ধনিয়া চাষের সরল ও সঠিক পদ্ধতি , ধনিয়া সাধারণত মসলা জাতীয় ফসল। বাসা বাড়িতে এটি রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর ফলের জন্য চাষ করা হলেও এর পাতা ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাবারের স্বাদ বাড়াতে ধনিয়া পাতার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এর সবুজ পাতা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। ধনিয়া পাতা চাটনি, স্যুপ, ভর্তা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ধনিয়া চাষের সরল ও সঠিক পদ্ধতি
আজ আমরা আপনাদের সাথে ধনিয়া চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই ধনিয়া চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন। চলুন দেখে নিন ধনিয়া চাষের বিস্তারিত:-
মাটি ও জলবায়ু
সাধারণত সব ধরনের মাটিতেই ধনিয়া চাষ হয়ে থাকে। তবে ধনিয়া চাষের জন্য বেলে দোআঁশ বা এটেল দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। জমিতে প্রয়োজনীয় জল নিকাশেন ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বীজ বপনের সময়
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ধনিয়া বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।
বীজ বপনের সময়
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ধনিয়া বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।
জমি তৈরি
উন্নত ফলন পেতে হলে জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। জমিতে মাটির প্রকৃতি অনুযায়ী ৪-৬টি চাষ ও মই দিতে হবে।
বীজের হার
সাধারণত এক হেক্টর জমিতে ৮ কেজি ধনিয়ার বীজের প্রয়োজন হয়ে থাকে।
বীজ বপন
বীজ বপন করার আগে বীজকে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। বীজ যদি ছিটিয়ে বপন করা হয় তাহলে পরিমাণ বেশি লাগে। যদি ধনিয়া মিশ্র ফসল হিসেবে জমিতে বপন করা হয় তাহলে ৪-৫ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়ে থাকে।
বীজ বপনের পদ্ধতি
বীজ বপন করার আগে জমিতে বেড তৈরি করে নিতে হবে। বেডের মাঝখানে নালা তৈরি করতে হবে। নালার আকার হবে ৪০-৫০ সেমি। জমি তৈরি করার সময় মাটির সাথে জৈব পদার্থ মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপন করার আগে ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে তাহলে বীজ দ্বারা বাহিত রোগ থেকে চারা কে রক্ষা করা যাবে। বীজ দুইভাবে বপন করা যায়।
ছিটিয়ে ও বপন করা যায় আবার লাইনে ও বীজ বপন করা যায়। ছিটিয়ে বীজ বপন করার পর জমিতে হালকা মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। লাইন করে বীজ বোনার ক্ষেত্রে জমিতে লাইন করতে হবে। এক লাইন থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব হবে ৩০ সেমি। লাইনের গভীরতা হবে ১.৫ সেমি। বীজ বপন করার পর মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। চারা গজানোর পর ১০-১৫ দিন পরে একটি করে চারা গাছ রেখে বাকি সব চারা তুলে ফেলতে হবে।
সার প্রয়োগ
উন্নত ফলন পেতে হলে জমিতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে মাটিতে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সারের পাশাপাশি মাটিতে অন্যান্য সার ও প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে গোবর ৮-১০ টন, ইউরিয়া ২৮০-৩১০ কেজি, টিএসপি ১১০-১৩০ কেজি, এমপি ৯০-১১০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি আবর্জনা পচা সার ও ব্যবহার করা যেতে পারে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
জমি তৈরি করার সময় জমিতে অর্ধেক পরিমাণ গোবর সার, সম্পূর্ণ টিএসপি ও অর্ধেক এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক সার চারা রোপণ করার ৭ দিন পর মাদায় মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর চারা রোপণ করতে হবে। ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক এমপি সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণ করার ৮-১০ দিন পর প্রথম কিস্তি দিতে হবে এবং চারা লাগানোর ৩০-৫০ দিন পর বাকি সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগ করার পর প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।
সেচ ব্যবস্থা
জমিতে প্রয়োজনীয় সেচ প্রয়োগ করতে হবে। শুকনো মৌসুমে জমিতে সেচ দিতে হবে। তবে জমিতে যেন জল জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে নালা তৈরি করে দিতে হবে যেন অতিরিক্ত জল বের হয়ে যায়।
অন্যান্যা পরিচর্যা
ধনিয়া যদি পাতার জন্য চাষ করা হয়ে থাকে তাহলে জমিতে গাছ পাতলা করে দিতে হবে। চারা বড় হওয়ার ১০-১৫ দিন পর একটি সারিতে ৫ সেমি পর পর একটি করে চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হবে। আর যদি বীজের জন্য চাষ করা হয়ে থাকে তাহলে এক লাইনে ১০ সেমি পর পর চারা রাখতে হবে। গাছের গোড়া সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
জমিতে আগাছা জমে থাকলে তা নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রতিবার সেচ দেওয়ার পর জমিতে জো থাকা অবস্থায় মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে।
রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা
জমিতে রোগ ও পোকা আক্রমণ করলে প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক ও বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
ধনিয়া যদি পাতা ফসল সংগ্রহ করা হয় তাহলে চারা রোপন করার ৩০-৩৫ দিনের মধ্যেই সংগ্রহ করা যাবে। আর যদি বীজের জন্য রোপণ করা হয়ে থাকে তাহলে ১১০-১২০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যাবে। গাছ যখন সম্পূর্ণভাবে পাকে এবং গাছ সবুজ থাকে তখন বীজ সংগ্রহ করা যায়।
ফলন
সঠিকভাবে চাষ করতে পারলে এক শতক জমি থেকে ১৫-২০ কেজি পাতা পাওয়া যায়। আর যদি বীজ সংগ্রহ করা হয় তাহলে ৮-১০ কেজি বীজ পাওয়া যায়।
ধান চাষ পদ্ধতির বিস্তারিত নিয়ে তথ্য সূত্র অপেক্ষাকৃত কম। তথ্যগুলো নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাঠককে একাধিক সাইটে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে মেলাতে হয়। তাই আমরা চেষ্টা করেছি ধান চাষ সম্পর্কিত সকল তথ্য একটি জায়গায় নিয়ে আসতে। আশা করি আপনাদের সাহায্য করবে।
ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। তাই এর সাথে দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত । ঘন বসতিপূর্ণ এ দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে, অপরদিকে বাড়িঘর, কলকারখানা, হাট-বাজার, সড়ক-জনপথ স্থাপন এবং নদী ভাঙন ইত্যাদি কারণে আবাদি জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। তদুপরি রয়েছে খরা, বন্যা, জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, শৈত্য প্রবাহ ও শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে বেশি ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য ।
ধান চাষ
ধান চাষ
বাংলাদেশ পৃথিবীর ধান উৎপাদনকারী দেশ গুলোর মধ্যে চতুর্থ হলেও এখানকার হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৪.২ টন। চীন, জাপান ও কোরিয়ায় এ ফলন হেক্টর প্রতি ৬-৬.৫ টন। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে ধানের ফলন বাড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সনাতন জাতের ধান এবং মান্ধাতার আমলের আবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। এজন্য প্রয়োজন উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন।
বাংলাদেশে ১৯৬৮ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) থেকে প্রথম উফশী জাতের ধান (আইআর ৮) মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদ শুরু হয়। খাটো আকৃতির এ উফশী ধান থেকে প্রতি হেক্টরে ৫-৬ টন (বিঘাপ্রতি ১৮-২১ মণ) ফলন পাওয়া যায়। তখন থেকে উফশী ধান লোকমুখে ইরি ধান নামে পরিচিতি লাভ করে । বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৌসুম ও পরিবেশ উপযোগী উফশী ধানের জাত এবং ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ফসল, মাটি, পানি, সার ইত্যাদি বিষয়ক কলা-কৌশল উদ্ভাবন করছে।
বর্তমানে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাত দেশের মোট ধানি জমির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগে চাষাবাদ করা হচ্ছে এবং এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯০ ভাগ । ব্রি ধান এভাবে ইরি ধানের ̄স্থলাভিষিক্ত হয়েছে । আমাদের সৃষ্ট ওয়েব সাইটে ধানের উন্নত জাত ও এদের উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে তথ্য দেয়া আছে । আমরা আশা করি এসব তথ্য প্রয়োগ করে ব্যবহারকারীগণ উপকৃত হবেন।
বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ধানের চাষ করা হয়। এর মধ্যে ধানের জমি শতকরা ১১ ভাগ আউশ, ৪৮ ভাগ আমন ও ৪১ ভাগ বোরো ধান চাষ করা হয়। কিন্তু উৎপাদনের দিক থেকে বোরো শতকরা ৪৮ ভাগ, আমন ৪২ ভাগ ও আউশ ১০ ভাগ। বোরো মৌসুমে ধান চাষ হয় সবচেয়ে বেশি এবং আউশে সবচেয়ে কম। তিন মৌসুমে ধান চাষ প্রায় একই রকম। জমি নিবার্চন আউশ ধান চাষের জন্য উঁচু, মাঝারি উঁচু ও নিচু জমি উপযোগী। মাটির বুনট পলি দোঁআশ, পলি এঁটেল ও এেঁটল হলে ভালো।
মাঝারি উঁচু ও নিচু জমিতে রোপা আমন চাষ করা যায়। তবে সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে উঁচু জমিতেও রোপা আমন ধান চাষ করা যায়। দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ ও এঁটেল মাটি আমন ধান চাষের জন্য উপযোগী। ভারী বুননের মাটি যার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং যে মাটি অর্ধ—জলাবস্থায় উপযোগী তা বোরো ধান চাষের জন্য উত্তম। মাটিতে ৪০৬০% কর্দম কনা থাকলে ভাল হয়। সেচের ব্যবস্থা থাকলে উঁচু, মাঝারি উঁচু এবং নিচু যে কোন জমিতেই বোরো ধান চাষ করা যায়। মাটির অম্লমান ৫.০ হতে ৬.০ হলে ভাল।
মৌসুম অনুযায়ী ধানের চাষ:
চাষাবাদের মৌসুম অনুযায়ী ধানের চাষ তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন :
১. আউশ ধান (Aus rice): খরিপ ১ মৌসুমে এ ধান মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত চাষ করা হয়।
২. আমন ধান (Aman rice): খরিপ ২ মৌসুমে জুন থেকে ডিসেম্বর মাসে পর্যন্ত চাষ করা হয়।
৩. বোরো ধান (Boro rice): রবি মৌসুমে নভেম্বর থেকে মে মাসে এ ধান চাষ করা হয়।
বাংলাদেশের মোট ধানী জমির শতকরা প্রায় ১১ ভাগ জমিতে আউশ, ৪১ ভাগ জমিতে বোরো ও ৪৮ ভাগ জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। উৎপাদন হয় বোরোতে শতকরা প্রায় ৪৮ ভাগ, আমান ৪২ ভাগ ও আউশে ১০ ভাগ। বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদনশীলতা বেশি।
জলবায়ু ব্যাপক ও বি¯তৃত জলবায়ুতে ধান চাষ করা যায়। ধান চাষের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ২০—৩৫ক্কসে. ডিগ্রি। এর মধ্যে বীজ অংকুরোদগমের জন্য ৩০—৩৫ক্ক সেন্টিগ্রেড। অঙ্গজ বৃদ্ধির জন্য ২৫—৩১ক্কসে. পুস্পায়নের জন্য ৩০—৩৩ক্কসে. এবং পরিপক্কতার জন্য ২০—২৯ক্ক তাপমাত্রা উপযোগী। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭৫—৯৫%।
মাঝারি বৃষ্টিপাত ও উজ্জ্বল সূর্যালোক ধান চাষের জন্য প্রয়োজন। বৃষ্টিপাত কম হলে সেচের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ করতে হয়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৪০% এর কম ও ৯৫% এর বেশি হলে পুস্পায়ন ব্যহত হয়। মাটি ও ভূমি বন্ধুরতা ভারী বুনটের মাটি যার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং যে মাটি অর্ধজলাবস্থার উপযোগী তা ধান চাষের জন্য ভালো। তবে দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিও ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। মাটিতে ৪০—৬০% কর্দম কনা থাকলে ভালো হয়। সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থা থাকলে যে কোন মাটিতেই ধান চাষ করা যায়। উঁচু, মাঝারি উঁচু ও নিচু সব ধরনের জমিতেই ধান চাষ করা যায়। তবে মাঝারি উঁচু জমি উত্তম। মাটির অম্লমান ৫.০—৬.০ উত্তম।
ধান চাষের জন্য জমি নির্বাচন:
ধানের ফলন সব ধরনের জমিতে ভাল হয় না । মাঝারি নিচু ও নিচু জমিতে ধানের ফলন সবচেয়ে ভাল হয়। মাঝারি উঁচু জমিতেও ধান চাষ করা হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে পানি সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। এঁটেল ও পলি দো-আঁশ মাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী।
ধানের জাত নির্বাচন:
কৃষি পরিবেশিক অবস্থা এবং রোপনের সময়ের উপর ভিত্তি করে ধানের জাত নিবার্চন করতে হয়। রোপা আউশ ধান চাষের জন্য বিআর ২৬ (শ্রাবনী) ও ব্রিধান ৪৮ এবং অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে ব্রিধান ২৭ নিবার্চন করতে হয়। বোনা আউশ ধান বৃষ্টিবহুল এলাকার জন্য বিআর ২১ (নিয়ামত), বিআর ২৪ (রহমত) ও ব্রিধান ২৭ এবং খরাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রিধান ৪২ এবং ব্রিধান ৪৩ নিবার্চন করতে হয়। নিচু জমির জন্য জলমগ্নতা সহনশীল জাত যেমন ব্রিধান ৫১, ব্রিধান ৫২, বৃষ্টি নির্ভর রোপা আমনের জন্য খরাসহিষ্ণু জাত যেমন ব্রিধান ৫৫; নাবী আমনের জন্য বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রিধান ৪৬; লবনাক্ততা সহনশীল জাত ব্রিধান ৪০, ব্রিধান ৪১, ব্রিধান ৫৩, ব্রিধান ৫৫; সুগন্ধি চালের জন্য বিআর ৫, ব্রিধান ৩৪, ব্রিধান ৫০ ইত্যাদি।
আগাম বোরো ধানের জাত শীতসহিষ্ণু হলে ভালো যেমন ব্রিধান ৩৬; হাওড় অঞ্চলের জন্য বিআর ১৭, বিআর ১৮, বিআর ১৯ ভালো; লবনাক্ততা সহিষ্ণুজাত যেমন ব্রি—ধান ৫৫, ব্রিধান ৬১, ব্রিধান ৬৭, বিনাধান ৮, বিনাধান ১০, বিনাধান ১১, বিনাধান ১২, বিনাধান ১৩, বিনাধান ১৪ ও বিনাধান ১৫। এছাড়া বিশেষ পুষ্টিগুন সম্পন্ন জাত যেমন জিংক সমৃদ্ধ জাত ব্রিধান ৬২, ব্রিধান ৬৩, উচ্চমাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ জাত ব্রিধান ৬৬।
বাংলাদেশে তিন জাতের ধান আছে।
১। স্থানীয় জাত : টেপি, গিরবি, দুধসর, বতিশাইল ইত্যাদি।
২। স্থানীয় উন্নত জাত : হবিগঞ্জ, কটকতারা, পাজাম, কালিজিরা, হাসিকলমি, নাইজার শাইল, লতিশাইল, বিনাশাইল ইত্যাদি।
৩। উচ্চ ফলনশীল জাত : মুক্তা, ময়না, শাহজালাল, মঙ্গল, নিজামী ইত্যাদি।
ধানের স্থানীয় জাতের বৈশিষ্ট্য :
১. এ জাত সাধারণত নির্দিষ্ট এলাকায় চাষ করা হয়।
২. ধান গাছ লম্বা হয় তাই হেলে পড়ে।
৩. পাতা লম্বাটে, হেলে পড়ে।
৪. কান্ড নরম এবং কুশির সংখ্যা কম।
৫. রোগ ও পোকা মাকড় আক্রমনের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
৬. এ জাতের ফলন কম, হেক্টর প্রতি ১.৫—২.৫ টন।
৭. জীবনকাল বেশি।
৮. মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করার ক্ষমতা কম।
স্থানীয় জাতের উদাহরণ:
আউশ মৌসুমে : কটকতারা, হাসিকলমি, ধারিয়াল আমন মৌসুমে : হরিনমুদা, লাল মোটা, সাদা মোটা, কালিজিরা বোরো মৌসুমে : দুধসর, বাজাইল, হবিগঞ্জ ইত্যাদি
ধানের উচ্চ ফলনশীল জাতের বৈশিষ্ট্য:
নিচে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধানের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো :
১। ধান গাছ খাটো ও শক্ত হয় এবং সহজে হেলে পড়ে না।
২। ধান গাছের পাতা ঘন সবুজ ও পুরু থাকে।
৩। পাতাগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে যে একটি অন্যটিকে ঢেকে রাখে না। এতে আলো-বাতাস প্রতিটি পাতা সমানভাবে পায় এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য বেশি তৈরি হয়।
৪। গাছ মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে।
৫। জমি থেকে উৎপাদিত ধানের ওজন ও খড়ের ওজন প্রায় সমান হয় অর্থাৎ ১৪১
৬। পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ কম হয়।
৭। পাকার সময়ও কিছু কিছু ধান সবুজ থাকে।
বাংলাদেশে মোট ৮১টি উফশী জাত রয়েছে যার মধ্যে ৭৫টি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট এবং ১৬টি বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে। নিচের তালিকাতে এর জাতগুলির নাম, জন্মানোর মৌসুম, গড় জীবনকাল, গড় ফলন এবং চালের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:
ধানের বীজ বাছাই ও চারা তৈরি:
দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশাতে হবে। এবার ১০ কেজি বীজ ঐ পানিতে দিয়ে নাড়তে হবে। পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে। আর অপুষ্ট ও হালকা বীজ পানির ওপরে ভেসে উঠবে। হাত অথবা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। ভারী বীজ নিচ থেকে তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। ইউরিয়া মিশানো পানি সার হিসেবে বীজতলায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
দোআঁশ ও এেঁটল মাটি যেখানে প্রচুর আলো বাতাস আছে এমন জমি বীজতলার জন্য উপযোগী। বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। তবে অনুর্বর জমি হলে প্রতি বর্গমিটার ২ কেজি হারে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এর পর জমিতে ৫৬ সে.মি. পানি দিয়ে দু—তিনটি চাষ ও মই দিয়ে ৭—১০ দিন পানি বদ্ধ অবস্থায় রেখে দিতে হবে। জমিতে ব্যবহৃত জৈব সার পচে গেলে পুনরায় চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। একটি আদর্শ বীজতলায় ৪টি বেড থাকবে। প্রতিটি জমির দৈর্ঘ্য বরাবর এক মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে এবং দু—বেডের মাঝে ২৫—৩০ সে.মি. ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে।
বেডের উপরের মাটি কাঠ বা বাঁশ দিয়ে সমান করে নিতে হয়। বেডের মধ্যবতীর্ নালা সেচ ও নিস্কাশন এবং চারার পরিচযার্র জন্য ব্যবহৃত হয়।
ধানের বীজের পরিমাণ:
চারা তৈরির জন্য প্রতি কাঠা বীজতলায় ২.৫-৩.০ কেজি বীজ বুনতে হয়। এক কাঠা বীজতলার চারা দিয়ে ২০ কাঠা জমিতে ধানের চারা রোপণ করা যায়।
ধানের বীজ শোধন:
ধানের বীজে যাতে রোগজীবাণু না থাকে সেজন্য ওষুধ দ্বারা শোধন করে নিতে হয়। প্রতি কেজি ধান বীজ ৩০ গ্রাম এগ্লোসান জি এন বা ২০ গ্রাম এপ্রোসান এম ৪ ওষুধ দ্বারা শোধন করতে হয়।
বিভিন্ন ধানের বীজ
ধানের বীজ বাছাইয়ের জন্য করণীয়:
দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশাতে হবে।
এবার ১০ কেজি বীজ ঐ পানিতে দিয়ে নাড়তে হবে।
পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে এবং অপুষ্ট ও হালকা বীজ পানির উপরে ভেসে উঠবে।
হাত অথবা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
ভারী বীজ নিচ থেকে তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। ইউরিয়া মিশানো পানি সার হিসাবে বীজতলায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
ধানের বীজতলার ধরণ:
দো-আঁশ ও এটেল মাটি বীজতলার জন্য ভাল। জমি অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি হারে জৈব সার মেশানো যেতে পারে। এরপর জমিতে ৫-৬ সেমি পানি দিয়ে ২/৩টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে। আগাছা ও খড় ইত্যাদি পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১মি চওড়া বেড তৈরি করতে হবে।
দু’বেডের মাঝে ২৫-৩০ সেমি জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। নির্ধারিত জমির দু’পাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। এরপর ওপরের মাটি ভালভাবে সমান করে ৩/৪ ঘণ্টা পর বীজ বোনা উচিত।
মৌসুম ভেদে ধানের চারা উৎপাদনের জন্য চার ধরনের বীজতলা তৈরি করা যায়। যেমন:
১। শুকনা বীজতলা;
২। ভেজা বা কাদাময় বীজতলা
৩। ভাসমান বীজতলা:
৪। দাপোগ বীজতলা।
উঁচু ও দো-আঁশ মাটি সম্পন্ন জমিতে শুকনা বীজতলা এবং নিচু ও এঁটেল মাটি সম্পন্ন জমিতে। ভিজা বীজতলা তৈরি করা হয়। আর বন্যাকবলিত এলাকায় ভাসমান ও দাপোগ বীজতলা তৈরি করা হয়। প্রচুর আলো-বাতাস থাকে ও বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে ডুবে যাবে না এমন জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়।
শুকনা বীজতলা
এখানে শুকনা ও ভিজা বীজতলা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
শুকনা বীজতলা:
জমিতে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে ও সমান করতে হবে। মাটিতে অবশ্যই রস থাকতে হবে যাতে বীজ ভালোভাবে গজাতে পারে। প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। এর আগে জমি থেকে আগাছা বেছে ফেলতে হবে এবং পরিমাণ মতো পচা গোবর সার বা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে।
বীজতলায় রসায়নিক সার ব্যবহার না করাই উত্তম। হালকা বুনটের মাটি হলে ১১/২-২ টন জৈবসার দিলে ভালো হয়। বীজতলার মাপ- বীজতলার বেডের দৈর্ঘ্য বেডের গ্রন্থ।
= সুবিধামত লম্বা
= ১২৫ সে.মি
জমির আইল বা বেডের মাঝখানের দূরত্ব প্রতি দুই বেডের মাঝখানের দূরত্ব
২৫ সে.মি
৫০ সে. মি
এতে চারার পরিচর্যা ও অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে সুবিধা হয়। প্রতি দুই বেডের মাঝখানের মাটি তুলে নিয়ে বেডের উপর সমান করে দিতে হয়। এতে বেড উঁচু হয়। এরপর বীজ বেডের উপর সমানভাবে ছিটিয়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে নিতে হয়।
শুকনা ও ভিজা মাটিতে কর্ষণ ও বীজতলা তৈরি
ভেজা বা কাদাময় বীজতলা:
এক্ষেত্রে জমিতে পানি দিয়ে ২-৩ টি চাষ ও মই দেয়ার পর ৬-৭ দিন ফেলে রাখতে হয়।। এতে জমির আগাছা, খড়কুটা ইত্যাদি পড়ে গিয়ে সারে পরিণত হয়। এরপর আবার ২-৩ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি থকথকে কাদাময় করতে হয়। ভিজা বীজতলায় বীজ বাড়িতে গজিয়ে নিয়ে বুনা ভাল। এক্ষেত্রেও বীজতলার মাপ একনা বীজতলার মতোই।
শুকনা ও ভিজা মাটিতে কর্ষণ ও বীজতলা তৈরি
উর্বর দোআঁশ ও এেঁটল দোআঁশ মাটি এ বীজতলার জন্য উত্তম। জমিতে দাড়ানো পানি থাকলে ভাল তা না হলে সেচের মাধ্যমে ৫—৬ সে.মি. পানি দিয়ে ২—৩ বার চাষ ও মই দিয়ে এক সপ্তাহ পানিসহ রেখে দিতে হয়। এর ফলে আগাছা ও খড় পচে যাবে। এরপর আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদাময় বীজতলা তৈরি করতে হয়। শুকনো বীজতলার মতো করেই বেড তৈরি করতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বীজতলায় কাদা বেশি না হয়। কাদা বেশি হলে বীজ ডুবে যাবে এবং বীজ ভালভাবে গজাবে না। এ রকম অবস্থা হলে বেড তৈরির ৩—৪ ঘন্টা পর বীজ বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে জাগ দেয়া অংকুরিত বীজ বপন করতে হয়।
ভাসমান বীজতলা:
আমন মৌসুমে বিশেষ অবস্থার মোকাবেলার জন্য ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। বন্যাজনিত কারনে বীজতলা করার জায়গা পাওয়া না গেলে ভাসমান বীজতলায় চারা উৎপন্ন করা যায়। বন্যাকবলিত জমি, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির উপর বাঁশের মাচা বা কলাগাছের ভেলা তৈরি করে তার উপর ২—৩ সে.মি. উঁচু কাদার প্রলেপ দিয়ে কাদাময় বীজতলার মত ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যায়। এ বীজতলায় কাদাময় বীজতলার মতই অংকুরিত বীজ বুনতে হয়। বীজতলা যাতে বন্যার পানিতে ভেসে না যায় এজন্য এটি খুটির সাথে বেঁধে রাখতে হয়।
ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয় মূলত কচুরিপানাসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ভেলার ওপর মাটি দিয়ে। ধানের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার পর এই ভাসমান বীজতলায় ছিটিয়ে দিতে হয়। সেখানে জমিতে রোপণের উপযোগী চারা উৎপাদন হতে ২০ থেকে ২৫ দিন লাগে। পরে চারাগুলো জমিতে রোপণ করা হয়।
বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ একটি দেশ। প্রায় প্রতিবছরই এখানে বন্যা হয়। তখন বন্যার কারণে অনেক এলাকার বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া ঝড়, অতিবৃষ্টি এবং জোয়ারের পানিতেও বহু বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এতে করে যথাসময়ে ফসল উৎপাদনে বিলম্ব হয়। দেখা দেয় ফসলের ঘাটতি। ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক কৃষকেরা। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভাসমান বীজতলা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
১০ মিটারের একটি ভাসমান বীজতলায় এক কেজি অঙ্কুরিত বীজ ছিটানো সম্ভব। এ থেকে উৎপাদিত চারা এক বিঘা জমিতে রোপণ করা সম্ভব। পানির ওপর ভেসে থাকার কারণে এই বীজতলায় পানি সেচেরও দরকার হয় না। দেশের অনেক জেলায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করে ধানের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। এ বীজতলায় ধানের চারা উৎপাদন ছাড়াও পেঁপে, লাউ, কুমড়া, বেগুন, করলাসহ বিভিন্ন সবজির চারাও উৎপাদন সম্ভব। দেশের অনেক কৃষক ভাসমান বীজতলায় সবজির চারা উৎপাদন করে লাভবান হয়েছেন।
ভাসমান বীজতলা
ডাপোগ বা দাপোগ বীজতলা :
বন্যাকবলিত এলাকায় চারা উৎপাদনের আরেকটি কৌশল হলো ডাপোগ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পাকা অথবা কাঁচা বারান্দা, করিডোর, বাড়ির উঠান অথবা যে কোন শুকনো জায়গায় ডাপোগ বীজতলা তৈরি করা যায়। এ পদ্ধতিতে নিধার্রিত স্থানে চারিদিকে মাটি, ইট, কাঠ বা কলাগাছের বাকল দিয়ে ঘিরে নিতে হবে। তারপর কলাপাতা বা পলিথিন বিছিয়ে তার উপর ঘন করে অংকুরিত বীজ বপন করতে হয়। বীজে সঞ্চিত খাদ্যই চারার প্রাথমিক খাবার। তাই এই চারার বয়স ১৫—১৮ দিন হলেই রোপন করতে হয়। এ বীজতলায় মাটি থাকে না তাই ৫—৬ ঘন্টা পর পর পানি দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি পানি জমে না থাকে।
বাড়ির উঠান বা যে কোনো শুকনো জায়গায় অথবা কাদাময় সমতল জমিতে পলিথিন, কাঠ অথবা কলাগাছের বাকল দিয়ে তৈরি চৌকোনা ঘরের মতো করে তার মধ্যে অঙ্কুরিত বীজ ছড়িয়ে দিতে হয়। এ বীজতলায় মাটি থেকে চারাগাছ কোনোরূপ খাদ্য বা পানি গ্রহণ করতে পারে না বলে বীজতলায় প্রয়োজন মাফিক পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজতলায় প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ৩ কেজি অঙ্কুরিত বীজ দিতে হয়। এভাবে প্রস্তুতকৃত ২ থেকে ৩ বর্গমিটার দাপোগ বীজতলা থেকে উৎপাদিত চারা দিয়ে এক বিঘা জমি রোপণ করা যায়। দাপোগ বীজতলার প্রস্থ প্রায় ১.৫ মিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রয়োজনমতো নিতে হবে।
এভাবে করা বীজতলা থেকে ১৪ থেকে ১৫ দিন বয়সের চারা জমিতে রোপণ করতে হবে। চারার বয়স বাড়ার সাথে সাথে চারার গুণগতমান নষ্ট হতে থাকে। চারার বয়স কম থাকে বলে অনেক সময় চারার মৃত্যুহার কিছুটা বেশি থাকে। সেজন্য চারা রোপণের সময় প্রতি গোছায় ৪ থেকে ৫টি চারা দিলে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠা যায়। দাপোগের চারার উচ্চতা কম থাকে বলে জমিতে লাগানোর সময় এমন পরিমাণ পানি রাখতে হবে যাতে করে চারা পানির নিচে ডুবে না যায়। এক্ষেত্রে রোপিত চারার সব পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা অন্যসব চারার মতোই হবে। দাপোগ পদ্ধতিতে লাগানো চারা পরবর্তীতে অন্যান্য স্বাভাবিক চারার মতোই ফলন দেয়।
দাপোগ বীজতলা
ধানের বীজ শোধন ও জাগ দেওয়ার পদ্ধতি:
বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পরিপুষ্ট হলে সাধারণভাবে শোধন না করলেও চলে। তবে শোধনের জন্য ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবাণুমুক্ত হয়। বীজ যদি দাগমুক্ত হয় এবং বাকানি আক্রমণের আশঙ্কা থাকে তাহলে কারবেনডাজিম-জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করা যায়। ক্ষেতে ২-৩ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে ১ কেজি পরিমাণ বীজ পানিতে ডুবিয়ে নাড়াচাড়া করে ১২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর বীজ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে।
এভাবে শোধনকৃত বীজ বাঁশের টুকরি বা ড্রামে ২/৩ পরত শুকনো খর বিছিয়ে তার উপর বীজের ব্যাগ রাখুন এবং আরও ২/৩ পরত শুকনো খর দিয়ে ভালভাবে চেপে তার উপর ইট বা কোন ভারী জিনিস দিয়ে চাপ দিয়ে রাখুন। এভাবে জাগ দিলে আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘণ্টা, বোরো মৌসুমে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভাল বীজের অঙ্কুর বের হবে এবং বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হবে।
ধানের বীজ শোধন
আদর্শ বীজতলা তৈরির নিয়ম:
দো-আঁশ ও এটেল মাটি বীজতলার জন্য ভাল। জমি অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি হারে জৈব সার মেশানো যেতে পারে। এরপর জমিতে ৫-৬ সে.মি. পানি দিয়ে ২/৩টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে। আগাছা ও খড় ইত্যাদি পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১ মি. চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। দু’বেডের মাঝে ২৫-৩০ সে.মি. জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। নির্ধারিত জমির দু’পাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। এরপর ওপরের মাটি ভালভাবে সমান করে ৩/৪ ঘণ্টা পর বীজ বোনা উচিত।
বীজতলায় বীজ বপনের আদর্শ পদ্ধতি:
প্রতি বর্গমিটার বেডে ৮০-১০০ গ্রাম বীজ বোনা দরকার। বপনের সময় থেকে ৪/৫ দিন পাহারা দিয়ে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং নালা ভর্তি পানি রাখতে হবে।
বীজতলায় বীজ বপনের সময় রোপা পদ্ধতিতে আউশ ধান চাষের জন্য এপ্রিল মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। চারার বয়স ২০—২৫ দিন হলে মূল জমিতে রোপন করতে হয়। বোনা আউশ ধানের বীজ মধ্য মার্চ থেকে মে এর প্রথম সপ্তাহে জমিতে বপন করতে হয়। রোপা আউশ চাষের জন্য বীজতলায় মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজতলায় বীজ ফেলতে হয়। রোপা আমন ধান ১৫ই জুলাই হতে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত মুল জমিতে রোপন করা হয়। কাজেই রোপন সময়ের একমাস আগে বীজতলায় বীজ বুনতে হবে যেন রোপনের সময় চারার বয়স ২৫—৩০ দিন হয়।
বোরো ধানের ক্ষেত্রে নভেম্বর—ডিসেম্বর মাসে বীজতলায় বীজ ফেলতে হয় এবং চারার বয়স ৪০—৪৫ দিন হরে রোপন করতে হয়। বীজের পরিমান বীজের পরিমান নির্ভর করে বপন অথবা রোপন দূরত্ব, বীজের আকার ও আয়তন ইত্যাদির উপর। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সে.মি. হলে বীজ প্রয়োজন ৫০—৬০ কেজি/হেক্টর। ডিবলিং পদ্ধতিতে বপনের ক্ষেত্রে ২৫ সে.মি. দূরে দূরে সারি ও ২০ সে.মি. দূরে দূরে বীজ বপন করলে বীজের প্রয়োজন হয় ৩০—৩৫ কেজি/হেক্টর।
রোপা আউশের জন্য বীজতলায় চারা তৈরিতে বীজের প্রয়োজন ২০—৩০ কেজি/হেক্টর। বীজ বাছাই ভালো ফলনের জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে ভালো বীজ। বপনের জন্য সুস্থ ও পুষ্ট বীজ নিবার্চন করতে হবে। এজন্য দশ লিটার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে নিয়ে এ দ্রবনে ১০ কেজি বীজ ছেড়ে হাত দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দিয়ে পুষ্ট বীজ নীচে জমা হবে।
অপুষ্ট হাল্কা বীজ ভেসে উঠবে। ভারীগুলো ভালোভাবে পরিস্কার পানিতে ৩—৪ বার ধুয়ে নিতে হবে। বীজ শোধন ও জাগ দেওয়া বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পরিপুষ্ট হলে সাধারণভাবে শোধন না করলেও চলে। তবে শোধনের জন্য ৫২—৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবানুমুক্ত হয়। বীজ শোধনের জন্য ২—৩ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে এক কেজি পরিমান বীজ ডুবিয়ে ১২ ঘন্টা রেখে দিতে হয়।
এরপর বীজ পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হয়। আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘন্টা বা দুই দিন ও বোরো মৌসুমে ৭২ ঘন্টা বা তিন দিনের বীজের অংকুর বের হয় এবং তা বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হয়। বীজতলায় বীজ বপন শুকনো বীজতলার জন্য প্রতি বর্গমিটার ১৫০ গ্রাম শুকনো বীজ বুনতে হয়। বীজ ছিটিয়ে বোনার পর বীজগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ভেজা বীজতলায় প্রতি বর্গমিটার ৮০—১০০ গ্রাম হারে বীজ বপন করতে হয়। এক বর্গমিটার বীজতলার চারা দিয়ে ২০—৩০ বর্গমিটার রোপন করা যায়। তবে ডাপোগ বীজতলায় ঘন করে বীজ বুনতে হয় প্রতি বর্গমিটারে ২.৫৩.০ কেজি বীজ।
শুকনো বীজতলায় শুকনো বীজ বুনতে হয়। কিন্তু অন্যগুলিতে অংকুরিত বীজ বুনতে হয়। এজন্য বীজ জাগ দেয়ার প্রয়োজন হয়। ভেজা বীজতলায় বীজ বপনের পর ৪—৫ দিন পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হয়। বীজতলার পরিচযার্ বীজতলায় নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে এবং আগাছা দমন করতে হবে। চারা হলদে হলে প্রতি বর্গমিটার ৭ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পরও চারা সবুজ না হলে সালফারের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম হারে জিপসাম সার ছিটিয়ে দিতে হবে। এছাড়া বীজতলায় পোকামাকড় ও রোগবালাই এর উপদ্রব হলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
জমি তৈরিজমির জো অবস্থা থাকলে মার্চ—এপ্রিল মাসে আউশ ধানের বীজ বপন করা যায়। জমিতে প্রয়োজনমত পানি দিয়ে ২—৩টি চাষ ও মই দিয়ে জমি কাদাময় করতে হয়। আউশ ধানে আগাছার প্রকোপ বেশি হয় বলে প্রথম চাষের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচে যাবে। রোপা আউশের জন্য মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি বা সেচের পানির সহায়তায় কর্দমাক্ত করে জমি প্রস্তুত করতে হয়।
রোপা আমনের জন্য মধ্য জুন থেকে মধ্য আগস্ট এ সময়ের মধ্যে বৃষ্টি বা সেচের পানির সাহায্যে জমি প্রস্তুত করা হয়। বোরো ধানের জন্য মধ্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারী এ সময়ের মধ্যে সেচের পানির সাহায্যে থকথকে কর্দমাক্ত করে জমি তৈরি করতে হয়। জমি তৈরির সময় জমির উপরিভাগ ভালভাবে সমতল করতে হয় যাতে সেচের পানি সব জায়গায় পৌছে।
অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় ধানের বীজতলার যত্ন:
শৈত্য প্রবাহের সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে দিলে, বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিলে, প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিলে ধানের চারা ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়।
ধানের বীজতলার সাধারণ পরিচর্যা:
বীজতলায় সব সময় নালা ভর্তি পানি রাখা উচিত। বীজ গজানোর ৪-৫ দিন পর বেডের ওপর ২-৩ সে.মি. পানি রাখলে আগাছা ও পাখির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
চাৱা উঠানো ও সংরক্ষণ:
জাত ও মৌসুম ভেদে ২৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা ভালো। চারা তোলার পূর্বে বীজতলাতে পানি সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নেয়া ভালো। এতে চারা তুলতে সুবিধা হয়। চারা তোলার সময় যাতে গোড়া বা কাজ ভেজে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চারা তোলার পর তা ছোট ছোট আঁটি আকারে বেঁধে নিতে হয়।
বীজতলা থেকে চারা তোলার পর পর মূল জমিতে লাগানো সম্ভব না হলে চারার আঁটি ছায়ার মধ্যে ছিপছিপে পানিতে রেখে দিতে হয়।
ধানের চারা উঠানোর সময় বা বহন করার সময় সতর্কতা:
বীজতলায় বেশি করে পানি দিয়ে বেডের মাটি নরম করে নিতে হবে যাতে চারা উঠানোর সময় শেকড় বা কাণ্ড মুচড়ে বা ভেঙে না যায়। বস্তাবন্দী করে ধানের চারা কোনক্রমেই বহন করা উচিত নয়।
ধান রোপণ
ধানের চারা রোপণ:
রোপণের জন্য জমি তৈরি:
মাটির প্রকারভেদে ৩-৫ বার চাষ ও মই দিলেই জমি তৈরি হয়ে মাটি থকথকে কাদাময় হয়। জমি উঁচুনিচু থাকলে মই ও কোদাল দিয়ে সমান করে নিতে হবে।
রোপা আউশ ও আমনের চারা ২০—২৫ দিন বয়সে লাগাতে হয়। কিন্তু বোরোর ক্ষেত্রে একটু বেশি বয়সের ৪০—৪৫ দিনের চারা রোপন করতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০—২৫ সে.মি ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫—২০ সে.মি। চারা মাটির ২—৩ সে.মি. গভীরে রোপন করতে হয়। এর চেয়ে বেশি গভীরতা হলে গাছে কুশি উৎপাদন কমে যায়। সারি করে চারা লাগালে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা সহজ হয়।
চারার বয়স ও রোপণ পদ্ধতি:
আউশে ২০-২৫ দিনের, রোপা আমনে ২৫-৩০ দিনের এবং বোরোতে ৩৫-৪৫ দিনের চারা রোপণ করা উচিত। এক হেক্টর জমিতে ৮-১০ কেজি বীজের চারা লাগে। প্রতি গুছিতে ১টি সতেজ চারা রোপণ করাই যথেষ্ট। তবে চারার বয়স একটু বেশি হলে প্রতি গুছিতে ২-৩টি চারা রোপণ করা যেতে পারে। সারিতে চারা রোপণ করার সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০-২৫ সে.মি. এবং প্রতি গুছির দূরত্ব ১৫-২০ সে.মি. হওয়াই উত্তম।
সমান জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় চারা রোপণ করতে হয়। লম্বা রশির সাহায্যে সোজা সারি করে চারা রোপণ করা উত্তম। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০-২৫ সে.মি. এবং সারিতে গুছি থেকে জহির দূরত্ব হবে ১৫-২০ সে.মি.। প্রতিটি হিতে ২-৩টি চারা দিতে হয়। দেরিতে রোপণ করলে চারার সংখ্যা বেশি ও ঘন করে লাগাতে হয়।
ধান চাষে দ্বি-রোপণ পদ্ধতি:
জলাবদ্ধতা পূর্ববর্তী ফসলের কর্তন বিলম্বিত হলে বা অন্য কোন কারণে যদি রোপণের জন্য নির্ধারিত জমিতে রোপণ বিলম্বিত হয় তবে বেশি বয়সের চারা ব্যবহারের পরিবর্তে দ্বি-রোপণ পদ্ধতিতে ধান রোপণ একটি ভাল প্রযুক্তি। এ পদ্ধতিতে ধানের চারা বীজতলা হতে উত্তোলন করে অন্য জমিতে ঘন করে ১০-১০ সে.মি. দূরত্বে সাময়িকভাবে রোপণ করা হয়, আমন মৌসুমে ২৫-৩০ দিন পর এবং বোরো মৌসুমে ৩০-৪০ দিন পর আবার উত্তোলন করে মূল জমিতে ২০-২০ সে.মি. দূরত্বে দ্বি-রোপণ করা হয়।
ধান চাষে সার ব্যবস্থাপনা
সারের মাত্রা আবহাওয়া, মাটি, ধানের জাত, জীবনকাল, ফলন দেয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। ভালো ফলনের জন্য সময়মত ও পরিমানমত সার প্রয়োগ করতে হয়। নিচে মৌসুম ভেদে ধানের বিভিন্ন জাতের সারের পরিমান দেয়া হলো:
জমির উর্বরতার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা নির্ধারন করা হয়। এছাড়া জমিতে গোবর বা আর্বজনা পচা সার হেক্টর প্রতি ৮—১০ টন ব্যবহার করা হলে রাসায়নিক সারের মাত্রা প্রায় অর্ধেক নামিয়ে আনা সম্ভব। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সব সার জমি তৈরির সময় শেষে চাষের পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয় বলে ইউরিয়া সার ধাপে ধাপে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সারকে সমান তিনভাগে ভাগ করে চারা রোপনের ১০—১৫, ৩০—৩৫ ও ৪৫—৫০ দিন পর জমিতে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় নিম্নের বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখতে হবে :
১ / সার দেয়ার সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা প্রয়োজন, শুকনো জমিতে অথবা অতিরিক্ত পানি থাকলে সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
২/ সারের উপরি প্রয়োগের পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করলে অথবা হাত দিয়ে মিশিয়ে দিলে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
৩/ শেষ কিস্তির সার ধানের কাইচথোড় আসার ৫—৭ দিন আগে প্রয়োগ করা উচিত।
৪/ ইউরিয়া সারের প্রভাব পরবতীর্ ফসলে থাকে না বলে প্রত্যেক ফসলেই মাত্রানুযায়ী ইউরিয়া ব্যবহার করতে হবে।
৫/ ইউরিয়া প্রয়োগের পরও ধান গাছ যদি হলদে দেখায় তবে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এ অবস্থায় জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ভালো ফলন পেতে চাইলে অবশ্যই জমিতে সার দিতে হবে। এছাড়া উচ্চফলনশীল ধানের জাত মাটি থেকে বেশি পরিমাণে খাদ্যের উপাদান গ্রহন করে বিধায় সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। গোবর বা আবর্জনা পচা জাতীয় জৈব সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।।
ইউরিয়া ব্যতীত সকল রাসায়নিক সার যেমন- টিএসপি, এমপি, জিপসাম, না প্রভৃতি। জমিতে শেষ চাষ দেয়ার আগে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার চারা রোপণ করার পর ও কিস্তিতে ছিটিয়ে প্রযোগ করতে হয়। এবার দেখা যাক শতক প্রতি সারের পরিমাণ কি?
জাত ও মৌসুম ছাড়া সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মারও কিছু কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয়। যেমন:
১। পাহাড়ের পানভূমির মাটি ও লাল বেলে মাটিতে এমপি সার নেতৃতণ দিতে হয়।
২। গঙ্গাবাহিত পলিমাটি ও সেচ প্রকল্প এলাকার মাটিতে লক্ষা সার বেশি পরিমাণে নিতে হয়।
৩। হাওড় এলাকার মাটিতে সার কম পরিমাণে দিতে হয়।
৪। স্থানীয় জাতের ধানে সারের পরিমাণ অর্ধেক দিলেই চলে।
৫। পূর্ববর্তী ফসলে প্রতিটি সার সঠিক পরিমাণে প্রয়োগ হয়ে থাকলে উপস্থিত ফসলে প্রতিটি সারের অর্ধেক পরিমাণ ব্যবহার করলেই চলে।
৬। পূর্ববর্তী ফসলে দস্তা সার ব্যবহার হয়ে থাকলে পরবর্তী ২টি ফসলে আর এ সার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
৭। বেলে মাটিতে এম পি সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়।
৮। কোন জমিতে সবুজ সার ফসলের চাষ হলে পরবর্তী ফসলে ইউরিয়া সার ৪০-৫০% কমিয়ে ব্যবহার করলেও চলে।
ধান চাষে সার প্রয়োগে
ধান চাষে সার প্রয়োগের নিয়মাবলী:
ধান গাছের বাড়-বাড়তির বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন মাত্রায় নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। প্রথম দিকের কুশি গজানোর সময় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে তা থেকে গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন গ্রহণ করে কার্যকরী কুশির সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। সর্বোচ্চ কুশি উৎপাদন থেকে কাইচথোর আসা অবধি গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন পেলে প্রতি ছড়ায় পুষ্ট ধানের সংখ্যা বাড়ে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার যেমন টিএসপি, মিউরেট অব পটাশ, জিপসাম, জিংক সালফেট মাত্রানুযায়ী জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে।
তবে বেলে মাটিতে পটাশ সার দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। তিন ভাগের দুই ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং এক-তৃতীয়াংশ কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার ব্যবহার করা সম্ভব হলে তা প্রথম চাষের সময়ই জমিতে সমভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জৈব সার খরিফ মৌসুমে ব্যবহার করাই শ্রেয়।
ধানে গন্ধক ও দস্তা সার প্রয়োগের সময়:
ইউরিয়া সার প্রয়োগ করার পরও ধান গাছ যদি হলদে থাকে এবং বাড়-বাড়তি কম হয় তাহলে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। সেক্ষেত্রে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ হিসাবে জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। অত:পর বিঘা প্রতি ৮ কেজি জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
দস্তা সার
ইউরিয়া সার ব্যবস্থাপনায় এলসিসি ব্যবহার:
লিফ কালার চার্ট বা এলসিসি প্লাস্টিকের তৈরি চার রং-বিশিষ্ট একটি স্কেল। এলসিসি পদ্ধতি অবলম্বন করলে ধান গাছের চাহিদানুযায়ী ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যায়। ফলে ইউরিয়া সারের খরচ কমানো ও অপচয় রোধ করা যায় এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, এলসিসি ব্যবহারে শতকরা ২০-২৫ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় করা যায়।
ইউরিয়া সার
গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের বিভিন্ন দিক:
গুটি ইউরিয়া হল, ইউরিয়া সার দিয়ে তৈরি বড় আকারের গুটি যা দেখতে ন্যাপথালিন ট্যাবলেটের মত। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে সারের কার্যকারিতা শতকরা ২০-২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরিয়া সার পরিমাণে কম লাগে। আবার গুটি ইউরিয়া জমিতে একবারই প্রয়োগ করতে হয়।
এরপর সব সময় গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী নাইট্রোজেন সরবরাহ থাকায় গাছের কোন সুপ্ত ক্ষুধা থাকে না। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পূর্ব শর্ত হল, ধান রোপণ করতে হবে সারিবদ্ধভাবে। সারি থেকে সারি এবং গোছা থকে গোছার দূরত্ব হবে ২০ সে.মি.। বোরো মৌসুমে চারা রোপণের ১০-১৫ দিন এবং আউশ ও আমন মৌসুমে চারা রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যে প্রতি ৪ গোছার মাঝখানে ৩-৪ ইঞ্চি কাদার গভীরে গুটি পুঁতে দিতে হবে।
গুটি ইউরিয়া
অঞ্চল-ভিত্তিক পরিমিত সার প্রয়োগ:
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-ভিত্তিক (৩০টি) থানা নির্দেশিকায় উল্লেখিত নিয়মানুযায়ী সার-এর পরিমাণ ও নির্দেশনা অনুযায়ী সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।
ধান চাষে আগাছা ব্যবস্থাপনা:
আগাছা ফসলের একটি মারাত্মক শত্রু। আগাছা ফসলের ক্ষেতে অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ যেমন শ্যামা, ছেঁচড়া, হলদে মুথা ইত্যাদি। যে উদ্ভিদ ভুল জায়গায় জন্মেছে যেমন ধান ক্ষেতে পাট গাছ। আগাছা ধান গাছের আলো, পানি ও খাদ্য উপাদানের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং ফসলের ক্ষতি করে।
ধান ক্ষেতে আগাছা
আগাছার প্রকার:
জীবনকালের ভিত্তিতে: বর্ষজীবী (শ্যামা, বথুয়া), দ্বি-বর্ষজীবী (বন্য গাজর) এবং বহুবর্ষজীবী (দূর্বা, ভেদাইল)। পাতা ও কাণ্ডের আকৃতির ভিত্তিতে: ঘাস-জাতীয় (শ্যামা, ক্ষুদে শ্যামা, দূর্বা, আরাইল, গৈচা, ফুলকা ঘাস, মনা ঘাস, ঝরা ধান), সেজ(Sedge)(হলদে মুথা, বড় চুচা, ছেঁচড়া, জয়না, পানি সেজ) ও চওড়া পাতা-জাতীয় (পানি কচু, শুষনি শাক, ঝিল মরিচ, পানি লং, পানি ডোগা, চাঁদমালা, হেলেঞ্চা, ঘেঁচু, বড় পানা, ক্ষুদে পানা ও কচুরি পানা)।
আগাছা দমনের পদ্ধতিসমুহ:
(ক)হাত বাছাই
(খ)রাইচ উইডার ও
(গ)আগাছানাশক-এর যে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে আগাছা দমন করা যায়। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মীদের সাথে পরামর্শক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
আগাছানাশক ব্যবহারে সতর্কতা:
(ক)সঠিক আগাছানাশক নির্বাচন,
(খ)সঠিক মাত্রায় আগাছানাশক প্রয়োগ,
(গ)সঠিক সময়ে আগাছানাশক প্রয়োগ,
(ঘ)সঠিক প্রয়োগ পদ্ধতির অনুসরণ,
(ঙ)সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার অনুসরণ,
(চ)আগাছা-নাশকের বোতলে সঠিক নির্দেশনা পালন এবং
(ছ)স্থানীয় কৃষি কর্মীদের পরামর্শ মেনে চলা।
আগাছা-নাশক ব্যবহারের সঠিক সময়:
(ক)আগাছা-নাশকের কার্যকারিতা পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল।
(খ)প্রয়োগের সময়-ভিত্তিক আগাছা-নাশক ভিন্ন ভিন্ন:
(১) “গজানোর পূর্বে” (Pre-emergence), আগাছা গজানোর পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে,
(২) “গজানোর পরে” (Post-emergence), আগাছা জন্মানোর পর প্রয়োগ করতে হবে,
(৩) “গজানোর পর পর” (Early post-emergence, আগাছা জন্মানোর পর পরই প্রয়োগ করতে হবে এবং
(৪) সরকারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকৃত আগাছা-নাশকের বোতল/প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশাবলী ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সর্বদা মেনে চলতে হবে।
গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের আওতাধীন ক্যানালের মাধ্যমে সেচ
ধান চাষে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
ধান চাষে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার:
ধান চাষে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধানের জমিতে সব সময় দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ১০-১২ দিন পর্যন্ত ছিপছিপে পানি রাখতে হবে যাতে রোপণ-কৃত চারায় সহজে নতুন শিকড় গজাতে পারে। এরপর কম পানি রাখলেও চলবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ধানগাছ যেন খরা কবলিত না হয়।
রোপা ধানে সবসময় দাড়ানো পানি রাখার দরকার নেই। চারা রোপনের পর ৬—৭ সে.মি. পানি রাখতে হবে। চারা রোপনের ৬—৭ দিন পর্যন্ত ৩—৫ সে.মি. সেচ দিলে আগাছা দমন হয়। কুশি উৎপাদন পর্যায়ে ২—৩ সে.মি. এবং থোর আসার সময় ৭—১০ সে.মি. সেচ দেয়া উত্তম। দানা পুষ্ট হওয়া শুরু হলে আর সেচ দিতে হয় না।
রোপা আমন সাধারণত বৃষ্টি নির্ভর। আমন মৌসুমে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির পানি যেন সরাসরি জমির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে না পারে এজন্য উচু আইল তৈরি করে দিতে হয়। কারণ বৃষ্টির পানি জমির পুষ্টি উপাদান ধুয়ে নিয়ে যায়। বর্তমানে পরিবর্তিত জলবায়ুতে বৃষ্টির সময় কাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেখা যায় রোপনের সময় বৃষ্টির পানির অভাবে জমি তৈরি করা যায় না অথবা অতি বৃষ্টির জন্য জমিতে অনেক দাড়ানো পানি থাকে যার জন্য চারা রোপন করা যায় না। বর্তমানে রোপা আমনে সম্পূরক সেচ বিশেষ করে শীষ উদগম থেকে দানা পুষ্ট হওয়া পর্যন্ত সময়ে প্রয়োগ করে ফসল ফলানো হয়। এতে ফলন বেড়ে যায়।
মাঠ পর্যায়ে কৃষক বোরো ধান চাষে ২৫—৩০ বার সেচ প্রদান করে যা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত। বোরো ধান চাষে একবার ৫—৭ সে.মি. পানি দেয়ার পর জমিতে দাড়ানো পানি শেষ হওয়ার তিন দিন পর পুনরায় সেচ দিলে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পানি কম লাগে। বোরো চাষে পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে (অডউ) সেচ দিলে গাছে মূলের বৃদ্ধি ভালো হয় ও সেচ খরচ ও কমানো যায়।
আগাছা দমন সাধারণত বোরো ও রোপা আমনের চেয়ে আউশ মৌসুমে বিশেষ করে বোনা আউশে আগাছার উপদ্রব বেশি হয়। এজন্য আউশ মৌসুমে প্রথম বৃষ্টিপাতের পর জমিতে দু—একটি চাষ দিয়ে পতিত রাখলে আগাছার বীজ গজিয়ে উঠে। কিছুদিন পর পুনরায় মই দিয়ে ধান বপন করলে আগাছার উপদ্রব কম হয়। রোপা জমিতে ৫—১০ সে.মি. পানি রাখলে জমিতে আগাছা কম হয়। বোরো ধানে দাড়ানো পানি থাকে বলে আগাছার উপদ্রব কম হয়। তারপরও আগাছা হলে আগাছা পরিস্কার করতে হয়। আগাছা পরিস্কারের সময় হাত দিয়ে মাটি নেড়ে দিলে বাতাস চলাচলের সুযোগ পায় যা গাছের মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
জমিতে দাড়ানো পানি না থাকলে আগাছার প্রকোপ বেড়ে যায়। সারিতে রোপনকৃত রোপা আমনে জাপানি রাইস উইডার দিয়ে আগাছা দমন করা যায়। আগাছানাশক প্রয়োগ করেও আগাছা দমন করা যায়। ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণ ধানের শিষের শতকরা ৮০—৯০ ভাগ অংশের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে এবং ধানের রং সোনালি হলে ধান কাটতে হয়।
ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য ধান পরিপক্ক হবার পরপরই যত দ্রুত সম্ভব ধান কাটতে হবে। এরপর মাড়াই করে খড়কুটা বেছে পরিস্কার করে ধান পরপর ৪—৫ দিন শুকাতে হবে। শুকানোর সময় ধানের আর্দ্রতা ১২% এ চলে আসলে চিটা, আবর্জনা, ভাঙ্গা ধান, ধুলাবালি পরিস্কার করে নিতে হবে। এরপর ধান ছায়ায় ঠান্ডা করে ড্রামে, মটকায়, পলিকোটেড বায়ুরোধক পাত্রে রাখতে হবে।
ফলন মৌসুম ভেদে ধানের ফলন ভিন্ন হয়। বোরো মৌসুমে ধানের ফলন সবচেয়ে বেশি ও আউশ মৌসুমে সবচেয়ে কম। উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরোতে গড়ে হেক্টর প্রতি ৫—৬ টন, রোপা আমনে ৪—৫ টন এবং আউশে ৩—৪ টন।
বৃষ্টি-নির্ভর রোপা আমন এলাকায় জমির আইল ১৫ সে.মি. উঁচু রাখলে অনেকাংশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায় যা খরা থেকে ফসলকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। এরপরও যদি ধান ফসল খরা কবলিত হয় তাহলে প্রয়োজন মাফিক সম্পূরক সেচ দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, খরা কবলিত ধানের চেয়ে সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় ১ টন বেশি হয়।
ধান চাষে সেচ
সেচের পানির অপচয় রোধ:
বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে সাধারণত মাটির নালা দিয়ে সেচ দেয়া হয়। ফলে ফসলের জমি ও সেচের পানি উভয়েরই অপচয় হয়। এ অপচয় রোধকল্পে পিভিসি অথবা প্লাস্টিক পাইপ ব্যবহার করে পানির অপব্যবহার ও অপচয় রোধ করা যায়। এ পদ্ধতিতে সেচ দিলে পানির অপচয় কমানোর সাথে সেচের খরচও কমানো যায়। গভীর/অগভীর নলকূপ থেকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সেচ দিলে একই পরিমাণ পানি দিয়ে কাঁচা নালার তুলনায় শতকরা প্রায় ৪০-৪২ ভাগ বেশি জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব। বোরো মৌসুমে ধান আবাদে পানি সাশ্রয়ী আর একটি পদ্ধতির নাম অলটারনেট ওয়েটিং এন্ড ড্রাইং (AWD)।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ চলবে জাত ভেদে ৪০-৫০ দিন পর্যন্ত। যখনই গাছে থোড় দেখা দেবে তখন থেকে দানা শক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষেতে স্বাভাবিক ২-৫ সে.মি. পানি রাখতে হবে। এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে সেচের পানি, জ্বালানি ও সময় সাশ্রয় হয় এবং উৎপাদন খরচও হ্রাস পায়।
সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে জমিতে সেচ
ধান চাষে অনিষ্টকারী পোকা ও মেরুদন্ডী প্রাণী ব্যবস্থাপনা:
ধান ফসলে বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ দেখা যায়। যেমন- সবুজ পাতা ফড়িং, মাজরা পোকা, পামরী পোকা, গান্ধী পোকা, গল মাছি, শীষ কাটা লেদা পোকা ইত্যাদি। জমিতে গাছের ডাল বা বাশের কঞ্চি পুঁতে দিলে সেখানে পাখি বসে এবং পোকা ধরে খায়। তাছাড়া প্রতিরোধী ফসলের জাত ও বিভিন্ন দমন পদ্ধতি দ্বারা পোকা দমন করা যায়। তবে দ্রুত দর্শনের ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিচে একটি তালিকা দেয়া হলো ।
রোগ দমন ধান ফসলে বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। যেমন- কান্ড পচা রোগ, টুংরো রোগ, বাদামী দাগ রোগ, উফরা রোগ, ট্রাস্ট রোগ ইত্যাদি। এসব রোগ সঠিক সময়ে দমন করতে না পারলে ফলন যথেষ্ট কমে যায়। বীজ শোষন, আগাছা দমন ও সুষম সার প্রয়োগে বিভিন্ন রোগ দমন হয়। এছাড়া প্রতিরোধী জাত যেমন- মালা ও গাজী জাতের ধানে বাদামী দাগ রোগ কম হয়। বিভিন্ন রোগনাশক যেমন- কুপ্রাভিট ৫০, হিমোসান ৫০ ইত্যাদি প্রয়োগ করে ও রোগ দমন করা যায়।
ধানের রোগ ব্যবস্থাপনা:
নিবিড় চাষাবাদের কারণে ধান ফসলে বিভিন্ন প্রকার রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন রোগ-বালাই ধানের ক্ষতি করে এবং ফলন কমিয়ে দেয়। এজন্য রোগ শনাক্ত করে তার জন্য ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।
ধানের টুংরো রোগ:
ভাইরাসজনিত রোগ। সবুজ পাতাফড়িং এ রোগের বাহক। চারা অবস্থা থেকে গাছে ফুল ফোটা পর্যন্ত সময়ে এ রোগ দেখা দিতে পারে। ধানের ক্ষেতে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় গাছের পাতা হলুদ বা কমলা রঙ ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে সালফার বা নাইট্রোজেন সারের ঘাটতিজনিত কারণে এবং ঠাণ্ডার প্রকোপে এরূপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে সমস্ত জমির ধান বিক্ষিপ্তভাবে না হয়ে সমভাবে হলুদাভ বা কমলা রঙ ধারণ করে। গাছের বাড়-বাড়তি ও কুশি কমে যায় ফলে আক্রান্ত গাছ সুস্থ গাছের তুলনায় খাটো হয়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
রোগের প্রাথমিক অবস্থায় রোগাক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন। আগাম বীজতলায় বিশেষ করে আমন ধান কাটার সময়, বোরোর বীজতলায় সবুজ পাতাফড়িং দেখা গেলে হাতজাল বা কীটনাশক প্রয়োগ করে দমনের ব্যবস্থা নিন।
নিবিড় ধান চাষ এলাকায় ভলান্টিয়ার রাইস/রেটুন ধান তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন অথবা জমিতে চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিন। আলোক-ফাঁদ ব্যবহার করে বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলুন। সবুজ পাতাফড়িং দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া:
চারা রোপণের ১৫-২০ দিনের মধ্যে এবং বয়স্ক ধান গাছে এ রোগ দেখা যায়। আক্রান্ত চারা গাছের গোড়া পচে যায়, পাতা নেতিয়ে পড়ে হলুদাভ হয়ে মারা যায়। এ অবস্থাকে কৃসেক বলে। রোগাক্রান্ত কাণ্ডের গোড়ায় চাপ দিলে আঠালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ বের হয়। বয়স্ক গাছে সাধারণত থোড় অবস্থা থেকে পাতাপোড়া লক্ষণ দেখা যায়। প্রথমে পাতার অগ্রভাগ থেকে কিনারা বরাবর আক্রান্ত হয়ে নিচের দিকে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত অংশ প্রথমে জলছাপ এবং পরে হলুদাভ হয়ে খড়ের রং ধারণ করে।
ক্রমশ সম্পূর্ণ পাতাটাই শুকিয়ে মরে যায়। অতিমাত্রায় ইউরিয়া সারের ব্যবহার, শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ো আবহাওয়া এ রোগ বিস্তারে সাহায্য করে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন। রোগ দেখা দিলে প্রতি বিঘায় অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করুন। ঝড়-বৃষ্টি এবং রোগ দেখা দেওয়ার পর ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রাখুন। কৃসেক হলে আক্রান্ত জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিন। রোগাক্রান্ত জমির ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন।
ধানের উফরা রোগ:
কৃমিজনিত রোগ। কৃমি ধানগাছের কচি পাতা ও খোলের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে। কৃমি গাছের রস শোষণ করায় প্রথমে পাতার গোড়ায় ছিটেফোঁটা সাদা দাগ দেখা যায়। ক্রমান্বয়ে সে দাগ বাদামি রঙের হয়ে পুরো আগাটাই শুকিয়ে মরে যায়। আক্রমণের প্রকোপ বেশি হলে গাছে বাড়-বাড়তি কমে যায়। থোড় অবস্থায় আক্রমণ করলে থোড়ের মধ্যে শিষ মোচড়ানো অবস্থায় থেকে যায়। ফলে শিষ বের হতে পারে না।
কৃমি পরিত্যক্ত নাড়া, খড়কুটো এবং ঘাসে এমনকি মাটিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেঁচে থাকে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
রোগ দেখা দিলে হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি হারে ফুরাডান ৫জি অথবা কিউরেটার ৫জি প্রয়োগ করুন। রোগাক্রান্ত জমির ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন। সম্ভব হলে জমি চাষ দিয়ে ১৫-২০ দিন ফেলে রাখুন। আক্রান্ত জমিতে বীজতলা করা উচিৎ নয়। ধানের পর ধান আবাদ না করে অন্য ফসলের চাষ করুন। জলী আমন ধানে আক্রান্ত জমিতে কারবেনডাজিম ২% হারে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
ধানের ব্লাস্ট রোগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ পাতায় হলে পাতা ব্লাস্ট, গিটে হলে গিট ব্লাস্ট ও শিষে হলে শিষ ব্লাস্ট বলা হয়। পাতায় ব্লাস্ট হলে পাতায় ছোট ছোট ডিম্বাকৃতির দাগের সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে দাগ বড় হয়ে দু’প্রান্ত লম্বা হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে।
দাগের চার ধারে বাদামি ও মাঝের অংশ সাদা বা ছাই বর্ণ ধারণ করে। অনেকগুলো দাগ একত্রে মিশে গিয়ে পুরো পাতা মরে যায়। এ রোগের কারণে জমির সমস্ত ধান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এ রোগ বোরো মৌসুমে বেশি হয়। গিট ব্লাস্ট এবং শিষ ব্লাস্ট হলে গিট ও শিষের গোড়া কালো হয়ে যায় ও ভেঙে পড়ে এবং ধান চিটা হয়ে যায়। রাতে ঠান্ডা, দিনে গরম, রাতে শিশির পড়া এবং সকালে কুয়াশা থাকলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করুন। জমিতে পানি ধরে রাখুন। রোগমুক্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করুন। সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করুন। আক্রান্ত জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রেখে প্রতি হেক্টরে ৪০০ গ্রাম ট্রপার, জিল বা নেটিভো ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করুন।
সকল সুগন্ধি ধান, হাইব্র্রিড ধান এবং লবণ-সহনশীল ধানে ফুল আসার সময় নিম্নচাপ দেখা দিলে উল্লিখিত ছত্রাকনাশক আগাম স্প্রে করতে হবে।
ধানের খোলপোড়া রোগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। ধান গাছের কুশি গজানোর সময় হতে রোগটি দেখা যায়। প্রথমে খোলে ধূসর জলছাপের মত দাগ পড়ে। দাগের মাঝখানে ধূসর হয় এবং কিনারা বাদামি রঙের রেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। দাগ আস্তে আস্তে বড় হয়ে সমস্ত খোলে ও পাতায় অনকেটা গোখরো সাপের চামড়ার মত চক্কর দেখা যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া, বেশি মাত্রায় ইউরিয়ার ব্যবহার ও ঘন করে চারা রোপন এ রোগ বিস্তারে সহায়তা করে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
জমিতে শেষ মই দেয়ার পর পানিতে ভাসমান আবর্জনা সুতি কাপড় দিয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন। পটাশ সার সমান দু’কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সার প্রয়োগের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করুন।
নেটিভো, ফলিকুর, কনটাফ, হেক্সাকোনাজল খোলপোড়া রোগ দমনে কার্যকর ছত্রাকনাশক। আক্রান্ত ধানগাছের চারপাশের কয়েকটি সুস্থ গুছিসহ বিকেলে গাছের উপরিভাগে এটি স্প্রে করুন। ছত্রাকনাশকের মাত্রা লেবেলে দেখে নিন। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন।
ধানের বাকানি রোগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। আক্রান্ত কুশি দ্রুত বেড়ে অন্য গাছের তুলনায় লম্বা ও লিকলিকে হয়ে যায় এবং হালকা সবুজ রঙের হয়। গাছের গোড়ার দিকে পানির উপরের গিঁট থেকে শিকড় বের হয়। ধীরে ধীরে আক্রান্ত গাছ মরে যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
রোগাক্রান্ত কুশি তুলে ফেলুন। এ রোগ বীজবাহিত। তাই বীজ শোধন করতে পারলে ভাল হয়। এ জন্য কারবেনডাজিম গ্রুপের যেকোনও ছত্রাকনাশকের ৩ গ্রাম ওষুধ ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে অঙ্কুরিত বীজে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া একই পরিমাণ ওষুধ দিয়ে সারা রাত চারা শোধন করেও ভাল ফল পাওয়া যায়।
ধানের বাদামি দাগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ হলে পাতায় প্রথমে ছোট ছোট বাদামি দাগ দেখা যায়। দাগের মাঝখানটা হালকা বাদামি রঙের হয়। অনেক সময় দাগের চারদিকে হলুদ আভা দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করুন। ইউরিয়া ও পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করুন। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন। পর্যায়ক্রমে জমিতে পানি সেচ দিন এবং জমি শুকিয়ে নিন। আক্রান্ত জমিতে শিষ বের হওয়ার পর ৬০ গ্রাম পটাশ ও ৬০ গ্রাম থিওভিট/কমুলাস ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫শতক জমিতে স্প্রে করলে ধানে বাদামি দাগ কম হয়। কারবেনডাজিম-জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে (বীজ ০.৩% দ্রবণে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে) বীজ শোধন করুন।
ধানের খোল পচা:
ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ ধানগাছের ডিগপাতার খোলে হয়। রোগের শুরুতে ডিগপাতার খোলের ওপরের অংশে গোলাকার বা অনিয়মিত আকারের বাদামি দাগ দেখা যায়। আস্তে আস্তে দাগটি বড় হতে থাকে এবং গাঢ় ধূসর রঙ ধারণ করে। এ অবস্থায় অনেক সময় শিষ বের হতে পারে না অথবা রোগের প্রকোপ অনুযায়ী আংশিক বের হয় এবং বেশিরভাগ ধান কালো ও চিটা হয়ে যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
আক্রান্ত খড়কুটো জমিতে পুড়িয়ে ফেলুন। সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করুন। খোলপোড়া রোগের ছত্রাকনাশক এ রোগের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করুন।
ধানের লক্ষ্মীর গু রোগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। ধান পাকার সময় এ রোগ দেখা যায়। ছত্রাক ধানের বাড়ন্ত চালকে নষ্ট করে বড় গুটিকার সৃষ্টি করে। গুটিকার ভিতরের অংশ হলদে-কমলা রঙ এবং বহিরাবরণ সবুজ যা আস্তে আস্তে কালো হয়ে যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
এ রোগ ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে ভাল উপায় হল রোগাক্রান্ত শিষ তুলে ফেলা ও মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার না করা।
ধানের পাতা লালচে রেখা রোগ:
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। ব্যাকটেরিয়া পাতার ক্ষত দিয়ে প্রবেশ করে এবং শিরার মধ্যবর্তী স্থানে সরু রেখার জন্ম দেয়। আস্তে আস্তে রেখা বড় হয়ে লালচে রঙ ধারণ করে। পাতা সূর্যের বিপরীতে ধরলে দাগের ভেতর দিয়ে স্বচ্ছ আলো দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
এ রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বীজ শোধন করা দরকার, আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করা উচিত নয় এবং নাড়া পুড়িয়ে ফেলা দরকার।
ধান অনিষ্টকারী পোকা ও প্রাণী নিয়ন্ত্রণ:
নিবিড় চাষাবাদের কারণে ফসলে পোকার প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন পোকার প্রাদুর্ভাব বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের উপায়সমূহ একে একে নিম্নে বর্ণনা করা হল:
মাজরা পোকা
মাজরা পোকা ব্যবস্থাপনা (Stem borer):
মাজরা পোকার আক্রমণ ফুল ফোঁটার আগে হলে মরা ডিল এবং ফুল ফোঁটার পরে হলে সাদা শিষ বের হয়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলুন।
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা (মথ) সংগ্রহ করে দমন করুন।
ধান ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির সাহায্য নিন।
জমিতে শতকরা ১০-১৫ ভাগ মরা ডিগ অথবা শতকরা ৫ ভাগ সাদা শিষ দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করুন। আমন ধান কাটার পর চাষ দিয়ে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে বা পুড়িয়ে ফেলুন।
ধানের নলিমাছি বা গলমাছি
নলিমাছি বা গলমাচি ব্যবস্থাপনা (Gall midge):
এই মাছির দ ধানগাছের বাড়ন্ত কুশিতে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত কুশি পেঁয়াজ পাতার মত হয়ে যায়। ফলে কুশিতে আর শিষ হয় না।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
রোপণের পর নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করুন।
আলোক-ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণবয়স্ক পোকা দমন করুন।
জমিতে শতকরা ৫ ভাগ পেয়াজ পাতার লক্ষণ দেখা গেলে কীটনাশক ব্যবহার করুন।
ধানের পামরি পোকা
পামরি পোকা ব্যবস্থাপনা (Rice hispa):
পামরি পোকার কীড়া পাতার ভেতরে সুড়ঙ্গ করে সবুজ অংশ খায়, আর পূর্ণবয়স্ক পোকা পাতার সবুজ অংশ কুরে কুরে খায়। এভাবে খাওয়ার ফলে পাতা সাদা দেখায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
হাতজাল বা মশারির কাপড় দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলুন।
জমিতে শতকরা ৩৫ ভাগ পাতার ক্ষতি হলে অথবা প্রতি গোছায় চারটি পূর্ণ বয়স্ক পোকা অথবা প্রতি কুশিতে ৫টি কীড়া থাকলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
পাতা মোড়ানো পোকা
পাতা মোড়ানো পোকা ব্যবস্থাপনা (Leaf roller):
পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া গাছের পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে পাতার ভিতরের সবুজ অংশ খায়। খুব বেশি ক্ষতি করলে পাতা পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন।
গাছে থোড় আসার সময় বা ঠিক তার আগে যদি শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের চুঙ্গি পোকা
চুঙ্গি পোকা ব্যবস্থাপনা (Rice caseworm):
চুঙ্গি পোকা পাতার উপরের অংশ কেটে ছোট ছোট চুঙ্গি তৈরি করে ভেতরে থাকে। আক্রান্ত ক্ষেতে গাছের পাতা সাদা দেখায় এবং পাতার উপরের অংশ কাটা থাকে। দিনের চুঙ্গিগুলো পানিতে ভাসতে থাকে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
পানি থেকে হাতজাল দিয়ে চুঙ্গিসহ কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করুন।
জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের লেদা পোকা
লেদা পোকা ব্যবস্থাপনা (Swarming caterpillar):
এ পোকার কীড়া পাতার পাশ থেকে কেটে এমনভাবে খায় যে কেবল ধানগাছের কাণ্ড অবশিষ্ট থাকে। সাধারণত: শুকনো জমিতে এ পোকার আক্রমণের আশঙ্কা বেশি।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
ধান কাটার পর জমি চাষ দিয়ে রাখুন অথবা নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন।
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন।
জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের মাঠে ঘাসফড়িং:
ঘাসফড়িং পাতার পাশ থেকে শিরা পর্যন্ত খায়। জমিতে অধিক সংখ্যায় আক্রমণ করলে এদেরকে পঙ্গপাল বলা হয়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
হাতজাল বা মশারির কাপড় দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলুন। ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন। জমির শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের মাঠে লম্বাশুড় উরচুঙ্গা:
এ পোকা ধানের পাতা এমনভাবে খায় যে পাতার কিনারা ও শিরা বাকি থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত পাতা ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন। আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পূর্ণবয়স্ক উরচুঙ্গা দমন করুন। জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের মাঠে সবুজ পাতাফড়িং:
সবুজ পাতাফড়িং ধানের পাতার রস শুষে খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ও গাছ খাটো হয়ে যায়। এ পোকা টুংরো ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা দমন করুন। হাতজালের প্রতি টানে যদি একটি সবুজ পাতাফড়িং পাওয়া যায় এবং আশেপাশে টুংরো রোগাক্রান্ত ধান গাছ থাকে তাহলে বীজতলায় বা জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের মাঠে বাদামি গাছফড়িং:
বাদামি গাছফড়িং ধানগাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়। ফলে গাছ পুড়ে যাওয়ার রং ধারণ করে মরে যায় তখন একে বলা হয় ‘হপার বার্ন’ বা ‘ফড়িং পোড়া’।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
বোরো মৌসুমে ফেব্রুয়ারি এবং আমন মৌসুমে অগাস্ট মাস থেকে নিয়মিত ধান গাছের গোড়ায় পোকার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন। এ সময় ডিম পাড়তে আসা লম্বা পাখাবিশিষ্ট ফড়িং আলোক-ফাঁদের সাহায্যে দমন করুন। ধানের চারা ঘন করে না লাগিয়ে পাতলা করে রোপণ করলে গাছ প্রচুর আলো বাতাস পায়; ফলে পোকার বংশ বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে।
ধানের মাঠে ইঁদুর দমন:
ইঁদুর ধান গাছের কুশি কেটে দেয়। ধান পাকলে ধানের ছড়া কেটে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে জমা রাখে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
জমির আইল ও সেচ নিষ্কাশন নালা কম সংখ্যক ও চিকন রাখতে হবে। একটি এলাকায় যথাসম্ভব একই সময় ধান রোপণ ও কর্তন করা যায় এমনভাবে চাষ করতে হবে। ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন করুন। বিষটোপ, যেমন-ব্রমাডিওলন দিয়ে ইঁদুর দমন করা যায়।
ধান কাটা
ধান ফসল কর্তন, মাড়াই ও সংরক্ষণ:
শীথের উপরের অর্ধেক দানার শতকরা ৮০ ভাগ এবং নিচের অর্ধেক নানার শতকরা ২০ ভাগ শক্ত হলে ধান কাটার উপযুক্ত সময় হয়। তাছাড়া কিছু কিছু ধান সোনালী রং ধারণ করে এবং নীলের মতন ছেলে পড়ে। এমতাবস্থান কেটে আঁটি বেঁধে পরিষ্কার জানালার দিয়ে প্যাডেল প্রেসার বা গরু দিয়ে বা পিটিয়ে মাড়াই করতে হয়। এরপর কেড়ে পরিষ্কার করে ৩- ৪ বার ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়।
অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শিষ ভেঙে যায়, শিষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। শিষের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাড়াই করা উচিত। কাঁচা খলার উপর ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নিন। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে।
মাড়াই করা ধান অন্তত ৪-৫ দিন রোদে ভালভাবে শুকানোর পর যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে এবং এমতাবস্থায় গুদামজাত ও আর্দ্রতা-রোধক গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে।
ওলকচু চাষ করার পদ্ধতি , ওলকচুর চাষ পদ্ধতি সঠিকভাবে না জানার কারণে চাষিরা তাদের কাঙ্খিত ফলন পান না। ওল মাটির নিচে জন্মানো একটি সবজি। আমাদের দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই ওলকচুর চাষ হয়ে থাকে। ওল কচুতে পুষ্টি ও ওষুধি গুণ উভয়ই বিদ্যমান। ওল কচু তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। আসুন জেনে নেই ওলকচু চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে-
ওলকচু চাষ করার পদ্ধতি
জলবায়ু ও মাটির গুণাগুণ
ওলকচুর জমিতে অবশ্যই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ছায়া থাকলে ভালো হয় না। ওল কচুর গাছ ভালোভাবে বৃদ্ধির জন্য ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও বার্ষিক ১০০-১৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। মাটির নির্বাচনের ক্ষেত্রে এঁটেল দোআঁশ, দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি ওলকচু চাষের জন্য উপযোগী।
ওলকচুর জাত
বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের ওলকচুর চাষ করা হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে ‘মাদ্রাজি’ জাতের ওলকচু উৎকৃষ্ট মানের। তবে আমাদের দেশে এখনও ওলকচুর তেমন কোনও নির্দিষ্ট জাত আবিষ্কার করা যায়নি।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ
ওলকচু চাষের জন্য প্রথমেই মাটি ভালোভাবে চাষ করে নিতে হবে ও মই দিয়ে মটি ঝুরঝুরে করে মই দিয়ে মাটি চেপে দিতে হবে। মাঘ মাসের মাঝামাঝি ও ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি ওলকচুর বীজ বপনের জন্য উপযুক্ত সময়। প্রয়োজনে মধ্য-চৈত্র থেকে মধ্য-বৈশাখ মাসেও লাগানো যায়। তবে এরপরে রোপণ করলে ফলন কমে যায়।
জমি থেকে সাধারণত কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ওল তোলা শুরু হয়। তখন ওলের চারপাশে যে মুখি জন্মে সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে। এসব মুখি থেকেই চাকি তৈরি হয়। চাকির আকার যত বড় হয় ওল তত বড় হয়।
ওলকচু চাষে সার প্রয়োগ
ওলকচুর চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর প্রতি শতক জমির জন্য ১.২ কেজি টিএসপি, ০.৫ কেজি গোবর ও ০.৩ কেজি ইউরিয়া সার মাটির সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। প্রতি গর্তের মাটিতে কী পরিমাণ সার মেশাতে হবে তা নির্ভর করে একরপ্রতি গর্তের সংখ্যার ওপর। সারের মাত্রা একর প্রতি ৩০ কেজি ইউরিয়া, ১২০ কেজি টিএসপি, ৫০ কেজি এমওপি। সার মেশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে।
সারের মাত্রা
সারের মাত্রা একর প্রতি ৩০ কেজি ইউরিয়া, ১২০ কেজি এসএসপি, ৫০ কেজি এমওপি। প্রতি গর্তের মাটিতে কী পরিমাণ সার মিশাতে হবে তা নির্ভর করবে একর প্রতি গর্তের সংখ্যার ওপর। মোট সারের পরিমাণকে একর প্রতি গর্তের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গর্ত প্রতি সারের পরিমাণ বের করে নিতে হবে। সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। ভরাট করার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে ভালো ‘জো’ থাকে। ভরাটের পর গর্তের মুখ মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু করে ঢিবির মতো করে দিতে হবে।
এতে সুবিধা হলো, গর্তের মধ্যে অনেক সময় বৃষ্টির জল জমে ‘চাকি’ পচে যায়। ঢিবি তৈরির ফলে এ সম্ভাবনা কমে যায়। ‘চাকি’ থেকে মাটির ওপরে চারা বেরিয়ে আসতে বেশ সময় লাগে। তাই এ সময় সব জমি খড় বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রাখলে ভালো হয়। জমিতে সালফারের অভাব থাকলে একরপ্রতি ২০ কেজি জিপসাম সার এবং সুযোগ থাকলে ১০০ কেজি ছাই ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়।
চারা গজানোর পর চারা যাতে ভালোভাবে মাটির ওপরে পাতা ছড়াতে পারে সে জন্য কচুরিপানা বা খড় মুখের কাছে সামান্য আলগা করে ঢেকে দিতে হবে। চারা গজানোর এক মাস পর একর প্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি এমওপি সার সেচের পর গাছের চারপাশে খড় বা কচুরিপানার নিচে দিতে হবে। কিছু দিন পর গোড়ার মাটি হালকা করে কুপিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে এতে শিকড় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ‘চাকি’ ক্রমশ ওপরের দিকে বাড়তে থাকে। অনেকেই বলে থাকেন, ওলের আকার-আকৃতি অনেকটা গর্তের আকারের ওপর নির্ভর করে।
ওলকচু চাষে সেচ ও পানি নিষ্কাশন
ওলকচু চাষে প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থাও করতে হবে। বীজ লাগানোর পরে যদি বৃষ্টিপাত না হয় তবে সেচ দিতে হবে। দুই সারি বা প্রতি সারির পাশ দিয়ে হালকা নালা তৈরি করে দিতে হবে যাতে সহজেই বৃষ্টির পানি যেতে পারে। ওলের জমিতে পানি জমতে দেয়া যাবে না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ওলকচু চাষে আগাছা ও নিড়ানি
ওলকচু চাষে সময়মত আগাছা দমন ও নিড়ানি দিতে হবে। ধান, গমের খড় বা কচুরিপানা দ্বারা আচ্ছাদন দিয়ে ফলন অনেক গুণ বৃদ্ধি করা যায় এবং সহজেই আগাছা দমন করা যায়। চারা গজানোর পর আগাছা দমন করতে হবে।
ওলকচু চাষে পোকামাকড় ও রোগদমন
ওলকচুর কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই দ্বারা তেমন আক্রান্ত হয় না । তবে মাঝে মধ্যে ওলকচুতে লিম্ফ ব্লাইট কলার রট ও মোজাইক রোগ দেখা দেয়। আবার গোঁড়া পচা রোগ ওলের প্রধান ক্ষতিকর রোগ। চাকি লাগানোর আগে ছত্রাকনাশক ব্যাভিস্টিন (Bavistin) দিয়ে তা শোধন করে নিলে এ রোগ কম হয়। কচু মুখি কার্তিক মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাসের দিকে পরিপক্ব হয়ে থাকে। ওলকচু লাগানোর পর প্রায় ৭ থেকে ১২ মাস পর সংগ্রহ করা যায়। গোড়ার মাটি সরিয়ে ওল সংগ্রহ করা যায়।
শালগম চাষের সহজ ও সঠিক পদ্ধতি , শালগম কমবেশি সবার কাছেই পরিচিত। এটি সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় উপযোগী। কম তাপমাত্রায় এটি ভালো জন্মে। এই গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রচুর আলো দরকার হয়ে থাকে। তাপমাত্রা বেশি হলে ফসলের মান কমে যায়। স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। মূল আঁশময় হয়ে যায়। আবার বেশি বৃষ্টিপাত ও শালগম চাষের জন্য ক্ষতিকর। আজ আপনাদের সাথে শালগম চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই শালগম চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন:
শালগম চাষের সহজ ও সঠিক পদ্ধতি
শালগম চাষের জন্য জমি ও মাটি:
শালগম চাষে জমি অধিক আলো যুক্ত হতে হবে। শালগম চাষে সাধারণত বেলে দোআঁশ মাটি বেশি উপযোগী।
শালগম চাষের সময়:
শালগম চাষ করার উপযুক্ত সময় হলো রবি মৌসুম। শালগম গাছ বৃষ্টিপাত সহ্য করতে পারে না। চারা কচি অবস্থায় যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই শালগম এমন সময় চাষ করতে হবে যখন বৃষ্টি পাত না হয়। সাধারণত নভেম্বর মাসের প্রথম থেকে ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত শালগমের বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।
শালগম চাষের জন্য জমি তৈরি:
জমিতে বীজ বপন করার আগে জমি ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হবে। জমিতে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। তারপর বীজ বপন করতে হবে।
শালগম চাষের জন্য বীজ প্রস্তুত:
উন্নত ফলন পেতে হলে ভালো মানের বীজ বাছাই করতে হবে। বীজগুলো ৫% লবণের দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তাহলে নিম্নমানের বীজগুলো ভেসে উঠবে এবং ভালো বীজগুলো দ্রবণের নিচে থাকবে। এভাবে ভালো বীজ বাছাই করা যাবে।
শালগম চাষের জন্য বীজ শোধন:
বীজ বপন করার আগে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ শোধন করে নিলে বীজ বাহিত রোগ দ্বারা ফসল আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। বীজগুলো প্রথমে একটু বেশি গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর একবারে খুব ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া বীজগুলো পটাসিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট দ্রবণেও ভিজিয়ে নিয়ে শোধন করা যাবে।
শালগম চাষের জন্য বীজ বপন:
বীজ বপন করে আবার চারা রোপণ করে শালগমের চাষ করা যায়। তবে চারা রোপণ করতে গেলে অনেক সময় প্রধান শেকড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই চারা রোপণ পদ্ধতি না ব্যবহার করাই ভালো। ভালো মানের বীজ বপন করার ৪০-৫০ দিনের মধ্যেই ফসল সংগ্রহের উপযোগী হয়ে থাকে। বীজ সারিতে বপন করতে হবে। এক সারি থেকে আরেক সারির দূরত্ব হবে ৩০ সেমি। এক চারা থেকে আরেক চারার দূরত্ব হবে ২০ সেমি।
শালগম চাষের জন্য বীজের হার:
বীজ বপন করলে এক শতক জমিতে ১২ গ্রাম চারা প্রয়োজন হতে পারে। চারা রোপণ করলে এক শতক জমিতে ২.৫ গ্রাম চারা করা যেতে পারে।
শালগম চাষের জন্য সার ব্যবস্থাপনা:
উন্নত ফলন পেতে হলে জমিতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে। এক হেক্টর জমিতে গোবর দিতে হবে ১০ টন, ইউরিয়া সার ১৫০ কেজি, টিএসপি দিতে হবে ১২৫ কেজি, পটাশ দিতে হবে ১৭৫ কেজি। তবে যদি আগাম জাত চাষ করা হয়ে থাকে তাহলে ফসল লাগানোর সময় সব সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। আর নাবি জাত চাষ করলে ইউরিয়া সার ও পটাশ সার জমিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপন করার ৩০ দিন পর প্রথম কিস্তি সার প্রয়োগ করতে হবে। তখন ইউরিয়া দিতে হবে ১৫০ গ্রাম ও এমওপি দিতে হবে ১৫০ গ্রাম। আর বীজ বপন করার ৪৫ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি দিতে হবে আরও ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১৫০ গ্রাম এমওপি। প্রতিবার সার প্রয়োগ করার পর জমিতে সেচ দিতে হবে।
শালগম চাষে সেচ প্রয়োগ:
উন্নত ফলন পেতে হলে জমিতে সেচ দিতে হবে। সেচ দেওয়ার পর জমিতে জো আসলে মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। জমিতে চারা রোপণ করার পর প্রয়োজন অনুযায়ী এক সপ্তাহে দুটি সেচ দিতে হবে। তারপর ৭-১০ দিন পর পর সেচ দিলে হবে। জমিতে সেচ ঠিকমত দিতে হবে কারণ ফসলের আর্দ্রতা মাটির আর্দ্রতার ওপর নির্ভর করে। জমিতে জলের পরিমাণ কম হলে ফলগুলো তিতা স্বাদ যুক্ত হয়ে যেতে পারে। আবার পানি বেশি হলে ফলের স্বাদ নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং পানি জলময় হয়ে যেতে পারে। তাই শালগম চাষে মাটিতে জলের পরিমাণ ঠিক রাখা খুব জরুরি।
আগাছা দমন: জমির আগাছা ঠিক মত পরিষ্কার করে দিতে হবে। জমিতে আগাছা জমে থাকলে ফসলের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। জমি নিড়ানি দিয়ে গোঁড়া আলগা করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গোঁড়ায় মাটি দিয়ে দিতে হবে।
রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা: শালগম চাষে কাটুই পোকা ক্ষতিকারক। এ পোকা চারা গাছ কেটে নষ্ট করে ফেলে। তাই এ পোকা দমন করার জন্য ৫ লিটার জলে ১.৫ চা চামচ পরিমাণ ডায়াজিনন নিয়ে মিশাতে হবে। তারপর তা স্প্রে করতে হবে জমিতে। এ ছাড়া জাব পোকা, শুয়ো পোকা ও গাছের পাতা খেয়ে পাতা নষ্ট করে ফেলে। এর জন্য ম্যালাথিয়ন পরিমিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ: শালগম বেশি পরিপক্ব হয়ে গেলে বাজারে আনা যাবে না। তখন সে সব শালগমের মূল আঁশ যুক্ত হয়ে যায় এবং ফসল স্বাদহীন হয়ে যায়। সাধারণত বীজ বপন করার ৪৫-৬০ দিনের মধ্যেই শালগম খাওয়ার উপযু্ক্ত হয়ে থাকে।
শালগম এর ফলন:
এক শতক জমিতে প্রায় ১০০-১২০ কেজি শালগম এর ফলন হয়ে থাকে।
ধুন্দল চাষ পদ্ধতি ও জাত পরিচিতি , বাংলাদেশে ধুন্দল (Sponse gourd) চাষ করা হয় সাধারণত সবজি হিসেবে খাওয়ার জন্য। যার বৈজ্ঞানিক নাম Luffa cylindrica এবং পরিবার Cucurbitaceae। আমাদের দেশে দুই ধরনের ধুন্দল পাওয়া যায়। একটি হলো সাধারণত আমরা যেটা খাই। এর শাঁস তিতা নয়, সুস্বাদু এবং নরম। অন্যটি হলো বন্য ধুন্দল, যাকে তিতপল্লা বলা হয়। এর পাকা ফল শুকিয়ে স্পঞ্জের মতো গায়ে সাবান মাখার খোসা তৈরি করা হয়।
ধুন্দল চাষ পদ্ধতি ও জাত পরিচিতি
ধুন্দল চাষ প্রক্রিয়া:
ধুন্দল চাষের জমি:
ধুন্দল চাষে জমির প্রথম শর্ত হচ্ছে উঁচু, পানি জমে থাকে না, গাছের কোনও ছায়া থাকে না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ ধুন্দুল চাষের জন্য উত্তম। মাটি উর্বর এবং সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ধুন্দল চাষের জন্য বীজের পরিমাণ:
বিঘা প্রতি ৩৩০-৪০০ গ্রাম (শতক প্রতি ১০-১২ গ্রাম) বীজের প্রয়োজন।
ধুন্দল চাষের জন্য জমি প্রস্তুতকরণ:
জমি ৩- ৪ বার ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে ধুন্দুল চাষের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। জমির মাটি ভালো করে আগাছামুক্ত ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। এরপর ১ ফুট গভীর, ২.৫ ফুট লম্বা এবং ২.০ ফুট চওড়া করে মাদা তৈরি করতে হবে। এক মাদা থেকে অপর মাদার দূরত্ব হবে ৮-১০ ফুট। জমির চেয়ে মাদা কমপক্ষে ৫-৬ ইঞ্চি উঁচু করে তৈরি করতে হবে।
ধুন্দলের বীজ বপন:
বীজ বোনার আগে দেড় থেকে দুদিন ভিজিয়ে রেখে মাদা প্রতি ৪-৫টি বীজ।
ধুন্দল চাষে সার ব্যবস্থাপনা:
ধুন্দলের ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি শতাংশ (ডেসিমাল) জমির জন্য নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে:-
ধুন্দল চাষের জন্য সার প্রয়োগ পদ্ধতি:
সমুদয় গোবর, অর্ধেক টিএসপি ও পটাশ শেষ চাষের সময়। বাকি টিএসপি, পটাশ, সম্পূর্ণ জিপসাম ও অর্ধেক ইউরিয়া মাদার গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ধুন্দল চাষে অন্যান্য প্রযুক্তি:
ধুন্দল চাষে সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা:
মাটির অবস্থার ওপর ভিত্তি করে জমিতে সেচ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে জমিতে যেন অতিরিক্ত পানি না জমে থাকে। থাকলে তা বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ধুন্দল পরিচর্যা:
প্রতি মাদায় ৩-৪টি সুস্থ-সবল গাছ রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে। গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে জমিতে গাছের গোঁড়ার পাশে বাঁশের কুঞ্চী বা কাটি পুতে দিতে হবে। যাতে করে মাচায় বা জাংলায় সহজে উঠতে পারে। জমিতে মাচা ৩-৪ ফুট উঁচু করে দিলে ভালো হয়। জমিতে আগাছা জন্মালে পরিষ্কার করে দিতে হবে। ১৫-২০ দিন র পর প্রতি মাদায় ৫০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ধুন্দল চাষে পোকামাকড় ও রোগবালাই:
ধুন্দলের গাছে অনেক ধরনের রোগ হয়ে থাকে। রোগাক্রান্ত ও মরা পাতা সংগ্রহ করে পুঁতে ফেলতে হবে। ফল ছিদ্রকারী পোকা ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এ পোকার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। চারা অবস্থায় রেড পাম্পকিন বিটিল চারার পাতা ঝাঁঝরা করে খেয়ে ক্ষতি করে। চারার কচি পাতা ও মাথা খেয়ে এরা ক্ষতি করে। ছাই ছিটিয়ে বা মশারির জাল দিয়ে বীজতলায় চারা ঢেকে রেখে এ পোকার আক্রমণ হতে রক্ষা করা যায়। এ ছাড়া কাঁটালে পোকাও গাছে আক্রমণ করে থাকে।
ধুন্দল ফল সংগ্রহ:
বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ শুরু করা যায়। শরৎকাল পর্যন্ত ধুন্দল তোলা যায়। ফল বোঁটা কেটে সংগ্রহ করতে হবে। খাওয়ার জন্য কচি থাকতেই সবুজ রঙের ধুন্দল তুলতে হবে। খোসা শক্ত হয়ে এলে তা আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।
ধুন্দল ফলন:
রোগমুক্ত, উন্নত জাতের বীজ, আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও সঠিক নিয়ম অনুযায়ী চাষ করলে শতক প্রতি ১২০-১৪০ কেজি এবং একরপ্রতি ১২-১৪ টন ফলন পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও হেক্টর প্রতি ৫০ হাজার ধুন্দুল উৎপাদন করা সম্ভব।
চিচিঙ্গা চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করবো আজ। চিচিঙ্গা হচ্ছে ঝিঙের মতো কিন্তু আরও লম্বা বা কখনও সাপের মত পেঁচানো, অপেক্ষাকৃত নরম সবজি। একে কখনো কইডা বা দুধকুুুশি বা হইডা বলা হয়ে থাকে। এর ইংরেজি নাম Snake gourd আর বৈজ্ঞানিক নাম Trichosanthes cucumerina। এটি ঝিঙে, লাউ, শশা, কুমড়ো ইত্যাদির মতই কিউকারবিটেসি পরিবারের সদস্য। চিচিঙ্গা বাংলাদেশের সকলের নিকট প্রিয় অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি।
চিচিঙ্গা চাষ
চিচিঙ্গা গাছের পাতা ২৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ফুলগুলি উষ্ণ, সাদা আঁশ নিয়ে রাতে পাপড়ি মেলে , পাপড়িগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় চুলের মতো সাদা আঁশ গুলো কিছুটা মুটিয়ে আসে, তবে রাতের বেলা সাদা রেখার কারণে নীল রঙের ফলগুলো দেখা যায় (নিচের গ্যালারীতে ফটো দেখুন)। চিচিঙ্গা ফল ২০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পেকে গেলে লাল বর্ণ ধারণ করে এবং বীজ সংগ্রহ করা যায়। এদের একটি জাত হলো জাপানি চিচিঙ্গা। এটি কিছুটা গোলাকৃতির হয় এবং ৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃত্তাকার হয়। চট্টগ্রামে এটিকে হইডা ও গোপালগঞ্জে কুশি নামে ডাকা হয়।
চিচিঙ্গার অনেক ঔষধী গুণ আছে। চিচিঙ্গার ১০০ ভাগ ভক্ষণযোগ্য অংশে ৯৫ ভাগ পানি, ৩.২-৩.৭ গ্রাম শর্করা, ০.৪-০.৭ গ্রাম আমিষ, ৩৫-৪০ মিঃগ্রাঃ ক্যালসিয়াম, ০.৫-০.৭ মিঃগ্রাঃ লৌহ এবং ৫-৮ মিঃগ্রাঃ খাদ্যপ্রাণ সি আছে।
প্রতি ১০০ গ্রাম চিচিঙ্গার পুষ্টি তথ্য:
আয়রন
৫.৭০%
আয়োডিন
৫.৯০%
কোলেস্টেরল
০.০ মিলিগ্রাম
ক্যালোরি
৮৬.২ কিলোক্যালরি
খনিজ পদার্থ: ক্যালসিয়াম
৫.১০%
খাদ্যতালিকাগত ফাইবার
০.৬ গ্রাম
দস্তা
৭.২০%
পটাশিয়াম
৩৫৯.১ মিগ্রা
প্রোটিন
২.০ গ্রাম
ফসফরাস
৫.০০%
ভিটামিন ই
১.১০%
ভিটামিন বি৬
১১.৩০%
ভিটামিন সি
৩০.৫০%
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস: ভিটামিন: ভিটামিন এ
৯.৮০%
মোট কার্বোহাইড্রেট
১২.৫ গ্রাম
ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস: মোট ফ্যাট
৩.৯ গ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম
৬.৭০%
ম্যাঙ্গানিজ
১২.৫০%
সোডিয়াম
৩৩.০ মিলিগ্রাম
স্যাচুরেটেড ফ্যাট
০.৫ গ্রাম
চিচিঙ্গা চাষের জন্য জলবায়ু ও মাটি:
উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় চিচিঙ্গা ভাল জন্মে। শীতের দু’ তিন মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যেকোন সময় চিচিঙ্গা জন্মানো যায়। সব রকম মাটিতে চিচিঙ্গার চাষ করা যায় তবে জৈব সার সমৃদ্ধ দো-আশঁ ও বেলে দো-আশঁ মাটিতে ভালো জন্মে।
জাত
বিএডিসি ‘ঝুম লং’ নামের একটি জাতের বীজ উৎপাদন করছে। এর ফল নীলাভ কালচে সবুজ ও দীর্ঘ। ফলধারী আরো একটি জাত ‘সাদা সাভারী’ নামে পরিচিত। তাছাড়া তিস্তা, তুরাগ, সুরমা, রূপসা, বিভিন্ন জাত এদেশে চাষ হয়।
চিচিঙ্গার জীবন কাল:
মোট জীবনকাল প্রায় পাঁচ মাস। তবে জাত ও আবহাওয়া ভেদে সময় কমবেশী হতে পারে।
চিচিঙ্গার উৎপাদন মৌসুম:
এদেশে চিচিঙ্গা প্রধানত খরিফ মৌসুমেই হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে যে কোন সময় চিচিঙ্গার বীজ বোনা যেতে পারে।
চিচিঙ্গা চাষের জন্য বীজের হার:
চিচিঙ্গার জন্য হেক্টর প্রতি ৪-৫ কেজি (১৬-২০ গ্রাম/শতাংশ) বীজের প্রয়োজন হয়। জাত ভেদে শতক প্রতি ১২ – ১৫ গ্রাম। উন্নত জাতঃ সুরমা এফ-১, তিস্তা, বারি চিচিঙ্গা-১।
চিচিঙ্গার কৃত্রিম পরাগায়ন:
বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশেপাশে অন্য জাতের চিচিংগার গাছ থাকলে নির্বাচিত গাছের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার আগে (সকাল ৯ঃ০০ ঘটিকা থেকে দুপুর ২ঃ০০ ঘটিকার মধ্যে) পেপার ব্যাগ দ্ধারা বেধেঁ নিতে হবে। অতঃপর ফুল ফোটার পর কৃত্রিম পরাগায়ণ করতে হবে এবং পরাগায়ণ শেষে স্ত্রী ফুলটি আবার ব্যাগিং করে রাখতে হবে। ৩-৪ দিন পর ব্যাগ খুলে ফেলা যাবে। কৃত্রিম পরাগায়ণ অবশ্যই সকাল ৬ঃ০০ ঘটিকা থেকে ৯ঃ০০ ঘটিকার মধ্যেই সমাপ্ত করতে হবে।
চিচিঙ্গার অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা:
অন্য ফসলের মতোই ভালো ফলন পেতে গেলে চিচিঙ্গার পরিচর্যা জরুরী। যেমন – আগাছা সবসময় পরিষ্কার করে সাথে সাথে মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। পাশাপাশি খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। জুন-জুলাই মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আর সেচের প্রয়োজন হয় না। এরপর বাউনী দেয়া চিচিঙ্গার প্রধান পরিচর্যা। চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মিটার উঁচু মাচা তৈরি করতে হবে । বাউনী দিলে ফলন বেশী ও ফলের গুনগত মানও ভালো হয়।
চিচিঙ্গা চাষে সেচ:
চিচিঙ্গা গ্রীষ্মকালে চাষ করা হয়। গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয় বলে তখন সবসময় পানি সেচের প্রয়োজন নাও হতে পারে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ সময় থেকে মে মাস পর্যন্ত খুব শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। তখন অনেক সময় কারণ বৃষ্টিই থাকে না। উক্ত সময়ে ৫-৬ দিন অন্তর নিয়মিত পানি সেচের প্রয়োজন হয়।
চিচিঙ্গা চাষে সার প্রয়োগ:
২০ কেজি গোবর, অর্ধেক টিএসপি ও ২০০ গ্রাম পটাশ, সমুদয় জিপসাম, দস্তা, বোরণ জমি তৈরির সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট গোবর (মাদা প্রতি ৫ কেজি), টিএসপি (মাদা প্রতি ৩০ গ্রাম), ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ২০ গ্রাম), সমুদয় ম্যাগনেসিয়াম (মাদা প্রতি ৫ গ্রাম) চারা রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর ১ম বার ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম), ৩০-৩৫ দিন পর ২য় বার, ৫০-৫৫ দিন পর ৩য় বার ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম
শতকপ্রতিসার
কম্পোস্ট
৮০ কেজি
ইউরিয়া
৭০০ গ্রাম
টিএসপি
৭০০ গ্রাম
পটাশ
৬০০ গ্রাম
জিপসাম
৪০০ গ্রাম
চিচিঙ্গা চাষে পোকামাকড়ঃ
রেড পামকিন বিটল-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সুড়ঙ্গকারী পোকা-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
জাব পোকা-হলুদ রং এর আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করুন।আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার / ২মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ফলের মাছি পোকা-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
চিচিঙ্গা চাষে রোগবালাইঃ
ডাউনি মিলডিউ রোগ-ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ( যেমনঃ রিডোমিল গোল্ড ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে যেতে পারে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
পাতায় দাগ রোগ-কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক ( যেমনঃ ডিলাইট ২০ গ্রাম) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে যেতে পারে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
চিচিঙ্গার পাতা কুঁকড়ানো রোগ-বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ১০ মি.লি. ২ মুখ ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
চিচিঙ্গা চাষে সতর্কতাঃ
বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলুন। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যাবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করুন। বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যাবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না।
চিচিঙ্গা ফসল সংগ্রহ ও ফলন:
চারা গজানোর ৬০-৭০ দিন পর চিচিঙ্গার গাছ ফল দিতে থাকে। স্ত্রীফুলের পরাগায়নের ১০-১৩ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুই আড়াই মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে চিচিঙ্গার হেক্টর প্রতি ফলন ২০-২৫ টন (৮০-১০০ কেজি/শতাংশ)
চিচিঙ্গা সংরক্ষনঃ
ঠান্ডা ও বাতাস চলাচল করা জায়গাতে ফল ঘষা বা চাপ খায় না এমন ভাবে সংরক্ষণ করুন। বীজ বেশিদিন সংরক্ষণ করতে চাইলে নিমের তেল মিশিয়ে রাখতে পারেন। কিছুদিন পর পর বীজ হালকা রোদে শুকিয়ে নিবেন।
পটল চাষে সফলতা নিয়ে আজকের আলোচনা। পটল একটি জনপ্রিয় উচ্চমূল্য সবজি। পটল খরিপ মৌসুমের সবজি হলেও বর্তমানে সারা বছর ধরেই পাওয়া যায়। গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে বাজারে যখন অন্যান্য সবজি কম পাওয়া যায় তখন পটল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের জলবায়ু ও আবহাওয়া পটল চাষের উপযোগী। দেশের সকল এলাকাতেই পটল চাষ করা সম্ভব।
পটল
পটল চাষে সফলতা পাবেন যেভাবে
যেভাবে পটল চাষে শতভাগ সফলতা পাওয়া যাবে:
পটলের জাত নির্বাচন:
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পটলের দুটি জাত আবিষ্কার করেছে। জাত দুটো উচ্চ ফলনশীল ও রোগবালাই সহ্য করতে পারে সেগুলো হলো ‘বারি পটল-১’ ও ‘বারি পটল-২’। হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০ থেকে ৩৮ টন।
বারি পটল-১:
আকার: ফল ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি লম্বা, বেড় প্রায় ১.৫ ইঞ্চি।
ওজন : প্রায় ৫৫ গ্রাম।
ফলন: প্রতি গাছে সর্বোচ্চ ২৪০টি ফল ধরে, যার মোট ওজন প্রায় ১০ কেজি। একর প্রতি ফলন: ১২১৪৫ কেজি বা প্রতি শতাংশে ১২০ কেজি।
পটল
বারি পটল-২:
আকার: ফল ৩.৫ থেকে ৪ ইঞ্চি লম্বা, বেড় ১.৫ থেকে ১.৭৫ ইঞ্চি।
ওজন: প্রায় ৫০ গ্রাম।
ফল: প্রতি গাছে সর্বোচ্চ ৩৮০ টি ফল ধরে, যার মোট ওজন ১৪ কেজি।
একর প্রতি ফলন: ১৫,৩৮৫ কেজি বা প্রতি শতাংশে ১৫০ কেজি।
পটলের বংশবিস্তার:
এটি কাণ্ড এবং টিউবারের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। শাখা কলমের ক্ষেত্রে পরিপক্ব কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। এদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাণ্ড মরে গেলেও শিকড় জীবিত থাকে। ফলে এই শিকড় থেকেই আবার গাছ জন্মে। রোপণের আগে পটোলের শিকড় গজিয়ে নিলে বেশি ভালো হয়।
পটল
পটল চাষের জন্য জলবায়ু ও মাটি:
উষ্ণ ও আদ্র জলবায়ু পটল চাষের জন্য বেশি তাপমাত্রা ও সূর্যালোকের প্রয়োজন। বন্যামুক্ত ও পানি জমে না এমন বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি পটল চাষের জন্য ভাল। নদীর তীরে পলিযুক্ত মাটিতেও পটল চাষ করা যায়।
পটল রোপণের সময়:
অক্টোবর থেকে নভেম্বর অথবা ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পটোল রোপণের উপযুক্ত সময়। পটোল চাষের কথা চিন্তা করলে অক্টোবর মাসের আগেই জমি তৈরি করতে হবে। মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকলে শাখা কলম শুকিয়ে মারা যায়।
পটল চাষের জন্য জমি তৈরি ও চারা রোপণ:
প্রথমে মাটি ভালো করে চাষ দিয়ে প্রস্তুত করে নেওয়া উচিত। জমিকে ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমান করে নিতে হবে। বেড পদ্ধতিতে পটল চাষ করলে ফলন ভালো হয় এবং বর্ষাকালে ক্ষেত নষ্ট হয় না। সাধারণত একটি বেড ১.০-১.৫ মিটার চওড়া হয়। বেডের মাঝামাঝি এক মিটার থেকে দেড় মিটার বা দু’হাত থেকে তিন হাত পর পর মাদায় চারা রোপণ করতে হয়।
এক বেড থেকে আর এক বেডের মাঝে ৭৫ সেমি. নালা রাখতে হবে। মাদা বা পিট তৈরি মাদা বা পিটের আকার- দৈর্ঘ্য- ৫০ সেমি. প্রস্থ- ৫০ সেমি. গভীরতা- ৪০ সেমি. নালা- ৭৫ সেমি. মাদা থেকে মাদার দূরত্ব-১.০-১.৫ মিটার মাদায় গাছের দূরত্ব-৭.০-১০.০ সেমি. গভীরতা-৫০ সেমি. মোথার সংখ্যা ১০,০০০/হেক্টর স্ত্রী গাছপ্রতি ১০টি স্ত্রী গাছের জন্য ১টি পুরুষ গাছ সুষ্ঠু পরাগায়নের ক্ষেত্রে ১০% পুরুষ জাতের গাছ লাগানো উচিত এবং এসব গাছ ক্ষেতের সব অংশে সমানভাবে ছড়িয়ে লাগানো উচিত।
গোবর বা আবর্জনা সার ভালোভাবে পচানো দরকার। পটল দীর্ঘমেয়াদি সবজি ফসল, এ জন্য মে মাস থেকে ফসল সংগ্রহের পর প্রতি মাসে হেক্টরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি এবং ১৪ কেজি এমপি সার উপরি প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এতে ফলন বেশি হবে।
পটল চাষে সার প্রয়োগ:
মাদাপ্রতি ১.০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম খৈল, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৭০ গ্রাম টিএসপি, ১৩০ গ্রাম এমওপি, ২০ গ্রাম বোরন সার এবং ১৫০ গ্রাম জিপসাম সার রোপণের সময় প্রয়োগ করা হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফুল ধরা কমে গেলে সে ক্ষেত্রে মাদাপ্রতি ৫০০ গ্রাম গোবর সার, ৭০ গ্রাম ইউরিয়া, ৯০ গ্রাম টিএসপি, ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করলে ফলন অনেক বেড়ে যায়।
পটল চাষে ফসল সংগ্রহ:
কচি অবস্থায় সকাল অথবা বিকালে পটল সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত জাতভেদে ফুল ফোটার ১০-১২ দিনের মধ্যে পটল সংগ্রহের উপযোগী হয়।
এ ছাড়া পটলের পোকামাকড় রোগ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে হবে।
লেবু চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজকের আলোচনা।লেবু চাষ করা হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। লেবু সাইট্রাস জাতীয় ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ একটি ফল। খাবার টেবিলে এবং সালাদে লেবু ছাড়া তো ভাবাই যায় না। এর স্বাদ বৃদ্ধির ভূমিকা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিশেষ খাদ্যগুণ। বিশেষ করে পাতি লেবুকে ‘সি’ ভিটামিনের ডিপো বলা হয়ে থাকে। গরমে ঠাণ্ডা এক গ্লাস লেবুর সরবত মুহূর্তে ক্লান্তি দূর করে। ছোট-বড় সবার জন্য লেবু এক আশ্চর্য গুণসম্পন্ন সবজি এবং ভেষজ। আমাদের দেশে শতকরা ৯১ জন লোক ভিটামিন ‘সি’র অভাবে ভুগছেন। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক গড়ে ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ খাওয়া দরকার। ভিটামিন ’সি’ সমৃদ্ধ ফলের মধ্যে লেবুই একমাত্র ফল যা সারা বছর কম বেশি পাওয়া যায়।
লেবু চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা
পুষ্টি মূল্য:
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ।
ভেষজ গুণ:
লেবুর রস মধু বা আদা বা লবণের সাথে মিশিয়ে পান করলে ঠাণ্ডা ও সর্দি কাশি উপশম হয়।
উপযুক্ত জমি ও মাটি:
হালকা দোআঁশ ও নিকাশ সম্পন্ন মধ্যম অম্লীয় মাটিতে লেবু ভালো হয়।
লেবুর জাত পরিচিতি:
লেবুর অনেক জাত আছে। তন্মধ্যে পাতিলেবু, কাগজি লেবু, এলাচি লেবু, সিডলেস লেবু, সরবতি লেবু, বাতাবিলেবু, কমলালেবু ও মাল্টা লেবু উল্লেখযোগ্য। তবে কমলালেবু পাহাড়ি এলাকায় জন্মে। বাকিগুলো সমভূমিতেই জন্মে। এছাড়াও নিম্নে আরও কিছু জাতের কথা উল্লেখ করা হলো-
বারি লেবু-১ (এলাচি লেবু):
উচ্চ ফলনশীল লেবু বারি লেবু-১। ঘ্রাণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। গাছ আকারে বড়।পাতা বড় ও প্রশস্ত। পরিচর্যা পেলে গাছ বছরে দু’বার ফল দেয়। জুলাই-আগস্ট মাসে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। পূর্ণবয়স্ক গাছ ১৫০টি পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে। আকারে বড়, ডিম্বাকৃতি এবং প্রতিটি ফলের গড় ওজন ১৯৫ থেকে ২৬০ গ্রাম। বৃহত্তর সিলেট এবং আরও অনেক এলাকায় এলাচি লেবুর খোসা খাওয়া হয়।
বারি লেবু-২:
বারি লেবু-২ উচ্চ ফলনশীল জাত। মধ্যম আকৃতির ও ঝোপের মতো গাছ। সারা বছর প্রচুর ফল দেয়। ফল গোলাকার, মধ্যম ওজনের। ত্বক মসৃণ এবং বীজের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এই লেবু সারা দেশেই চাষাবাদের উপযোগী।
বারি লেবু-৩:
একটি দেরীতে হওয়া (নাবি) জাত বারি লেবু-৩। গাছ ও পাতা ছোট আকৃতির। ফল গোলাকার ও ছোট। ত্বক খুবই মসৃণ, খোসা পাতলা এবং বীজের সংখ্যাও কম ১৮-২২টি। রসের পরিমাণ খুব বেশি (৩৭.৭%)। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। সার ও পানির ব্যবস্থা করলে বছরে দু’বার ফল পাওয়া যায়। সারা দেশেই চাষাবাদের জন্য উপযোগী।
লেবুর চারা রোপণ:
গুটি কলম ও কাটিং তৈরি করে মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য আশ্বিন মাসে ২.৫ মিটার দূরে দূরে রোপণ করা হয়। মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য আশ্বিন মাস চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত।
সার ব্যবস্থাপনা: প্রতি গাছে টিএসপি সার ৪০০ গ্রাম, এমওপি সার ৪০০ গ্রাম, ইউরিয়া সার ৫০০ গ্রাম ও গোবর ১৫ কেজি প্রয়োগ করতে হয়। সার তিনভাগে যার প্রথম কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে, ২য় কিস্তি মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন মাসে এবং ৩য় কিস্তি মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য আষাঢ় মাসে প্রয়োগ করতে হয়।
অঙ্গ ছাঁটাই: প্রতি বছর মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে গাছের অবাঞ্ছিত শাখা ছাঁটাই করতে হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা: খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ দেওয়া দরকার। পানি যাতে না জমে থাকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
লেবুর পোকা মাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
লেবুর প্রজাপতি পোকা:
ক্ষতির ধরন:
এ পোকার কীড়া পাতার কিনারা থেকে খেতে শুরু করে এবং সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে।
প্রতিকার:
ডিম ও কীড়াযুক্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটির নীচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হয়। আক্রমণ বেশি হলে ডাইমেক্রন ১০০ ইসি ১ মিলি অথবা সেভিন ৮৫ এসপি ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হয়।
লেবুর লাল ক্ষুদ্র মাকড়:
লক্ষণ:
মাইট লেবু গাছের পাতা ও ফলের সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ফলের গায়ে সাদা আবরণ দেখা যায়। পাতার নীচের দিকে লক্ষ্য করলে ক্ষুদ্র মাইট চলাচল করতে দেখা যায়।
প্রতিকার:
মাকড়সহ আক্রান্ত পাতা তুলে ধ্বংস করা। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ইথিয়ন ৪৬.৫ তরল বা নিউরন ৫০০ তরল মিশিয়ে লেবুর পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করা।
লেবুর ফসল সংগ্রহ:
ফল পূর্ণতা প্রাপ্তি হলে সবুজ থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করতে হবে।
লেবুর ব্যবহার:
লেবুর কদর সাধারণত তার রসের জন্য। এর শাঁস এবং খোসাও ব্যবহার হয় বিভিন্ন কাজে। কিন্তু প্রধানত সর্বত্র লেবুর রসই ব্যবহৃত হয়। লেবু পছন্দ করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
লেবুর অনেক আছে গুণ। ১০০ গ্রাম লেবুতে প্রায় ৫৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি বা এসকরিক এসিড পাওয়া যায়। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধকারী কোষের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। শরীরের কোনও অংশ কেটে গেলে বা ক্ষত হলে দ্রুতগতিতে কোলাজেন কোষ উপাদান তৈরি করে ক্ষত নিরাময়েও সাহায্য করে এই ভিটামিন সি।
লেবুর সাইট্রিক এসিড ক্যালসিয়াম নির্গমন হ্রাস করে পাথুরি রোগ প্রতিহত করতে পারে। জ্বরে কোনকিছুই যখন খেতে ভালো লাগে না তখন একমাত্র লেবুই ভরসা। লেবু হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। রূপচর্চায় লেবুর ব্যবহার অনেক আগে থেকেই।
কাপড়ে দাগ পড়লে লেবুর রস দিয়ে ঘষলে দাগ উঠে যায়। বয়সজনিত মুখের দাগ সারাতে লেবুর রস কার্যকরী। লেবুর রস ব্যবহারে মুখের ব্রণও সারে। লেবু দেহের ওজন কমায়। লেবুর মধ্যে এমন পদার্থ আছে যা কিনা শরীরের অতিরিক্ত মেদকে জ্বালিয়ে দেয়। ফলে রোগ সংক্রমণও কমে যায়।
বাড়ির ছাদ বা টবে লেবু চাষ:
বাড়ির ছাদ এমনকি বারান্দায় ছোট টবেও এর চাষ সম্ভব। দুইভাগ দোঁ-আশ বা বেলে দোঁ-আশ মাটির সাথে একভাগ গোবর মিশাতে হবে। একটি বার ইঞ্চি টবের জন্য ৫০ গ্রাম টিএসপি, ৫০ গ্রাম পটাশ, ১০ গ্রাম চুন এবং ১৫০ গ্রাম হাড়ের গুড়া একত্রে মিশিয়ে ১২-১৫ দিন রেখে দিতে হবে। তারপর একটি লেবুর কলমের চারা ঐ টবে রোপণ করতে হবে। লেবুতে সাধারণত ডাইব্যাক নামক এক ধরনের রোগ দেখা যায়। তাই কলমের চারাটি যাতে রোগাক্রান্ত না থাকে তা দেখে নিতে হবে। লেবু জাতীয় সকল গাছেই সাধারণত পানি খুব কম প্রয়োজন হয়। চারা লাগানোর প্রথমদিকে পানি আরও কম দিতে হয়।
লেবুর পরিচর্যা:
চারা লাগানোর পর প্রথম ২-৩ মাস পানি দেওয়া এবং আগাছা পরিষ্কার করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে হবে না। গাছ একটু বড় হলে ২০ দিন অন্তর অন্তর সরিষার খৈল পচা পানি হালকা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে লেবু গাছে ফল ধরবে। বর্ষা আসার পূর্বে সাতদিন অন্তর অন্তর কয়েকবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে ভাল হয়।
এ ছাড়াও বছরে তিন থেকে চার বার কোন ভাল কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। তবে লেবু গাছে ফুল থাকা অবস্থাতে কীটনাশক স্প্রে না করাই ভাল। গাছ লাগানোর দুই বছর পর থেকে প্রতি বছর বর্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে টবের গা ঘেঁষে দুই ইঞ্চি পরিমাণ প্রস্থে এবং ছয় থেকে আট ইঞ্চি গভীর করে মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিতে হবে। আমাদের দেশের আবহাওয়া লেবু চাষের উপযোগী। বিশেষ করে টবে লেবুর ফলন খুব ভাল হয় এবং অতি সহজেই।
লেবুতে কলম:
লেবুতে বিভিন্ন ধরনের কলম হলেও সাধারণত গুটি কলমই বেশি জনপ্রিয়। খুব সহজেই লেবুর গুটিকলম করা যায়। গুটিকলম করতে হয় বর্ষাকালে। গুটিকলমের জন্য একটি একবছর বয়সী পেন্সিলের মত মোটা ডাল নির্বাচন করতে হবে। ডালের ডগা থেকে এক ফুট নিচে একটা গাঁটের গোঁড়ায় এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাল ডাল থেকে তুলতে হবে। কাঠের মধ্যে যে পিচ্ছিল পদার্থ বিদ্যমান তা একটি শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলতে হবে।
পরবর্তীতে গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ঐ জায়গা ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। তবে মাটি অবশ্যই কাদামাটির মত নরম করে নিতে হবে। একটি মোটা পলিথিন দিয়ে ঐ জায়গাটুকু ভালোভাবে ঢেকে দুই দিকের মাথা সুতলি দিয়ে শক্ত করে এমনভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন ভেতরে আলো-বাতাস না ঢুকে। এক মাসের মধ্যেই শিকড় গজিয়ে যায়। কিন্তু কাটার উপযোগী হয় আরও এক মাস পর।
বায়োফ্লকে মাছ চাষে কম খরচে অধিক লাভ , কমছে ভূমি, বাড়ছে মানুষ। ভূমি আর জনসংখ্যার এই ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্কের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানুষের ক্ষুধা, কমছে ভূমির সক্ষমতা। ‘স্বল্প জমিতে অধিক উৎপাদন’ সফল করতে গিয়ে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানকে। বাড়তি মানুষের বাস্তুভিটার চাপ সামলাতে গিয়ে বন-জঙ্গল তো বহু আগেই কাটা গেছে; আধুনিক পৃথিবীতে হারাতে বসেছে গ্রামের সংজ্ঞায়নও। ভরাট হয়ে যাচ্ছে ফসলী জমি, খেলার মাঠ, খাল-বিল-পুকুর! রূপকথায় ঠাঁই পেতেছে গোলায় ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের সোনালী সময়টাও।
বায়োফ্লকে মাছ চাষে কম খরচে অধিক লাভ
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
তবে, অধুনা যুগের কৃষি সংকটকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কার্যকর একটি উপায় হতে পারে বায়োফ্লক। মাছ চাষের জন্য পুকুর লাগবেই এমন কোনও কথা নেই। তার জন্য চাই কেবল উপযুক্ত জলাধার। বায়োফ্লকের ব্যাতিক্রমী এই ধারণাকে খাটিয়েই মাছ চাষ এখন ঢুকে গেছে মানুষের ঘরে। নির্দিষ্ট কলাকৌশল আর প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ঘরের ভিতর চৌবাচ্চাতে চাষ করা যাচ্ছে মাছ।
একদিকে খরচ কমে যাচ্ছে তিন ভাগের এক ভাগ, আরেকদিকে উৎপাদনও হচ্ছে ২০ গুণ বেশি। বাড়ির ভেতরে এ্যাকুরিয়ামে শখের বশে আমরা যে মাছ পালন করি, সেই এ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতিরই উন্নত সংস্করণ হচ্ছে নতুন এই প্রযুক্তি। ‘বায়োফ্লক’ ব্যবহার করে অল্প জমিতে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব।
প্রযুক্তিটির জনক ইজরায়েলি বিজ্ঞানী ইয়ান এভনিমেলেচ। এবার বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক, কি এই বায়োফ্লক আর কিভাবেই বা এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে সম্ভব অধিক লাভবান হওয়া।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
বায়ো শব্দটি এসেছে গ্রীক বায়োস থেকে, যার অর্থ জীবন। আর ফ্লক অর্থ হচ্ছে আলতোভাবে লেগে থাকা কণার সমষ্টি। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে জৈব বর্জ্যের পুষ্টি থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য খাবার তৈরি করা হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বায়োফ্লক প্রযুক্তি মাছ চাষের একটি টেকসই এবং পরিবেশগত ভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চৌবাচ্চার পানিতে ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ও শৈবালের সমম্বয়ে পাতলা একটি আস্তরণ তৈরি হয়।
যা পানিকে ফিল্টার করে পানি থেকে নাইট্রোজেন জাতীয় ক্ষতিকর উপাদানগুলি শোষণ করে নেয় এবং এর প্রোটিন সমৃদ্ধ যে উপাদান গুলো থাকে সেগুলো মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অনুজীব মুলত দুটি প্রধান ভূমিকা পালন করে-
অণুজীব পানিতে বিদ্যমান নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ যৌগ গুলোকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিনে রূপান্তর করার মাধ্যমে পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখে।
এই প্রযুক্তি খাদ্য রূপান্তর হার এবং মাছ চাষে খাদ্য ব্যয় কমিয়ে চাষের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি করে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক এই ব্যাতিক্রমী প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করতে গেলে অবশ্যই জানতে হবে কার্যকর উপায়ে ফ্লক তৈরির কলাকৌশল। আর এই ফ্লক তৈরিতে লাগবে চৌবাচ্চা বা ট্যাংক বা হাউজ, লোহার খাঁচা, ত্রিপল, আউটলেট, টিডিএস মিটার, পিএইচ মিটার, অ্যামোনিয়াম টেস্ট কিড, অক্সিজেনের জন্য মটর, বিদ্যুৎ, মাছের পোনা, খাদ্য ও প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি।
বায়োফ্লকের জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের ট্যাংকই চাইলে তৈরি করা যায়। ইট সিমেন্ট দিয়ে কিংবা স্টিলের পাত দিয়ে কিভাবে স্থায়ী ট্যাংক তৈরি করতে হয় সেটা সবাই জানেন। এখানে আমরা জানবো কিভাবে অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচে ত্রিপল দিয়ে অস্থায়ী ট্যাংক তৈরি করতে হয়। এর জন্য প্রথমে গ্রেড রড দিয়ে ট্যাংকের বৃত্তাকার খাঁচাটি তৈরি করতে হবে। তারপর যে স্থানে ট্যাংকটি স্থাপন করা হবে সেই জায়গাতে খাঁচার পরিধির সমান করে সিসি ঢালাই দিতে হবে। বৃত্তের ঠিক কেন্দ্রে পানির একটি আউটলেট পাইপ স্থাপন করতে হবে।
এরপর খাঁচাটিকে ঢালাই মেঝের উপর স্থাপন করে মাটিতে গেঁথে দিতে হবে। মেঝের মাটি শক্ত ও সমান হলে ঢালাইয়ের পরিবর্তে পরিধির সমান করে পুরু পলিথিন বিছিয়েও মেঝে প্রস্তুত করা যায়। এরপর উন্নতমানের তারপুলিন বা ত্রিপল দিয়ে সম্পূর্ণ খাঁচাটি ঢেকে দিতে হবে। তার উপর পুরু পলিথিন দিয়ে আচ্ছাদিত করে তাতে পানি মজুদ করতে হবে।
জানা জরুরী ৩০০০ লিটার পানি ধারনের জন্য ট্যাংকের সাইজ হবে ৬ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ৫০০০ লিটারের জন্য ৮ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ৭৫০০ লিটারের জন্য ১০ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ১০০০০ লিটারের জন্য ১৩ ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা।
তারপর ট্যাংকের সঙ্গে এয়ার পাম্পের সংযোগ ঘটাতে হবে পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য। প্রতি ১০ হাজার লিটার পানির জন্য ৭০ থেকে ৮০ ওয়াটের এয়ার পাম্প লাগবে; সেইসঙ্গে ৮ থেকে ১০টি এয়ার স্টোন প্রয়োজন হবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
স্থায়ী বা অস্থায়ী; যেমন ট্যাংকই হোক না কেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের পরবর্তী ধাপ শুরু হয় চাষের ট্যাংকে পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। প্রথমে ট্যাংক ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এর পর নির্বাচিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পানি প্রবেশ করাতে হবে। এরপর পানিতে আয়রনের মাত্রা ০.২ পিপিএম এর বেশি হলে পানি থেকে আয়রন দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। আয়রন দূর করার জন্য প্রতি টন পানিতে ২৫- ৩০ পিপিএম হারে ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগের পর ১০ – ১২ ঘন্টা একটানা বাতাস সরবরাহ করতে হবে।
তারপর ৫০ পিপিএম হারে ফিটকিরি প্রয়োগ করে আরও ১২ ঘন্টা পানিতে অনবরত বাতাস সরবরাহ করতে হবে। ২৪ ঘন্টা পর পানিতে ১০০ হারে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ( CaCO3) চুন প্রয়োগ করে বাতাস সরবরাহ নিয়মিত করতে হবে। এরপর নির্বাচিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পানি প্রবেশ করাতে হবে। এসময় পানির যে গুনাবলীর দিকে নজর রাখতে হবে সেগুলো হলো-
তাপমাত্রা থাকতে হবে ২৫ – ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে
পানির রং – সবুজ, হালকা সবুজ, বাদামী হলে চলবে
দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান প্রতি লিটারে ৭- ৮ মিলিগ্রাম থাকতে হবে
পিএইচ হতে হবে ৭.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে
ক্ষারত্ব থাকতে হবে প্রতি লিটারে ৫০ – ১২০ মিলিগ্রাম
খরতা প্রতি লিটারে ৬০ – ১৫০ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম প্রতি লিটারে ৪ – ১৬০ মিলিগ্রাম
অ্যামোনিয়া প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম
নাইট্রাইট প্রতি লিটারে ০.১ – ০.২ মিলিগ্রাম
নাইট্রেট প্রতি লিটারে ০ – ৩ মিলিগ্রাম
ফসফরাস প্রতি লিটারে ০.১ – ৩ মিলিগ্রাম
হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S) প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম
আয়রন প্রতি লিটারে০.১ – ০.২ মিলিগ্রাম
পানির স্বচ্ছতা ২৫ – ৩৫ সে.মি.
পানির গভীরতা – ৩ থেকে ৪ ফুট
ফলকের ঘনত্ব – ৩০০ গ্রাম / টন
টিডিএস প্রতি লিটারে ১৪০০০ – ১৮০০০ মিলিগ্রাম
লবণাক্ততা – ৩ – ৫ পিপিটি
এ তো গেল মাছের জন্য জলাধার নির্মাণের খেলা। এবার তার বাঁচা ও বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত জলজ পরিবেশ, অর্থাৎ ফ্লক তৈরির পালা। পানিতে ফ্লক তৈরির জন্য প্রথমে চাষ ট্যাংকের ১২ ভাগের ১ ভাগ পানি নিয়ে সেই পানিতে ১০০০ পিপিএম হারে আয়োডিনবিহীন লবণ প্রয়োগ করতে হবে। লবণ প্রয়োগের পর টিডিএস পরীক্ষা করে নিতে হবে। বায়োফ্লকের জন্য ১৪০০ – ১৮০০ পিপিএম, টিডিএস থাকা ভাল।
যদি লবণ প্রয়োগের পর কাঙ্খিত টিডিএস পাওয়া না যায়, তা হলে কম পরিমাণ লবণ প্রয়োগ করে আদর্শ মাত্রায় টিডিএস রাখতে হবে। এরপর প্রথম ডোজে ৫ পিপিএম প্রেবায়োটিক, ৫০ পিপিএম চিটাগুড়, ৫ পিপিএম ইস্ট, পানি প্রতি টনের জন্য ১ লিটার, একটি প্লাস্টিকের বালতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে ৮- ১০ ঘন্টা কালচার করে প্রয়োগ করতে হবে। ২য় দিন থেকে ১ পিপিএম প্রোবায়োটিক, ৫ পিপিএম চিটাগুড়, ১ পিপিএম ইস্ট, প্রতি টনের জন্য ১ লিটার পানি দিয়ে কালচার করে প্রতি দিন প্রয়োগ করতে হবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
পানিতে যথাযথ পরিমাণ ফ্লক তৈরি হলো কিনা সেটা বুঝতে কিছু ব্যাপার নজরে রাখতে হবে। যেমন-
পানির রং যেন সবুজ বা বাদামী দেখায়।
পানিতে যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ কণা দেখা যায়।
পানির অ্যামোনিয়া পরীক্ষা করলে যেন পানি অ্যামোনিয়া মুক্ত দেখায়।
প্রতি লিটার পানিতে ফ্লকের ঘনত্ব যেন ০.৩ গ্রাম পাওয়া যায়।
ক্ষুদেপানা দেওয়ার পর তাদের যেন ঠিকঠাক বংশবিস্তার হয়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
এইভাবে বায়োফ্লক তৈরি করে চাষ করা যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ । কিন্তু আমাদের দেশে সচরাচর যেসব মাছ চাষ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা, চিংড়ি প্রভৃতি। তবে, যারা বায়োফ্লক প্রযুক্তিটি প্রথমবারের মত ব্যবহার করতে যাচ্ছেন তারা অবশ্যই প্রথমে তেলাপিয়া, শিং ও মাগুর মাছ দিয়ে চাষ শুরু করবেন। অন্যান্য দেশে অবশ্য তেলাপিয়া ও চিংড়িই মূলত বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। বায়োফ্লকে চাষকৃত মাছের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছটির নাম চিংড়ি।
বায়োফ্লকে পুকুরের চেয়ে মাছের খাদ্য খরচ ৩০ শতাংশ কম লাগে। মাছ চাষে মুলত শতকরা ৬০ ভাগ খরচই খাবারের জন্য ব্যয় হয়। এই পদ্ধতিতে সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া ট্যাংকেই অণুজীব প্রোটিন তৈরি করে, তাই এ পদ্ধতিতে অন্যান্য সিস্টেমের চেয়ে অনেক কম খাবার লাগে। ফলে চাষের খরচ কমে যায় এবং লাভ হয় বেশি। তাছাড়া পুকুরের সমপরিমাণ জায়গায় বায়োফ্লকে অন্তত ২০ গুণ বেশি মাছ চাষ করা যায়। অর্থাৎ কম জায়গা ব্যবহার করে অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন সম্ভব এই পদ্ধতিতে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
বায়োফ্লকে মাছের রোগবালাই হয় খুবই কম। এই পদ্ধতিতে প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপকারি ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া) ব্যবহার করা হয় বলে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে পুরো সিস্টেমকে প্রদান করা সম্ভব হয় উচ্চ বায়োসিকিউরিটি। ফ্লকে ব্যবহৃত এসব উপকারি ব্যাকটেরিয়া মাছের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে বৃদ্ধি পেতে বাধা প্রদান করে
ফলে ঐসব ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ থেকে রক্ষা পায় মাছ। তাই উন্নত এই প্রযুক্তিতে মৎস্য খামারকে রক্ষা করা সম্ভব হয় রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে। শুধু কি তাই? এটি স্বীকৃতভাবে পরিবেশবান্ধব একটি মাছ চাষ পদ্ধতি। কারণ এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন নেই বললেই চলে।
জমি না থাকলেও মাশরুম চাষে হতে পারেন সফল , প্রকৃতি আমাদের উদ্ভিদ আকারে অনেক ধরনের খাদ্য উপাদান দিয়েছে। মাশরুম তার মধ্যে অন্যতম। খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ অত্যন্ত স্বাস্থ্যপ্রদ একটি খাবার ছত্রাক জাতীয় এই উদ্ভিদটি।
মাশরুম চাষে হতে পারেন সফল
মাশরুমের পুষ্টিমান তুলনামূলকভাবে অত্যধিক এবং এর প্রোটিন অতি উন্নতমানের ,যা মানব দেহের জন্য অতিশয় দরকারি। একটি পরিপূর্ণ প্রোটিনের পূর্বশর্ত হলো মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ৯টি অ্যাসিডের উপস্থিতি। মাশরুমে অতীব প্রয়োজনীয় এই ৯টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের সবকটিই বিদ্যমান মাশরুমের মধ্যে। পাশাপাশি এর আছে নানা ঔষধি গুণাগুণ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের মতো জটিল বহু রোগের মহৌষধ প্রাচীন এই উদ্ভিদটি।
যে কারণে স্বাস্থ্যসচেতন লোকদের খাবারের তালিকায় একেবারে শীর্ষে থাকে মাশরুমের নাম। মাত্র বছর কয়েক আগেও একে বিদেশি একটি খাবার মনে করা হলেও স্বাদ, পুষ্টি ও ঔষধিগুণের জন্য আমাদের দেশেও দিন দিন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বহু ভেষজ গুণসম্পন্ন খাবারটি। দেশেই এখন চাষ হচ্ছে কয়েক প্রজাতির উন্নত জাতের মাশরুম।
শুধু কি পুষ্টিগুণই মাশরুমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির একমাত্র কারণ? বাংলাদেশে জমির অপ্রতুলতা, বেকারত্ব, পুষ্টিহীনতা, মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বহুমুখী বিষয় বিবেচনায় সম্ভাবনাময় একটি ফসল এই মাশরুম । এদেশের আবহাওয়াও মাশরুম চাষের জন্য অত্যান্ত উপযোগী। ছাত্রাক জাতীয় এই উদ্ভিদটি চাষের জন্য কোনো উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় দেশে মাশরুম উৎপাদন যতই বাড়ানো হোক না কেন তাতে কোনো ফসলেরই উৎপাদন কমার সম্ভাবনা নেই।
এক প্রকারের ছত্রাক হওয়ায় অন্যান্য উদ্ভিদের মতো নিজের খাবার তৈরির জন্য সূর্যের আলোর প্র্যোজন পড়ে না মাশরুমের। ফলে ঘরের ভেতরেও এর চাষ করা যায়। যার মোটেই চাষের জমি নেই তিনিও বসত ঘরের পাশের অব্যবহৃত জায়গায় অনেক পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করতে পারেন। এজন্য ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষই চাষ করতে পারেন এটি। গ্রাম-গঞ্জে, শহরে এমনকি অতিমাত্রায় বিলাসিদের প্রাসাদেও সহজেই স্থান করে নিতে পারে খাবারটি।
মাশরুম চাষ করতে বেশি টাকা খরচ করতে হয়না। ছোট একটু জায়গাতেও এর চাষ করা সম্ভব। সঠিক ভাবে মাশরুম উৎপাদন পদ্ধতি জানা থাকলে এই চাষ এবং ব্যবসা করে প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব। কেননা দেশের বাজারে মাশরুমের চাহিদা এখন অনেক বেশি।
তাই কেউ যদি একজন কৃষিপ্রেমী হয়ে থাকেন এবং কম টাকা বিনিয়োগ করে লাভজনক ব্যবসা শুরু করতে চায়, মাশরুম চাষ হতে পারে তার জন্য ভালো একটি অপশন।
মাশরুম প্রকৃত অর্থে কোন উদ্ভিদ বা বনস্পতি গাছ নয়। যদিও সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে একে উদ্ভিদজাতীয় প্রজাতি হিসাবেই ধরা হয়ে থাকে কিংবা ধরা যায়। অনেক সময় কিছু স্যাঁতসেঁতে ছায়াযুক্ত স্থানে ছাতার আকৃতির সাদা ও বাদামী রঙের এক ধরণের ছত্রাক জন্মাতে দেখা যায়। এগুলোকেই মাশরুম বলা হয়ে থাকে, যদিও এইগুলো খাওয়ার যোগ্য হয়না। খাওয়ার জন্য যে মাশরুম রয়েছে সেটা আলাদা এবং সেই খাওয়ার মাশরুম বিশেষভাবে চাষ করেই উৎপাদন করতে হয়।
বর্তমান সময়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে মাশরুমের অনেক চাহিদা রয়েছে, বিশেষ করে বিদেশি বাজারে এর চাহিদা প্রচুর। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, চাইনিজ-ইতালিয়ানসহ বিভিন্ন ডিসে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করার জন্য মাশরুমের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই গ্রাহকদের খাওয়ার উপযোগী করে তোলার জন্য এবং গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করার জন্য আলাদা রকমের মাশরুম উৎপাদন করা হয়।
পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির ছত্রাক দেখতে পাওয়া যায় । সেগুলোর মধ্যে যেসব ছত্রাক মানুষের খাওয়ার জন্য উপযোগী, বিষমুক্ত এবং পুষ্টিকর সেগুলোকেই মাশরুমের শ্রেণীতে ধরা হয়ে থাকে। সে হিসেবে ওয়েস্টার, মিল্কি, বাটন, শীতাকে, পেডিস্ট্রও নামক মাত্র পাঁচ প্রজাতির মাশরুম কৃত্রিমভাবে চাষের উপযোগী। আমাদের দেশের জলবায়ুতে তিনটি প্রজাতিকে অধিক উপযুক্ত মানা হয়ে থাকে এবং সেগুলো হলো ওয়েস্টার মাশরুম, মিল্কি মাশরুম এবং বাটন মাশরুম।
মাশরুমচাষেপ্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ
এমনিতে চাইলে মাশরুমের চাষ যে কেউ চাইলে নিজের ঘর থেকেও শুরু করতে পারবেন। এটা একটি অনেক লাভজনক ঘোরোয়া ব্যবসার আইডিয়া। সাধারণত প্রতি বর্গ মিটারে ১০ কেজি মাশরুম চাষ করা যায়। ঘরের ছাদে বা ছায়াযুক্ত কোনো খালি ঘরে মাশরুম উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।
এছাড়া বড় স্তরে এর চাষ শুরু করতে চাইলে জমিতে বা ঘরের বাইরে মাশরুমের চাষ হতে পারে। সেক্ষেত্রে সেখানে কাঠ এবং ছন বা বাঁশের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করে নিতে হবে এবং হাওয়া বাতাস যাতে ঢুকতে না পারে তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারণ সূর্য্যের আলো পড়লে কিংবা বাইরের হাওয়া বাতাস ঢুকলে মাশরুম খারাপ হয়ে যাবে।
মাশরুম চাষেখরচ
কেউ যদি ছোটস্তরে মাশরুমের চাষ শুরু করতে চান তাহলে তার ১৫-৩০ হাজার টাকার প্রয়োজন হবে। আগ্রহী চাষি যদি ঘর থেকে শুরু করেন এবং সেই ঘর গ্রাম এলাকায় হয় তাহলে এক্ষেত্রে খরচ আরও কিছুটা কম হবে।
কারণ মাশরুম চাষ করার জন্য ব্যবহার হওয়া বাঁশ, ছন, গমের ভুসি, শুকনো খড়, কাঠ ইত্যাদি সামগ্রীগুলো গ্রাম এলাকায় সহজেই পাওয়া যায়। এছাড়াও বড়স্তরে মাশরুম উৎপাদন শুরু করতে চাইলে এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে সক্ষমতা অনুযায়ী বিনিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে।
মাশরুমচাষেরক্ষেত্রেপ্রয়োজনীয় সামগ্রী–
১. গমের ভুসি
২. মাশরুম বীজ
৩. খড় ভেজানোর জন্য ড্রাম বা মাটির গামলা
৪. ধানের শুকনো খড়
৫. পলিথিন ব্যাগ
৬. মাশরুম কাটার ছুরি
৭. জলের স্প্রে
কম্পোস্টতৈরিরপদ্ধতি
মাশরুম চাষ করার জন্য প্রথমে কম্পোস্ট খাদ তৈরি করে নেওয়া আবশ্যক।
কেননা এই চাষ সঠিক এবং সফল ভাবে করার জন্য কম্পোস্ট খাদ এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কম্পোস্ট বানানোর জন্য ধানের শুকনো খৈল, গমের ভূসি, শস্যের খৈল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কপোস্ট তৈরি করার জন্য একটি বড় পাত্রে বা ড্রামে ১৫০০ লিটার পানিতে ১.৫ কেজি ফরমালিন এবং ১৫০ গ্রাম বেভিস্টিন মেশাতে হবে। এরপর এক কুইন্টাল এবং ৫০ কেজি গমের ভূষি ও ধানের ভূষি ভিজিয়ে দিয়ে ভালো করে মেশাতে হবে এই মিশ্রনে।
তারপর মিশ্রনটিকে কিছু সময় প্লাস্টিকের ত্রিপাল দিয়ে ভালো করে ঢেকে রাখতে হবে যাতে মিশ্রণটি জীবাণুমুক্ত হয়ে থাকে এবং বাইরের হাওয়া বাতাস ঢুকে রাসায়নের গুণাগুণ নষ্ট করতে না পারে।
মাশরুমেরবীজসংগ্রহ
এমনিতে মাশরুমের বীজ গুলোকে Mushroom Spawnও বলা হয়। আজকাল অনলাইনে বিভিন্ন ই-কমার্স মার্কেটপ্লেসগুলোতে সহজেই মাশরুমের বীজ কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া বীজের দোকান কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মাশরুম বীজ কিনতে পাওয়া যায়। প্রতি কেজি মাশরুম বীজের দাম ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা হতে পারে।
মাশরুমেরবীজরোপণেরপ্রক্রিয়া
ভূষির মিশ্রণ তৈরি করার পর বীজ লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাশরুম রোপন করার আগে ভেজানো ভূষি বাইরের বাতাসে কোনো খোলা জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হয় যাতে ভুষিতে সিক্তভাব না থাকে। এরপর পলিথিন ব্যাগের ভিতরে প্রথমে ভূষি ভরতে হয়। তারপর মাশরুমের বীজ ভালো করে ছড়াতে হয়। এবার আবার ছড়ানো বীজের ওপরে কিছু ভূষি দিয়ে দিতে হবে এবং তার ওপরে মাশরুম এর বীজ আবার ছড়াতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি অন্তত ৪ বার করতে হয়। মাশরুম উৎপাদনের জন্য প্রতি ৩ কেজি ভূষির মিশ্রনে ১০০ গ্রাম বীজ লাগানো যায়। এরপর পলিথিন ব্যাগে ১৫-২০টি ছিদ্র বানিয়ে দিতে হয় যাতে অতিরিক্ত জল ঝরে পড়ে যেতে পারে। যে জায়গায় মাশরুম উৎপাদন করতে চাচ্ছেন সে স্থানে পলিথিন ব্যাগ গুলো রেখে দিতে হয়।
মনে রাখতে হবে, পলিথিন ব্যাগগুলো এমন একটি জায়গায় রাখা দরকার যেখানে হাওয়া বাতাস লাগার সুযোগ অনেক কম। যতদিন এই ছত্রাক তৈরি হয়ে কাটার উপযোগী না হয় ভূষির সিক্তভাব বজায় রাখার জন্য পানি স্প্রে করে যেতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকারের মাশরুমের রোপন পদ্ধতিতে সামান্য পার্থক্য থাকে।
মাশরুমকেহাওয়াবাতাসথেকেবাঁচানোর উপায়
মাশরুম চাষের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ বিষয়ে সতর্কতা খুবই জরুরী। মাশরুম যেহেতু একধরনের ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ তাই চাষের স্থানটি ছায়াযুক্ত হওয়া দরকার। সে স্থানে যাতে বাইরের কোনো রকম হাওয়া বাতাস কিংবা সূর্য্যের আলো না ঢুকে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তাই চাষের শুরুর দিকে হাওয়া বাতাস থেকে বাঁচানোর জন্য ভূষি ভরা পলিথিন ব্যাগগুলো ঘরে ১৫ -২০ দিনের জন্য রুদ্ধ অবস্থায় রাখতে হবে।
১৫ দিন পর হাওয়া লেগে থাকলেও কোনো ভয় নেই। তাই ১৫ দিন পরেই ঘরের দরজা খোলা যাবে।
১৫-২০ দিন যাওয়ার পর ঘরটি খুলে দিলে দেখা যাবে ভূষির উপর সাদা রঙের ছত্রাকের জাল ছড়িয়ে রয়েছে। এই সময় মাশরুম উৎপাদনের স্থানে যেন হাওয়া দেওয়া যায় তাই একটি ফ্যান এর ব্যবস্থা করে রাখা দরকার।
মাশরুমএরফসলকাটার সময়
এমনিতে মাশরুম এর ফসল সম্পূর্ণভাবে তৈরি হতে ৩০ থেকে ৪০ দিনের সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে ফসল কাটার জন্য তৈরি হয়ে যাবে।
মাশরুমচাষকরেকতটালাভকরাযাবে
এমনিতে ভালো করে মাশরুম উৎপাদন করতে পারলে এবং সঠিক সময়ে ফসল কেটে সেগুলোকে বিক্রি করতে পারলে দুই থেকে তিন গুণ লাভ করা সম্ভব।
এই ব্যবসাতে লাভের পরিমান অনেক বেশি। তবে এর জন্য সঠিকভাবে মাশরুমগুলোকে বিক্রি করার কৌশল জানতে হবে। যত অধিক পরিমানে মাশরুম এর উৎপাদন করতে পারবেন ততটাই অধিক মুনাফা আপনার হবে। তাই সবকিছুর আগে মাশরুম চাষ পদ্ধতি সঠিক ভাবে জেনে একটি ভালো এবং সঠিক জায়গাতে মাশরুম উৎপাদন করতে জানতে হবে।
তৈরিহওয়ামাশরুমগুলোরমার্কেটিংকরুন
ভালো ফসল ফলিয়েও লাভ নেই যদি না যথোপযোক্ত মার্কেটিং করা না যায়। তাই, সঠিক মার্কেটিং পন্থা অবলম্বন করে উৎপাদিত মাশরুমগুলোকে বিক্রি করার চেষ্টা করতে হবে।
এমনিতে শহরে মাশরুম এর চাহিদা অনেক বেশি, তাই শহরে অনেক তাড়াতাড়ি এগুলোকে বিক্রি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে শহরে এসে মার্কেটিং অবশ্যই করতে হবে।
যদি তৈরি হওয়া মাশরুম গুলো ৭ দিনের অধিক সময় চাষির কাছেই থাকে তাহলে সেগুলো নষ্ট হওয়া শুরু হবে। তাই কম সময়ের মধ্যেই মাশরুমগুলো বিক্রি করতে হবে।
আসে পাশের শহর গুলোতে গিয়ে সেখানে থাকা বড় বড় দোকান গুলোর সাথে যোগাযোগ করুন।
খাবারের হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির সাথে যোগাযোগ করুন।
মার্কেটিং এর জন্য দু-চার জন ছেলে রেখে তাদের মাধ্যমে বিক্রি করাতে পারবেন।
কোনো বড় খাদ্যপণ্য ডিস্ট্রিবিউটারের সাথে যোগাযোগ করুন।
অনলাইন ডিজিটাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে প্রচার বা মার্কেটিং করুন।
মাশরুম বিক্রি করার নিজের ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করতে পারেন।
মাশরুমচাষের জন্যপ্রশিক্ষণজরুরি
মাশরুম এর চাষ করাটা একটি অনেক জটিল প্রক্রিয়া। কেবল অনলাইনে আর্টিকেল পড়ে সবটা বুঝা সম্ভব না। মাশরুম চাষে সফল হতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ জরুরি। তাই ব্যবসা শুরুর আগে দেশের মধ্যে থাকা বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা কৃষির সাথে জড়িত সংগঠন গুলোর সাথে যোগাযোগ করে সঠিক ভাবে মাশরুম চাষ করার পদ্ধতি শিখে ও জেনে নেয়া উচিত।
এমন না যে, ভালো করে প্রশিক্ষণ না নিয়ে মাশরুম এর চাষ করা যাবে না। কিন্তু সফলতার সম্ভাবনা বেড়ে যায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেয়া থাকলে।
কৃষি, কৃষি শিক্ষা, কৃষি প্রশিক্ষণ, কৃষি শিল্প, কৃষি গবেষণা