Category Archives: বাউবি বিএই ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন

বাউবি বিএই ২৩০৪ গৃহপালিত পশুপালন

ছাগলের বাচ্চা পালন

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-ছাগলের বাচ্চা পালন।

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • কীভাবে নবজাত ছাগলের বাচ্চার যত্ন নিতে হয় তা বুঝিয়ে বলতে পারবেন।
  • শালদুধ কী তা লিখতে পারবেন।
  • বাচ্চা ছাগলের পালন পদ্ধতি বর্ণনা করতে পারবেন ।
  • বাচ্চা ছাগলের দুধ ছাড়ানোর সঠিক সময় বলতে ও লিখতে পারবেন।
  • বাচ্চা ছাগল ব্যবস্থাপনা ব্যাখ্যা করতে পারবেন ।

ছাগলের বাচ্চা পালন

 

নবজাত বাচ্চা ছাগলের (newborn kid) সঠিক যত্নের ওপরই এদের বেড়ে ওঠা ও ভবিষ্যৎ উৎপাদন নির্ভর করে। নবজাত বাচ্চার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না বলে এরা অত্যন্ত রোগ সংবেদনশীল হয়। এমতাবস্থায় সামান্য যত্নের অভাবে বাচ্চার মৃত্যু ঘটতে পারে। তাই সুস্থ সবল বাচ্চা পেতে হলে যেমন গর্ভাবস্থায় ছাগীর সুষ্ঠু যত্ন ও পর্যাপ্ত খাদ্যের প্রয়োজন তেমনি প্রসবকালীন ও নবজাত বাচ্চার যত্ন নেয়া আবশ্যক। প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলে গর্ভবর্তী ছাগীকে বিশেষ নজরে রাখতে হবে এবং কোনো অসুবিধা দেখা দিলে সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

স্বাভাবিক অবস্থায় সাধারণত কোনরূপ সাহায্য ছাড়াই বাচ্চা প্রসব হয়। তবে গর্ভস্থ বাচ্চার বা ছাগীর জননতন্ত্রের অস্বাভাবিক অবস্থায় প্রসবকালে বিঘ্ন ঘটে। এমতাবস্থায় নিজে টানাটানি করে বাচ্চা প্রসব করানো ঠিক নয়। বরং সঙ্গে সঙ্গে পশু চিকিৎসক বা ভেটেরিনারি সার্জনের (Veterinary Surgeon) শরণাপন্ন হওয়া উচিত। ছাগী সাধারণত একাধিক বাচ্চা প্রসব করে। প্রথম বাচ্চা প্রসবের ১৫-২০ মিনিট পর সাধারণত দ্বিতীয় এবং একই সময় অন্তর পরবর্তী বাচ্চা প্রসব করে। তাই প্রথম বাচ্চা প্রসবের পর তেমন ব্যস্ত তার প্রয়োজন হয় না। জন্মের সময় পুরুষ বাচ্চা গুলো সাধারণত ওজনে স্পী বাচ্চা গুলোর থেকে বড় হয়। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাচ্চা গুলো জন্মের সময় গড়ে প্রায় এক কিলোগ্রাম হয়ে থাকে

নবজাত বাচ্চা ছাগলের যত্ন

নিম্নলিখিতভাবে নবজাত বাচ্চা ছাগলের যত্ন নিতে হয়-

১) বাচ্চার শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করা :

বাচ্চা প্রসবের পরপরই বাচ্চার নাক ও মুখের লালা (saliva) এবং শ্লেষ্মা (mucus) পরিষ্কার করে দিতে হবে। নতুবা শ্বাস বন্ধ হয়ে বাচ্চার মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। বাচ্চা জন্ম নেয়ার পর শ্বাসপ্রশ্বাস না নিলে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে বাচ্চার

জিহ্বায় সুড়সুড়ি বা নাড়াচাড়া দিলে কাশি দিতে চাইবে যা শ্বাসতন্ত্র কে কার্যকরী করতে সাহায্য করবে। তাছাড়া বাচ্চার বুকের পাঁজরের হাড়ে আস্তে আস্তে বার কয়েক চাপ দিলেও শ্বাসপ্রশ্বাস চালু হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও বাচ্চার নাক-মুখে ফুঁ দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করা যায়।

২) বাচ্চার শরীর পরিষ্কার করা ও শুকানো :

প্রসবের পর ছাগী তার বাচ্চার শরীর, মুখ প্রভৃতি জিহ্বা দিয়ে চেটে পরিষ্কার করে দেয়। প্রথম প্রসবের ক্ষেত্রে অনেক সময় ছাগী বাচ্চার গা চাটে না। এক্ষেত্রে বাচ্চার গায়ে একটু লবণ ছড়িয়ে দিলেই চাটতে থাকবে।

এতেও কাজ না হলে পরিষ্কার কাপড়, চট বা নরম খড় দিয়ে বাচ্চার পুরো শরীর ভালোভাবে মুছে পরিষ্কার করে দিতে হবে। কোনোক্রমেই নবজাত বাচ্চার শরীর পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না। এতে ঠান্ডা লেগে বাচ্চা মারা যেতে পারে। শীতে বাঅতিরিক্ত ঠান্ডায় শুকনো কাপড় বা চট দিয়ে বাচ্চাকে ঢেকে দিতে হবে। এছাড়াও আগুন জ্বেলে বাচ্চার শরীর গরম রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৩) বাচ্চার নাভি রজ্জু (Navel cord) কাটা :

বাচ্চার নাভি রজ্জু দেহ থেকে ২.৫-৫.০ সে.মি. বাড়তি রেখে পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত কাঁচি দিয়ে কেটে দিতে হবে। কাটার পর উক্ত স্থানে টিঙ্কচার আয়োডিন বা টিঙ্কচার বেনজয়িন নামক জীবাণুনাশক ওষুধ লাগাতে হবে। ফলে নাভি রজ্জু দিয়ে দেহে রোগজীবাণু প্রবেশ করতে পারবে না। নাভী রজ্জু বেধে না দেয়াই ভালো।

৪) বাচ্চাকে শালদুধ বা কলস্ট্রাম (Colostrum) পান করানো :

জন্মের পর কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত বাচ্চার কোনো খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। সুস্থ সবল বাচ্চা জন্মের ১৫-২০ মিনিট পর থেকেই দাঁড়ানোর চেষ্টা করে এবং প্রথম দুধ অর্থাৎ শালদুধ বা কলস্ট্রাম পান করতে সক্ষম হয়। বাচ্চার জন্মের ১-২ ঘণ্টার মধ্যেই এ দুধ পান করানো উচিত। তবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ দুধ পান করাতে হবে। যদি দুর্বলতার কারণে বাচ্চা। দাঁড়াতে বা দুধ পান করতে না পারে তবে ছাগী থেকে দুধ দোহন করে তা বোতলে ভরে চুষির (nipple) সাহায্যে পান করাতে হবে।

অনুশীলন (Activity) : ধরুন, আপনার খামারে একটি ছাগী বাচ্চা দিয়েছে। কীভাবে নবজাত বাচ্চাটির যত্ন নিবেন তা ধারাবাহিকভাবে লিখুন ।

 

 

শালদুধ বা কলস্ট্রাম কী

বাচ্চা জন্মের পর ছাগী থেকে প্রথম যে দুধ পাওয়া যায় তা শালদুধ বা কলস্ট্রাম নামে পরিচিত। নবজাত বাচ্চার প্রথম খাবার হিসেবে শালদুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুধ জন্মের দিন থেকে অন্তত ৩-৪ দিন বয়স পর্যন্ত বাচ্চাকে পান করাতে হবে। শালদুধের রঙ হলুদ এবং এই দুধ আঠালোviseous) হয়।

গরম করলে কলস্ট্রাম জমাট বেধে যায়। স্বাভাবিক দুধের তুলনায় শালদুধে ৩-৫ গুণ বেশি আমিষ থাকে। এই আমিষের অধিকাংশই গ্লোবিউলিন (globulin) নামক আমিষ যা রোগপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডিসমৃদ্ধ (antibody)। নবজাত বাচ্চার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শালদুধ এদেরকে রোগের কবল থেকে রক্ষা করে।

স্বাভাবিক দুধের থেকে শালদুধে ৫-১৫ গুণ বেশি ভিটামিন-এ থাকে। বাচ্চার স্বাভাবিক স্বাস্থ্যরক্ষা ও দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজপদার্থগুলোও এই দুধে যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। শালদুধ কোষ্ঠ পরিষ্কারক (laxative), তাই নবজাত বাচ্চার পরিপাকতন্ত্রে যে হলুদ বর্ণের বিপাকজাত মল জমে থাকে তা বের করে দিয়ে খাদ্য অন্ত কে পরিষ্কার করে। নবজাত বাচ্চা কোনো কারণে মাতৃহারা হলে সাধারণ দুধের সঙ্গে ডিমের সাদা অংশ বা অ্যালরুমেন (albumen), এক চামচ কড লিভার তেল (cod liver oil) ও এক চামচ পানি মিশিয়ে বিকল্প বা কৃত্রিম কলস্ট্রাম তৈরি করে পান করানো যায়।

বাচ্চা পালন পদ্ধতি

দু’টো পদ্ধতিতে ছাগলের বাচ্চা পালন করা হয়। যথা- ১. প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মায়ের সঙ্গে রেখে ও ২. কৃত্রিম পদ্ধতিতে মা থেকে পৃথক অবস্থায় হাতে পালন (artificial rearing)। প্রতিটি পদ্ধতিরই কিছু কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। তবে, এদেশে প্রাকৃতিক পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এই পদ্ধতিতে বাচ্চাকে মায়ের সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়।

