Category Archives: এগ্রোটেক

এগ্রোটেক

বীজের শ্রেণীবিভাগ, বৈশিষ্ট্য ও বীজের অপরিহার্য অঙ্গসমূহ

বীজের শ্রেণীবিভাগ ও বীজের অপরিহার্য অঙ্গসমূহ – পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ব্যবহারিক পাঠ ১.২ নং পাঠের অংশ। বীজের শ্রেণীকরণ বিভিন্নভাবে করা যায়। বীজের আকার-আকৃতি, ব্যবহার, শারীরবৃভীয় গুণাবলী ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বীজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। নিয়ে তা আলোচনা করা হলোঃ

বীজের শ্রেণীবিভাগ ও বীজের অপরিহার্য অঙ্গসমূহ

 

বীজের অঙ্কুরোদগম

 

 

বীজের ধারণা

উদ্ভিদের বংশবিস্তারের অন্যতম মাধ্যম হলো বীজ। উদ্ভিদ যৌন পদ্ধতিতে বীজের মাধ্যমে অথবা অযৌন পদ্ধতিতে কোন অঙ্গজ অংশের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। বীজের সংজ্ঞা দু’রকম হতে পারে। প্রথমত : উদ্ভিদতাত্ত্বিক বিবেচনায় নিষিক্ত পরিপক্ব ডিম্বককে বীজ বলে। যেমন- ধান, গম, পেঁপে।

দ্বিতীয়ত : কৃষিতাত্বিক বিবেচনায় উদ্ভিদের শারীরিক বা জাননিক অঙ্গ উপযুক্ত পরিবেশে আপন জাতের নতুন উদ্ভিদের জন্ম দিতে পারে, তাকে কৃষি বীজ বলে। যেমন- আদা ও হলুদের কন্দ, মিষ্টি আলুর লতা, পাথরকুচির পাতা, ফুল গাছের শাখা-প্রশাখা ইত্যাদি।

 

ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য

১। ভালো বীজ পরিষ্কার থাকবে। এতে ধুলো বালি, ময়লা, আগাছা বা অন্য কোন ফসলের বীজ মিশানো থাকবে না ।

২। ভালো বীজ পুষ্ট, সুপরিপক, সঙ্গীর ও অধিক তেজসম্পন্ন হবে।

৩। বীজের রং উজ্জ্বল থাকতে হবে অর্থাৎ জাতের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাভাবিক বর্ণ থাকতে হবে।

৪। ভালো বীজ অবশ্যই পোকামাকড় আক্রমণমুক্ত হতে হবে

৫। ভালো বীজ অবশ্যই রোগজীবাণু মুক্ত হতে হবে।

৬। ভালো বীজ কৌলিতাত্ত্বিক দিক থেকে বিশুদ্ধ থাকবে (Genetic purity) অর্থাৎ বীজ উৎপাদনে জাতের বিশুদ্ধতা অপরিহার্য। তাই একই জাতের বীজের মধ্যে অন্য জাতের মিশ্রণ ষণীয়।

৭। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা (৮০%) বেশি হবে। অনুকূল পরিবেশ অর্থাৎ পরিমিত পানি, অক্সিজেন, তাপ ও আলোর উপস্থিতিতে বীজের জন্য সতিনাভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে বীজত্বক ভেদ করে বেরিয়ে এসে কচি চারা গাছ উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে বীজের অঙ্কুরোগম বলে।

৮। বীজের আর্দ্রতা ৪-১২% এর নিচে থাকতে হবে।

৯। বীজে সমরূপিতা থাকবে অর্থাৎ সকল বীজের আকার-আকৃতি প্রায় একই রকম হলে ভালো হয়।

 

বীজের শ্রেণীবিভাগ

বিভিন্নভাবে বীজের শ্রেণীবিভাগ করা যায়। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।

বীজপত্রের সংখ্যা অনুসারে

১। একবীজপত্রী বীজ যে সব বাজে একটিমাত্র বীজপত্র থাকে তাদেরকে একবীজপত্রী বীজ বলে। যেমন- পাট, হোগা, আম, কাঁঠাল প্রভৃতি।

৩। বহুবীজপত্রী বীজ যে সমস্ত বীজে দুই এর অধিক বীজপত্র থাকে তাদেরকে বহুবীজপত্রী বীজ বলে। যেমন- পাইন বীজ।

 

ভ্রূণের সংখ্যা অনুসারে

১। একজনী বীজ যে সব বীজে একটিমাত্র ভ্রূণ থাকে, তাদেরকে একজণী বীজ বলে। যেমন- ধান, পাট, গম

২। বহুজনী বীজ যে সকল বীজে একাধিক ভ্রূণ থাকে এবং প্রতিটি জন্ম এক একটি আলাদা গাছের জন্ম দিতে পারে, তাদেরকে বহুজনী বীজ বলে। যেমন- আম, লেবু ইত্যাদি।

 

নিষিকতা অনুসারে

১। নির্মিত বীজ ও পরাগরেণু দ্বারা ডিম্বক নিষিক্ত হয়ে যে বীজ উৎপন্ন হয়। তাকে নিষিক্ত বীজ বলে। যেমন- ধান, গম, সরিষা, ইত্যাদি।

২। অনিষিক্ত বীজ ও পরাগরেণু দ্বারা ডিম্বক নিষিক্ত না হয়েই যে বীজ উৎপন্ন হয় তাকে অনিষিক্ত বীজ বলে। যেমন- লেবু, জাম্বুরা, কমলা ইত্যাদি।

 

শস্যের Endosperm উপস্থিতি অনুসারে

১। সস্যল বীজ যে সব বীজের ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য বীজপত্রের বাইরে খাদ্য হিসেবে সস্য জমা থাকে তাদেরকে সস্যল বীজ বলে। যেমন- ধান, গম, ভূট্টা প্রভৃতি।

২। যে সকল বীজে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য বাঁজা পত্রের বাইরে সত্য জমা থাকে না তাদেরকে অসসাল বীজ বলে। যেমন- ছোলা, কুমড়া ইত্যাদি।

 

বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী

বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী বীজকে ৪টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।

(ক) মৌল প্রজননবিদ (Breeder seed)

(খ) ভিত্তি বীজ (Foundation seed)

(গ) নিবন্ধিত বীজ ( Registered seed)

(খ) প্রত্যায়িত বীজ (Certified seed)

(ক) মৌল প্রজননবিদ বীজ (Breeder seed):

অনুমোদিত বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে মৌল  বীজ। উদ্ভিদ প্রজনন প্রতিষ্ঠানে কোন প্রজননবিনের ঘনিষ্ঠ ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত সর্বাধিক বংশগত বিশুদ্ধতা সম্পন্ন বীজকে মৌল বীজ বলে।

(খ) ভিত্তি বীজ (Foundation seed)

মৌল বীজের বিস্তার ঘটানোর জন্য ভিত্তি বীজের উৎপাদন। করা হয়। বীজ অনুমোদনকারী সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত বীজ উৎপাদনের নিয়মনীতি অনুসরণ করে প্রজননবিদ বা কুষিতভুবিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে মৌল বীজ থেকে উৎপাদিত বীজকে ভিত্তি বীজ বলে।

(গ) নিবন্ধিত বীজ ( Registered seed)

ভিত্তিবীজ থেকে উৎপাদিত বীজকে নিবন্ধিত বীজ বলে। বীজ বর্ধন খামার বা জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত কোন ব্যক্তিগত খামারের এ বীজ বর্ধন।

(ঘ) প্রত্যায়িত বীজ (Certified seed)

চুক্তি চাষীর মাধ্যমে বীজ উৎপাদনের নিয়মনীতি মেনে ও জাতের বংশগত বিশুদ্ধতা রক্ষা করে ভিত্তি বীজ থেকে প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হয়। পরে বীজ প্রত্যাবানকারী সংস্থা (Seed Certification Agency) পরীক্ষা করে অনুমোদন প্রদান করার পর এ বীজ প্রত্যায়িত বীজ হিসেবে ভাষীদের মাঝেঝ ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হয়।

উদ্ভিদের বংশবিস্তারের মৌলিক উপকরণ হলো বীজ। কোন ফসলের ভালো ফলন পেতে হলে অবশ্যই ভালো বীজ ব্যবহার করতে হবে। বীজকে বিভিন্নভাবে শ্রেণীকরণ করা যায়। বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী বীজকে ৩টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যথা- মৌল বীজ, ভিত্তি বীজ ও প্রত্যায়িত বীজ।

 

ব্যবহারের উদ্দেশ্য অনুসারে শ্রেণীবিন্যাস

১ প্রকৃত বীজ :

নিষিক্ত ও পরিপক্ক ডিন্বককে উদ্ভিদতাত্তিক বীজ বলে। যেমন ঃ দানাদার বীজ (পান, গম, ভুটা প্রভৃতি), তৈলবীজ (সরিষা, সয়াবীন, তিল প্রভৃতি) ও ডালবীজ (মসুর, শেসারী, মুগ প্রভৃতি)।

 

২। কৃষি বীজ :

উদ্ভিদের যে কোন ভাংশ যা তানুকুল পরিবেশ তার সমতুল্য নতুন গাছের জন্ম দিতে সক্ষম তাকে কৃষি বীজ বলে। যেমনঃ কান্ড (আখ, আলু প্রভৃতি), শিকড (মিষ্টি আলু, কাকরোল, পটল প্রভৃতি) পাতা (পাথরকুচি) থেকে শুরু পান, গম, ভুট্টা প্রভৃতির বীজ কুষিজ বীজের উদাহরণ।

 

আম বীজ

 

বীজের আবরণের উপর ভিত্তি করেো

১. নগ্নবীজ :

যে বীজে কোন আবরণ থাকেনা, তাকে নগ্নবীজ বলে। যেমন ৪ গম, ভুট্টা প্রভৃতি।

২। আবরিত বীজ :

যে বীজে আবরণ থাকে তাকে আবরিত বীজ বলে। যেমন: পান, ডাল, তৈল বীজ ইত্যাদি।

 

 

বীজ পত্রের সংখ্যা অনুযায়ী

১। একবীজপত্রী বীজ :

যে সকল বীজে একটি মাত্র বীভপত্র থাকে তাদেরকে একবীজপত্রী বীজ বলে। যেমন ঃ পান, গম, ভুট্টা, নারিকেল, তাল ইত্যাদি।

২। দ্রিবীজপত্রী বীজে :

যে সকল নীজে দুইটি বীজপত্র থাকে তাদেরকে দ্বিবীজপত্রী বীজ বলে। যেমন ঃ পাট, ছোলা, সয়াবীন, আম, কাঠাল ইত্যাদি।

৩। বহুবীজপত্রী বীজ :

য়ে বীজে দুই এর আদিক বীজপত্র থাকে তাকে বহুবীজপত্রী বীজ বলে। যেমন ঃ পাইন বীজ।

 

গম

 

বীজে ভ্রূণের সংখ্যা অনুসারে

একজণী বীজ (Monoembryonic seed ) :

যে বীজে একটি মাত্র ভ্রূণ থাকে তাকে এক ভ্রূণী বীজ বলে যেমন : পাট, ধান, গম।

বহুভ্রূণী বীজ (Polyembryonic seed ) :

যে বীজে একাধিক ভ্রূণ থাকে এবং প্রত্যেকটি ভ্রূণ এক একটি স্বতন্ত্র উদ্ভিদের জন্ম দিতে পারে তাকে বহুভ্রূণী বীজ বলে। যেমন : আম, লেবু ইত্যাদি। সস্য (Endosperm) এর উপর ভিত্তি করে

সস্যল বীজ (Endospermic seed ) :

যে সকল বীজের বীজপত্রের বাইরে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য খাদ্য হিসেবে সস্য বা এন্ডোস্পার্ম সঞ্চিত থাকে তাদেরকে সস্যল বীজ বলে। যেমন : ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি।

অসস্যল বীজ (Non endospermic seed) :

যে সকল বীজে ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সস্য হিসেবে জমা না থেকে বীজ পত্রের মধ্যে সঞ্চিত থাকে সে সকল বীজকে অসস্যল বীজ বলে। যেমনঃ কুমড়া, ছোলা ইত্যাদি।

 

গুটি কলম

 

নিষিক্ততা (Fertilization) অনুসারে

নিষিক্ত বীজ (Fertilized seed) :

ডিম্বক পরাগরেণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে যে বীজ উৎপন্ন করে তাকে নিষিক্ত বীজ বলে। যেমন : ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদি।

অনিষিক্ত বীজ (Unfertilized seed) ঃ

পরাগরেণু দ্বারা ডিম্বক নিষিক্ত না হয়েই যে বীজ উৎপন্ন হয় তাকে অনিষিক্ত বীজ বলে। এক্ষেত্রে ডিম্বকের দেহ কোষ (Vegetative cell) থেকে ভ্রূণের উৎপত্তি হয়। এই বীজকে এপোমিকটিক (Apomictic) বীজ বলে এবং বীজ উৎপন্ন হওয়ার উক্ত পদ্ধতিকে এপোমিক্সিস (Apomixis) বলে। এপোমিকটিক বীজ দ্বারা বংশ বিস্তার করলে তাকে অংঙ্গজ বংশ বৃদ্ধি বলে এবং তাতে মাতৃগুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে। লেবু, জামবুরা, কমলা ইত্যাদি সাইট্রাস ফলে এপোমিকটিক বীজ পাওয়া যায়।

 

চোখ কলম

 

বিভিন্ন অঙ্গজ বীজের পরিচিতি

রাইজোম (Rhizome) :

রাইজোম ভূ-নিম্নস্থ রূপান্তরিত কান্ড। আদা, হলুদ ইত্যাদির বংশ বিস্তারের জন্য রাইজোম ব্যবহৃত হয়।

স্ফীত কন্দ (Tuber) :

স্ফীত কন্দ ভূ-নিম্নস্হ রূপান্তরিত কান্ড। নিম্ন কান্ডের শীর্ষে খাদ্য সঞ্চিত হয়ে তা স্ফীত হয়ে কন্দের রূপ ধারণ করে। এতে চোখ (Eye বা bud), শল্কপত্র (Scale leaves) বর্তমান থাকে। গোল আলুর বংশ বিস্তার টিউবারের সাহায্যে করা হয়ে থাকে।

 

বীজ আবরণ

 

টিউবারকল (Tubercol বা Bulbil) :

এ জাতীয় উদ্ভিদে পাতার কক্ষীয় কুঁড়ি রূপান্তরিত হয়ে স্ফীত ও গোলাকার ধারণ করে। এদের টিউবারকল বা বুলবিল বলে। যেমনঃ মেটে আলুর বুলবিল।

শঙ্ক কন্দ (Bulb) ঃ

এটা ভূ-নিম্নস্হ রূপান্তরিত কান্ড যা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং স্কেল (Scale) সমন্বয়ে গঠিত। পিয়াজের অংঙ্গজ বংশ বিস্তার শঙ্ক কন্দের দ্বারা করা হয়। অনেক সময় শঙ্কের কক্ষীয় কুঁড়িও আবার ক্ষুদ্রাকার কন্দে পরিণত হয়। এগুলো কোয়া (Bulblet) নামে পরিচিত। যেমনঃ রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি।

গুঁড়িকন্দ (Corm) :

কান্ডের নিচের অংশ স্ফীত ও গোলাকার হলে একে গুঁড়িকন্দ বলে। এতে সন্ধি (Node) ও পর্বসন্ধি (Inter node) বিদ্যমান থাকে। গুঁড়িকন্দের উপরিভাগ শল্কপত্র দ্বারা আবৃত থাকে। আবার গুঁড়িকন্দের নিচের দিকে কতিপয় কুড়ি ক্ষুদ্রাকার গুঁড়িকন্দে পরিণত হয়। এগুলো মুখি নামে পরিচিত। কচুর বংশ বিস্তার গুঁড়িকন্দ দ্বারা করা হয়।

 

ব্যক্তবীজ

 

কন্দালমূল (Tuberous root) :

যখন কোন মূল খাদ্যদ্রব্য সঞ্চিত করে স্ফীত হয়ে উঠে তখন তাকে কন্দালমূল বলে। মিষ্টি আলু ও বিভিন্ন জাতের আলুর বংশ বিস্তারে কন্দালমূল ব্যবহৃত হয়।

শোষক (Sucker) :

মাতৃগাছের গোড়া থেকে নতুন চারা বের হয় এবং বৃদ্ধির প্রথম পর্যায় মাতৃগাছ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে যেমন: কলা, আনারস, চন্দ্রমল্লিকা প্রভৃতি।

শিকড় (Root cutting) :

অনেক গাছের মূল নতুন চারা গাছের জন্ম দেয় এবং পরে তা কেটে পৃথক করে রোপণ করলে স্বতন্ত্র উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়। বেল ও পেয়ারা ফলের এরূপ শিকড় ব্যবহার করা হয়।

 

 

পাতা ঃ

পাতা থেকেও চারা উৎপন্ন করা যায়। যেমন : পাথরকুচি। অনেক সময় চায়ের পাতা থেকে চারা উৎপন্ন করা হয়।

শাখা কলম (Stem cutting) :

বিভিন্ন প্রকার ফসল, ফল ও ফুল গাছের বংশ বৃদ্ধির জন্য শাখা কলম ব্যবহৃত হয়। যেমন : আম, মিষ্টি আলু, আংগুর, গোলাপ, গন্ধরাজ, ইত্যাদি।  যথাঃ কর্তন বা ছেদ কলম : এক্ষেত্রে সরাসরি কচি ডাল কেটে মাটিতে লাগিয়ে চারা তৈরি করা হয়। যেমন : সজিনা, শিমুল, এলামন্ডা ইত্যাদি।

 

 

প্রধানত পাঁচভাবে কলমের চারা তৈরি করা হয়।

দাবা কলম ঃ

এক্ষেত্রে গাছের শাখার খানিক মাটিতে চাপা দিয়ে তাতে মূল গাজিয়ে মাতৃগাছ থেকে আলাদা করা হয়। যেমন : লেবু।

গুটি কলম ঃ

নির্বাচিত গাছের ডালের ৫ সে.মি. পরিমাণ অংশের ছাল তুলে গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে গুটি তৈরি করে চট দিয়ে আটকে দিতে হয়। বর্ষাকালে সাধারণত লিচু, ডালিম,  লেবুতে, এ ধরণের কলম করে চারা তৈরি করা হয়।

জোড় কলম ঃ

এক্ষেত্রে একই জাতের দুটি গাছের কান্ডকে পরিমিত চেছে একত্রে বেঁধে দিলে ২-৩ মাসের মধ্যে জোড়া লেগে যায়। অতঃপর কাঙ্খিত গাছের মধ্যে অন্যটির নিচের অংশ কেটে আলাদা করে কলমের চারা পাওয়া যায়। আমের ক্ষেত্রে জোড় কলম উত্তম।

চোখ কলম :

পাতা বা ডালের সংযোগ স্থানের কুঁড়িকে বিশেষ পদ্ধতিতে অন্য উদ্ভিদে স্থানান্তরিত করাকে চোখ কলম বলে। গোলাপ, লেবু, কুল প্রভৃতি উদ্ভিদে এ কলম ব্যবহৃত হয়। কুলের ক্ষেত্রে টক কুল গাছকে চোখ কলমের সাহায্যে মিষ্টি কুলে রূপান্তরিত করা যায়।

 

 

আন্তর্জাতিক শস্য উন্নয়ন সমিতির শ্রেণিবিন্যাস:

এতক্ষণ আপনি প্রকৃত বীজের শ্রেণিবিন্যাস এবং কৃষি বীজের বিভিন্ন অঙ্গজ বংশ বিস্তারের মাধ্যম সম্পর্কে ধারণা পেলেন। এখন আমরা আলোচনা করবো আন্তর্জাতিক শস্য উন্নয়ন সমিতি (International Crop Improvement Association, ICIA) বীজকে কীভাবে শ্রেণিবিন্যাস করছেন। উক্ত সমিতি বিভিন্ন বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা, উৎপাদন ও বিতরণের প্রকৃতির ভিত্তিতে বীজকে প্রধানতঃ ৪টি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন (ক-ঘ)। কিন্তু বাংলাদেশ বীজ বিধি ১৯৮০ এর ১৮ ধারা মোতাবেক বীজকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে (ক, খ, ঘ)।

(ক) প্রজনন বীজ (Breeder seed )

(খ) ভিত্তি বীজ (Foundation seed)

(গ) নিবন্ধিত বীজ ( Registered seed )

(ঘ) প্রত্যায়িত বীজ (Certified seed)

বাংলাদেশ বীজ বিধিতে নিবন্ধিত ও প্রত্যায়িত বীজকে একই ধরণের বিবেচনা করে নিবন্ধিত বীজকে বাদ দেয়া হয়েছে। কারণ এ দুই শ্রেণির বীজই ভিত্তি বীজ থেকে উৎপাদিত হয়।

প্রজননবীদের বীজ (Breeder seed) :

উদ্ভিদ প্রজনন প্রতিষ্ঠান বা কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা কোন প্রজননবিদের ঘনিষ্ঠ ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপন্ন বীজ, যা থেকে ভিত্তি বীজ (Foundation seed) উৎপন্ন করা হয় তাকে প্রজনন বীজ বলে। এ বীজের মধ্যে সর্বাধিক কৌলিক বিশুদ্ধতা (Genetic purity) থাকে। অনুমোদিত বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হলো প্রজনন বীজ। প্রজনন বীজ থেকে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়।

ভিত্তি বীজ :

বীজের পরবর্তী বিস্তার ঘটানোর জন্য কৌলিকভাবে শনাক্তকরণযোগ্য জাতের প্রথমিক উৎসকে ভিত্তি বীজ বলে। ভিত্তি বীজে কৌলিক স্বাতন্ত্র্য (Genetic identity) ও জাতের বিশুদ্ধতা (Varietal purity) বিদ্যমান থাকে। ভিত্তি বীজ থেকে প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হয়। অনুমোদনকারী সংস্হা কর্তৃক অনুমোদিত বীজ উৎপাদনের নিয়মনীতি পালন করে ও সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক কমিটির তত্ত্বাবধানে এ বীজ উৎপাদন করা হয়।

নিবন্ধিত বীজ ঃ

অনুমোদিত সরকারী উৎসের ভিত্তি বীজ থেকে নিবন্ধিত উৎপাদনকারী যথাযথ নিয়মনীতি অনুসরণ করে যে বীজ উৎপন্ন করে তাকে নিবন্ধিত বীজ বলে। ভিত্তি বীজের সকল কৌলিক গুণাবলী ও বিশুদ্ধতা নিবন্ধিত বীজে বিদ্যমান রাখা হয়।

প্রত্যায়িত বীজ :

ভিত্তি বীজ হতে প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হয় যাতে বংশগত ও বাহ্যিক বিশুদ্ধতা নির্ধারিত মানের থাকে। প্রয়োজনবোধে প্রত্যায়িত বীজ হতেও সর্বাধিক তিন ধাপ পর্যন্ত প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা যেতে পারে।বীজের গুণাবলী সংরক্ষণের জন্য প্রত্যয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্হা। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী নামে একটি সরকারী সংস্হা এই অনুমোদনের কাজটি করে থাকে।

 

 

বীজের অপরিহার্য অংগসমূহ :

একটি বীজের প্রধানতঃ দুইটি অংশ থাকে। যথাঃ

(১) বীজত্বক (Seed coat) ও

(২) অন্তবীজ বা বীজসার ( Kernel ) ।

(১) বীজত্বক :

বীজের আবরণকে বীজত্বক বলে। ডিম্বকের ত্বক বীজত্বকে পরিণত হয়। বীজত্বক আবার দুইটি আবরণ দ্বারা গঠিত। বাহিরের অপেক্ষাকৃত পুরু ও শক্ত স্তরটিকে বলে বহিঃত্বক বা টেস্টা (Testa)। ভিতরের পাতলা স্বচ্ছ আবরণকে বলে অন্তঃত্বক বা টেগমেন (Tegmen)। বীজত্বক দুইটি সংযুক্ত থাকতে পারে অথবা একটি হতে অন্যটি পৃথক থাকতে পারে। বীজ যে অংশ দ্বারা ফলের সংগে যুক্ত থাকে সেই সংযোগস্থলকে বলে হাইলাম (Hilum) বীজনাভি বা ডিম্বকনাভি। বীজ ফিউনিকুলাস (Funiculus) নামক বোটার সংগে হাইলামের সংগে যুক্ত থাকে। হাইলামের সন্নিকটে বীজত্বকে একটি ছিদ্র থাকে যাকে মাইক্রোপাইল (Micropyle) বা বীজরন্ধ্র বলে। কোন কোন বীজের ত্বকে লম্বালম্বি যে প্রবর্ধন দেখা যায় তাকে র‍্যাফি ( Raphe) বলে। রাফির সাহায্যে বীজ বোঁটার সংগে লেগে থাকে।

(২) অস্তবীজ বা কার্নেল বা বীজসার :

বীজত্বক অপসারণের পর বীজের অবশিষ্ট অংশকে বলে অন্তবীজ বা কার্নেল বা বীজসার। কার্নেল শুধু ভ্রূণ দ্বারা গঠিত হতে পারে (যেমন : ছোলা বীজ) অথবা ভ্রূণ ও সস্য (Endosperm) দ্বারা গঠিত হতে পারে (যেমন : ধান বীজ)।

 

অন্তবীজ বা কার্নেল এর বিভিন্ন অংশ:

ভ্রূণ (Embryo) :

বীজত্বক দ্বারা আবৃত সুপ্ত উদ্ভিদকে ভ্রূণ বলে। কার্নেলের মূল অংশ ভ্রূণ। ভ্রূণের দুইটি অংশ যথাঃ ভ্রূণাক্ষ বা টাইজেলাম (Tigellum) ও বীজপত্র (Cotyledon)। ভ্রূণাক্ষের আবার দুইটি অংশ যেমন: ভ্রূণমূল (Radicle) যা থেকে বীজ গজানোর পর শিকড় হয় এবং ভ্রূণকান্ড ভ্রূণমুকুল (Plumule) যা থেকে কান্ড উৎপন্ন হয়।

ভ্রূণাক্ষ :

যে অক্ষের সংগে বীজপত্র সংযুক্ত থাকে তাকে ভ্রূণাক্ষ বলে। ভ্রূণাঙ্কের যে স্হানে বীজপত্র সংযুক্ত থাকে তাকে ভ্রূণপর্ব (Nodal zone) বলে। ভ্রূণাক্ষের উপরের অংশ ভ্রূণমুকুল এবং নিচের অংশ ভ্রূণমূল। ভ্রূণাক্ষের যে অংশ পর্বাঞ্চলের উপরে অবস্থিত তাকে এপিকোটাইল (Epicotyle) বা বীজ পত্রাধিকান্ড বলে। অপরপক্ষে ভ্রূণাক্ষের যে অংশ পর্বাঞ্চলের নিচে অবস্থিত তাকে বলে হাইপোকোটাইল (Hypocotyle) বা বীজপত্রাবকান্ড। একবীজপত্রী উদ্ভিদে ভ্রূণমুকুল ও ভ্রূণমূল যে আবরণীসমূহ দ্বারা আবৃত থাকে তাদেরকে যথাক্রমে কলিওপটাইল (Coleoptyle) এবং কলিওরাইজা (Coleorrhiza ) বলে।

বীজপত্র (Cotyledon) :

দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদে দুইটি বীজপত্র এবং একবীজপত্রী উদ্ভিদে একটি বীজপত্র থাকে। বীজপত্রে খাদ্য সঞ্চিত থাকলে তা পুরু ও রসাল হয়। যেমন : ছোলা বীজ। যে বীজপত্রে খাদ্য সঞ্চিত থাকে না তা পাতলা ও স্বচ্ছ হয় (যেমন : রেডি)। নিম্নে চিত্রে বীজের বিভিন্ন অংশ দেখানো হয়েছে।

 

পান

 

বীজপত্রের কাজ :

  • বীজপত্র নরম ও কোমল ভ্রূণমুকুলকে রক্ষা করে।
  • বীজপত্র ভ্রূণের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করে।
  • বীজপত্র ভ্রূণাক্ষকে খাদ্য সরবরাহ করে।
সস্য (Endosperm) :

কোন কোন কার্নেলে সস্য বা এন্ডোস্পার্ম পাওয়া যায়। বীজের এন্ডোস্পার্মে শিশু উদ্ভিদের খাদ্য সঞ্চিত থাকে। সকল বীজে সস্য থাকে না। সস্য যুক্ত বীজকে বলে সসাল (Albuminous) বীজ। যে বীজে সস্য থাকে না তাকে বলে অসস্যল বীজ (Exalbuminous)।

পেরিস্পার্ম (Perisperm) :

ডিম্বকের নিউসেলাসের অবশিষ্টাংশকে পেরিস্পার্ম বলে। ইহা বর্ধিষ্ণু ভ্রূণে খাদ্য সরবরাহ করে। সকল বীজে পেরিস্পার্ম থাকে না। খুব অল্প সংখ্যক বীজে পেরিস্পার্ম থাকে। যেমন : শাপলা।

 

বীজের সংজ্ঞা, প্রকৃত ও কৃষি বীজের মধ্যে পার্থক্য এবং বীজের গুরুত্ব

বীজের সংজ্ঞা, প্রকৃত ও কৃষি বীজের মধ্যে পার্থক্য এবং বীজের গুরুত্ব – পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ব্যবহারিক পাঠ ১.১ নং পাঠের অংশ।

বীজ কাকে বলে বা বীজের সংজ্ঞা কী তা আপনার জানা দরকার। বীজ উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের মাপাম হিসেবে কাজ করে। উত্ভিদতান্তিক বৈশিষ্ট্যাবলী এবং কৃষি কাজের বৈচিত্রাময় ব্যবহার অনুসারে বীজের সংজ্ঞা দু’রকম হতে পারে। প্রথমত, উত্ভিদতত্তানুসারে ফুলের পরাগরেণু দ্বারা ডিন্গক নিষিক্ত হবার পর পরিপক্ক ডিম্বককে বীজ বলে। যেমন ৪ পান, গম, পেপে বীজ।

বীজের সংজ্ঞা, প্রকৃত ও কৃষি বীজের মধ্যে পার্থক্য এবং বীজের গুরুত্ব

 

দ্বিতীয়ত, কৃষিতত্তানুসারে গাছের যে অংশ (শারীরিক বা জাননিক) বংশ বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হয় পাথরকুচির পাতা, বিভিন্ন ফুল গাছের শাখা-প্রশাখা, পান, গম ইত্যাদি। উপরিউক্ত সংজ্ঞা দ্বারা প্রকৃত বীজ ও কৃষি বীজের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারি। প্রকৃত বীজ বা ধৌন বীজ হচ্ছে বীজত্বকদ্বারা আবৃত এক সুপ্ত ভ্রণপারী পরিণত ও নিষিক্ত ডিন্ক। আর গাছের যে কোন অংশ বিশেষ, যা উপযুক্ত পরিবেশে একই রকম গাছের বংশ বিস্তারের জন্য ব্যবহার হয়ে
থাকে, তাকে কৃষি বীজ বলে।

আলুর টিউবার বলতে আমরা যে আলু খাই তাকে বোঝায়। কলার সাকার বলতে কলার চারা বোঝায় যা মুখ্য বা তেউড় নামেও পরিচিত। আনারসের চারাকেও সাকার বলে। কচুর চারাকে কন্দ বা গুঁড়িকন্দ বলে।

বীজের গুরুত্ব

বীজ থেকে গাছ জন্মায় যা পৃথিবীকে ধূসর বিবর্ণ মরুভূমিতে পরিণত হতে না দিয়ে আচ্ছাদিত করে সবুজ বৃক্ষরাজিতে এবং পরিবেশকে বাসপোযোগী করে। বীজ মানুষের জন্য একটি সর্বোত্তম কল্যাণকর শক্তি। অতি ক্ষুদ্র একটি বীজ মাটিতে বপন করার পর তা সুন্দর, সতেজ ও বৃহৎ একটি গাছে রূপান্তরিত হওয়া নিঃসন্দেহে একটি শক্তি। মানুষ যখন আবিষ্কার করল বীজ থেকে গাছ জন্মায়, মানব সভ্যতার উন্মেষ তখন থেকেই শুরু। কৃষিতে বীজের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ বীজ কেবল ফসলের ফলন বৃদ্ধিই করে না, এর মান উন্নয়ন, কীট ও রোগাক্রমণ প্রতিরোধ, ভালো বাজার প্রাপ্তি এবং নির্দিষ্ট ভূ-প্রাকৃতিক অবস্হায়

কম খরচ করে অদিক ফলন পাওয়া কৃষকের একটি অন্যতম লক্ষ্য থাকে। রোগজীবাণু, পোকামাকড় ও আগাছা মুক্ত সে জক্ষারটি অর্জন করতে পারে। কৃষি ও পলাটী উন্নয়ন স্কুল জন্মানোর উপযোগিতা ইত্যাদি গুণাগুণও নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ফসল উৎপাদনে বীজকে একটি মৌলিক উপকরণ বলা যেতে পারে। অতএব কৃষি কাজে সম্পৃক্ত সকলেরই বীজের গুরুত্ব সম্পর্কে সমাক পারণা থাকা প্রয়োজন। নিমোক্ত বিষয়সমূহ সংক্ষেপে বীজের গুরুত্ব তুলে পরে।

১। বীজ ফসল উৎপাদনের প্রান মৌলিক উপকরণ।

২। উন্নত মানের বীজে উচ্চ ফলন হয়।

৩। ভালো বীজ পোকামাকড় ও গাছের রোগবালাই প্রতিরোপ করে।

৪। ভালো বীজ পরোক্ষভাবে উৎপাদন ব্যয় কমায়।

৬। বীজের মাপামে সংকরায়ন করে উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন করা হয়।

৭। বীজ ব্যবসা খুবই লাভজনক।

৮। বীজের মাপানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

ঈ। বীজ প্রজাতি টিকিয়ে রাখার অনাতম প্থা।

১০। বীজের খামার বা বীজ বর্ণন খামার করে জীবিকা নির্বাহ করা খুবই লাভজনক।

১১। বীজের মাপ্যমে সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায়।

আসুন এসব বিষয়সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।

 

বীজ ফসল উৎপাদনের প্রধান মৌলিক উপকরণ

ফসল উৎপাদনের জনা অন্যান কৃষি উপকরণ, যেমন $ঃ সার, সেচ, ও বালাইনাশকের ন্যায় বীজ একটি অন্যতম মৌল উপকরণ। কারণ বীজ বপন না করে অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করলে কোন ফসল আসবে না। কিন্তু বীজ বপন করে তন্যান্য যত্ত না নিলেও কিছু ফলন পাওয়া সম্ভব৷ ততএব উপরোক্ত বিষয়াদি বিবেচনা পূর্বক বীজকেই প্রপান মৌলিক উপকরণ বলা যায়।

 

উচ্চ ফলনশীল বীজে অধিক ফলন হয়

যেখানে জমি সীমিত এবং লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে খাদ্যোৎপাদন বাড়ানোর জন্য উচ্চ কিছুটা সফলতা পাওয়া গিয়েছে। পূর্বে দেশী পান জাতের (যেমন ঃ ধারিয়াল, দুলার, কটকতারা ইত্যাদি) হেক্টর প্রতি ফলন ছিল ১.০-১৫ টন বর্তমানে উফশী বীজ ব্যবহার করে (বরি-পান ৩০, ৩১ ৩২ ইত্যাদি) হেক্টর প্রতি ৪-৬ টন ফলন পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া দেশী আলুর উৎপাদন যেখানে হেক্টর প্রতি ছিল ৮_-১০ টন সেখানে আপুনিক জাত (ডায়মন্ড, পেট্রোনিজ, মুলটা প্রভৃতি) বাবহার করে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ২৫৩০ টন।

 

ভালো বীজ রোগবালাই ও পোকামাকড় প্রতিরোধী

অনেক রোগের জীবাণু বীজবাহিত। তাছাড়া, বীজের স্তুপে পোকা, রোগজীবাণু ও আগাছার বীজে মিশ্রিত থাকতে পারে। বর্তমানে বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাপামে এগুলো দূর করা সম্ভব হচ্ছে এবং প্রত্যায়িত ভালো বীজ কৃষকের মগ বিতরণ করা যাচ্ছে।

 

ভালো বীজ উৎপাদন ব্যয় কমায়

কম খরচ করে অপিক ফলন পাওয়া কৃষকের একটি অনাতম লক্ষা থাকে। রোগজীবাণু পোকামাকড ও আগাছা মুক্ত ভালো বীজ বাবহার করে কৃষক সে লক্ষি অন করতে পারে। সেক্ষেত্রে কীটনাশক, বালাইনাশক এবং আগাছা দমনের জনা শ্রমিক বায় কমে আসবে।

 

বীজ উন্নত জাত উদ্ভাবনের মাধ্যম

বিজ্ঞানের একটি অন্যতম অবদান হলো উদ্ভিদের বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিদ্যমান বৈশিষ্টাসমৃহকে সংকরায়নের মাপামে একটি জাতে সংযোগ করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াটি যে সমস্ত ফসল উদ্ভিদতান্তিক বীজ উৎপন্ন করে কেবল সেক্ষেত্রে সম্ভব। যেমন ঃ বি আর-৩ পান দুইটি জাতের পানের বীজের সাথে সংকরায়ন পদ্ধতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে।

 

 

বীজ ব্যবসার উপাদান

বর্তমানে বীজ ব্যবসা একটি লাভজনক ব্যবসা। বিভিন্ন বীজের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছে এমন নজিরও এদেশে আছে। বিশেষ করে তরমুজ, বীপাকপি, ফুলকপি ও আলু বীজের ব্যবসা খুবই লাভজনক।

 

বীজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব

উন্নত জাতের বীজ ও হাইবরীড বীজ উৎপাদন করে তান্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাজার তৈরি করে বৈদেশিক ঘুদ্রা অর্জন করা যায়। বীজ রপ্তানি করে জাপান, তাইওয়ান, ডেনমার্ক, হল্যান্ড উন্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

 

বীজ প্রজাতি টিকিয়ে রাখার অন্যতম পশ্থা

গাছ থেকে যে বীজ উৎপন্ন হয়, সেই বীজ অনুরূপ গাছ উৎপাদনে সন্দম। সুতরাং যুগ যুগ পরে বীজ তার প্রজাতি টিকিয়ে রাখছে।

 

ঘরের ভিতরে মাশরুম চাষ

ঘরের ভিতরে মাশরুম চাষ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ১ম পত্র ১৮৮৯” বিষয়ের ৫ নং ইউনিটের ৫.৮ নং পাঠ। মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু একটি সবজি। একটি ছত্রাক জাতীয় একটি উদ্ভিদ। এর ভেষজ গুণ রয়েছে। চাষ করার জন্য মাঠে কোনো জমির প্রয়োজন পড়ে না। ঘরের মধ্যেই ৭—১০ দিনে জন্মানো যায়। ঘরের মধ্যেই তাকে তাকে সাজিয়ে জন্মানো যায় বলে একটি ঘরকে কয়েকটি ঘরের সমান ব্যবহার করা যায়। মাশরুমের বীজকে স্পন বলা হয়।

ঘরের ভিতরে মাশরুম চাষ

 

ঘরের ভিতরে মাশরুম চাষে প্রয়োজনীয় উপকরণ :

১। মাশরুম বীজের প্যাকেট

২। কাঠ বা বাঁশের তৈরি তাক

৩। ে¯প্রয়ার

৪। প্লাষ্টিকের গামলা বা বালতি

৫। চট

৬। চোষ কাগজ

৭। ব্লেড বা চাকু

৮। ছিদ্রযুক্ত লম্বা পলিথিন শীট

৯। খবরের কাগজ বা পাতলা সুতি কাপড়

১০। থার্মোমিটার

১১। হাইগ্রোমিটার ইত্যাদি।

ঘরের ভিতরে মাশরুম চাষে কাজের ধাপ :

১। বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে মাশরুম বীজের প্যাকেট সংগ্রহ করুন।

২। প্রতিটি প্যাকেটের দুই পাশের কাঁধ বরাবর অর্ধ—চন্দ্রাকৃতির বা উল্টো উ আকারে কেটে নিন।

৩। গামলা বা বলতিতে পানি নিয়ে কাটা প্যাকেটগুলো উপুড় করে চুবানোর পর ভালোভাবে পানি ঝরিয়ে নিন।

৪। প্যাকেটগুলো ঘরের মেঝে বা তাকে ২ ইঞ্চি পর পর সারি করে সাজিয়ে নিন।

৫। পাকেটগুলোর পার্শ্বের আর্দ্রতা ৭০—৮০% রাখার জন্য শীতে ও বর্ষার দিনে ২/৩ বার এবং গরমের সময় দিনে ৪/৫ বার পানি ে¯প্র কর এবং প্রয়োজনে চোষ কাগজ পানিতে ভিজিয়ে প্যাকেটগুলোর পার্শ্বে স্থাপন করুন।

৬। ঘরের তাপমাত্রা ২০—৩০০ সে. এর বেশি হলে প্যাকেটের একটু উপরে পাতলা সুতি কাপড় বা খবরের কাগজ বিছিয়ে দিন।

৭। ঘরের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনে প্যাকেটগুলোর উপর সামান্য উঁচু করে ছিদ্রযুক্ত লম্বা পলিথিন শীট বেঁধে দিন।

৮। মাশরুম বীজের প্যাকেট তাকে বসানোর ২—৩ দিনের মধ্যে পিনের মতো মাশরুম অঙ্কুর বের হবে। একসাথে অনেক
অঙ্কুর বের হলে নিচের ছোটগুলো কেটে ফেল এবং ৮—১২ টি ফ্রুটিং বডি রেখে দিন।

৯। অঙ্কুরগুলো যাতে কোনোভাবে ভেঙ্গে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখুন।

১০। অঙ্কুর বের হবার ৫—৭ দিনের মধ্যেই মাশরুম তোলা বা সংগ্রহ করার উপযোগী হবে।

১১। মাঝে মাঝে চাষ ঘরের চট বেড়া ও মেঝে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিন।

১২। চাষ ঘরের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য মাঝে মাঝে থার্মোমিটার দ্বারা তাপমাত্রা ও হাইগ্রোমিটার দ্বারা আর্দ্রতা মেপে নিন।

 

 

ঘরের ভিতরে মাশরুম চাষে সতর্কতা :

১। মাশরুম অত্যন্ত স্পর্শকাতর সবজি হওয়ায় চাষ ঘর ও এর আশে পাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা অত্যাবশ্যক।

২। প্রয়োজনে ে¯প্রয়ারের মাধ্যমে চাষ ঘরের চট বেড়া ও মেঝে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।

৩। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনে চোষ কাগজ ভিজিয়ে প্যাকেটের পার্শ্বে রাখতে হবে অথবা সুতি কাপড় বা খবরের কাগজ দিয়ে প্যাকেট ঢেকে দিতে হবে।

৪। অঙ্কুর বের হবার সময় এমনভাবে পানি ে¯প্র কর যাতে পানির ফেঁাটার আঘাতে মাশরুম অঙ্কুর ভেঙ্গে না যায়।

৫। কাঁটা অঙ্কুরগুলোর স্থান এমনভাবে চেছে দিতে হবে যাতে প্যাকেটের গায়ে কোনো গর্ত তৈরি না হয়।

৬। মাশরুম ভালোভাবে সংরক্ষনের স্বার্থে তোলার ১২ ঘন্টা আগ পর্যন্ত এর গায়ে পানি ে¯প্র করা যাবে না।

 

গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন

আজকের আলোচনার বিষয় গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন। কৃত্রিম প্রজনন ব্যাখ্যা করার আগে প্রথমে বুঝতে হবে প্রজনন কী? প্রজনন হলো জীবের একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জীব তার বংশ রক্ষা করে এবং একই বৈশিষ্ট্যের নতুন জীবন সৃষ্টি হয়। প্রজনন প্রধানত দুই ধরনের হয়—
১. প্রাকৃতিক উপায়ে প্রজনন
২. কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন।

এই পাঠে আমরা কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব, প্রক্রিয়া ও উপকারিতা বিস্তারিতভাবে জানব।

গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন

ডাকে আসা বা গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে সরাসরি ষাঁড় দ্বারা পাল দেওয়াকে প্রাকৃতিক প্রজনন বলা হয়। প্রাকৃতিক প্রজনন মাঠে বা ঘাটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে থাকে, আবার গাভীর মালিক নিজেও ষাঁড়ের কাছে নিয়ে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। তবে, প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে গরুর জাত উন্নত করা সম্ভব নয়।

দেশীয় বা অনুন্নত গরুকে উন্নত করতে হলে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করে কৃত্রিম প্রজনন করতে হয়। কৃত্রিম প্রজননে উন্নত ষাঁড় থেকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বীর্য সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা ডাকে আসা বকনা বা গাভীতে প্রয়োগ করে গর্ভধারণ করানো হয়। এর ফলে বাচ্চার মধ্যে উন্নত জাতের বৈশিষ্ট্য আসে।

বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বেসরকারি ও সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে দেশীয় গাভী বা বকনাকে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য দিয়ে প্রজনন করানো হয়। এজন্য উন্নত ও মানসম্মত ষাঁড়ের নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।

ষাঁড়ের যে সমস্ত গুণাবলি থাকা দরকার তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহারের জন্য ষাঁড়ের অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট গুণাবলি থাকা আবশ্যক। ভাল মানের ষাঁড় থেকে উন্নত জাতের বাচ্চা পাওয়ার জন্য নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো পূরণ করা জরুরি:

১. শারীরিক স্বাস্থ্য ও শক্তিশালী: ষাঁড়কে অবশ্যই সুস্থ, সবল ও সতেজ থাকতে হবে। রোগমুক্ত এবং শরীর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।

২. রোগমুক্ত ও বংশগত সমস্যা মুক্ত: ষাঁড়কে সকল প্রকার রোগ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। বংশগত বা জেনেটিক কোনো রোগ থাকলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

৩. মাতার গুণগত মান: ষাঁড়ের মাতাকে অবশ্যই উন্নত জাতের এবং অধিক দুধ বা মাংস উৎপাদনক্ষম হতে হবে, যাতে গুণগত মান নিশ্চিত করা যায়।

৪. উর্বর শুক্রাণু: ষাঁড়ের শুক্রাণু অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে উর্বর এবং প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।

৫. উপযুক্ত বয়স: ষাঁড়ের বয়স কমপক্ষে ২ থেকে ৩ বছর হতে হবে। তবে জাতভেদে বয়সের সীমা কিছুটা কমবেশি হতে পারে।

৬. আকর্ষণীয় গায়ের রঙ: ষাঁড়ের দেহ বা গায়ের রঙ পরিষ্কার ও আকর্ষণীয় হওয়া উচিত, কারণ কৃত্রিম প্রজননে উৎপাদিত বাচ্চার গায়ের রঙ ষাঁড়ের মতো হয়।

৭. স্বাস্থ্যগত মধ্যম মান: ষাঁড়ের স্বাস্থ্য যদি মধ্যম মানের হয়, তা অধিকতর সুবিধাজনক।

৮. পরজীবী মুক্ত: ষাঁড়ের শরীরে কোনো পরজীবী থাকা যাবে না।

৯. শান্ত মেজাজ: ষাঁড়ের স্বভাব শান্ত ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য হওয়া আবশ্যক, যাতে প্রজনন প্রক্রিয়া সহজ হয়।

ষাঁড়ের যত্ন ও ব্যবস্থাপনা

কৃত্রিম প্রজননের পূর্বে ষাঁড়কে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য ও পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে হবে। ষাঁড়কে কোনো প্রকার ভয়-ভীতি দেখানো যাবে না এবং তাকে ভারী বা কঠোর কাজে ব্যবহার করা উচিত নয়। নিয়মিত গোসল করানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক পরিবেশে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অতিরিক্ত, ষাঁড়ের প্রজনন যোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত পশুচিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করানো আবশ্যক। এভাবে ষাঁড়ের স্বাস্থ্য ও প্রজনন ক্ষমতা নিয়মিত যাচাই করলে কৃত্রিম প্রজননের সফলতা বৃদ্ধি পায়।

কৃত্রিম প্রজননের ধাপসমূহ:

গরুর কৃত্রিম প্রজননের জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয় :

১। বীর্য সংগ্রহ :

গরুর কৃত্রিম প্রজননে সফলতার জন্য নির্দিষ্ট ধাপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রধান ধাপসমূহ হলো:

(ক) প্রাকৃতিক প্রজনন পদ্ধতি:
গরুর প্রাকৃতিক প্রজননের পর বকনা বা গাভীর যোনিপথ থেকে সরাসরি বীর্য সংগ্রহ করা যায়।

(খ) মলদ্বার উত্তেজনা পদ্ধতি:
ষাঁড়ের মলদ্বার নাড়ানো হলে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা বীর্যপাত ঘটায়। এই সময় বীর্য সংগ্রহ করা হয়।

(গ) বৈদ্যুতিক উত্তেজনা পদ্ধতি:
বিশেষ বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার করে ষাঁড়কে উত্তেজিত করলে বীর্যপাত ঘটে, যাকে সংগ্রহ করা যায়।

(ঘ) কৃত্রিম যোনি পদ্ধতি (Artificial Vagina):
বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও কার্যকর পদ্ধতি হলো কৃত্রিম যোনি পদ্ধতি। এটি অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় সহজ ও কম খরচে সম্পাদনীয়।

  • এই পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট মাপের শক্ত রাবারের নলের মধ্যে পাতলা রাবারের আরেকটি নল ঢোকানো হয়। নল দুটির সংযোগ এমনভাবে করা হয় যাতে মাঝখানে পানি ঢেলে তা বের হতে না পারে।

  • একপ্রান্তে রাবারের পাতলা টিউব এবং অপরপ্রান্তে কাঁচের টিউব সংযুক্ত করা হয়।

  • মাঝের জায়গায় গরম পানি দিয়ে কৃত্রিম যোনির তাপমাত্রা গাভীর যোনির তাপমাত্রার সমপর্যায়ে রাখা হয়।

  • একটি বিশেষ খোয়াড় বা ট্রাভিসে (যাকে ‘ডামি’ বলা হয়) একটি কাঁঠের ষাঁড় দাঁড় করানো হয়। ষাঁড় উত্তেজিত হয়ে গাভীর উপর উঠলে তার লিঙ্গ বের হয় এবং সেটি কৃত্রিম যোনির ভিতরে প্রবেশ করানো হয়।

  • উত্তেজিত ষাঁড় বীর্যপাত করে, যা রাবারের নলের মাধ্যমে কাঁচের টিউবে জমা হয়।

  • সংগ্রহকৃত বীর্য দ্রুত রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা হয়।

এই ধাপগুলি সঠিকভাবে পালন করলে উন্নত জাতের ষাঁড় থেকে উচ্চমানের বীর্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, যা কৃত্রিম প্রজননের সফলতার মূল ভিত্তি।

২। বীর্য পরীক্ষা :

ষাঁড়ের বীর্যের গুণাগুণ ও মান নির্ধারণের জন্য প্রধানত পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, যা নিম্নরূপ:

(ক) বীর্যের আয়তন মাপা:
সংগৃহীত বীর্য মাপার জন্য আয়তন মাপক নলের সাহায্য নেওয়া হয়। একটি সুস্থ ষাঁড় থেকে প্রতিবার গড়ে ৫ থেকে ৮ সিসি বীর্য প্রাপ্তি হলে সেটিকে উপযুক্ত পরিমাণ ধরা হয়।

(খ) বীর্যের রঙ নিরীক্ষণ:
ভালো মানের বীর্যের রঙ সাধারণত ক্রিমের মতো ধূসর বা হালকা সাদাটে হয়। যদি বীর্যের রঙ হলুদ, লালচে, রক্তমিশ্রিত, পুঁজ-আবদ্ধ অথবা প্রস্রাবের মতো মিশ্রিত থাকে, তবে সে বীর্য ব্যবহারের জন্য অযোগ্য বলে গণ্য হয়।

(গ) বীর্যের ঘনত্ব পরিমাপ:
সুস্থ ও শক্তিশালী ষাঁড়ের বীর্যের ঘনত্ব সাধারণত ক্রিমের মতো মজবুত হয়। কিন্তু অসুস্থ বা দুর্বল ষাঁড়ের বীর্য পানির মতো পাতলা হয়ে থাকে, যা ব্যবহারযোগ্য নয়।

(ঘ) অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা:
বীর্য সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই একটি ফোঁটা বীর্য স্লাইডে নিয়ে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে শুক্রাণুর নড়াচড়ার গতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই গতি ০ থেকে ৫ গ্রেডে ভাগ করা হয়। যেখানে গ্রেড ০ অর্থ শুক্রাণু একদমই নড়াচড়া করছে না, যা ব্যবহারের অনুপযোগী। গ্রেড যত বাড়বে, বীর্যের গুণমান তত ভালো হবে।

(ঙ) বীর্যের রাসায়নিক পরীক্ষা:
সংগৃহীত বীর্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে কয়েক ফোঁটা মিথাইল ব্লু মিশিয়ে ১১-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টেস্ট টিউবে পানির সাথে মিশ্রিত করা হয়। যদি টেস্ট টিউবের নীল রঙ ৩ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে হারিয়ে যায়, তবে বীর্য ভালো মানের বলে ধরা হয়। নীল রঙ দীর্ঘস্থায়ী হলে বীর্য ব্যবহারের উপযোগী নয়।

উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে ষাঁড়ের বীর্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা হয়, যা সফল কৃত্রিম প্রজননের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

 

৩। বীর্য তরলীকরণ :

কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে বীর্য তরলীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, একটি মাত্র উর্বর শুক্রাণুই বকনা বা গাভীর গর্ভধারণের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বীর্যে লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু থাকে এবং তা অত্যন্ত ঘন রূপে থাকে। এই ঘন বীর্য সরাসরি কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহার করলে অতিরিক্ত শুক্রাণু অপচয় হয় এবং স্বল্পসংখ্যক প্রাণীর প্রজননেই তা শেষ হয়ে যায়।

এই কারণে কৃত্রিম প্রজননে ঘন বীর্যকে একটি বিশেষ দ্রবণের সাহায্যে পাতলা বা তরল করে নেওয়া হয়, যাতে করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বীর্য দিয়ে একাধিক বকনা বা গাভীকে প্রজনন করানো সম্ভব হয়। এই পদ্ধতিকে বীর্য তরলীকরণ (Semen Dilution) বলা হয়।

তরলীকরণে ব্যবহৃত দ্রবণ: কুসুম-সাইট্রেট দ্রবণ

কুসুম-সাইট্রেট দ্রবণ বীর্য তরলীকরণের জন্য সবচেয়ে প্রচলিত ও কার্যকর মাধ্যম। এটি বীর্যকে শুধু তরল করে না, বরং শুক্রাণুকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিও সরবরাহ করে, যার ফলে বীর্যের কার্যকারিতা বজায় থাকে।

প্রস্তুত প্রণালি:

১. প্রথমে ২–৯ গ্রাম সোডিয়াম সাইট্রেট (Sodium Citrate) ও ১০০ মিলিলিটার পাতিত পানি একসঙ্গে মিশিয়ে সাইট্রেট সলিউশন তৈরি করা হয়।

২. পরে ২ ভাগ সাইট্রেট সলিউশনের সঙ্গে ১ ভাগ ডিমের কুসুম মিশিয়ে কুসুম-সাইট্রেট দ্রবণ প্রস্তুত করা হয়।

৩. এই দ্রবণের সঙ্গে সংগৃহীত বীর্য নির্ধারিত অনুপাতে মিশিয়ে যথাযথভাবে তরলীকরণ করা হয়।

এই ডাইলুয়েন্ট বা তরলকারক দ্রব্য শুক্রাণুর জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে, তাদের সক্রিয়তা বজায় রাখে এবং জীবাণুমুক্ত রাখতেও সাহায্য করে। ফলে কৃত্রিম প্রজননের সাফল্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

এই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করলে কম পরিমাণ বীর্য থেকে অনেক বেশি সংখ্যক প্রাণীকে সফলভাবে গর্ভবতী করা সম্ভব, যা পশুসম্পদ উন্নয়নে অত্যন্ত সহায়ক।

 

৪। বীর্য সংরক্ষণ :

কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় ষাঁড়ের কাছ থেকে সংগৃহীত বীর্যকে তরলীকরণের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়, যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে গাভী বা বকনাকে প্রজনন করানো যায়। বীর্য সংরক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো—বীর্যের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখা এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহারের জন্য তা সহজলভ্য করে তোলা।

বীর্য সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়:

(ক) স্বল্পমেয়াদে রেফ্রিজারেটর বা বরফযুক্ত থার্মোফ্লাক্সে বীর্য সংরক্ষণ

এই পদ্ধতিতে তরলীকৃত বীর্যকে টেস্টটিউব বা ভায়ালে ভরে ৩–৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে রাখা হয়। এভাবে সংরক্ষিত বীর্যকে ২–৩ দিন পর্যন্ত কার্যকর রাখা যায়। তবে দূরবর্তী স্থানে বীর্য পরিবহনের সময় রেফ্রিজারেটরের বাইরের তাপমাত্রার প্রভাবে বীর্য দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ সমস্যা এড়াতে বরফযুক্ত থার্মোফ্লাক্স ব্যবহার করা হয়। এতে ঠান্ডা পরিবেশ বজায় রাখার ফলে বীর্য ৩ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। এইভাবে সংরক্ষিত বীর্যকে তরল বীর্য (Liquid Semen) বলা হয়।

(খ) দীর্ঘমেয়াদে তরল নাইট্রোজেন ভর্তি সিমেন ক্যান-এ বীর্য সংরক্ষণ

এটি হলো আধুনিক ও কার্যকর বীর্য সংরক্ষণ পদ্ধতি, যা হিমায়িত বীর্য (Frozen Semen) নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে তরলীকৃত বীর্যকে বিশেষভাবে তৈরি ছোট নল বা স্ট্র-তে ভরে তরল নাইট্রোজেন ভর্তি সিমেন ক্যানের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ডুবিয়ে রাখা হয়। প্রতিটি স্ট্র-তে সাধারণত ২০–৩০ মিলিয়ন উর্বর শুক্রাণু থাকে।

তরল নাইট্রোজেনের তাপমাত্রা প্রায় –196° সেলসিয়াস, যেখানে বীর্য ২০–২৫ বছর পর্যন্ত কার্যক্ষমভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে বীর্যের কার্যক্ষমতা রক্ষার জন্য সিমেন ক্যানের ভেতরে স্ট্রগুলো সার্বক্ষণিক তরল নাইট্রোজেনের মধ্যে ডুবে থাকতে হয়। এজন্য ক্যানের নাইট্রোজেন স্তর সবসময় ১০ সেমি বা তার বেশি রাখতে হয়।

একটি ২ লিটার ধারণক্ষমতার সিমেন ক্যান সাধারণত প্রতি ৪–৫ দিন পরপর তরল নাইট্রোজেন দিয়ে পূরণ করতে হয়, যাতে তাপমাত্রা স্থিতিশীল থাকে এবং বীর্যের কার্যক্ষমতা বজায় থাকে।

এইভাবে সঠিকভাবে বীর্য সংরক্ষণ করলে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছানো যায় এবং কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গাভী বা বকনার জাত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

 

৫। বকনা বা গাভীতে বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি :

কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বকনা বা গাভীকে গর্ভবতী করার জন্য প্রধানত দুই ধরনের বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়:

(ক) তরল বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে তরল বীর্য সংরক্ষণ করা হয় রেফ্রিজারেটর বা থার্মোফ্লাস্কে। প্রয়োগের ধাপগুলো নিম্নরূপ:

১। বীর্য সংগ্রহ: ১ মিলিলিটার তরল বীর্য নিডলের মাধ্যমে সিরিঞ্জে নেওয়া হয়।

২। এ.আই. টিউব প্রস্তুতকরণ: সিরিঞ্জে সংযুক্ত টিউবটিকে গ্লিসারিন দিয়ে পিচ্ছিল করে নেওয়া হয় যাতে এটি সহজে যোনিতে প্রবেশ করতে পারে।

৩। প্রয়োগ পদ্ধতি:
 — বাম হাতে জীবাণুমুক্ত গ্লাভস পরে, হাতটি মলদ্বার দিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে জরায়ুকে ধরতে হয়।
 — ডান হাতে সিরিঞ্জসহ টিউবটি যোনিতে প্রবেশ করাতে হয় যাতে টিউবের অগ্রভাগ বাম হাতে অনুভব করা যায় (কিন্তু তা জরায়ুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না)।

৪। বীর্য প্রয়োগ: ডান হাত দিয়ে সিরিঞ্জের পিস্টনে চাপ দিলে বীর্য জরায়ু মুখে প্রবেশ করে এবং প্রজনন সম্পন্ন হয়।

(খ) হিমায়িত বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ধাপগুলো নিম্নরূপ:

১। থয়িং (Thawing):
 — হিমায়িত বীর্য ভর্তি নল বা স্ট্র সিমেন ক্যান থেকে চিমটার সাহায্যে বের করে তা ৩৪–৩৮° সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রিত পানিতে ৩০–৪০ সেকেন্ড ধরে গরম করতে হয়।
 — একে “থয়িং” বলা হয়। গলানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই বীর্য ব্যবহার করতে হয়।

২। এ.আই. গান প্রস্তুতকরণ:
 — বীর্য ভর্তি স্ট্র-এর কটন প্লাগ প্রান্ত নিচের দিকে রেখে তা গানের মধ্যে ঢুকাতে হয়।
 — স্ট্র-এর উন্মুক্ত বায়ুশূন্য প্রান্তটুকু সমান করে কেটে ফেলা হয় এবং তা জীবাণুমুক্ত এ.আই. সিথে ঢুকিয়ে লকিং ডিভাইস দিয়ে আটকাতে হয়।

৩। প্রয়োগ পদ্ধতি:
 — গাভী বা বকনাকে খোঁয়াড়ে আটকে রেখে যোনিপথ পরিষ্কার করতে হয়।
 — বাম হাতে গ্লাভস পরে তাতে তরল প্যারাফিন লাগিয়ে তা মলদ্বার দিয়ে ঢুকিয়ে জরায়ু ধরে রাখতে হয়।
 — ডান হাতে এ.আই. গানটি যোনিতে ঢুকিয়ে, বাম হাতে অবস্থান নিশ্চিত করে, ধীরে ধীরে পিস্টনে চাপ দিয়ে বীর্য প্রয়োগ করতে হয়।

🔶 গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা:

  • ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।

  • ষাঁড় ও গাভীর পরিচ্ছন্নতা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে।

  • সফল প্রজননের জন্য সঠিক তাপমাত্রা, সময় ও দক্ষতা অপরিহার্য।

 

কত্রিম প্রজনৃ নে সফলতার কারণ —

গাভী বা বকনার কৃত্রিম প্রজনন একটি সূক্ষ্ম ও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতির সফলতা নির্ভর করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণের উপর। সেগুলো হলো:

১। উর্বর ও মানসম্পন্ন ষাঁড় নির্বাচন:
কাঙ্ক্ষিত বা উন্নত জাতের সুস্থ ও উর্বর ষাঁড় থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বীর্য সংগ্রহ করা কৃত্রিম প্রজননের ভিত্তি।

২। বীর্যের গুণগতমান যাচাই:
সংগ্রহের পর ল্যাবরেটরিতে বীর্যের চলনক্ষমতা, ঘনত্ব, গুণমান ও স্বাস্থ্যগত বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়।

৩। সঠিকভাবে বীর্য সংরক্ষণ:
বীর্যকে নির্ধারিত তাপমাত্রায়, তরল নাইট্রোজেনের ট্যাংকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হয় যাতে তা কার্যকারিতা না হারায়।

৪। সাবধানতার সাথে বীর্য পরিবহন:
সংরক্ষিত বীর্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরের সময় অতিরিক্ত তাপ বা কম্পন যেন বীর্যের গুণমান নষ্ট না করে তা নিশ্চিত করতে হয়।

৫। যন্ত্রপাতি ও পরিবেশ জীবাণুমুক্ত রাখা:
প্রজনন কাজে ব্যবহৃত এ.আই. গান, সিথ, গ্লাভসসহ সকল উপকরণ এবং কাজের পরিবেশ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত হওয়া আবশ্যক।

৬। অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত কৃত্রিম প্রজননকারী:
যিনি কৃত্রিম প্রজনন সম্পাদন করবেন, তার অভিজ্ঞতা ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি।

৭। বকনা বা গাভীর গরম হওয়া নিশ্চিতকরণ:
প্রজননের আগে বকনা বা গাভীর হিট বা গরম হওয়ার লক্ষণ সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হতে হয়।

৮। সঠিক সময়ে প্রজনন:
গরম হওয়ার ১২–১৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রজনন করানো হলে সর্বোচ্চ সফলতা পাওয়া যায়।

৯। অনিয়মিত গরম হওয়া গাভীর চিকিৎসা:
যেসব গাভী অনিয়মিত বা দেরিতে গরম হয়, তাদের পশুচিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা করে উপযুক্ত করে তুলতে হয়।

১০। প্রজননের আগে ও পরে বিশ্রামের ব্যবস্থা:
বকনা বা গাভীর ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ না দিয়ে যথাযথ বিশ্রাম দেওয়া দরকার, যাতে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে।

১১। যৌনাঙ্গে সংক্রমণমুক্ত থাকা:
যোনি বা জরায়ু সংক্রান্ত কোনো সংক্রমণ বা যৌন রোগ থাকলে কৃত্রিম প্রজননের সফলতা ব্যাহত হয়, তাই পূর্বেই তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করতে হয়।

কৃত্রিম প্রজননে ব্যার্থতার কারণ —

যথাযথভাবে পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি প্রয়োগ না করলে কৃত্রিম প্রজনন ব্যর্থ হতে পারে। ফলে কাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ঘটে না এবং গবাদি পশু থেকে আশানুরূপ উৎপাদন মেলে না। নিচে কৃত্রিম প্রজননে ব্যর্থতার সম্ভাব্য কারণগুলো তুলে ধরা হলো:

১। রোগাক্রান্ত, দুর্বল বা অনুর্বর ষাঁড় থেকে বীর্য সংগ্রহ করা:
এমন ষাঁড়ের বীর্যে যথেষ্ট পরিমাণে চলনক্ষম ও স্বাস্থ্যবান শুক্রাণু না থাকায় গর্ভধারণে ব্যর্থতা ঘটে।

২। বীর্যের গুণগতমান যাচাই না করা:
বীর্য সংগ্রহের পর তা পরীক্ষা না করলে, দূষিত বা কম উর্বর বীর্য ব্যবহৃত হয়ে প্রজননে ব্যর্থতা ঘটতে পারে।

৩। সঠিকভাবে বীর্য সংরক্ষণ না করা:
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বা তরল নাইট্রোজেন যথেষ্ট না থাকলে বীর্যের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়।

৪। বীর্য পরিবহনে সতর্কতার অভাব:
কম্পন, অতিরিক্ত উত্তাপ বা সময়সীমা অতিক্রম করলে বীর্যের গুণমান নষ্ট হয়ে যায়।

৫। সিমেন ক্যানের নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া:
তরল নাইট্রোজেন পর্যাপ্ত না থাকলে বীর্য হিমায়িত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায়।

৬। সঠিকভাবে স্ট্র থয়িং না করা:
স্ট্র (বীর্য ভর্তি নল) নির্ধারিত সময় ও তাপমাত্রায় গরম না করলে শুক্রাণুর কার্যকারিতা নষ্ট হয়।

৭। প্রজনন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না রাখা:
দূষিত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, যা গর্ভধারণে বাধা সৃষ্টি করে।

৮। অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ প্রজননকারী:
সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে শুক্রাণু ভুল স্থানে প্রবেশ করে অথবা প্রজনন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।

৯। বকনা বা গাভীর গরম হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া:
গরম না হওয়া অবস্থায় বীর্য প্রয়োগ করলে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না।

১০। সঠিক সময়ে প্রজনন না করা (১২–১৮ ঘণ্টার মধ্যে):
প্রজননের নির্দিষ্ট সময়সীমা না মানলে শুক্রাণু নিষিক্ত হতে পারে না।

১১। ভুল স্থানে শুক্রাণু স্থাপন করা:
জরায়ুর পরিবর্তে যোনিতে বা অন্যত্র শুক্রাণু পড়লে গর্ভধারণ ব্যর্থ হয়।

১২। অনিয়মিত গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে চিকিৎসা না করেই প্রজনন করানো:
হরমোনজনিত বা শারীরিক সমস্যার কারণে সফলতা নাও আসতে পারে।

১৩। প্রজননের আগে ও পরে পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব:
অতিরিক্ত চলাফেরা বা মানসিক চাপ গর্ভধারণের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

১৪। যৌনাঙ্গে সংক্রমণ বা যৌন রোগের উপস্থিতি:
এসব সমস্যা থাকলে জরায়ুতে শুক্রাণুর জীবনচক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গর্ভসঞ্চার সম্ভব হয় না।

বকনা বা গাভীর গরম হওয়া বা ডাকে আসার বাহ্যিক লক্ষণসমূহ —

বকনা বা গাভী গরমে আসলে (Heat বা Estrus) তার প্রজনন সক্ষমতা অর্জন করে এবং এ সময় প্রজননের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য গাভীর গরম হওয়া শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে গরম হওয়া বা ডাকে আসার সাধারণ ও লক্ষণীয় বাহ্যিক চিহ্নসমূহ তুলে ধরা হলো:

১। অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া ও ঘন ঘন ডাকাডাকি করা:
গাভী সাধারণত শান্ত প্রকৃতির হলেও গরমে এলে অস্থির আচরণ করে এবং বারবার ডাকতে থাকে।

২। এক জায়গায় স্থির হয়ে না দাঁড়িয়ে ছটফট করতে থাকা:
সে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে থাকে এবং আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।

৩। লেজ বারবার নাড়া ও উঁচু করে রাখা:
প্রায়ই লেজ তুলে রাখে এবং পেছনের অংশ ঘন ঘন নাড়ে, যা যৌন উত্তেজনার লক্ষণ।

৪। ঘন ঘন অল্প পরিমাণ প্রস্রাব করা:
প্রস্রাবের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায়, তবে পরিমাণে খুব কম থাকে।

৫। ক্ষুধা কমে যাওয়া বা খেতে না চাওয়া:
সাধারণ খাদ্যে আগ্রহ হারায় এবং খাওয়া কমিয়ে দেয়।

৬। যোনিদ্বার ফুলে যাওয়া ও লালচে দেখানো:
প্রজনন অঙ্গ ফুলে ওঠে এবং তাতে লালচে ভাব দেখা যায়।

৭। যোনিদ্বার থেকে স্বচ্ছ, জেলির মতো শ্লেষ্মা নির্গত হওয়া:
এই শ্লেষ্মা লেজের গোড়া এবং যোনির চারপাশে লেগে থাকতে দেখা যায়, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।

৮। অন্য গরুর উপর লাফিয়ে ওঠা ও নিজে লাফিয়ে উঠতে দেওয়া:
গরমে আসা গাভী সাধারণত অন্য গরুর উপরে লাফানোর চেষ্টা করে এবং অন্য গরুকে নিজের উপরে উঠতে দেয়। অনেক সময় নিজের পেছনে অন্য গরুকে চাটতেও দেয়।

৯। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া:
শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে একটু বেশি অনুভূত হয়।

১০। দুধের পরিমাণ হঠাৎ কমে যাওয়া (দুধালো গাভীর ক্ষেত্রে):
গাভীর গরমে আসার সময়ে দুধ উৎপাদন কিছুটা কমে যেতে পারে।

✅ এসব লক্ষণগুলো গাভী বা বকনার গরম হওয়া নিশ্চিত করতে সহায়ক। সঠিক সময়ে (সাধারণত গরম হওয়ার ১২–১৮ ঘণ্টার মধ্যে) কৃত্রিম প্রজনন করালে গর্ভধারণের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

 

কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা :

কৃত্রিম প্রজনন আধুনিক প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে প্রাণির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, জাত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। নিচে কৃত্রিম প্রজননের প্রধান সুবিধাগুলো তুলে ধরা হলো:

১। দেশীয় অনুন্নত জাতের প্রাণির উন্নয়ন সম্ভব:
উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করে দেশীয় গরুর গুণগত মান ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়।

২। একটি ষাঁড়ের বীর্যে বহু প্রাণিকে প্রজনন করানো সম্ভব:
একবার সংগৃহীত বীর্য থেকে প্রায় ১০০ থেকে ৪০০টি বকনা বা গাভীকে প্রজনন করানো যায়, যা ব্যয় ও সময় সাশ্রয় করে।

৩। উন্নত বা কাঙ্ক্ষিত ষাঁড়ের বীর্য সহজে ব্যবহারযোগ্য:
দূরবর্তী বা বিদেশি উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্যও সহজে সংগ্রহ ও প্রয়োগ করা যায়।

৪। দীর্ঘমেয়াদে বীর্য সংরক্ষণ:
উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য হিমায়িত অবস্থায় বহুদিন সংরক্ষণ করে পরবর্তী সময়ে ব্যবহার করা যায়।

৫। সঙ্গমে অক্ষম হলেও ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার সম্ভব:
শারীরিকভাবে সঙ্গমে অক্ষম বা বয়স্ক ষাঁড় থেকেও কার্যকর বীর্য নিয়ে তা কৃত্রিমভাবে ব্যবহার করা যায়।

৬। উচ্চ হারে গর্ভধারণ সম্ভব:
সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে বকনা বা গাভীর গর্ভধারণের হার তুলনামূলক বেশি হয়।

৭। বহু দূরের অঞ্চলেও প্রজনন করানো যায়:
কাঙ্ক্ষিত ষাঁড়ের বীর্য দেশের যেকোনো স্থানেই পৌঁছে দিয়ে প্রজনন করানো যায়, এমনকি দেশের বাইরেও।

৮। প্রাকৃতিক প্রজনন অপছন্দকারী প্রাণির জন্য উপযোগী:
অনেক সময় কিছু গাভী বা বকনা ষাঁড়ের সংস্পর্শে যেতে চায় না বা শুয়ে পড়ে না—তাদের ক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রজনন একটি কার্যকর সমাধান।

৯। হাইব্রিড বা সংকর জাত তৈরির সুযোগ:
ভিন্ন ভিন্ন জাতের প্রাণির মধ্যে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সংকর জাত বা হাইব্রিড তৈরি করে অধিক উৎপাদনশীল ও টেকসই প্রজাতি সৃষ্টি করা যায়।

১০। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ:
বীর্য ও যোনি পরীক্ষা করে প্রজনন অঙ্গের বিভিন্ন রোগ বা সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয়।

 

কৃত্রিম প্রজননের অসুবিধা :

যদিও কৃত্রিম প্রজনন গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকর একটি আধুনিক প্রযুক্তি, তবুও এ পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নিচে কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্বপূর্ণ অসুবিধাগুলো তুলে ধরা হলো:

১। দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রজননকারীর প্রয়োজনীয়তা:
এ পদ্ধতি পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রজননকারী দরকার হয়। অদক্ষ ব্যক্তির দ্বারা কার্য সম্পন্ন হলে তা ব্যর্থতার ঝুঁকি তৈরি করে।

২। বিশেষায়িত যন্ত্রপাতির প্রয়োজন:
বীর্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রয়োগের জন্য নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতি যেমন—এ.আই. গান, থার্মোফ্লাক্স, স্ট্র থয়িং ডিভাইস ইত্যাদি অপরিহার্য। এগুলো ব্যয়বহুল এবং সবসময় সহজলভ্য হয় না।

৩। ত্রুটিযুক্ত বীর্য ব্যবহারে ব্যর্থতা:
নষ্ট বা নিম্নমানের বীর্য ব্যবহার করলে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

৪। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে সফলতা কমে:
প্রজননের সময় ভুল পদ্ধতি প্রয়োগ, বীর্য ভুল স্থানে প্রয়োগ ইত্যাদি সমস্যায় গর্ভধারণের হার অনেক কমে যায়।

৫। উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্যের অভাব:
কাঙ্ক্ষিত গুণসম্পন্ন উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য সহজে পাওয়া না গেলে প্রজননের উদ্দেশ্য সফল হয় না।

৬। বীর্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জটিলতা:
নির্ধারিত তাপমাত্রায় এবং নিরাপদভাবে বীর্য সংরক্ষণ না করলে তা অকেজো হয়ে যেতে পারে।

৭। নীরব গরম (Silent Heat) শনাক্তে সমস্যা:
অনেক বকনা বা গাভী গরম হলেও তা বাহ্যিকভাবে বোঝা যায় না। ফলে নির্ধারিত সময়ে প্রজনন না করানো গেলে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না।

৮। সঠিক সময়ে প্রজনন করাতে ব্যর্থ হওয়া:
গরমের সঠিক সময় জানার ঘাটতি থাকলে বীর্য প্রয়োগ ব্যর্থ হয় এবং চক্র আবার পুনরায় অপেক্ষা করতে হয়।

৯। প্রজননকারীর অদক্ষতা:
যন্ত্রপাতি ব্যবহার বা পশুর আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে অদক্ষতা থাকলে সঠিকভাবে প্রজনন সম্ভব হয় না।

১০। প্রতিকূল পরিবেশ ও আবহাওয়ার প্রভাব:
অতিরিক্ত গরম, ঠান্ডা বা বর্ষাকালে তরল নাইট্রোজেন ব্যবহার, বীর্য সংরক্ষণ ও পরিবহণ জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।

কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব :

কৃত্রিম প্রজনন হলো আধুনিক কৃষি ও পশুপালন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, যা গবাদি পশুর উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাত উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এর গুরুত্বগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:

১। অনুন্নত গরুর জাতকে উন্নত জাতের সঙ্গে রূপান্তরিত করা যায়:
দেশীয় বা নিম্নমানের গবাদি পশুকে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করে উচ্চ ফলনশীল ও প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতে রূপান্তরিত করা সম্ভব।

২। উন্নত জাতের কারণে দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণে সহায়ক:
উন্নত জাতের গবাদি পশুর মাধ্যমে দেশের দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে।

৩। গবাদি পশুর প্রজনন সংকট প্রতিরোধে কার্যকর:
প্রজনন সমস্যা থাকলে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দ্রুত ও নিয়ন্ত্রিত প্রজনন সম্ভব হয়।

৪। গাভী বা বকনার গর্ভধারণের হার বৃদ্ধি পায়:
সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে বীর্য প্রয়োগের ফলে গর্ভধারণের সফলতার হার বেড়ে যায়।

৫। কাঙ্খিত জাতের হাইব্রিড বা সংকর বাচ্চা উৎপাদন:
বীর্যের নির্বাচনের মাধ্যমে উচ্চমানের সংকর জাতের বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব, যা অধিক ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধক।

৬। গবাদি পশুর যৌন রোগ প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণে সহায়ক:
কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে সরাসরি ষাঁড়ের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকায় যৌন রোগের সংক্রমণ কমে।

৭। কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি:
এ কার্যক্রমে প্রশিক্ষিত জনশক্তির চাহিদা থাকায় অনেক বেকার ব্যক্তি কর্মসংস্থান পায়।

৮। একটি ষাঁড় থেকে ব্যাপক সংখ্যক গাভী বা বকনাকে প্রজনন করানো সম্ভব:
বছরে একটি উন্নত ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করে প্রায় ১০,০০০ টি গাভী বা বকনাকে গর্ভবতী করা যায়, যা প্রজনন খরচ ও সময় বাঁচায়।

৯। গ্রামাঞ্চলে উন্নত জাতের ষাঁড় পালনের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়:
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের বীর্য সরবরাহে গৃহ পর্যায়ে উন্নত জাতের পশু পালন সহজ হয়।

১০। বীর্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘস্থায়িত্ব:
উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য হিমায়িত অবস্থায় সংরক্ষণ করে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা সম্ভব, যা প্রজনন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।

কৃত্রিম প্রজনন দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এর সুফল নিশ্চিত করা গেলে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের গড় উন্নত হবে এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে।

মৗমাছি পালন ও মধু উৎপাদন

মৗমাছি পালন ও মধু উৎপাদন নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি ৫ নং ইউনিটের “বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি” ৫.৬ নং পাঠ।

মৗমাছি পালন ও মধু উৎপাদন

 

কীটপতঙ্গের নাম শুনলেই আমরা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে থাকি। ধারণা করে থাকি এরা খুব ক্ষতিকর। ইহা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ অনেক পোকা আছে যা আমাদের প্রভৃত উপকার করে থাকে। এর মধ্যে মৌমাছি অন্যতম।

কারণ মধু ও মোমের জন্য মৌমাছি সকলের নিকট খুবই প্রিয়। এছাড়াও এরা ফসলের পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে ফলন অনেক বাড়িয়ে দেয়। মধু ও মোম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে মৌমাছি পালন করার বিদ্যাকে মৌমাছি পালনবিদ্যা বলা হয়। সাধারণতঃ প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে মৌমাছি সংগ্রহ করে এনে মৌবাক্সে মৌচাকের উপযোগী কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন করাকে মৌমাছি চাষ বলা হয়। মৌমাছি একটি সামাজিক পোকা। এরা কলোনী তৈরি করে একসাথে বসবাস করে। এই পোকার মধ্যে শ্রমবিভাজন দেখা যায়। শ্রমবিভাজন অনুসারে এই পোকাদের ৩টি শ্রেণি বা কাস্টে বিভক্ত করা হয়। যথা :

(১) রাণী মৌমাছি

(২) কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি

(৩) পুরুস মৌমাছি।

১। রাণী মৌমাছি:

মৌমাছির যে কোনো কলোনীতে বা মৌচাকে প্রজনন কার্য সম্পন্ন করার জন্য একটি মাত্র স্ত্রী মৌমাছি দেখা যায়, একে রাণী মৌমাছি বলা হয়। রাণী মৌমাছি কলোনীর সব মৌমাছির তুলনায় আকারে বড়। সে কলোনীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং রাণী—প্রকোষ্ঠে বাস করে। যৌন সঙ্গম ও ডিম পাড়া ছাড়া রাণী অন্য কেনো কাজ করে না। সে তার জীবদ্দশায় পুরুষ মৌমাছির সাথে এক বা একাধিকবার মিলনে যেতে পারে। কলোনীর বাইরে কুমারী রাণীর সাথে পুরুষ মৌমাছির মিলন হয়। মিলনের বাসনায় কুমারী রাণী শুষ্ক আবহাওয়ায় মৌচাকের বাইরে এসে উড়তে শুরু করলে চাকের পুরুষ মৌমাছিরা তার পিছু ছুটতে থাকে।

পুরুষদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ চলার পর যে পুরুষটি যুদ্ধে জয়লাভ করে সর্বপ্রথম রাণীর কাছে পেঁৗছাতে পারে সে পুরুষ মৌমাছিটির সাথেই কুমারী রাণী মিলনে লিপ্ত হয়। মিলনের পর পুরুষ মৌমাছিটি মারা যায়।

মিলনের পর রাণী মৌমাছি গর্ভবতী হয়ে কলোনীতে ফিরে আসে এবং সময়মত ডিম দিতে শুরু করে। দেখা গেছে যে, একটি রাণী মৌমাছি তার দেহের জনন থলির মধ্যে প্রায় ২ কোটি শুক্রাণু জমা করে রাখতে পারে। একটি রাণী মৌমাছি গড়ে প্রতিদিন ৩০২১ টি করে ডিম দিতে পারে। এই রাণী মৌমাছি দু’ধরনের ডিম পেড়ে থাকে  ক) নিষেককৃত ডিম ও খ) অনিষেককৃত ডিম। নিষেককৃত ডিম থেকে কর্মী মৌমাছি এবং অনিষেককৃত ডিম থেকে পুরুষ মৌমাছি তৈরি হয়ে থাকে। মৌচাকের মধ্যে রয়েল জেলী থাকে।

এই রয়েল জেলী মৌমাছির লার্ভাকে ৬—৭ দিন খাওয়ালে তা রাণী মৌামাছি এবং ৩ দিন খাওয়ালে তা কর্মী মৌমাছিতে পরিণত হয়। একই মৌচাকে একাধিক রাণী মৌমাছি থাকলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং যুদ্ধে জয়ী রাণীই একমাত্র বেঁচে থাকে, বাকীরা মারা যায়। যে রাণী বেঁচে থাকে, কর্মী ও পুরুষ মৌমাছিরা তার নির্দেশ মেনে এবং তাকে অনুসরণ করে অন্যত্র কলোনী তৈরি করে। তবে স্বাভাবিকভাবে একটি রাণী মৌমাছি নির্দিষ্ট সংখ্যক ডিম দেওয়ার পর সে মারা যায় এবং নতুন রাণীর উদ্ভব ঘটে।

 

২। কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি:

কলোনীর সব মৌমাছির তুলনায় এরা আকারে সবচেয়ে ছোট। তবে খুবই শক্তিশালী ও পরিশ্রমী এবং এদের পেটের শেষ খন্ডাংশে একটি হুল থাকে। একটি কলোনীতে প্রায় ২০,০০০—৩০,০০০ কর্মী মৌমাছি থাকে। এরা বন্ধ্যা স্ত্রী মৌমাছি। এই মৌমাছির গায়ে লোম থাকে যা দেখতে চিরুনীর মত যা মধু ও পরাগ সংগ্রহে সহায়তা করে এবং এদের পিছনের দু’পায়ে পরাগ থলে থাকে। এদের কাজ হলো মৌচাক তৈরি করা, মৌচাক রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা, মৌচাক পরিস্কার করা ও পাহারা দেয়া, মধু অনুসন্ধান ও সংগ্রহ করা, রাণীকে খাওয়ানো ও রাণীর পরিচর্যা করা, বাচ্চাদের খাওয়ানো ও তাদের লালন পালন করা, মোম প্রস্তুত করা ইত্যাদি। একটি কর্মী মৌমাছি ৪২—১৮০ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

 

৩। পুরুষ মৌমাছি:

এরা আকারে কর্মী মৌমাছির চেয়ে বড়, কিন্তু রাণী মৌমাছির তুলনায় ছোট। এরা সাধারণতঃ কালচে রঙের হয় এবং এদের শরীর বেশ শক্ত ও মজবুত হয়। তবে এরা অত্যন্ত অলস প্রকৃতির। খাবারের জন্য এরা কর্মী মৌমাছির ওপর নির্ভরশীল। জীবনের অধিকাংশ সময়ই এরা মৌচাকের মধ্যে ঘুমিয়ে সময় কাটায়। বাকী সময় উজ্জ্বল রোদে মুক্ত বাতাসে উড়ে বেড়িয়ে জীবনকে উপভোগ করে। প্রতিটি কলোনীতে স্বল্পসংখ্যক পুরুষ মৌমাছি থাকে। মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে কর্মী মৌমাছিরা আক্রমণ করে এদেরকে মেরে ফেলে। পুরুষ মৌমাছির প্রধান কাজই হলো রাণীর সাথে যৌন সঙ্গমে মিলিত হয়ে রাণীকে গর্ভধারণ করানো। রাণীর সঙ্গে যৌন মিলন হওয়ার পর পরই পুরুষ মৌমাছিটি মরে যায়। একটি পুরুষ মৌমাছি সাধারণতঃ ৯০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

 

আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন:

পৃথিবীতে প্রায় ২০,০০০ বিভিন্ন প্রকার ভ্রমর জাতীয় মাছি (নবব) আছে। এদের মধ্যে সারাবিশ্বে চার প্রজাতির মৌমাছি অর্থনৈতিকভাবে পরিচিত। তা হলো— ভারতীয় মৌমাছি (অঢ়রং রহফরপধ), ইউরোপীয় মৌমাছি (অঢ়রং সবষষরভবৎধ), বৃহদাকার বা পাহাড়ী মৌমাছি ও ক্ষুদে বা ক্ষুদ্রাকৃতির মৌমাছি (অঢ়রং ভষড়ৎবধ)। ইউরোপীয় মৌমাছি ছাড়া বাকী তিন প্রজাতির মৌমাছি বাংলাদেশে দেখা যায়। তবে মধু উৎপাদনের জন্য ভারতীয় মৌমাছি সবচেয়ে বেশি উপযোগি।

এরা বেশ শান্ত স্বভাবের এবং খুব সহজে পোষ মানে। ফলে মৌমাছি পালকরা অনায়াসে এদের নিয়ে কাজ করতে পারে। কাঠ বা প্যাকিং বাক্স, কেরোসিনের টিন অথবা দেয়ালের কুঠুরীতে এদেরকে পালন করা হয়ে থাকে। এদেরকে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে কৃত্রিম বাসস্থান তৈরি করে সেখানে তাদের উপযোগি পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে পালন করাকেই আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন করা বোঝায়। নিচে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালনের ধাপসমূহ বর্ণনা করা হলো।

 

১। রাণী মৌমাছি সংগ্রহ :

চার উপায়ে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করা যায়। যথা—

(ক) রাণী, বেশ কিছু কর্মী ও পুরুষ মৌমাছিসহ মৌবাক্স কিনতে পাওয়া যায়।

(খ) মাঠ ফসল বা উদ্যান ফসলে ফুল ধরার সময় জাল দ্বারা রাণীসহ কর্মী মৌমাছি ধরা যায়। জালে আটকানো রাণী মৌমাছিকে কাপড় বা ন্যাকড়া দ্বারা আস্তে করে ধরে কৃত্রিম মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে ঢুকিয়ে আটকিয়ে দিতে হয়। রাণী মৌমাছি চেনার উপায় হলো— আকারে সবচেয়ে বড়, খয়েরী বর্ণের ছোট হুল যা দেখতে ছুরির মত, ডানা ছোট এবং বুক বড় হয়।

(গ) গাছের ডাল, বাড়ী—ঘর বা দালান—কোঠার আনাচে কানাচে, মাঠির গর্ত বা গুহায় প্রাকৃতিকভাবে মৌমাছি কলোনী বা চাক তৈরি করে। কোনো জ্বালানী দ্বারা আগুনের ধুঁয়া তৈরি করে মৌচাকে ধঁুয়া লাগাতে হবে। কারণ মৌমাছিকে ধঁুয়া দ্বারা কাবু করা যায়। এতে পুরুষ ও কর্মী মৌমাছি মৌচাক ছেড়ে কাছাকাছি স্থানে সরে যাবে, কিন্তু রাণী মৌমাছি সরবে না। এই অবস্থায় মৌচাক থেকে সাবধানে রাণী মৌমাছিকে ধরে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে আটকাতে হয়। সাধারণতঃ কম বা মাঝারী বয়সের মৌচাক থেকে রাণী সংগ্রহ করলে সহজে পোষ মানে। কিন্তু পুরাতন মৌচাকের রাণী সহজে পোষ মানে না।

(ঘ) আগুনের ধঁুয়া দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি মৌচাকের মৌমাছিকে সরাতে হয় অথবা শান্ত করতে হয়। পরে মৌচাকের অবস্থান বুঝে একটি কাঠি ঢুকিয়ে ছুরি বা চাকু দ্বারা মৌচাকের গোড়া কেটে দিয়ে চাককে আলাদা করা হয়। চাকের অপ্রয়োজনীয় ও পচা অংশ কেটে ফেলা হয়। চাকটি কাঠিতে এমনভাবে রাখতে হয় যেন ঝুলে থাকে। এই সময় রাণী মৌমাছি ঝাঁক হয়ে বসে থাকা মৌমাছিদের উপরে বা বাইরের দিকে থাকে। সেখান থেকে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে বসাতে হয়। কোনো কারণে রাণী মৌমাছিকে খঁুজে পাওয়া না গেলে ধঁুয়া বা হাত দ্বারা সকল মৌমাছিকে মৌবাক্সে ঢুকিয়ে দিতে হয়।

এতে সকল মৌমাছির সাথে রাণীর যাওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকে। রাণী মৌমাছি মৌবাক্সে না ঢুকে থাকলে কর্মী মৌমাছিরা রাণীকে নিয়ে ঝাঁক বেঁধে বসে থাকে। সেখান থেকেও রাণী মৌমাছিকে সংগ্রহ করে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে আটকানো যায়।

 

২। সংগ্রহকৃত রাণী মৌমাছি মৌবাক্সে স্থাপন :

উপরে বর্ণিত যে কোনো পদ্ধতিতে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করে রাণীকে কুঠুরী বা খাঁচায় আটকিয়ে মৌবাক্সের ফ্রেমের ভিতর রেখে কুঠুরীর ঢাকনা বা মুখ খুলে দিলে কুঠুরী থেকে বের হয়ে রাণী ফ্রেমের ভিতর থাকে, কিন্তু মৌবাক্স থেকে বের হতে পারে না। কারণ মৌবাক্সের ছিদ্র তার জাল দিয়ে আটকানো থাকে। রাণী মৌমাছির আকার বড় বলে তারজালের ছিদ্র দিয়ে বের হতে পারে না। কিন্তু কর্মী ও পুরুষ মৌমাছি রাণীর চেয়ে আকারে ছোট বলে তারা তারজালের ছিদ্র দিয়ে মৌবাক্সের ভিতর সহজে আসা—যাওয়া করতে পারে। রাণী মৌমাছির দেহ থেকে এক ধরনের সুগন্ধ নিঃসৃত হয়।

এই সুগন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কর্মী ও পুরুষ মৌমাছি ঝাঁকে ঝাঁকে মৌবাক্সের ভিতর প্রবেশ করে। এভাবে মৌবাক্সে রাণীকে ৪—৫ দিন আটকিয়ে রাখার পর কর্মী মৌমাছিরা কলোনী বা মৌচাক তৈরি করা শুরু করে। তারপর মৌবাক্সের ঢাকনা খুলে দিলেও রাণী মৌমাছি কোথাও চলে যায় না। মৌবাক্সের প্রবেশ পথে একটি পাত্রের মধ্যে চিনির সিরা রেখে দিলে তা খেয়ে মৌমাছিরা স্বাভাবিক ও শান্ত থাকে।

 

৩। মৌবাক্স উদ্যান বা ফসল মাঠে স্থাপন :

উদ্যান বা মাঠ ফসলের জমিতে ফুল ধরার আগে মৌবাক্সগুলোকে লোহা বা কাঠের তৈরি ৪ পায়া বিশিষ্ট ১.৫—২.০ ফুট উঁচু টুলের উপর স্থাপন করতে হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ফুলের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও সরিষা, তিল, তুলা, পিঁয়াজ, আম, জাম, লিচু, ভূট্টা প্রভৃতি ফুলের প্রতি মৌমাছির আসক্তি একটু বেশি। প্রতি হেক্টর সরিষার জমিতে ১০টি মৌবাক্স ১০০ মিটার দূরত্বে উত্তর—পূর্বমুখী করে বসাতে হয়। কারণ পূর্ব বা পশ্চিমমুখী করে বসালে রোদে মৌচাক নষ্ট হবে। আবার সোজা উত্তরমুখী করে বসালে শৈত্যপ্রবাহ এবং দক্ষিণমুখী করে বসালে বৃষ্টির পানিতে মৌচাকের ক্ষতি হবে। মৌবাক্সে স্থাপনের সময় মৌমাছি প্রবেশ পথের সামনে যাতে ফাঁকা জায়গা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এতে মৌমাছি সহজে চলাফেরা করতে পারে।

একটি উন্নত মৌবাক্স দু’টি অংশ নিয়ে গঠিত। মৌবাক্সের নিচের বড় কক্ষটি হলো বাচ্চার ঘর এবং উপরের ছোট কক্ষটি হলো মধু সঞ্চয়ের ঘর। বাক্সের সবার উপরে ঢাকনা ও সবার নিচে তলা থাকে। ঘর দুটোতে ৫—৭টি ফ্রেম থাকে এবং এই ফ্রেমেই মৌমাছিরা মৌচাক বাঁধে। বাচ্চা ঘরে ৭টি খোপ থাকে। এক খোপ থেকে পরবর্তী খোপের মাঝখানে ৮ মিলিমিটার ফাঁকা থাকে। খোপগুলোতে কাঠের ফ্রেম বসানো থাকে। রাণী মৌমাছি এই ফ্রেমে তৈরি করা চাকে ডিম পাড়ে ও বংশবিস্তার ঘটায়। বাচ্চা ঘর সবচেয়ে বড় ঘর।

মৌবাক্সটি এক ফালি পুরু কাঠের ওপর বসাতে হয়। বাক্সটি কাঠের ওপর বসানোর পর উক্ত কাঠের সামনের দিকে কিছুটা জায়গা বাড়ানো থাকে যাকে পাটাতন বলা হয়। এই পাটাতনের ওপর মাঝে মাঝে মৌমাছিদের কৃত্রিম খাবার দেয়া হয়।

৪। মৌবাক্স রক্ষণাবেক্ষণ :

কমপক্ষে প্রতি ৭ দিন পর পর মৌবাক্স পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তবে ঘন ঘন বাক্স খুললে বিশেষ করে বাচ্চার ঘর খুললে মৌমাছিদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। যদি শত্রু মথের আক্রমণ হয় তবে মৌচাক খুলে রোদে শুকাতে হয়। মৃত লার্ভা বা পিউপা বা বাক্সের তলায় মৌচাকের অন্য কোন ময়লা থাকলে তা পরিস্কার করে ফেলা উচিত। রাণীর ঘর তৈরি হলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে। নচেৎ মৌচাক ছেড়ে মৌমাছিদের চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বংশবৃদ্ধিকালে বাচ্চা ঘরে নতুন ফ্রেম লাগাতে হবে। কোনো পুরনো অকেজো চাক বাক্সে থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।

প্রয়োজনে বয়স্ক রাণীকে সরিয়ে নতুন রাণীর সংযোজন করতে হবে। তা না হলে মৌমাছিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যেতে পারে। মৌচাকে নবনির্মিত রাণী মৌমাছি, বাচ্চা ও পুরুষ মৌমাছিদের কঠুরীগুলো কেটে নষ্ট করে দিতে হবে। মৌমাছির বংশবিস্তার খুব বেশি হলে তাদেরকে একাধিক বাক্সে ভাগ করে দিতে হবে। আবার খাদ্য সংকটের কারণে মৌমাছির সংখ্যা কমে গেলে একাধিক বাক্সের মৌমাছি একত্র করে এক বাক্সে স্থানান্তর করা উচিত। প্রচুর ফুলযুক্ত স্থানে বাক্স স্থানান্তর করতে হয়। খাদ্য সংকট হলে চিনির সিরা তৈরি করে সরবরাহ করা উচিত।

সিরা কোনো পাত্রে রেখে এর ওপর একটি পাতা বা কাঠি স্থাপন করতে হয় যাতে পাতা বা কাঠির ওপর বসে মৌমাছিরা সিরা খেতে পারে। চিনির সিরা রাতের বেলায় দেয়া উচিত যাতে এক বাক্সের মৌমাছি অন্য বাক্সে গিয়ে মারামারি করতে না পারে। ঝড়—বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে মৌবাক্সটির প্রবেশ পথ বৃষ্টি ও বাতাসের বিপরীতমুখী করে শুষ্ক ও নিরাপদ স্থানে রাখা উচিত। বাক্সের ওপর পলিথিন শীট দিয়েও বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। প্রচন্ড শীতে মৌমাছিদের যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য শীতের রাতে চট বা ছালা দিয়ে বাক্স ঢেকে রাখতে হয়। বাক্সে মৌমাছি পালনের সবচেয়ে খারাপ সময় হলো বর্ষাকাল।

এজন্য এসময় খুব খেয়াল রাখতে হয়। বহু শত্রু আছে যারা মৌমাছির বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক উভয় অবস্থাতেই ক্ষতি করে। ওয়াক্স মথ, ওয়াক্স বিটল, বোলতা, পিঁপড়া, উইপোকা, তেলাপোকা, ব্যাঙ, ইঁদুর, টিকটিকি, রক্তচোষা ইত্যাদি মৌচাকের ক্ষতি করে থাকে। এছাড়াও নসিমা, একারাইন, সেপ্টিসিমিয়া ও প্যারালাইসিস রোগে মৌমাছিদের প্রচুর ক্ষতি হয়। এজন্য সময়মত যে কোনো কীটতত্ত্ববিদের পরামর্শ নিয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

 

 

৫। মধু আহরণ :

মৌচাকের শতকরা ৭৫ ভাগ কুঠুরী মধু দ্বারা ভরে গেলে মৌমাছিরা মোম দ্বারা কুঠুরীর মুখ বন্ধ করে দেয়। এজন্য মৌচাকের উপর সাদা মোমের স্তর পড়লে বা সাদা চিক চিক করলে বুঝতে হবে মৌচাক মধু দ্বারা পরিপূর্ণ হয়েছে। এবার জ্বালানী দিয়ে আগুনের ধঁুয়া মধু ঘরে লাগালে সব মৌমাছি চাক থেকে সরে পাটাতনের ওপর আসবে। তখন পুরো মৌচাকটি কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এরপর কাপড় একটু একটু করে সরিয়ে মধুঘর থেকে ফ্রেমসহ মৌচাক বের করতে হয়। চাকে মৌমাছি থাকলে ব্রাশ দিয়ে তাদেরকে বাচ্চা ঘরে ঢুকিয়ে দিতে হয়।

কোনো কোনো সময় মধু ঘরে মৌমাছি থেকে গেলে রাণীর কুঠুরীর সামনে মধু ঘর রেখে একটু নাড়াচাড়া বা বাতাস দিলে মৌমাছিরা বাচ্চা ঘরে ঢুকে যাবে। এই অবস্থায় মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্যে মধু আহরণ করা হয়। মধু ভর্তি চাক বালতি বা গামলায় রেখে চাকু দিয়ে মৌাচাকের মধু কোষের উপর থেকে মোমের সাদা স্তরটি কেটে ফেলতে হয়। এবার ফ্রেমসহ চাকটি মধু নিষ্কাশন যন্ত্রে রেখে আস্তে আস্তে যন্ত্রটির হাতল ঘুরালে ঐ যন্ত্রে মধু জমা হবে। এবার পরিষ্কার ছাকনি দিয়ে ছেঁকে মধু সংরক্ষণ করতে হবে। মৌমাছিরা তাদের প্রয়োজনে ফুল থেকে রস সংগ্রহ করে লালার সঙ্গে মিশিয়ে মধু থলিতে করে মৌচাকে নিয়ে আসে।

কর্মী মৌমাছিরা তাদের পাখা নেড়ে বাতাস সৃষ্টি করে সংগৃহীত রস থেকে পানি বাষ্পায়িত করে দেয়। খাঁটি মধু তৈরি হওয়ার পর সেগুলোকে চাকের নির্ধারিত প্রকোষ্ঠে জমা করে এবং মোম দিয়ে ঐ সমস্ত প্রকোষ্ঠের মুখ বন্ধ করে দেয়। এক পাউন্ড মধু উৎপাদন করতে একটি কর্মী মৌমাছিকে চাক থেকে বের হয়ে ৪০০০০—৮০০০০ বার ফুল থেকে ফুলে বিচরণ করতে হয়। হিসেবে দেখা গেছে যে, এজন্য একটি কর্মী মৌমাছিকে ৩২০০০—৪২০০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হয়।

 

 

মধু উৎপাদনের গুরুত্ব :

১। মধু মহৌষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাশয়, কানপাকা, জিহবার ঘা, জন্ডিস, অর্শরোগ, সর্দি, কাশি, শ্বাসরোগসহ বিভিন্ন রোগের উপশম ছাড়াও জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

২। মধু বলবৃদ্ধিকারক, পুষ্টিকর ও মিষ্টিদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

৩। মধুতে ভিটামিন—এ, ভিটামিন—বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন—সি রয়েছে।

৪। মধুতে বিদ্যমান ডেক্সট্রোজ শরীরের দীর্ঘস্থায়ী শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।

৫। মধু দেহের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে।

৬। দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ক, ঈধ, গম, ঝ, ঋব, ঈঁ, চ ইত্যাদি উপাদানের উৎস হিসেবে কাজ করে।

৭। বর্তমানে অনেক লোক মৌমাছি চাষের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এছাড়াও বনাঞ্চলের বহু মানুষ প্রাকৃতিক মধু সংগ্রহ করে তাদের জীবিকা চালাচ্ছে।

৮। মৌচাক থেকে প্রসেস করে মোম তৈরি করা হয়। এই মোম ক্রীমজাতীয় প্রসাধনীর প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৯। দরজা, জানালা, প্রাচীরের পুডিং তৈরিতে মোমের ব্যবহার হয়।

১০। জুতার কালি ও কার্বন পেপার তৈরিতে মোম ব্যবহৃত হয়।

১১। রৌপ্যকাররা বিভিন্ন কাজে মোম ব্যবহার করে থাকেন।

১২। বিভিন্ন শিল্প কর্ম ও বাটিকের কাজে মোম ব্যবহৃত হয়।

১৩। বিভিন্ন আসবাবপত্র, জ্বালানী তেল ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরিতেও মোমের ব্যবহার হয়।

১৪। রঙ, বার্ণিশ, সেভিং ক্রীম ও লিপস্টিক তৈরির কাঁচামাল হিসেবে মোম ব্যবহৃত হয়।

১৫। মৌমাছি পালনে মধু উৎপাদনের পাশাপাশি ফসলের পরাগায়ন ভালভাবে হওয়ায় ফলন প্রায় ২০—৩০% বেশি হয়।

১৬। মধু উৎপাদন করা খুব কঠিন নয়। একবার মৌবাক্স স্থাপন করলে সারা বছর মধু পাওয়া সম্ভব। একবার তৈরি করা বাক্স দিয়ে কয়েক বছর মধু পাওয়া যায়।

১৭। অন্য যে কোনো পেশার পাশাপাশি মধু উৎপাদন করে বাড়তি উপার্জন করা সম্ভব।

১৮। মধু উৎপাদনে কম পঁুজি খাটিয়ে বেশি লাভ করা সম্ভব।

১৯। বেকার লোকেরা মৌচাষ করে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে আত্ম—কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করে অনায়াসে স্বাবলম্বী হতে পারে।

২০। শস্য শ্যামল বাংলাদেশে মৌচাষ করে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।

মাশরুম চাষ

মাশরুম চাষ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি”, ৫ নং ইউনিটের ৫.৫ নং পাঠ।

 

মাশরুম চাষ

মাশরুম খুব সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি সবজি। এর ওষুধি বা ভেষজ গুণ রয়েছে। ছত্রাকবিদরা বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষা—নিরীক্ষার মাধ্যমে এ পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় দুই লক্ষেরও বেশি প্রজাতির ছত্রাক আবিষ্কার করেছেন। এই বিপুল সংখ্যক ছত্রাকের মধ্য থেকে অনেক যাচাই—বাছাই করে খাওয়ার উপযোগী প্রায় দুই হাজার ছত্রাক চিহ্নিত করেছেন যেগুলো মাশরুম হিসেবে গণ্য। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ প্রজাতির ছত্রাক মাশরুম হিসেবে উৎপাদন করা যায়। মূলতঃ মাশরুম হলো ভক্ষণযোগ্য মৃতজীবী ছত্রাকের প্রজনন অঙ্গ।

সুগন্ধ, রুচিসম্মত ও ভালো স্বাদের জন্য মাশরুম সকল মানুষের নিকট প্রিয় সবজি হিসেবে পরিচিত। পুষ্টিগুণ বিচারেও মাশরুম সেরা সবজির মধ্যে একটি। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যেসব উপাদান থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন, যেমন—আমিষ , খাদ্য প্রাণ ও খনিজ পদার্থ সেগুলো মাশরুমে উচ্চ মাত্রায় রয়েছে। মাশরুম চাষ করার জন্য কোনো উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না। এটি ঘরেই চাষ করা সম্ভব। এটি চাষ করার জন্য দরকারি কাঁচামাল সস্তায় ও সহজে পাওয়া যায়। বর্তমান বিশ্বে মাশরুম চাষে মানুষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে।

 

বাংলাদেশে চাষযোগ্য মাশরুম:

চাষযোগ্য মাশরুম আমাদের দেশে বর্তমানে যে সমস্ত মাশরুম চাষ হচ্ছে তার একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো :

১। স্ট্র মাশরুম

২। ওয়েস্টার মাশরুম

৩। মিল্কী মাশরুম

৪। ঋষি মাশরুম

৫। শিতাকে মাশরুম

৬। বাটন মাশরুম

৭। পপলার মাশরুম ইত্যাদি।

 

মৌসুমি মাশরুম:

মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে তিন শ্রেণির মাশরুম উৎপাদিত হয়। যথা :

 

১। গ্রীষ্মকালীন মাশরুম :

এ ধরনের মাশরুম শুধু গ্রীষ্মকালে চাষ করা যায়। যেমন— স্ট্র, মিল্কী ও ঋষি মাশরুম।

 

২। শীতকালীন মাশরুম :

এ ধরনের মাশরুম শুধু শীতকালে চাষ করা যায়। যেমন— বাটন, শিতাকে ও শিমাজী মাশরুম।

 

৩। উভয় মৌসুমী বা বছরব্যাপী মাশরুম :

এ ধরনের মাশরুম সারা বছর ধরে চাষ করা যায়। যেমন— ওয়েস্টার, পপলার, ঝিনুক ও কান মাশরুম। মাশরুমের পুষ্টিগুণ পুষ্টিগুণ বিচারে মাশরুম নিঃসন্দেহে একটি সেরা সবজি। খাদ্য জগতে মাশরুমকে সবজি শ্রেণিতে ফেলা হয়, কিন্তু প্রায়োগিকভাবে এরা উদ্ভিদ নয়। এরা ছত্রাক জাতের অন্তভুর্ক্ত। সুস্বাদু খাবার হিসেবে এরা বেশ কিছু পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকে। এরা হৃৎপিন্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে।

এছাড়া মাশরুমে মৌলিক পুষ্টি উপাদান, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং কাইটিন ও বিটা—গ্লুকান জাতীয় উপকারী অঁাশ থাকায় দীর্ঘকালস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। মাশরুমে প্রোটিন, অঁাশ, নিয়াসিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন বি, ভিটামিন ডি, কপার, সেলেনিয়াম, পটাসিয়াম, অন্যান্য খনিজ যেমন— ফসফরাস, জিঙ্ক, ম্যাগেনেসিয়াম, কম পরিমাণ ফ্যাট, ক্যালরী ও সোডিয়াম বিদ্যমান থাকে।

এতে কোনো কোলস্টেরল নেই। পাতলা করে কাটা এক কাপ কাঁচা সাদা মাশরুমে ১৫ ক্যালরি, ০ গ্রাম ফ্যাট, ২.২ গ্রাম প্রোটিন, ২.৩ গ্রাম কার্বহাইড্রেট, ০.৭ গ্রাম অঁাশ ও ১.৪ গ্রাম সুগার থাকে। মাশরুমে কোন কোলস্টেরল থাকে না এবং প্রাকৃতিকভাবেই সোডিয়াম ও ফ্যাট কম থাকে বিধায় এটাকে কার্যকরী খাবার বলা হয়।

মাশরুম চাষের ধাপসমূহ :

মাশরুম চাষে সাধারণত: যে সমস্ত পন্থা অবলম্বন করতে হয় তা ধারবাহিকভাবে নিচে আলোচনা করা হলো :

১। চাষঘর তৈরি :

পরিচ্ছন্ন এবং পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে এমন ঘরে মাশরুম চাষ করতে হয়। মাশরুম চাষের পরিবেশ খুবই স্পর্শকাতর। কারণ কাঙ্খিত পরিবেশ তৈরি না হলে মাশরুম উৎপাদন হয় না। এর চাষে পাঁচটি পরিবেশ বা মূলনীতি মেনে চলতে হয় যেমন :

 

(ক) অক্সিজেন :

মাশরুম প্রধানত কাঠের গুড়া থেকে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। এই কাঠের গুড়া অক্সিজেনের উপিস্থিতিতে জারণ—বিজারণ প্রক্রিয়ায় মাশরুমের খাবার সহজলভ্য করে দেয়। ফলে মাশরুমের ঘরে অক্সিজেনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা জরুরী।

 

(খ) আলো :

মাশরুম ঘরটি হালকা বা আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে হবে। কারণ এই ধরনের আলো মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী।

 

(গ) তাপমাত্রা :

মাশরুম ২০—৩০০ সে. তাপমাত্রায় ভালো জন্মায়। এজন্য মাশরুম ঘরের তাপমাত্রা ২০—৩০০ সে. এর মধ্যে রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে মাশরুম উৎপাদন ব্যাহত হবে। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য ঘরে সিলিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

(ঘ) আর্দ্রতা :

মাশরুম আর্দ্র অবস্থা পছন্দ করে বিধায় ঘরে ৭০—৮০% আর্দ্রতা বজায় রাখা উচিত। এর চাষঘরে মাশরুম প্যাকেটের চারিদিকে উচ্চ মাত্রার আর্দ্রতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। মাশরুম বীজকে স্পন বলা হয়।

 

(ঙ) বায়ুপ্রবাহ :

চাষ ঘরে অক্সিজেন দ্বারা কাঠের গুড়া জারিত হওয়ার ফলে প্রচুর ঈঙ২ তৈরি হয় যা প্রজনন অঙ্গ বা ফুল তৈরিতে বাঁধা দান করে। এজন্য ঈঙ২ কে বের করে দেয়ার জন্য ঘরের নিচের অংশে বায়ুপ্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

২। প্যাকেট বা স্পন সংগ্রহ :

যাচাই—বাছাই করে ভালো মানসম্পন্ন মাশরুম স্পন যে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করতে হবে। যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যাবলী থাকলে মাশরুম স্পনকে ভালো স্পন বলা যায় তা নিম্নরূপ 

ক) প্রতিটি প্যাকেট সুষমভাবে মাইসেলিয়াম দ্বারা পূর্ণ ও সাদা হবে।

খ) মাইসেলিয়ামের রঙ হলুদ, লাল বা কালো হওয়া চলবে না।

গ) প্রতিটি প্যাকেটের গঠন টাইট বা শক্ত হবে।

ঘ) প্যাকেটের গায়ে জাতের নাম ও ইনোকুলেশনের তারিখ লেখা থাকবে।

 

 

৩। প্যাকেট বা স্পন পরিবহন :

সাধারণত: ঠান্ডা পরিবেশে প্যাকেট পরিবহন করতে হয়। দূরবর্তী কোনো স্থানে নেয়ার ক্ষেত্রে ট্রেন বা বাসের ছাদের ওপর রোদে বা ইঞ্জিনের ওপর গরম স্থানে রেখে বা বৃষ্টিতে ভিজিয়ে পরিবহন করা যাবে না। বাতাস চলাচল করতে পারে এমন কাটুর্ন বা বস্তায় ভরে প্যাকেট পরিবহন করতে হয়। কোনো কারণে যদি কয়েকদিন রেখে প্যাকেট কাটতে হয় সেক্ষেত্রে ২৫০ সে. তাপমাত্রায় অর্থাৎ ঠান্ডা ঘরে আলাদা আলাদাভাবে ১৫—২০ দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। তবে প্যাকেট সংগ্রহের পরপরই যত দ্রুত সম্ভব ঠান্ডা সময়ে প্যাকেট কেটে চাষ ঘরে বসানো উচিত।

 

৪। প্যাকেট বা স্পন কর্তন :

প্রতিটি প্যাকেট চাষ ঘরে স্থাপন করার আগে সঠিক পদ্ধতিতে কাটতে হবে। প্রত্যেক প্যাকেটে কোনাযুক্ত দুইটি কাঁধ থাকে। প্রতি কাঁধ বরাবর ২ ইঞ্চি লম্বা এবং ১ ইঞ্চি ব্যাস করে উল্টো ডি আকারে কাটতে হবে। প্রত্যেক প্যাকেটের দুই কাঁধে দুইটি উল্টো ডি আকারে কাটা থাকবে। প্রতি প্যাকেটের উভয় পার্শ্বের এ কাটা জায়গার সাদা অংশ ব্লেড দিয়ে চেছে ফেলতে হবে। এই কাটা ও চাছা প্যাকেট উপুড় করে ৫—১৫ মিনিট পানিতে চুবিয়ে নেয়ার পর ভালোভাবে পানি ঝরিয়ে চাষ ঘরের মেঝে অথবা তাকে সারি করে স্থাপন করতে হবে।

 

৫। প্যাকেট বা স্পন তাকে স্থাপন :

চাষ ঘরের মেঝে বা তাকের ওপর প্যাকেট থেকে প্যাকেটের দূরত্ব ২ ইঞ্চি এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ২ ইঞ্চি বজায় রাখলে ভালো ফলন হয়। প্যাকেটের চারিদিকে ৭০—৮০% আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য গরমের সময় দিনে ৪/৫ বার, শীতে ও বর্ষায় দিনে ২/৩ বার পানি ে¯প্র করা যেতে পারে যাতে প্যাকেট ও এর চারপাশে আর্দ্র অবস্থা বিরাজ করে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন প্যাকেটের কাটা জায়গার মাশরুম অঙ্কুরের ওপর ফেঁাটার আঘাতে অঙ্কুর ভেঙ্গে না যায় এবং পানি জমে না থাকে। পানি ে¯প্র করার সংখ্যা বা মাত্রা প্রয়োজনে কম বা বেশি হতে পারে। তবে সূর্য ওঠার আগে এবং সূর্য ডোবার পর পানি ে¯প্র করলে মাশরুমের ফলন বেড়ে যায়।

 

৬। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ :

সুতি কাপড় বা খবরের কাগজ ভিজিয়ে প্যাকেটের ওপরে একটু উঁচু করে রেখে চাষ ঘরের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। প্রয়োজনে ে¯প্র মেশিন দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি ে¯প্র করে চাষ ঘরের দেয়াল ও মেঝে কয়েকবার ভিজিয়ে দিয়ে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কাঙ্খিত মাত্রায় বজায় রাখা যায়।

 

৭। অন্যান্য পরিচর্যা :

মাশরুম একটি স্পর্শকাতর সবজি হওয়ায় চাষ ঘরের ভিতর ও বাহিরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্যাকেটে একসাথে অনেকগুলো অঙ্কুর দেখা গেলে সমআকারের স্বাস্থ্যবান মাশরুম পাওয়ার জন্য ছোট অঙ্কুরগুলো ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলতে হবে এবং প্রতি কাঁধ বা পাশের থোকায় ৮ থেকে ১২টি ফ্রুটিং বডি রাখতে হবে।

৮। মাশরুম সংগ্রহ :

প্রথমবার মাশরুম তোলার পর পাকেটকে ১ দিন বিশ্রাম অবস্থায় রাখতে হয়। পরের দিন পূর্বের কাটা অংশ পুনরায় চেছে ফেলে আগের মতো পানি ে¯প্র করতে হয়। একটি প্যাকেট থেকে ৫/৬ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যায়, তবে বাণিজ্যিকভাবে ২/৩ বারের বেশি সংগ্রহ করা উচিত নয়।

 

৯। মাশরুম সংরক্ষণ :

কাঁচা মাশরুমে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় সংরক্ষণকাল খুবই কম হয়। মাশরুম সংগ্রহ করার পরপরই এর রং এবং গঠনের দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। এজন্য সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে রং ও গঠন ঠিক রেখে বেশি দিন ব্যবহার করা সম্ভব হয়। কিছু নিয়ম মেনে চললে মাশরুম ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়। যেমন— পরিপক্ক অবস্থা বা সঠিক সময়ে মাশরুম সংগ্রহ করা, পরিস্কার—পরিচ্ছন্ন রাখা, ঠান্ডা ও বায়ুরোধী অবস্থায় সংরক্ষণ করা ইত্যাদি। মাশরুমকে তাজা ও শুকনো উভয় অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়। এ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :

 

(ক) তাজা মাশরুম সংরক্ষণ :

মাশরুম তোলার ১২ ঘন্টা আগ পর্যন্ত পানি ে¯প্র না করে তুললে তা ব্যাগে সিলিং করে ঘরের ঠান্ডা জায়গায় রেখে ২—৩ দিন পর্যন্ত খাওয়া যায়। এছাড়াও রেফ্রিজারেটরে ১০০ সে. তাপমাত্রায় নরমাল চেম্বারে সিলিং অবস্থায় ৭—৮ দিন রেখে খাওয়া যায়। তাছাড়া ব্লানচিং করে লবণ দ্রবণে ৫—৬ মাস রেখে মাশরুম খাওয়া যায়। ব্লানচিং করার নিয়ম হলো— শতকরা ২ ভাগ লবণযুক্ত ফুটন্ত পানিতে ২—৫ মিনিট মাশরুম সিদ্ধ করে পরিস্কার ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিয়ে তা ২% লবণ ও ১% সাইট্রিক এসিড মিশ্রিত দ্রবণে বায়ুরোধী করে সংরক্ষণ করা।

 

(খ) শুকনো মাশরুম সংরক্ষণ :

মাশরুম শুকানোর পর তা বায়ুরোধী প্যাকেটে ৫—৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এছাড়াও শুকানো মাশরুম ব্লেন্ডার মেশিন দিয়ে গুড়ো বা পাউডার করে বায়ুরোধী প্যাকেটে ৫—৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়। ভক্ষণযোগ্য মাশরুম বিভিন্ন পদ্ধতিতে আবাদ বা চাষ করা যায়। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে খড়দিয়ে এবং শীতকালে কম্পোস্ট দিয়ে যথাক্রম স্ট্র মাশরুম ও ওয়েস্টার মাশরুম চাষ করা হয়। নিচে স্ট্র মাশরুম ও ওয়েস্টার মাশরুম এর চাষ পদ্ধতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

 

স্ট্র মাশরুম চাষ পদ্ধতি প্রয়োজনীয় উপকরণ :

মাশরুম বীজ বা স্পন ধানের খড় ৬০ সে.মি.  ৪০ সে.মি. সাইেজের পাতলা পলিথিন ব্যাগথার্মোমিটার হাইগ্রোমিটার হ্যান্ড ে¯প্রয়ার ব্লেড বা চাকু জীবাণুনাশক বালতি কড়াই ছিদ্রমুক্ত কালো পলিথিন শীট ছিকা চাষ প্রক্রিয়া : এক কেজি ধানের খড় ২—৩ ইঞ্চি আকারে কেটে নিয়ে একটি বেড প্রস্তুত করা যায়। কাটা খড় বালতিতে পরিস্কার পানি নিয়ে তাতে ১২ ঘন্টা ডুবিয়ে রাখতে হয়। এরপর একটি বড় কড়াইয়ে প্রায় ৮৫০ সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে বালতির খড়গুলো ৩০ মিনিট ধরে সিদ্ধ করতে হয়।

 

 

এতে খড়ের মধ্যে থাকা জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। সিদ্ধ করা খড় কড়াই থেকে তুলে চাটাই বা পাকা মেঝের ওপর রেখে ঠান্ডা করতে হবে ও পানি ঝড়াতে হবে, কিন্তু শুকানো যাবে না। নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো মানের মাশরুম বীজ সংগ্রহ করে প্যাকেট থেকে বীজ বা স্পন বের করে এমনভাবে ছোট ছোট টুকরোয় ভাঙ্গতে হবে যাতে বীজযুক্ত প্রতিটি দানা পৃথক হয়ে যায়। প্রতি বেডের জন্য ১০০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। এখন ৪০—৫০ টি ছিদ্রযুক্ত একটি পলিথিন ব্যাগে পানি ঝড়ানো সিদ্ধ করা খড় ঢুকাতে হবে।

বায়ু চলাচলের সুবিধার্থে পলিথিন ব্যাগে ছিদ্র করা হয়। প্রথমে পলিথিন ব্যাগের ভিতর ৪—৫ ইঞ্চি উঁচু করে খড়ের স্তর দিয়ে তার ওপর ২৫ গ্রাম মাশরুম বীজ সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর এই ছড়ানো মাশরুম বীজের ওপর আবার ৪—৫ ইঞ্চি উঁচু করে খড়ের ¯র বিছিÍ য়ে পুনরায় ২৫ গ্রাম মাশরুম বীজ সমভাবে ছড়াতে হবে। এভাবে খড়ের ৪টি স্তরের ওপর ৪ বার মাশরুম বীজ ছড়ানোর পর পঞ্চমবার একইভাবে খড় বিছিয়ে পলিথিন ব্যাগের মুখ বেঁধে দিলেই একটি উপযুক্ত বেড প্রস্তুত হয়ে যাবে।

চাষঘরের তাপমাত্রা ২৫—৩০০ সে. এবং আর্দ্রতা ৮০—৯০% রাখা উচিত। পলিথিন শীট দিয়ে ঢেকে তাপ বাড়ানো যায়, আবার খুলে দিয়ে তাপ কমানো যায়। প্রস্তুতকৃত বেড চাষঘরের মাচার ওপর ১৪ দিন অন্ধকারে রেখে দিলে বীজ গজাবে এবং খড়ের চারিদিকে মাইসেলিয়াম দেখা যাবে। এ অবস্থাকে বীজ রানিং বলা হয়। এরপর অন্ধকার থেকে সরিয়ে নিয়ে পলিথিন ব্যাগ থেকে খড়ের বেড বের করে চাষ ঘরে মাচায় বা ছিকায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সাবধানে বেড বের করলে ঐ পলিথিন পুনরায় ব্যবহার করা যায়। পলিথিন বেড থেকে বেড বের করার ৭—১০ দিন পরই মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। এরকম বেড থেকে মোট ৩ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। এ ধরনের বেডে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে হ্যান্ড ে¯প্রয়ার দিয়ে পানি ে¯প্র করতে হয়।

বেডকে পোকামাকড় ও অন্যান্য আপদের হাত থেকে রক্ষা করতে হয়। উল্লেখ্য ১ কেজি ওজনের শুকনো খড়ের বেড থেকে ৬০০—৮০০ গ্রাম মাশরুম উৎপাদন সম্ভব। ওয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতি প্রয়োজনীয় উপকরণ : মাশরুম বীজ বা স্পন (রর) কম্পোস্ট তৈরির জন্য কাঠের গুঁড়া ও ধানের কুড়া প্লাষ্টিক গামলা অটোক্লেভ মোম লাগানো কাগজ ও তুলা চোষ কাগজ/চট তাক একটি সরু কাঠি পলিথিন ব্যাগ হ্যান্ড ে¯প্রয়ার।

 

চাষ প্রক্রিয়া :

একটি বড় প্লাস্টিকের গামলায় ৩/৪ ভাগ শুকনো কাঠের গুঁড়া, ১/৪ ভাগ ধানের কুড়া ও পরিষ্কার পানি নিয়ে এমনভাবে মিশাতে হবে যেন মিশ্রণে চাপ দিলে ২/১ ফোটা পানি ঝরে। পরিস্কার পলিথিন ব্যাগে এই ভিজানো গুড়ার ৫০০ গ্রাম ভরতে হবে। একটি সরু কাঠি দিয়ে পলিথিন ব্যাগের ভিতর মাঝখান থেকে তলার দিকে চাপ দিয়ে একটি গর্ত করতে হবে। ব্যাগের মুখ মোমযুক্ত কাগজ ও তুলা দিয়ে বন্ধ করতে হবে। এরপর অটোক্লেভ দ্বারা ১০০০ সে. তাপে ৩০—৪০ মিনিট ব্যাগগুলো শোধন করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

অটোক্লেভ থেকে ব্যাগ সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করার জন্য ২৪ ঘন্টা রেখে দিতে হবে। তারপর ব্যাগের ভিতর মাঝখানের ছিদ্র দিয়ে মাশরুম বীজ ঢুকিয়ে ব্যাগগুলো সঁ্যাতসঁ্যাতে ও অন্ধকার ঘরে ২০—২৫০ সে. তাপমাত্রায় তাকের ওপর ২০ দিন রাখতে হয়। এতে সাদা মাইসেলিয়াম দিয়ে ব্যাগ ভরে যাবে। এই অবস্থায় ব্যাগগুলোর কাঁধ বরাবর উল্টো উ আকৃতিতে কেটে নিতে হবে এবং প্রতিদিন ৪—৫ বার করে পানি ে¯প্র করতে হবে। এ সময় ঘরে আলো বাতাস থাকা জরুরী। এমতাবস্থায় ১০—১৫ দিনের মধ্যেই মাশরুম গজাবে। উপরের অংশ ছাই রঙের হলে মাশরুম সংগ্রহ করতে হয়। একটি ব্যাগ থেকে ৬—৭ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যায়।

 

মাশরুমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব :

১। মাশরুম সুস্বাদু ও পুষ্টিকার সবজি বিধায় নিয়মিত খেয়ে পুষ্টিহীনতা দূর করা যায়।

২। বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।

৩। মাশরুমে ভেষজ গুণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।

৪। আবাদী জমির প্রয়োজন হয় না। ফলে ভূমিহীন কৃষক তাকে তাকে সাজিয়ে একটি ঘরকে কয়েকটি ঘরের সমান ব্যবহার করতে পারে। অর্থাৎ মাশরুম চাষ স¤প্রসারণের মাধ্যমে এক একর জমির উৎপাদনকে বাড়িয়ে প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি করতে পারে।

৫। বাড়তি আয়ের উৎস। অন্য যে কোনো পেশার পাশাপাশি এটা চাষ করে একদিকে যেমন পরিবারের চাহিদা মেটানো যায়, অন্যদিকে বাড়তি আয়ও করা সম্ভব হয়।

৬। অল্প পুঁজি ও শ্রমের মাধ্যমে এটা চাষ করা যায়।

৭। মাশরুম চাষে বিনিয়োগকৃত অর্থ অতি দ্রুত তুলে আনা সম্ভব।

৮। চাষে সার ও বালাইনাশক ব্যবহৃত হয় না বলে মাশরুম স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব হয়।

৯। মাশরুম চাষে ব্যবহৃত প্যাকেট সর্বশেষে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

১০। এক কেজি মাশরুম উৎপাদন করতে ৪০ টাকা খরচ হয় অথচ ২০০ টাকা বিক্রি করা যায়। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ১৬০ টাকা লাভ হয়।

১১। এক হিসেবে দেখা গেছে যে, প্রতি হেক্টরে গরুর মাংস ও মাছ উৎপাদিত হয় যথাক্রমে ৭৮ কেজি ও ৬৭৫ কেজি। অথচ মাশরুম উৎপাদিত হয় ৬৫০০০ কেজি।

১২। চাষ শুরুর অল্প দিনের মধ্যে মাশরুম সংগ্রহ করা যায়, অথচ অন্য কোন ফসলে তা সম্ভব নয়।

১৩। মাশরুম চাষের মাধ্যমে দুঃস্থ মহিলা ও বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। ফলে সমাজ থেকে দারিদ্র্যতা দূর হবে।

১৪। সারা বছর মাশরুম চাষ করা যায়।

 

রেশম চাষ

রেশম চাষ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি ” বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি” বিষয়ের, ৫ নং ইউনিটের ৫.৪ নং পাঠ।

রেশম চাষ

রেশম পোকার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে ইড়সনুী সড়ৎর রেশম চাষে বেশি ব্যবহার করা হয়। এ পোকা তুঁত গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে বিধায় রেশম চাষীকে তুঁত গাছ চাষ করতে হয়। রেশম চাষ এর ইংরেজি হলো Sericulture। ল্যাটিন শব্দ ‘Serio’ থেকে Sericulture শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

রেশম পোকার খাদ্যের জন্য তুঁত গাছ চাষ করে এই পোকার লার্ভা পালন করে তাদের সৃষ্ট গুটি বা কোকুন থেকে রেশম সুতা আহরণ করার পদ্ধতিকে রেশম চাষ বলা হয়। তুঁত গাছ চাষ ও রেশম পোকার লার্ভা পালন ছাড়াও এ পোকার বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে অধিক উৎপাদনশীল রেশম পোকা উদ্ভাবন করা আধুনিক রেশম চাষের অন্তভুর্ক্ত। আমাদের দেশের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু রেশম চাষের জন্য বেশ উপযোগী।

 

রেশম চাষের ধাপসমূহ :

১। তুঁত গাছ:

চাষ বন্যামুক্ত ও সুনিষ্কাশিত দোঅঁাশ ও বেলে দোঅঁাশ মাটি তুঁত গাছ চাষ করার জন্য উত্তম। বাড়ির চারিদিকে, পুকুর পাড়ে, রাস্তা ও রেললাইনের পাশে এবং পতিত জমিতে তুঁত গাছ চাষ করা হয়। এস ১, এসভি ৫, সি ৭৭৬, এস ৭৯৯ ইত্যাদি জাতের তুঁত গাছের চারা রোপণ করা যেতে পারে। কারণ উন্নত জাতের চারা থেকে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বীজ, শাখা কলম, দাবা কলম, গুটি কলম ও কঁুড়ি সংযোজনের মাধ্যমে তুত গাছের বংশবিস্তার করা যায়।

তবে বাংলাদেশে শাখা কলমের মাধ্যমে তৈরি চারাই বেশি ব্যবহৃত হয়। আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে ও আগাছা পরিষ্কার করে জমি তৈরি করতে হয়। এক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় প্রতি বিঘা জমিতে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ কেজি ইউরিয়া, ৩০ কেজি টিএসপি ও ১৫ কেজি এমপি সার শেষ চাষের সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। তবে পুকুর পাড়, রাস্তা ও রেল লাইনের পাশে গর্ত পদ্ধতিতে লাগানোর বেলায় সারগুলোকে একত্রে মিশিয়ে পরিমাণমত প্রতিটি গর্তের মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়।

সাধারণত সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬—৬.৫ ফুট এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩—৪ ফুট রাখতে হয়। তুঁত গাছ লাগানোর আসল উদ্দেশ্যই হলো পাতা সংগ্রহ। ভালো জাতের তুঁত গাছ থেকে অধিক পাতা সংগ্রহ করা যায়। রেশম পোকার লার্ভা তুঁত গাছের কচি বা নতুন পাতা খেয়ে বড় হতে থাকে। একবার লাগালে তুঁত গাছ ২০—২৪ বছর পর্যন্ত পাতা দিতে থাকে।

নিয়মিত ডাল ছাঁটাই করা হলে নতুন ডাল ও পাতা গজায়। ধারালো দা বা চাকু দিয়ে পুরনো ডালের এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক অংশ কেটে ফেলতে হয়। সাধারণত চারা লাগানোর এক বছর পর বর্ষার শেষে তুঁত গাছের ডালপালা প্রথম ছাঁটাই করতে হয়। দুই থেকে আড়াই বছর পর নিয়মিতভাবে রেশম লার্ভার জন্য নতুন পাতা সংগ্রহ করা যায়। তুঁত গাছের গোড়ায় প্রতি বছর অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হয়। বৃষ্টি না হলে মাঝে মাঝে সেচ দিতে হয়। আবার কোনো কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা নিতে হয়। আগাছা বেশি হলে তা দমন করতে হয়।

তুঁত গাছে পোকা ও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পোকার মধ্যে উইপোকা, বিছাপোকা, লিফ হপার এবং রোগের মধ্যে লিফ স্পট, পাউডার মিলডিউ, মরিচা রোগ, শিকড় পচা রোগ ও নেমাটোড রোগ দেখা যায়। উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে এসব পোকা ও রোগ দমনের ব্যবস্থা নিতে হয়।

২। তুঁত পাতা সংগ্রহ

সকালে অথবা বিকালে তুঁত গাছের পাতা সংগ্রহ করতে হয়। সকালে এমন সময় পাতা সংগ্রহ করতে হয় যেন ভেজা না থাকে। প্রখর রৌদ্রের সময় পাতা সংগ্রহ করা উচিত নয়। নতুন বা কচি পাতা তোলার পর তা পলিথিন ব্যাগে রেখে ঠান্ডা স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। প্রয়োজনে পলিথিন ব্যাগে ভেজা স্পঞ্জ ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাগের ভিতর যাতে তাপ সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চব্বিশ ঘন্টায় লার্ভাকে বর্ষা মৌসুমে ৩ বার এবং শুষ্ক মৌসুমে ৫ বার পর্যন্ত খাবার দিতে হয়। লার্ভার বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়।

 

৩। রেশম পোকার লার্ভা বা পলু বা শুককীট:

রেশম পোকার লার্ভা বা পলু বা শুককীট সংগ্রহ সাধারণত রেশম বীজাগার থেকে রেশম পোকার লার্ভা সংগ্রহ করতে হয়। ৪—৫ দিন বয়সী সুস্থ ও স্বাভাবিক লার্ভা চাষিদের মধ্যে বিতরণ বা সরবরাহ করা হয়। সকালে বা বিকেলে অথবা দিনের যে কোনো ঠান্ডা সময় হার্ডবোর্ডের তৈরি ছিদ্রযুক্ত বাক্স বা নেটের বাক্সে লার্ভা পরিবহণ করতে হয়। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকলে বাক্সের চারিদিকে ভেজা কাপড় বা ন্যাকড়া জড়িয়ে লার্ভা পরিবহণ করা আবশ্যক।

এছাড়াও রেশম পোকার কোকুন বা গুটি সংগ্রহ করেও লার্ভা পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে রেশম পোকার কোকুন বা গুটি সাধারণ তাপমাত্রায় রেখে দিলে ১০—১২ দিন পর গুটি কেটে প্রতিটি কোকুন থেকে পুরুষ বা স্ত্রী মথ বের হয়ে আসবে। বের হবার পর পুরুষ ও স্ত্রী মথ যৌন সঙ্গমে মিলিত হবে। মিলনের ঘন্টা তিনেক পর পুরুষ মথটিকে সঙ্গমরত অবস্থা থেকে আলাদা করে নিতে হবে এবং স্ত্রী মথটিকে একটি কৌটার ভিতরে সাদা কাগজের ওপর রেখে তা ঢেকে দিতে হবে। স্ত্রী মথটি এ অবস্থায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাদা কাগজের ওপর ৩৫০০—৫০০০ টি পর্যন্ত ডিম পাড়বে।

এবার কৌটার ভিতরকার ডিম সম্বলিত সাদা কাগজ বের করে তা ডালাতে রাখতে হবে এবং অন্য একটি ডালা দিয়ে তা ঢেকে রাখতে হবে। ডিমের ঘরে ২৫০ সে. তাপমাত্রা ও ৭৫—৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা থাকা উত্তম। বর্ণিত অবস্থায় রেখে দিলে ৮—৯ দিনের মাথায় ডিমে কালো ছিট দাগ পড়বে এবং ৯—১০ দিনের মাথায় পুরো ডিম কালো রং ধারণ করবে। এ ডিমগুলো শোধন করার জন্য ২% ফরমালিন দ্রবণের মধ্যে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পানি দ্বারা ধুঁয়ে নিতে হয়। ডিম ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূলে থাকলে ২৪ দিনের মধ্যেই ৯০—৯৫ ভাগ ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়ে আসবে।

 

৪। রেশম পোকার লার্ভা পালন:

নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করে রেশম পোকার লার্ভা পালন করা যায়।

(ক) লার্ভা ঘর তৈরি :

মুক্ত আলো বাতাসযুক্ত উঁচু স্থানে লার্ভা ঘর তৈরি করতে হয়। এ ঘরের ক্ষেত্রফল ২২ ফুট  ১৬ ফুট হলে ভালো হয়। ঘরের দেয়াল মাটির ও ছাউনি খড়ের হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। বায়ু চলাচল নিশ্চিত করার জন্য ঘরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দরজা ও জানালা রাখতে হয়। মাছি যাতে রেশম পোকার লার্ভাকে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য দরজা ও জানালায় তার জাল বা বাঁশের চিক লাগাতে হয়। লার্ভা ঘর যাতে সঁ্যাতস্যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

(খ) লার্ভা পালনে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি :

লার্ভার ছোট অবস্থায় বাঁশের ছোট ডালা, বড় অবস্থায় বাঁশের বড় ডালা, ডালা রাখার জন্য কাঠ বা বাঁশের তাক, লার্ভার বেড বা ডালা পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত ছোট লার্ভার জন্য ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট জাল ও বড় লার্ভার জন্য বড় ছিদ্রবিশিষ্ট জাল, তাকের পায়ায় দেয়ার জন্য আলকাতরা বা পানির বাটি, তুঁত পাতা কাটার জন্য চাকু বা ছুরি, লার্ভার গা থেকে ছোপ পোকা ঝাড়ার জন্য পাখির পালক, গুটি করার জন্য বাঁশের চন্দ্রকী, ঘরের আর্দ্রতা বাড়ানোর স্পঞ্জ, শীতে ঘর গরম করার জন্য হিটার বা চুলা, ঘরের তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মোমিটার, আপেক্ষিক আর্দ্রতা মাপার জন্য আর্দ্রতা মাপক যন্ত্র, শোধন করার জন্য ফরমালিন, চুন ইত্যাদি সরঞ্জামাদি ব্যবহৃত হয়।

 

(গ) লার্ভা ঘর ও সরঞ্জামাদি শোধন :

রেশম পোকার লার্ভা পালন শুরুর ২—৩ দিন আগেই যে সব জিনিসপত্র ব্যবহৃত হবে তাসহ লার্ভা ঘর শোধন করে নিতে হয়। ঘরের মেঝেসহ সকল সরঞ্জামাদি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে কড়া রোদে শুকিয়ে নেওয়া উত্তম। এরপর ফরমালিন অনুমোদিত মাত্রা অনুযায়ী পানির সঙ্গে মিশিয়ে ে¯প্র মেশিন দিয়ে মেঝেসহ ঘরের ভিতর সব স্থানে ও সরঞ্জামাদির ওপর ে¯প্র করতে হয়। ে¯প্র করার পর উক্ত ঘর ২৪ ঘন্টা বায়ুরোধী করে বন্ধ রাখতে হয়।

 

(ঘ) লার্ভার পরিচর্যা :

রোগমুক্ত ও ভালো মানের লার্ভা সংগ্রহ করে রেশম চাষ শুরু করতে হয়। লার্ভা দেখতে পশমবিহীন ছাইয়া—ধূসর বা ক্রীম বর্ণের। লার্ভা প্রায় ৭—৯ সে.মি. লম্বা হয়। রেশম বা গুটি পোকার অনেকগুলো রেস (ৎধপব) আছে। বছরে একবার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে একচক্রী (ঁহরাড়ষঃরহব), বছরে দু’বার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে দ্বিচক্রী (নরাড়ষঃরহব) এবং বছরে বহুবার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে বহুচক্রী (সঁষঃরাড়ষঃরহব) রেস বলা হয়। আমাদের দেশে বহুচক্রী রেস চাষ হয়। পালনের সময় ডালাতে লার্ভার ছোট অবস্থায় তুঁত পাতা কেটে টুকরো করে দিতে হয় এবং লার্ভার বড় অবস্থায় আস্ত পাতা দিলেও কোনো সমসা হয় না। পালনের সময় লার্ভার পায়খানা ও পাতার অবশিষ্টাংশ ডালা অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা করে ফেলে।

এজন্য লার্ভার ছোট অবস্থায় ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট জালের ওপর টুকরো টুকরো তুঁত পাতা দিয়ে ঐ জালটি ডালার ওপর বিছিয়ে দিলে লার্ভাগুলো জালের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে জালের ওপর খাবার খাওয়ার জন্য চলে আসবে। এমতাবস্থায় লার্ভাসহ ঐ জালটি অন্য ডালায় রেখে নোংরা ডালাটি পরিস্কার করা সম্ভব হয়। এমনিভাবে বড় ছিদ্রবিশিষ্ট জাল দিয়েও বড় লার্ভাগুলো স্থানান্তর করে নোংরা ডালা পরিষ্কার করা যায়। লার্ভাগুলো এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার সময় দেহের খোলস বদলায়। এই খোলস বদলানোকে মোল্টিং (সড়ঁষঃরহম) বলা হয়।

খোলস বদলানোর সময় লার্ভাগুলো খাওয়া—দাওয়া বন্ধ করে দেয় ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। এই লার্ভাগুলোতে পাঁচটি ইনস্টার (রহংঃধৎ) পরিলক্ষিত হয়। ডিম থেকে বের হবার পর থেকে ১ম খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ১ম ইনস্টার, ১ম খোলস বদলানোর পর থেকে ২য় খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ২য় ইনস্টার, ২য় খোলস বদলানোর পর থেকে ৩য় খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ৩য় ইনস্টার, ৩য় খোলস বদলানোর পর থেকে ৪র্থ খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ৪র্থ ইনস্টার এবং ৪র্থ খোলস বদলানোর পর থেকে পিউপা বা পুত্তলী বা গুটি বা কোকুন তৈরির আগ পর্যন্ত সময়কে ৫ম ইনস্টার বলা হয়।

রেশম পোকা সাধারণত ২২—২৩ দিন লার্ভা অবস্থায় থাকে। ১ম ইনস্টারে ৩ দিন ও ১ম খোলস বদলাতে ২০ ঘন্টা সময় লাগে। ২য় ইনস্টারে ২ দিন ও ২য় খোলস বদলাতে ২০ ঘন্টা সময় লাগে। ৩য় ইনস্টারে ৩ দিন ও ৩য় খোলস বদলাতে ১ দিন সময় লাগে। ৪র্থ ইনস্টারে ৪ দিন ও ৪র্থ খোলস বদলাতে ১ দিন সময় লাগে। ৪র্থবার খোলস বদলানোর পর কোকুন বা গুটি তৈরির পূর্বে ৬—৭ দিন লার্ভা অবস্থায় থাকে। লার্ভার ১ম তকে ৩য় ইনস্টার পর্যন্ত ঘরের তাপমাত্রা ২৭০ সে. ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০—৮৫% রাখতে হয়।

আবার ৪র্থ ইনস্টার থেকে গুটি তৈরির আগ পর্যন্ত সময়ে ২৫—২৬০ সে. তাপমাত্রা ও ৭০—৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা রাখা বাঞ্চনীয়। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ বা খোলা রেখে এবং ডালার চার পাশে পানিতে ভেজানো স্পঞ্জ রেখে ঘরের তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা বাড়ানো বা কমানো যেতে পারে।

 

(ঙ) রেশম পোকার রোগ, পোকা, মাকড় ও কমি দমনৃ :

বিভিন্ন রোগ রয়েছে, যেমন— পেব্রিন রোগ, ফ্লাচারি রোগ, জন্ডিস রোগ, প্যাটিন রোগ, মাসকারডাইন রোগ ইত্যাদি। এছাড়া উজি মাছি, ডার্মাস্টিক বিটল, মাকড়, কৃমি ইত্যাদিও রেশম পোকার শত্রু। তবে এগুলোর মধ্যে প্রধান শত্রু হলো উজি মাছি। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী উজি মাছি লার্ভার গায়ে ডিম পাড়ে। ১—২ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে ম্যাগট বের হয়। এই ম্যাগটগুলো লার্ভার দেহের ভিতরে ঢুকে পেশিকলা খেয়ে ফেলে। ফলে লার্ভা মারা যায়। এভাবে একটি উজিমাছি প্রায় ২০০—৩০০ টি রেশম লার্ভা মেরে ফেলতে পারে। অনুমোদিত মাত্রায় ঔষধ ব্যবহার করে বা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ সমস্ত রোগ, পোকা, মাকড় ও কৃমি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

 

৫। রেশম গুটি সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ :

রেশম গুটি সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পঞ্চম ইনস্টার শেষ হবার পর লার্ভা যখন চুপচাপ ও নিস্তেজ হয়ে পড়বে, তখন ঐ লার্ভাগুলোকে বাঁশের চন্দ্রকীতে স্থানান্তর করতে হয়। ৬ ফুট লম্বা ও ৪ ফুট প্রস্থের একটি চন্দ্রকীতে প্রায় এক হাজার লার্ভা রাখা যায়। চন্দ্রকীতে রাখার পর এক পর্যায়ে লার্ভার মুখ থেকে তরল রেশমের ফোটা নিঃসৃত হয় যা সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে চন্দ্রকীতে আটকে যায়। শেষ পর্যায়ে লার্ভা নিজ দেহের চারিদিকে একটি আবরণ তৈরি করে যাকে কোকুন বা গুটি বলা হয়। চন্দ্রকীতে লার্ভা দেয়ার পর ঐ চন্দ্রকী লার্ভা ঘরের বাইরে বারান্দায় হেলানো অবস্থায় রাখতে হয়।

এতে করে রেশম গুটির গুণগত মান ভালো হয়। লার্ভা ঘরে চন্দ্রকী রাখা উচিত নয়। কারণ ঘরের অবশিষ্ট লার্ভার ক্ষতি হয়। ২৩—২৪০ সে. তাপমাত্রা ও ৭০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ভালো ও উন্নতমানের রেশম গুটি পাওয়া যায়।

রেশম পোকার লার্ভা রেশম গ্রন্থি থেকে যে লালা নিঃসরণ করে তা থেকে রেশম তৈরি হয়। রেশম গ্রন্থি দেহের দু’পাশে অবস্থিত দুটো লম্বা ও পুরু প্রাচীরের থলে দ্বারা গঠিত যাদের সাধারণ একটি ছিদ্রপথে রেশম লালা নিঃসৃত হয়। রেশম পোকার লার্ভা যখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় তখন থলে দু‘টো আঠালো তরল পদার্থে পূর্ণ হয়ে যায়। আর এই আঠালো তরল পদার্থ যখন বাইরে বেরিয়ে আসে তখন বাতাসের সংস্পর্শে তা শক্ত হয়ে গুটি বা কোকুনে পরিণত হয়। গুটি করা শেষ হলে লার্ভা পিউপায় বা মুককীটে রূপান্তরিত হয়।

পিউপায় রূপান্তরিত হবার ২/১ দিনের মধ্যেই চামড়া শক্ত হয়ে বাদামি রং ধারণ করে। পিউপার চামড়া শক্ত হবার পর চন্দ্রকী থেকে রেশম গুটি ছাড়াতে হয়। রেশম গুটি ছাড়ানোর আগে চন্দ্রকী ১ দিন রোদে ও বাতাসে রেখে দিলে ভালো হয়। এতে করে গুটির শেল শক্ত হয় এবং নষ্ট কম হয়। গুটি ছাড়ানোর পর তা পরিষ্কার করে সুতা তৈরি বা রিলিং  এর জন্য বিক্রি করা হয়।

৬। সুতা তৈরি:

রেশম গুটির ভিতরে পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ রেশম মথ বের হলে মথটি গুটির একদিকে কেটে বের হয়ে আসে। ফলে গুটির লম্বা সুতাটি অসংখ্য টুকরোয় পরিণত হয় এবং ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এজন্য গুটির অক্ষত লম্বা সুতাটি পাওয়ার জন্য পূর্ণাঙ্গ রেশম মথ বের হবার আগেই গুটিগুলো ৯০—৯৫০ সে. তাপমাত্রার প্রায় ফুটন্ত পানিতে ৩—৪ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হয়। এর ফলে গুটির ভিতরের পিউপা বা মুককীট মারা যায় এবং গুটিতে রেশম সুতার সাথে লেগে থাকা আঠালো পদার্থ গলে যায়।

এতে সুতা রিলে জড়ানোর উপযোগী হয়। এরপর গুটির মুখের সুতার প্রান্ত সুতা কাটা চরকি বা রিলের সাথে আটকিয়ে নিয়ে চরকির ঘূর্ণন অব্যাহত রাখলে গুটি থেকে সুতা মুক্ত হয়ে চরকি বা রিলের সাথে পেচাতে থাকে। চরকি বা রিলের মাধ্যমে গুটি থেকে সুতা উত্তোলনের এই পদ্ধতিকে রিলিং  বলে।

চরকি বা রিলের মাধ্যমে উৎপাদিত এ সুতাকে কাঁচা রেশম বলা হয়। পরবর্তীতে এ কাঁচা রেশমকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রসেস করে রেশম বস্ত্র বয়ন করা হয়। পূর্ণতার শেষ পর্যায়ে এসে একটি রেশম লার্ভা প্রতি মিনিটে প্রায় ছয় ইঞ্চি সুতা তৈরি করতে পারে এবং সম্পূর্ণ গুটি বা কোকুন তৈরি করতে ৩ দিন সময় নেয়। একটি রেশম গুটি থেকে প্রায় ১০০০—৩০০০ ফুট সুতা পাওয়া যায় এবং ১ পাউন্ড রেশম সুতা পেতে প্রায় ২৫ হাজার গুটির প্রয়োজন হয়।

 

রেশম পোকার জীবনচক্র:

রেশম পোকার জীবনে চারটি দশা বা ধাপ রয়েছে, যথা— ১। ডিম ২। লার্ভা বা শুককীট ৩। পিউপা বা মুককীট ও ৪। পূর্ণাঙ্গ মথ। এগুলো সম্পর্কে পূর্বে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

 

রেশমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:

রেশমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১। রেশম পোকা থেকে রেশমি সুতা পাওয়া যায়। এই রেশমি সুতা দ্বারা উন্নতমানের অতি মূল্যবান ও আরামদায়ক রেশমি কাপড় তৈরি হয়।

২। রেশম কাপড়ের দেশে ও বিদেশে যেমন চাহিদা রয়েছে তেমনি এর দামও বেশি।

৩। রেশম কাপড় বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।

৪। জাতীয় আয় বৃদ্ধিসহ গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৫। রেশম বস্ত্র কোমল ও নমনীয়। এই বস্ত্রে শতকরা ১১ ভাগ আর্দ্রতা বিদ্যমান থাকে। ফলে শীত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত সব ঋতুতেই এ কাপড় পরিধান করা আরামদায়ক হয়।

৬। অল্প মূলধন ও কম জায়গা কাজে লাগিয়ে রেশম চাষ করে অধিক অর্থ উপার্জন করা যায়। এত কম মূলধন ও জায়গা দিয়ে অন্য কোন ফসল চাষ বা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড করা সম্ভব হয় না।

৭। আত্মকর্মসংস্থান তথা বেকারত্ব দূরীকরণের একটি সহজ উপায়। রেশম চাষ করলে পরিবারের বেকার সব লোকের কর্মসংস্থান হয়। এতে পরিবার তথা সমাজের ওপর একটা পজিটিভ প্রভাব পড়ে।

৮। রেশম চাষে ঝঁুকি কম। অর্থাৎ প্রাকৃতিক দূর্যোগ, দাম কম হওয়া বা অন্য কোনো কারণে আর্থিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

৯। অধিক কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না বিধায় যে কেউ রেশম চাষ করে রেশম সুতা উৎপাদন করতে পারে।

১০। রেশম চাষে রেশম সুতার উৎপাদন খরচ কম, কিন্তু লাভ বেশি হয়।

১১। রেশম গুটি সিদ্ধ করে সুতা বা তন্তু ছাড়িয়ে নেয়ার পর মৃত পিউপা বা মুককীট হাঁস—মুরগি ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

১২। রেশম গুটি থেকে সুতা আহরণের পর উচ্ছিষ্ট ছোবড়া থেকে সার্টিন তৈরি করা যায়। এছাড়াও কোর্সি কাটা দ্বারা বিশেষ বুনন প্রক্রিয়ায় গুটি থেকে কাপড় তৈরি করা হয়। বয়নকালের বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার করে কার্পেট তৈরি করা যায়।

১৩। রেশম চাষে একই জমির তুঁত গাছ থেকে বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময় ৪—৫ বার তুঁত পাতা (তুঁত ফসল) পাওয়া যায় এবং তুঁত গাছ ২০—২৪ বছর বাঁচে বলে এক নাগাড়ে রেশম চাষ করে অনেক অর্থ উপার্জন করা যায়।

১৪। বাড়ির চারিদিকে, পুকুর পাড়ে, রাস্তা ও রেললাইনের পাশে এবং অনাবাদী ও পতিত জমিতে তুঁত গাছ আবাদ করে রেশম’ চাষ করা যায়। এতে ফসলী জমি নষ্ট হয় না।

১৫। তুঁত গাছ একবার লাগালে ২০—২৪ বছর বাঁচে বলে রেশম’ চাষে এর উৎপাদন খরচ কম হয়।

১৬। রেশম চাষের জন্য তুঁত গাছ আবাদে অধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়। এক হিসেবে দেখা গেছে যে, রেশম’ চাষের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে তুঁত বৃক্ষ আবাদ করলে বছরে ১২—১৩ জন লোকের কর্মসংস্থান হয় অথচ অন্য ফসলে বছরে ৪—৫ জন লোক হলেই চলে।

১৭। মরা তুঁত গাছ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তুঁত গাছের অতিরিক্ত পাতা গবাদি—পশুকেও খাওয়ানো যায়।

১৮। রেশম কীট থেকে আহরিত তেল সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও রেশম সুতা অপারেশনের পর সেলাই কাজে ব্যবহার করা হয়।

 

 

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ – পাঠটি বাউবির “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়র “বীজ উৎপাদন” অধ্যয়ের এর ইউনিট-৪ ,পাঠ-৪.৩। বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ বীজ শুকানো, পরিচারকরণ, বিভিন্ন আকা রে শ্রেণীবিন্যাসকরণ এবং ওষুধ প্রয়োগ করে শোধন ইত্যাদিকার্যাদির মাধ্যমে বীজকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করার পর বস্তাবন্দি করে বাজারজাতকরণ ও বিতরণ করা হয়। বীজ জমিতে পূনরায় বপন করার পূর্বে উক্ত কার্যাদি সম্পন্ন করতে হয়। বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়া কত নিপুণ ও কার্যকরভাবে করা হলো তার উপর নির্ভর করে বীজ বাজারজাতকরণ।

 

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ

 

প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি:

সদ্য মাড়াইকৃত বীজের মধ্যে খড়—কুটা, ভাংগা দানা, অন্য জাতের বীজ, আগাছা বীজ এবং পোকামাকড় থাকতে পারে। এছাড়াও বীজের মধ্যে পানি থাকে। বীজের পানির পরিমাণ ১২% বেশি হলে বীজ পোকা—মাকড় ও ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে। বীজের সাথে থেকে যাওয়া খড়—কুটা আবর্জনা, পোকামাকড় ও রোগ—জীবাণুর আবাসের ব্যবস্থা করে। এসব মিলিয়ে বীজের তাপ বেড়ে যায় এবং এভাবে কিছুদিন থাকলে বীজ জীবনশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। বীজের ভিতর থেকে খড়কুটা, আবর্জনা, অন্য বীজ, পোকামাকড় ইত্যাদি পরিষ্কার করে বেছে ফেলে বীজকে উত্তমরূপে শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে বীজ ভাল থাকবে।

ধান ও গমবীজের ক্ষেত্রে ১২% এবং অন্যান্য বীজের ক্ষেত্রে ১০% জলীয় ভাগের নিচে বীজ সংরক্ষণ করা উচিত। পরিষ্কার করা বীজ মাড়াই করার সাথে সাথে কুলা দিয়ে ঝেড়ে খড়—কুটা, ছোট দানা ইত্যাদি আলাদা করা হয়। তারপর চালুনি দিয়ে চেলে ছোট দানা, আগাছা ইত্যাদি চেলে ফেলে দেয়া হয়। প্রয়োজন হলে হাত দিয়ে বেছে বড় বড় খড়—কুটা বেছে ফেলে দেয়া হয়। বীজের মধ্যে যদি দাগ, ফ্যাকাশে রঙ বা কালচে রঙ থাকে তবে সেগুলোকেও বেছে ফেলা উচিত। বীজ পরিষ্কার করা এবং গ্রেডিং করার জন্য ইঞ্জিনচালিত বা হস্তচালিত যন্ত্র পাওয়া যায়।

বীজের আর্দ্রতা :

বীজের মধ্যে প্রধানত শুকনো পদার্থ ও পানি থাকে। যদি বাতাস শুষ্ক হয় তাহলে বীজ থেকে পানি বাতাসে চলে আসে। আবার বীজ শুকনা হলে বাতাস থেকে পানি বীজে ঢুকে পড়ে। বাতাস ও বীজ একই মাত্রায় শুকনা হলে বাতাস থেকে বীজে বা বীজ থেকে বাতাসে পানি চলাচল করে না। অন্যদিকে, বীজ ভেজা হলে পোকা মাকড় দিয়ে আক্রান্ত হয়, ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে এবং বীজের তাপ বেড়ে গিয়ে বীজ মরে যায়। বীজ ভেজা হলে বীজকে উত্তমরূপে শুকাতে হবে। শুকনা বীজ এমন পাত্রে রাখতে হবে যাতে বাতাসের সংস্পর্শে আসতে না পারে।

শুকানো রোদে পলিথিন সিট, মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে অথবা পাকা মেঝেতে বীজ শুকানো যেতে পারে। বীজ কখনোও মাটির উপর শুকাতে দেয়া উচিত নয়। খুব সকালে এবং পড়ন্ত বিকালে বীজ শুকানো উচিত নয়। সাধারণত সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত বীজ শুকানো ভাল। বীজ উত্তমরূপে শুকিয়ে ঠান্ডা করে গুদামজাত করতে হবে। বীজ শুকানো কি না তা দাঁত দিয়ে চেপে দেখতে হবে। কটকট শব্দ হলে সাধারণত ধারণা করা যায় যে, বীজ শুকিয়েছে। তবে সব থেকে ভালো উপায় আর্দ্রতামাপক যন্ত্র দিয়ে বীজের আর্দ্রতা মাপা হলো উত্তম পন্থা।

বীজ সংরক্ষণ:

শুকনো বীজ টিনের পাত্রে বা ড্রামে রাখলে ভাল থাকে। এছাড়া মোটা পলিথিন ব্যাগে বীজ রাখলেও বীজ ভালো থাকে। অন্যান্য পাত্র যেমন: মাটির পাত্র, বাঁশের ডোল ইত্যাদি বীজ সংরক্ষণের জন্য ভাল নয়, কারণ এগুলো বায়ু নিরোধী নয়। মোট কথা যে পাত্রে বীজ রাখা হবে তা অবশ্যই বায়ু নিরোধক হতে হবে।

 

বীজ সংরক্ষণকালীন পরিচর্যা:

বায়ু নিরোধ পাত্রে রক্ষিত বীজ মাঝে মাঝে খুলে দেখতে হবে যে পোকার আক্রমণ হয়েছে কিনা এবং বীজের মধ্যে হাত দিয়ে দেখতে হবে গরম লাগে কিনা। যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে পূর্বে বর্ণিত পদ্ধতিতে বীজ শুকাতে হবে। যদি পোকা থাকে তাহলে বীজ চেলে পোকামুক্ত করতে হবে। যদি এভাবে পোকামুক্ত না হয় তবে বীজের সঙ্গে ঔষধ মিশিয়ে পোকা মেরে ফেলে বীজ ঠান্ডা করে পুনরায় গুদামজাত করতে হবে। ফসফিন ঔষধ মিশিয়েও পোকা মারা যায়, তবে ঔষধ মিশ্রিত বীজ কোন ক্রমেই খাওয়া যাবে না।

 

বীজ এর প্যাকিং:

উপরে বর্ণিত পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করে সংরক্ষিত বীজ বিক্রয়ের জন্য ছোট ছোট প্যাকেট ভরে প্যাকেট এর গায়ে বীজের নাম, জাত, গুণগত মান ইত্যাদি লিখে প্রয়োজন মোতাবেক বাজারে সরবরাহ করা যেতে পারে। নিজে ব্যবহারের জন্য বীজ প্যাকিং করার প্রয়োজন নেই।

 

বীজ সংরক্ষণ:

অল্প সময়ের জন্য বস্তায় বীজ সংরক্ষনই উপযুক্ত পদ্ধতি। তবে বীজের বস্তা অবশ্যই পরিষ্কার, শুষ্ক এবং পোকামাকড় মুক্ত হতে হবে। বীজ ভর্তি প্রতিটি বস্তা যথাযথভাবে চিহ্নিত হতে হবে (যেমন: বীজের নাম, জাতের নাম, উৎপাদনের উৎস) ইত্যাদি। বস্তাগুলো সরাসরি মেঝের উপর না রেখে কাঠের মাচার উপর রাখা উচিত। গাদা করে গাদার উচ্চতা

দানা শস্য বীজের বেলায় ৩—৪ মিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়। বীজের বস্তা খুব সাবধানের নাড়াচাড়া করা উচিত যাতে কোন যান্ত্রিক ক্ষতের (গবপযধহরপধষ উধসধমব) সৃষ্টি না হয়। বীজের বস্তার উপর হাঁটা বা বীজের বস্তার উপর বসে থাকা মোটেও উচিত নয়। সাময়িক সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত গুদাম অবশ্যই পরিচ্ছন্ন, শুষ্ক, শীতল হতে হবে এবং ম্যালথিয়ন দ্বারা স্প্রে করে নিতে হবে।

পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে ফিউমিগেট করে নিতে পারলে ভাল হয়। ফসটকসিন প্যালেটস ফিউমিগেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আর্দ্রতা প্রতিরোধক যে কোন পাত্র যেমন: ধাতব টিন, ড্রাম ইত্যাদি বীজ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা অবশ্যই নির্ধারিত মাত্রায় থাকতে হবে এবং পাত্রটি বায়ুরোধক হতে হবে।

 

 

বীজ সংরক্ষণের অর্থ জীবনের সংরক্ষণ। অনুপযুক্ত অবস্থায় সংরক্ষণের ফলে বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটে থাকে। এমনকি বীজের জীবন অবসানও ঘটাতে পারে। নির্দিষ্ট সংরক্ষণ কালের পর বীজের তেজ ও মান নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহের পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে।

১। সংগ্রহকালে বীজের তেজ ও মান।

২। বীজের জাত।

৩। সংরক্ষণাগারে পারিপাশ্বিক অবস্থা বিশেষ করে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা।

৪। বীজের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার হার।

 

বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি:

বীজ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। সংরক্ষণকালে বীজের পারিপাশ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে বর্ণিত চার পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

১। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই খোলা অবস্থায় বীজ সংরক্ষণ:

এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণের জন্য ডোল, বস্তা, গোলা, টিন কিংবা মাটির পাত্র, কাঁচের বোতল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শুষ্ক ও ঠান্ডা মৌসূমে বীজ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। কিন্তু উষ্ণ ও আর্দ্র মৌসুমে অধিকাংশ সবজি বীজের জন্য এ সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করতে হলে পোকা দমন করার জন্য ফিউমিগেশন করা অথবা কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে সাধারণত সবজি বীজ এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। বীজকে রোদে শুকিয়ে উপরোল্লিখিত যেকোন পাত্রে রেখে দেয়া হয়।

এ পদ্ধতিতে বীজের জলীয় ভাগ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় না। কুমড়া জাতীয় সবজি, ডাটা, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, টমেটো ইত্যাদি বীজ এ পদ্ধতিতে অন্তত: ১ (এক) বৎসর সংরক্ষণ করা যায়।

অল্প পরিমাণ গম বীজ তেলের ড্রাম কিংবা কেরোসিন বা বিস্কুটের টিনে সংরক্ষণ করা যায়। তবে নিশ্চিত হতে হবে যে, পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার, পাত্রের গায়ে কোন প্রকার ছিদ্র নেই এবং পাত্রের মুখ বন্ধ করে দিলে ভিতরে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে অথাৎ পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে বায়ুরোধক হতে হবে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে অধিক পরিমাণ বীজ সংরক্ষণ করতে হলে কীটপতঙ্গমুক্ত পরিষ্কার ও শুকনা চটের বস্তায় এবং বীজ সংরক্ষণের উপযুক্ত গুদামে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

প্রতি তিন দিন পর হিমাগারের দরজা খুলে খুব সকালে মুক্তবাতাস দিতে হবে। সংরক্ষণ কালে অন্ততঃপক্ষে দু’বার বস্তা উল্টিয়ে দিলে বীজ ভালো থাকে এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে অঙ্কুরিত হয় না। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রনবিহীন হিমাগারে কোনক্রমেই সবজি বীজ খোলা অবস্থায় রাখা উচিত নয়। তবে বায়ুরোধক পাত্রে বীজ রেখে তা অনায়াসে এ জাতীয় হিমাগারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

 

২। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পন্ন হিমাগারে বীজ সংরক্ষণ:

এ ধরনের হিমাগারকে ডি—হিউমিডিফাইড কোল্ড স্টোরেজ বলে। উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ সংরক্ষনের জন্য এ হিমাগার অত্যন্ত
উপযোগী। এ হিমাগারের তাপমাত্রা সাধারণত ১০ সে: ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৫০% এর উপর রাখা হয় না। এ অবস্থায় রাখা বীজ ৩—৮ বৎসর পর্যন্ত সজীব ও সতেজ থাকে অবশ্য এই ধরনের হিমাগার স্থাপন ও পরিকল্পনা ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে বীজ গুদামের অভ্যন্তরে বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

 

৩। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ:

এ পদ্ধতিতে শুকনা বীজকে বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। আর্দ্র মৌসূমে বীজ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষনের জন্য বায়ুরোধক টিন, এলুমিনিয়াম, কাঁচ কিংবা প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও মোটা পলিথিনের ব্যাগ এলুমিনিয়াম ফয়েল সংযুক্ত কাগজের ব্যাগ এবং বার্ণিশ করা বা বিটুমিনের প্রলেপ দেয়া মাটির পাত্র ও ব্যবহার করা চলে। তবে পাত্রের মুখ এমনভাবে বন্ধ করে দিতে হবে যাতে ভিতর দিয়ে কোন বাতাস চলাফেরা না করে। অল্প পরিমাণ বীজ হলে তা ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড কিংবা সিলিকাজেল সমেত ডেসিকেটর বা বীজ জারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

 

আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণবিহীন হিমাগারে বীজ সংরক্ষণ:

অধিকাংশ হিমাগারে সাধারণতত: ৮০% এর উপর আর্দ্রতা রাখা হয়। এসব হিমাগার আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি উচ্চ জলীয়ভাগ সম্পন্ন কৃষিজাত দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বীজ আলু হিমাগারে নেয়ারপূর্বে ২৪—২৮ ঘন্টা কাল ১৬—১৮০ সে. তাপমাত্রায় প্রিকুলিং (চৎব—পড়ড়ষরহম) করতে হয়। অতঃপর বস্তা হিমকক্ষে তাকের উপর খাড়াভাবে রেখে আস্তে আে¯ Í তাপমাত্রা কমিয়ে ৪ ০ সে. এ নামিয়ে আনতে হয়। হিমাগারের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০% বা তার বেশি হওয়া দরকার।

সারাংশ :

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বাজারজাত ও ভবিষ্যতের ব্যবহারে উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করা হয়। বীজের প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে হবে। অনুপযুক্ত অবস্থায় বীজ সংরক্ষণ করা যাবে না। এতে বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটে।

 

 

 কৃষি যন্ত্রপাতি

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কৃষি যন্ত্রপাতি। এই আর্টিকেলে আমরা কৃষি যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জানতে পারবো ।

 কৃষি যন্ত্রপাতি

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। গবেষণা করে দেখা গেছে যে, জমিতে শক্তির ব্যবহার বাড়লে উৎপাদন বাড়ে। তাই জমিতে শক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবং বাংলাদেশের কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন ফসলের জন্য লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

বর্তমানে ডিজেল ইঞ্জিনের দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় এবং দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও পাওয়ার টিলার পাওয়া যায় বলে শক্তি-চালিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে একদিকে পাওয়ার টিলারের বহুমুখী ব্যবহার বেড়েছে, অন্যদিকে কৃষকগণ অল্প খরচে শক্তি-চালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারছেন। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে ।

উৎপাদিত শস্য ঠিকমত প্রক্রিয়াজাতকরণ না করলে শস্য সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে এর বড় একটা অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে যা ব্যবহার করে ফসলের পরিমাণগত ও গুণগত মান বাড়ানো যায় ৷

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত অনেকগুলি কৃষি যন্ত্রপাতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত প্রস্তুতকারকগণ উৎপাদন ও বিপণন করছে। ফলে এসব কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এবং যন্ত্রপাতিগুলির চাহিদাও বাড়ছে। বারি কর্তৃক এ যাবৎ যত আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে তার কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো ।

 

 

হাই স্পিড রোটারি টিলার

প্রচলিত পাওয়ার টিলার দিয়ে শুকনা জমি চাষ করতে যেখানে ৫-৬টি চাষের প্রয়োজন হয়, হাই স্পিড রোটারি টিলার দিয়ে সেখানে ১-২টি চাষ যথেষ্ট। হাই স্পিড রোটারি টিলার এসব পাওয়ার টিলার অপেক্ষাও উন্নত মানের শুকনা জমি চাষের যন্ত্র।

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • ১/২টি চাষ দিয়ে স্বল্প সময়ে জমি তৈরি করে জমিতে ফসল আবাদ করা যায় ।
  • যন্ত্রের রোটারি ব্লেড শ্যাফট উচ্চ গতিতে ঘুরে বিধায় জমির ঢেলা খুব ছোট হয় ও মাটি ভাল গুঁড়া বা মিহি হয়।
  • হাই স্পিড রোটারি টিলারে প্রচলিত টিলারের তুলনায় ৫০% সময় ও আর্থিক সাশ্রয় হয়।
  • প্রতি ঘণ্টায় ০.১ হেক্টর (২৪ শতাংশ) জমি চাষ করতে পারে।
  • যন্ত্রটি দিয়ে প্রতি হেক্টর জমি চাষ করতে মাত্র ৩৪০০ টাকা খরচ হয়।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৫০,০০০ টাকা ।

 

 

পাওয়ার টিলার চালিত ইনক্লাইন্ড প্লেট সিডার

সারিতে বীজ বুনলে কম বীজ লাগে, সহজে আগাছা পরিষ্কার করা যায়, গাছ বেশি আলো বাতাস পায় এবং সর্বোপরি উৎপাদন বাড়ে। সারিতে ও নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং গভীরতায় সহজে বীজ বোনার জন্য পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ যন্ত্র দিয়ে চাষ করা জমি ছাড়াও চাষবিহীন অবস্থায় বেলে ও বেলে দোআঁশ মাটিতে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, তৈলবীজ ও ডাল শস্য সারিতে বোনা যায় ।

পাওয়ার টিলার চালিত ইনক্লাইভ প্লেট সিডার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যন্ত্রটি পাওয়ার টিলার চালিত
  • এ যন্ত্র বীজকে নির্দিষ্ট স্থানে ও সঠিক গভীরতায় সুষমভাবে বপন করে।
  • বীজের মান ভাল হলে ভাল অঙ্কুরোদগম এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক চারাগাছ নিশ্চিত করা যায়।
  • এটি ব্যবহার করে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ১০-৪০ শতাংশ বীজ কম লাগে। এবং ফলনও ১০-১৫% বৃদ্ধি পায় ।
  • সারিবদ্ধভাবে বীজ বপনের ফলে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। ফলে আগাছা দমন, কীটনাশক প্রয়োগসহ অন্যান্য আন্তঃপরিচর্যা করার জন্য প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ২৫% সময় ও খরচ কম লাগে।
  • বপন খরচ প্রতি হেক্টরে ৬০ টাকা (প্রতি ঘন্টায় ১৩ টাকা)
  • প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ০.১৮ হেক্টর (৪৫ শতাংশ) জমিতে বীজ বপন করা যায় ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৫০,০০০ টাকা ।

বেড প্লান্টার

আমাদের দেশে আলু, ভুট্টা, মরিচ, সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল বীজ ফারো বা বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করা হয়। বেড পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করলে বাতাস সহজেই গাছের শিকড়ের নিকট যেতে পারে। ফলে গাছ বাতাস থেকে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান গ্রহণ করতে পারে। বেড পদ্ধতিতে নালায় পানি সেচ দিলে সহজেই অল্প সময়ে অনেক জমিতে পানি সেচ দেওয়া যায়। এতে পানির পরিমাণ ও প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় কম লাগে। এই পদ্ধতিতে শুকনা বা রবি মৌসুমে পানি যেমন কম লাগে তেমনি বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে নালা দিয়ে সহজেই পানি বের হয়ে যায়।

 

বারি বেড প্লান্টার

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • বেডে ফসল ফলালে উৎপাদন খরচ কমে, মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও দুষণমুক্ত পরিবেশ পাওয়া যায়।
  • এ যন্ত্রের দ্বারা ১-২টি চাষে বেড তৈরি, সার প্রয়োগ ও বীজ বপনের কাজ একই সঙ্গে করা যায়।
  • বেড প্লান্টার দ্বারা গম, ভুট্টা, আলু, মুগ, তিলসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি বীজ সফলভাবে বপন করা সম্ভব।
  • স্থায়ী বেডেও বীজ বপন করা যায় ।
  • বেডে ফসলের অবশিষ্টাংশ রেখেই বিনা চাষে বীজ বপন করা যায়।
  • স্থায়ী বেডে কেঁচো বাস করে বিধায় জমির উর্বরতা বাড়ে ।
  • স্থায়ী বেডে কয়েক বছর চাষ করলে জমিতে জৈব সারের পরিমাণ বাড়ে।
  • বেডে ফসল করলে ইঁদুরের উৎপাত কমে।
  • বেডে ফসল করলে সেচ খরচ ও সময় ২৫% কমে।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ০.১১ হেক্টর জমিতে বেড তৈরি করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির (মডেল-১) বাজার মূল্য ৪০,০০০ টাকা (পাওয়ার টিলার ছাড়া)।
  • যন্ত্রটির (মডেল-২) বাজার মূল্য ৭০,০০০ টাকা (পাওয়ার টিলার ছাড়া)।

গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্ৰ

নাইট্রোজেন উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম। ধান ক্ষেতে ৬-৭ সেমি কাদা মাটির নিচে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করে সার অপচয় নিয়ন্ত্রণ করে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা যায়। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের সুবিধা থাকা সত্বেও মাঠে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহারে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম হলো হাতে একটি একটি করে গুটি সার প্রয়োগ করা।

ধানের চারা গাছের মাঝে উপুড় হয়ে হাত দিয়ে কাদার নির্দিষ্ট গভীরে সার প্রয়োগ যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনি কষ্টকর। অন্যদিকে নিরস ও কষ্টকর এ কাজের জন্য প্রয়োজন দক্ষ শ্রমিক, যার অভাব দেশের সর্বত্রই। ধান চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের অসুবিধাসমূহের কথা অনুধাবন করে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র দ্বারা ধানের জমিতে ইউরিয়া প্রয়োগ করা হচ্ছে

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যন্ত্রটি দেশীয় কাঁচামাল দ্বারা স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরি করা যায় ।
  • এমএস বার দ্বারা তৈরিকৃত ফ্রেমে মিটারিং ডিভাইস বসানো থাকে ।
  • মিটারিং ডিভাইসের পাত্র ও ডিস্ক প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি ।
  • যন্ত্রের দুই পার্শ্বের দুটি এমএস সিট দ্বারা তৈরি নৌকাকৃতির স্কিড থাকে যা কাদার উপর যন্ত্রকে ভাসিয়ে রাখে।
  • স্কিডের নিচে দুইটি ৬ সেমি দৈর্ঘ্যের ফারো ওপেনার আছে। • প্রতিটি ফারোকে বন্ধ করার জন্য দুটি করে ফারো ক্লোজার আছে।
  • ১.৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি হ্যান্ডেল আছে যা চালকের দৈর্ঘ্যের সাপেক্ষে বিভিন্ন কোণে স্থাপন করা যায়। হ্যান্ডেলে ধাক্কা দিয়ে যন্ত্রটি চলানো হয়।
  • যন্ত্রটি ২-৫ সেমি দাঁড়ানো পানিতে ভাল চলে ।
  • মানুষের সাধারণ হাঁটার গতিতে (১-১.৫ কি.মি./ঘন্টা) যন্ত্রটি চালানো যায় ।
  • যন্ত্রটি সম্মুখ গতিতে ৮০ সেমি প্রস্থ জমিতে সার প্রয়োগ করে ।
  • যন্ত্রটির ওজন ৯ কেজি।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ০.১০ হেক্টর জমিতে সার প্রয়োগ করতে পারে।
  • যন্ত্রটির চালনা খরচ প্রতি হেক্টরে ৭০০ টাকা।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৩,৫০০ টাকা ৷

 

স্বচালিত শস্য কর্তন যন্ত্র

বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকদের ধান ও গম চাষে যে সমস্যাগুলি রয়েছে তার মধ্যে ধান/গম কাটা একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। ধান বা গম কাটার মৌসুমে কৃষককে বেশ কয়েকটি কাজ একসাথে করতে হয়। যেমন- ফসল কাটা, মাড়াই করা, ঝাড়াই করা, শুকানো এবং পরবর্তীকালে ফসলের জন্য জমি তৈরি, বীজতলা তৈরি ইতাদি। কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় এসময় শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এ সমস্যা দূরীকরণে স্বচালিত যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

স্বচালিত ধান ও গম কর্তন যন্ত্র

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যন্ত্রটি দিয়ে ধান ও গম কাটা যায় ।
  • কিছুটা হেলে পড়া ধান বা গমও কাটা যায় ।
  • জমিতে কিছুটা পানি থাকলেও যন্ত্রটি দিয়ে ফসল কাটা যায় (এঁটেল মাটি ছাড়া)।
  • কাটা ধান বা গম ডান পাশে সারিবদ্ধভাবে পড়ে যাতে সহজে আঁটি বাঁধা যায় ।
  • প্রতি ঘণ্টায় জ্বালানি খরচ মাত্র ০.৬ লিটার (ডিজেল)।
  • প্রতি হেক্টর ধান ও গম কাটতে প্রায় ১২০০ টাকা খরচ হয়।
  • একজন লোক সহজেই যন্ত্রটি চালাতে পারে এবং এটি সহজে স্থানান্তর করা যায়।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ০.১৪-০.২০ হেক্টর (৩৫-৫০ শতাংশ) ধান এবং ০.১৮-০.২৪ হেক্টর (৪৫-৬০ শতাংশ) গম কাটতে পারে।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ১,৬০,০০০ টাকা।

শক্তি চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র

বর্তমানে দেশের অনেক এলাকায় ব্যাপকভাবে ভুট্টা চাষ করা হচ্ছে। শক্তি-চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র দিয়ে বেশি পরিমাণ ভুট্টা মাড়াই করা সম্ভব নয়। এ বিবেচনায় অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তি-চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। বর্তমানে এ যন্ত্রটি সারাদেশে ব্যাপকভাবে তৈরি ও ব্যবহার হচ্ছে।

 

শক্তি চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • এ যন্ত্রটির নির্মাণ কৌশল সহজ।
  • যন্ত্রটি পরিচালনা করা খুবই সহজ।
  • এর মেরামত করার প্রয়োজনীয়তা কম ।
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৪ জন লোকের দরকার হয় ।
  • যন্ত্রটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় মাড়াই খরচ খুবই কম ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য (বড়) : ৪৫,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া)।  (ছোট): ৩৫,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া) ।

শক্তি চালিত শস্য মাড়াই যন্ত্র

বাংলাদেশের সব এলাকায় সাধারণত কৃষক ধান কাটার পর হাতে পিটিয়ে বা গরুর সাহায্যে (মলন) মাড়াই করে থাকে। এতে অনেক বেশি শ্রমিক লাগে বলে মাড়াই খরচ বেড়ে যায়। বৃষ্টির সময় সনাতন পদ্ধতিতে মাড়াই করা যায় না বলে প্রচুর ধান ও গম নষ্ট হয় এবং গুণগতমান কমে যায়। ফলে বাজার মূল্য হ্রাস পায়। দেশে ধান ও গমের উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সনাতন পদ্ধতিতে বা পা-চালিত মাড়াই যন্ত্র দিয়ে মাড়াই করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। সে জন্য শক্তি চালিত শস্য মাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

শক্তি চালিত শস্য মাড়াই যন্ত্র দ্বারা গম মাড়াই

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • এ যন্ত্র দিয়ে ধান, গম ও ডাল শস্য মাড়াই করা যায়।
  • এ যন্ত্রটি দিয়ে ৫০-৭০ সেমি দৈর্ঘ্যের, শস্য মাড়াইয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল ফল পাওয়া যায়।
  • কম আর্দ্রতা সম্পন্ন ফসল মাড়াইয়ে ব্যবহার করলে যন্ত্রটির মাড়াই ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • যন্ত্রটি উচ্চ মাত্রায় শ্রম এবং অর্থ সাশ্রয়ী।
  • মাড়াই ক্ষমতা পা-চালিত মাড়াই যন্ত্রের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেশি।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ৯৩০ কেজি ধান ও ৩৪০ কেজি গম মাড়াই করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৪৫,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া)।

 

আলু উত্তোলন যন্ত্ৰ

বাংলাদেশে আলু একটি অর্থকরী ফসল। অধিকাংশ স্থানে কৃষকগণ কোদাল দিয়ে আলু ওঠান। কোন কোন এলাকায় হাত বা বলদ দিয়ে লাঙ্গল টেনে আলু ওঠানো হয়। উভয় পদ্ধতিতেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু মাটির নিচে থেকে যায় যা আবার ওঠানো দরকার হয়। ফলে সময় বেশি লাগে এবং অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয় যা ব্যয়সাপেক্ষ। সময়মতো আলু ওঠাতে না পারলে বৃষ্টিতে প্রচুর আলু নষ্ট হয় যা কৃষকের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। এসব অসুবিধা দূর করার জন্য অল্প সময়ে কম খরচে মাটির নিচ থেকে আলু ওঠানোর জন্য আলু উত্তোলন যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

আলু উত্তোলন যন্ত্র

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অল্প সময়ে, কম খরচে মাটির নিচ থেকে আলু ওঠানো যায়।
  • যন্ত্রটি যে কোন পাওয়ার টিলার দিয়ে চালানো যায় ।
  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে যন্ত্রটি তৈরি করা যায় ।
  • যন্ত্রটি দিয়ে ৫৫-৬০ সেমি দূরত্ব বিশিষ্ট সারির আলু তোলার জন্য ব্যবহার করা যায় ৷
  • যন্ত্রটি মাটির নিচ থেকে ১০০% আলু উঠিয়ে মাটির ওপরে রেখে দেয়।
  • যন্ত্রটি ঘণ্টায় ০.০৭ হেক্টর (১২ শতাংশ) জমির আলু উত্তোলন করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৩০,০০০ টাকা ।

 

শক্তি চালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র (মডেল-১)

বাণিজ্যিকভাবে এবং কৃষক পর্যায়ে বীজ সংরক্ষণ ও বাজারে বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন সাইজে আলু ভাগ করতে হয়। বর্তমানে আলু গ্রেডিং এর কাজটি কোল্ড স্টোরের শ্রমিক ও কৃষকগণ হাতের সাহায্যে বিভিন্ন সাইজে ভাগ করে থাকেন। এর জন্য প্রচুর শ্রমিক লাগে এবং অনেক সময় ব্যয় হয়। সেজন্য গ্রেডিং এর কাজে খরচ পড়ে অনেক বেশি। কম খরচে, অল্প সময়ে আলু বিভিন্ন সাইজে ভাগ করার জন্য দুই ধরনের শক্তিচালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

শক্তি চালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র (মডেল-১)

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লোহার সামগ্রী দিয়ে এ যন্ত্রটি তৈরি করা যায়।
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৩/৪ জন লোকের দরকার হয়।
  • স্বল্প সময়ে ও কম খরচে আলুকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ করা আলু সরাসরি বস্তায় জমা হয়।
  • যন্ত্রটি দুটি লোহার চাকার উপর বসান থাকে যাতে সহজে স্থানান্তর করা যায়।
  • যন্ত্রটি ঘণ্টায় ১.৬ টন আলু বাছাই করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৪০,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া)।

 

শক্তি চালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র (মডেল-২)

 

শক্তি চালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র দ্বারা আলু বাছাইকরণ

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লোহার সামগ্রী দিয়ে এ যন্ত্রটি তৈরি করা যায় ।
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৩ জন লোকের দরকার হয়।
  • স্বল্প সময়ে ও কম খরচে আলুকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
  • ভাগ করা আলু সরাসরি বস্তায় জমা হয় । • যন্ত্রটি চারটি চাকার উপর বসান থাকে যাতে সহজে স্থানান্তর করা যায়।
  • যন্ত্রটি ঘণ্টায় ১.৩ টন আলু বাছাই করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৪০,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া)।

 

শক্তি চালিত শস্য ঝাড়াই যন্ত্র

আমাদের দেশের কৃষক শস্য মাড়াই করার পর পরিষ্কার করার জন্য প্রাকৃতিক বাতাসের উপর নির্ভর করেন। পর্যাপ্ত বাতাসের অভাবে অনেক শস্য অপরিষ্কার অবস্থায় স্তূপাকারে রাখার ফলে অপচয় হয়। শস্যের গুণগতমান ও দাম কমে যায়। এ সমস্যা দূরীকরণে শক্তি চালিত শস্য ঝাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

শক্তি চালিত শস্য ঝাড়াই যন্ত্র দ্বারা ধান ঝাড়াই

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • ঘরোয়া পরিবেশে এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ব্যবহার করা যায়। • অল্প সময় ও খরচে ঝাড়াই ও পরিষ্কার করা সম্ভব ।
  • যে কোন মহিলা/পুরুষ যন্ত্রটি সহজে চালাতে পারেন।
  • স্থানীয় কারখানায় এটি সহজে তৈরি করা যায় ।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ৮০০ কেজি ধান এবং ১০০০ কেজি গম ঝাড়াই করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ২০,০০০ টাকা ।

 

আম পাড়া যন্ত্র

আম পাড়ার জন্য বাংলাদেশে বাঁশের চটার তৈরি গোলাকৃতি কোটা ব্যবহৃত হয় যার সাথে পাটের/নাইলনের রশির তৈরি জাল লাগানো থাকে। কোটাটি একটি চিকন বাঁশের মাথায় লাগিয়ে ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে বোঁটা থেকে আম আলাদা হয় বলে বোঁটা পচা রোগ হয়। ফলে আমের সংরক্ষণকাল কমে যায় এবং কৃষক আমের মূল্য কম পায়। তাই বোঁটাসহ আম পাড়ার জন্য এ যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। আম রপ্তানিকারক দেশে যন্ত্রের সাহায্যে বোঁটাসহ আম পাড়া হয় বলে সাধারণত রোগ হয় না।

 

আম পাড়া যন্ত্র

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • এ যন্ত্র দিয়ে বোঁটাসহ আম পাড়া যায়।
  • প্রচলিত আম পাড়া কোটার চেয়ে ২০% দ্রুত আম পাড়া যায় ।
  • যন্ত্রটি ঘণ্টায় ২০০-৪০০ কেজি আম পাড়তে পারে।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৪৫০ টাকা ।

 

আম শোধন যন্ত্র

আম একটি দ্রুত পচনশীল ফল। সংগ্রহ মৌসুমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা উভয়ই বেশি থাকে বলে আম পচা ত্বরান্বিত হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট আমের ২০ থেকে ৩০% সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নষ্ট হয়। প্রধানত বোঁটা পচা ও এ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণে আম নষ্ট হয়। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, জাতের উপর নির্ভর করলে বোঁটা পচা রোগ ও এ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমন করা যায়। এভাবে আম নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতি কাজে লাগানোর জন্য গরম পানিতে আম শোধন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

আম শোধন যন্ত্র

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • ২ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৮টি বৈদ্যুতিক ওয়াটার হিটারের মাধ্যমে পানিকে গরম করা হয়।
  • তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক ব্যবহার করা হয় ।
  • আম ভর্তি প্লাস্টিক ব্রেন্ট বহনের জন্য মটর চালিত কনভেয়ার রোলার ব্যবহার করা হয়।
  • যন্ত্রটি দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে আম শোধন করা যায় ।
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৬ জন লোকের প্রয়োজন হয়।
  • এ যন্ত্র দ্বারা আমকে সুষমভাবে ৫২-৫৫° সে. তাপমাত্রার পানিতে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করা হয় ।
  • গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখা আমের গায়ে লেগে থাকা পচনে সাহায্যকারী জীবাণু মারা যায়।
  • শোধনকৃত আম ৫-৬ দিনের পরিবর্তে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত টাটকা থাকে এবং
  • আমের রং উজ্জ্বল হয়। যন্ত্রটি পরিচালনা করা খুবই সহজ।
  • যন্ত্রটি দিয়ে ঘণ্টায় ১০০০ কেজি আম শোধন করা যায়।
  • উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় প্রতি কেজির শোধন খরচ মাত্র ৫০ পয়সা। যন্ত্রটির বাজার মূল্য ১,৩৫,০০০ টাকা।

হাইব্রিড ড্রায়ার

সূর্যের তাপে বা রোদে শস্য শুকানোর পদ্ধতি অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশে এখনও রোদে শস্য শুকানো বহুল প্রচলিত পদ্ধতি । খোলা রোদে শস্য শুকানো সহজ এবং খরচও অনেক কম। কিন্তু, রোদে শস্য শুকানোর গতি অনেক কম এবং শস্য শুকাতে অনেক জায়গার প্রয়োজন হয়।

সূর্যের আলো কখনও কম থাকে আবার কখনও বেশি হয়। তাছাড়া মেঘলা আবহাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের ও আশঙ্কা থাকে যার ফলে শস্যের গুণগত মান বজায় থাকে না। শস্য শুকানোর সময় ধূলিকণা, পোকামাকড়, পশু-পাখি ও অণুজীবের দ্বারা শস্য আক্রান্ত হয়। শস্য সংগ্রহকালীন সময়ে অনবরত কয়েক দিন বৃষ্টিপাত হলে শস্যের বিরাট অংশ নষ্ট হয়ে যায় এমনকি সমস্ত শস্যও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের কৃষকের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এ হাইব্রিড ড্রায়ার উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি হাইব্রিড ড্রায়ার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • সৌরশক্তি ও বৈদ্যুতিক শক্তির সমন্বয়ে এটি চালনা করা হয়। তাছাড়া রিফ্লেক্টর ব্যবহার করে সৌরশক্তির মাত্রাকে প্রায় ৫০% বৃদ্ধি করা হয় ।
  • বিভিন্ন ধরনের শস্য বীজসহ ফল, শাক-সবজি, ঔষধি গাছ ইত্যাদি এই ড্রায়ারে শুকানো যায়। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা ও ট্রের সেটিং ভিন্ন করা হয়।
  • সূর্যের আলো না থাকলেও বৃষ্টি বা মেঘলা আবহাওয়ায় এটি ব্যবহার করা যায় ।
  • স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রায়ারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা আছে। ফলে কম তাপমাত্রার দরুন শস্যের পচন ও বেশি তাপমাত্রায় শস্যের গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না ।
  • নির্গত গরম বাতাসকে পুনরায় ব্যবহার করে তাপশক্তির সাশ্রয় করা যায় ।
  • চাকা থাকার দরুন ড্রায়ারকে স্থানান্তর করা সহজ এবং ড্রায়ারকে ঘুরিয়ে এবং রিফ্লেক্টর উঁচু ও নিচু করে সর্বাধিক সৌর রশ্মি ড্রায়ারে আপতিত করা যায় ।
  • ড্রায়ারের প্রত্যেকটা অংশ খোলা ও ফিটিং করা যায়। ফলে ড্রায়ারের যন্ত্রাংশগুলো
  • খুলে সহজে পরিবহণ করা যায় এবং পরে এগুলো সংযোজন করা যায় ।
  • ড্রায়ার তৈরির মালামালগুলি বাজারে সহজলভ্য এবং স্থানীয় ওয়াকর্শপে এটি তৈরি করা যায়।
  • ড্রায়ারের তাপমাত্রা ৪০-৬০° সে. (নিয়ন্ত্রণযোগ্য)।
  • ড্রায়ারের ক্ষমতা: ধান (২৫০-৩০০ কেজি) ১৭ ঘণ্টা, গম (২৫০ কেজি) ১২ ঘণ্টা, ভুট্টা (৩০০-৩৫০ কেজি) ১৬ ঘণ্টা, বাদাম (২০০ কেজি) ২০ ঘণ্টা, ফল (৮০-১০০ কেজি) ২০-২৫ ঘণ্টা, সবজি (৪০-৬০ কেজি) ১২-১৫ ঘণ্টা
  • ড্রায়ারের বাজার মূল্য ১,০০,০০০ টাকা ।

কম্পোস্ট সেপারেটর

ভার্মিকম্পোষ্ট এমন এক ধরনের সার যা ব্যবহারে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত সাশ্রয় করা সম্ভব। ভার্মিকম্পোষ্ট বা কেঁচো সার তৈরিতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য কাজ হলো কম্পোস্ট থেকে কেঁচো আলাদা করা ও হেঁকে নির্দিষ্ট সাইজের গুঁড়া প্যাকেটজাত করণের জন্য আলাদা করা।

চালনীর মাধ্যমে হাতে চেলে কাঙ্ক্ষিত আকারের সার পাওয়ার জন্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। হাতে চেলে কেঁচো আলাদা করা যেমন কষ্টের তেমনি কেঁচোর স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। তাছাড়া এভাবে সার কমপক্ষে ২ বার হাতে চালতে হয়। কিন্তু এই যন্ত্রের দ্বারা একই সাথে কেঁচো আলদা করা সহ একবারেই কাঙ্ক্ষিত সার পাওয়া সম্ভব ।

 

বারি কম্পোস্ট সেপারেটর দ্বারা ভার্মিকম্পোস্ট চালা হচ্ছে

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা যায়।
  • মাত্র ০.৫ অশ্ব শক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দ্বারা চালানো সম্ভব।
  • সার থেকে কেঁচোকে পুরোপুরি আলাদা করতে পারে।
  • অল্প সময় ও স্বল্প খরচে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কেঁচো সার তৈরির সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ কাজ করা যায় ।
  • ট্রাইকোকম্পোস্টকেও সহজেই চালা যায় ।
  • ট্রাইকোকম্পোস্ট চালার জন্য ঘূর্ণন গতি বাড়ানোর ব্যবস্থা আছে।
  • মহিলা/পুরুষ এটা সহজেই চালাতে পারেন ।
  • যন্ত্রটি চালাতে ৩ জন লোকের প্রয়োজন হয়।
  • যন্ত্রটি দ্বারা ৫ মিমি এর চেয়ে কম ব্যসার্ধের চা পাতার মত সার সহজেই পাওয়া যায়।
  • যন্ত্রটি দ্বারা ঘণ্টায় ১৫০০ কেজি ভার্মিকম্পোস্ট বা ১০০০ কেজি ট্রাইকোকম্পোস্ট চালা যায় যেখানে হাতে চাললে ৩ জন লোকে ঘন্টায় ২৪০ কেজি ভার্মিকম্পোস্ট বা ১০০ কেজি ট্রাইকোকম্পোস্ট চালতে পারে।
  • যন্ত্রটির চালনা খরচ প্রতি কেজিতে ০.০৭ টাকা (ভার্মিকম্পোস্ট) এবং ০.১৫ টাকা (ট্রাইকোকম্পোস্ট)
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৩৫,০০০ টাকা ।

বারি কফি গ্রাইন্ডার

কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় উপজাতি কৃষকদের উদ্যোগে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার পাহাড়ী এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বিগত তিন দশক ধরে কফির চাষ হয়ে আসছে। উৎপাদিত কফির সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কিত জ্ঞান এবং ভাল বিপণন ব্যবস্থার অভাবে অত্যন্ত লাভজনক এ ফসলটির চাষ জনপ্রিয় হয়নি।

কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ একটি জটিল এবং যন্ত্রপাতি নির্ভর প্রক্রিয়া। এ কাজটি স্থানীয় কফি উৎপাদনকারীরা হামান দিস্তার সাহায্যে হাতে গুড়া করে থাকে। কাজটি যেমন শ্রম সাপেক্ষ তেমনি এভাবে উৎপাদিত কফির গুণগতমান বহুলাংশে কমে যায়। কফির গুণগতমান ঠিক রেখে ভাজা কফিকে গুড়ো করার কাজটি সহজে এবং দ্রুত করার জন্য বারি কফি গ্রাইন্ডার যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি কফি গ্রাইন্ডার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা যায় ।
  • এ যন্ত্রটি চালানোর জন্য অল্প জায়গার প্রয়োজন হয়।
  • মাত্র ০.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে চালানো যায় ৷
  • এ যন্ত্র ব্যবহারের ফলে উৎপাদন সময় ও খরচ কম লাগে।
  • এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য হওয়ায় এটি দিয়ে যে কোন কাঙ্খিত ধরণের কফি গুঁড়ো পাওয়া যায়।
  • একজন মানুষ অতি সহজেই এ যন্ত্র চালাতে পারে ।
  • মাপ : ৫৬০ ৪৫০ ৭৪০ সেমি।
  • ওজন : ২৫ কেজি।
  • কার্যমতা : ১১.৫ কেজি/ঘণ্টা ৷
  • মূল্য : ২৫,০০০ টাকা (মোটরসহ)।

বারি বাদাম মাড়াই যন্ত্ৰ

বাংলাদেশের চরাঞ্চলে বাদামের চাষ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিস্তৃত এলাকায় বপনের জন্য প্রয়োজনীয় বাদামের খোসা ছাড়াতে ও মাঝারি ধরনের কনফেকশনারির জন্য হস্তচালিত বাদাম মাড়াই যন্ত্র যথেষ্ট নয়। এ বিবেচনায় শ্রম সাশ্রয়ী শক্তিচালিত বাদাম মাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি বাদাম মাড়াই যন্ত্ৰ

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যন্ত্রটি স্থানীয় প্রকৌশল কারখানায় তৈরি করা যায় ৷
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য একজন লোকই যথেষ্ট।
  • যন্ত্রটি একই সাথে মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের সাথে সাথে মাড়াইকৃত বাদাম থেকে অমাড়াইকৃত বাদাম আলাদা করে দেয় ৷
  • মাত্র ০.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে চালানো যায় ।
  • যন্ত্রের মাপ ১০৬ ৪১ ১০১ সেমি।
  • হপারের ধারণ ক্ষমতা : ৬-১০ কেজি।
  • যন্ত্রের ওজন ৭৫ কেজি।
  • মাড়াই ক্ষমতা : ১২০-১৫০ কেজি/ঘণ্টা।
  • দানা ভাঙ্গার হার : ১-২%।
  • ঝাড়াই দক্ষতা : ১০০% ।
  • বাছাই দক্ষতা : ৯৫%।
  • মূল্য : ৩০,০০০ টাকা (মোটরসহ)।

বারি হলুদ পলিসার

বাংলাদেশের হলুদ গুণগত দিক থেকে বিখ্যাত। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের হলুদের কদর থাকায় হলুদের উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হলুদ সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন ধাপগুলো হলো পরিষ্কার করা, বাছাই করা, সিদ্ধ করা, শুকানো, পলিস করা এবং গুঁড়া করা।

হলুদ পলিস করা বলতে বুঝায় শুকানো হলুদের চামড়া, শিকড় এবং অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত অংশ সরিয়ে উজ্জ্বল, মসৃণ এবং হলুদাভ কন্দ পাওয়া। এ কাজটি সাধারণত বস্তায় ভরে হাত দিয়ে পিটিয়ে করা হয়ে থাকে যা সময় সাপেক্ষে, কষ্টসাধ্য এবং শ্রমনির্ভর। কৃষকের কষ্ট লাঘব করার জন্য একটি শক্তিচালিত হলুদ পলিসার যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি হলুদ পলিসার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে যন্ত্রটি তৈরি করা যায় ।
  • মাত্র ০.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে যন্ত্রটি চালানো যায় ।
  • একজন মানুষ অতিসহজেই এ যন্ত্র চালাতে পারে।
  • রৌদ্র তাপে শুকিয়ে গরম অবস্থায় পলিস করলে ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও গুণাগুণ ভাল হয়।
  • ঘূর্ণায়মান ষড়ভুজাকৃতির ড্রামের দৈর্ঘ্য ৬১০ মিমি ।
  • বাহিরের ব্যাস ৬৯ সেমি।
  • ভেতরের ব্যাস ৫৯ সেমি।
  • যন্ত্রের মাপ: ১০৪×৮৫×১৪৫ সেমি।
  • প্রতি ব্যাচে হলুদের ওজন: ৩০ কেজি।
  • যন্ত্রের ওজন: ৯০ কেজি।
  • কার্যক্ষমতা : ৬৫-৯০ কেজি/ঘণ্টা।
  • মূল্য : ৩০,০০০ টাকা (মোটরসহ)।

বারি কফি রোস্টার

কফি প্রক্রিয়াজাতকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে সবুজ কফিকে উচ্চ তাপে ভাজা বা রোস্টিং করা। এটি একটি তাপ রাসায়নিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সবুজ কফিতে অবস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থগুলি পরিবর্তিত হয়ে সুগন্ধ, রং ও স্বাদ প্রাপ্ত হয়। আমাদের দেশের খাগড়াছড়ি বা বান্দরবনের কফি চাষীরা কফি রোস্টিং বা ভাজার কাজটি সাধারণ চুলায় খোলা পাত্রে বা কড়াইতে করে থাকে।

পর্যাপ্ত তাপমাত্রার অভাবে কফির সুষমভাবে ভাজা হয় না। ফলে স্বাদ, রং ও ঘ্রাণের দিক দিয়ে এ কফি খুবই নিম্নমানের হয়। উৎকৃষ্ট মানের কফি প্রস্তুত করার জন্য কফি রোস্টার মেশিনের কোন বিকল্প নেই। এ ধরণের মেশিন কফি উৎপাদনকারী দেশগুলোতে সহজলভ্য হলেও আমাদের দেশে এখনও সহজলভ্য নয়। বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষকে উৎসাহিত করার জন্য কফি রোস্টার যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে।

 

বারি কফি রোস্টার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা যায়।
  • ০.২৪ অশ্বশক্তির (০.১৮ কিলোওয়াট) বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে যন্ত্রটি চালানো যায় ।
  • এ যন্ত্রটি প্রাকৃতিক গ্যাসচালিত হওয়ার ফলে উৎপাদন সময় ও খরচ কম লাগে।
  • এটি তাপ নিয়ন্ত্রণযোগ্য হওয়ায় এটি দিয়ে যে কোন কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ভাজা কফি পাওয়া যায় ।
  • একজন মানুষ অতি সহজেই এ যন্ত্র চালাতে পারেন ৷
  • জ্বালানী : প্রাকৃতিক গ্যাস । মাপ : ৭১০×৪০০x৬১০ সেমি।
  • ওজন : ১৫ কেজি।
  • কার্যক্ষমতা : ৪.৫ কেজি/ঘণ্টা ।
  • মূল্য : ২০,০০০ টাকা (মোটরসহ)।

বারি সোলার পাম্প

জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা ও অনিশ্চয়তা সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে ১৭.৫ লক্ষ সেচ যন্ত্র রয়েছে যার মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ ডিজেল চালিত। প্রতিবছর ডিজেলের দাম বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে সৌর আলোক শক্তির মাত্রা প্রতিদিন প্রতি বর্গমিটারে ৪.০ থেকে ৬.৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং প্রখর সূর্যালোক প্রতিদিন ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা। তাই বাংলাদেশের বিদ্যুৎবিহীন এলাকাতে ফসল উৎপাদনে ক্ষুদ্র পরিসরে সেচের জন্য সৌর পাম্প বিকল্প হতে পারে।

কৃষিতে সৌর পাম্প সেচ পদ্ধতি ডিজেল চালিত সেচ পাম্পের বিকল্প, দূষণমুক্ত ও পরিবেশ বান্ধব। ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি সেচের জন্য এক অশ্বশক্তির একটি সৌর পাম্প উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাম্পটি ৯০০ ওয়াট ক্ষমতার প্যানেল দিয়ে চালনা করা হয়। এক অশ্বশক্তির ভিসি মোটরের সাথে পাম্পের সরাসরি কাপলিং করে সৌর পাম্প তৈরি করা হয়েছে। এ পাম্পে কোন ব্যাটারী লাগেনা। ফলে শুধুমাত্র সূর্যালোকের সময় পাম্প চলবে। রাতে বা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলে পাম্প চলবে না ।

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • এই পাম্প দিয়ে ৬ মিটার (২০ ফুট) গভীরতা থেকে পানি তোলা যায় ।
  • রাতে বা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলে পাম্প চালনো যায় না।
  • সৌর সেচের মাধ্যমে সবজি চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ।
  • তবে সৌর সেচের মাধ্যমে ধান চাষ অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক ।

 

বারি সোলার পাম্প

 

  • পানি উত্তোলন উপযোগিতা : ভূ-পৃষ্ঠস্থ
  • পাইপের ব্যাস : ৩৮ মিমি (১.৫ ইঞ্চি)।
  • মোটরের শক্তি : ১ অশ্বশক্তি।
  • মোটরের প্রকৃতি : ডিসি ।
  • প্যানেল শক্তি : ১০০ ওয়াট।
  • বিভব পার্থক্য : ৬০ ভোল্ট।
  • গড় পানি নির্গমন ক্ষমতা : প্রতি মিনিটে ১৪০ লিটার।
  • সৌর পাম্পের মোট মূল্য : ১,০০,০০০ টাকা।

কলা ও পেঁয়ারার উন্নতমানের বারি কার্টন

আম, কাঁঠাল, কলা ও পেঁয়ারা বাংলাদেশের প্রধান ফল। বাংলাদেশে কলা ও পেঁয়ারা যথেষ্ঠ জনপ্রিয় ফল। কলা সাধারণত সারা বছর পাওয়া যায়। কলা সংগ্রহের ৭/৮ দিন পরেই পচন শুরু হয়। পেঁয়ারা সাধারণত জুলাই-আগস্ট মাসে পাওয়া যায় । এটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল। পেঁয়ারা সংগ্রহের ২/৩ দিন পরে গায়ের রং হলুদ হয়ে যায় ।

এদের গা নরম হওয়ায় প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিবহনের কারণে গায়ে প্রচুর দাগ পড়ে ও অনেক ফল ক্ষত হয়ে যায়। ফলে এদের গুণগতমান কমে যায় ও অপচয় হয়। যে কারণে বাজার মূল্য হ্রাস পায়। কলা ও পেঁয়ারার গুণগতমান বজায় রেখে অক্ষত অবস্থায় পরিবহন ও বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে কলা ও পেঁয়ারার উন্নতমানের কার্টন উদ্ভাবন করা হয়েছে। কার্টন ব্যবহার করে ফল ব্যবসায়ী ও কৃষকগণ ফলের অপচয় রোধ করে অধিক লাভবান হবেন। তদুপরি এসব কার্টন ব্যবহার করে জনপ্রিয় এ ফলগুলো সুপার মার্কেটে বিক্রয় ও বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।

 

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • কার্টুনটি করোগেটেড ফাইবার বোর্ড দিয়ে তৈরি ।
  • কার্টন হালকা বিধায় ফল-ফলাদি পরিবহন ও স্থানাস্তর করা সহজ।
  • ইহা ফলকে অক্ষত অবস্থায় ভোক্তাদের নিকট পৌছাতে সহায়তা করে ।
  • এর পায়ে ৮ টি ছিদ্র থাকায় ভিতরে রক্ষিত ফলের শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করে।

কলার ক্ষেত্রে

  •  ৪০×৩২×৩০.৫ সেমি, ৭ প্লাই
  • ধারণ ক্ষমতা : ১০-১২ কেজি কলা
  • শক্তিবহন ক্ষমতা (লোড বিয়ারিং ক্যাপাসিটি) : ৭০-৮০ কেজি
  • মূল্য: ৪৫ টাকা।

পেঁয়ারার ক্ষেত্রে

  • ৫১.৩×৩০×৩০ সেমি, ৭ প্লাই
  • ধারণ ক্ষমতা ১৮-২০ কেজি
  • শক্তিবহন ক্ষমতা (লোড বিয়ারিং ক্যাপাসিটি) : ৭০-৯০ কেজি
  • মূল্য: ৬০ টাকা ।