বকনা বা গাভীর ঋতুচক্র, গরম হওয়ার লক্ষণ ও করণীয়

 বকনা বা গাভীর ঋতুচক্র, গরম হওয়ার লক্ষণ ও করণীয়

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ  বকনা বা গাভীর ঋতুচক্র, গরম হওয়ার লক্ষণ ও করণীয়। এটি কৃত্রিম প্রজনন ও খামার স্থাপন এর গাভীর জাত উন্নয়ন ইউনিটের অন্তর্গত।

 

 

 বকনা বা গাভীর ঋতুচক্র, গরম হওয়ার লক্ষণ ও করণীয়

বকনা বা গাভীর ঋতুচক্র (Estrous cycle of heifer or cow)

বয়ঃপ্রাপ্তির পর (Sexual maturity) বকনা বা গাভী জাতীয় গবাদিপশু হঠাৎ করে একদিন কামোদ্দীপ্ত হয়ে উঠে অর্থাৎ ষাঁড়ের সাথে মিলিত হবার ইচছা প্রকাশ করে । এই কামোদ্দীপনাকেই আমরা ‘গরম হওয়া’ বা ডাকে আসা এস্ট্রাস (Estrous) নামে অভিহিত করে থাকি ।

এটি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যা বকনা বা গাভীর প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে পর্যায়ক্রমিকভাবে শারীরবৃত্তীয় ও আকৃতিগত পরিবর্তন আনে । এই সাময়িক পরিবর্তনগুলো পরবর্তীতে গরম হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে এবং এই সময়কালকেই ঋতুচক্র (Estrous cycle) বলে। তবে গরম হওয়ার পর ষাঁড়ের সাথে মিলনের ফলে যদি গর্ভবতী হয় তবে বাচ্চা প্রসবের পূর্ব পর্যন্ত বকনা বা গাভী আর গরম হয় না ।

 

 

ঋতুচক্রের বিভিন্ন ধাপ (Different phase of estrous cycle)

বিজ্ঞানী মার্শাল ঋতুচক্রকে চারটি ধাপে ভাগ করেছেন-

প্রোএন্ট্রাস

করপাস লিউটিয়াম ক্ষয় হতে শুরু করে এবং পুনরায় এস্ট্রাস ধাপ না আসা পর্যন্ত চলতে থাকে ।

এস্ট্রাস

এই ধাপে বকনা বা গাভী ষাঁড়ের সাথে মিলিত হবার তীব্র আকাংখা প্রকাশ করে ।

মেটএস্ট্রাস

এস্ট্রাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে এই ধাপ শুরু হয় এবং এই ধাপে ওভারীতে করপাস লিউটিয়াম তৈরি শুরু হয়।

ডাই এস্ট্রাস

এই ধাপে কর্পাস লিউটিয়াম পূর্ণমাত্রায় কার্যকরী হয়। এটি ঋতুচক্রের সবচেয়ে বড়ো ধাপ। তবে বকনা বা গাভী যদি ষাঁড়ের সাথে মিলিত হয় এবং মিলনের ফলে গর্ভধারণ করে তবে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত এই ধাপটি চলতে থাকে ।

 

 

তবে বর্তমানে ঋতুচক্রকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে-

১. ফলিকুলার ধাপ :

প্রোএস্ট্রাস ও এস্ট্রাস এধাপের অন্তর্গত ।

২. লিউটিয়াল ধাপ :

মেটএস্ট্রাস ও ডাইএস্ট্রাস ধাপকে এ ধাপে নিয়ে আসা হয়েছে ।

বকনা বা গাভীর ঋতুচক্র (Estrous cycle of heifer or cow)

  • ঋতুচক্রের দৈর্ঘ্য ঃ ২০-২২ দিন (গড়ে ২১ দিন)
  • এস্ট্রাসের স্থায়ীত্বকাল : ১২-২৪ ঘন্টা (গড়ে ১৮ ঘন্টা)
  •  মেটএস্ট্রাসের স্থায়ীত্বকাল : ৩ দিন
  •  ডাইএস্ট্রাসের স্থায়ীত্বকাল : ঋতুচক্রের ৫ম দিন থেকে ১৭তম দিন পর্যন্ত । প্রোএস্ট্রাস ঃ ১৮তম দিন থেকে
  • এস্ট্রাস না আসা পর্যন্ত ।
  • লিউটিয়াল ধাপ ঃ ১৭-১৮ দিন
  • ফলিকুলার ধাপ ঃ ৩-৪ দিন
  • ওভুলেশন বা ডিম্বস্খলনের সময় : এস্ট্রাস শুরু হওয়ার ১০-১২ ঘন্টা পর ।

বকনা বা গাভীর গরম হওয়ার লক্ষণ (Symptoms during estrous of cow)

বকনা বা গাভী গরম হলে বিভিন্ন ধরনের স্বভাবগত ও শারীরবৃত্তীয় লক্ষণ ও পরিবর্তন দেখা দেয়। এগুলো হলো-