ফলে বাচ্চা নিজের ইছে এবং প্রয়োজনমতো মায়ের কাছ থেকে দুধ পান করতে পারে। কৃত্রিমভাবে মা থেকে পৃথক অবস্থায় হাতে পালনের ক্ষেত্রে দু’টো পদ্ধতি প্রচলিত। একটি পদ্ধতিতে বোতলের মাধ্যমে (bottle feeding) এবং অন্যটিতে বালতির মাধ্যমে (pan feeding) বাচ্চাদের দুধ পান করানো হয়।

বাচ্চারা সহজেই এসব পদ্ধতিতে দুধ পানে অভ্যস্ত হয়ে যায়। দুপদ্ধতির মধ্যে বোতল পদ্ধতিটিই অপেক্ষাকৃত ভালো ও সুবিধাজনক। কারণ, বাচ্চা বোতলের নিপল চুষে দুধ পান করলে তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের উদ্দীপনার (stimulation) সৃষ্টি হয়। এতে সহজেই লালা (saliva) তৈরি হয় যা দুধ হজমে সাহায্য করে। অনেক সময় শিশু অবস্থায় মা মারা গেলে ধাত্রী মায়ের (foster mother) দুধ পান করানোর পদ্ধতিও এদেশে প্রচলিত আছে।

মা থেকে বাচ্চা আলাদা করা

মা ছাগল থেকে বাচ্চা আলাদা করা নির্ভর করে কোন্ উদ্দেশ্যে ছাগল পালন করা হচ্ছে তার ওপর। যেমন- মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হলে বাচ্চাকে বেশি দিন পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করাতে হবে। আমাদের মতো গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে সাধারণত ৩ মাস বয়সের পূর্বে এই ধরনের বাচ্চা ছাগল মা থেকে আলাদা করা ঠিক নয়। তবে, যেসব ছাগল বেশি দুধ দেয় তাদের ক্ষেত্রে বাচ্চাকে ৩-৪ দিন কলস্ট্রামসমৃদ্ধ দুধ পান করানোর পর আলাদা করে নেয়া যেতে পারে এবং এক্ষেত্রে বোতল দিয়ে দুধ পানের অভ্যাস করাতে হবে।

 

বাচ্চা ছাগল ব্যবস্থাপনা

সাধারণত দু’সপ্তাহ বয়স থেকেই বাচ্চারা কাঁচা ঘাস বা লতাপাতা খেতে আরম্ভ করে। তাই এদের নাগালের মধ্যে কিছু কিছু কচি ঘাস, লতাপাতা এবং দানাদার খাদ্য রাখতে হয়। এতে এরা আস্তে আস্তে কঠিন খাদ্য খেতে অভ্যস্ত হয়। এসময় বাচ্চাদের জন্য প্রচুর উন্মুক্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

গ্রীষ্মকালে দিনের বেলা গাছের নিচে পরিমাণমতো জায়গায় বেড়া দিয়ে বাচ্চা পালন করা যায় । এতে এরা একদিকে পর্যাপ্ত ছায়া পেতে পারে। অন্যদিকে, দৌড়াদৌড়ি এবং ব্যয়াম করারও প্রচুর সুযোগ পায় যা তাদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য অত্যন্ত দরকারী। প্রতিটি বাচ্চা ছাগলকে জন্মের প্রথম সপ্তাহে দৈনিক ৩০০-৩২৫ মি.লি. দুধ ৩-৪ বারে পান করাতে হবে। ধীরে ধীরে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৬-৭ সপ্তাহে তা ৭৫০-৮৫০ মি.লি.-এ উন্নীত করতে হবে।

দুধের বিকল্প খাদ্য ৩ সপ্তাহ বয়সের পর খেতে দেয়া যেতে পারে। ৩ সপ্তাহ থেকে ৩ মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চাকে দিনে দুবেলা দুধ বা দুধের বিকল্প খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। ১০-১১ সপ্তাহে দৈনিক দুধ সরবরাহের পরিমাণ ২০০-১০০ মি.লি. নামিয়ে আনতে হবে।

এসময় দৈনিক ৩০০-৩৫০ গ্রাম দানাদার খাদ্য ও প্রচুর কচি ঘাস, লতাপাতা সরবরাহ করতে হবে। ৩-৪ মাস বয়সে দুধ পান করানো পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ, এসময় বাচ্চা বড় হয়ে যায় এবং কঠিন খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার জন্য এদের পাকস্থলী পুরোপুরিভাবে তৈরি হয়ে যায়।

প্রজননের কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্য না থাকলে ২-৩ মাস বয়সেই পুরুষ বাচ্চাগুলোকে খাসি করে দিতে হবে। কারণ, এটা প্রমাণিত সত্য যে, খাসি করলে মাংসের গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। অন্যথায় এদেরকে স্পী বাচ্চার (doe kid) কাছ থেকে আলাদা করে পালন করতে হবে ।

শরৎ ও হেমন্ত কালে ছাগলের মৃত্যুহার অত্যধিক বেশি থাকে। এসময় কৃমির আক্রমণ দেখা দিতে পারে। তাছাড়া নিউমোনিয়া (Pneumonia) এবং এন্টারোটক্সিমিয়া (Enterotoxaemia) ব্যাপক হারে দেখা দিতে পারে। তাই এসময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বাচ্চার বয়স দু’সপ্তাহ হলে প্রথম বার এবং দু’মাস পূর্ণ হলে দ্বিতীয় বার নির্ধারিত মাত্রায় কৃমির ওষুধ সেবন করাতে হবে ।

 

ছাগল পালনে বিভিন্ন সুবিধাদি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- ছাগল পালনে বিভিন্ন সুবিধাদি। বিভক্ত খুরবিশিষ্ট (Cloven hooted) রোমন্থক ( ruminant) প্রাণীদের মধ্যে ছাগল ও ভেড়া প্রথম গৃহপালিত পশু। প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে প্রথমে বুনো ভেড়া ও পরে বুনো ছাগলকে পোষ মানানো হয়েছিল। এরা অত্যন্ত উপকারী প্রাণী। এদের দুধ ও মাংস অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। চামড়া, লোম / পশম ও অন্যান্য উপজাত দ্রব্য বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়। ছাগল পালন অত্যন্ত সহজ। এরা আকারে ছোট, তাই জায়গা কম লাগে। এদের রোগব্যাধি গরুর তুলনায় অনেক কম।

এরা অত্যন্ত উৎপাদনশীল; একটি স্পী ছাগল বা ছাগী থেকে বছরে অন্তত চারটি বাচ্চা পাওয়া যায়। তাই ছাগল পালন করে সহজেই লাভবান হওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রধানত ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট (Black Bengal goat)’ বা ‘বাংলার ছাগল’ জাতটিই বেশি পাওয়া যায়। এদেশের ৯৮% ছাগলই গ্রামে পারিবারিকভাবে পালন করা হয়। বেশির ভাগ পালনকারী ভূমিহীন কৃষক। যাদের পক্ষে গাভী কেনা সম্ভব নয়, তারা সহজেই ছাগল কিনে পালন করতে পারেন।

ছাগলকে তাই ‘গরীবের গাভী’ বলা হয়। এদেশের অসংখ্য বেকার ও ভূমিহীন লোক এবং দুঃস্থ মহিলারা ছাগল পালনের মাধ্যমে সহজেই আত্মকর্মসংস্থান করতে পারেন। এই ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে ছাগল পালনে বিভিন্ন সুবিধাদি, বাচ্চা পালন, বাসস্থান ও পরিচর্যা, খাদ্য, রোগব্যাধি দমন, বাচ্চাকে খাসি বানানো প্রভৃতি বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিকসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ছাগল পালনে বিভিন্ন সুবিধাদি

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • ছাগল পালনে বিভিন্ন সুবিধাদি বলতে পারবেন ।
  • ছাগলের দুধ ও মাংসের গুণাগুণ বর্ণনা করতে পারবেন।
  • ছাগলের চামড়া, লোম/পশম এবং অন্যান্য উপজাত, যেমন- হাড়, নাড়িভুঁড়ি, রক্ত, মলমূত্র ইত্যাদি সম্পর্কে লিখতে পারবেন।

ছাগল পালনে সুবিধাদি

  • ছাগল দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। এরা ৬/৭ মাস বয়সেই প্রজননের (breeding) উপযোগী হয়।
  • ছাগী গর্ভবতী হওয়ার প্রায় পাঁচ মাস পরেই বাচ্চা প্রসব করে এবং প্রতিবারে অন্তত ২/৩টি বাচ্চা দেয়। কাজেই একটি ছাগী থেকে বছরে অন্তত চারটি বাচ্চা পাওয়া যায়।
  • ছাগল ছোট প্রাণী; তাই এদের জন্য জায়গা কম লাগে। এরা নিরীহ বলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও পালন করতে পারে। ছাগল পালনে পুঁজি কম লাগে।
  • এটি ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস।
  • যে পরিবেশ বা আবহাওয়ায় গরু মহিষ জীবনধারণ করতে পারে না ছাগল সেখানে সহজেই খাপ খাইয়ে নেয়।
  • গরু মহিষের তুলনায় এদের জন্য খাদ্য কম লাগে।
  • কারণ, ছাগল খাদ্য রূপান্তরে (feed conversion) গরুর থেকে বেশি দক্ষ।
  • এরা বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা, ঘাস, লতা খেয়ে সহজেই জীবনধারণ করতে পারে।
  • গরুর তুলনায় ছাগল রোগব্যাধিতে কম আক্রান্ত হয়।
  • ছাগলের দুধের চর্বির কণিকাগুলো (fat globules) অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ায় গরুর দুধের তুলনায় সহজে হজম হয়।
  • তাই বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য এই দুধ অধিক উপযোগী, উপাদেয় এবং উৎকৃষ্ট।
  • ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর।
  • এগুলো মোলায়েম ও নরম আঁশযুক্ত, তাই সহজে হজম হয়। খাসির মাংস সকল ধর্মের লোকের কাছেই অত্যন্ত প্রিয়।
  • এদেশে ছাগলের মাংসের দাম তুলনাম লকভাবে বেশি বলে বাণিজ্যিকভাবে অধিক লাভজনক।
  • বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়ার গুণগতমান অতি উন্নত, তাই বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক চাহিদা।
  • এই চামড়া রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে ।

ছাগলের দুধ (Goat milk)

এদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল অত্যন্ত অল্প পরিমাণ অর্থাৎ ২৫০-৫০০ মি.লি. দুধ দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, যমুনাপারি ছাগল তুলনামূলকভাবে বেশি দুধ দেয়। তবে, অল্প হলেও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দুধ অত্যন্ত পুষ্টিকর। গুণগতমানে এই দুধ মানুষ বা গরুর দুধের থেকেও সেরা (সারণি ২৫ দেখুন)। গরুর দুধের তুলনায় এই দুধ সহজে হজম হয়।

দুধের চর্বির কণিকা ক্ষুদ্র ও সহজপাচ্য। তাই এই দুধ রোগীদের জন্য পথ্য ও শিশুদের জন্য উপযুক্ত খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। শিশুদের জন্য মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে ছাগলের দুধ গরুর দুধের থেকে বেশি উপযোগী। কারণ, এতে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।

এটি অ্যালার্জিক পদার্থমুক্ত এবং বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। এই দুধে ভিটামিন-এ, নিকোটিনিক অ্যাসিড, কোলিন, ইনসিটল ইত্যাদি বেশি পরিমাণে এবং ভিটামিন-বি, ও ভিটামিন-সি অল্প পরিমাণে রয়েছে। দুধ একটি আদর্শ খাদ্য হলেও গরুমহিষের দুধে ভিটামিন-সি-এর অভাব থাকায় একে মানুষের জন্য একটি সম্পূর্ণ খাদ্য বলা যায় না।

ছাগলের দুধে মানুষ ও গরুর দুধের তুলনায় ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ক্লোরিন বেশি এবং লোহা কম থাকে। এছাড়াও এ দুধে যথেষ্ট পরিমাণে সোডিয়াম, কপার বা তামা ও অন্যান্য খনিজপদার্থ থাকে। কিন্তু এত গুণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে অনেকেই ছাগলের দুধ পছন্দ করেন না। ছাগলের দুধ পানে অনভ্যস্ততা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সহজলভ্য না হওয়াকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

সারণি ২৫ ঃ ছাগী, গাভী ও স্পীলোকের দুধে উপস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের তুলনা

 

ছাগলের মাংস (Goat meat )

ছাগলের মাংস এদেশে খাসির মাংস নামেই বেশি পরিচিত। ইংরেজিতে ছাগলের মাংস চেভন নামে পরিচিত। খাসির মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর প্রাণিজ আমিষজাতীয় খাদ্য। এ মাংস দেখতে অনেকটা কালচে বা গাঢ় লাল (dark red) এবং এতে চর্বি পাতলাভাবে সন্নিবেশিত থাকে।

উন্নত বিশ্বে ছাগলের মাংস তেমন জনপ্রিয় নয়। সেখানে এই মাংস গরীবের মাংস হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই দামে বেশ সস্তা। কিন্তু, বাংলাদেশসহ পাক-ভারত উপমহাদেশে ছাগলের মাংসের অত্যন্ত চাহিদা। গরুর মাংস খেলে যাদের অ্যালার্জি হয় তারা খাসির মাংসের ওপরই বেশি নির্ভর করেন।

ছাগলের মাংস বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদানে ভরপুর (সারণি ২৬ দেখুন)। ৬-১২ মাস বয়সের ছাগলের মাংস উৎকৃষ্ট । এই বয়সের ছাগল থেকে ৪৩-৫৩% মাংস পাওয়া যায়। পাঠার মাংসে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গন্ধ থাকে বলে অনেকেই তা পছন্দ করেন না। বাচ্চা ছাগলের মাংস কিছুটা আঠালো, নরম ও বিশেষ ঘ্রাণযুক্ত হয়। এই মাংস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা যায়। তবে, এদেশের লোকেরা সাধারণত ১৮-২৪ মাস বয়সের চর্বিযুক্ত খাসির মাংস বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু, যাদের হজমশক্তি দুর্বল ও যারা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন তাদের জন্য চর্বিযুক্ত মাংস ক্ষতিকর।

উৎকৃষ্ট মাংসের বৈশিষ্ট্য

  • উৎকৃষ্ট মাংসের মধ্যে রক্তের শিরা-উপশিরাগুলো রক্তশ ন্য থাকবে।
  • মাংসের রঙ কালচে বা গাঢ় লাল হবে ।
  • চর্বি অত্যন্ত তাজা হবে যা ভেড়ার মাংসের ন্যায় আঁশের ভাঁজে ভাঁজে থাকবে না।
  • বরং মাংসের উপরে একটা পাতলা আবরণের মতো থাকবে। চর্বি সাদা থেকে হলুদ বর্ণের হতে পারে।
  • মাংসের মধ্যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক গন্ধ থাকবে না ।
  • মাংস তাজা ও উজ্জ্বল হবে।
সারণি ২৬ : ছাগলের মাংসে উপস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ

 

ছাগলের চামড়া (Goat skin)

ছাগলের চামড়া অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এই চামড়াতে সারবস্ত্র ও দানাদার অংশ ভেড়ার চামড়ার তুলানায় বেশি থাকে। ছাগলের লোম ভেড়ার পশমের মতো পেঁচানো বা কোঁকড়ানো নয় এবং এদের গোড়া ভেড়ার মতো চামড়ার বেশি গভীরে প্রবেশ করে না। ফলে চামড়া পাকা করার পর লোমের গোড়া শোষক বা স্পঞ্জি (spongy) হিসেবে চামড়ার মধ্যে থেকে যায় না। তাই চামড়ার মান হয় অতি উন্নত। ছোট, রেশমি ও সুন্দর লোমে আবৃত চামড়া বড়, লম্বা ও রুক্ষ লোমে আবৃত চামড়া থেকে বেশি উন্নতমানের হয়।

সাধারণত মাংস উৎপাদনের জন্য পালিত ছাগল থেকে ভালোমানের চামড়া পাওয়া যায়। অধিক চর্বিযুক্ত ও মোটাসোটা ছাগলের তুলনায় কম চর্বিযুক্ত ছিপছিপে ছাগলের চামড়া উৎকৃষ্ট। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে একটি ছাগলের চামড়ার মূল্য প্রাণীটির মূল্যের ৫-১০% হয়ে থাকে। তাই চামড়া ছাড়ানোর সময় যত্নবান হতে হবে যেন তা কেটে না যায়।

জাতভেদে একটি পূর্ণবয়স্ক ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার পর ০.৭৫-২.০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত ৯-১৮ মাসবয়সের ছাগলের চামড়া থেকে ভালোমানের জুতো, ব্যাগ, সুটকেস, পরিধেয় বস্ত, জ্যাকেট, তাবু ইত্যাদি তৈরি হয়।

কিন্তু দস্তানা তৈরি, বই বাঁধানো প্রভৃতি কাজের জন্য ৬ মাস বয়সের ছাগলের চামড়া ভালো।বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের গায়ের লোম ছোট, মসৃণ ও নরম। তাই চামড়া নরম, পুরু ও উন্নতমানের। চামড়ার তন্ত্র (fibre) অত্যন্ত ঘনভাবে সন্নিবেশিত থাকে এবং চামড়া অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক (elastic) হয়। এই চামড়া যে কোনো আবহাওয়ায় বেশি দিন টিকে। আর্দ্র জলবায়ু এবং

পানিতেও সহজে নষ্ট হয় না। এসব কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়ার চাহিদা বিশ্ববাজারে অত্যন্ত বেশি। তবে, চামড়ার সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা উন্নত করতে পারলে চাহিদা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে ।

অনুশীলন (Activity) ঃ কোন্ ধরনের ছাগলের চামড়া বেশি ভালো তা যুক্তিসহকারে লিখুন।

ছাগলের লোম/পশম (Hair fleece )

বিভিন্ন জাতের ছাগল থেকে বিভিন্ন ধরনের লোম (hair) উৎপন্ন হয়। কোনো কোনো জাতের ছাগল, যেমন- অ্যাংগোরা ও কাশ্মিরির পশম (fleece or wool) থেকে ভেড়ার উলের থেকেও উন্নতমানের উল উৎপন্ন হয়। এগুলো যথাক্রমে মোহেয়ার (mohair) ও পশমিনা (pashmina) নামে পরিচিত।

লোম ও পশম কিন্তু এক জিনিস নয়। সাধারণত ভেড়ার লোমকেই উল বলে (ব্যতিক্রম- অ্যাংগোরা ও কাশ্মিরি ছাগলের উল)। পশমের পৃষ্ঠতল খাঁজকাটা, এগুলো কোঁকড়ানো বা ঢেউ খেলানো ও অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক। পশমের অভ্যন্তর ভাগে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ রয়েছে। পক্ষান্তরে লোমের পৃষ্ঠতল মসৃণ, এগুলো কোঁকড়ানো নয় এবং স্থিতিস্থাপকও নয়।

জাতভেদে ছাগলের লোম / পশম খাটো বা লম্বা এবং নানা বর্ণের হতে পারে। এসব লোম / পশম থেকে কার্পেট, কম্বল, মূল্যবান শীতের পোষাক, বিখ্যাত কাশ্মিরি শাল, এমনকি, রশিও তৈরি করা হয়। এদেশে ছাগলের লোম কোনো কাজেই ব্যবহার করা হয় না। অথচ এগুলো বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ছাগলের লোম/পশম রপ্তানির ক্ষেত্রে পাকিস্তান শীর্ষস্থানীয় ।

মোহেয়ার :

তুরস্কের অ্যাংগোরা জাতের ছাগল থেকে প্রাপ্ত সাদা, নরম, উজ্জ্বল ও উন্নত গুণসম্পন্ন সুতোর মতো পশমই মোহেয়ার নামে পরিচিত। এগুলো ১০-২৫ সে.মি. লম্বা হয়। দামি চাদর ও কম্বল তৈরিতে মোহেয়ার ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি ছাগল থেকে বছরে ২.৫-৪.৫ কেজি মোহেয়ার পাওয়া যায়।

পশমিনা :

কাশ্মিরি ছাগলের লোমকে পশমিনা বলা হয়। পশমিনা মোটা ও রঙিন হতে পারে। এগুলো দেখতে উলের মতোই । তবে আকারে লম্বা, গড়ে ২.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। প্রতিটি ছাগল থেকে বছরে গড়ে ১০০-১২০ গ্রাম পশমিনা উৎপন্ন হয়। উৎপাদন কম বলে দাম অনেক বেশি। পশমিনা সূক্ষ্মতা বা মিহিত্বের (fineness) জন্য বিখ্যাত।

অনুশীলন ( Activity) : ধরুন, আপনাকে পশম ও উল দুটোই দেয়া হলো। কীভাবে আপনি এদের মধ্যে পার্থক্য করবেন তা খাতায় লিখুন।

 

হাড় ও নাড়িভুঁড়ি (Bones and offals)

ছাগলের দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রাপ্ত হাড় গুঁড়ো করার পর তা প্রক্রিয়াজাত করে হাঁসমুরগি ও গবাদিপশুকে খাওয়ানো যেতে পারে। হাড়ের গুঁড়ো উৎকৃষ্টমানের সার হিসেবেও জমিতে ব্যবহার করা যায়। হাড়ের গুঁড়ো, নাড়িভুঁড়ি ও মানুষের খাবার অনুপযোগী মাংস দিয়ে হাঁসমুরগি, কুকুরবিড়াল প্রভৃতির খাদ্য তৈরি করা যায়। তবে, পশুপাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার পূর্বে এগুলোকে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।

রক্ত (Blood)

রক্তে রয়েছে উন্নতমানের আমিষ ও খনিজদ্রব্য। রক্ত থেকে তৈরি ‘ব্লাড মিল (blood meal)’ গবাদিপশু, হাঁস, মুরগি ও কোয়েলের খাদ্যতালিকা বা রেশন (ration) তৈরিতে সহজেই ব্যবহার করা যায়। তবে, খাদ্যতালিকায় ব্লাড মিলের পরিমাণ ২-৩%-এর বেশি থাকা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সঠিকভাবে না হলে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। ফলে এই খাদ্য খেয়ে পশুপাখি রোগাক্রান্ত ও হতে পারে ।

মলমূত্র (Urine and feces)

ছাগলের মলমূত্র বা গোবর ও চনা মূল্যবান জৈব সার। এগুলো জমির উর্বরতা বাড়ায়। কারণ, এতে পটাশ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস উল্লেখযোগ্য পরিমাণে থাকে। সবুজ সার হিসেবে গোবর ও চনা বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় ।

 

গাভীর দানাদার খাদ্য প্রস্তুত করা (duplicate)

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- গাভীর দানাদার খাদ্য প্রস্তুত করা। যেসব খাদ্যে আয়তনের তুলনায় খাদ্যমান অপেক্ষাকৃত বেশি এবং সহজপাচ্য তাকে দানাদার খাদ্য বলা হয়। দানাদার গোখাদ্যগুলো হলো চালের কুঁড়া গমের ভুসি, ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকার খৈল, কলাই, ছোলা, খেসারি, সয়াবিন ও শুকনো মাছের গুঁড়া এসব। আমিষের পরিমাণ ভিত্তিতে দানাদার খাদ্যগুলো তিন ভাগে করা যায়। ক. কম আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন- কুঁড়া, ভুসি (৫-১৫% আমিষ)। খ. মধ্যম আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য যেমন- খৈল, কলাই, ছোলা ২০-২৫% আমিষ। গ. উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য শুকনো মাছের গুঁড়া, কসাই খানার মাংসের কণা, রক্তের গুঁড়া ৩৫-৪৫% আমিষ।

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • বিভিন্ন খাদ্য উপকরণ আনুপাতিক হারে মিশিয়ে দুগ্ধবতী গাভীর জন্য দানাদার খাদ্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

 

 গাভীর দানাদার খাদ্য প্রস্তুত করা

 

প্রাসঙ্গিক তথ্য

দুগ্ধবতী গাভীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপকরণ ও খাদ্যতালিকাসম হ তাত্ত্বিক পাঠে (পাঠ ৫.৩) আলোচনা করা হয়েছে। খাদ্য তৈরির পদ্ধতি সব গাভীর জন্যই একই রকম। তবে, পালন পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতার কারণে খাদ্য উপকরণগুলোর পরিমাণ কমবেশি হয়ে থাকে। এই পাঠে দুগ্ধবতী গাভীর দানাদার -খাদ্য প্রস্তুত করার একটি নমুনা দেখানো হয়েছে।

 

 

দুগ্ধবতী গাভীর জন্য ১০ কেজি দানাদার -খাদ্যের প্রস্তুত প্রণালী

প্রয়োজনীয় উপকরণ

এজন্য সারণি ২৪-এ উল্লেখিত পরিমাণ খাদ্য উপকরণ বিভিন্ন পাত্রে সংগ্রহ করুন। তাছাড়া কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা, একটি ছালার বস্তা ইত্যাদিরও প্রয়োজন হবে।

সারণি ২৪ : দুগ্ধবতী গাভীর দানাদার -খাদ্যের উপকরণসম হের পরিমাণ

 

কাজের ধাপ

  • প্রথমে ঘরের শুকনো মেঝে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করুন।
  • পরিমাণে কম এমন উপকরণগুলো, যেমন- খনিজপদার্থ, খাদ্য লবণ প্রভৃতি একসঙ্গেভালোভাবে মেশান ।
  • এরপর অন্যান্য উপকরণগুলোও পর্যায়ক্রমে একত্রে ভালোভাবে মেশান।
  • এই মিশ্রণের সঙ্গে পূর্বে মিশ্রিত খণিজ পদার্থ ও খাদ্য লবণের মিশ্রণ যোগ করুনও ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
  • সমস্ত মিশ্রণটি বস্তায় ভরে মজুদ করুন এবং সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী দুগ্ধবতী গাভীকে খেতে দিন।
  • কাজের ধাপগুলো ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিখুন ও শিক্ষককে দেখান।

 

সাবধানতা

  • ভেজা, স্যাঁতস্যাতে বা অপরিচ্ছন্ন স্থানে খাদ্য মিশ্রিত করবেন না।
  • খাদ্য মিশ্রণ করার পূর্বে অবশ্যই খাদ্য উপকরণের গুণাগুণ পরীক্ষা করে নিন।
  • ভেজা বা ছত্রাকযুক্ত ও দুষিত খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করবেন না।

 

 

গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ও রোগপ্রতিরোধ পদ্ধতি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ও রোগপ্রতিরোধ পদ্ধতি।

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালনের বিধিব্যবস্থাগুলোর নাম লিখতে পারবেন।
  • গাভীর প্রজনন ও প্রসবে নির্জীবাণু পদ্ধতি অবলম্বনের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে লিখতে পারবেন ।
  • কীভাবে অসুস্থ গাভীকে সুস্থগুলোর থেকে পৃথক করবেন ও মৃত গাভীর সৎকার করবেন তা বলতে ও লিখতে পারবেন।
  • নাম, ব্যবহার মাত্রা, প্রয়োগ পদ্ধতি ও সময়সহ গাভীর বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।

গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ও রোগপ্রতিরোধ পদ্ধতি

গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন বিষয়ে ইতোমধ্যেই গাভীর বাসস্থান ও পরিচর্যা পাঠ থেকে আমরা কিছুটা জেনেছি। এই পাঠে গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন বলতে এমন কতগুলো স্বাস্থ্যগত বিধিব্যবস্থাকে বোঝায় যা এযাবৎকাল সারা পৃথিবীতে পশুসম্পদ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এগুলো হলো-

১. বাসস্থান নির্মাণে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা ও দুর্যোগ নিবারণ করা,

২. খাদ্য ও পানির পাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা,

৩. প্রজনন ও প্রসবে জীবাণুমুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা,

৪. মলমূত্র নিষ্কাশন করা,

৫. অসুস্থ গাভী পৃথকীকরণ ও মৃত গাভীর সৎকার,

৬. নিয়মিত কৃমিনাশক ব্যবহার করা,

৭. সংক্রামক ব্যাধির প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করা ইত্যাদি ।

এখানে এগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

 

 

১. বাসস্থান নির্মাণে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা ও দুর্যোগ নিবারণ করা

