লাভজনক পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং উৎপাদন কৌশল

লাভজনক পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং উৎপাদন কৌশল

লাভজনক পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং উৎপাদন কৌশল ,মাছ প্রাণীজ আমিষের অন্যতম অনুষঙ্গ। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মাছের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। একই পুকুরে নানা জাতের মাছ চাষ করা যায়। আবার খাল ও ডোবায়ও চাষ করা যায়। আবার চৌবাচ্চা, খাঁচায় করা সম্ভব। নির্দিষ্ট জলাশয়ে পরিকল্পিত উপায়ে স্বল্পপুঁজি, অল্পসময় ও লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়ম মেনে প্রাকৃতিক উৎপাদনের চেয়ে অধিক মাছ উৎপাদনই মাছ চাষ। মাছ চাষে লাভবান হতে হলে পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত বিশেষ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়।

লাভজনক পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং উৎপাদন কৌশল

গুণাগুণ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা

দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০টিরও বেশি প্রজাতির মাছ আছে। খাঁড়ি অঞ্চলে ও লোনা পানিতেও কয়েকশ প্রজাতির মাছ আছে। তবে চাষযোগ্য মাছ হলো রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, সিলভার কার্প, মিরর কার্প, গ্রাস কার্প, কমন কার্প, বিগহেড, রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, তেলাপিয়া, বিদেশি মাগুর, থাই পাঙ্গাশ। এসব মাছ খুব দ্রুত বাড়ে। মাছ চাষ শুরু করার আগে প্রয়োজন হচ্ছে সঠিক সুষ্ঠু এবং বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা।

উৎপাদন কৌশল

সনাতন পদ্ধতির মাছ চাষে পুকুরের কোনও ব্যবস্থাপনা ছাড়াই মাটি ও পানির উর্বরতায় পানিতে যে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় মাছ সেটা খেয়ে জীবনধারণ করে। এক্ষেত্রে আলাদা কোনও পরিচর্যা নিতে হয় না।

আধানিবিড় পদ্ধতিতে নিয়মমতো পুকুর প্রস্তুত করে আংশিক সার ও খাদ্য সরবরাহ করে মাছের খাদ্য উৎপন্ন করতে হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপাদিত খাদ্যের সঠিক ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য রেখে মাছের পোনা ছাড়তে হয়।

নিবিড় পদ্ধতিতে অল্প জায়গা, অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হয়।

পুকুর নির্বাচন

পুকুর খোলামেলা রৌদ্রজ্জ্বল জায়গায় এবং বাড়ির আশপাশে হতে হবে। মাটির গুণাগুণ পুকুরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি পুকুরের জন্য ভালো। পুকুরের আয়তন কমপক্ষে ১০ শতাংশ হতে হবে। ৩০-৫০ শতাংশ আকারের পুকুর মাছ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। পুকুরের গভীরতা ২-৩ মিটার রাখতে হবে। বছরের পুরো সময় পানি থাকতে হবে। পুকুর পাড়ে বড় গাছ বা ঝোপঝাড় থাকা যাবে না।

পুকুর খনন ও প্রাথমিক কাজ

যেখানে পুকুর খনন করা হবে সেখানকার অবকাঠামো, পরিবেশ, পানির গভীরতা, বর্ষায় বন্যার হুমকি, পুকুর পাড়ের ঢাল, বকচর, শুষ্ক মৌসুমে পানি কতটা থাকে, পানি কমে গেলে বাইরে থেকে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা এসব বিষয়ে সঠিক ধারণা নিয়ে শুরু করতে হবে। এজন্য প্রথমেই অভিজ্ঞ মৎস্য চাষি বা মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। মাছ চাষ শুরু করার আগে বা মাছের পোনা ছাড়ার আগে সঠিক নিয়মে পুকুর তৈরি করা অত্যাবশ্যক। পানিতে প্রাকৃতিক খাবার জন্মানো এবং পুকুরে পানি প্রবেশ এবং নিষ্কাশনের রাস্তা সঠিকভাবে রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে অবহেলা করা হলে পরবর্তীতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। পোনা মাছ ছাড়ার আগে পুকুর তৈরি করে নিতে হবে। নতুন পুকুর কাটা কিংবা পুরনো পুকুরই তৈরি করে নেওয়া আবশ্যকীয় প্রাথমিক কাজ।

ধাপে ধাপে প্রস্তুতি

জলজ আগাছা কচুরিপানা, কলমিলতা হেলেঞ্চা, অন্যান্য গাছ শেকড়সহ তুলে ফেলতে হবে। শোল, গজার, বোয়াল, টাকি রাক্ষুসে মাছ এবং অবাঞ্ছিত মাছ মলা, ঢেলা, চান্দা, পুঁটি সরিয়ে ফেলতে হবে।

প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন পুকুরে পানি থাকলে ড্রামে বা বালতিতে গুলে ঠাণ্ডা করে পুরো পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। মাটি ও পানির গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে চুন দেওয়ার এক সপ্তাহ পর জৈব সার বিশেষ করে পচা গোবর দিতে হবে। পুকুর শুকনা হলে সার, চুন/জিওলাইট, গোবর ছিটিয়ে দিয়ে লাঙল দিয়ে চাষ করে দুষণমুক্ত পানি ঢুকাতে হবে। পোনা মজুতের আগে পুকুরে ক্ষতিকর পোকামাকড় থাকলে তা মেরে ফেলতে হবে। পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে পোনা মজুত করতে হবে। মৃত্যুহার যেন কম থাকে সেজন্য পোনার আকার ৮-১২ সেন্টিমিটার হতে হবে। নিয়মমতো পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে। দিনে দুই বার সকাল ১০টায় এবং বিকেল ৩টায় খৈল, কুঁড়া, ভুসিসহ সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।

সতর্কতা ও পরিচর্যা

রোগ প্রতিরোধী মাছের চাষ করতে হবে। সঠিক সংখ্যায় পোনা মজুত করতে হবে। পোনা ছাড়ার আগে পোনা রোগে আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং যাতে আগাছা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতি ৩-৪ বছর পরপর পুকুর শুকিয়ে ফেলে নতুন করে পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হবে।

পোনা যত্নও মজুত

মাছ চাষি হ্যাচারি থেকে যেসব পোনা সংগ্রহ করেন তার অধিকাংশই সরাসরি চাষ পুকুরে ছাড়ার উপযোগী নয়। চাষ পুকুরে ছোট পোনা সরাসরি ছেড়ে অনেক সময় চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এতে ব্যাপক হারে পোনা মারা যায়। এ কারণে পোনা ভালোভাবে নার্সিং করতে হবে। নার্সিং করার পর পোনা বড় ও টেকসই হলে গণনার মাধ্যমে পোনা মজুত পুকুরে দেয়া যায়। পরবর্তীতে খাবার ব্যবস্থাপনার সাথে অন্যান্য ব্যবস্থাপনাও যথার্থ হতে হবে। বেশি পোনা নয় বরং পরিমিত পরিমাণে পোনা ছেড়ে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।

পোনা নির্বাচন পরিবহন ও অবমুক্তকরণ

চাষিকে মানসম্মত ব্রুড থেকে উৎপাদিত এবং অন্তঃপ্রজননমুক্ত পোনা, একই আকারের ও বয়সের রোগমুক্ত পোনা সংগ্রহ করতে হবে। মানসম্পন্ন পোনা সংগ্রহ করার পর তা সঠিক নিয়মে পরিবহন এবং পরিবহনের পর যথার্থভাবে পুকুরে অবমুক্ত করতে হবে। পরিবহনজনিত ক্রুটি থাকায় এবং পরিবহনের আগে পোনা সঠিক নিয়মে টেকসই করা হয় না বলে ব্যাপক হারে মারা যায়। অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে মারা না গেলেও পোনা এতই দুর্বল থাকে যে দুই একদিনের মধ্যে অনেক পোনাই মারা যায়। এ কারণে পোনা পরিবহন ও পোনা ছাড়ার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।

পানির গুণাগুণ রক্ষা

মাছ পানিতে থাকে বলেই পানির গুণাগুণ ও পরিবেশ রক্ষা করাটা জরুরি। অথচ অনেক মাছ চাষি পানির গুণাগুণ রক্ষায় সচেষ্ট নন। মাছ চাষের জন্য পানির নির্ধারিত স্থিতিমাপ রয়েছে। এগুলো দক্ষতার সাথে রক্ষা করতে পারলে চাষকালে নানা সমস্যা এড়ানো সম্ভব। চাষিরা টেস্ট কিটের মাধ্যমে মাত্রা  মেপে পানির গুণাগুণ জানতে এবং করণীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

নিয়মিত ওজন নেওয়া ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা

প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর মাছের গড় ওজন নেওয়া আবশ্যক। তা না হলে খাবারের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা যায় না। মাছের ওজন না নিলে চাষিও বুঝতে পারেন না যে মাছের বাড়বাড়তি সন্তোষজনক নাকি হতাশাব্যঞ্জক। পোনা ছেড়ে এবং খাবার সরবরাহ করেই চাষির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ একটি বড় কাজ। মাছের অস্বাভাবিক আচরণ বা দেহে অস্বাভাবিক কোনও কিছু দেখা গেলে বা ক্ষত হলে মৎস্য বিশেষজ্ঞ বা মৎস্য কর্মকর্তার শরণাপন্ন হতে হবে।

 

মাছ পরিবহন

মাছ ধরে সঠিকভাবে বাজারজাত করতে না পারলে চাষি চাষের শেষ দিকে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। যেসব মাছ জীবিত পরিবহন করা হয় সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে অধিক সময় পরিবহন বা অন্য কোনও ক্রটির কারণে মারা যায়। এক্ষেত্রে প্লাস্টিক ড্রামে পরিষ্কার পানিসহ পরিমিত মাছ পরিবহন করা উচিত। মাছ ধরার ৮-১০ ঘণ্টা আগে খাবার দেওয়া বন্ধ রাখলে মাছ অধিক সময় জীবিত থাকে।

প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ

শুকনো অথবা ভেজা অবস্থায় লবণ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা যায়। মাছ কেটে নাড়িভুঁড়ি ও মাথা ফেলে দিয়ে চাক করে সেগুলো সিদ্ধ করতে হবে। এরপর লবণ, তেল, মসলা চাকের সাথে মেখে টিনের পাত্রে সুন্দর করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে পাত্রটি বায়ুশূন্য করে মুখবন্ধ করতে হবে। একে ফিশকেনিং পদ্ধতি বলে।

মাছ অমূল্য প্রাণীজ জাতীয় সম্পদ। নিজেদের একান্ত প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি পদ্ধতি অনুসরণ এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করলে মাছ চাষে কম খরচে বেশি লাভবান হওয়া যায়। মাছ দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারব।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *