Tag Archives: কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ

কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ

বিভিন্ন ধরনের ইকোসিস্টেম

বিভিন্ন ধরনের ইকোসিস্টেম – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ১ নং ইউনিটের ১.৩ নং পাঠ।

বিভিন্ন ধরনের ইকোসিস্টেম

 

আলো, বাতাস, পানি, মাটি, উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব এবং এদের পারস্পরিক ক্রিয়া—বিক্রিয়া বিশে­ষণে গোটা পৃথিবীটাই একটি বিশাল ইকোসিস্টেম। কিন্তু বিশ্লেষণ ক্ষমতার বিচারে এত ব্যাপক একটি ইকোসিস্টেম পর্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনা করা খুবই দূরহ ব্যাপার। সে কারণেই ইকোসিস্টেমের শ্রেণিবিন্যাস প্রয়োজন যাতে করে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি একক হিসেবে তা পর্যবেক্ষণ করা যায়।
এদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ইকোসিস্টেম। 

 

১। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম :

প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমগুলো মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রাকৃতিক পরিবেশে গতিময়তা বজায় রেখে চলে। বসতির (ঐধনর:ধ:) প্রকৃতি অনুযায়ী এরা দু’ধরনের হয়ে থাকে। যেমন:

(ক) স্থলজ ইকোসিস্টেম :

যেমন: বনজ ইকোসিস্টেম, তৃণভ মির ইকোসিস্টেম, সাভানা ইকোসিস্টেম, মরুজ ইকোসিস্টেম ইত্যাদি।

(খ) জলজ ইকোসিস্টেম :

যেমন: পুকুর, নদী, ঝরনা, খাল, হ্রদ ইত্যাদি স্বাদু পানির ইকোসিস্টেম এবং সাগর, মহাসাগর, মোহনা ইত্যাদি লোনা পানির ইকোসিস্টেম।

 

২। কৃত্রিম ইকোসিস্টেম :

এসব ইকোসিস্টেমের ভৌত রাসায়নিক পরিবেশ বহুলাংশে মানুষের নিয়ন্ত্রণে থেকে পরিচালিত হয়, যেমন: কৃষিজ ইকোসিস্টেম। উপাদানের দিক বিশ্লেষণে প্রতিটি ইকোসিস্টেমের ধরন প্রায় একই রকম। কারণ সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে স্ব—ভোজী ও পরভোজী উপাদান। কিন্তু যে সকল জীব নিয়ে উপাদানগুলি গঠিত তা ভিন্নতর। এখানে কয়েকটি প্রধান ইকোসিস্টেমের বর্ণনা দেয়া হ‘ল।

 

১। পুকুরের ইকোসিস্টেম :

পুকুরের ইকোসিস্টেম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পদ্ধতি। এর উপাদানগুলি নিম্নরূপে উপস্থাপন করা যায় :

 

(ক) জড় উপাদান :

জড় বস্তুর মধ্যে প্রধান জৈব ও অজৈব যৌগিক উপাদানগুলো হচ্ছে পানি, কার্বন—ডাই—অক্সাইড, অক্সিজেন, ক্যালসিয়াম, নাইট্রোজেন, ফসফেট, অ্যামিনো এসিড, হিউমিক এসিড ইত্যাদি। এগুলোর অধিকাংশই পুকুরের তলদেশে তলানী হিসেবে জমা থাকে এবং কিছু পরিমাণ উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে দ্রবণীয় অবস্থায় থাকে। পুকুরের ইকোসিস্টেমে দু’ধরনের প্রাথমিক উৎপাদনকারী পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রয়েছে সবুজ উদ্ভিদ ও কিছু সালোক—সংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া, আবার অন্যদিকে রয়েছে ফাইটোপ্লাংটন।

 

(খ) প্রাথমিক উৎপাদনকারী :

পুকুরের ইকোসিস্টেমে দু’ধরনের প্রাথমিক উৎপাদনকারী পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রয়েছে সবুজ উদ্ভিদ ও কিছু সালোক—সংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া, আবার অন্যদিকে রয়েছে ফাইটোপ্লাংটন। মাটির সঙ্গে সংযুক্ত অথবা ভাসমান সবুজ উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে, শাপলা, শালুক, কচুরীপানা, টোপাপানা, ক্ষুদিপান, হাইড্রিলা, ইলোডিয়া ইত্যাদি। ফাইটোপ্লাংটনগুলি সাধারণত ছোট ছোট মুক্ত ভাসমান নিম্নশ্রেণির শৈবালজাতীয় উদ্ভিদ ও ফ্ল্যাজিলেট। পুকুরে এদের বিস্তৃতি সাধারণভাবে যতদর গভীরতায় সূ ূর্যের আলো পেঁৗছে ততদূর পর্যন্ত। তবে পুকুরের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এরা গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

 

(গ) খাদক  :

পুকুরের তলদেশে বাস এবং উদ্ভিদ অবশেষের উপর নির্ভরশীল বেনথনিক জীবগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মাছ, কীট—পতঙ্গ, ঝিনুক, শামুক, ক্রাস্টেশিয়ান ইত্যাদি। এসব তৃণভোজী ছাড়াও রয়েছে গৌণখাদক, যেমন: ছোট মাছ খেয়ে জীবন ধারণকারী বড় মাছ ও কীট—পতঙ্গ, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি এবং রটিফারজাতীয় জুপ্লাংটন।

(ঘ) বিয়োজক :

পুকুরের বিয়োজকদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ফ্ল্যাজিলেটস এবং ছত্রাকের প্রাধান্যই বেশি। এরা সমস্ত পুকুরে সুবিস্তৃত থাকলেও কর্দমাক্ত স্থানে
অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। এছাড়া পুকুরে কিছু সংখ্যক ট্রান্সফরমার ব্যাকটেরিয়াও থাকে।

 

২। সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম :

ভূ—পৃষ্ঠের প্রায় ৭০ ভাগ স্থান জুড়ে রয়েছে সাগর, মহাসাগরের বিস্তৃতি। সাগরের পানি লবণাক্ত হওয়ার কারণে এর রাসায়নিক পরিবেশ খুব স্থিতিশীল।

(ক) উৎপাদক :

সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের প্রধান উৎপাদক হচ্ছে ফাইটোপ্লাংটন। যেমন:সবুজ, নীলাভ—সবুজ, লোহিত এবং ধূসর শৈবাল আধিক্যই বেশি।

(খ) খাদক :

প্রাথমিক তৃণভোজী খাদকের মধ্যে ক্রাস্টেশিয়ান, মোলাক্স (শামুক, ঝিনুক), শাকাশী মাছ ইত্যাদি প্রধান। গৌণ খাদকের মধ্যে রয়েছে ঐবৎৎরহম, ঝযধৎশ, ঈড়ফ, গধপশবৎবষ ইত্যাদি মাংসাশী মাছসমূহ।

(গ) বিয়োজক :

সমুদ্রে মৃত জীবের বিয়োজক হিসেবে ব্যাকটেরিয়ার প্রাধান্যই মুখ্য। এছাড়াও রয়েছে কিছু ছত্রাক। সমুদ্রের ১ লিটার পানিতে ৫ লক্ষ পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া জীবের বর্জ্য ও মৃতদেহের উপর ক্রিয়া—বিক্রিয়া দ্বারা উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় অজৈব পদার্থ সৃষ্টি করে।

যেসব অঞ্চলে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি কিন্তু তাপমাত্রা বেশি নয় সেসব স্থানে বনভূমির সৃষ্টি হয়। আবহাওয়ার তারতম্যের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে।

 

৩। বনজ ইকোসিস্টেম :

যেসব অঞ্চলে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি কিন্তু তাপমাত্রা বেশি নয় সেসব স্থানে বনভূমির সৃষ্টি হয়। আবহাওয়ার তারতম্যের উপর নির্ভর করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। এসব বনাঞ্চলের নির্ধারিত ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় থাকলেও কর্ম পদ্ধতি প্রায় অবিচ্ছেদ্য।

(ক) উৎপাদক :

বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদই বনের মুখ্য উৎপাদক। অবশ্য বনাঞ্চলের প্রকৃতি অনুযায়ী বৃক্ষরাজির বিভিন্নতা ও স্তরবিন্যাসে পার্থক্য রয়েছে। যেমন: উষ্ণমন্ডলীয় বনভূমি পত্রঝরা প্রকৃতির হওয়ায় সেখানে কিছু ছায়া প্রেমিক গুল্ম ও বীরুতজাতীয় গাছও জন্মে; আবার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলীয় বনভূমিতে পত্রঝরা, চিরহরিৎ, কনিফার ধরনের অরণ্য সৃষ্টি হয়।

(খ) খাদক :

প্রাথমিক খাদক হচ্ছে তৃণভোজী প্রাণী, যেমন: পোকা—মাকড়, হরিণ, বাদুর, বিভিন্ন ধরনের পাখি, কাঠবিড়ালি, ইঁদুর, হাতি ইত্যাদি। আবার গৌণ খাদকের মধ্যে রয়েছে, সাপ, পাখি, গিরগিটি, শিয়াল ইত্যাদি এবং টার্সিয়ারি খাদকের মধ্যে রয়েছে— কিছু পাখি, বাঘ, সিংহ হায়েনা প্রভৃতি।

(গ) বিয়োজক :

বনজ ইকোসিস্টেমের বিয়োজকের মধ্যে রয়েছে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, নেমাটোড, এনেলিডা, মিলিপেড, সেণ্টিপেড, ফ্ল্যাটওয়ার্ম, কেঁচো, শামুক, পিপড়া, উঁইপোকা ইত্যাদি।

পৃথিবীর এক বিস্তির্ণ এলাকা ( প্রায় ১৩ মিলিয়ন বর্গ মাইল) তৃণদ্বারা আচ্ছাদিত। এখানে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫—৭৫ সে. মি. যার ফলে প্রচুর ঘাস জন্মে এবং এধরনের ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে।

 

৪। তৃণভূমির ইকোসিস্টেম :

পৃথিবীর এক বিস্তির্ণ এলাকা (প্রায় ১৩ মিলিয়ন বর্গ মাইল) তৃণদ্বারা আচ্ছাদিত। এখানে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫—৭৫ সে. মি. যার ফলে প্রচুর ঘাস জন্মে এবং এধরনের ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য তৃণভূমির মধ্যে কানাডার বিস্তির্ণ সমতলভূমি, যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেণ্টিনা, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত তৃণভূমি রয়েছে।

(ক) প্রাথমিক উৎপাদক :

এৎধসরহবধব ও ঈুঢ়বৎধপবধব পরিবারের উদ্ভিদের প্রাধান্যই বেশি। তবে কিছু কিছু গুল্ম ও বিরুৎকেও প্রাথমিক উৎপাদক হিসেবে দেখা যায়।

(খ) খাদক :

তৃণভোজী প্রাণী বিশেষ করে স্তন্যপায়ী জীব, পাখি, পোকা—মাকড় ও সরীসৃপ তৃণের উপর মূখ্য খাদক হিসেবে নির্ভরশীল। গৌণ খাদকের মধ্যে রয়েছে শিয়াল, সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, পাখি ইত্যাদি।

 

(গ) বিয়োজক :

বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও মোল্ড, ইত্যাদি উলে­খযোগ্য। বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে কম (সাধারণভাবে ২৫ সে.মি.—এর নিচে) এবং যেখানে তাপের আধিক্য রয়েছে সেখানে মরুজ ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে। পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ১৭ ভাগ এলাকাই মরুময়।

 

৫। মরুজ ইকোসিস্টেম :

বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে কম (সাধারণভাবে ২৫ সে. মি.এর নিচে) এবং যেখানে তাপের আধিক্য রয়েছে সেখানে মরুজ ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে। পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ১৭ ভাগ এলাকাই মরুময়।

(ক) প্রাথমিক উৎপাদক :

প্রধান উৎপাদকের মধ্যে রয়েছে গুল্ম, ঝোপ—ঝাড়, ক্যাকটাস, মস, লাইকেন, কিছু ঘাস ও বৃক্ষ, নীলাভ—সবুজ শৈবাল ইত্যাদি। এ সকল উদ্ভিদের মুল অসংখ্য শাখা প্রশাখাযুক্ত এবং মাটির সামান্য নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে সামান্য বৃষ্টিপাত হলে খুব সহজেই পানি সংগ্রহ করতে পারে। প্রস্বেদনের হার কমানোর জন্য এদের পাতা, কান্ড ও শাখাগুলো বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়ে থাকে।

(খ) খাদক :

এই ইকোসিস্টেমে উৎপাদন কম হওয়ার কারণে খাদকের সংখ্যাও কম। মরু খাদকের মধ্যে সরীসৃপজাতীয় প্রাণী ও কীট—পতঙ্গ প্রধান। এছাড়া রয়েছে মরু—জাহাজ বলে খ্যাত উট, মেষ, মরু ব্যাঙ, ইঁদুর, পেঁচা, টিকটিকি ইত্যাদি প্রাণী।

(গ) বিয়োজক :

মরুজ ইকোসিস্টেমে তুলনামুলকভাবে বিয়োজকের সংখ্যাও খুব সীমিত। ফলে মৃতদেহ পঁচে হিউমাস তৈরি হবার পরিবর্তে অত্যধিক তাপে তা শুকিয়ে যায়। একারণেই সেখানে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় না। তবু তাপ সহ্যকারী কিছু সংখ্যক ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া সেখানে বিয়োজক হিসেবে কাজ করে।

কৃষিজ ইকোসিস্টেম :

এটি মানব সৃষ্ট একটি কৃত্রিম ইকোসিস্টেম। এখানে মানুষ তার চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ফসলের সর্বোচ্চ উৎপাদন বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক, সেচের ব্যবস্থা, আগাছা অপসারণ ইত্যাদি কার্যক্রম চালু রাখে। ফলে এখানে উৎপাদনই মুখ্য বিষয়।

(ক) জড় উপাদান :

স্থানীয় জলবায়ু, মৃত্তিকার ধরন ও খনিজ পদার্থের পরিমাণ, ব্যবহৃত জৈব ও অজৈব সার ইত্যাদি মিলেই কৃষিজ ইকোসিস্টেমের জড় উপাদান।

(খ) উৎপাদক :

চাষকৃত উদ্ভিদই শস্য ক্ষেত্রের মুখ্য উৎপাদক। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের আগাছা যা শস্য ক্ষেত্রে জন্মে তারাও উৎপাদক হিসাবে বিবেচিত।

(গ) খাদক :

প্রাথমিক স্তরে খাদকের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পোকা, শশক, ইঁদুর, পাখি, গবাদি পশু, মানুষ ইত্যাদি। গৌণ খাদকের মধ্যে রয়েছে ব্যাঙ, সাপ, বিভিন্ন ধরনের পাখি যারা পোকা—মাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে।

(ঘ) বিয়োজক :

প্রধান বিয়োজককারীরা হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অপ:রহড়সুপব:বং. এদের পঁচনক্রিয়ার ফলেই মাটিতে উৎপাদকের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ মজুত থাকে।

 

 

ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ইকোসিস্টেম

ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ইকোসিস্টেম , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ১ নং ইউনিটের ১.৫ নং পাঠ।

ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ইকোসিস্টেম

কোন জীবই পৃথিবীতে অবিমিশ্র অবস্থায় বাস করতে পারে না। প্রায় সকল জীবই একদিকে তার পরিবেশ অন্যদিকে অন্যান্য জীবের সাথে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। বিভিন্ন জাতের জীবের এরূপ সমষ্টিগত বসবাসরীতিকে জীব—স¤প্রদায়  বলে। আবার জীব—সম্প্রদায় এবং অজৈব পরিবেশের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া—বিক্রিয়া দ্বারা একটি অবিচ্ছেদ্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয় যার নাম ইকোসিস্টেম। এ.জি. টেনসলি (১৯৩৫) নামে একজন বৃটিশ পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। পরে সুকাচেভ নামক একজন রুশ পরিবেশ বিজ্ঞানী এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ইকোসিস্টেম হচ্ছে একটি গতিময় পদ্ধতি যেখানে জীব ও জড় উপাদানের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়াবিক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের গঠন ও কার্যের পরিবর্তন ঘটছে।

 

ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা :

ইকোসিস্টেম (Ecosystem) একটি ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা প্রতিশব্দ বাস্তুতন্ত্র। বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম হচ্ছে জৈব, অজৈব পদার্থ ও বিভিন্ন জীবসমন্বিত এমন প্রাকৃতিক একক যেখানে বিভিন্ন জীবসমষ্টি পরস্পরের সাথে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে।

ই. পি. ওডামের মতে:

ইকোসিস্টেম বলতে জীব, প্রকৃতি ও তাদের আনুষঙ্গিক উপাদানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিক্রিয়ার মূল কার্যকর একককে বুঝায়। কিন্তু, এস. মাথাভান (১৯৭৪) এর মতে, জীব ও তার পরিবেশ নিজেদের মধ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া—বিক্রিয়ার পদ্ধতিকে ইকোসিস্টেম বলে।

 

 

 

 

ইকোসিস্টেমের কার্য পদ্ধতি :

ইকোসিস্টেমে উদ্ভিদ, প্রাণী ও তাদের পরিবেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত সম্পদ সৃষ্টি ও বিনিময় ঘটছে। এই প্রক্রিয়াকে সম্পদের আবর্তন (ঈুপষরহম ড়ভ সধঃবৎরধষং) বলে। এই আবর্তন প্রক্রিয়ায় সকল শক্তির উৎস সূর্য। একমাত্র সবুজ উদ্ভিদ সৌর শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম। এভাবে সঞ্চিত শক্তি খাদ্য হিসেবে এক জীব থেকে অন্য জীবে স্থানান্তর হয় এবং সেখান থেকে আবার অন্য জীবে স্থানান্তরিত হতে থাকে। প্রতিটি খাদ্য স্থানান্তরের ধাপকে খাদ্য স্তর (ঞৎড়ঢ়যরপ ষবাবষ) বলে। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরেই অবশ্য কিছুটা শক্তির অপচয় ঘটে। এই সমগ্র পদ্ধতির নাম শক্তির প্রবাহ (ঋষড়ি ড়ভ বহবৎমু)। ইকোসিস্টেমে জীব ও জড়ের মধ্যে শক্তি প্রবাহ বহমান থাকায় একে গতিশীল বলে মনে করা হয়।

 

ইকোসিস্টেমের উপাদান :

কার্যপ্রণালির দিক বিবেচনায় ইকোসিস্টেমের উপাদান সম হকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এর এক দিকে রয়েছে অটোট্রফিক বা স্বভোজী যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপন্ন করতে সমর্থ, যেমনঃ সবুজ উদ্ভিদ। আবার অন্যদিকে আছে হিটারোট্রফিক বা পরভোজী যারা খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না বলে খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল, যেমনঃ মানুষসহ অন্যান্য সকল প্রাণী। কিন্তু গঠনগত দিক বিবেচনায় ইকোসিস্টেমের উপাদানগুলিকে জড় ও জৈবিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

 

১। জড় উপাদান: 

ইকোসিস্টেমের জড় উপাদানগুলো সাধারণত দু’ধরনের হয়ে থাকে। এর একদিকে রয়েছে মাটি, পানি, খাদ্য, কার্বন—ডাই—অক্সাইড, নাইট্রেজেন, ফসফরাস, প্রভৃতি মৌলিক ও যৌগ দ্রব্যসমূহ এবং অন্যদিকে রয়েছে আলো, তাপ ইত্যাদি শক্তিসমূহ। এগুলি উদ্ভিদ দ্বারা গৃহীত হয় এবং সূর্যালোকের সাহায্যে খাদ্যে রূপান্তরিত হয়। আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীবের সাহায্যে মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ পঁচনের ফলে পুনরায় মাটি ও বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়াকে জীব—ভূ—রাসায়নিক চক্র (ইরড়মবড়পযবসরপধষ পুপষব) বলা হয়। তবে প্রতিটি উপাদানেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং স্থান—কালভেদে পরিবর্তনশীল যা জীবের প্রাচুর্য ও বিস্তৃতিকে প্রভাবিত করে।

 

২। জৈবিক উপাদান:

পরিবেশের জৈবিক উপাদানসমূহকে চারটি প্রধান অংশে ভাগ করা যায়, এরা হচ্ছে উৎপাদক, খাদক, বিয়োজক ও রূপান্তরক।

(ক) উৎপাদক 

এরা সাধারণভাবে নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে পারে। এজন্য এদরেকে বলা হয় স্বভোজী (অঁঃড়ঃৎড়ঢ়যং)। সবুজ উদ্ভিদ পত্রস্থ ক্লোরোফিলের সাহায্যে সৌর শক্তিকে পানি ও কার্বন—ডাই—অক্সাইডযোগে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে জৈব খাদ্য উৎপাদন করে। এই খাদ্য উদ্ভিদ নিজে ব্যবহার করে এবং অন্যদের খাদ্যের যোগান দেয়। সবুজ উদ্ভিদ ছাড়াও কিছু কেমোসিনথেটিক ব্যাকটেরিয়া এবং বেগুনি রংএর ক্যারোটিনযুক্ত ব্যাকটেরিয়া সূর্যালোক ও যৌগিক পদার্থের উপস্থিতিতে নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে। এজন্য এদেরকেও প্রাথমিক উৎপাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

(খ) খাদক 

যে সকল জীব নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে না বরং খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎপাদকের উপর নির্ভরশীল তাদেরকে খাদক বলে। যে সকল প্রাণী একমাত্র উদ্ভিদকেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদেরকে প্রাথমিক খাদক বলে। যেমনঃ ফড়িং, প্রজাপতি, কীট—পতঙ্গ, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হরিণ, খরগোশ ইত্যাদি। আবার কিছু প্রাণী আছে যারা সরাসরি খাদ্য হিসেবে উদ্ভিদ গ্রহণ না করে তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে। সেইজন্য এদেরকে দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদক বা গৌণ খাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যেমনঃ ব্যাঙ, সাপ, কাক, চিল ইত্যাদি প্রাণী। আবার কিছু কিছু মাংসাশী প্রাণী আছে যারা অন্য প্রাণীকতৃর্ক খাদ্যরূপে গৃহীত হয় না। এদেরকে সর্বোচ্চ খাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেমনঃ বাঘ, সিংহ, বাজপাখি, কুমির, হাঙ্গর ইত্যাদি। কিছু কিছু প্রাণী আছে যারা অবশ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়কেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে থাকে। এদেরকে বলা হয় সর্বভূক প্রাণী, যেমনঃ মানুষ।

(গ) বিয়োজক

যে সকল অণুজীব মৃত জীবদেহে অবস্থিত জৈব পদার্থগুলিকে ধাপে ধাপে ভেঙ্গে সরল পদার্থে রূপান্তরিত করে তাদেরকে বিয়োজক বলে। যে সকল অণুজীব মৃত জীবদেহে অবস্থিত জৈব পদার্থগুলিকে ধাপে ধাপে ভেঙ্গে সরল পদার্থে রূপাš রিত করে তাদেরকে বিয়োজক বলে। ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া বিয়োজকের পর্যায়ভুক্ত। এদের প্রভাবেই প্রাণীদেহের জৈব পদার্থগুলি উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী অজৈব পদার্থে রূপাš রিত হয়। বিয়োজকদেরকে অনেক সময় খাদক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কেননা জৈব পদার্থকে সরল পদার্থে পরিণত করার সময় এরা জৈব পদার্থ থেকে শক্তি সঞ্চয় করে থাকে।

 

(ঘ) রূপান্তরক 

যে সকল ব্যাকটেরিয়া পঁচনের ফলে উৎপন্ন বস্তুর উপর ক্রিয়ার দ্বারা সেগুলিকে জৈব ও অজৈব পদার্থে রূপান্তরিত করে তাদেরকে রূপান্তরক বা ট্রান্সফরমার বলে। বিয়োজক ও ট্রান্সফরমারগুলো ইকোসিস্টেমের গতিময়তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এদের ক্রিয়া—কর্মের ফলেই জৈব ও অজৈব উপাদানসমূহ জৈব—ভূ—রাসায়নিক চক্রের মাধ্যমে আদি অবস্থানে ফিরে যায়। অন্যথায়, পৃথিবীর সকল ইকোসিস্টেমই মৃত জৈব উপাদানের আধিক্যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেত।

 

খাদ্য – শিকল 

প্রকৃতিতে একমাত্র সবুজ উদ্ভিদই নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে অর্থাৎ তারা স্বভোজী। অন্যসব জীবকে খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপরই নির্ভর করতে হয়। উদ্ভিদ যে খাদ্য তৈরি করে তার কিছু অংশ নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করে, বাকি অংশ তার দেহে সঞ্চিত করে রাখে। এই সঞ্চিত খাদ্যই তৃণভোজী প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার মাংসাশী প্রাণীরা তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এভাবে সকল জীব খাদ্য ও খাদক সম্পর্ক স্থাপন করে ইকোসিস্টেমে শক্তি প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখে এবং এর মধ্য দিয়ে উৎপাদক ও সর্বোচ্চ খাদক পর্যন্ত খাদ্যের যে ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয় তার নাম খাদ্য—শিকল ।

 

একটি খাদ্য—শিকলে উৎপাদকের সাথে কয়েকটি পর্যন্ত খাদক স্তর থাকতে পারে, তবে সর্বোচ্চ খাদককে কোন প্রাণী খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে না। প্রকৃতিতে সাধারণত তিন ধরনের খাদ্য—শিকল দেখা যায়—

(১) শিকারজীবী শিকল :

এই খাদ্য—শিকলে উৎপাদক থেকে প্রথমে ছোট প্রাণী, পরে ক্রমান্বয়ে বড় প্রাণী যুক্ত হয়। যেমনঃ

  • ঘাস
  • ফড়িং
  • ব্যাঙ
  • সাপ

(২) পরজীবী শিকল :

এখানে বড় জীব থেকে ক্রমান্বয়ে ছোট জীবের মধ্যে খাদ্য—শিকল গড়ে উঠে, যেমনঃ

  • মানুষ
  • মশা
  • ম্যালেরিয়ার জীবাণু

(৩) মৃতজীবী শিকল :

এখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃতদেহের উপর ভিত্তি করে খাদ্য—শিকল গড়ে ওঠে, যেমনঃ

  • মৃতদেহ
  • ছত্রাক
  • কেঁচো

 

খাদ্য – জাল 

প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমে খাদ্য—শিকলগুলো সকল সময় সরল পথে চলে না অর্থাৎ প্রয়োজনবোধে প্রাণীর খাদ্য স্তরের পারস্পরিক বিনিময় ঘটে। যেমনঃ একটি কাক সরাসরি গাছের ফলকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে অথবা তৃণভোজী কীট—পতঙ্গকে খাদ্য হিসেবে বেছে নিতে অথবা কীট—পতঙ্গকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণকারী অন্য কোন প্রাণীকেও তার খাদ্য—সামগ্রীর অšর্Íভূক্ত করতে পারে। এভাবে একটি ইকোসিস্টেমে বিভিন্ন খাদ্য—শিকলের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় ও সংযুক্তির মাধ্যমে যে জটিল সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার নাম খাদ্য—জাল। সাধারণত খাদ্য—জালে উৎপাদকের সংখ্যা অধিক থাকলেও খাদকের সংখ্যা প্রতিস্তরে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে থাকে।

চিত্র ১.২—২ খাদ্য—জাল

 

যে কোন ইকোসিস্টেমে প্রাথমিক উৎপাদক প্রথম স্তরের খাদক, দ্বিতীয় স্তরের খাদক, তৃতীয় স্তরের খাদক এবং এভাবে সর্বোচ্চ খাদকের সংখ্যা ভর এবং শক্তির মধ্যে কোন না কোন ভাবে একটি সম্পর্ক বজায় থাকে। খাদ্যস্তরগুলির মধ্যে এই সম্পর্ককে লৈখিক চিত্র অঙ্কন দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব, যা ইকোলোজিক্যাল পিরামিড নামে পরিচিত। ইকোলোজিক্যাল পিরামিডগুলো তিন ধরনের হয়ে থাকে (ক) সংখ্যার পিরামিড, (খ) জীবভরের পিরামিড এবং (গ) শক্তির পিরামিড। সংখ্যা ও জীবভরের পিরামিডের আকৃতি খাড়া বা উল্টানো অথবা অন্য কোন ধরনের হতে পারে, কিন্তু শক্তির পিরামিড সর্বদাই খাড়া আকৃতির হয়ে থাকে।


ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মঙ্গলের জন্যই ইকোসিস্টেম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। সবুজ উদ্ভিদ ঈঙ২, পানি, খাদ্য উপাদান ইত্যাদি ব্যবহার করে সূর্যালোকের সাহায্যে শ্বেতসারজাতীয় খাদ্য উৎপাদন করছে। এই উৎপাদনের ফলেই উদ্ভিদের আঙ্গিক ও দৈহিক বৃদ্ধি ঘটছে। মানুষসহ সকল প্রাণীর জীবনচক্র চালু রাখার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খাদ্য হিসেবে উদ্ভিদকর্তৃক উৎপাদিত উপাদানের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়। এ কারণেই সব ধরনের ইকোসিস্টেম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা এত তাৎপর্যপূর্ণ।

 

পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা

পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা- নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ১ এর ১.১ নং পাঠ।

পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা

 

পরিবেশের ধারণা পরিবেশ কথাটি বহুলভাবে ব্যবহৃত, যেমনঃ সামাজিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি আরও অনেক পরিবেশ। তবে পরিবেশ বিজ্ঞান জীব বিজ্ঞানেরই একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ও আধুনিকতম সংকলন যেখানে জীবের সাথে তার পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিজ্ঞানের যে শাখা জীবের পারিপার্শি¦কতার সাথে জীবকূলের প্রতিটি পারস্পরিক ক্রিয়া—বিক্রিয়া নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করে তাই পরিবেশ বিজ্ঞান।

পরিবেশের সাথে প্রাণীজগতের সম্পর্ক নিয়ে আলোচিত বিদ্যাকে ইকোলজি বলা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী পরিবেশের নানাবিধ সংজ্ঞা দিয়েছেন। যার উৎপত্তি ও বিস্তৃতি ব্যাপক বিধায় স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে বহুল প্রচলিত ও সমাদৃত কয়েকটি সংজ্ঞা এখানে দেওয়া গেল।

 

পরিবেশ বিজ্ঞানের সংজ্ঞা :

(১) জৈব ও অজৈব পরিবেশের সাথে প্রাণীর অনাবিল সম্পর্ককেই পরিবেশ বিজ্ঞান বলে,  হেকেল, ১৮৬৯।

(২) পরিবেশের সাথে জীবের সম্পর্ক নিয়ে যে বিজ্ঞান অনুসন্ধান চালায় তাই পরিবেশ বিজ্ঞান। এটি জ্ঞানের এমন একটি দর্শন যেখানে জীবজগতকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়  উডবারি, ১৯৫৫।

(৩) জীবক লের প্রাচুর্য ও বিস্তার সম্পর্কিত সুনিদিষ্ট গবেষণাই পরিবেশ বিজ্ঞান  এন্ড্রিয়ার্থা, ১৯৬১।

(৪) পরিবেশ বিজ্ঞান হচ্ছে পরিবেশের আন্তঃক্রিয়াদির অধ্যয়ন যা জীবের বিস্তার, উৎপাদন প্রাচুর্য ও অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে এবং মঙ্গল সাধন করে  পেট্রিডিস, ১৯৬৮।

(৫) প্রকৃতির গঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে অধ্যয়নই হচ্ছে পরিবেশ বিজ্ঞান  ওডাম, ১৯৭১।

(৬) জীবের প্রাচুর্য ও বণ্টন নির্ণয়কারী আন্তঃক্রিয়াদির বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনাই হচ্ছে পরিবেশ বিজ্ঞান  ক্রেব, ১৯৭২।

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর সার সংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, আমাদের চার পাশে যা কিছু আছে এবং যা কিছুই আমাদের জীবনধারাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তাই আমাদের পরিবেশ।

 

পরিবেশের উপাদান :

সাধারণভাবে পরিবেশ বলতে জীবের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেই বুঝায়। তবে পরিবেশ আসলে একটি জটিল পদ্ধতি যা বহুবিধ উপাদানের সমষ্টি নিয়ে গঠিত। বাহ্যিক যে সকল বস্তু বা উপাদান জীবকে ঘিরে রেখেছে এবং যা জীবকে তার বিকাশ ও বিস্তারে প্রভাবিত করে তাই পরিবেশের উপাদান। এই উপাদানগুলো সজীব ও জড় উভয়বিধই হতে পারে। পরিবেশের মৌলিক উপাদানসমূহকে পরবতীর্ পৃষ্ঠায় ছকে দেখানো হলো।

 

পরিবেশের উপাদানসমূহের আন্তঃক্রিয়া:

প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশেষ কোন একক উপাদানের চেয়ে উপাদানসমুহের সমষ্টিগত প্রভাব জীবের উপর বেশি অবদান রাখে। এর কারণ এই যে, উপাদানগুলো পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। পরিবেশের কোন একটি উপাদানের তারতম্য ঘটলে অন্য উপাদানের ক্রিয়াকান্ডও তাদ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায় যা ঐড়ষড়পড়বহড়ঃরপ প্রভাব বলে খ্যাত। যেমনঃ সূর্যালোকের প্রখরতা বাড়লে উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার বৃদ্ধি পায়। প্রস্বেদন হার বাড়লে বিপাকীয় কাজ প্রভাবিত হয় ইত্যাদি।

বিভিন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী পরিবেশের উপাদানগত শ্রেণিবিন্যাস বিভিন্নভাবে দিয়ে থাকলেও অধিকাংশের মতে চারটি ভাগের উপরই প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে।

১। জলবায়ুগত উপাদান

(ক) আলো :

এ পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবনকে কার্যকর রাখার জন্য সকল শক্তির উৎস সৌর শক্তি। সবুজ উদ্ভিদ পত্রস্থ ক্লোরোফিলের সাহায্যে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আলোকশক্তি শোষণ করে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে এবং শর্করাজাতীয় খাদ্য উৎপাদন করে তাকে সালোক—সংশ্লেষণ বলে।

সালোক—সংশ্লেষণ বিবর্জিত উদ্ভিদের অস্তিত্ব যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি উদ্ভিদ ছাড়া অন্য প্রাণীর জীবন ধারণও প্রায় অসম্ভব। আর এসবই হচ্ছে আলোক শক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সালোক—সংশে­ষণ ছাড়াও উদ্ভিদের গঠন, আকৃতি, পত্রবিন্যাস, পাতার পুরুত্ব, ক্লোরোফিলের পরিমাণ, প্রস্বেদন, পুষ্পায়ন এবং আরও বহুবিধ জৈবিক কার্যাবলী আলো দ্বারা সংঘটিত বা প্রভাবিত হয়। পৃথিবীতে পতিত আলোক রশ্মির তীব্রতা ও স্থায়ীত্ব, ঋতুভেদ, অক্ষাংশ, ভূমির ঢাল ও দিক, বায়ুমন্ডলের স্বচ্ছতা, আর্দ্রতা, কুয়াশা, মেঘ ইত্যাদি উপকরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

যে সকল উদ্ভিদ তীব্র আলোতে ভাল জন্মে (যেমনঃ ধান, পাট, গম, আম, তূলা ইত্যাদি) তাদেরকে আলো পছন্দকারি উদ্ভিদ বা হেলিওফাইট বলে। আবার যে সকল উদ্ভিদ ছায়াযুক্ত স্থানে জন্মানো পছন্দ করে (যেমনঃ ফার্ণ, পান, বনের নিম্নস্তরের লতাগুল্ম ইত্যাদি) তাদেরকে ছায়া পছন্দকারি উদ্ভিদ বা সাইওফাইটস বলে।

(খ) তাপমাত্রা :

উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে তাপমাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সকল বিপাকীয় কার্যক্রম, যেমনঃ সালোক—সংশ্লেষণ, শ্বসন, পরিশোষণ, অঙ্কুরোদগম, প্রস্বেদন, অভিস্রবন ইত্যাদি পরিবেশীয় তাপমাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাপমাত্রা কম বা বেশি হলে বিপাকীয় কার্যাবলীর উপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বেঁচে থাকার জন্য সকল উদ্ভিদের একটি সর্বোচ্চ শ্বসণ , পরিমিত  ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রয়েছে, যাকে কার্ডিনাল তাপমাত্রা বলা হয়। কোন আবাসস্থলে উদ্ভিদের বিস্তৃতি তার কার্ডিনাল তাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

যেমনঃ ধান গাছের অভিযোজন সর্বোচ্চ ৪০০ সে. এবং সর্বনিম্ন ৫০ সে. তাপমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ কিন্তু পরিমিত বা অনুকূল তাপমাত্রা ২০—৩০০ সে. এর মধ্যে। তাই উদ্ভিদের ভৌগলিক বিস্তৃতি তাপমাত্রার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাপমাত্রার তারতম্যের উপর নির্ভর করে উদ্ভিদসম হকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ঃ

(১) মেগাথার্ম — যে সকল উদ্ভিদ অতি উচ্চ তাপমাত্রা সম্পন্ন অঞ্চলে জন্মায়।

(২) মেসোথার্ম — এরা মূলত উষ্ণ প্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ। তবে বাৎসরিক ঋতুভেদে অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতাও সহ্য করতে পারে।

(৩) মাইক্রোথার্ম — এরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উদ্ভিদ বলে বছরের বেশির ভাগ সময়ই অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতা সহ্য করতে পারে।

(৪) হেকিস্টোথার্ম — এরা মেরু অঞ্চলের উদ্ভিদ, সারা বছর নিম্ন তাপমাত্রা সহনশীল।

অনুশীলন  ঃ আলো ও তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাস করুন। আপনার পরিচিত উদ্ভিদগুলোকে উল্লিখিত শ্রেণিবিন্যাসে বিভক্ত করুন।

বায়ুতে অবস্থিত ঈঙ২ গ্যাস উদ্ভিদের সালোক—সংশ্লেষণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে এর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য
দায়ী।

 

(গ) বায়ু :

বায়ু প্রবাহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিস্তৃতি প্রভাবিত করে। অনেক উদ্ভিদের বীজ একস্থান হতে অন্যস্থানে বায়ু দ্বারা স্থানান্তরিত হয়ে উদ্ভিদের বংশ বিস্তার ঘটায়। বহু উদ্ভিদের পরাগায়ণ বায়ুর মাধ্যমে হয়ে থাকে। মৃদু বায়ুতে উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার কম। কিন্তু প্রবল বায়ুতে তা বৃদ্ধি পেয়ে উদ্ভিদের পানির চাহিদা বাড়িয়ে তোলে। প্রবল বায়ু দ্বারা সংঘটিত জটিলতার মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের আকৃতিগত বিকৃতি, ভেঙ্গে পড়া, ঘর্ষণজনিত ক্ষতিসাধন, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি। এ ছাড়া বহু রোগের জীবাণু বায়ুবাহিত হয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর রোগের কারণ ঘটায়। বায়ুতে অবস্থিত ঈঙ২ গ্যাস উদ্ভিদের সালোক—সংশ্লেষণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে এর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য দায়ী।

 

(ঘ) বায়ুর আর্দ্রতা :

বায়ুর জলীয় আর্দ্রতাকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। কোন বায়ুতে অবস্থিত জলীয়—বাষ্পের বর্তমান অবস্থা এবং একই বায়ু সম্পৃক্ত হলে কতটুকু জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা রাখে তার অনুপাতকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বলে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা শতকরা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা কম—বেশির সাথে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও কম—বেশি হয়। উষ্ণতা বাড়লে আপেক্ষিক আর্দ্রতা কমে। আবার উষ্ণতা কমলে আপেক্ষিক আপেক্ষিক আর্দ্রতা উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার নিয়ন্ত্রণ করে বলে কোন্ অঞ্চলে কী ধরনের উদ্ভিদ জন্মাবে তা সে অঞ্চলের আপেক্ষিক আর্দ্রতার ওপর বহুলাংশে ি নর্ভরশীল।

আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার নিয়ন্ত্রণ করে বলে কোন্ অঞ্চলে কী ধরনের উদ্ভিদ জন্মাবে তা সে অঞ্চলের আপেক্ষিক আর্দ্রতার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। অনেক উদ্ভিদ আছে যারা শুষ্ক আবহাওয়ায় সংবেদনশীল কিন্তু আর্দ্র আবহাওয়ায় সহজেই জন্মাতে পারে। এদেরকে হাইগ্রোফাইটস বলে। যেমনঃ রাস্না, ঢেঁকিশাক ইত্যাদি।

 

(ঙ) বৃষ্টিপাত ও পানি :

উদ্ভিদ জীবনে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় যাবতীয় কার্যক্রম পানির মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। পানি সালোক—সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার অন্যতম উপাদান। পানির অবর্তমানে উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া চলতে পারে না। আর খাদ্য উৎপাদন ছাড়া উদ্ভিদের বেঁচে থাকার কথাই ভাবা যায় না। একারণেই পরিবেশীয় অন্যান্য উপাদান অপেক্ষা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদ বিস্তারের ক্ষেত্রে পানির তাৎপর্য অনেক বেশি।

কোন স্থানে উদ্ভিদের ধরন, ি বকাশ, বিস্তৃতি, ইত্যাদি নির্ভর করে সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ও পানির প্রাপ্যতার ওপর। কোন স্থানে উদ্ভিদের ধরন, বিকাশ, বিস্তৃতি, ইত্যাদি নির্ভর করে সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ও পানির প্রাপ্যতার উপর। আবার কোন এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নির্ভর করে অনেকটা উক্ত এলাকা সাগরের কতটা নিকটবর্তী, সাগর থেকে ভূমির দিকে প্রবাহিত বায়ুর গতিধারা, বায়ুতে জলীয় বাষ্পের প্রাচুর্যতা, অক্ষাংশ ইত্যাদির উপর। নিরক্ষীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বাধিক, পক্ষান্তরে মেরুঅঞ্চলের বৃষ্টিপাত সর্বনিম্ন।

 

উদ্ভিদ বাসস্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পানির প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে উদ্ভিদকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় :

 

(১) জলজ উদ্ভিদ :

যে সকল উদ্ভিদ জলজ পরিবেশে আংশিক বা সব সময় জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে জলজ উদ্ভিদ বলে। এরা নিমজ্জিত বা ভাসমান, মুক্ত বা নোঙ্গরাবদ্ধ হতে পারে, যেমনঃ কচুরীপানা, হাইড্রিলা, শেওলা, শাপলা ইত্যাদি। উভচর উদ্ভিদও জলজ উদ্ভিদের গোত্রেই পড়ে, যেমনঃ কলমী শাক এদের মূলকান্ড সুগঠিত নয়। অভিস্রবন চাপও খুব কম।

 

(২) সাধারণ উদ্ভিদ :

যে সকল উদ্ভিদ মাটিতে পরিমিত পানি থাকা অবস্থায় জন্মে তাদেরকে সাধারণ উদ্ভিদ বলে। এদের জীবন ধারণের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর প্রয়োজন। এদের জন্য জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা কোনটাই সহনীয় নয়, যেমনঃ গম, সরিষা, আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি। এদের মূল, কান্ড, শাখা—প্রশাখা সুগঠিত। অভিযোজন চাপ স্বাভাবিক।

(৩) মরুজ উদ্ভিদ :

যে সকল উদ্ভিদ শুষ্ক মাটিতে অথবা খুব কম বৃষ্টিপাত সম্পন্ন অঞ্চলে জন্মে তাদেরকে মরুজ উদ্ভিদ বলে। কম বৃষ্টিপাতসম্পন্ন এলাকায় জন্মে বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের পাতা, কান্ড, মূল, অভ্যন্তরীণ ও শারীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে প্রচুর রূপান্তর হয়ে থাকে। এদের উদাহরণ হচ্ছে — ফণিমনসা, ক্যাকটাস, করবি, খেজুর, ঝাউ, ঘৃত কুমারী ইত্যাদি।জোয়ার ভাটা বিধৌত সমুদ্রতীরবর্তী এ ধরনের উদ্ভিদকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলে, যেমনঃ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনের সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, গোলপাতা ইত্যাদি।

 

(৪) লোনা মাটির উদ্ভিদ :

যে সকল উদ্ভিদ লবণাক্ত পানি বা মাটিতে জন্মে তাদেরকে লোনা মাটির উদ্ভিদ বলে। এ সকল উদ্ভিদের পাতা প্রায়ই রসালো এবং ভূগর্ভস্থ মল ূ থেকে মাটির উপরে খাড়াভাবে শ্বাস—মূল দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জরায়ুজ—অঙ্কুরোদগম ঘটে এবং উচ্চ অভিস্রবন চাপ বিদ্যমান। জোয়ার ভাটা বিধৌত সমুদ্র তীরবর্তী এ ধরনের উদ্ভিদকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলে, যেমনঃ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনের সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, গোলপাতা ইত্যাদি।

২। মৃত্তিকাগত উপাদান

পরিবেশের মৃত্তিকাগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলী। মাটির গঠন, বুনট ইত্যাদি ভৌত গুণাবলী এবং মাটির অম্লত্ব, ক্ষারত্ব, লবণাক্ততা, খাদ্য উপাদান ইত্যাদি রাসায়নিক উপাদান দ্বারা উদ্ভিদের বর্ধন, বিকাশ ও বিস্তৃতি বহুলভাবে প্রভাবিত। মাটির পানি ধারণক্ষমতা তার ভৌত গুণাবলীর উপর নির্ভরশীল। অপরপক্ষে উদ্ভিদের খাদ্য সরবরাহের পরিমাণ মাটির রাসায়নিক গুণাবলীর উপর নির্ভরশীল। তাই সব মাটিতেই সব
উদ্ভিদ ভাল জন্মে না যেমনঃ ভারি মাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী, অপর দিকে হালকা দো— অঁাশ মাটি আখ, গম, সরিষা, ইত্যাদি চাষের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত।

 

৩। স্থান সংক্রান্ত উপাদান

স্থান সংক্রান্ত উপাদানের মধ্যে রয়েছে

(ক) ভূমির উচ্চতা ও বন্ধুরতা

(খ) অক্ষাংশ এবং

(গ) ভূমির ঢাল ও দিক।

(ক) ভূমির উচ্চতা ও বন্ধুরতা ঃ সাগর—পৃষ্ঠ থেকে ভূমি কত উচ্চতায় অবস্থিত অথবা ভূমির উপরিভাগের বন্ধুরতার ধরন উদ্ভিদ জীবনকে প্রভাবিত করে। কারণ এ দ্বারা আলো ও পানির প্রাপ্যতা এবং স্থানীয় জলবায়ু বহুলাংশে নির্ভরশীল।

(খ) অক্ষাংশ ঃ অক্ষাংশের অবস্থান, স্থানীয় জলবায়ু, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আলোর পরিমাণ ইত্যাদি আবহাওয়াগত উপাদানের নির্দেশক এবং এসবকিছু দ্বারাই উদ্ভিদ ও প্রাণী বিস্তার প্রভাবিত হয়। পৃথিবীর নিম্ন অক্ষাংশের মরু অঞ্চল উচ্চ তাপ ও পানির অভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী। আবার উচ্চ অক্ষাংশের মেরু অঞ্চল তীব্র শীত ও বরফজনিত কারণে বসবাসের অনুপযোগী।

(গ) ভূমির ঢাল ও দিক ঃ ভূমির ঢাল ও দিকের প্রভাব উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর বেশি অনুভূত হয় মধ্য ও উচ্চ অক্ষাংশে। নিম্ন অক্ষাংশে এর তেমন কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। কারণ সূর্য সারা বৎসরই এখানে লম্বভাবে কিরণ দিয়ে থাকে। ভূমির ঢালের মাত্রাও এখানে গুরুত্বপর্ণ, কারণ ু ঢালের পরিমাণ বেশি খাড়া হলে পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে তা উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য অনুকল নয়।

 

জৈবিক উপাদান

জীবকূলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রভাবকেই জৈবিক কারণ বলে। পরিবেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সকল প্রাণীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় বায়ুর যে ঈঙ২ গ্রহণ করে তা প্রাণীর শ্বসনজাত। পক্ষান্তরে প্রাণী নিঃশ্বাসের সাথে যে ঙ২ গ্রহণ করে তা উদ্ভিদের সালোক—সংশে­ষণ প্রক্রিয়ার উপজাত। প্রকৃতিতে উদ্ভিদ কর্তৃক ব্যবহৃত নাইট্রোজেনঘটিত খাদ্য ব্যাকটেরিয়া ও নীলাভ—সবুজ শৈবাল দ্বারা মাটিতে ধারণকৃত। তাছাড়া জীবকূলের মধ্যে রয়েছে সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা, মিথোজীবীতা, পরজীবীতা, পরাশ্রয়ীতা, ইত্যাদির মতো আরও অনেক ক্রিয়া কর্ম যা জীব সম্পর্কীয় উপাদানেরই অংশবিশেষ।

 

বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ

বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.৫ নং পাঠ।

 

বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ

 

বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের হার বাড়ানো প্রয়োজন। আর সেজন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি ও সময় মত কৃষকের নিকট লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর।

কৃষিক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি যোগ হতে থাকলে কম সময়ে স্বল্প পরিসর আবাদী জমিতে অধিক ফসল ফলিয়ে অধিক পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের হার বাড়ানো প্রয়োজন। আর সেজন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি ও সময় মত কৃষকের নিকট লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর। উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষ ও নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বিগত কয়েক বৎসরে অধিকাংশ ফসলেরই উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিক বিবেচনায় আনলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন সে তুলনায় বাড়েনি, তাই এ ঘাটতি পূরণের জন্য অধিকাংশ কৃষি পণ্যই আমাদের বিদেশ হতে আমাদানি করতে হয়।

প্রয়োজনের তুলনায় আমরা কী পরিমাণ কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করি এবং কতটুকু ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত্ব তার পরিসংখ্যান নিম্নে (ছক — ১) দেয়া হলো:
ছক — ১ ঃ কৃষি পণ্যের প্রয়োজন, উৎপাদন ও ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত্বের পরিমাণ (১৯৯২—৯৩) [‘০০০’ কেজি]

উপরের ছক হতে দেখা যায় বাংলাদেশে ধান উৎপন্ন হয় ১৮৩.৪১ লক্ষ টন এবং প্রয়োজন ১৮৩.৭১ লক্ষ টন। এ হিসেবে ঘাটতির পরিমাণ ৩০ হাজার টন। তবে খাদ্য হিসেবে ধানের (চাল) পরিবর্তে আমরা বেশি করে গম আমদানি করে থাকি। দেশে বর্তমানে ১১.৭৬ লক্ষ টন গম উৎপন্ন হয় এবং বিদেশ হতে আমদানি করা হয় ১০.৩৩ লক্ষ টন যা মোট প্রয়োজনের ৪৭ শতাংশ। দেশে গমের মোট প্রয়োজন ২২.০৯ লক্ষ টন। দেশে চিনির প্রয়োজন প্রায় ৮.২৪ লক্ষ টন এবং উৎপন্ন হয় প্রায় ৭.৫১ লক্ষ টন। প্রয়োজনীয় বাকী ৭৩ হাজার টন চিনি বিদেশ হতে আমদানি করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হয় অর্থাৎ চাহিদার প্রায় ৮১ শতাংশ চিনি আমরা উৎপন্ন করি।

দেশে ডালের উৎপাদন ৫.১৯ লক্ষ টন অথচ আমাদের প্রয়োজন ৫.৭৬ লক্ষ টন। বর্তমানে দেশে ডালের ঘাটতি ৫৭ হাজার টন। এ ঘাটতি মোট প্রয়োজনের ১০ শতাংশ। তৈল বীজ হতে আমরা যে তৈল পাই (তৈল বীজে ৩৩% তৈল ধরে হিসেবে করা হয়েছে) এর পরিমাণ প্রায় ১.৫৩ লক্ষ টন। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থাৎ প্রায় ৪.১২ লক্ষ টন।

তৈলের ঘাটতি ২.৫৯ লক্ষ টন যা আমরা বিদেশ হতে আমদানি করে থাকি এবং এর পরিমাণ প্রয়োজনের প্রায় ৬৩ শতাংশ। আমাদের প্রয়োজনীয় কৃষি পণ্যের মধ্যে তৈলের ঘাটতিই সবচেয়ে বেশি। মশলা, গোল আলু, শাকসব্জি ইত্যাদির প্রয়োজন যথাক্রমে ৩.১২, ১৩.৮৫ এবং ১২.৬২ লক্ষ টন এবং আমাদের দেশে এদের উৎপাদনের পরিমাণ যথাক্রমে ৩.০২, ১৩.৮৪ এবং ১১.৯৮ লক্ষ টন। যে সকল কৃষি পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি আছে সেগুলো আমদানি করে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হয়। প্রয়োজনের তুলনায় বিভিন্ন কৃষি পণ্যের ঘাটতির পরিমাণ শতকরা ০.০৫৬২.৯৮ ভাগ।

আমাদের সব কৃষি পণ্যেরই যে উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে তা নয় বরং কোন কোন পণ্য আমরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি উৎপন্ন করে থাকি। এ ক্ষেত্রে চা, পাট এবং তামাকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে । চায়ের বাৎসরিক উৎপাদন ৫০.৮ হাজার টন। এ উৎপাদন থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে আমরা ২৯.৬২ হজার টন বিদেশে রপ্তানি করে থাকি যা মোট উৎপাদনের ৫৮.৩ শতাংশ। দেশে পাটের মোট উৎপাদন প্রায় ৯.১৮ লক্ষ টন এবং এখান হতে প্রায় ৪.৩৩ টন বিদেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে এবং এটা মোট উৎপাদনের ৪৭.১৭ শতাংশ। বর্তমানে দেশে প্রয়োজনের চেয়ে ১ হাজার টন বেশি তামাক উৎপন্ন হয়।

তামাকের মোট উৎপাদন ৩৬.০০ হাজার টন এবং প্রয়োজন ৩৪.৯২ হাজার টন। উৎপাদিত অতিরিক্ত এক হাজার টন তামাক আমরা বিদেশে রপ্তানি করে থাকি যা মোট উৎপাদনের তিন শতাংশ। উৎপাদিত কৃষি পণ্যের মধ্যে শতকরা হিসেবে চা—ই আমরা বেশি রপ্তানি করে থাকি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে চা, পাট ও তামাকের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত্বের পরিমাণ যথাক্রমে ৫৮.৩, ৪৭.২ এবং ৩ শতাংশ ।

 

বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের তালিকা ও পরিমাণ

বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের তালিকা ও পরিমাণ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.৫ নং পাঠ।

 

বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের তালিকা ও পরিমাণ

 

আমদানিকৃত পণ্য বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের মাটি ও জলবায়ু ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। কিন্তু অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে দেশ আজ ভারাক্রান্ত এবং যে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয় তা এ বাড়তি

জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই প্রতি বছরই আমাদের বিদেশ হতে খাদ্য আমদানি করে এ ঘাটতি পুরণ করতে হয়। শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও বেশ কিছু পণ্য বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। বস্ত্র শিল্পের জন্য প্রতি বছরই আমাদের তুলা আমদানি করতে হয়। শিশুখাদ্য হিসেবে বিদেশ হতে প্রচুর পরিমাণে গুঁড়া দুধ আমদানি করতে হয়। প্রধান প্রধান কৃষি পণ্য যেগুলো বিদেশ হতে আমদানি করতে হয় তার খতিয়ান নিম্নে (ছক — ১) দেয়া হলো:
ছক — ১ ঃ আমাদানিকৃত প্রধান প্রধান কৃষি পণ্যের তালিকা।

রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্য

আমরা যে শুধু কৃষি পণ্য বিদেশ হতে আমদানি করি তা নয়, কিছু কিছু পণ্য আমরা বিদেশে রপ্তানিও করে থাকি। এক সময় একচেটিয়া পাট রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এক নম্বরে ছিল। বর্তমানেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সিংহভাগ আসে পাট ও চা রপ্তানি খাত হতে। তাছাড়া আমরা শুকনা ও হিমায়িত মাছ, চামড়া, তামাক ও তামাক জাত দ্রব্য ইত্যাদি বিদেশে রপ্তানি করে থাকি। প্রধান প্রধান কৃষি পণ্য যেগুলো আমাদের দেশ হতে বিদেশে রপ্তানি করা হয় তাদের নাম ও পরিমাণ নিম্নে (ছক — ২) দেয়া হলো:
ছক — ২ ঃ পরিমাণসহ রপ্তানিযোগ্য প্রধান প্রধান পণ্যের তালিকা।

উপরিউক্ত রপ্তানি পণ্য তালিকার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে কিছু কিছু রপ্তানি পণ্য যেমন হিমায়িত মাছ, চা, চামড়া ইত্যাদির রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। পাট ও পাটজাত দ্রব্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও এর রপ্তানির পরিমাণ ১৯৯২—৯৩ সনে কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে এবং উন্নত মানের পাট ও পাটজাত সামগ্রীর রপ্তানি বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।

রপ্তানি আয়ের বেশ একটা ভাল অংশ আসে চামড়া থেকে যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। চায়ের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে এবং সে সঙ্গে বাড়ছে এর রপ্তানির পরিমাণ এবং দেশের রপ্তানি আয়। হিমায়িত ও শুকনা মাছ রপ্তানির পরিমাণও ক্রমান¦য়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমানে আমদানির পরিমাণ রপ্তানির তুলনায় বেশি। জাতীয় আয়ের বিরাট অংশ ব্যয় হয় খাদ্য আমদানির জন্য। যে বছর দেশে বন্যা, খরা, বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ আঘাত হানে সে বছরই খাদ্যশস্য ফলনের উপর এদের বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে ফলন কমে যায় এবং তখনই বিদেশ হতে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষিকেই প্রধান্য দিতে হবে বেশি। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে পারলেই দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।

 

সারমর্ম

বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের আমদানির পরিমাণ রপ্তানির তুলনায় বেশি। আমাদানিকৃত প্রধান প্রধান কৃষি পণ্য হলো গম, চাল, চিনি, গুঁড়াদুধ, সয়াবিন তৈল, পাম্প ওয়েল, বিভিন্ন ধরনের মশলা, ডাল, ফল এবং ঔষধ ও প্রসাধনী শিল্পের কাঁচামাল। সবচেয়ে বেশি আমদানি করতে হয় গম, চাল ও ভোজ্য তেল। বাংলাদেশ হতে যে সব পন্য বিদেশে রপ্তানি হয় সেগুলোর মধ্যে উলে­খযোগ্য হলো হিমায়িত ও শুকনো মাছ, চা, চামড়া, পাট ও পাটজাত দ্রব্য ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে।

 

বাংলাদেশের খাদ্যের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের খাদ্যের বর্তমান অবস্থা – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.৩ নং পাঠ।

 

বাংলাদেশের খাদ্যের বর্তমান অবস্থা

 

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি উন্নয়নে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, জমির খহুবিখন্ডতা, প্রশস্ত রাস্তা ঘাটের অভাব এবং কৃষকের সকল ধরনের উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির ক্রয় ক্ষমতা না থাকায় এদেশে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব নাও হতে পারে। যে সকল কৃষি যন্ত্রপাতি আমাদের আবহাওয়ায় মানানসই এবং ফসল উৎপাদনে একান্তই প্রয়োজন সেগুলো দিয়ে বর্তমানে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। সেই সাথে হাঁস—মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য খামারে তাদের উন্নতির জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতিও ব্যবহার হচ্ছে।

বাংলাদেশে খরিপ মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। ফলে এসময় বন্যায় অনেক ক্ষয়—ক্ষতি হয়। শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে পানির অভাবে রবি ফসলের আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। বন্যা নিয়ন্ত্রন ও সেচ প্রদানের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প রয়েছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্ণ নয়। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ যা উৎপন্ন হয় তা নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন খাদ্যশস্য, দুধ ইত্যাদি আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ কম তাই অধিকাংশ পণ্যই আংশিক আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান পেশা হলো কৃষি যেখানে মোট শ্রমশক্তির ৬৮.৫% নিয়োজিত।

দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ৩৫% আসে কৃষজাত দ্রব্য থেকে। এদেশের জমি উর্বর হলেও কৃষক দরিদ্র। নতুন নতুন প্রযুক্তি, উন্নত বীজ ও কৃষি উপকরণ ব্যবহারে পশ্চাদপদ থাকায় প্রতি একক জমিতে উৎপাদন সন্তুোষজনক নয়। ধান, গম, পাট, আখ, তামাক, চা, তৈলবীজ, ডাল, শস্য এবং আলু এদেশের প্রধান ফসল। বিভিন্ন ধরনের শাকসব্জি এবং মশলা জাতীয় ফসলের চাষও এদেশে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে কী পরিমাণ খাদ্য শস্য উৎপন্ন হয় তা নিম্নে (ছক — ১) দেয়া হলো:

উপরোক্ত ছক হতে দেখা যায় যে ধান, গম, ডাল ফসল, মশলা জাতীয় শস্য, গোল আলু এবং শাকসব্জির ফলন ১৯৯১—৯২ সনের তুলনায় ১৯৯৩—৯৪ সনে বেড়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ। নিকট অতীতেও এখানকার অভ্যন্তরীণ জলাশয় মাছে ভরপুর ছিল। দেশের মৎসজীবি সম্প্রাদায় অভ্যন্তরীণ প্লাবন ভূমিতে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ও সেখানে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদ গত তিন দশকে মারাত্বক হ্রাস পেযেছে।

সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ এবং বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অভ্যন্তরীন মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন হ্রাস পেলেও সামুদ্রিক মৎস্য ও উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জলজ সম্পদ হতে প্রাপ্ত মৎস্য সম্পদের উৎপাদন ধরা হয়েছে প্রায় ১২ লক্ষ মেট্রিক টন যা নিম্নের ছকে (ছক — ২) দেখানো হলো:

মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদন দেশে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে (ছক — ৩ দ্রষ্টব্য)। ১৯৯১—৯২ সনে যেখানে মাংস ও দুধের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৩৭,৬,০০০ ও ৯,৫৪,০০০ মেট্রিক টন, ১৯৯৪—৯৫ সনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫,০৪,৭০২ ও ১৪,১১,৯৫৯ মেট্রিক টনে। ডিমের উৎপাদনও এসময়ে ১,৫৭৭ মিলিয়ন হতে বেড়ে ২,৫৩০ মিলিয়ন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টা ও সরকারী পৃষ্টপোষকতায় গবাদিপশু ও হাঁস—মুরগির খামার প্রতিষ্ঠাই সম্ভবত এই উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ।

 

মাঠ ফসল, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি

মাঠ ফসল, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.২ নং পাঠ।

মাঠ ফসল, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি

 

আমাদের দেশে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির নাম নিম্নে দেয়া হলো ঃ

 

১। চাষের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি —

* দেশী লাঙ্গল

* মোল্ডবোর্ড লাঙ্গল

* পাওয়ার টিলার

* ট্রাক্টর প্লাউ * ডিস্ক প্লাউ

* হ্যারো

* রোটোভেটর

* গরুর কাঁধে বাঁধার জন্য জোয়াল

* কোদাল (কোন কোন ক্ষেত্রে )

 

২. জমি সমান করার যন্ত্রপাতি —

* মই

* রোলার

* হ্যারো

* মুগুর (ঢিলা ভাঙ্গার জন্য)

 

৩। বীজ বপনের যন্ত্রপাতি —

* সিড ড্রিল

* ফারোয়ার

 

৪। আঁচড়া দেয়ার যন্ত্রপাতি —

* হ্যান্ড র‌্যাক বা গার্ডেন র‌্যাক

* ফিল্ড র‌্যাক বা বিদা বা অঁাচড়া

 

৫। নিড়ানী দেয়ার যন্ত্রপাতি —

* নিড়ি বা খুরপি

* জাপানিজ রাইস উইডার

* হ্যান্ড হো বা হুইল হো

 

৬। সেচ যন্ত্রপাতি —

* সেউতি

* দোন

* ঝাঝড়া

* টিউবওয়েল

* ট্রেডেল পাম্প

* পাওয়ার পাম্প

* অগভীর নলকূপ

* গভীর নলকূপ

 

৭। আপদনাশক ব্যবহারের যন্ত্রপাতি —

* নেপসেক স্প্রেয়ার

* পাওয়ার স্প্রেয়ার

* সিড ড্রেসার

* এরোপ্লেন

৮। কর্তন, মাড়াই, ঝাড়াই ইত্যাদি যন্ত্রপাতি

* কাস্তে * চালনি

* কোদাল * ডালি

* পেডেল থ্রেসার * ঝাটা

* ঘানি * গ্রেইন কালেক্টর

* ইক্ষু মাড়াই কল * কর্ণ সেলার

* কুলা

 

হাঁস—মুরগির খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি হাঁস—মুরগির খামারে যে সব প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ব্যবহৃত হয় সেগুলো হলো ঃ

* মুরগিকে খাবার দেয়ার জন্য খাবার পাত্র * থামোর্মিটার

* পানির পাত্র * কাঁকর ও ঝিনুকের খোসা রাখার পাত্র

* ডিম পাড়ার বা* * স্প্রেয়ার

* ওজন করার ব্যালেন্স * হারিকেন বাতি

* ডিম গ্রেডিং এর যন্ত্র * ওজন মাপার যন্ত্র

* মুরগি স্থানান্তরের খাঁচা * কোদাল

* ডিম রাখার পাত্র * খুরপি

* খাদ্য মিশানোর যন্ত্র * বালতি

* হাইগ্রোমিটার * ঠেঁাট কাটার যন্ত্র।

 

খামারে ডিম ফুটানোর যন্ত্রপাতি

* ইনকিউবেটর

* জেনারেটর

* ড্রাই বাল্ব ওয়েট বাল্ব থার্মোমিটার

 

ব্রয়লার খামারের যন্ত্রপাতি

* ব্রুডার বা তাপায়নের যন্ত্র

* চিকগার্ড

* ডিম পরীক্ষার বাতি

* ডিম মাপার ব্যালেন্স

* টেবিল

 

গবাদি পশুর খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি

গবাদি পশুর খামারে নিম্নলিখিত যন্ত্রপাতি থাকা আবশ্যক ঃ

* মিল্কিং পেইল * ম্যানুয়েল গ্রাস্ চপিং মেশিন

* দুধ মাপার বাকেট * সার্ভিস ষ্টকার

* দুধের বড় বাকেট * পানি তাপ দেয়ার হিটার

* দুধ মাপার ব্যালেন্স * স্টাজ পাম্প

* নাড়ন কাঠি * ঘর্ণায়নমান ক্রেনূ

* ড্রাম বা দুধ পাত্র * পেডেল থ্রেসার

* ছাঁকনি * কর্ণ সেলার

* দুধ দোহনের যন্ত্র * খাদ্য বহনের ট্রলি

* রি*া বা ভ্যানগাড়ী * পশু মাপার যন্ত্র

* ফিডিং বোতল * হোস পাইপ

* হুইল বারো * পানির পাত্র

* ইলেকট্রিক গ্রাস্ চপিং মেশিন * খাদ্য মাপার যন্ত্র

* দানা খাদ্য মিশানোর যন্ত্র

 

ভেড়ার শেয়ারিং করার যন্ত্রপাতি ডিহর্ণিং করার যন্ত্রপাতি

* পাওয়ার ড্রাইভেন শেয়ারিং মেশিন * ইলেকট্রিক ডি হর্ণার

* ক্লিপার বা হ্যান্ড শেয়ার * হর্ণ শেয়ার

 

খোজা করার যন্ত্রপাতি

* বার্ডিজোস ক্যাস্ট্রেটর * ডাইলেটর

* ধারালো চাকু * ফরসেপ

* রাবার রিং * রেজার গরু বা ঘোড়াকে নাল বা জুতা পরানোর যন্ত্রপাতি

* বাসপ্

* হাতুরি

* ড্রইং নাইফ

* চিমটা * টোইং নাইফ

* বাকার

 

মৎস্য খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি

* জেনারেটর

* অ*িজেন মিটার

* পি. এইচ. মিটার

* এয়ারেটর

 

মাছের কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি

* ইনজেকশনের সিরিঞ্জ এবং নিড্ল

* প্লাষ্টিকের গামলা মৎস্য প্রজনন হ্যাচারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি

* ৩ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপযুক্ত অগভীর নলকুপ

* ইলেকট্রিক পাম্প — ২২০ ভোল্ট, ১.৫ অশ্ব শক্তি, ১৫ মিটার উচ্চতায় ১২০ লিটার পানি তুলতে সক্ষম।

* অ*িজেন টাওয়ার মাছ ধরার যন্ত্রপাতি

* বেহুন্দি জাল

* বড়শি

* ভাসান জাল

* ফিডিং ট্রে

* স্প্রে মেশিন

* রিফ্রেক্ট্রোমিটার

* এ*েল পাম্প

* হোমোজিনাইজার

* সেন্ট্রিফিউজ

* ইনকিউবেশন বোতল

* পানির ট্যাঙ্ক বা জলাধার

* পানির চৌবাচা

* হাপা

* ঝাকি জাল * ঠেলা জাল

* চাই

* শিব জাল বা ধর্ম জাল।

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন সেচ প্রকল্প:

গঙ্গা – কপোতাক্ষ প্রকল্প :

কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারার কাছে পদ্মা নদী থেকে পানি তুলে খালের সাহায্যে বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা জেলাসমূহের ব্যাপক অঞ্চলে সেচ দেয়ার উদ্দেশ্যে গঙ্গাকপোতাক্ষ প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য পানি সেচ হলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণণ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারার কাছে পদ্মা নদী থেকে পানি তুলে খালের সাহায্যে বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা জেলাসমূহের ব্যাপক অঞ্চলে সেচ দেয়ার উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে ৮৪ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপন্ন হবে।

এ প্রকল্পটি তিনটি ইউনিটে বিভক্ত। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পদ্মাতীরে ভেড়ামারার কাছে একটি পাম্প ষ্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এই পাম্প গুলো পরিচালনার জন্য ৮২০০ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য পানি সেচ হলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

 

কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প :

কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প প্রধানত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প হলেও এর সাহায্যে কর্ণফুলী নদীর নিম্নাঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রায় ৬৫০ি কলোমিটার নৌচলাচলের সুব্যবস্থা এবং ৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া যায়। এটি একটি বহুমুখী প্রকল্প। এটি প্রধানত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প হলেও এর সাহায্যে কর্ণফুলী নদীর নিম্নাঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার নৌচলাচলের সুব্যবস্থা এবং ৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর ৪৬.৬ মিটার উঁচু, ৬৬০ মিটার দীর্ঘ এবং ২৪০ মিটার চওড়া একটি বাঁধ দিয়ে এ প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। এ কৃত্রিম হ্রদের পানির সাহায্যে রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলে বছরে বর্তমানে দু’টি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এ হ্রদ থেকে বর্তমানে প্রতি বছর ৫ হাজার টনেরও বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে।

 

উত্তরবঙ্গ গভীর নলকূপ প্রকল্প:

এ প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের উত্তরাঞ্চলে চারটি বৃহত্তর জেলা — রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুরে ৩৬০ টি গভীর নলকূপ এবং ৭৬০ টি পাওয়ার পাম্পের সাহায্যে মহানন্দা ও বড়াল নদীর পানি দিয়ে ১ লক্ষ হেক্টর জমিতে পানির সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ অঞ্চলে বাৎসরিক বৃষ্টিপাত কম এবং শীতকালে নদীতে পানি খুব কম পরিমাণে থাকে। তাই এ এলাকায় সেচের জন্য গভীর নলকূপ এবং পাওয়ার পাম্পই বেশি কার্যকরী। এছাড়াও ১০,৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বিশিষ্ট একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও চাষের জমিতে পানি সরবরাহের উপযোগী নালা, প্রধান নালা থেকে ফিল্ড নালা এবং প্লট নালাও এ প্রকল্পের অন্তভূর্ক্ত।

 

চাঁদপুর সেচ প্রকল্প

এটি কুমিল­া—চট্টগ্রাম বহুমুখী প্রকল্পের অংশ বিশেষ। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য চাঁদপুর এলাকার কৃষকদের দীর্ঘদিনের অসুবিধাসম হের অবসান ঘটানো এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন। চাঁদপুর প্রকল্প উত্তর দক্ষিণে দু’ভাগে বিভক্ত। উত্তরাংশে রয়েছে ফরিদগঞ্জ, রায়পুর থানা, রামপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার অংশবিশেষ। এ বহুমুখী প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বন্যা নিরোধ বাঁধ নিমার্ণ এবং বহু সংখ্যক পাম্পিং ষ্টেশন। এ পাম্পিং ষ্টেশনের কাজ প্রয়োজনের সময় জমিতে সেচ প্রদান করা এবং বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করা। এ প্রকল্পের অধিনে জমির পরিমাণ প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টর।

 

 

উপকূলীয় বাঁধ পুনর্বাসন প্রকল্প

এটি একটি বহুমুখী প্রকল্প। বন্যা প্রতিরোধের জন্য এখানে উপক ল বরাবর ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। úুইস গেইটের মাধ্যমে এখানে পানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১৯৬৮ সনে এ প্রকল্প চালু হয় এবং ৪৭,০০০ হেক্টর জমি পুনরুদ্ধার করে সেচ প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসল উৎপন্ন করা হয়।

 

গোমতী প্রকল্প

গোমতী নদীর বন্যার ফলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতি বছর নদী তীরবর্তী অঞ্চল সমূহের মানুষের জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল। এ অবস্থা নিরসনকল্পে প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে লর্ড কর্ণওয়ালিসের সময় গোমতীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এ বাঁধ প্রথম দিকে প্রায়ই ভেঙ্গে যায় ফলে গোমতী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এটি একদিকে বন্যা নিরোধ এবং অন্যদিকে সেচ প্রকল্প হিসেবে কাজ করে। এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা যাবে।

 

ঢাকা—নারায়ণগঞ্জ—ডেমরা সেচ প্রকল্প

এ প্রকল্প ঢাকা শহরের দক্ষিণ—পূর্বে অবস্থিত। এ প্রকল্প এলাকার পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী, দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ শহর, পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা নদী এবং উত্তরে ধোলাইখাল। এ প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার হেক্টর চাষাবাদের উপযোগী। এ উদ্দেশ্যে প্রতি সেকেন্ডে ১২৮ ঘনফুট পানি তোলার ক্ষমতা বিশিষ্ট ৪টি পাম্প বসানো এবং ১১ কিলোমিটার লম্বা সেচ খালের উপর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। তিস্তা বাঁধ প্রকল্প এ প্রকল্প অনুযায়ী রংপুর জেলার গাদামারী নামক স্থানে তিস্তা নদীতে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

এ প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার প্রায় সাত লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা যাবে। এতে কতকগুলো úুইস গেইট দিয়ে পানির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেচের প্রয়োজন হলে úুইস গেইট বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।

এই পানি তখন নালা দিয়ে জমিতে গিয়ে পড়ে। ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিরোধ বাঁধ প্রকল্প রংপুর,বগুড়া ও পাবনা জেলার এক বিস্তির্ণ অঞ্চল প্রায় প্রতি বছরই তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙ্গনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থা নিরসনকল্পে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিরোধ বাঁধ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই বাঁধের ফলে প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর জমি বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাবে।
এই বাঁধের বিভিন্ন স্থানে পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য আটটি রেগুলেটর বসানো হয়েছে।

 

বরিশাল সেচ প্রকল্প

জমিতে সেচ দিয়ে ফসল উৎপাদনের জন্যই এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে ১৯৮০ সন হতে ৫৬,৬৬০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৮৫ সন হতে আরও ৪৮,৫৬০ হেক্টর জমিতে এ প্রকল্পের মাধ্যমে সেচ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।

 

 

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.১ নং পাঠ।

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

কৃষি উন্নয়নে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অবদান অনস্বীকার্য। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সেসব দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শুধু শ্রম শক্তির লাঘবই করেনি বরং ফসলের উৎপাদন খরচ কমিয়ে তার ফলন ও গুনাগুণ বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। অল্প শ্রম, অল্প সময়, অল্প ব্যয় ও অধিক দক্ষতার সাথে খামারে কাজ করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে তুলনায় বাংলাদেশ এখনও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় রয়ে গেছে।

অল্প শ্রম, অল্প সময়, অল্প ব্যয় ও অধিক দক্ষতার সাথে খামারে কাজ করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জনসংখ্যার ক্রম বৃদ্ধির ফলে ফসলের জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। এই ক্রমবর্ধমান বাড়তি মুখের খাবার যোগান দিতে সীমিত জমিতে প্রচলিত শস্য চাষ রীতি পরিবর্তন করে উৎপাদন বর্ধক শস্য চাষ রীতি অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণসহ উন্নত চাষাবাদ প্রণালী অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

১৯২৮ সন হতে এ উপমহাদেশে আংশিক খামার যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। ১৯২৮ সনের “রাজকীয় কৃষি কমিশন”, ১৯৪৫ সনের “দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধানী কমিশন”, ১৯৫১ সনের “পাকিস্তান কৃষি অনুসন্ধানী কমিটি”, ১৯৬০ সনের “খাদ্য ও কৃষি কমিশন” এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা উত্তরকালে “খামার যান্ত্রিকীকরণ কমিটি” দেশে ভূমি কর্ষণ, সেচ ও শস্য সংরক্ষণ এ তিন বিষয়ে বিশেষভাবে যান্ত্রিকীকরণের সুপারিশ করে।

 

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কী?

কৃষিক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজে যন্ত্র শক্তির ব্যবহারকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। কৃষিক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজে যন্ত্রশক্তির ব্যবহারকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। এক্ষেত্রে যন্ত্রশক্তি বলতে মেশিন এবং ইঞ্জিন উভয়কে বোঝায়। যান্ত্রিকীকরণ দু’ধরনের হতে পারে পর্ণ এবং আংশিক। কৃষি ক্ষেত্রে সমুদয় কার্যাদি যখন যূ ন্ত্রশক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় তখন তাকে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ বলা হয়। পক্ষান্তরে ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ কতকগুলো কাজ যন্ত্রের সাহায্যে সম্পন্ন করলে তাকে আংশিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। বাংলাদেশের আবহাওয়া, কৃষকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় বর্তমানে এখানে আংশিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে।

 

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। সুবিধা, অসুবিধা এবং আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে দেশে কোন কোন ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব আছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

 

বীজ উৎপাদন খামারের জন্য

বীজ কৃষির অন্যতম প্রধান উপকরণ। উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় বিবিধ কারণে বীজের মান কমে যেতে পারে। এসব কাজ সাফল্যজনকভাবে কৃষি যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিভিন্ন বীজ বর্ধন খামারে অনায়াসে করা যেতে পারে।

 

কৃষি গবেষণাগারের জন্য

বিভিন্ন কৃষি গবেষণাগার এবং কৃষি শিক্ষার বিদ্যাপিঠে অবশ্যই বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ ও ব্যবহার থাকতে হবে। কৃষি উন্নয়নে চাই উপযুক্ত প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের এবং কৃষি শিক্ষায় ছাত্রদের শিক্ষিত করে তুলতে গবেষণাগার ও বিদ্যাপিঠে কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

 

কৃষক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য যন্ত্রপাতি :

কৃষক পর্যায়ে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার সম্ভব:

ক. জমি চাষ

বাংলাদেশে বছরে তিনবার জমি চাষের ব্যস্ত সময় লক্ষ্য করা যায় ।

* মার্চের প্রথম সপ্তাহ হতে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ।

* জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ হতে আগষ্টের তৃতীয় সপ্তাহ।

* নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য জানুয়ারী পর্যন্ত ।

দেশে বর্তমানে চাষের বলদের অভাব শতকরা ৪০ ভাগ এবং বছরের ব্যস্ত সময়ে এ অভাব দাঁড়ায় ৭০ ভাগে। দেশে বর্তমানে চাষের বলদের অভাব শতকরা ৪০ ভাগ এবং উপরোক্ত ব্যস্ত সময়ে এ অভাব দাঁড়ায় ৭০ ভাগে। গরুর ভাল জাত, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব, চারণভূমির অভাব এবং বিভিন্ন সময়ের বন্যায় গবাদি পশুর মৃত্যুর ফলে কৃষিক্ষেত্রে পশুশক্তির অভাব বেড়েই চলছে। তাছাড়া যে সকল কৃষকের চাষের বলদ আছে তারা দু’ফসলের মধ্যবর্তী এত কম সময়ে তড়িঘড়ি করে সঠিকভাবে জমি চাষ করতে পারেনা। ফলে ফসলের ফলনও ভাল হয়না। এসব কারণে দেশে পাওয়ার টিলারের চাহিদা বেড়েই চলছে।

পাওয়ার টিলার ব্যবহারের ফলে ব্যস্ত সময়ে জমি চাষ করতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা বরং অল্প সময়ে কৃষক বেশি গভীরতায় জমি চাষ করে বেশি ফলন পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বীজ বর্ধন খামার ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটে এবং কিছু সংখ্যক ধনী কৃষক তাদের খামারে বিভিন্নঅশ্বশক্তির ট্রাক্টর প্লাউ ব্যবহার করছে এবং দিন দিন এদের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

 

খ. বীজ বপন

বীজ বপন করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট হতে বীজ বপন যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছে যা গবেষণাগারে, বীজ বর্ধন খামারে এবং কৃষকের মাঠে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি কৃষকেরা এখন বীজ বপন যন্ত্র সরবরাহের জন্য আবেদন জানাচ্ছে।

 

গ.আগাছা দমন

আগাছা দমনের বিভিন্ন নিড়ানী যন্ত্র যেমন জাপানী ধান নিড়ানীযন্ত্র কৃষকেরা এখন নিজেদের ফসলী জমিতে ব্যাপক হারে ব্যবহার করছে। হ্যাম্পর‌্যাক, গার্ডেন র‌্যাক ইত্যাদিও আজকাল আগাছা দমনের জন্য কিচেন গার্ডেনে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

ঘ. সেচ প্রয়োগ

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করেছে বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি। ফসলের পানির চাহিদা মেটাতে দেশীয় সেচ পদ্ধতি অতিরিক্ত ফসল ফলানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করেছে বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে খাল, বিল, নদী এবং ভূ—গর্ভ হতে পানি তুলে ফসলের জমিতে দেয়া হচ্ছে এবং সেচের আওতায় দিন দিন ফসলী জমির পরিমাণ বাড়ছে।

বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি যা এদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো হলো নলকূপ, ট্রেডেল পাম্প, পাওয়ার পাম্প, অগভীর নলকূপ এবং গভীর নলকূপ, ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর বা অগভীর নলকূপ তাদের নির্ধারিত সেচের আওতাভূক্ত জমিতে সেচ দিতে পারছেনা।

এ ক্ষেত্রে পাওয়ার পাম্প দক্ষতার সাথে নদী বা বিল হতে জমিতে সেচ দিতে পারে। সেচের আওতায় জমির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকেরা বেশি পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করছে। ফলে রবি মৌসুমে অন্যান্য ফসল বিশেষ করে ডাল ও মশলা জাতীয় ফসলের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে যদিও ফসলের নিবিড়তা বাড়ছে কিন্তু অন্য ফসলের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে যার ফলে এসব ফসল বিদেশ থেকে আমদানি করে চাহিদা মিটাতে হচ্ছে ।

দেশের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে হলে বেশি পরিমাণে জমি সেচের আওতায় আনতে হবে। আর তাই সেচ যন্ত্রপাতির চাহিদা এদেশে বাড়তেই থাকবে। ফসল উৎপাদনে সেচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। অতএব কৃষি যান্ত্রিকীকরণের এ উপকরণটি বিশেষ করে ফসল উৎপাদনে সেচ যন্ত্রপাতির গুরূত্ব অপরিসীম।

ঙ. ফসল সংরক্ষণ

আগাছা, রোগ ও পোকা—মাকড়ের আক্রমণ হতে জমির ফসল রক্ষার জন্য হস্ত চালিত ও শক্তিচালিত বিভিন্ন স্প্রেয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে এদের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। বর্তমানে এসব যন্ত্রপাতি আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে। উঁচু গাছে ঔষধ দেবার জন্য উচ্চ চাপের স্প্রেয়ার তৈরি করা হয়েছে যা দেশের উত্তরাঞ্চলের আম বাগানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ বিস্তীর্ণ এলাকায় কীটনাশক বা আপদনাশক প্রয়োগের জন্য ছোট ছোট উড়োজাহাজ ব্যবহার করে থাকে।

 

চ. মাড়াই ও প্রক্রিয়াকরণ

আউশ ও বোরো ধান কাটার পর বৃষ্টি হলে অনেক সময় মাড়াই কাজের বিঘ্ন ঘটে। পদচালিত মাড়াই যন্ত্র (চধফফষব ঃযৎবংযবৎ) এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ মাড়াই যন্ত্র তৈরি হচ্ছে। যেখানে আগে গরু দিয়ে মাড়াই কাজ করা হতো, গরু কমে যাওয়ায় এসব কাজ এখন পদচালিত মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়। শুধু তাই নয়, গম মাড়াই যন্ত্রের উদ্ভাবনের চেষ্টাও দেশে চল্ছে। ধান, সরিষা ও মশলা যেগুলো ঢেঁকি কিংবা ঘানির সাহায্যে ভাঙ্গানো হতো এখন এসব কাজ মেশিনের সাহায্যে করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এখন এসব মিল চালু হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সম্ভাব্য বেকারত্ব।


কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বড় সুবিধা এই যে অল্প সময়ে, কম শ্রমিক দিয়ে, দক্ষতার সাথে, কম খরচে অধিক ফসল ফলানো সম্ভব। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সম্ভাব্য বেকারত্ব। দেশের অর্ধেকেরও বেশি শ্রমিক কৃষি শিল্পে নিয়োজিত। দেশে কৃষি ক্ষেত্রে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ হলে অধিকাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলদেশে আংশিক যান্ত্রিকীকরণই শ্রেয়। দেশের পরিবেশের কথা বিবেচনা করে দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি কৃষি ক্ষেত্রে বেশি লাগসই হবে বলে বিবেচিত। তাই কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

শুধু তাই নয় এসব যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ যেন সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায় সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তাই দেশে খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কারখানা করতে হবে নতুবা যেসব কৃষি যš পাতি বিদেশ হতে আমদানি করা হয় তাদের খুচরা যন্ত্রাংশও যেন কৃষক সব সময় হাতের কাছে পায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।