গোশালা এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে যাতে গাভীর জন্য পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকে। একই সাথে এতে গাভীকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করারও ব্যবস্থা থাকতে হবে। যে কোনো মধ্যম আকারের গাভী প্রতিদিন ৯০.১ কেজির (২০০ পাউন্ড) অধিক বাতাস গ্রহণ করে।

প্রশ্বাসকৃত বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের (CO2) আধিক্য ০.০৩% থেকে ৫.৫৩%-এ উন্নীত হয়। আর অক্সিজেনের পরিমাণ ২০.৯৪% থেকে ১৪.২৯%-এ কমে যায়। একটি গাভী থেকে অন্যটি কমপক্ষে ১.৫ মিটার (৫ ফুট) দূরে রাখা উচিত। গোশালা নির্মাণের সময় এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখা একান্তপ্রয়োজন। গোশালার জায়গা বরাদ্দও এই ভিত্তিতেই করতে হবে। এতে গাভীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

২. খাদ্য ও পানির পাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা

খাদ্য ও পানির পাত্র সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কারণ, পাত্র অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা থাকলে এতে সহজেই বিভিন্ন রোগজীবাণু বাসা বাধবে ও ফলে গাভীর রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। কাজেই এই দিকটায় বিশেষ নজর দিতে হবে।

৩. প্রজনন ও প্রসবে জীবাণুমুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা

প্রজনন ও প্রসবের মাধ্যমে গাভীতে রোগব্যাধি ছড়াতে পারে। সাধারণত প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ষাঁড়ের অনেক কমে যায়। কিন্তু তা যদি নির্জীবাণু পদ্ধতিতে করা না হয় তাহলে রোগব্যাধি ছড়াতে পারে,
মাধ্যমে প্রজনন করালে এই সম্ভাবনাটা বেশি থাকে।

কৃত্রিম প্রজননে রোগব্যাধি ছড়ানোর প্রকোপ বিশেষ করে যৌন রোগসমূহ। সুতরাং কৃত্রিম প্রজননের প্রতিটি পদক্ষেপ নির্জীবাণু পদ্ধতিতে করতে হবে। তবেই যৌনব্যাধি ছড়ানো বন্ধ হতে পারে। তাছাড়া প্রসবকালেও যথারীতি ধাত্রীবিদ্যার নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। তা না হলে গাভী রোগজীবাণু কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে। প্রতিটি ডেয়রি ফার্ম বা পারিবারিক দুগ্ধ খামারে জীবাণুমুক্ত ধাত্রীকক্ষ রাখতে হবে।

নির্জীবাণু পদ্ধতি ব্যবহারের সর্বোত্তম পন্থা হলো পরিষ্কার ও ফুটানো পানি দিয়ে যন্ত্র পাতি ধৌত করা। বাণিজ্যিকভিত্তিতে পরিচালিত বড় দুগ্ধ খামারগুলোতে অটোক্লেভ (autoclave) নামক যন্ত্র দিয়ে যন্ত্র পাতি জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা হয় ।

 

 

৪. মলমূত্র নিষ্কাশন করা

ডেয়রি ফার্ম বা পারিবারিক দুগ্ধ খামার যেখানেই গাভী লালনপালন করা হবে সেখানেই মলমূত্র নির্গমণ ও নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। গাভীর বাসস্থানে সেরকম নর্দমা ও পয়ঃপ্রনালী তৈরি করতে হবে যাতে মলমূত্র উপজাত হিসেবে সার বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করা যায়।

প্রতিদিন অন্তত একবার পানি ঢেলে গোশালা পরিষ্কার করতে হবে। মাসে অন্তত একবার জীবাণুনাশক ওষুধ, যেমন- ফিনাইল (phenyle) বা আয়োসান ( iosan) দিয়ে শোধন করতে হবে । এতে মলমূত্র থেকে গাভীতে রোগব্যাধি ছড়ানো ও পরিবেশ দুষিত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।

৫. অসুস্থ গাভী পৃথকীকরণ ও মৃত গাভীর সৎকার করা

যে কোনো দুগ্ধ খামারে মৃত গাভীর সৎকার করার যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে। গাভী কোনো সংক্রামক রোগে মারা গেলে তার সৎকার প্রয়োজন। মৃত গাভীর শবদেহ মাটির ০.৫ মিটার নিচে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে এবং উপরিভাগে চুন বা ডি.ডি.টি. (D.D.T.) ছড়িয়ে শোধন করতে হবে।

আর অসুস্থ গাভীগুলোকে আলাদা কক্ষে রাখা উচিত, বিশেষ করে অসুখটি যদি কোনো সংক্রামক ব্যাধি হয়। ছোঁয়াচে গর্ভপাত বা ব্রুসেলোসিস রোগ হলে তা স্বাস্থ্যসম্মত বিধিব্যবস্থা দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ছোঁয়াচে গর্ভপাত গাভীর একটি মারাত্বক ব্যাধি। স্যাঁতস্যাঁতে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই রোগের বিস্তার ঘটে। এই রোগের উৎস সব সময়ই কোনো না কোনো প্রসূতি গাভী। প্রসূতি কক্ষে কোনো গাভী থাকাকালীন ৩-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত অন্য সুস্থ গাভীর সংশ্রবে আনা যাবে না।

একাধিক গাভী প্রসূতি হলে ঘরের মধ্যে বেড়া দিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে। বাচ্চা প্রসবের পরে প্রসূতি কক্ষগুলো পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে শোধন করতে হবে। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো ওষুধ দেয়া যেতে পারে ।

৬. নিয়মিত কৃমিনাশক ব্যবহার করা

কৃমির ডিম যত্রতত্র বেঁচে থাকার জন্য বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষ উপযোগী। বিভিন্ন ধরনের মাছি, মশা, উকুন, আটালি, অন্যান্য কীটপতঙ্গ ও শামুক কৃমিসহ বেশ কিছু রোগের বাহক। এরা নিজেরাই আবার পরজীবী হিসেবে গাভীর দেহে আশ্রয় নিয়ে বেশ কিছু রোগ সৃষ্টি করে।

সুতরাং বহিঃ ও অন্তঃ উভয় পরজীবীর বিরুদ্ধেই কৃমিনাশক ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়, বিশেষ করে যকৃৎ ও অন্ননালীর কৃমির জন্য তো বটেই । এছাড়াও রয়েছে কতগুলো এককোষী পরজীবী। বিভিন্ন প্রজাতির কৃমির বিরুদ্ধে কাজ করে এমন কৃমিনাশক ওষুধ নিকটস্থ ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো নিয়মিত ব্যবহার করে গাভীর কৃমি দমন করা যায় ।

৭. সংক্রামক ব্যাধির প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করা

গাভীর সংক্রামক ব্যাধির মধ্যে খুরা রোগ (foot and mouth disease), তড়কা ( anthrax), বাদলা (black quarter), গলাফোলা (haemorrhagic Septicaenia), সংক্রামক গর্ভপাত (brucellosis), জলাতঙ্ক (rabies) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ম্যাস্টাইটিস (mastitis) বা ওলানপ্রদাহ দুগ্ধবতী গাভীর একটি অতি সাধারণ রোগ। উপরোক্ত রোগগুলোর প্রতিষেধক বা টিকা সরকারীভাবে এদেশে তৈরি হয় এবং তা বিভিন্ন পশু হাসপাতাল ও ডিপেনসারিতে সরবরাহ করা হয়।

কাজেই নিকটস্থ ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো গাভীকে নিয়মিত এসব সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা দেয়া পশু রোগ নিবারণের সর্বোত্তম পন্থা। অবশ্য ওলানপ্রদাহের কোনো প্রতিষেধক টিকা নেই। এজন্য ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো চিকিৎসা করাই উত্তম ।

সারণি ২৩-এ বাংলাদেশে প্রস্তুত গাভীর বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকার নাম, ব্যবহার মাত্রা, প্রয়োগ পদ্ধতি ও সময় উলে-খ করা হয়েছে।

সারণি ২৩ ঃ বাংলাদেশে প্রস্তুত গাভীর বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকার নাম, ব্যবহার মাত্রা, প্রয়োগ পদ্ধতি ও সময়

 

বাছুরের দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ তৈরি করা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- বাছুরের দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ তৈরি করা

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • হিসাবনিকাশ করে বাছুরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ খাদ্যের মিশ্রণ- তৈরি করতে পারবেন।

শতকরা ২০ ভাগ আমিষসমৃদ্ধ একটি দানাদার খাদ্য মিশ্রণ -তৈরি করা।

বাছুরের দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ তৈরি করা

প্রাসঙ্গিক তথ্য

এই খাদ্য মিশ্রণ -তৈরির জন্য হিসাবকরণ, খাদ্য নমুনা মিশ্রণ ও খাদ্য সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধরুন, আপনার হাতে গম ভাঙ্গা, গমের ভুশি, তিলের খৈল, শুটকি মাছের গুঁড়ো, ঝিনুকের পাউডার ও লবণ আছে। এই খাদ্যগুলো দিয়ে শুষ্ক পদার্থের ভিত্তিতে শতকরা ২০ ভাগ আমিষসমৃদ্ধ একটি দানাদার খাদ্য মিশ্রণ তৈরি করবেন। উক্ত খাদ্য নমুনাগুলোতে উপস্থিত শুষ্ক পদার্থ (dry matter) ও আমিষের পরিমাণ সারণি ১৭-এ দেয়া আছে।

সারণি ১৭: বিভিন্ন খাদ্যনমুনায় শুষ্ক পদার্থ ও আমিষের শতকরা অংশ

প্রয়োজনীয় উপকরণ

এজন্য নিম্নলিখিত উপকরণগুলোর প্রয়োজন হবে। যথা- আমিষের শতকরা হারসহ খাদ্য নমুনাসমূহের তালিকা, একটি ক্যালকুলেটর, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা, একটি বেলচা, একটি ছালার বস্তা ইত্যাদি । উক্ত খাদ্য নমুনা দিয়ে ১০০ কেজি শুষ্ক পদার্থের একটি মিশ্রণ তৈরি করার জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে।

 

কাজের ধাপ

ব্যবহারিক খাতায় ৭টি কলামবিশিষ্ট একটি ছক (সারণি ১৮-এর মতো) তৈরি করুন।

প্রথম কলামে খাদ্যের নাম, দ্বিতীয় কলামে শুষ্ক পদার্থের শতকরা অংশ ও তৃতীয় কলামে আমিষের শতকরা অংশ লিখুন।

চতুর্থ কলামে মিশ্রণে প্রতিটি খাদ্য নমুনার পরিমাণমতো অংশ আনুমানিকভাবে লিখুন।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ কলামে খাদ্য নমুনার অংশ অনুযায়ী আমিষ ও খাদ্য নমুনার পরিমাণ হিসাব করুন। আমিষ হিসাব করার জন্য নিচের সূত্রটি ব্যবহার করুন

ধরুন গমে আমিষের শতকরা ভাগ ‘ক’ এবং মোট মিশ্রণে অংশ ‘ঘ’ ভাগ। অতএব মিশ্রণে গমের আমিষের মোট পরিমাণ হবে = K /100 X  খ কেজি।

মিশ্রণে খাদ্য নমুনার অংশ হিসাব করার জন্য নিচের সূত্রটি ব্যবহার করুন-

মনে করুন, গমে শুষ্ক পদার্থ শতকরা ‘গ’ ভাগ এবং মোট মিশ্রণে গমের শুষ্ক পদার্থের অংশ  ‘ঘ’ ভাগ। অতএব মিশ্রণে গমের পরিমাণ হবে = N/M X ১০০ কেজি।

পরিমাণ অনুযায়ী আমিষ পাওয়ার জন্য ৪-এর কলামে উল্লেখিত ভাগগুলো কয়েকবার পরিবর্তন করতে হতে পারে।

সারণি ১৮ : খাদ্য মিশ্রণে খাদ্য নমুনায় শুষ্ক পদার্থ ও আমিষের অংশ হিসাব করার ছক

  • এবার ৬ নং কলামে উল্লেখিত পরিমাণ মোতাবেক খাদ্য নমুনাগুলো মেপে পরিষ্কার মেঝেতে রাখুন। প্রথমে গম ভাঙ্গা, গমের ভুশি ও তিলের খৈল মিশিয়ে নিন। এরপর শুটকি মাছের গুঁড়ো, ঝিনুকের পাউডার ও লবণ ভালোভাবে মিশিয়ে আস্তে আস্তে গমের ভুশি ও তিলের খৈলের মিশ্রণের সাথে মিশিয়ে নিন। হাত বা বেলচা দিয়ে মেশাতে পারেন। মেশিনের সাহায্যেও মেশানো যায়।
  • মিশ্রিত দানাদার খাদ্য একটি বস্তায় ভরে সংরক্ষণ করুন ও বস্তা হতে বাছুরকে প্রতিদিন পরিমাণমতো খেতে দিন।
  • উপরোক্ত ধাপগুলো নিজ হাতে করুন।
  • পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যবহারিক খাতায় লিখুন ও টিউটরকে দেখান।

ভেড়ার জাত ও বৈশিষ্ট্য

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-ভেড়ার জাত ও বৈশিষ্ট্য

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • উলের গুণাবলীর ওপর ভিত্তি করে ছক আকারে ভেড়ার নামের তালিকা তৈরি করতে পারবেন।
  • ভারত ও পাকিস্তানের কয়েকটি ভেড়ার জাতের নাম বলতে পারবেন।
  • বাংলাদেশের ভেড়ার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারবেন।
  • ছক আকারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ভেড়ার নাম, উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে পারবেন।

 

ভেড়ার জাত ও বৈশিষ্ট্য

 

ছাগলের মতো পৃথিবীতে ভেড়ারও বহু জাত রয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই জাতগুলোকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  • উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে, যেমন- মাংস ও উল উৎপাদকারী।
  • মুখমন্ডলের রঙের ওপর ভিত্তি করে, যেমন- কালে বা সাদা মুখমণ্ডল।
  • শিংয়ের ওপর ভিত্তি করে, যেমন- শিং আছে বা শিং নেই।
  • লেজের আকৃতির ওপর ভিত্তি করে, যেমন- লম্বা লেজ, মোটা লেজ বা খাটো লেজ।
  • উলের গুণাবলীর ওপর ভিত্তি করে, যেমন- সূক্ষ্ণ উল, মাঝারি উল, লম্বা উল, কার্পেট উল, ফার টাইপ ইতাদি।
  • উৎপত্তিস্থান অনুযায়ী, যেমন- পাহাড়ি জাত, সমতলভূমির জাত বা নিম্নভূমির জাত।

গৃহপালিত পশুর মধ্যে উল উৎপাদনের জন্য ভেড়ার গুরুত্ব সর্বাধিক আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভেড়ার পশম থেকে উৎপাদিত শীতবস্ত্রের চাহিদা বিশ্ববাজারে ব্যাপক। এই কারণে উলের গুণাবলীর ওপর ভিত্তি করে ভেড়ার শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। সারণি ১২-এ চার্ট আকারে তা তুলে ধরছে।

সারণি ১২ : উলের গুণাবলীর ওপর ভিত্তি করে ক্রেয়ার শ্রেণিবিন্যাস

 

ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভেড়ার জাতসমূহ

অঞ্চলভিত্তিতে ভারতীয় ভেড়াকে মোট তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। য হিমালয় অঞ্চলের ভেড়া, যেমন- ওরেজ, কার্নাল, বাখরওয়াল, গাদি ইত্যাদি শুষ্ক পশ্চিমাঞ্চলীয় ভেড়া, যেমন- লোহি, কাচ্চি, মারওয়ারি, চোকলা, নালি, কাথিওয়ারি ইত্যাদি। দক্ষিণাঞ্চলীয় ভেড়া, যেমন- সেলারি, মান্দা, দামাস্কাস, বেলোরি, সোনাদি ইত্যাদি৷ পূর্বাঞ্চলীর ভেড়া, যেমন- শাহবাদি।

পাকিস্তানি জাতসমূহ

পাকিস্তানে ভেড়ার প্রায় ১৫টি জাত রয়েছে। এরা প্রধানত কার্পেট উল উৎপাদন করে। যেমন- ভাওয়ালপুরি, বিত্রিক, বলছি, দামানি, হর্নাই, হস্তানগরি, কাগনি, কাজলি, কোকা, লোহি, খাল, আফ্রিদি, ওয়াজিরি ইত্যাদি।

বাংলাদেশী ভেড়া

বাংলাদেশী ভেড়া অনুন্নত এবং দেশী ভেড়া হিসেবে পরিচিত। এদের নির্দিষ্ট বা স্থায়ী কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এদেরকে অধিক সংখ্যায় নোয়াখালীর চরাঞ্চলের ভূমি, সন্দীপ, ঢাকা, টাঙ্গাইল, চাপাইনবাবগঞ্জ নওগা প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা যায়।

দৈহিক বৈশিষ্ট্য

এদের গায়ের রঙ সাদা, কালো, বাদামি বা মিশ্র হয়ে থাকে। এরা আকারে ছোট, চুট পর্যন্ত উচ্চতা ৪৪ সে.মি। বুকের বেড় প্রায় ৬৫ সে.মি। মাথা, ঠোঁট, নাক সোজা; কান খাটো, গলা চিকন, পিঠ সোজা, পশ্চাদভাগ মোটামুটি গড়নের ও উন্নত। ভেড়া ও ভেড়ার ওজন যথাক্রমে ২০-২৫ ও ১৫- ১৮ কেজি।

গুণগত বৈশিষ্ট্য

এদেরকে প্রধানত মাংসের জন্য পালন করা হয়। বছরে গড়ে প্রায় ৫০০ গ্রাম মোটা পশম (উল) পাওয়া যায়। সামান্য পরিমাণ দুধও দেয়। কিন্তু এরা খুবই উর্বর ও ঘন ঘন বাচ্চা দেয়। ভেড়ী প্রতি ১৫ মাসে অন্তত দু’বার বাচ্চা দিয়ে থাকে। প্রতিবারে ২টি করে বাচ্চা দেয়।

এদের পশম দিয়ে মোটা কম্বল, কার্পেট, মাফলার ইত্যাদি তৈরি করা যায়। কার্পেট তৈরির জন্য এই পশম খুবই ভালো। তবে, পরিধেয় বস্ত্র তৈরির জন্য এটা খুবই নিম্নমানের। এখানে সারণি ১৩-এর মাধ্যমে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ভেড়ার উৎপত্তি, দৈহিক ও গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা করা হয়েছে।

সারণি ১৩ : কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ভেড়ার উৎপত্তি, দৈহিক ও গুণগত বৈশিষ্ট্য

 

 

উন্নত সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-উন্নত সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা। উন্নত জাতের গরু বাছাই খুবই জরুরী। উন্নত জাতের গরু বাছাই না করলে সারা বছর ফার্মে রোগবালাই লেগে থাকবে। সংকর জাতের গাভী এই দেশের আবহাওয়ায় চমৎকার ভাবে খাপ খাওয়াতে পারে।

এই পাঠ শেষে আপনি-

সংকর- জাতের গরুর আকার ও আকৃতি বলতে পারবেন। সংকর- জাতের গরুর উৎপাদন ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাগুণ লিখতে পারবেন।

উন্নত সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা

প্রাসঙ্গিক তথ্য

সংকর -জাতের গরু দু’টি ভিন্ন জাতের গাভী ও ষাঁড়ের মিশ্রণে জন্ম নেয়। আমাদের দেশে সাধারণত উন্নত জাতের ষাঁড়ের সাথে দেশী গাভীর মিলন ঘটিয়ে সংকর- জাত সৃষ্টি করা হয়। উন্নত জাতের ষাঁড় উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী যে কোনো জাতের হতে পারে। যেমন- দুধ উৎপাদন, মাংস উৎপাদন বা শক্তি উৎপাদন প্রভৃতি।

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ

একটি সংকর- জাতের গাভী, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।

কাজের ধাপ

  • আপনার বা আপনার প্রতিবেশীর কাছে যদি কোনো সংকর- জাতের গরু থাকে তবে সেটিকে একটু ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করুন।
  • ব্যবহারিক খাতায় আপনার প্রত্যক্ষ করা সংকর -জাতের গরুটির ছবি আঁকুন এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অংশ চিহ্নিত করুন।
  • এই সংকর- জাতের গরুটি কোন্ কোন্ জাত থেকে সৃষ্টি হয়েছে তা জেনে নিন। এরপর লক্ষ্য করে দেখুন ঐ জাতগুলোর বৈশিষ্ট্যসমূহ এ সংকর -জাতের গরুটির মধ্যে কতটুকু এসেছে।
  • সংকর -জাতের গরু ও দেশী গরুর মধ্যে যেসব পার্থক্য আছে তা লক্ষ্য করুন।
  • ব্যবহারিক খাতায় সংকর -জাতের গরুর বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করুন এবং শিক্ষককে দেখান।

 

মন্তব্য

দেশী গাভী ও হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ষাঁড়ের মধ্যে সংকরায়নের ফলে সৃষ্ট সংকর গরুর বৈশিষ্ট্যসমূহ হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান গরুর মতোই হয়। এদের গায়ের রঙ সাদা-কালো, চুট নেই ও গলকম্বল ছোট।

 

দেশী গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-দেশী গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা।

এই পাঠ শেষে আপনি –

দেশী গরুর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম বলতে ও লিখতে পারবেন। দেশী গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো বলতে পারবেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য

দেশী -গরু আমাদের দেশে যদিও পরিচিত, তথাপি এর বিভিন্ন গুণাবলী ও উৎপাদন বৈশিষ্ট্যসমূহ অনেকেরই জানা নেই। আমাদের দেশী- গরুকে উন্নত করতে হলে এর মধ্যে যেসব ভালো অথবা নিম্নমানের গুণাবলী আছে তা জানা দরকার।

 

দেশী গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ

একটি ষাঁড় বা গাভী, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।

 

 

কাজের ধাপ

  • একটি দেশী- গরু দেখে প্রথমে এর দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গের নাম জানুন।
  • নিজ বাড়িতে বা প্রতিবেশীর বাড়িতে যেখানে দেশী- গরু আছে সেখানে যান এবং পাঠ্য বইয়ে উল্লেখিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামের সাথে ঐ গরুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো মিলিয়ে নিন।
  • ব্যবহারিক খাতায় একটি ষাঁড় ও একটি গাভীর ছবি এঁকে এদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিহ্নিত করুন।
  • ব্যবহারিক খাতাটি মূল্যায়নের জন্য শিক্ষককে দেখান।

 

 

১. পোল, ২. কপাল,৩.এ নাকের বাঁশি, ৪ মুখ, ৫. চোয়াল, ৬. গলা, ৭. কাঁধের অগ্রভাগ, ৮. সিনা , ৯. কনুই, ১০. হাঁটু, ১১. পায়ের পাতা, ১২. নিম্নবক্ষদেশ, ১৩ দুগ্ধকুপ, ১৪ দুগ্ধশিরা, ১৫. ওলানের সম্মুখাংশের সংযোগ, ১৬. ওলানের সম্মুখভাগ, ১৭ ও ১৮. বাঁট, ১৯. খুর, ২০ মুরকব্জি , ২১ লেজের লোম, ২২. হক, ২৩. জংঘা ও খুরের মধ্যস্থল, ২৪ স্টাইফল, ২৫. উরু, ২৬. ওলানের পশ্চাদাংশের সংযোগ, ২৭. কটি, ২৮- লেজ ও লেজের অগ্রভাগ , ২৯. খাল, ৩০. কটির নিম্নদেশ, ৩১ পঙ্গুর, ৩২. পেটের সম্মুখভাগ, ৩৩ চটিফুল, ৩৪ বুকের বেড়, ৩৫. চটি, ৩৬ যায়, ৩৭. শিং।

 

৭.গলকম্বল, ১৪. দুগ্ধশিরা, ১৫ অবধিত বাঁট ও ১৬. অন্ডকোষ। অন্য অঙ্গগুলো গাভী ও ষাঁড়ের মধ্যে একই রকম।

সতর্কতা

  • দেশী- গরুর জাত বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করার সময় সতর্কতার সাথে গরুর কাছে যান।

গরুর দুধ দিয়ে দই বা যে কোনো একটি খাদ্য তৈরি করা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় গরুর দুধ দিয়ে দই বা যে কোনো একটি খাদ্য তৈরি করা।

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • দই তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোর নাম বলতে পারবেন।
  • দুধ দিয়ে নিজ হাতে মজাদার দই তৈরি করতে পারবেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য

দই বাংলাদেশে অতি জনপ্রিয় দুগ্ধজাত খাদ্য। যে কোনো ভোজে দই পরিবেশন করা না হলে সে ভোজের উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যায়। ভোজ অনুষ্ঠানকারী সমালোচনার সম্মুখীন হন। ভোজের সাফল্য অনেকাংশেই পরিবেশিত দইয়ের মানের ওপর নির্ভর করে। দই সাধারণত দুপ্রকার। যথা- টক ও মিষ্টি দই। টক দই সাধারণত রান্নাবান্না ও সালাদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তবে, অধিক টক না হলে খাদ্যের সাথেও পরিবেশন করা যায়।

 

গরুর দুধ দিয়ে দই বা যে কোনো একটি খাদ্য তৈরি করা

 

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ

দুধ, ডেকচি, মাটির পাত্র, সাঁচ, চিনি, লাকড়ি বা গ্যাসের চুলো।

কাজের ধাপ

  • প্রথমে সদ্য দোহনকৃত পাঁচ লিটার কাঁচা দুধ ভালোভাবে ছেকে নিন।
  • নির্ধারিত পরিমাণ দুধ অল্প জ্বালে ফুটাতে থাকুন।
  • তবে, লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দুধ পুড়ে না যায়।
  • দুধের আয়তন ১/৩ অংশ কমে গেলে তাতে ১৫-১৮% পরিষ্কার চিনি সম্পুর্ণভাবে মেশান।
  • মিষ্টি দই তৈরিতে প্রতি লিটার দুধে এই হারে চিনি মেশান।
  • ফুটন্ত দুধ নতুন মাটির পাত্রে ঢেলে রাখুন এবং শুষ্ক ও বায়ু চলাচলের সুবিধাযুক্ত কক্ষে রাখুন।
  • যখন দুধের তাপমাত্রা ৪০-৪৫° সেলসিয়াসে নামবে তখন চা-চামচের ২/৩ চামচ সাঁচ বা কালচার যোগ করুন। কালচার বা সাঁচ পাতিলে মেশানোর পর দুধ স্থিরভাবে পাত্রে ঢেলে রাখুন।
  • তারপর ৪-৫ ঘন্টা দুধের পাত্রগুলো ভালো করে ভারি কাপড় বা অন্য কোনো ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন অথবা ওভেনে রাখুন। মোটামুটিভাবে ২৪ ঘণ্টায় দই হয়ে যাবে।
  • দইয়ের আকৃতি শক্ত করার জন্য ৫% গুঁড়ো দুধ ফুটানোর পূর্বে যোগ করা যেতে পারে।

অনুশীলন (Activity) ঃ

ধরুন, আপনি তিন লিটার কাঁচা দুধ দিয়ে মিষ্টি দই বানাবেন। এই পরিমাণ দই বানাতে মোট কতটুকু চিনি, সাঁচ ও গুঁড়ো দুধ মেশাতে হবে তা হিসেব করে বের করুন।

 

 

দই সংরক্ষণ ও সাবধানতা

  • জমাট বাধার পর দই রেফ্রিজারেটরে রাখলে ভালো থাকবে।
  • তাপ নিয়ন্ত্রণ আমাদের দেশে একটি সমস্যা। তাপ কমে গেলে (অর্থাৎ শীতের সময়) দই খারাপ হয়ে যেতে পারে।
  • মাটির পাত্র বিধায় দই তৈরির পর সাবধানে নাড়াচাড়া করা উচিত।
  • বেশি সাঁচ বা কালচার দিলে দই টক হয়ে যেতে পারে। ভালো কালচার হলে দইয়ের স্বাদও ভালো হয়।
  • আমাদের দেশে শীতকাল ব্যতীত বছরের অন্য সময় খোলা জায়গায় রেখে দই তৈরি করা যায়। শীতকালে ওভেনে রাখার দরকার আছে। দই হওয়ার জন্য ৩৮-৪০° সে তাপমাত্রাই উত্তম।

 

পশু দিয়ে নিজ হাতে হালচাষ করা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-পশু দিয়ে নিজ হাতে হালচাষ করা।

এই পাঠ শেষে আপনি-

হালচাষের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোর সাথে পরিচিত হতে পারবেন। গবাদিপশুর কাধে জোয়াল বাধতে ও লাঙ্গল লাগাতে পারবেন এবং অন্যকে দেখাতে পারবেন। গরু নিয়ে নিজেই হালচাষ করতে পারবেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য

হালচাষ বা গবাদিপশু দিয়ে জমি কর্ষণ আমাদের দেশে একটি অতি পুরাতন পেশা যা কৃষির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে গণ্য। গ্রাম বাংলার কৃষকরা ভোর না হতেই লাঙ্গল কাঁধে মাঠের পানে ছুটেন। দৃশ্যটি খুবই মনোরোম। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কৃষক মাঠে যাওয়ার আগে তার গরু, লাঙ্গল, জোয়াল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে নেন। জমি, গরু, লাঙ্গল ও মই এই চারটি উপকরণ সমন্বয়ে জমিতে অধিক ফসল ফলানো সম্ভব।

 

পশু দিয়ে নিজ হাতে হালচাষ করা

 

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ

জমি, একজোড়া বলদ, লাঙ্গল, জোয়াল, মই, শলা, টুই, রশি ইত্যাদি।

পূর্ব প্রস্তুতি

হালচাষের জন্য সকাল অথবা বিকেলে সময় নির্ধারণ করুন। হালচাষে যাবার পূর্ব রাতে গরুকে ভালোভাবে ঘাস ও দানাদার খাবার দিন। হালচাষের জন্য মাঠে যাবার পূর্বে গরুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিষ্কার পানি পান করান। কীভাবে গরুর জোয়াল এবং জোয়ালের সাথে লাঙ্গল বাধতে হয় তা পার্শ্ববর্তী কৃষকের বাড়িতে গিয়ে তার কাছে শিখুন এবং নিজে করার জন্য চেষ্টা করুন।

প্রধান কর্ষণ যন্ত্রপাতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

দেশী লাঙল

বাংলাদেশে এটি অতি পরিচিত কর্ষণ যন্ত্র। একটি বাঁকা কাঠের আগায় লোহার একটি ফলক বা ফলা সন্নিবেশে এটি প্রস্তুত করা হয়। এর বিভিন্ন অংশ নিম্নরূপ-

কাঠের শরীরঃ

লাগলের শরীর গজারি, বেল, কুল প্রভৃতি কাঠের বাঁকা কান্ড দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। শরীরের উপরের অংশকে বলা হয় হাতল। হাতলের শেষ প্রান্তে মুটি থাকে। এই মুটি চেপে ধরে কৃষকরা লাঙ্গল চালিয়ে থাকেন। শরীরের নিচের সরু অংশে ফলক লাগানো হয়। শরীরের মধ্যবর্তী জায়গায় একটি ছিদ্র করা হয় এবং সে ছিদ্রে ঈশ সংযোজন করা হয়।

ঈশঃ

এটি একটি সরু চ্যাপ্টা কাষ্ঠদণ্ড যা লম্বায় ২.৫ মিটার অর্থাৎ প্রায় আট ফুট। ঈশের গোড়ার অংশ লাঙ্গলের শরীরের ছিদ্রপথে শক্তভাবে আটকানো থাকে, ঈশের অগ্রভাগ অপেক্ষাকৃত চিকন বা গরু হয়। এতে ৪-৫টি দাত বা খাজকাটা হয়। এ দাঁতগুলোর যে কোনো একটি রশি বেঁধে ছোয়ালের সঙ্গে লাঙ্গল লাগানো হয়।

বিলঃ

ঈশ লাগলের শরীরের ছিদ্রের মধ্যে শক্ত করে আটকানোর জন্য একটি কাঠের টুকরো ব্যবহার করা হয়। দেশীয় কাথায় একে দিল বা গোজ বলে।

হাতল:

লাগলের শরীরের উপরের যে অংশ হাতে ধরে গরুর সাহায্যে লাঙ্গল চালনা করা হয়, তাকে হাতল বলে। হাতলের উপরের প্রান্তে মুটি থাকে। এই মুটিতে চাপ প্রয়োগ করে চাষি গরু দিয়ে জমি চাষ করেন।

ফলকঃ

গ্রাম্য ভাষায় এটিকে লাঙ্গলের ফাল বলে। এটি নরম স্টিলপাত বা লোহার পাত দিয়ে তৈরি এবং লম্বায় ১৫-১৭ সেন্টিমিটার। লাঙ্গলের সরু আগার উপরের দিকে লোহার পিন দিয়ে ফলকটি আটকে দেয়া হয়। এ ফলার সাহায্যেই লাঙ্গল মাটি চিরে জমি কর্ষণ করে।

জোয়ালঃ

ছোয়াল ভূমি কর্ষণের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জোয়াল ছাড়া লাঙ্গল দিয়ে ভূমি কর্ষণ সম্ভব নয়। জোয়ালের দু’প্রান্ত রশি দিয়ে একজোড়া গরুর কাঁধে বেঁধে দেয়া হয়। লাঙ্গলের ঈশ রশির সাহায্যে জোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে বেঁধে জমি কর্ষণ করা হয়। জোয়াল কাঠের অথবা বাঁশের হতে পারে। জোয়াল যেন বলদের কাধের নির্দিষ্ট স্থানে থাকে সেজন্য বাশের দু’টি শলা দু’প্রান্তে এবং রশি দিয়ে জোয়ালকে কাধের সাথে বাধা হয়।

মইঃ

আমাদের দেশে প্রধানত বাশের তৈরি মই ব্যবহৃত হয়। বাশেঁর তৈরি মই মোট তিনটি ফালি দিয়ে তৈরি হয় যার মধ্যবর্তী ফালিটি সোজা রাখা হয়। দু’পার্শ্বের দু’টি ফালি কতকটা অর্ধচন্দ্রাকারে বাঁকানো থাকে এবং গাইট দিয়ে সংযোজন করা হয়। গাইটগুলোর প্রায় ৩৭৫ সে.মি. (২.৫ ইঞ্চি) করে উভয়দিকে বাড়তি রাখা হয়। প্রান্তিক গাইট দু’টির মাধ্যায় পাটের রশি দিয়ে জোয়ালের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। দু’টি সোজা বাশের ফালি দিয়েও মই তৈরি করা যায়।

অনুশীলন (Activity) :

ধরুন, আপনার এক টুকরো জমি আছে, হালচাষের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো সংগ্রহ করে সেটি নিজে চাষ করুন

কাজের ধাপ

  • প্রথমে নিজ হাতে জোয়ালটি বলদ দু’টোর দু’কারে পাটের রশি দিয়ে বাধুন। এরপর লাঙ্গলের ঈশটিকে জোয়ালের সাথে জোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে ভালোভাবে বাধুন।
  • এরপর লাঙ্গলের মাথার মুটি বাম হাতে শক্তভাবে সোজা করে ধরুন যাতে লাঙ্গলের ফালটি জমির বুকে ঢুকে যায়।
  • চাষ করার সময় গরুর সাথে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কথা বলুন যাতে গরু আপনার নির্দেশনা বুঝতে পারে। গরুর প্রতি কখনো নিষ্ঠুর আচরণ করা ঠিক নয়। হাতের শলা দিয়ে গরুকে ডানে/বামে চলার নির্দেশনা দিন।
  • হালচাষের মাঝামাঝি সময়ে গরুকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম দেয়া প্রয়োজন। পরে আবার চাষাবাদ শুরু করা যেতে পারে।
  • কোনো অবস্থাতেই দৈনিক ৪-৬ ঘণ্টার বেশি সময় একই গরু দিয়ে হালচাষ করা সমিচীন নয়।
  • হালচাষ চলাকালীন সময়ে গরু বা হালের যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিলে প্রতিবেশী অভিজ্ঞ কৃষকের সাথে আলাপ করে সমাধান করুন।
  • হালচাষের পর গরুকে ঘরে উঠানোর পূর্বে পুকুর বা খালে ভালোভাবে গোছল করান। ব্রাশ দিয়ে তাদের শরীর পরিষ্কার করে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘাস, দানাদার খাদ্য ও পানি দিন এবং পরিষ্কার জায়গায় রাখুন যাতে বিশ্রাম নিতে পারে।
  • লাগলসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে সযত্নে উঁচু জায়গায় তুলে রাখুন। আপনি নিজে হালচাষ করুন এবং ধাপগুলো ব্যবহারিক খাতায় পর্যায়ক্রমে লিখুন।

 

 

সাবধানতা এবং করণীয়

  • হালচাষে যাবার আগে লাঙ্গলসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ভালোভাবে পরীক্ষা করুন।
  • হালের গরুকে প্রত্যেহ নির্ধারিত সময় ঘাস ও দানাদার খাদ্য সরবরাহ করুন এবং গোছল করান।
  • ব্রাশ দিয়ে শরীর পরিষ্কার করুন। গরুর স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখুন।
  • গর্বদা গরুর কাছে পরিষ্কার খাবার পানি রেখে দিন।
  • প্রত্যেহ নির্ধারিত সময়ে হালচাষ করুন। এতে গরু অভ্যস্থ হয়ে যাবে।
  • লাগলের মুটি শক্ত করে না ধরলে ফালা যে কোনো সময় গরুর পায়ে লেগে পা কেটে যেতেপারে। এদিকে সতর্ক থাকুন।
  • জোয়াল ব্যবহারের ফলে পশুর দেহে যেন কোনো ক্ষত সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।