  • বকনা বা গাভী অশান্ত থাকবে এবং একজায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে ছটফট করবে।
  • গরম হওয়ার শুরুতে নিজে অন্য পশুর উপর লাফ দিবে এবং পুরোপুরি গরম অবস্থায় অন্য পশুকে নিজের উপর লাফ দিতে উদ্বুদ্ধ করবে ।
  • অন্য পশুকে নিজের পশ্চাৎদেশ চাটতে দিবে ।
  • দুধালো গাভীর ক্ষেত্রে হঠাৎ করে দুধ দেয়া কমে যাবে ।
  • খাওয়ার আগ্রহ কমে যাবে ।
  • বকনা বা গাভীকে খুবই সতর্ক মনে হবে এবং সবসময় কান খাড়া করে
  • ঘনঘন অল্প পরিমাণে প্রস্রাব ও পায়খানা করবে ।
  • লেজ নাড়াতে থাকবে ।
  • যোনি পথ (vagina) দিয়ে স্বচ্ছ মিউকাস বা শ্লেষ্মা বের হবে ।
  • হাত দিয়ে যোনিমুখ সামান্য ফাঁক করলে ভেতরটা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি লালচে দেখাবে ।
  • স্পেকুলামের সাহায্যে সার্ভিক্সের (cervix) মুখ দেখলে মনে হবে সার্ভিক্স খোলা রয়েছে ।
  • বকনা বা গাভী হাম্বা হাম্বা করে অনবরত ডাকতে থাকবে ।
  • শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে যাবে ।
  • রক্তে প্রথমে ইস্ট্রোজেন ও পরে লিউটিনাইজিং হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাবে ।

 

 

বকনা বা গাভী গরম হওয়ার পর করণীয় ( Activities during estrous)

বকনা বা গাভীর গরম অবস্থায় প্রধান কাজ হলো পাল দেওয়ানো। এজন্য প্রথমেই পাল দেওয়ার উপযুক্ত সময় নির্ণয় করতে হবে।

সাধারণত গাভী গরম হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবার পর থেকে পরবর্তী ১৮ ঘন্টার মধ্যে পাল দিলেই চলে । কিন্তু ভালো ফলাফল পাবার জন্য চিত্র ৬ এ প্রদর্শিত সময় অনুযায়ী পাল দিতে হবে। চিত্র ৬ অনুযায়ী এস্ট্রাস ধাপ শুরু হওয়ার ৮ ঘন্টা পর গাভীতে গরম হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং পরবর্তী ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত গরম অবস্থা স্থায়ী থাকে । এরপর থেকে গরম অবস্থা চলে যেতে থাকে ।

গরম অবস্থায় আসার শুরু থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে পাল দিলে সফলতার হার হবে শতকরা ৪৫ থেকে ৭০ ভাগ। আর ৭ থেকে ১৮ ঘন্টার মধ্যে পাল দিলে শতকরা ৭০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত সফলতা পাওয়া যাবে । তবে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে ১২ ঘন্টার সময় পাল দিলে । ১৮ ঘন্টার পর পাল দিলে ক্রমান্বয়ে সফলতার হার কমতে থাকবে ।

পাল দেওয়ার দুটো পদ্ধতি রয়েছে—

১. প্রাকৃতিক পদ্ধতি ঃ

বকনা বা গাভীর সংগে প্রজননক্ষম ষাঁড়ের মিলনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় ।

২. কৃত্রিম পদ্ধতি ঃ

এক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে ষাঁড়ের বীর্য বকনা বা গাভীর জননতন্ত্রে প্রবেশ করানো হয় । বকনা বা গাভীর ক্ষেত্রে মলদ্বার যোনি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে ।

 

 

সারমর্ম

বকনা বা গাভীর ষাঁড়ের সাথে মিলিত হবার ইচ্ছাকেই গরম হওয়া বা ডাকে আসা বা এস্ট্রাস | (Estrous) বলে । পরপর দুটো গরম হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকুই হচ্ছে ঋতুচক্র (Estrous cycle)| বকনা বা গাভীর ঋতুচক্রের দৈর্ঘ্য ২০-২২ দিন । বর্তমানে বকনা বা গাভীর ঋতুচক্রকে ফলিকুলার ও লিউটিয়াল এই দুই ধাপে ভাগ করা হয়। গরম হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবার পর পরবর্তী ৬ থেকে | ১৮ ঘন্টার মধ্যে বকনা বা গাভীকে পাল দেওয়ানো উচিত। বকনা বা গাভীর গরম হওয়ার স্থায়ীত্বকাল হলো ১২ থেকে ২৪ ঘন্টা । প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম এই দুপদ্ধতিতে বকনা বা গাভীকে পাল | দেওয়ানো হয়ে থাকে ।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

১। সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন (√) দিন ।

ক. বকনা বা গাভীর এস্ট্রাসের স্থায়ীত্বকাল কত ঘন্টা ?

i. ১২ – ২৪ ঘন্টা

ii. ১০ – ২৬ ঘন্টা

iii. ১২ – ২৬ ঘন্টা

iv. ১৬ – ২৪ ঘন্টা

খ. বিজ্ঞানী মার্শাল ঋতুচক্রকে কয়টি ধাপে ভাগ করেছেন?

i. ২ টি

ii. ৩ টি

iii.৪ টি

iv. ৫ টি

২। সত্য হলে ‘স’ এবং মিথ্যা হলে ‘মি’ লিখুন ।

ক. ডাইএস্ট্রাস ধাপে বকনা বা গাভী ষাঁড়ের সাথে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে ।

খ. গরম অবস্থায় দুধালো গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায় ।

৩। শূণ্যস্থান পূরণ করুন ।

ক. বর্তমানে ঋতুচক্রকে ফলিকুলার ও —– ধাপে ভাগ করা হয় ।

খ. এস্ট্রাস শুরু হওয়ার – – – – – – – ঘন্টার পর ওভুলেশন বা ডিম্বস্খলন হয় ।

৪। এক কথায় বা বাক্যে উত্তর দিন।

ক. বকনা বা গাভীর ঋতুচক্রের দৈর্ঘ্য কত?

খ. গাভী গরম হওয়ার কত সময়ের মধ্যে পাল দিতে হয় ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *