রসুনের উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কিত তথ্য , রসুন হলো কন্দ জাতীয় মসলা ফসল। বৈজ্ঞানিক নাম Allium sativum। রসুন শুধু মসলা হিসেবে নয় হেকিমি শাস্ত্রে ওষুধ হিসাবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি রান্নার স্বাদ, গন্ধ ও রুচি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। রসুনে পর্যাপ্ত পরিমাণে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন বি-৬ রয়েছে।
রসুনের উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কিত তথ্য
উপকারিতা
রসুন হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কাঁচা রসুন সেবনে ক্যান্সার প্রতিরোধ হয়। সর্দি-কাশিতেও রসুন বেশ উপকারী। রক্তে কোলেস্টেরল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়াও রসুনকে ন্যাচারাল পেইন কিলারও বলা হয়। কেননা শিশু বা বড়দের দাঁতে ব্যথা হলে এক কোষ রসুন চিবালে দাঁতের ব্যথা অনেকটা উপশম হয়। নিয়মিত রসুন খেলে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত রোগের ঝুঁকি কমে যায়।
দেশের দিনাজপুর, রংপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর ও বরাইগ্রাম, পাবনা জেলার চাটমহর, শরিয়তপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তারাশ উপজেলায় রসুন বেশি উৎপাদিত হয়।
মাটি ও জলবায়ু
উর্বর দো-আঁশ মাটি, পলি দো-আঁশ মাটি অর্থাৎ যেখানে পানি জমে থাকে না মাটি সহজেই ঝুরঝুরা হয় এমন মাটি রসুন চাষের জন্য উপযোগী। শক্ত এঁটেল মাটি রসুন চাষের জন্য উপযোগী নয়। কেননা এঁটেল মাটিতে রসুনের কন্দ সুগঠিত হয় না। রসুন চাষের জমি থেকে পানি অপসারণ হওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে কন্দ বড় হয় না এবং রং নষ্ট হয়ে যায়। রসুন সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে ভালো জন্মে।
জাত পরিচিতি
বারি রসুন-১: বারি রসুন ১ এর গড় উচ্চতা ৬০-৬২ সেমি এবং পাতার সংখ্যা (প্রতি গাছে) ৭-৮টি। প্রতি কন্দে কোয়ার সংখ্যা ২০-২২টি। এই জাতে রোগ ও পোকার আক্রমণ খুব কম। এর জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন। ফলন ৬-৭ টন/ হেক্টর।
বারি রসুন-২: গড় উচ্চতা ৫৬-৫৮ সেমি। প্রতি গাছে পাতার সংখ্যা ৯-১০টি। প্রতি কন্দে কোয়ার সংখ্যা ২৩-২৪ টি এবং কোয়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ১ ইঞ্চি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ও সংরক্ষণ ক্ষমতা ভালো। এর জীবনকাল ১৪৫-১৫৫ দিন এবং ফলন হেক্টর প্রতি ৭-৯ টন।
বারি রসুন-৩: এ জাতের রসুন গাছের গড় উচ্চতা ৭১-৭২ সেমি। পাতার সংখ্যা (প্রতি গাছে) ৯-১০টি। প্রতি কন্দে কোয়ার সংখ্যা ২৩-২৪টি। ভাইরাস রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল হলেও মাঝে মাঝে পার্পল ব্লচ ও পাতা মোড়ানো রোগ দেখা দিতে পারে। জীবনকাল ১৩৫-১৪০ দিন। ফলন (হেক্টর প্রতি) ১০.৫-১১.৩১ টন।
বারি রসুন-৪: গাছের গড় উচ্চতা ৬৭-৬৮ সেমি এবং পাতার সংখ্যা প্রতি গাছে ৯-১০টি। প্রতি কন্দে কোয়ার সংখ্যা ১৭-১৮টি। ভাইরাস রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল হলেও মাঝে মাঝে পার্পল ব্লচ ও পাতা মোড়ানো রোগ দেখা দিতে পারে। জীবনকাল ১৩০-১৪০ দিন। ফলন (হেক্টর প্রতি) ৮.০-৮.৭৮ টন।
বাউ রসুন-১: রসুনের এই জাতটি ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত কিছু রোগ প্রতিরোধী। এছাড়াও এটি উচ্চ ফলনশীল এবং সংরক্ষণ গুণসম্পন্ন।
বাউ রসুন-২: এটি উচ্চ ফলনশীল ও ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী জাত। রসুনের এ জাতের সংরক্ষণ গুণ অনেক ভালো এবং পোকা-মাকড়ের আক্রমণও কম হয়ে থাকে। একর প্রতি ফলন ৫ থেকে ৬ হাজার কেজি হয়ে থাকে।
ইটালি (দেশি জাত): রসুনের এই জাতের গাছগুলো শক্ত, চওড়া, পাতাগুলো উপরের দিকে থাকে এবং ফলন বেশি হয়।
আউশী (দেশি জাত): রসুনের এই জাতের পাতা অপেক্ষাকৃত ছোট ও চিকন। এর কন্দ আকারে ছোট এবং ঢলে পড়ে। এই জাতের ফলন কম হয়ে থাকে। এ ছাড়াও আকারে ছোট হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা ও মূল্য কম পাওয়া যায়। দেশি জাতের মধ্যে আমনী জাতের রসুনও রয়েছে।
রোপণের সময়
রসুন সাধারণত মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বরের মধ্যে রোপণ করা উত্তম।
বীজ বপনের হার
হেক্টর প্রতি ৩০০-৪০০ কেজি কোয়া বা বীজ রসুন লাগে। রসুনের কোয়ার আকার বড় হলে ফলনও বেশি হয়।
বীজ বপন
রসুনের কোয়াগুলো হাতের দু’আঙুল দিয়ে ধরে সারি থেকে সারির দূরত্ব ১৫ সেমি. রেখে প্রতি সারিতে ১০ সেমি. দূরে দূরে ৩-৪ সেমি. মাটির গভীরে লাগাতে হবে।
সার প্রয়োগ
রসুনের জমিতে হেক্টর/বিঘা প্রতি সারের পরিমাণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
সারের নাম
পরিমাণ (হেক্টর প্রতি)
পরিমাণ (বিঘা প্রতি)
গোবর
৮ টন
১ টন
ইউরিয়া
২০০ কেজি
২৫-২৬ কেজি
টিএসপি
১২৫ কেজি
১৫-১৬ কেজি
এমওপি
১০০ কেজি
১৩-১৪ কেজি
জিপসাম
১০০ কেজি
১৩-১৪ কেজি
জিংক সালফেট
২০ কেজি
২-৩ কেজি
বোরাক্স (বরিক এসিড)
১০ কেজি
১-১.৫ কেজি
সারের মাত্রা মাটির উর্বরতা বা প্রকৃতি ভেদে কম বেশি হতে পারে। এক কিস্তি ইউরিয়া এবং অন্যান্য সারের সবটুকু জমি তৈরির শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া সার দুই কিস্তিতে চারা গজানোর যথাক্রমে ২৫ ও ৫০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়াও ছাই প্রয়োগ করা যাবে। কেননা ছাই দিলে মাটি আলগা থাকে এবং ফলন বেশি হয়।
আন্তঃপরিচর্যা
রসুনের চারা বৃদ্ধি পর্যায়ে জমিতে আগাছা থাকলে জমি আগাছামুক্ত করতে হবে। রসুন লাগানোর ১৫ দিন পর আগাছা বেশি হলে অর্থাৎ আগাছাগুলো নাড়ার ওপর দিয়ে উঠা শুরু করলে রনষ্টার ১ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কন্দ গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ২-৩ বার জমিতে নিড়ানি দিতে হবে। জমিতে ৪-৫ সেমি পুরু করে কচুরিপানা বা ধানের খড় দ্বারা মালচ প্রয়োগ করলে রসুনের ফলন ভালো হয়। এক্ষেত্রে বেশি সেচের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মালচ ছাড়া করলে জমির প্রকারভেদে ১০-১৫ দিন পর সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
রসুন লাগানোর ২ মাস পর থাকে কন্দ গঠন করতে শুরু করে। ৩-৩.৫ মাস পরে কন্দ পুষ্ট হতে আরম্ভ করে। এভাবে ৪-৫ মাস পরে রসুন উত্তোলন করা যাবে। রসুন গাছের পাতার অগ্রভাগ শুকিয়ে হলুদ বা বাদামি রং হয়ে গেলে রসুন তোলা যাবে। হাত দিয়ে টেনে গাছসহ রসুন তোলা হয়ে থাকে। এভাবে রসুনের কন্দগুলো ৪-৫ দিন ছায়াতে শুকানোর পর মরা পাতা কেটে সংরক্ষণ করা হয়।
ফলন
রসুনের হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৮-১০ টন।
ফসল উত্তোলনের পর করণীয়
রসুনের কন্দগুলো ৪-৫ দিন ছায়াতে শুকিয়ে নিলে রসুনের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। রোদে শুকালে রসুন নরম হয়ে যেতে পারে। ফুতি পোকার লার্ভা থেকে রসুনকে রক্ষার জন্য সংরক্ষণের সময় সেভিন পাউডার ২ গ্রাম/ লিটার পানিতে দিয়ে স্প্রে করতে হবে। রসুন খুব ভালোভাবে পরিপক্ব করে নিয়ে জমি থেকে তুলতে হবে। কেননা অপরিপক্ব রসুন তুললে তা থেকে বীজ করা যাবে না।
বীজ হিসাবে রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি
রসুন সংগ্রহের পর ৫-৭ দিন ছায়াযুক্ত স্থানে ভালোভাবে শুকাতে হয়। একে রসুনের কিউরিং বলে। পরে পরিমাণ মতো (৪-৫ কেজি) রসুনের শুকনো গাছ দিয়ে বেনি তৈরি করে বাতাস চলাচল করে এমন ঘরে কয়েকটা বাঁশ দিয়ে তার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এক ঝোপা থেকে অন্য ঝোপা ফাঁকা ফাঁকা করে রাখতে হবে যাতে করে বাতাস চলাচল করতে পারে। এ ছাড়া রসুন উত্তোলনের পর পাতা ও শিকড় কেটে ব্যাগে, বাঁশের রেকে, মাচায় এবং চটের বস্তাতেও সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
সবজি চাষের সঠিক নিয়ম এবং উপায় , বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে প্রতিনিয়ত চাষের জমি কমে যাচ্ছে। কিন্তু খাদ্যের চাহিদা বেড়েই যাচ্ছে। ফলে ফসলের সঠিক যোগান দিতে আমাদের সবজি চাষ হোক কিংবা সাধারণ ভেষজ উদ্ভিদ চাষ হোক; সঠিক উপায় মেনে চললে ভালো ফল আশা করতে পারবো।
আমরা যেসব ফলমূল রান্না করে খাই, তাদের সাধারণভাবে সবজি বলা হয়। যেমন—আলু, বেগুন, পটল, মুলা, ঝিঙে, কপি, লাউ, কুমড়া ইত্যাদি।
ঋতু বা বপনকাল অনুসারে সবজিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—গ্রীষ্মকালীন বা বর্ষাকালীন সবজি ও শীতকালীন সবজি।
সবজি চাষের সঠিক নিয়ম এবং উপায়
খারিফ সবজি
শসা, বেগুন, ঢেঁড়স, পটল, লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, উচ্ছে প্রভৃতি সবজির চাষ গ্রীষ্মকাল বা বর্ষাকালে হয়। এদের খারিফ সবজি বলে।
রবি সবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, টম্যাটো, বীট, গাজর, শিম, মুলা প্রভৃতি সবজির চাষ শীতকালে হয়। এদের রবি সবজি বলে। হেমন্তকালে বীজ বুনে যে ফসল কৃষক বসন্তকালে ঘরে তোলে তা-ই রবিশস্য।
সবজি চাষের জন্য প্রধান উপকরণ হল জমি। সাধারণত সবজি চাষের জন্য দো-আঁশ মাটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী। মাটিতে যেন রৌদ্র পড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সবজি চাষের জন্য যে সকল যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেগুলো হল—কোদাল, খুরপি, নিড়ানি, পানির ঝাঁঝরি ইত্যাদি।
সবজি চাষের জন্য কয়েক দফা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যেমন— বীজতলা কর্ষণ ও প্রস্তুত করা, বীজ বপন, চারা লাগানো, সেচ, সার প্রয়োগ, আগাছা তোলা, কীটনাশক প্রয়োগ, ফসল তোলা।
রবি সবজি -গাজর
বীজতলা ও মূল জমি প্রস্তুত করা
কিছু সবজি আছে যাদের চারা প্রস্তুত করে মূল জমিতে লাগানো হয়। সে কারণে সবজির বীজতলা প্রয়োজন। চারা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে যে জমি নির্বাচন করা হয়, তাকে বীজতলা বলে। বীজতলার জমি পার্শ্ববর্তী জমি থেকে অন্তত ১৫ সেমি উঁচু হওয়া চাই। একটি আদর্শ বীজতলার আকৃতি হবে লম্বায় ৩০০ সেমি, এবং চওড়ায় ১২০ সেমি.। বীজতলায় যাতে অবাধ রোদ পাওয়া যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। প্রতি বীজতলার চারিধারে গভীর জলনিকাশের নালা রাখা প্রয়োজন। বীজতলার মাটি বেশ নরম, উর্বর, ঝুরঝুরে হওয়া দরকার। বীজতলার মাটিকে কোদাল দিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে ঝুরাঝুরা করে নিতে হবে। সার হিসাবে গোবর, কম্পোস্ট সার, খৈল, অ্যামোনিয়াম সালফেট, সুপার ফসফেট ব্যবহার করা হয়। বীজতলা তৈরি হয়ে গেলে মাটি সামান্য আর্দ্র অবস্থায় থাকার সময় পাতলা করে বীজ বপন করতে হবে।
মূল জমি প্রস্তুত করা
যে জমিতে চারা লাগানো হবে সেখানকার জমি ভালোভাবে কর্ষণ করে এবং প্রয়োজনমতো সার প্রয়োগ করে জমি তৈরি করে রাখতে হবে।
বীজ বপন
ভালো পুষ্ট, রোগহীন বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় বপন করতে হবে। মাটি সামান্য ভিজে অবস্থায় থাকার সময় পাতলা করে বীজ বপন করতে হবে। বীজ বপনের পর প্রত্যহ সকাল-বিকাল ঝাঁঝরি দিয়ে জল দিতে হবে। রোদের সময় বীজতলা খড়, চাটাই দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
চারা লাগানো
বীজ বপনের ১৫ দিন পর চারাগুলো এক ইঞ্চির মতন লম্বা হলে বীজতলা থেকে চারা তুলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে। চারা তুলবার আগে বীজতলাকে ভিজিয়ে রাখতে হবে। চারা তুলে লাগানোর উপযুক্ত সময় হল বিকেল। চারা বীজতলা থেকে ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট সারি ও গাছের দূরত্ব রেখে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গোড়ার মাটি শক্ত করে চেপে দিতে হবে। পরে গোড়ায় সামান্য জল দিতে হবে।
সেচ
চারাগাছ লাগানোর ১০-১৫ দিন পর থেকে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। গাছের গোড়ায় যাতে অতিরিক্ত পানি না জমে তার জন্য নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ
চারা লাগানোর কিছুদিন পর থেকে গাছের গোড়ার চারপাশে ৩/৩ ইঞ্চি দূরত্বে সার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে উপযুক্ত পরিমাণে গোবর বা পাতাপচা সার প্রয়োগ করলে মাটি খুব সরস ও সতেজ থাকে।
আগাছা দমন
সবজি গাছের চারপাশের মাটিকে হালকাভাবে কর্ষণ করে আগাছাগুলো বেছে গাছের গোড়ায় মাটি ধরিয়ে দিতে হবে। সবজি খেতে আগাছা থাকলে সবজির বৃদ্ধি কমে যায় এবং উদ্ভিদ দুর্বল হয়ে পড়ে। তার ফলে ফসল সহজেই কাঁটশত্র দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাই জমি ও জমির আশপাশ আগাছামুক্ত রাখা একান্ত দরকার।
কীটনাশক প্রয়োগ
গাছে পোকামাকড়ের উপদ্রব হলে মাঝে মাঝে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। এতে ফলনের হার বৃদ্ধি পায়। এর পরেই নির্দিষ্ট সময়ে ফসল তোলার কাজ করতে হবে।
উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও পুষ্টি
উদ্ভিদ বৃদ্ধি ও পুষ্টির প্রয়োজনে মাটি, জল ও বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পুষ্টি ও দেহগঠনের জন্য মাটিতে ১৬টি খাদ্য উপাদান প্রয়োজন। এগুলোকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
প্রধান বা মুখ্য খাদ্যোপাদান (Major nutrients): কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম প্রভৃতি উপাদানগুলো গাছ বেশি মাত্রায় গ্রহণ করে বলে এদের প্রধান বা মুখ্য খাদ্যোপাদান বলে। এদের মধ্যে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, জল ও বাতাস থেকে এবং বাকিগুলো উদ্ভিদ মাটি থেকে গ্রহণ করে।
গৌণ খাদ্যোপাদান (Secondary nutrients): ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার— এই উপাদানগুলো উদ্ভিদ কিছুটা কম পরিমাণে গ্রহণ করে। এদের বলা হয় গৌণ খাদ্যোপাদান।
অণুখাদ্য উপাদান (Micro Trace elements): আয়রন, জিংক, বোরন, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, ক্লোরিন- এই উপাদানগুলো অতি সামান্য পরিমাণ উদ্ভিদের প্রয়োজন হয়। এগুলোকে অণুখাদ্য উপাদান বলে।
উদ্ভিদদেহে প্রধান, গৌণ ও অণুখাদ্য সবই অপরিহার্য। কারণ এদের যেকোনও একটির অভাব ঘটলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও পুষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটে। সেজন্য এদের সকলকেই অপরিহার্য উপাদান বলে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ অপেক্ষাকৃত নতুন একটি পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে দেশে প্রচুর তরুণ উদ্যোক্তারা চাষ করছেন। তরুণ ও বেকার যুব-সমাজের কাছে এই পদ্ধতি খুবই আকর্ষণের বিষয়। কারণ, সীমিত জায়গা ও স্বল্প খরচে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়। তাই পদ্ধতিটি বাজারে আসার পরেই তরুণ ও যুবকদের মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিলো। অনেকেই এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে লাভবান হয়েছেন। আবার অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন বলেও খবর বেরিয়েছে। অভিজ্ঞ জনদের মতে সঠিক দিকনির্দেশনা, আর্থিক অভাব, প্রতারণার শিকার ও মাছের পোনার সঠিক পরিচর্যা না করায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উদ্যোক্তারা। তাই আপনাদের সবার সুবিধার্থে এই বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি একত্রে পরিবেশন করার চেষ্টা করা হল।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ
বায়োফ্লক প্রযুক্তির ইতিহাস
প্রথম বিএফটি ১৯৭০-এর দশকে ইফ্রেমার-সিওপি (ফ্রেঞ্চ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর এক্সপ্লয়টেশন অফ দ্য সি, ওশেনিক সেন্টার অফ প্যাসিফিক) পেনিয়াস মনোডন, ফেনারোপেনিয়াস মেরগুয়েনসিস, লিটোপেনিয়াস ভ্যানামেই এবং এল. স্টাইলিরোস্ট্রিসের মাছ নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ওয়াডেল মেরিকালচার সেন্টার) যথাক্রমে ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তেলাপিয়া এবং এল. ভ্যানামেইয়ের নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন শুরু করে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
বায়োফ্লক প্রযুক্তি কী?
বায়োফ্লক প্রযুক্তি হলো সিস্টেমের মধ্যে কার্বন এবং নাইট্রোজেনের ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে মাছ চাষে চাষে পানির গুণমান বাড়ানোর একটি কৌশল। অন্যভাবে বলা যায় বায়োফ্লক প্রযুক্তি জল থেকে বর্জ্য অপসারণ করার একটি ব্যবস্থা।
বায়োফ্লক প্রযুক্তির অর্থ হল উপকারী ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ও শৈবালের সমন্বয়ে তৈরি করা পাতলা আস্তরণ, যা পানিকে শোধন করে। এই প্রযুক্তি পানি থেকে নাইট্রোজেন জাতীয় ক্ষতিকর উপাদানগুলি শোষণ করে নেয়। যার ফলে মাছ খাদ্য হিসেবে এর প্রোটিন সমৃদ্ধ উপাদান গ্রহণ করতে পারে। এই প্রযুক্তিতে যেহেতু উপকারী ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া) ব্যবহার করা হয়, যার ফলে এই পদ্ধতিতে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চ বায়োসিকিউরিটি প্রদান করে। এই পদ্ধতিতে বিদ্যমান ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া ও বাইরে থেকে সরবরাহকৃত কার্বনকে ব্যবহার করে অণুজীব আমিষ তৈরি করে। এক্ষেত্রে বায়োফ্লক প্রযুক্তি উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের অব্যবহৃত খাদ্য, মল-মূত্র থেকে নিঃসৃত অ্যামোনিয়াকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিন তৈরি করার ফলে বাহির থেকে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য কম সরবরাহ করলেও হয়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ছোট ছোট ট্যাংকে অনেক মাছ উৎপাদন সম্ভব হয় এবং ট্যাংকের পানি খুব কম পরিবর্তন করতে হয় তাই অল্প জমি ও অল্প পানি ব্যবহার করে অধিক মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়। এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন নেই বললেই চলে। তাই এটি একটি পরিবেশ-বান্ধব মাছ চাষ পদ্ধতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হচ্ছে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
ফ্লক কি?
শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, বিভিন্ন ধরণের জৈব কণা যেমন মাছের মল ও অব্যবহৃত ফিড ইত্যাদির সমষ্টি। পানিতে ফ্লক একসাথে মিউকাসের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে যা ব্যাকটিরিয়া দ্বারা খাদ্যে রূপান্তরিত হয়।
বায়োফ্লক কী কাজ করে?
এই প্রযুক্ততে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয় যা উপকারী ব্যাকটেরিযা। এগুলি কেই আমরা প্রোবায়োটিক বলছি। এই প্রোবায়োটিকগুলি ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়াকে হত্যা করে।
সুতরাং পানির গুণাগুণ বজায় বজায় থাকে। জলের নাইট্রোজেনকে প্রোটিনে রূপান্তর করার ক্ষমতাও এই প্রোবায়োটিকগুলির রয়েছে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
বায়োফ্লক সিস্টেমের কাজ কি?
বায়োফ্লক দুটি আলোচনামূলক পরিষেবা সরবরাহ করে-
মাছকে খাওয়ানো, পুষ্টি সরবরাহ ও চিকিৎসা করা সহজ ও কম খরচ হয়।
সিস্টেমে পানি পরিবর্তন হার কম (প্রতিদিন 0.5 থেকে 1 শতাংশ)।
মাছগুলো ট্যাঙ্কে বর্জ্য উত্পাদন করে। প্রোবায়টিক/উপকারি অনুজীব এই বর্জ্যগুলিকে প্রোটিন/পুষ্টিতে রূপান্তর করে। যা মাছের জন্য উৎকৃষ্ট খাদ্য।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
বায়োফ্লক সিস্টেম কীভাবে কাজ করে?
বায়োফ্লক প্রযুক্তি হলো একটি রিসাইকেলিং প্রক্রিয়া যেখানে পানিতে উৎপন্ন বর্জ্য খাদ্যে রুপান্তরিত হয়। পানিতে সামান্য কার্বন থাকে যা নাইট্রোজেন যুক্ত বর্জ্য পদার্থ রিসাইকেলিং করতে পারে না এজন্য কর্বনের সোর্স হিসাবে চিটাগুর ও প্রোবায়টিক ব্যবহার করা হয় যা পানিতে থাকা বর্জকে খাবারে রুপান্তরিত করে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে কীভাবে ফ্লক বজায় রাখা যায়?
ফ্লকের পরিমাণ 30 থেকে 40 মিলি / 1000 মিলি বজায় রাখতে হবে। এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যদি ফ্লক হ্রাস পায় তবে ট্যাঙ্কে অ্যামোনিয়া স্তর বৃদ্ধি পাবে, যদি ফ্লক বৃদ্ধি পায় তবে পানি সংবেদনশীল হয়ে উঠবে এবং মাছের শ্বাস নিতে অসুবিধা হবে। সুতরাং ফ্লক রক্ষণাবেক্ষণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যদি ফ্লক বৃদ্ধি পায় তবে পানি পরিবর্তন করতে হবে।
যদি ফ্লক হ্রাস পায় তবে আপনার ট্যাঙ্কে সামান্য চিটাগুড়ের সাথে 25 মিলিগ্রাম প্রোবায়োটিক যুক্ত করুন।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
বায়োফ্লোক মাছ চাষের জন্য জলে কী পরীক্ষা করা হয়?
লবনাক্ততা
টিডিএস (মোট দ্রবীভূত কঠিন)
পিএইচ (হাইড্রোজেনের শক্তি বা হাইড্রোজেনের সম্ভাব্য)
ট্যান (মোট অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন) / অ্যামোনিয়া, অ্যামোনিয়ার অধীনে আমরা এনএইচ 3 এবং এনএইচ 4 পরীক্ষা করি
তাপমাত্রা
সি: এন অনুপাত (কার্বন থেকে নাইট্রোজেন অনুপাত)
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
টিডিএস (TDS)
টিডিএস (TDS) শব্দের পূর্ণ রূপ হলো টোটাল ডিসলভড সলিডস (Total dissolved solids (TDS)। অর্থাৎ সম্পূর্ণ দ্রভীবুত বস্তু কণা।
পানির টিডিএস (TDS) কী?
টোটাল ডিসলভড সলিডস (Total dissolved solids, TDS হলো পানিতে উপস্থিত আয়নযুক্ত বা ক্ষুদ্র কণা এবং পানিতে উপস্থিত সমস্ত অজৈব এবং জৈব পদার্থগুলির দ্রবীভূত পরিমাপ। টিডিএসকে মাঝে মাঝে প্রতি মিলিয়নে অংশ হিসাবে উল্লেখ করা হয়- parts per million (ppm)। ডিজিটাল টিডিএস মিটার দ্বারা পানির টিডিএস নির্ণয় করা যেতে পারে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে টিডিএস কী?
পানি প্রাকৃতিক পুকুর থেকে নেওয়া উচিৎ (মিনারেল বা খনিজ পানি নয়), এরপর পানির টিডিএস পরীক্ষা করুন এটিতে সাধারণত টিডিএস স্তর 400-500 হযয়ে থাকে। পানিতে সমুদ্রের লবণ যুক্ত করুন (দ্রষ্টব্য: – আয়োডিনযুক্ত লবণ নয়) পানির টিডিএস স্তর বাড়ানোর জন্য। 1 কেজি লবণ / 1000 লিটার পানি, এই অনুপাতে। টিডিএস কিছু সময়ের পরে 1000 লিটার পানির জন্য 1000 বৃদ্ধি পাবে। 1800-1900 জলের টিডিএস নিয়ে আসা উচিত।
বায়োফ্লোক মাছ চাষের জন্য কত টিডিএস দরকার?
টিডিএস বায়োফ্লোকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, টিডিএস 1800 থেকে 2000 এর মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।
টিডিএসটি যদি 1800 এর চেয়ে কম হয় তবে জলে প্রাকৃতিক কাঁচা লবণ যুক্ত করুন। কাঁচা নুন সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত হবে এবং অপ্রসারণযোগ্য হবে।
যদি টিডিএস 2000 এর চেয়ে বেশি হয়, তবে এটিতে আরও টাটকা জল যুক্ত করুন।
বায়োফ্লোক ট্যাঙ্কে টিডিএস কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
টিডিএস যদি 1800 এর চেয়ে কম হয় তবে পানিতে প্রাকৃতিক কাঁচা লবণ যুক্ত করুন। কাঁচা নুন সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত হবে এবং অপ্রসারণযোগ্য হবে। যদি টিডিএস 2000 এর চেয়ে বেশি হয়, তবে এটিতে আরও টাটকা জল যুক্ত করুন।
বায়োফ্লোকের জন্য টিডিএস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, টিডিএস 1800 থেকে 2000 এর মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।
পিএইচ (pH)
রসায়নে, পিএইচ (pH) এর সম্পূর্ণ ফর্ম ( power of hydrogen or potential for hydrogen )। এটি একটি স্কেল বা পরিমাপের একক যা পানির অম্ল ও খারত্বের অনুপাতকে নির্দেশ করে। পানি যদি এসিটিক বা অম্লিয় হয় তাহলে পিএইচ এর মান কম হয় আর পানি খারীয় হলে পিএইচের মান বাড়ে।
পিএইচ (pH) কি?
পিএইচ হাইড্রোজেন আয়ন ঘনত্বের একটি পরিমাপ বা পানির অম্লতা বা ক্ষারত্বের একটি পরিমাপ। পিএইচ স্কেল সাধারণত 0 থেকে 14 এর মধ্যে থাকে। 25 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বা ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পানির পিএইচ ৭ এর কম হলে এটি অম্লিয় আর ৭ এর বেশি হলে এটি ক্ষারীয় হয়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে কত পিএইচ (pH) প্রয়োজন?
পিএইচ প্রায় 6 থেকে 8 প্রয়োজন।
দ্রষ্টব্য: – পিএইচ সমস্ত মাছের জন্য এক নয়, বিভিন্ন মাছের বিভিন্ন পিএইচ প্রয়োজন। বায়োফ্লক মাছ চাষের ক্ষেত্রে এর মান ৭ এর কম হলে তবে এটি নাইট্রিফিকেশন প্রক্রিয়াটিকে প্রভাবিত করতে পারে।
পানির পিএইচ কী?
মাছ চাষের জন্য pH খুবই গুরুত্বপূর্ণ। pH এর মান ৪ এর কম ও ১০ এর বশি হলে মাছ বাচতে পারে না। অপর দিকে ৬-৮ এর মধ্যে থাকলে মাছ ভালো থাকে এবং দ্রুত বাড়তে পারে।
কিভাবে বায়োফ্লকে পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়?
বায়োফ্লোকের জন্য পিএইচ মান 6 থেকে 8 এর মধ্যে বজায় রাখা উচিত। যদি পিএইচ 6 এর চেয়ে কম হয় তবে পানিতে চুন (CaCO3 বা চুনা) যুক্ত করুন। যদি পিএইচ 8 এর চেয়ে বেশি হয় তবে আরও মিঠা জল যুক্ত করুন।
আপনি কীভাবে পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করবেন?
পাতিত জল বা খাঁটি জলের একটি পিএইচ স্তর 7 থাকে যার অর্থ এটি নিরপেক্ষ।
আপনি যদি পানির পিএইচ বৃদ্ধি করতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই এটিতে একটি ক্ষারযুক্ত উপাদান যেমন বেকিং পাউডার যুক্ত করতে হবে। আপনি যদি পানির পিএইচ হ্রাস করতে চান তবে আপনি এটিতে একটি অম্লীয় পদার্থ যেমন লেবুর রস যুক্ত করুন।
বায়োফ্লোক মাছ চাষে টিএএন এর পূর্ণরূপ কী?
ট্যান নামক মোট অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন, এটি মূলত অ্যামোনিয়া।
বায়োফ্লোক মাছ চাষে ট্যান কী?
ট্যান (মোট অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন) পানিতে এনএইচ 3 এবং এনএইচ 4 + আকারে মোট নাইট্রোজেনের পরিমাণ। জলে অ্যামোনিয়া (এনএইচ 3) দ্রবীভূত অ্যামোনিয়াম আয়নগুলি (এনএইচ 4 +) সহ ভারসাম্যের মধ্যে উপস্থিত থাকে। দ্রষ্টব্য: – জলজ চাষে, টিএএন ঘনত্ব অবশ্যই 0.5 মিলিগ্রাম / এল এর চেয়ে কম হওয়া উচিত।
অণুজীব দ্বারা জলে টিএন ব্যবহার করে কতটি প্রক্রিয়া?
মাইক্রো-অর্গানিজমের জলে ট্যান (মোট অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন) ব্যবহার করে বায়লফোক টু প্রসেসে। 1.সাম্যকরণ প্রক্রিয়া ২.অনুক্রমিককরণ প্রক্রিয়া
বায়োফ্লোকের মধ্যে আত্তীকরণ প্রক্রিয়াটি কী?
হিটারোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া টিএএনকে মাইক্রোবায়াল প্রোটিনের সাথে মিলিত করে। এই প্রক্রিয়াতে উভয় নাইট্রোজেন এবং কার্বন উত্স থাকা উচিত। ভিয়েতনাম লিনহের কয়েকটি উল্লেখ অনুসারে, সি: এন> 15 অনুপাতটি হ্যাঁরোট্রফিক ব্যাকটেরিয়ার জন্য ট্যান গ্রহণের জন্য ভাল হার হিসাবে বিবেচিত হয় এবং নিম্ন স্তরে পানিতে টিএএন ঘনত্ব বজায় রাখে।
অ্যাকোয়াচারাল্ট মডেল বায়োফ্লোকে, বায়োফ্লোক কণাগুলিতে অন্যান্য জীব এবং জৈব কণাগুলির সাথে লেগে থাকা ব্যাকটিরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
০.০ থেকে কয়েক মিমি অবধি বায়োফ্লোক কণা হ’ল খামারযুক্ত মাছ এবং চিংড়ির জন্য সরবরাহকারী প্রোটিনের উত্স।
বায়োফ্লোকের নাইট্রিফিকেশন প্রক্রিয়া কী?
নাইট্রিফিকেশন ট্যানকে (মোট অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন) নাইট্রেটে রূপান্তর করে। এই রূপান্তর প্রক্রিয়াতে, প্রথম ধাপে, টিএন নাইট্রাইটে রূপান্তরিত হয় (NO2-, বিষাক্ত)। এর পরে, নাইট্রাইট (NO2-) নাইট্রেটে রূপান্তরিত হয় (NO3-)। এই দুটি পদক্ষেপের জন্য ব্যাকটিরিয়া এবং অক্সিজেনের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
পানির লবণাক্ততা
লবণাক্ততা হ’ল নোনতা বা জলের শরীরে লবণের পরিমাণ। তার মানে মিঠা পানিতে কত লবণ? উদাহরণস্বরূপ, আপনার যদি 1 গ্রাম লবণ এবং এক হাজার গ্রাম জল থাকে তবে আপনার লবণাক্ততা 1 গ্রাম / কেজি বা 1 পিপিটি হয়।
পানির লবণাক্ততা কীভাবে পরিমাপ করা যায়?
পানির লবণাক্ততা বলতে পানিতে কতটা লবণের পরিমাণ রয়েছে? হাইড্রোমিটার ব্যবহার করে বা লবণাক্ততা মিটার নামে পানির লবণাক্ততা পরিমাপ করতে।
তাপমাত্রা
বায়োফ্লোক চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত তাপমাত্রা 22 থেকে 29 ডিগ্রির মধ্যে যে কোনও জায়গায়। যখন তাপমাত্রা 30 ডিগ্রির উপরে চলে যায় তখন আমার ফ্লুক নেমে আসে এবং সেখানে অ্যামোনিয়াতে বৃদ্ধি ঘটে। কিছু সময় মাছ মারা যায় তাই যখন তাপমাত্রা 31 ডিগ্রির উপরে চলে যায় তখন আমি শীতল পুকুরে মাছগুলি স্থানান্তর করতে পছন্দ করি।
অ্যামোনিয়া কি?
অ্যামোনিয়া হ’ল মৎস্য সংস্কৃতিতে উত্পন্ন বর্জ্য এবং বিষাক্ত যৌগ। অ্যামোনিয়া আপনার মাছের জন্য খুব বিপজ্জনক।
অ্যামোনিয়া কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
অ্যামোনিয়া আপনার মাছের জন্য খুব বিপজ্জনক। অ্যামোনিয়া 10: 1 কার্বন থেকে নাইট্রোজেন অনুপাত (যার অর্থ সি: এন অনুপাত) বজায় রেখে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
জেনে নিন পিএইচ হ্রাস করার পাশাপাশি জলের তাপমাত্রা হ্রাস করতে সহায়তা করে। সুতরাং আপনার কাছে নতুন জল দিয়ে জল মিশিয়ে দেওয়ার, জল ঠান্ডা করার বা পিএইচ কমিয়ে দেওয়ার পছন্দ রয়েছে।
বা ফিল্টারিং সিস্টেমের মাধ্যমে জলটি পাম্প করুন যা অ্যামোনিয়াকে ক্যাপচার করবে বা নাইট্রেটে রূপান্তর করতে জীবাণু ব্যবহার করবে (ভাল বায়ুচঞ্চলের প্রয়োজন)
বায়োফ্লোক মাছ চাষে এনএইচ 3 কী?
জলে অ্যামোনিয়াাকাল নাইট্রোজেন সর্বদা NH3 + NH4 আকারে থাকে। এনএইচ 3 (অ্যামোনিয়া) একটি গ্যাস এবং কখনও কখনও এটি বিষাক্ত বা ফ্রি অ্যামোনিয়া বলে। এই ধরণের অ্যামোনিয়া বিপজ্জনক অংশ। এটি ইউনিয়নযুক্ত অ্যামোনিয়া (এনএইচ 3) যা মাছকে মেরে ফেলে।
বায়োফ্লোক মাছ চাষে এনএইচ 4 কী?
জলে অ্যামোনিয়াাকাল নাইট্রোজেন সর্বদা NH3 + NH4 আকারে থাকে। এনএইচ 4 (অ্যামোনিয়াম) একটি নন-অ্যাটাক লবণ। এটি অ্যামোনিয়ার আয়নযুক্ত রূপ। আপনার মাছের জন্য এনএইচ 4 খুব ভাল।
কীভাবে অ্যামোনিয়া (এনএইচ 3) এবং নাইট্রাইট (এনও 2-) হ্রাস করবেন?
দ্রুততম পদ্ধতিটি হল জল পরিবর্তন করা। যখন জল পরিবর্তন করা যায় না, জলাশয়ে জলাশয় / ট্যাংকগুলিতে জৈব কার্বনের পরিপূরক প্রয়োজনীয় কারণ এটি হিটারোট্রফিক ব্যাকটিরিয়া “হজম” অ্যামোনিয়াকে সহায়তা করে। চিনি এবং গুড় জলাশয় / ট্যাঙ্কে জলের জৈব কার্বনের উত্স। এছাড়াও, অ্যানারোবিক ব্যাকটেরিয়া, স্থিতিশীল পিএইচ এবং ঘনত্বের অ্যালগাল-ব্যাকটেরিয়াগুলির পর্যাপ্ত অক্সিজেন সমর্থনকারী কার্যক্রমও নিশ্চিত করতে হবে।
প্রোবায়োটিক কী?
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যাকটিরিয়া, পুষ্টি উপাদান, মাইক্রো এবং ম্যাক্রো মিনারেল এর সমষ্টি যা ফ্লক, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মাছের উন্নত বিকাশের জন্য এটি একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে, পানির গুণমান উন্নত করে এবং বজায় রাখে।
কোন ব্যাকটিরিয়া বায়োফ্লকে ব্যবহৃত হয়?
বায়োফ্লকে কিছু অণুবিক্ষণীক জীব ব্যবহার করা হয় যেমন- হেটেরোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া (heterotrophic bacteria), শৈবাল বা শেওলা (algae), ছত্রাক (fungi), নেমাটোড (nematodes), মেটাযোয়া (metazoans), ডেট্রিটাস (detritus) ইত্যাদি। এগুলো সবই জলজ এক কোষি প্রাণি।
সি এন রেশিও
গ: এন অনুপাত বলতে সি: এন অনুপাত বলে কার্বন এবং নাইট্রোজেন অনুপাত। যদি আমরা বায়োফ্লোক ট্যাঙ্কে 1 মিলিগ্রাম অ্যামোনিয়া শেষ করি তবে আমাদের 10 মিলিগ্রাম কার্বন (10: 1) প্রয়োজন।
এফসিআর কী?
বায়োফ্লোক মাছ চাষে এফসিআর এর সম্পূর্ণ ফর্ম হ’ল ফিড রূপান্তর অনুপাত। এফসিআর (ফিড রূপান্তর অনুপাত) 1 কেজি মাছের ওজন বাড়ানোর জন্য মাছ খাওয়ার পরিমাণ।
বায়োফ্লোক মাছ চাষে এফসিআর কী?
এফসিআর (ফিড রূপান্তর অনুপাত) 1 কেজি মাছের ওজন বাড়ানোর জন্য মাছ খাওয়ার পরিমাণ। ফিড রূপান্তর অনুপাত একটি সূচক যা সাধারণত সব ধরণের কৃষিতে ব্যবহৃত হয়। এফসিআর হ’ল ফিডটি দেওয়া ফিডের ইনপুট এবং জনসংখ্যার ওজন বাড়ানোর মধ্যে গাণিতিক সম্পর্ক।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ কী?
বায়োফ্লোক ফিশ ফার্মিং, ফিশ ফার্মিংয়ের একটি লাভজনক পদ্ধতি। খোলা পুকুরের মাছ চাষের বিকল্প হিসাবে এটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি একটি স্বল্প ব্যয়যুক্ত উপায় যেখানে মাছের জন্য বিষাক্ত পদার্থ যেমন অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট এবং নাইট্রাইটকে ফিডে রূপান্তর করা যায়। এই কৌশলটির মূলনীতি পুষ্টি পুনর্ব্যবহার করা।
বায়োফ্লোক ফিডের অতিরিক্ত উত্স দেওয়ার সময় মাছের সংস্কৃতি জল পরিষ্কার করতে সহায়তা করে।
এটি একটি টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব প্রক্রিয়া। উচ্চ ঘনত্বে মাছ পালনের জন্য কিছু বর্জ্য পরিচালনার ব্যবস্থা প্রয়োজন। বায়োফ্লোক মূলত এটি একটি বর্জ্য চিকিত্সা সিস্টেম। একটি খামারে আগত জল থেকে রোগ প্রতিরোধের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ কি লাভজনক?
অনেক লোক যারা বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করেছেন তারা উত্পাদন এবং লাভের উন্নতি হওয়ায় এটি থেকে প্রচুর আয় হয়েছে। এটি মাছ উত্থাপনে প্রয়োজনীয় সময়ও হ্রাস করেছে যার অর্থ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মাছগুলি বহুবার বাড়ানো যায়। সুতরাং, বায়োফ্লোক প্রযুক্তি মাছ উৎপাদন এবং লালন পালনে লাভজনক।
কোন মাছ বায়োফ্লকের জন্য সবচেয়ে ভাল?
প্রায় সমস্ত বায়োফ্লক সিস্টেম চিংড়ি, তেলাপিয়া, শিং, কৈ ও কার্প মাছ বৃদ্ধি করতে ব্যবহৃত হয়।
প্রয়োজনীয় বায়োফ্লক সরঞ্জাম গুলো কি কি?
প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সমূহ-
চুন [ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (চুনা)।] চিটাগুড় বা মোলাসেস। কাঁচা সল্ট, সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত লবণ। প্রোবায়োটিক টাটকা পানি ফিশ ফার্মিংয়ের জন্য পিভিসি ট্যাঙ্ক / সিমেন্টের ট্যাঙ্ক বায়ুচালিত করার জন্য এরটর পাম্প
পানি প্রস্তুতি কিভাবে করতে হবে?
প্রথমে ট্যাঙ্কটি ধুয়ে নিন, ওয়াশিংয়ের পরে ট্যাঙ্কিতে জল ভরাট শুরু করুন। প্রায় 35-50% টাটকা জল দিয়ে ট্যাঙ্কটি পূরণ করুন। 50% এর বেশি পূরণ করবেন না কারণ ব্যাকটেরিয়ার বিকাশের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিবেশের প্রয়োজন। জল ভলিউমের উপর নির্ভর করে নীচে বর্ণিত অনুপাতের সাথে গ্রেডিয়েন্টগুলি যুক্ত করুন।
চুন 0.05g / লিটার, গুড় 0.1g / লিটার এবং প্রোবায়োটিক 0.03g / লিটার, যুক্ত করুন। বায়োফ্লোক ট্যাঙ্কে গ্রেডিয়েন্ট যুক্ত করা বায়োফ্লোক প্রযুক্তিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সুতরাং দয়া করে এই পদক্ষেপগুলি যথাযথভাবে এবং সাবধানে অনুসরণ করুন। উপরে উল্লিখিত গ্রেডিয়েন্টগুলি মিশ্রণের পরে 3-7 দিনের জন্য ট্যাঙ্কটিকে উচ্চ বায়ুতে লাগিয়ে দিন। এর মধ্যে, প্রোবায়োটিকগুলির কারণে, এটি পানিতে বর্তমান অ্যামোনিয়া ধ্বংস করতে শুরু করবে যা মাছের জন্য জলজ পরিবেশ তৈরি করতে শুরু করে। এর পরে পানির পিএইচ এবং টিডিএসের মান পরিমাপ করুন।
পিএইচ মান 6 থেকে 8 এর মধ্যে বজায় রাখতে হবে। টিডিএস 1800 থেকে 2000 এর মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। টিডিএস 1800 এর চেয়ে কম হলে পানিতে প্রাকৃতিক কাঁচা লবণ যুক্ত করুন। যদি টিডিএস 2000 এর চেয়ে বেশি হয়, তবে এটিতে আরও টাটকা পানি যুক্ত করুন। যদি পিএইচ 6 এর চেয়ে কম হয় তবে পানিতে চুন (CaCO3 বা চুনা) যুক্ত করুন। যদি পিএইচ 8 এর চেয়ে বেশি হয়, তবে আরও টাটকা জল যুক্ত করুন।
কিভাবে বায়োফ্লক মাছ চাষ শুরু করবেন?
আপনার সঠিক প্রশিক্ষণ বা দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। ট্যাঙ্ক সেটআপ / ট্যাঙ্ক নির্মাণ। ট্যাঙ্ক স্যানিটাইজ করুন বা আপনার ট্যাঙ্কটি সঠিকভাবে পরিষ্কার করুন। আপনার একটি উপাদান প্রয়োজন যা বায়োফ্লক ট্যাঙ্কে ব্যবহৃত হয়। আপনার ট্যাঙ্কে জল প্রস্তুতি। জলের প্যারামিটারগুলি যেমন- পিএইচ, টিডিএস, অ্যামোনিয়া, সি: এন রেশিও, তাপমাত্রা, লবণাক্ততা এবং আরও যে কোনও জিনিস পরীক্ষা করে দেখুন। স্টোক ফিশ বীজ। আপনার মাছ স্যানিটাইজ করুন। স্যানিটাইজ করার পরে আপনি ট্যাঙ্কে রাখতে পারেন। সমস্ত জলের পরামিতি যদি ঠিক থাকে। এরপরে আপনার মাছের আকার অনুযায়ী আপনার মাছকে পর্যায়ক্রমে খাওয়ান। সময়ে সময়ে সমস্ত প্যারামিটার জলের পরীক্ষা করুন এবং আপনার মাছের অবস্থাও পরীক্ষা করুন।
লাভজনক উপায়ে মাছ চাষ: বিগত কয়েক দশকে দেশে চাষের অধীনে মাছের উৎপাদনে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দেশ মাছ চাষে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। অধিক ঘনবসতির দেশ হওয়ায় দেশের বাজারে যেমন মাছের ক্রমবর্ধমান চাহিদা আছে তেমনি গ্রামীণ বেকার যুবকের আত্মকর্মসংস্থানের অন্যতম মাধ্যম পুকুরে মৎস চাষ। অনুকূল আবহাওয়া, মাছ চাষের সহজ প্রযুক্তি, উপকরণের প্রাচুর্যতা গ্রাম পর্যায়ে মৎস চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে প্রতিনিয়ত।
লাভজনক উপায়ে মাছ চাষ
অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে আগামী দিনে বাজারে মাছের চাহিদাও বৃদ্ধিপাবে এটাই স্বাভাবিক। উন্নত দেশের মাথাপিছু মাছ গ্রহণের হার আমাদের চেয়েও অনেক বেশি। আমাদের দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রাকৃতিক নানাবিধ কারণে মাছের উৎপাদন কমে আসছে এবং এর বিপরীতে দেশে বাৎসরিক মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি (২০১৪-১৫ সালে ১৫ কেজি, ২০১৯-২০ সালে ২৩ কেজিতে উন্নীত) পাচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ের মাছ চাষিদের সাথে মতবিনিময়ে প্রাপ্ত তথ্য ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বিদ্যমান অবস্থার মাঝে কী উপায়ে লাভজনকভাবে মাছ চাষ করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
চাষ প্রযুক্তি নির্বাচন:
লাভজনক মাছ চাষের জন্য সঠিক চাষ পদ্ধতি নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চাষিপর্যায়ে অনেক ধরনের চাষ প্রচলিত আছে। বিদ্যমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে এখানে কয়েকটি লাভজনক মাছ চাষের পদ্ধতি উপস্থাপন করা হলোঃ
বড় আকারের পোনা মজুদ করে কার্প মিশ্রচাষ : সাধারণত ৫-৬ ইঞ্চি আকারের শতকে ৫০-৬০ কার্পজাতীয় মাছের পোনা মজুদ করে মাছ চাষের প্রচলন আছে। কিন্তু বর্তমান এর চেয়ে ভাল পদ্ধতি ৫০০ গ্রাম এর বড় পোনা কম ঘনত্বে (শতকে ১০-১২টি; যাতে ২টি হবে উপরের স্তরের মাছ, ৭টি মধ্যস্তরের রুই এবং নিচের স্তরের ১টি মৃগেল ও ১টি কার্পও এবং সর্বস্তরের ১টি গ্রাসকার্প) ছেড়ে অধিক বড় আকারের মাছ উৎপাদন। যত বড় আকারের পোনা মজুদ করা যাবে তত বেশি বড় আকারের দামি মাছ উৎপাদন করা যাবে।
তেলাপিয়ার সাথে কার্প মিশ্র চাষ : একক মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে অনেকে শতকে ২০০-৩০০ পোনা মজুদ করে চাষ করে থাকেন এটা এখন আর লাভজনক হচ্ছে না। তেলাপিয়া মজুদ কমিয়ে শতকে ১৫০টি (১০ গ্রাম আকারের পোনা) এবং তার সাথে বড় আকারের কাতল ২টি, রুই ৭টি পোনা মজুদ (২৫০-৪০০ গ্রাম ওজনের) করে ৩-৪ মাস চাষ করে যখন তেলাপিয়ার ৩-৪টিতে কেজি হবে তখন ১/৩ ভাগ তেলাপিয়া বিক্রয় করে দিয়ে আবার কয়েক মাস পরে যখন ২টিতে কেজি হবে তখন বাকি ২/৩ ভাগ হতে অর্ধেক তেলাপিয়া মাছ বিক্রয় করে দিতে হবে এবং পরিশেষে অবশিষ্ট তেলাপিয়া প্রত্যেকটি যখন ১ কেজি হবে তখন সম্পূর্ণ মাছ বিক্রয় করে অধিক লাভবান হওয়া যেতে পারে।
শিং, পাবদা এবং গুলসার সাথে কার্প মিশ্রচাষ : শিং, পাবদা ও গুলশা একক চাষে শতকে ১০০০-১৫০০ পোনা মজুদ করে পুকুরে মাছ চাষ প্রচলন আছে । এ ক্ষেত্রে মূল প্রজাতির (ধরুন পাবদা) মাছ কিছুটা কম মজুদ করে (শতকে ৬০০-৭০০টি) সাথে ৩০০-৫০০টি শিং বা গুলসা এবং তার সাথে ১টি কাতল, ৩টি রুই ও ১টি মৃগেল এবং ১৫-২০টি তেলাপিয়া মজুদ করে চাষে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। চাষের সময় ৬-৭ মাসে রুইজাতীয় মাছ ১.৫-২ কেজি হচ্ছে এবং তেলাপিয়া ১ কেজির উপরে বড় হচ্ছে। অনেকে বছরের শুরুতে ৩ মাসে একক কৈ মাছ চাষ করে একটি ফলন তুলে পুকুর পুনরায় প্রস্তুত করে এ পদ্ধতিতে চাষে যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন।
পাংগাস মাছের সাথে অন্য প্রজাতির মাছের মিশ্রচাষ : শতকে ২০০-৩০০টি পোনা মজুদ করে একক পাংগাস চাষ এখন আর নাই বললেই চলে। অনেকেই পাংগাস চাষ সম্পূর্ণ ছেড়েও দিয়েছেন। আবার অনেকে সমস্যার মধ্যে থেকেও চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা একক চাষের পরিবর্তে পাংগাসের সংখ্যা শতকে ৭০-১২০টিতে নামিয়ে সাথে ৫০-১০০টি তেলাপিয়া এবং ৮-১২টি বড় আকারের রুইজাতীয় মাছের পোনা মজুদ করে চাষ করছেন এবং লাভবান হচ্ছেন।
এখানে পাংগাস মাছকে লক্ষ করে গরম কালে ডুবন্ত বা ভাসমান এবং শীতে ভাসমান খাবার প্রয়োগ করে বছরে একটি ফসল চাষ করছেন। এক্ষেত্রে একক পাংগাস চাষের থেকে বিনিয়োগ কমে আসছে এবং মোট উৎপাদন কম হলেও চাষি লোকসানের হাত থেকে মুক্ত হয়ে লাভজনকভাবে মাছ চাষ করতে পারছেন। পাংগাস মাছ বিক্রয়ে বিনিয়োগ উঠছে এবং অন্য প্রজাতির মাছসমূহ বিক্রয়ের অর্থ সম্পূর্ণটা লাভ হচ্ছে।
কার্পজাতীয় মাছের সাথে অন্যান্য মাছের মিশ্রচাষ : প্রথমে কার্পজাতীয় মিশ্র চাষের সাথে শিং অথবা পাবদা অথবা গুলসা শতকে ৫০০-৭০০টি মজুদ করে সান্ধ্যকালীন এ মাছের জন্য নির্ধারিত পৃথক খাবার প্রয়োগ করেও সফলভাবে মাছ চাষ করা যেতে পারে।
গলদা চিংড়ি ও কার্প মিশ্রচাষ : কার্প মাছের সাথী ফসল হিসাবে গলদা চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কার্পজাতীয় মাছ মজুদের আগে শতক প্রতি ৭০-১০০টি হারে গলদা চিংড়ির পিএল ছেড়ে একমাস নার্সারিং করার পরে কার্পজাতীয় মাছ মজুদ করতে হবে। বাজারে এ মাছের ব্যাপক চাহিদার কারণে দাম পাওয়া যায় ভাল।
মাছ চাষ সম্পর্কে সঠিক ধারণা গ্রহণ:
মাছ চাষের একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা গ্রহণ করে চাষে নামতে হবে। শুরুতে স্বল্প পরিসরে মাছ চাষ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে বড় পরিসরে যেতে হবে।
উপযুক্ত পুকুর নির্বাচন:
যে প্রজাতির মাছ চাষ করা হবে তার জন্য উপযুক্ত পুকুর নির্বাচন করতে হবে। সব পুকুরে সব ধরনের মাছ চাষ করা যায় না। যেমন কৈ মাছ চাষের জন্য নিয়মিত পুকুরের পানি বের করে দেবার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পর্যাপ্ত আলো বাতাস সমৃদ্ধ উন্মুক্ত জায়গাতে কার্পজাতীয় মাছসহ পাবদা, গুলসা, চিংড়ি চাষ করলে ভাল হবে। কিছুটা ছায়াযুক্ত জায়গা হলেও শিং, তেলাপিয়া বা শোল মাছের চাষ করা যায়। পুকুরে পানির গভীরতা সব সময় ৬-৭ ফুট হতে হবে। কম গভীরতার পুকুরে মাছের চাষ হয় তবে রোগ-ব্যাধিসহ অন্যান্য সমস্যা বেশি দেখা দেয়। বেশি গভীর পুকুরে পাংগাস মাছ ভাল হলেও অন্যান্য মাছের ফলন ভাল হয় না।
মাছ চাষের সময় নির্বাচন:
বছরের সব সময় বাজারে মাছের দাম একই রূপ থাকে না। এজন্য মাছ কখন চাষ শুরু করতে হবে কখন বিক্রয় করতে হবে সে বিষয়ে আগেই হিসাব করে মাছের চাষ করতে হবে। সাধারণত মার্চ মাসের দিকে মাছের দাম বাড়তে থাকে এবং আগস্ট পর্যন্ত দাম ভাল থাকে এসময় মাছ বিক্রয় করা যাবে এভাবে হিসাব করে মাছ চাষ করতে হবে।
পুকুরে মাছ চাষের ঘনত্ব:
মাছ চাষে একেক প্রজাতির মাছ একেক ঘনত্বে মজুদ করতে হয়। তবে চাষের পুকুরে মাছের ঘনত্ব, মাছের উৎপাদন এবং প্রয়োগকৃত খাদ্যের খাদ্য রূপান্তর হারের (ঋঈজ) একটি সম্পর্ক আছে। মাছের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে মাছের মোট উৎপাদন বেশি করা সম্ভব কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রয়োগকৃত খাদ্যের রূপান্তর হার ভাল হয় না, ফলে চাষে লাভ কমে যেতে পারে। মাছ চাষে উপযুক্ত ঘনত্বের বেশি মাছ ছাড়লে পুকুরের পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ে এবং পরিবেশ ভাল রাখার জন্য নানা প্রকার ব্যবস্থাপনার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় এর ফলে চাষ ব্যবস্থাপনার খরচ বেড়ে যায়, মাছের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতেও পারে।
মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা:
মাছ চাষে মোট বিনিয়োগের ৭০% অধিক খাদ্য খরচ হয়। সে জন্য কোন খাদ্য প্রয়োগ করলে চাষে লাভ করা যাবে তা মাছের বাজার দর, মাছের প্রজাতি ও চাষ পদ্ধতি বিবেচনায় রেখে নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমান সময়ে মাছের বাজার দর বিষয়টিকে আরো কঠিন করে তুলেছে। বিদ্যমান অবস্থার মাঝে চাষিকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মাছের খাদ্য নির্বাচন করতে হবে।
মাছ চাষের পুকুরের পানি পরিবর্তন:
আধুনিক মাছ চাষ সম্পূর্ণভাবে, পুকুরের পানি ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। চাষের পুকুরে প্রতিদিন খাবার প্রয়োগ করতে হয়। মাছ পুকুরের পানিতেই পায়খানা করে। অবশিষ্ট খাবার এবং মাছের পায়খানার (ঊীপৎবঃধ) কারণে পুকুরের পানি সহজে ভারী হয়ে দূষিত হয়ে যায়। পানি পরিবর্তন করলে পুকুরের এ সমস্যাসহ অনেক সমস্যাই সহজে সমাধান করা যায়। মাছের যে কোন রোগ দেখা দিলে পানি পরিবর্তন সর্বোত্তম সমাধান। শীতের সময় পুকুরে পানি দিতে পারলে মাছ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং খাবার গ্রহণ হার বৃদ্ধি পায়। পুকুরের পানির অক্সিজেন মাত্রা বাড়াবার সহজ উপায় পুকুরে পানি সরবরাহ। তবে সরবরাহকৃত পানি অবশ্যই আয়রন মুক্ত হতে হবে।
মাছ চাষের পুকুরে এ্যারেটর স্থাপন:
মাছ চাষের পুকুরে এ্যারেটর সংযোজন করতে পারলে নিরাপদ চাষে কয়েকধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়। চাষের পুকুরে দ্রবণীয় অক্সিজেনের অভাব একটি সাধারণ সমস্যা। যান্ত্রিক এ্যারেটর এ সমস্যা দূর করা ছাড়াও পুকুরের সাধারণ অক্সিজেনের মাত্রা (৫ পিপিএম) বাড়িয়ে দেয় ফলে মাছের খাদ্য গ্রহণ হারসহ খাদ্যের হজম হার বৃদ্ধি পায়। মাছের শরীরে খাদ্যের আত্ত্বীকরণ (অংংরসরষধঃরড়হ) বৃদ্ধি পায় ফলে সার্বিকভাবে খাদ্যের ঋঈজ এর মান ভাল হয়। ফলে কম খাবারে মাছের অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়।
নিয়মিত প্রবায়োটিক্স ব্যবহার:
বর্তমান মাছ চাষে প্রবায়োটিক্সের ব্যবহার মাছের পুকুরের পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। প্রবায়োটিক্স হচ্ছে পুকুরে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির উপকরণ। চাষের পুকুরের তলদেশে প্রতিনিয়ত জৈব পচনশীল দ্রব্য জমতে থাকে। এই জৈব পদার্থ পুকুরের তলদেশে পচে ক্ষতিকর গ্যাসের সৃষ্টি হয় এবং পুকুরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হতে পারে। প্রবায়োটিক্স প্রয়োগের ফলে পুকুরে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার পর্যাপ্ত সৃষ্টি হওয়ার কারণে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া উৎপাদন প্রতিহত হয়।
পুকুরের পরিবেশ উন্নয়ন এবং মাছ চাষকে নিরাপদ রাখার জন্য বাজারে প্রাপ্ত যে কোন প্রবায়োটিক্স ২০-২৫ দিন পরপর প্রয়োগ করতে হবে। প্রবায়োটিক্স বাজারে দুই ধরনের আছে, কিছু আছে ব্যবহারের আগে চিনির পানিতে ২৪ ঘণ্টা প্রতিপালন করে ব্যবহার করতে হয়। আর কিছু আছে পুকুরে সরাসরি প্রয়োগ করতে হয়। প্রবায়োটিক্স প্রয়োগের পর পুকুরে কোন প্রকার ব্যাক্টেরিয়া নাশক (ঝধহরঃরুবৎ) প্রয়োগ করা যাবে না।
বর্তমান সময়ে একটু চিন্তাভাবনা করে মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে চাষের প্রযুক্তি নির্ধারণ করে একনিষ্ঠভাবে ধৈর্যসহকারে এগিয়ে গেলে যে কেউ মাছ চাষে সফলতা লাভ করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
মাছ চাষের লাভজনক পদ্ধতি: মাছ আমাদের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মাছের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। একই পুকুরে নানা জাতের মাছ চাষ করা যায়, খাল ও ডোবায় মাছ চাষ করা যায়, আবার চৌবাচ্চায়, খাঁচায় মাছের চাষ করা যায়। কোনো নির্দিষ্ট জলাশয়ে পরিকল্পিত উপায়ে স্বল্পপুঁজি, অল্পসময় ও লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছের বিভিন্ন নিয়ম মেনে প্রাকৃতিক উৎপাদনের চেয়ে অধিক মাছ উৎপাদনই মাছ চাষ। মাছ চাষে লাভবান হতে হলে মাছ চাষ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি পর্বে মাছ চাষিকে বিশেষ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
মাছ চাষের লাভজনক পদ্ধতি
মাছ চাষির অজ্ঞতা বা অবহেলা বা ভুল লাভজনক মাছ চাষের ক্ষেত্রে অন্তরায়। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় মাছ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মাছের অনেক চাহিদা থাকার কারণে মাছ চাষ করে ভালো আয় করা সম্ভব। স্থানীয় হাট, বাজার ছাড়াও দূরবর্তী বাজারে মাছ বিক্রি করে লাভ করা সম্ভব। তাছাড়া বিদেশে মাছ রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। মাছ চাষে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ। এটা আমাদের গর্বের বিষয়।
মাছের গুণাগুণ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা:
আমাদের দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০টিরও বেশি প্রজাতির মাছ আছে। এছাড়া খাঁড়ি অঞ্চলে ও লোনা পানিতে কয়েকশ‘ প্রজাতির মাছ আছে। তবে চাষযোগ্য মাছগুলো হলো রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, সিলভারকার্প, মিররকার্প, গ্রাসকার্প, কমনকার্প, বিগহেড, রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, তেলাপিয়া, বিদেশি মাগুর, থাই পাঙ্গাশ এসব। এসব মাছের কিছু বিশেষ গুণাগুণ আছে।
এসব মাছ খুব দ্রুত বাড়ে; খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না; পুকুরে বেশি সংখ্যায় চাষ করা যায়; পানির সব স্তর থেকে খাবার গ্রহণ করে, পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে; খেতে খুব সুস্বাদু; বাজারে এসব মাছের প্রচুর চাহিদা আছে; সহজে রোগাক্রান্ত হয় না, চাষে লাভ বেশি হয়। এজন্য লাভজনকভাবে এসব মাছে চাষ করা যায় আনয়াসে। মাছ চাষ শুরু করার আগে প্রয়োজন হচ্ছে সঠিক সুষ্ঠু এবং বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা।
মাছ উৎপাদন কৌশল:
১. সনাতন পদ্ধতির মাছ চাষ :
এ পদ্ধতিতে পুকুরের কোনো ব্যবস্থাপনা ছাড়াই মাটি ও পানির উর্বরতায় পানিতে যে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় মাছ তাই খেয়ে জীবন ধারণ করে। এক্ষেত্রে আলাদা কোনো পরিচর্যা নিতে হয় না;
২. আধানিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ :
এ পদ্ধতিতে নিয়মমতো পুকুর প্রস্তুত করে আংশিক সার ও খাদ্য সরবরাহ করে মাছের খাদ্য উৎপন্ন করতে হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপাদিত খাদ্যের সঠিক ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য রেখে মাছের পোনা ছাড়তে হয়;
৩. নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ :
অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হয়;
৪. কার্প জাতীয় মাছের মিশ্রচাষ :
পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপন্ন খাবার সম্পূর্ণ ব্যবহার করার জন্য রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, বিগহেড, সিলভারকার্প, মিররকার্প, কমনকার্প, কারপিউ এসব নানা প্রজাতির মাছ একসাথে চাষ করা যায়।
পুকুর নির্বাচন:
১. পুকুরটি খোলামেলা রোদ্রউজ্জ্বল জায়গায় এবং বাড়ির আশপাশে হতে হবে যেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়;
২. মাটির গুণাগুণ পুকুরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি পুকুরের জন্য ভালো;
৩. পুকুরের আয়তন কমপক্ষে ১০ শতাংশ হতে হবে। ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ আকারের পুকুর মাছ চাষের জন্য বেশি উপযোগী;
৪. পুকুরের গভীরতা ২-৩ মিটার রাখতে হবে এবং বছরের পুরো সময় পানি থাকতে হবে;
৫. পুকুর পাড়ে বড় গাছ বা ঝোপঝাড় থাকা যাবে না। বিশেষ করে পাতাঝরা গাছ রাখা যাবে না।
পুকুর খনন তৈরি ও প্রাথমিক কাজ:
যেখানে পুকুর খনন করা হবে সেখানকার অবকাঠামো, পরিবেশ, পানির গভীরতা, বর্ষায় বন্যার হুমকি, পুকুর পাড়ের ঢাল, বকচর, শুষ্ক মৌসুমে পানি কতটা থাকে, পানি কমে গেলে বাইরে থেকে পানি দেয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা এসব বিষয়ে সঠিক ধারণা নিয়ে শুরু করতে হবে। এজন্য প্রথমেই অভিজ্ঞ মৎস্য চাষি বা মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। মাছ চাষ শুরু করার আগে বা মাছের পোনা ছাড়ার আগে সঠিক নিয়মে পুকুর তৈরি করা অত্যাবশ্যক।
পানিতে প্রাকৃতিক খাবার জন্মানো এবং পুকুরে পানি প্রবেশ এবং নিষ্কাশনের রাস্তা সঠিকভাবে রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে অবহেলা করা হলে পরবর্তীতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। পোনা মাছ ছাড়ার আগে পুকুর তৈরি করে নিতে হবে। নতুন পুকুর কাটা কিংবা পুরনো পুকুরই তৈরি করে নেয়া আবশ্যকীয় প্রাথমিক কাজ। পুকুর প্রস্তুতির কাজটি হবে ধাপে ধাপে-
১ম ধাপ : জলজ আগাছা কচুরিপানা, কলমিলতা হেলেঞ্চা, অন্যান্য গাছ শেকড়সহ তুলে ফেলতে হবে;
২য় ধাপ : শোল, গজার, বোয়াল, টাকি রাক্ষুসে মাছ এবং অবাঞ্ছিত মাছ মলা, ঢেলা, চান্দা, পুঁটি সরিয়ে ফেলতে হবে;
৩য় ধাপ : প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন পুকুরে পানি থাকলে ড্রামে বা বালতিতে গুলে ঠা-া করে পুরো পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে;
৪র্থ ধাপ : মাটি ও পানির গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে চুন দেয়ার এক সপ্তাহ পর জৈবসার বিশেষ করে পচা গোবর দিতে হবে;
৫ম ধাপ : পুকুর শুকনা হলে পুকুরে সার, চুন/জিওলাইট, গোবর ছিটিয়ে দিয়ে লাঙল দিয়ে চাষ করে দুষণমুক্ত পানি ঢুকাতে হবে;
৬ষ্ঠ ধাপ : পোনা মজুদের আগে পুকুরে ক্ষতিকর পোকামাকড় থাকলে তা মেরে ফেলতে হবে;
৭ম ধাপ : পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে পোনা মজুদ করতে হবে। মৃত্যুর হার যেন কম থাকে সেজন্য পোনার আকার ৮-১২ সেন্টিমিটার হতে হবে;
৮ম ধাপ : নিয়মমতো পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে। এক্ষেত্রে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে তা হলো- পোনা হাঁড়িতে বা পলিথিন ব্যাগে আনা হলে, পলিথিন ব্যাগটির মুখ খোলার আগে পুকুরের পানিতে ২০-৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখা; তারপর ব্যাগের মুখ খুলে অল্প করে ব্যাগের পানি পুকুরে এবং পুকুরের পানি ব্যাগে ভরতে হবে। ব্যাগের পানি ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা যখন সমান হবে তখন পাত্র বা ব্যাগের মুখ আধা পানিতে ডুবিয়ে কাত করে সব পোনা পুকুরে ছাড়া; সকাল ও বিকাল পোনা ছাড়ার ভালো সময়;
৯ম ধাপ : দিনে দুইবার সকাল ১০টায় এবং বিকাল ৩টায় খৈল, কুঁড়া, ভুসিসহ সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
সতর্কতা ও পরিচর্যা
রোগ প্রতিরোধী মাছের চাষ করতে হবে; সঠিক সংখ্যায় পোনা মজুদ করতে হবে; পোনা ছাড়ার আগে পোনা রোগে আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে; পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং পুকুরে যাতে আগাছা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে; প্রতি ৩-৪ বছর পরপর পুকুর শুকিয়ে ফেলে নতুন করে পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হবে; বর্ষার শেষে পুকুরের পানিতে লাল বা সবুজভাব কমে গেলে অবশ্যই পরিমাণমতো সার দিতে হবে; মাঝে মাঝে জাল টেনে মাছের অবস্থা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখতে হবে; পুকুরে জাল টেনে দড়ি টেনে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানো এবং মাছের ব্যায়াম করাতে হবে।
পোনা যত্নও মজুদ:
মাছ চাষি হ্যাচারি থেকে যেসব পোনা সংগ্রহ করেন তার অধিকাংশই সরাসরি চাষ পুকুরে ছাড়ার উপযোগী নয়। চাষ পুকুরে ছোট পোনা সরাসরি ছেড়ে অনেক সময় চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এতে ব্যাপক হারে পোনা মারা যায়। এ কারণে পোনা ভালোভাবে নার্সিং করতে হবে। নার্সিং করার পর পোনা বড় ও টেকসই হলে গণনার মাধ্যমে পোনা মজুদ পুকুরে দেয়া যায় এবং পরবর্তীতে খাবার ব্যবস্থাপনার সাথে অন্যান্য ব্যবস্থাপনাও যথার্থ হতে হবে। একক চাষের ক্ষেত্রে বিশেষত শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া প্রভৃতি মাছের পোনা হ্যাচারি থেকে সরাসরি চাষ পুকুরে দিয়ে অনেক চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ইচ্ছেমতো বা পুকুরের জায়গার তুলনায় অধিক পরিমাণে পোনা ছাড়া আমাদের মৎস্য চাষিদের একটি প্রচলিত ত্রুটি। তাদের ধারণা বেশি পোনা ছাড়া হলেই বেশি উৎপাদন হবে। চাষের ধরন, অবকাঠামো, পানি বদলানোর সুবিধা, খাবারের ধরন, মাছ চাষের মেয়াদ, মাছের প্রজাতি এসব বিবেচনা করে পোনা মজুতের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ চাষি বা অভিজ্ঞ মৎস্য কর্মকর্তার কাছ থেকে তারা পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। বেশি পোনা নয় বরং পরিমিত পরিমাণে পোনা ছেড়ে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।
পোনা নির্বাচন পরিবহন ও অবমুক্তকরণ:
চাষিকে মানসম্মত ব্রুড থেকে উৎপাদিত এবং অন্তঃপ্রজনন মুক্ত পোনা, একই আকারের ও বয়সের রোগমুক্ত পোনা সংগ্রহ করতে হবে। মানসম্পন্ন পোনা সংগ্রহ করার পর তা সঠিক নিয়মে পরিবহন এবং পরিবহনের পর যথার্থভাবে পুকুরে অবমুক্ত করতে হবে। পরিবহনজনিত ক্রটি থাকায় এবং পরিবহনের আগে পোনা সঠিক নিয়মে টেকসই করা হয় না বলে পোনা ব্যাপক হারে মারা যায়। অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে মারা না গেলেও পোনা এতই দুর্বল থাকে যে দুই একদিনের মধ্যে অনেক পোনাই মারা যায়। এ কারণে পোনা পরিবহন ও পোনা ছাড়ার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
মিশ্রচাষে জাত নির্বাচন:
পুকুরে পানির তিনটি স্তরে একই রকমের মাছ থাকে না। এ কারণে মিশ্রচাষে প্রজাতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ওপরের স্তর, মধ্য স্তর এবং নিচের স্তরের বিষয়টি বিবেচনা করে প্রতিটি স্তর সঠিক ব্যবহারের জন্য সঠিক সংখ্যা সঠিক প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে। অনেক সময় মাছ চাষিরা কোনো একটি স্তরে বেশি মাছ ছেড়ে দেন অথচ অন্য একটি স্তরের উপযোগী মাছ ছাড়েন না। এতে কখনও ভালো ফল আসে না। তাছাড়া একই স্তরে বসবাসকারী বেশি মাছের জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে প্রতিযোগিতা করতে হয়। তাই প্রতিটি স্তরের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য আনুপাতিক হারে মাছ ছাড়তে হবে। পরস্পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এমন প্রজাতি এড়িয়ে যাওয়া ভালো।
ওপরের স্তরের জন্য কাতলা, সিলভার কার্প, তেলাপিয়া, সরপুঁটি, মধ্য স্তরের জন্য রুই, তেলাপিয়া, সরপুঁটি, নিচের স্তরে মৃগেল, মিররকার্প, কার্পিও, কালো বাউশ এ ধরনের মাছ আবাদ করতে হয়। পোনা ছাড়ার সময় আনুপাতিক হার ঠিক রেখেই পোনা ছাড়তে হবে। একই সাথে মৃগেল এবং গলদা চিংড়ি ছাড়া হলে গলদা চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার মাংসভোজী অর্থাৎ একে অপরকে খেয়ে ফেলে এ ধরনের প্রজাতি মিশ্রচাষে দেয়া যাবে না। মিশ্রচাষে রাক্ষুসে প্রজাতিকে এড়িয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক।
পানির গুণাগুণ রক্ষা:
মাছ পানিতে থাকে বলেই পানির গুণাগুণ ও পরিবেশ রক্ষা করাটা জরুরি। অথচ অনেক মাছ চাষি পানির গুণাগুণ রক্ষায় সচেষ্ট নন। মাছ চাষের জন্য পানির নির্ধারিত স্থিতিমাপ রয়েছে। এগুলো দক্ষতার সাথে রক্ষা করতে পারলে চাষকালীন নানা সমস্যা এড়ানো সম্ভব। পানির পিএইচ, অ্যামোনিয়া, ক্ষারত্ব, দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রভৃতির আদর্শ মাত্রা রয়েছে। এ মাত্রা অতিক্রম করলে বা অস্বাভাবিক কমবেশি হলেই বিপত্তি ঘটে। চাষিরা টেস্ট কিটের মাধ্যমে মাত্রা মেপে পানির গুণাগুণ জানতে এবং করণীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এ কারণে সব মাছ চাষিদের জন্য একটি টেস্ট কিট রাখা অতি জরুরি।
মাছের খাবার ব্যবস্থাপনা:
লাভজনক মাছ চাষের জন্য মানসম্মত খাবার অন্যতম প্রধান শর্ত। কেননা মাছ চাষে ৭০% এর বেশি খরচ হয় খাদ্য সরবরাহে। বাজারের খাদ্য এবং নিজে খাদ্য তৈরি করে সরবরাহ করেন। সঠিক পুষ্টিমান সম্পন্ন এবং মাছের আকার ও বয়স উপযোগী খাবার সরবরাহ না করলে লাভ হবে না। অনেক চাষি নিম্নমানের খাবার কিনে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাছাড়া পরীক্ষাগারে খাদ্য পরীক্ষা করালে খাদ্যের পুষ্টিমান সম্পর্কে জানা যায়।
কম খাবার সরবরাহ করলে যেমন মাছের প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়া যায় না তেমনি বেশি পরিমাণে খাবার সরবরাহে লোকশান হয়। এতে খাবার ও অর্থ দুই-ই অপচয় হয় এবং পানি দূষণের জন্য মাছ মারা যায়। সাধারণত মাছের পোনার সংখ্যা অজানা থাকায় খাদ্য প্রয়োাগের হিসাবে গড়মিল থাকায় সঠিকমাত্রায় খাবার সরবরাহ করতে পারেন না। এজন্য মাছের সংখ্যা এবং গড় ওজন জেনে পানির গুণাগুণের দিক বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পরিমাণে খাবার সরবরাহ করা দরকার।
অনেকে নিয়মিত খাবার সরবরাহ করার পরিবর্তে মাঝে মাঝে ও অনিয়মিতভাবে খাবার সরবরাহ করেন। এভাবে খাবার সরবরাহ করলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা সম্ভব নয়। অর্থাভাবে চাষের মাঝামাঝি সময়ে খাবার সরবরাহে ব্যর্থ হলে চাষি লাভবান হতে পারে না। মাছ চাষে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে জৈব ও অজৈব সারের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। অনেক চাষি কেবল সার প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ চাষ করতে চান। এ ধারণা থেকে অতিরিক্ত সার প্রয়োগে বিপদ ডেকে আনেন। পানিতে প্লাংক্টন বুম বেশি হয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে এক পর্যায়ে পানি নষ্ট হয়ে যায় এবং পুকুরে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে মাছ মারা যায়। সুতরাং প্রয়োজন হলেই সার দেয়া উচিত না হলে দরকার নেই। মাছের সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা একান্ত জরুরি।
পোলট্রি লিটার ব্যবহার:
পোলট্রি লিটারে খাদ্যমান রয়েছে এ চিন্তা থেকে অনেক মাছ চাষি পোলট্রি লিটারকেই কেবল মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু লিটার ব্যবহারের কারণে মাছ চাষিরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। পোলট্রি লিটারে কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করা হয় যা মাছ খেয়ে পরিপাক হয় না এবং তা থেকে বদহজম হয় পেট ফুলে মাছ মারা যায়। আবার লিটারে কেবল তুষ থাকার কারণে একই সমস্যা হয়। বেশি পরিমাণে লিটার পানির গুণাগুণ নষ্ট করে। পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের কারণে ব্যাপকহারে মাছ মারা যায় এবং পানির গুণাগুণ রক্ষা করতে গিয়ে ওষুধপত্র কিনতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। তাছাড়া এ লিটারের মাধ্যমে মাছে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া যায় যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
নিয়মিত ওজন নেয়া ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা:
প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর মাছের গড় ওজন নেয়া আবশ্যক। তা না হলে খাবারের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা যায় না। মাছের ওজন না নিলে চাষিও বুঝতে পারেন না যে মাছের বাড়বাড়তি সন্তোষজনক নাকি হতাশাব্যঞ্জক। পোনা ছেড়ে এবং খাবার সরবরাহ করেই চাষির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ একটি বড় কাজ। মাছের অস্বাভাবিক আচরণ বা দেহে অস্বাভাবিক কোনো কিছু দেখা গেলে বা ক্ষত হলে মৎস্য বিশেষজ্ঞ বা মৎস্য কর্মকর্তার শরণাপন্ন হতে হবে। তবে মাছের রোগ হলে চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধে অধিক মনোযোগী হলে মাছচাষি ক্ষতি এড়াতে পারেন। স্বাস্থ্যসম্মত চাষ ব্যবস্থা
বাস্তবায়নে মাছ চাষে চিকিৎসা, নানা ওষুধপত্র এবং পুষ্টিপণ্য পাওয়া যাচ্ছে যা চাষি ব্যবহার করে সুবিধা পেতে পারেন। আমাদের দেশেও নানা কোম্পানি নানা পণ্য বাজারজাত করছে। অনেক সময় তারা সস্তায় এসব কিনে প্রতারিত হন। আবার সঠিক ব্যবহার বিধি না জানা বা সঠিক মাত্রায় ব্যবহার না করায় সুফল পাচ্ছে না। এ কারণে মৎস্যবিদ বা অভিজ্ঞ চাষির পরামর্শে সঠিক ওষুধ, সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে এবং প্রয়োগ বিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
একই পুকুর থেকে একাধারে কয়েক দিন মাছ ধরলে চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কেননা পরপর কয়েক দিন জাল টানলে অন্য মাছ খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয় বলে মাছের ওজন কমে যায় এবং আঘাতজনিত কারণেও কিছু মাছ মারা যেতে পারে। এ কারণে একটানা কয়েক দিন মাছ না ধরে মাঝে বিরতি দেয়া উচিত।
মাছ পরিবহন:
মাছ ধরে সঠিকভাবে বাজারজাত করতে না পারলে মাছ চাষি চাষের শেষ দিকে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। যেসব মাছ জীবিত পরিবহন করা হয় সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে অধিক সময় পরিবহন বা অন্য কোনো ক্রটির কারণে মারা যায়। এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ড্রামে পরিষ্কার পানিসহ পরিমিত মাছ পরিবহন করা উচিত। আজকাল ড্রামসহ গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। শিং, মাগুর, কৈ মাছ এভাবে পরিবহন করা হয়। ড্রামে নেয়ার আগে কিছু সময় হাপায় রাখা আবশ্যক। মাছ ধরার ৮-১০ ঘণ্টা আগে খাবার দেয়া বন্ধ রাখলে মাছ অধিক সময় জীবিত থাকে। অন্যান্য মাছ দূরত্ব ভেদে বরফজাত করা উচিত। মাছ চাষিরা একটু সতর্ক হলে এবং চাষকালে প্রতিটি ধাপে দক্ষতার পরিচয় দিলে ক্ষতি বা লোকসান থেকে রক্ষা পেয়ে নিশ্চিত লাভবান হতে পারবেন।
মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ:
মাছ প্রক্রিয়াজাতের সময় হাত দিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা যাবে না; মাছ ধরার পর মাছের আকৃতি অনুযায়ী আলাদা করে ফেলতে হবে; বাক্সে বা পাত্রে বরফ দিয়ে স্তরে স্তরে মাছ সাজাতে হবে; শুকনোভাবে অথবা ভেজা অবস্থায় লবণ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা যায়; মাছ কেটে নাড়িভুঁড়ি ও মাথা ফেলে দিয়ে চাক করে সেগুলো সিদ্ধ করতে হবে। এরপর লবণ, তেল, মসলা চাকের সাথে মেখে টিনের পাত্রে সুন্দর করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে পাত্রটি বায়ুশূন্য করে মুখবন্ধ করতে হবে।
একে ফিশকেনিং পদ্ধতি বলে। বরফ ছোট ছোট টুকরা করে ঝুড়ি বা প্যাকিং বাক্সের তলায় ঘন করে স্তরে স্তরে বরফ দিয়ে মাছ প্যাকিং করে দিতে হবে; ব্যবসাভিত্তিক মাছ কোল্ড স্টোরেজে কমদামে একসাথে অনেক সংরক্ষণ করা যায়; বালির ওপর মাছ ছাড়িয়ে দিয়ে অথবা দড়ি টানিয়ে রোদের তাপে ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। তবে তাজা মাছ খাওয়া বেশি সুস্বাদু এবং লাভজনক।
মাছ আমাদের অমূল্য প্রাণিজ জাতীয় সম্পদ। নিজেদের একান্ত প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি পদ্ধতি অনুসরণ এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করলে মাছ চাষে কম খরচে বেশি লাভবান হওয়া যায়। মাছ দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারব। রূপালি সম্পদে দেশকে টইটম্বুর করতে পারব। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে কৃষি নিয়ে দাঁড়াতে পারব। আমাদের পারিবারিক সামান্য জলসীমা যেন আমরা খালি না রেখে পরিকল্পিত উপায়ে মাছ চাষ করি।