঠিকভাবে ডিম নির্বাচন করতে হবে।

 

বাচ্চা ফোটানোর জন্য ডিম বাছাইকরণ ও ডিম ফোটানো পদ্ধতি

 

বাচ্চা ফোটানোর জন্য সুস্থ ডিম নির্বাচন:

নিচের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ডিম নির্বাচন করলে সর্বাধিক বাচ্চা পাওয়া যেতে পারে।

 

 

১. নিষিক্ত ডিম:

ফোটানোর জন্য ব্যবহৃত ডিম নিষিক্ত হতে হবে। আর এজন্য মুরগিকে মোরগের সংস্পর্শে থাকতে হবে ও প্রজনননে অংশ নিতে হবে।

 

২. ডিমের আকার:

ফোটানোর জন্য ডিমের আকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিমের আকার স্বাভাবিক হতে হবে। প্রজাতিভেদে ডিমের আদর্শ ওজন কেমন হয় তার ধারণা থাকতে হবে। সাধারণত মাঝারি আকারের ডিম ফোটানোর জন্য ভালো। মুরগি, হাঁস ও জাপানি কোয়েলের ডিমের আদর্শ ওজন যথাক্রমে ৫০—৫৮ গ্রাম, ৬০—৭০ গ্রাম ও ৮—১০ গ্রাম হওয়া বাঞ্ছনীয়। আদর্শ মানের চেয়ে অতিরিক্ত বড় বা ছোট ডিম ব্যবহার করলে ফোটার হার কম হবে। আবার বেশি লম্বা ও বড় আকারের ডিমে ২টি কুসুম থাকতে পারে বলে এসব ডিম থেকে কখনই বাচ্চা ফুটবে না।

 

৩. ডিমের আকৃতি:

মুরগির ডিম ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। অস্বাভাবিক বা বিকৃত, যেমন— লম্বাটে, গোলাকার, আঁকাবাকা ডিম ফোটানোর জন্য নিবার্চন যোগ্য নয়।

 

৪. ডিমের খোসার পরিচ্ছন্নতা:

অবশ্যই পরিষ্কার ডিম নির্বাচন করতে হবে। অপরিষ্কার ডিম জীবাণুর উৎস। অপরিষ্কার ডিম থেকে একদিকে যেমন ডিম ফোটানোর সময় অন্য ডিমে জীবাণু ছড়ায় তেমনি যন্ত্রপাতিও নোংরা হয়। এতে ডিম ফোটার হারও কমে যায়। তবে অল্প ময়লা লেগে থাকলে তা পরিষ্কার ও শুষ্ক কাপড় বা শিরিষ কাগজ দিয়ে মুছে ফোটানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ফোটানো ডিম কখনও পানি দিয়ে ধোয়া যাবেনা।

 

৫. ডিমের খোসার রং ও গুরুত্ব:

ডিমের খোসার রং পোল্টি্রর প্রজাতি ও জাতভেদে ভিন্ন হতে পারে। যে প্রজাতি বা জাতের ডিম যে রঙের সে রঙের ডিমই ব্যবহার করতে হবে। খোসা পাতলা ও অসমৃণ হলে ডিম ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়। মুরগির ডিমের ক্ষেত্রে ডিমের খোসার আদর্শ পুরত্ব ০.৩৩ মি.মি. হলে ভালো হয়।

 

৬. ফাটা বা ভাঙ্গা ডিম:

ফাটা বা ভাঙ্গা ডিম নির্বাচন করা যাবে না। আগেই বলা হয়েছে ডিমে অসংখ্য সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে যা বাইরে থেকে এমনিতে বোঝা যায় না। এক্ষেত্রে একটি ডিমকে অন্য আরেকটি ডিম দিয়ে আলতোভাবে আঘাত করলে সৃষ্ট শব্দ যদি নিস্তেজ হয় তাহলে বুঝতে হবে ডিম ফাটা।

 

 

৭. ডিমের বয়স:

ডিমের বয়স বলতে সাধারণভাবে ডিম পাড়ার দিন থেকে ফোটানোর জন্য বসানোর সময় পর্যন্ত সময়টাকেই বুঝায়। বাচ্চা ফোটানোর ডিমের জন্য বয়স গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিমের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাচ্চা ফোটার হারও কমতে থাকে। শীতকালে সবোর্চ্চ ৭—১০ দিন এবং গরমকালে ৩—৪ দিনের বেশি বয়সের ডিম ফোটানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে না।

 

৮. ডিমের ভিতরের বৈশিষ্ট্য:

বাইরে থেকে স্বাভাবিকভাবে ডিমের বৈশিষ্ট্য বোঝা যায় না। আলোতে পরীক্ষা করলে তা বুঝা যায়।

 

 

৯. ডিমের সাদা অংশ ও কুসুমের পরিমাণ:

ডিমের সাদা অংশ ও কুসুমের পরিমাণের অনুপাত হবে ২ঃ১। ডিমের মধ্যে কোনো রক্তের ছিটা, ঘোলাটে বায়ু ইত্যাদি থাকলে তা বাদ দিতে হবে।

 

১০. ভাসমান বায়ু থলি:

ফোটানোর ডিম সঠিকভাবে হ্যান্ডলিং করতে হবে। ফোটানোর ডিম ঝাঁকানো যাবে না। অতিরিক্ত ঝাঁকালে ভাসমান বায়ু থলি তৈরি হয় যা ডিম ফোটানোর উপযোগী নয়।

 

 

১১. সাধারণ তাপমাত্রায় এনে ব্যবহার:

দূরবর্তী জায়গা থেকে ডিম সংগ্রহ কর ল তা কিছু সময় ছায়ায় রেখে পরে ফোটানোর জন্য ব্যবহার করতে হবে।

 

 

 

ডিম ফোটানোর পদ্ধতি:

ডিম থেকে বাচ্চা ফোটনোর জন্য কিছু পদ্ধতি রয়েছে। সাধারণত ডিম ফোটানোর পদ্ধতি দুই ভাগে বিভক্ত। যেমন— ১. প্রাকৃতিক পদ্ধতি ২. কৃত্রিম পদ্ধতি। কৃত্রিম পদ্ধতিকে পুনরায় ভাগ করা যায়। যেমন – ক) তুষ পদ্ধতি, খ) ইনকিউবেটর পদ্ধতি। ইনকিউবেটর পদ্ধতি আবার দু’ধরনের। যেমন— ১. কোরোসিন ইনকিউবেটর পদ্ধতি, ২. বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর পদ্ধত। আসুন জেনে নেয়া যাক বিস্তারিত।

চিত্র ৮.২.১ : বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর

 

১) প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ডিম ফোটানো:

প্রাকৃতিক পদ্ধতি হচ্ছে সবার্ধিক প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতি। এ পদ্ধতির সঙ্গে কম—বেশি সবাই পরিচিত। গ্রামাঞ্চলে অল্প পরিসরে যারা হাঁস—মুরগি পালন করেন তারা এই পদ্ধতিতে ডিম ফুটিয়ে থাকেন। দেশি মুরগি ১০—১২টি ডিম দেওয়ার পর উমে বা তায়ে বসার প্রবণতা দেখা যায়। এই অবস্থায় মুরগিকে কুঁচে মুরগি বলে। তখন মুরগিকে একটি নীরব স্থানে বাক্সে অথবা ঝুড়িতে কিছু বিছানাপত্র, যেমন— খড়, শুকনো পাতা বা তুষ রেখে তার উপর ১০—১২টি ডিম দিয়ে বসানো হয়। এ সময় মুরগির কাছাকাছি পাত্রে খাবার ও পানি রাখতে হয় যাতে চাইলেই মুরগি খেতে পারে।

ডিমে বাতাস চলাচল ও মুরগির স্বাস্থ্যের জন্য দিনে একবার ডিম থেকে উঠিয়ে দিতে হয়। এই সময় মুরগি খাবার ও পানি গ্রহণ করবে। খেয়াল রাখতে হবে মুরগি যাতে আধা ঘন্টার বেশি বাইরে না থাকে। এতে ডিমের সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকবে না। মুরগি তার নিজের ঠোঁট দিয়ে ডিমগুলো ঘুরিয়ে দেয়। এতে ডিমের সবদিকে তাপমাত্রা ঠিক থাকে। মুরগির বসার জায়গায় কোন প্যারাসাইট অথার্ৎ উকুন বা অন্য কোন রক্তচোষক আছে কি—না সেদিকে নজর রাখতে হবে। ডিম বসানোর পর কোন ডিম যদি ভেঙ্গে যায়, তাহলে সেটি দ্রুত সরিয়ে নিতে হবে যাতে অন্য ডিম নোংরা না হয়।

ডিমে তা দেওয়ার সময় মুরগিকে কোনোভাবেই বিরক্ত করা যাবে না। মুরগির ঘরে যথেষ্ঠ আলো—বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং বৃষ্টির দিনে যাতে পানি না পড়ে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে মুরগির ডিম থেকে ২১ দিন পর এবং হাঁসের ডিম থেকে ২৮ দিন পর বাচ্চা পাওয়া যাবে। ডিম বসানোর উপযুক্ত সময় হলো রাত। রাতে ডিম বসালে ২১ দিন পর রাতে সকল বাচ্চা ফুটবে এবং বাচ্চারা সারা রাত বিশ্রাম পাবে। পরদিন সকালে বাচ্চা বাইরে বেরুরে শক্তি পাবে।

 

 

২) কৃত্রিম পদ্ধতিতে ডিম ফোটানো:

প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মুরগি যেভাবে ডিম ফোটায় সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে যা দিয়ে ডিম ফোটানো হয়, এটিকে কৃত্রিম পদ্ধতি বলে। পূর্বে বলা হয়েছে কৃত্রিম পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে— ১) তুষ পদ্ধতি ২) ইনকিউবেটর পদ্ধতি।

নিচের এগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনার করা হলো।

 

তুষ পদ্ধতিতে ডিম ফোটানো:

গ্রামাঞ্চলে সাধারণত প্রাকৃতিক পদ্ধতি দেখা যায়। তবে আজকাল তুষ পদ্ধতি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় বাচ্চা ফোটানোর জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই অথচ অনেক ডিম ফোটানো দরকার সেসব অঞ্চলে তুষ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

এই পদ্ধতিতে হাঁস ও মুরগির ডিম ফোটানো হয়। তবে আজকাল তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম ফোটানো একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই পদ্ধতিতে দৈহিক পরিশ্রম হলেও খরচ খুব সামান্য। তুষ পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো— বাঁশের চাঁটাই দিয়ে তৈরি নলাকৃত ঝুড়ি, হারিকেন, কাপড়, বায়ুচলাচল শূন্য ও তাপ নিরোধক কক্ষ, বাচ্চা ফোটানোর বিছানা এবং থামোর্মিটার। ইনকিউবেটর পদ্ধতি: ডিম ফোটানোর আধুনিক পদ্ধতির নাম হচ্ছে ইনকিউবেটর পদ্ধতি। এটি প্রধানত দু’ধরনের যথা— ক) কেরোসিন ইনকিউবেটর— নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই ইনকিউবেটরের মুল জ¦ালানি হচ্ছে কোরোসিন।

 

 

বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানো:

বিদ্যুতের সাহায্যে এই ইনকিউবেটর চালিত হয় বলে এর নাম বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর।

 

কেরোসিন ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানো:

বিদ্যুতবিহীন এলাকাগুলোতে তুষ ইনকিউবেটরের পাশাপাশি কেরোসিন ইনকিউবেটর ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মূল জ¦ালিান যেহেতু কেরোসিন তুষ ইনকিউবেটরের তুলনায় কেরোসিন ইনকিউবেটরে খরচ একটু বেশি হয়। কেরোসিন ইনকিউবেটরে ৫০—৫০০টি ডিম ফোটানো যায়। তবে ডিম ফোটানোর সকল পদ্ধতির মূলনীতি একই। কেরোসিন ইনকিউবেটরের দাম বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরের তুলনায় কম। সাধারণত কেরোসিন ইনকিউবেটর ডিম ফোটানোর জন্য ৩৮.০—৩৯.৪ সে. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

 

 

বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানোর পদ্ধতি:

ডিম ফোটানোর সর্বাধুনিক পদ্ধতি এটি। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো একসাথে প্রায় এক লক্ষ ডিম ফোটানো যায়। তবে ধারণ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে ছোট, মাঝারি ও বড় আকৃতির ইনকিউবেটর পাওয়া যায় যা প্রস্তুতকারক কোম্পানির ওপর নির্ভর করে। বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর এমন জায়গায় বসাতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল করে। ইনকিউবেটরে ডিম বসানোর পূর্বে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে, সেই সাথে ইনকিউবেটর সঠিকভাবে কাজ করছে কি—না সেটাও পরীক্ষা করতে হবে।

বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরের প্রধান দুটি অংশ হচ্ছে সেটার ও হ্যাচার। সেটার হচ্ছে যেখানে ডিম বসানো হয়। এখানে নিয়মিত বিরতিতে ডিম ঘোরানো হয়। আর হ্যাচার হচ্ছে ডিম ফোটানোর শেষ তিন দিন যে ট্রেতে ডিম রাখা হয়। অনেক ইনকিউবিটরে সেটার ও হ্যাচার আলাদা নাও থাকতে পারে। সেটারে ডিম বসানোর জন্য খাঁজ/খোপ করা থাকে কিন্তু হ্যাচারে কোনো খোপ থাকে না। ডিম বসানোর সময় ডিমের মোটা অংশ যেন উপর দিকে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডিম ৪৫ কোন করে সেটিং ট্রেতে বসাতে হবে।

বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানো ব্যবস্থাপনা: সফলভাবে ডিম ফোটানোর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ গুরুত্বসহকারে পালন করা প্রয়োজন।

 

১. তাপমাত্রা:

ডিম ফোটানোর জন্য ইনকিউবেটরে ৯৯—১০০ ফারেনহাইট তাপমাত্রা রাখতে হবে। ডিম ফোটানোর জন্য সঠিক তাপমাত্রা ইনকিউবেটরের প্রস্তুতকারক কোম্পানির নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। অতিরিক্ত বা প্রয়োজনের কম তাপমাত্রা দুটোই ক্ষতিকারক। ডিমের চারিদিকে যেন সমভাবে তাপমাত্রা লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পূর্বের তিন দিন তাপমাত্রা ২—৩ ফারেনহাইট কম রাখতে হবে।

 

২. বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা:

ডিমের ভিতরে যেহেতু ভ্রƒণের জন্ম হয় ও ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে, তাই সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন থাকা অপরিহার্য। ইনকিউবেটরের বায়ুতে স্বাভাবিক অক্সিজেনের পরিমাণ ২১% হওয়া বাঞ্ছণীয়। অন্যদিকে, কার্বন—ডাই—অক্সাইড (ঈঙ২)—এর মাত্রা ০.৫% বেশি হলে ডিম ফোটার হার কমে যায়। এজন্য সঠিক জায়গায় ইনকিউবেটর রাখতে হবে যাতে পযার্প্ত বাতাস চলাচল করে।

 

৩. আর্দ্রতা:

মুরগির ডিমের ক্ষেত্রে প্রথম ১৮ দিন আর্দ্রতা লাগে ৫৫—৬২% এবং শেষ তিন দিন অথার্ৎ ১৯—২১ দিন ৬৫—৭৫%। আদর্শ আপেক্ষিক আর্দ্রতার চেয়ে কম হলে ভ্রƒম্নণ ডিমের খোসার একপাশে লেগে থাকে ফলে ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে পারে না। অনেক সময় ভ্রƒণ শুকিয়ে যায়। এজন্য প্রস্তুতকারক কোম্পানির নির্দেশনা অনুযায়ী আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

 

৪. ডিম পরীক্ষাকরণ:

সাধারণত ইনকিউবেটরে ডিম বসানোর ৭—১০ দিনের মধ্যে প্রথম বার এবং ১৪—১৮ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বার পরীক্ষা করা হয়। এজন্য এক ধরনের যন্ত্র (ক্যান্ডেলার) ব্যবহার করা হয়। একটি অন্ধকার ঘরে ক্যান্ডেলার দ্বারা ডিম পরীক্ষা করা হয়। ডিম নিষিক্ত হলে তাতে রক্তজালিকার মতো দেখা যায়। যদি রক্তজালি ডিমের মোটা অংশের দিকে থাকে তাহলে ভ্রƒণটি পরবর্তীতে বড় হবে এবং সুস্থ বাচ্চার জন্ম হবে। যদি সরু অংশের দিকে অথবা ডিমের এক পা শ গায়ে থিতিয়ে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে ভ্রƒণটি মারা গেছে এবং তার আর বৃদ্ধি হবে না।

এ ধরনের ডিম বাদ দিতে হবে। অনিষিক্ত ডিমে এ ধরনের কোন রক্তজালিকা থাকবে না। কাজেই সেটি বাদ দিতে হবে। ১৪—১৮ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বার ক্যান্ডেলিং বা পরীক্ষা করলে জীবিত ভ্রম্নণসম্পন্ন ডিমটি সম্পূর্ণ কালো দেখাবে।

 

৫. ডিম নাড়াচাড়া করানো:

আধুনিক ডিম ফোটানোর যন্ত্র বা ইনকিউবেটরের সকল মূলনীতি তৈরি হয়েছে কঁুচে মুরগির ডিমে তা দেওয়া ও বাচ্চা ফোটানোর পদ্ধতি থেকেই। মুরগি ঠোঁট দিয়ে ডিম উল্টে—পাল্টে দেয় যাতে ডিম সবদিকে সমান তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পায়। এই নীতি অনুসরণ করে আধুনিক ইনকিউবেটর যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে যা টারনার বা ডিম নাড়ানোর যন্ত্র নামে পরিচিত। মেশিনে সেট করা নির্দেশনা অনুযায়ী ৯০ কোনে ডিম ঘোরাতে পারে। দিন—রাত মিলে মোট ৬—৮ বার ডিম ঘোরালে ভালো ফল পাওয়া যায়। এতে ডিম ফোটানোর হারও বেড়ে যায়।

 

 

সূত্র : বাচ্চা ফোটানোর জন্য ডিম বাছাইকরণ ও ডিম ফোটানো পদ্ধতি | ইউনিট – ৮ , পাঠ – ৮.২ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র