Tag Archives: কৃষি উন্নয়ন

কৃষি উন্নয়ন

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ১ম পত্র । HSC” বিষয় এর ইউনিট ১ এর পাঠ-১.২ নং পাঠ।

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন

 

ফসল:

যে সমস্ত উদ্ভিদ মাঠে পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় এবং উৎপাদিত মূল দ্রব্য অথবা উপজাত দ্রব্যের আর্থিক মূল্য আছে তাদেরকে ফসল বলা হয়। যেমন, ধান, গম, সবজি ইত্যাদি। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে যে সকল গাছপালার চাষাবাদ করে তাকেই আমরা ফসল বলতে পারি। এই ফসল বা শস্য সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা ও সুষ্ঠুভাবে জ্ঞানার্জন আবশ্যক।

 

মাঠ ফসল (Field Crop):

মাঠ ফসল বলতে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বলিত ফসলকে বোঝায় সেগুলো বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ করা হয়। মাঠ ফসলকে কৃষিতাত্ত্বিক (অমৎড়হড়সরপ ঈৎড়ঢ়) ফসলও বলা হয়। মাঠ ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে একই জমিতে একই ফসল চাষ করা হয়। যেমন—ধান, গম, পাট, সরিষা, ছোলা, ভুট্টা, মসুর, খেসারী, চীনা ও কাউন ইত্যাদি। মাঠ ফসলের জন্য জমিতে একইভাবে প্রস্তুত করা হয় এবং এর বীজ একসাথে ছিটিয়ে বা লাইনে বপন বা রোপন করা হয়। সাধারণত একই জমিতে বছরে এক বা দুইবার মাঠ ফসল উৎপাদন করা হয়।

বিভিন্ন আন্তঃপরিচর্যা যেমন—পানি সেচ, আগাছা দমন, পানি নিস্কাশন, সার ও বালাই নাশক ইত্যাদি এক সাথে করা হয়।

 

মাঠ ফসলের শ্রেণিবিভাগ :

ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে মাঠ ফসলকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়।

যেমন-

দানা জাতীয় ফসল (Cereal grain crops ) :

গ্রামিণী ( Gramineae) পরিবারভুক্ত যেসব দানা জাতীয় ফসল প্রধানত কার্বোহাইড্রেট বা শ্বেতসার খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাদেরকে দানা জাতীয় ফসল বলে। যেমন ধান, গম, ভুট্টা, চীনা, জোয়ার, সরগাম ইত্যাদি।

 

ভাল জাতীয় ফসল (Pulse Crops ) :

লিগুমিনোসি পরিবারের অন্তর্গত যে সব দানা ফসল ভালের জন্য উৎপাদন করা হয় তাদের ডাল ফসল বলে । যেমন মুগ, মসুর, ছোলা, মাসকালাই এবং মটর ইত্যাদি। ডাল জাতীয় ফসল আমিষের অন্যতম
উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

 

তেলবীজ ফসল (Oilseed crop ) :

যে সব ফসল তেল উৎপাদনের জন্য চাষাবাদ করা হয় তাদেরকে তেলবীজ ফসল বলে। যেমন-সরিষা, সয়াবিন, তিল, তিসি ইত্যাদি। তেলবীজ ফসল স্নেহজাতীয় উপাদানের প্রধান উৎস ।

 

চিনি ফসল (Sugar Crop ) :

যে সকল ফসল চিনি উৎপাদনের জন্য চাষ করা হয় তাদেরকে চিনি ফসল বলা হয়। যেমন- আখ, সুগার বিট ইত্যাদি ।

 

আঁশ জাতীয় ফসল (Fiber Crop) :

যে সব ফসল আঁশ আহরনের জন্য উৎপাদিত হয় তাদেরকে আঁশ জাতীয় ফসল বলে। যেমন- পাট, কেনাফ, মেতা, তুলা ইত্যাদি।

 

পশু খাদ্য ফসল (Fodder Crops ) :

যে সব ফসল পশু খাদ্যের উৎস হিসেবে চাষ করা হয় তাদেরকে পশু খাদ্য ফসল বলে। যেমন- নেপিয়ার ঘাস, দুর্বা ঘাস, ক্লোভার ইত্যাদি।

 

পানীয় ফসল (Beverage Crops) :

পানীয় দ্রব্য উৎপাদনের জন্য যেসব ফসল চাষ করা হয় তাদেরকে পানীয় ফসল বলা হয় যেমন চা, কফি, কোকো ইত্যাদি ।

 

নেশা জাতীয় ফসল :

নেশাজাতীয় দ্রব্য উৎপাদনের জন্য যেসব ফসল চাষাবাদ করা হয় তাদেরকে নেশাজাতীয় ফসল বলা হয়। যেমন—তামাক, গাঁজা ইত্যাদি।

 

সবুজ সার ফসল  :

যে সকল ফসল সবুজ সার উৎপাদনের জন্য চাষ করা হয় তাদেরকে সবুজ সার ফসল বলে। যেমন ধৈঞ্চা, ইপিল ইপিল, কাউন ইত্যাদি।

 

শিল্প ফসল:

শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহের জন্য যেসব ফসল চাষ করা হয় তাদেরকে শিল্প ফসল বলে। যেমন—পাট, আখ, রাবার, তুলা ইত্যাদি।

 

মাঠ ফসলের গুরুত্ব:

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাঠ ফসলের গুরুত্ব সর্বাধিক। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য শস্য ধান হলো মাঠ ফসলের একসাথে। চাষযোগ্য জমির অধিকাংশটি ব্যবহৃত হয় মাঠ ফসল উৎপাদনের জন্য এবং ধান সবচেয়ে বেশি জমিতে চাষ করা হয়। এছাড়াও গম, অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসল, তেলবীজ ফসল ও চাষ করা হয়।

দানাজাতীয় ফসলের ৮০—৮৫% আসে ধান থেকে এবং ৬—৮% আসে গম থেকে। ধান ও গম শর্করা জাতীয় খাদ্যের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডাল জাতীয় ফসল যেমন মসুর, মুগ, খেসারী ইত্যাদি উদ্ভিদজাত আমিষের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তৈল বীজ ফসল স্নেহজাতীয় খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং এ সকল উদ্ভিদজাত স্নেহ বা চর্বির পুষ্টিমান প্রাণিজ তেল থেকেও বেশি। এছাড়াও পশু পাখি, হাঁস মুরগী ও মাছের খাদ্যের অন্যতম উৎস হিসেবে ও মাঠ ফসলের অবদান রয়েছে।

মাঠ ফসল যেমন, পাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত এবং এগুলো রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।

 

মাঠ ফসলের বৈশিষ্ট্য:

১। সাধারণত একসাথে বি¯ীর্ণ এলাকা জুÍ ড়ে চাষ করা হয়।
২। প্রতিটি গাছ/চারার আলাদা যত্ন নিতে হয় না।
৩। মাঠ ফসলের জমিতে সাধারণত বেড়া দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
৪। মাঠ ফসলের বীজ একসাথে ছিটিয়ে বা সারিতে রোপন বা বপন করা হয়।
৫। সাধারণত সমস্ত ফসল একসাথে কর্তন সংগ্রহ করা হয়।

 

 

উদ্যান ফসল (Horticulture crop):

উদ্যান ফসল বলতে সেসব ফসলকে বোঝায় যেগুলো অনেক সময় বেড়া দিয়ে উৎপাদন করা হয়। সাধারণত: উদ্যান ফসলের চাষ স্বল্প পরিসরে করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ক্রমবর্ধমান মানুষের চাহিদা মিটাতে বি¯ৃÍত এলাকায়ও উদ্যান ফসলের চাষ করা হয়। উদ্যান ফসল বন্যামুক্ত উঁচু জমিতে বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়।

সাধারণত বসতবাড়ির আশে পাশে উর্বর জমিতে উদ্যান ফসল চাষ করা হয়। রাস্তার ধারে, পতিত জমিতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট কথা ছোট উঁচু জমি যেখানে আছে সেখানেই উদ্যান ফসল চাষ করা হয়। এছাড়া ঘরের বারান্দায়, ছাদে টবের মধ্যেও চাষ করা হয়। উদ্যান ফসল চার প্রকার। যথা—

(১) ফল জাতীয় ফসল:

যেমন, আম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা, লিচু, আনারস, পেঁপে, কুল ইত্যাদি।

(২) ফুল জাতীয় ফসল :

যেমন—গোলাপ, গাঁদা, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি।

(৩) শাক সবজি জাতীয় ফসল :

বেগুন, টমেটো, বাধাঁ কপি, ফুলকপি, ডাটা শাক ইত্যাদি। (৪) মসলা জাতীয় ফসল: যেমন, পেঁয়াজ, রসুন হলুদ, আদা, এলাচ ইত্যাদি।

 

 

উদ্যান ফসলের বৈশিষ্ট্য:

১। সাধারণত স্বল্প জমিতে চাষ করা হয়।

২। জমি উঁচু হতে হবে, জমির চারপাশে অনেক সময় বেড়া দিতে হয়।

৩। প্রতিটি গাছের আলাদা যত্ন নিতে হয়।

৪। তুলনামূলক বেশি যত্ন নিতে হয়।

৫। ফসলের মূল্য মৌসুমের শুরুতে বেশি হয়। ফসল উৎপাদন খরচ কম হয় এবং লাভ বেশি হয়।

৬। ফসল উৎপাদনে ঝঁুকি কম।

৭। একই জমির সব ফসল একই সময়ে পরিপক্ক হয় না তাই কয়েকবার ফসল সংগ্রহ করতে হয়।

৮। আন্তঃপরিচর্যা বেশি করতে হয় এবং নিয়মিত পানি সেচ দিতে হয়।

৯। এরা স্বল্প সময়ের, একবর্ষজীবী, দ্বিবর্ষজীবী ও বহুবর্ষজীবী হতে পারে।

১০। ফসল সাধারণত তাজা বা রন্ধন অবস্থায় ব্যবহার করতে হয়।

১১। বেশিরভাগ উদ্যান ফসলই দ্রুত পচনশীল।

১২। উদ্যান ফসলের বীজ বা চারা সাধারণত সারিতে বপন বা রোপন করা হয়।

 

উদ্যান ফসলের গুরুত্ব:

বাংলাদেশের ব্যবসায়িক লাভের উদ্দেশ্যে বি¯ৃÍত মাঠে উদ্যান ফসল চাষ করা হয়। তবে স্বল্প পরিসরে পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই মূলত উদ্যান ফসল চাষ করা হয়। পরিবারের ফল ও শাকসবজির চাহিদা যোগান দেয়ার পাশাপাশি বাড়তি ফসল বিক্রয় করে নগদ অর্থ উপার্জিত হয়। এছাড়া গৃহপালিত পশুর খাদ্যের উৎস হিসেবে ফল গাছের পাতা ব্যবহৃত হয়। বয়ষ্ক ফল গাছ থেকে উন্নত জাতের কাঠ ও জ্বালানি পাওয়া যায়। এছাড়া ফুল চাষের মাধ্যমে যেমন বিনোদন পাওয়া যায় তেমন ফুল চাষ করে অনেক শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হচ্ছে।

ফল, শাকসবজি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং এগুলো বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে।

 

 

সামাজিক বনায়ন (Social Afforestration):

আদিমকাল থেকেই বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু। প্রাচীনকালে মানুষের যখন ঘরবাড়ি ছিল না তখন মানুষ গাছেই বাস করত। আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন সেটিও বৃক্ষই যোগান দেয়। মানুষসহ অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। প্রতিটি দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বৃক্ষ বা বনভুমি থাকা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু বনায়ন ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে থেকে বনায়ন কর্মসুচী গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে ‘সামাজিক বনায়ন হলো এমন বন ব্যবস্থাপনা বা কর্মকান্ড যার সাথে পল্লীর দরিদ্র জনগোষ্ঠি ওতপ্রোতভাবে জড়িত’।

এর মাধ্যমে উপকারভোগী জনগণ কাঠ ও জ্বালানি, খাদ্য, পশু খাদ্য ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেয়ে থাকে।

সুতরাং বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে পরিচালিত বনায়ন কার্যক্রমকে সামাজিক বনায়ন বলে। অর্থাৎ যে বনায়ন বা বন ব্যবস্থাপনায় জনসাধারণ সরাসরি জড়িত থাকে বা অংশগ্রহণ করে অর্থাৎ জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে এবং জনগণ দ্বারা সৃষ্ট বনকে সামাজিক বনায়ন বা বন বলে।

 

সামাজিক বনায়নের প্রকারভেদ (Classification) :

সামাজিক বনায়ন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন:

(১) কমিউনিটি বনায়ন
(২) গ্রামীণ বনায়ন
(৩) অংশীদারিত্ব বনায়ন
(৪) স্বনির্ভর বনায়ন

 

সামাজিক বনায়নের প্রয়োজনীয়তা (ঘNecessity of Social Afforestration):

ক. প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা, পরিবেশ দূষণ ও মরু প্রক্রিয়া থেকে দেশকে রক্ষা করা।
খ. ভুমির সুষ্ঠু ও উৎপাদনমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা।
গ. দেশের বিরাজমান গাছ ও জ্বালানি কাঠের ঘাটতি নিরূপণ করা।
ঘ. গ্রামীণ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাঁচামাল ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
ঙ. পতিত, অনাবাদী ও প্রান্তিক জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা।

 

বাংলাদেশের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী :

বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন গ্রামীণ জনপদের আর্থ—সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র—বিমোচনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। সে সাথে সামাজিক বনায়ন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজনে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলায় লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার সামাজিক বনায়নের ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। বন বিভাগ ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বনায়ন কর্মসূচী বনাঞ্চলের বাইরে জনগণের কাছে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের বন বিভাগ ১৯৮১—৮২ সালে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) আর্থিক সহযোগীতায় উত্তরাঞ্চলের ২৩ টি জেলার জনগণকে অংশীদার করে প্রথম সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এরপর ১৯৯৫—৯৭ সালে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করে সম্প্রসারিত সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ১৯৯৫২০০২ সালে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। সামাজিক বনায়নকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সরকার ২০০৪ সালে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা প্রবর্তন করে।

যা আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে সংশোধনী আনা হয়। সংশোধিত বিধিমালায় সরকারী বন ভূমিতে বনায়নের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠিীর বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

 

সামাজিক বনায়নের গুরুত্ব :

১। সামাজিক বনায়নের উৎপাদিত বনজ দ্রব্য: ১৯৯৯—২০০০ থেকে ২০০৫—০৬ সাল পর্যন্ত সামাজিক বনায়ন থেকে বিপুল পরিমাণ বনজ দ্রব্য আহরিত হয়। এসব বনজ দ্রব্য বিক্রয় হয়েছে ২৩৭ কোটি ২ লাখ ৮ হাজার ৭৫৫ টাকা যা দেশের অথনীতিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।

২। পরিবেশ রক্ষায়: পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে সামাজিক বনায়ন ভূমিকা রাখছে।

৩। উপকুলীয় বনাঞ্চল: ১৯৬০ সাল থেকে বন বিভাগ সামুদ্রিক ঝড়—ঝঞ্চা ও জলোচ্ছাসের ক্ষতি মোকাবেলা করতে উপকুলীয় ১০ জেলার বাঁধের উপর বনায়ন কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১.৫১ লাখ হেক্টর ভূমি উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে সমুদ্র গর্ভ থেকে পুনুরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এতে দেশের প্রায় ১% ভূমি বৃদ্ধি পেয়েছে।

৪। মরুময়তারোধে বনায়ন: দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুময়তা রোধ করার জন্য বনবিভাগ ব্যাপক বনায়ন করেছে। বনায়নের ফলে উত্তরবঙ্গের আবহাওয়ার যথেষ্ট অনুকুল ও কৃষিবান্ধব হয়েছে যার ফলে এটি দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখছে।

৫। শিল্প বনায়ন: চট্ট্রগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও পাবর্ত্য চট্ট্রগ্রামে ১৯৯৭—৯৮ থেকে ২০০৬—০৭ সাল পর্যন্ত বন বিভাগের হস্তক্ষেপে ২৪ হাজার ৪০১ হেক্টর শিল্প বনায়ন হয়েছে। এসব বনায়ন থেকে কম মূল্যে বিভিন্ন মিল কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ করা হচ্ছে।

৬। ঔষধি বনায়ন: সামাজিক বনায়নের আওতায় বন বিভাগ স্বাস্থ্য সেবা ও ঔষধ শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে ঔষধি বনায়ন শুরু করেছে যা দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলের ৬ শত একর ভূমি নিয়ে বিস্তৃত।

 

বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের সুযোগ :

সরকারী বনভূমি ব্যতীত বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রচুর সুযোগ রয়েছে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণ, অফিস অঙ্গন, রাস্তার ধার, পতিত জমি, কৃষি জমির আইল, সড়কের ধার, নদী ও খালের পাড়, বাঁধের পাড়, জলাশয় ও পুকুরপাড়, মসজিদের অঙ্গন, গোরস্থান, উদ্যান, বসতবাড়ির আশেপাশে, শিল্প এলাকায়, শহরের প্রধান সড়কের পাশে, গো—চারণ ভূমি, বাণিজ্যিক ভূমি, বাণিজ্যিক এলাকা, উপকূলীয় এলাকা। মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বনায়নের বিকল্প নেই। সেজন্য আমাদের বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, নতুন নতুন সামাজিক বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে এবং বর্তমান যে বনাঞ্চল রয়েছে সেটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

সারাংশ :

মাঠ ফসল সাধারণত বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ করা হয় এবং একই ধরণের জমিতে একই ফসল চাষ করা হয়। যেমন ধান, গম ইত্যাদি। উদ্যান অনেকসময় ফসল বেড়া দিয়ে স্বল্প পরিসরে চাষ করা হয় এবং একই জমিতে বিভিন্ন ফসল যেমনফুল, ফল ও শাকসবজি চাষ করা হয়। আবার কোন অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহনে সৃষ্ট বনায়নই সামাজিক বনায়ন। দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সামাজিক বনায়নের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

 

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়” এর “উচ্চ মাধ্যমিক” পর্যায়ের “কৃষি শিক্ষা ১ম পত্র” এর “ইউনিট ১” এর “বাংলাদেশের কৃষি” এর পাঠ – ১.১। কৃষি বলতে ফসল উৎপাদনের উদ্দেশ্যে জমির চাষাবাদকে বুঝায়। থাকতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন, প্রতিরক্ষা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ এবং ফসলের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য জ্ঞানের ব্যবহারকে কৃষি বলে। কৃষির প্রধান উপাদান হল মাটি। অর্থাৎ মাটিকে ব্যবহার করে যে কোন উৎপাদনকে কৃষি বলে অবহিত করা যায়। যেমন:- মাছ চাষ। মাছ চাষের জন্য পুকুরের প্রয়োজন, আর পুকুরের গুণগত মান মাটির গুণগত মানের উপর নির্ভর করে। অতএব, মাছ চাষকেও কৃষি বলা যাবে।

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র

বিজ্ঞানের যে শাখায় কৃষির উৎপাদন প্রযুক্তি ও কৃষি বিষয়সহ অন্যান্য বিষয়াদি জানা যায় তাকে কৃষি শিক্ষা বলে ।

 

কৃষি বিপ্লবের বিভিন্ন ধাপ:

আজকে কৃষি যে অবস্থায় আছে তা একসময় এমন ছিল না। কৃষি কয়েকটা ধাপ অতিক্রম করে আজকের অবস্থায় উন্নীত হয়েছে।

 

যেমন:

১। আদি ধাপ।
২। পশু শিকার ধাপ ।
৩। আগুন ও লোহার হাতিয়ারের ব্যবহার ধাপ।
৪। পশুপালন ধাপ।
৫। ফসল উৎপাদন ধাপ
৬। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি।

 

কৃষির উপাদান :

কৃষির প্রধান উপাদান হল মাটি। তাছাড়া আরোও অনেক উপাদান যা কৃষির উৎপাদনের সাথে জড়িত যেমন: পানি, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা ইত্যাদি কৃষি উপাদানের অন্তর্ভুক্ত। অতএব বিজ্ঞানের যে শাখায় কৃষির উৎপাদন প্রযুক্তি ও কৃষি বিষয় সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদি জানা যায় তাকে কৃষি শিক্ষা বলে।

 

কৃষির গুরুত্ব :

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দেশজ অর্থনীতি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মুল উপাদান হল কৃষি। দেশের প্রায় শতকরা ৭০—৮০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে এবং তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে যুক্ত। ২০১৫—২০১৬ অর্থ বছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল শতকরা ১৫.৩৩ ভাগ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৬)। দেশের মোট শ্রমশক্তির শতকরা প্রায় ৪৭ ভাগ সরাসরি এবং ৮০ ভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি খাতে নিয়োজিত। দেশের মোট রপ্তানিতে কৃষি জাত পণ্য যেমন— কাঁচাপাট, পাটজাত দ্রব্য, চিংড়ি চামড়া ও চা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে বাংলাদেশের কৃষির গুরুত্ব সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

মৌলিক চাহিদা পূরণ:

মানুষের মৌলিক চাহিদা বলতে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, ও শিক্ষাকে বুঝায়। এছাড়াও অন্যান্য চাহিদার মধ্যে রয়েছে আসবাবপত্র, জ্বালানি, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি। এসব চাহিদা পূরণে কৃষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে মৌলিক চাহিদা পূরণে কৃষির ভূমিকা আলোচনা করা হল।

 

১. খাদ্য:

মানুষের প্রথম মৌলিক চাহিদা হল খাদ্য। আর খাদ্যের জন্য আমরা সম্পূর্ণরূপে কৃষির উপর নির্ভরশীল। খাদ্যের বেশিরভাগ আসে কৃষি হতে। যেমন চাল, ডাল, গম, ভুট্টা, মাছ, শাকসবজি, মাংস ইত্যাদি। সুতরাং আমরা বেঁচে থাকার জন্য সম্পূর্ণরূপে কৃষির উপর নির্ভরশীল।

 

২. বস্ত্র:

বস্ত্র মানুষের দ্বিতীয় মৌলিক চাহিদা। লজ্জা ও শীত নিবারণের জন্য মানুষ বস্ত্র পরিধান করে। বস্ত্র তৈরি মুল উপাদান বা কাঁচামাল সুতা আসে কৃষি হতে। যেমন, পাট, তুলা, রেশম ইত্যাদি।

 

৩. বাসস্থান:

মানুষের তৃতীয় মৌলিক চাহিদা হল বাসস্থান। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হলে সর্ব প্রথম তার একটা স্থায়ী বাসস্থান দরকার। আর বাসস্থান তৈরির প্রধান উপকরণ যেমন বাঁশ, কাঠ, ছন, খড় ইত্যাদি আসে কৃষি খাত হতে।

 

৪. ঔষধ:

আদিকাল হতেই বিভিন্ন উদ্ভিদ বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হোমিওপ্যাথিক, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরির বেশিরভাগ কাঁচামাল হচ্ছে কৃষিজাত পণ্য। যেমন: পেনিসিলিন নামক জীবন রক্ষাকারী ঔষধ পেনিসিলিয়াম নামক ছত্রাক হতে তৈরি হয়।

 

৫. জ্বালানি:

গ্রামে অধিকাংশ মানুষ জ্বালানি হিসাবে লাকড়ি, লতাপাতা, বাঁশ ইত্যাদি ব্যবহার করে। এছাড়া গোবর, খড়, পাটকাঠি গ্রামাঞ্চলের জ্বালানির একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে কাজ করে। বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র শিল্পে জ্বালানি হিসাবে কাঠের লাকড়ি ব্যবহার করা হয়। যেমন বেকারী শিল্প।

 

৬. আসবাবপত্র:

আমাদের বাসস্থানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র প্রয়োজন হয়। যেমন—খাট, আলনা, চেয়ার, টেবিল, আলমারি, দরজা, জানালা ইত্যাদি। এগুলো বেশিরভাগই তৈরি হয় কাঠ ও বাঁশ দিয়ে।

 

৭. শিক্ষা:

শিক্ষার প্রধান উপকরণ হল কাগজ। আর এই কাগজ তৈরি হয় বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য থেকে। যেমন—বাঁশ, আখের ছোবড়া ইত্যাদি। এছাড়া শিক্ষার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল পেন্সিল। পেন্সিল তৈরিতে কাঠ ব্যবহৃত হয়। অতএব শিক্ষাও কৃষির উপর নির্ভরশীল।

 

৮. চিত্তবিনোদন:

একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন আছে। বন ও শিশু পার্কে লাগানো বিভিন্ন ধরনের ফুল ও সৌন্দর্যবর্ধক গাছগাছালি চিত্তবিনোদনের জন্য একটা ভাল মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। এই কারণে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ও সুন্দরবন দেখতে যায়।

 

 

কর্মসংস্থান :

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। নিচে কর্মসং¯া’ নের ক্ষেত্রে কৃষির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।

১. বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস কৃষিকাজ।
২. দেশের প্রায় ৪৭% শ্রমিক কৃষিকাজে নিয়োজিত (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৬)।
৩. দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০—৮০% লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কষির উপর নির্ভরশীল।ৃ
৪. কৃষিপণ্য নির্ভর বিভিন্ন শিল্প কারখানায় অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে।
৫. আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। আর এক্ষেত্রে কৃষির বিভিন্ন শাখা যেমন গবাদি পশু পালন, ফুল ফল চাষ, মুরগি পালন, মাছ চাষ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন কূ রে। অর্থাৎ আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কৃষির ভূমিকা অনস্বিকার্য।
৬. দক্ষ ও অদক্ষ উভয় প্রকার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের উৎস হল কৃষি।

 

 

শিল্প ও বাণিজ্য:

শিল্পক্ষেত্রে কৃষির বহুমুখী ব্যবহার আছে। নিচে তা আলোচনা করা হল।

১. বাংলাদেশের অনেক শিল্পের কাঁচামাল আসে কৃষিজাত পণ্য হতে। যেমন পাট, চা, বস্ত্র, কাগজ, চিনি, চামড়া, খাদ্য ইত্যাদি।
২. শিল্পজাত কৃষি পণ্য বেশি উৎপাদনের মাধ্যমে শিল্প কারখানার উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। ফলে শিল্পের তথা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ফলশ্রম্নতিতে বেকার সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে।
. কৃষিপণ্যের উপর নির্ভরশীল শিল্প কারখানার পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

অন্যান্য গুরুত্ব মানব জীবনে কৃষির বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নিচে সেগুলো বর্ণনা করা হল।
১. কৃষি পণ্যের উৎপাদনের সাথে কোন এলাকার যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
২. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কৃষির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৩. কৃষিজাতপণ্য রপ্তানি করার মাধ্যমে অন্যান্য দেশের সাথে একটা ভাল সম্পর্ক তৈরি হয় যা একটা দেশের উন্নতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা হতে সহজেই বুঝা যায় যে, মানব জীবনে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম।

 

কৃষির ক্ষেত্রসমূহ (Sectors of Agriculture ):

ফসল, পশু পাখি, বন ও মাছ প্রভৃতি কৃষির প্রধান ক্ষেত্র। এসব বিষয়সমূহ একে অপরের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এসব বিষয় একত্রে কোন এলাকার সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলে। অর্থাৎ কৃষি শিক্ষার জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ফসল, পশুপাখি, বন, মাছ প্রভৃতি চাষাবাদে আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে জানা যাবে।

নিম্নে বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্রসমূহের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হল।

 

 

সারাংশ :
কৃষি বলতে ফসল উৎপাদনের উদ্দেশ্যে অর্থসামাজিক উন্নয়নের মুল উপাদান হল কৃষি। ফসল, পশু পাখি, বন ও মাছ প্রভৃতি কৃষি শিক্ষার প্রধান পাঠ্য বিষয়।

 

বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার

বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার (আগে এর নাম ছিলো রাষ্ট্রপতি কৃষি উন্নয়ন পদক) বাংলাদেশের একটি জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার। কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরুপ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই পুরস্কার বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯৭৩ সাল থেকে প্রদান করা শুরু হয়।

 

বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রদান ইতিহাস:

কৃষি ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কৃষি খাতে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন, কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা পালনে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়।

  • ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৯/১৯৭৩ এর মাধ্যমে “বঙ্গবন্ধু পুরস্কার তহবিল” গঠন করা হয়।
  • ১৯৭৬ সালে উক্ত আদেশ বাতিল করে রাষ্ট্রপতির পুরস্কার তহবিল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ প্রবর্তন করা হয়।
  • বিভিন্ন পর্যায়ে এই পুরস্কারের নাম পরিবর্তন বা সংশোধন এর পর ৯ জুলাই ২০০৯ তারিখে ২০০৯ সনের ৩৯ নং আইন দ্বারা “জাতীয় কৃষি পুরস্কার তহবিল” সংশোধন করে “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার তহবিল” করা হয় ।
  • ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখ “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ট্রাস্ট আইন, ২০১৬” পাশ হয়।
  • আইন অনুযায়ী প্রতি বছর এ পুরস্কার দেয়ার বিধান থাকলেও বাংলা ১৩৮৩ (ইংরেজি ১৯৭৬-১৯৭৭) হতে কৃষি পুরস্কার প্রদান করা হয়।

 

বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রদানের কার্যক্রম:

উদ্দেশ্যে: কৃষি ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/্রতিষ্ঠানকে কৃষি খাতে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন, কৃষি
প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করা।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পটতৃমিকা:

  • ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৯/১৯৭৩ এর মাধ্যমে “বঙ্গবন্ধু পুরস্কার তহবিল” গঠন করা হয়।
  • ১৯৭৬ সালে উক্ত আদেশ বাতিল করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার তহবিল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ প্রবর্তন করা হয়।
  • বিভিন পর্যায়ে এ পুরস্কারের নাম পরিবর্তনের পর সর্বশেষ গত ৯ জুলাই ২০০৯ তারিখে ২০০৯ সনের ৩৯ নং আইন দ্বারা “জাতীয় কৃষি পুরস্কার তহবিল” সংশোধন করে “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার তহবিল” করা হয়।
  • এ আইনের আওতায় কৃষি পুরস্কার সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে গত ৩০/০৪/২০১৪ তারিখে ১০ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড পুনঃগঠন করা হয়।
  • বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ট্রাস্ট আইন, ২০১৬” এর ৬অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের বেসরকারি ট্রাস্টি ও সদস্য হিসেবে ডঃ আতিউর রহমান, অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলহাজ্ব মোঃ মোতাহার হোসেন মোল্লা, পিতা-সৃত মাওলানা মোজাফ্ফর আলী মোল্লা, গ্রাম- খোদাজিয়া, পোস্ট ও উপজেলা-কাপাসিয়া, জেলা-গাজীপুর-কে ২ বছরের জন্য বেসরাকারি ট্রাস্টি ও সদস্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।
  • গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখ “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ট্রাস্ট আইন, ২০১৬ পাশ হয়।

 

ইতপূর্বে প্রদানকৃত বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার এর বিবরণ:

  • আইন অনুযায়ী প্রতি বছর এ পুরস্কার দেয়ার বিধান থাকলেও বাংলা ১৩৮৩ (ইংরেজি ১৯৭৬-৭৭) হতে কৃষি
    পুরস্কার প্রদান শুরু হয়।
  • বাংলা ১৪২০ (ইংরেজি ২০১৩-২০১৪) পর্যন্ত ৩৮ বছরে ২২ বার এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন কারণে প্রতি বছর
    পুরস্কার দেয়া সম্ভব হয়নি।
  • এ পর্যন্ত মোট ৬০টি স্বর্ণ, ৩৩৯টি রৌপ এবং ৬১০টি ব্রোঞ্জ পদকসহ সর্বমোট ১০০৯টি পুরস্কার দেয়া হয়েছে।
  • বিগত ৭ বছরে মোট ৫ বার _বাংলা ১৪১৫ (ইংরেজি ২০০৮-০৯), ১৪১৭ (ইংরেজি ২০১০-১১), ১৪৪৮ (ইংরেজি
    ২০১১-১২), ১৪১৯ (ইংরেজি ২০১২-১৩) প্রদান করা হয়।
  • সর্বশেষ ১৪২০ (ইংরেজি ২০১৩-১৪) সনে বঙ্ঞাবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে প্রদান করা
    হয়েছে।
  • এ বছর “ববন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২১ ও ১৪২২ প্রদানের কার্যক্রম চলছে।

 

বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্র: ১০ টি বিষয়ে অবদানের জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হয়:

১। কৃষি গবেষণায় অবদান
২। কৃষি সম্প্রসারণে অবদান
৩। প্রতিষ্ঠনিক/সমবায়/কৃষক পর্যায়ে উচ্চ মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ ও নার্সারী স্থাপন
৪। কৃষি উন্নয়নে জন সচেতনতা বৃদ্ধি ও উদ্দ্ধকরণ প্রকাশনা ও প্রচারণামূলক কাজ
৫। পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্তাবন/ব্যবহার
৬। কৃষিতে মহিলাদের অবদান
৭। বাণিজ্যিক ভিত্তিক খামার স্থাপন
৮। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বনায়ন
৯। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদিপশু ও হাসমুরগি চাষ
১০। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য চাষ

বাছাই প্রক্রিয়া:

বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার বোর্ড অফ ট্রাস্টের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও কৃষি মন্ত্রণালয় “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার” প্রদান করে থাকে। পুরস্কারের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর মনোনয়ন প্রদানকারী যোগ্য সংস্থা ও ব্যক্তিগণ নীতিমালা অনুযায়ী পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য প্রার্থীদের নামের তালিকা উপজেলা মনোনয়ন কমিটির নিকট যাচাই বাছাইয়ের জন্য প্রেরণ করে। এরপর নীতিমালা অনুযায়ী প্রাথমিক যাচাই বাছাই করে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য প্রার্থীদের নামের তালিকা জেলা মনোনয়ন কমিটির নিকট প্রেরণ করা হয়।

এছাড়া সরাসরি মনোনয়ন পাওয়া পুরস্কার প্রার্থীদের নামের তালিকা একই সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জেলা মনোনয়ন কমিটির যাচাই-বাছাই শেষ হলে পুরস্কার প্রার্থীদের নামের তালিকা কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিকট চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পাঠানো হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার বোর্ড অফ ট্রাস্টের সম্মিলিত যাচাই-বাচাইয়ের পর “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার” বিজয়ী ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নাম ও পুরস্কার প্রদানের তারিখ, সময়, স্থান সংশ্লিষ্ট সকলকে জানানো হয়।

 

চিচিঙ্গা চাষ পদ্ধতি ও গুনাগুণ

চিচিঙ্গা চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করবো আজ। চিচিঙ্গা হচ্ছে ঝিঙের মতো কিন্তু আরও লম্বা বা কখনও সাপের মত পেঁচানো, অপেক্ষাকৃত নরম সবজি। একে কখনো কইডা বা দুধকুুুশি বা হইডা বলা হয়ে থাকে। এর ইংরেজি নাম Snake gourd আর বৈজ্ঞানিক নাম Trichosanthes cucumerina। এটি ঝিঙে, লাউ, শশা, কুমড়ো ইত্যাদির মতই কিউকারবিটেসি পরিবারের সদস্য। চিচিঙ্গা বাংলাদেশের সকলের নিকট প্রিয় অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি।

চিচিঙ্গা চাষ

 

চিচিঙ্গা গাছের পাতা ২৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ফুলগুলি উষ্ণ, সাদা আঁশ নিয়ে রাতে পাপড়ি মেলে , পাপড়িগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় চুলের মতো সাদা আঁশ গুলো কিছুটা মুটিয়ে আসে, তবে রাতের বেলা সাদা রেখার কারণে নীল রঙের ফলগুলো দেখা যায় (নিচের গ্যালারীতে ফটো দেখুন)। চিচিঙ্গা ফল ২০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পেকে গেলে লাল বর্ণ ধারণ করে এবং বীজ সংগ্রহ করা যায়। এদের একটি জাত হলো জাপানি চিচিঙ্গা। এটি কিছুটা গোলাকৃতির হয় এবং ৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃত্তাকার হয়। চট্টগ্রামে এটিকে হইডা ও গোপালগঞ্জে কুশি নামে ডাকা হয়।

চিচিঙ্গার অনেক ঔষধী গুণ আছে। চিচিঙ্গার ১০০ ভাগ ভক্ষণযোগ্য অংশে ৯৫ ভাগ পানি, ৩.২-৩.৭ গ্রাম শর্করা, ০.৪-০.৭ গ্রাম আমিষ, ৩৫-৪০ মিঃগ্রাঃ ক্যালসিয়াম, ০.৫-০.৭ মিঃগ্রাঃ লৌহ এবং ৫-৮ মিঃগ্রাঃ খাদ্যপ্রাণ সি আছে।

 

 

প্রতি ১০০ গ্রাম চিচিঙ্গার পুষ্টি তথ্য:

আয়রন ৫.৭০%
আয়োডিন ৫.৯০%
কোলেস্টেরল ০.০ মিলিগ্রাম
ক্যালোরি ৮৬.২ কিলোক্যালরি
খনিজ পদার্থ: ক্যালসিয়াম ৫.১০%
খাদ্যতালিকাগত ফাইবার ০.৬ গ্রাম
দস্তা ৭.২০%
পটাশিয়াম ৩৫৯.১ মিগ্রা
প্রোটিন ২.০ গ্রাম
ফসফরাস ৫.০০%
ভিটামিন ই ১.১০%
ভিটামিন বি৬ ১১.৩০%
ভিটামিন সি ৩০.৫০%
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস: ভিটামিন: ভিটামিন এ ৯.৮০%
মোট কার্বোহাইড্রেট ১২.৫ গ্রাম
ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস: মোট ফ্যাট ৩.৯ গ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম ৬.৭০%
ম্যাঙ্গানিজ ১২.৫০%
সোডিয়াম ৩৩.০ মিলিগ্রাম
স্যাচুরেটেড ফ্যাট ০.৫ গ্রাম

চিচিঙ্গা চাষের জন্য জলবায়ু ও মাটি:

উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় চিচিঙ্গা ভাল জন্মে। শীতের দু’ তিন মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যেকোন সময় চিচিঙ্গা জন্মানো যায়। সব রকম মাটিতে চিচিঙ্গার চাষ করা যায় তবে জৈব সার সমৃদ্ধ দো-আশঁ ও বেলে দো-আশঁ মাটিতে ভালো জন্মে।
জাত

বিএডিসি ‘ঝুম লং’ নামের একটি জাতের বীজ উৎপাদন করছে। এর ফল নীলাভ কালচে সবুজ ও দীর্ঘ। ফলধারী আরো একটি জাত ‘সাদা সাভারী’ নামে পরিচিত। তাছাড়া তিস্তা, তুরাগ, সুরমা, রূপসা, বিভিন্ন জাত এদেশে চাষ হয়।

 

 

চিচিঙ্গার জীবন কাল:

মোট জীবনকাল প্রায় পাঁচ মাস। তবে জাত ও আবহাওয়া ভেদে সময় কমবেশী হতে পারে।

চিচিঙ্গার উৎপাদন মৌসুম:

এদেশে চিচিঙ্গা প্রধানত খরিফ মৌসুমেই হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে যে কোন সময় চিচিঙ্গার বীজ বোনা যেতে পারে।

 

 

চিচিঙ্গা চাষের জন্য বীজের হার:

চিচিঙ্গার জন্য হেক্টর প্রতি ৪-৫ কেজি (১৬-২০ গ্রাম/শতাংশ) বীজের প্রয়োজন হয়। জাত ভেদে শতক প্রতি ১২ – ১৫ গ্রাম। উন্নত জাতঃ সুরমা এফ-১, তিস্তা, বারি চিচিঙ্গা-১।

চিচিঙ্গার কৃত্রিম পরাগায়ন:

বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশেপাশে অন্য জাতের চিচিংগার গাছ থাকলে নির্বাচিত গাছের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার আগে (সকাল ৯ঃ০০ ঘটিকা থেকে দুপুর ২ঃ০০ ঘটিকার মধ্যে) পেপার ব্যাগ দ্ধারা বেধেঁ নিতে হবে। অতঃপর ফুল ফোটার পর কৃত্রিম পরাগায়ণ করতে হবে এবং পরাগায়ণ শেষে স্ত্রী ফুলটি আবার ব্যাগিং করে রাখতে হবে। ৩-৪ দিন পর ব্যাগ খুলে ফেলা যাবে। কৃত্রিম পরাগায়ণ অবশ্যই সকাল ৬ঃ০০ ঘটিকা থেকে ৯ঃ০০ ঘটিকার মধ্যেই সমাপ্ত করতে হবে।

 

 

চিচিঙ্গার অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা:

অন্য ফসলের মতোই ভালো ফলন পেতে গেলে চিচিঙ্গার পরিচর্যা জরুরী। যেমন – আগাছা সবসময় পরিষ্কার করে সাথে সাথে মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। পাশাপাশি খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। জুন-জুলাই মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আর সেচের প্রয়োজন হয় না। এরপর বাউনী দেয়া চিচিঙ্গার প্রধান পরিচর্যা। চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মিটার উঁচু মাচা তৈরি করতে হবে । বাউনী দিলে ফলন বেশী ও ফলের গুনগত মানও ভালো হয়।

চিচিঙ্গা চাষে সেচ:

চিচিঙ্গা গ্রীষ্মকালে চাষ করা হয়। গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয় বলে তখন সবসময় পানি সেচের প্রয়োজন নাও হতে পারে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ সময় থেকে মে মাস পর্যন্ত খুব শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। তখন অনেক সময় কারণ বৃষ্টিই থাকে না। উক্ত সময়ে ৫-৬ দিন অন্তর নিয়মিত পানি সেচের প্রয়োজন হয়।

চিচিঙ্গা চাষে সার প্রয়োগ:

২০ কেজি গোবর, অর্ধেক টিএসপি ও ২০০ গ্রাম পটাশ, সমুদয় জিপসাম, দস্তা, বোরণ জমি তৈরির সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট গোবর (মাদা প্রতি ৫ কেজি), টিএসপি (মাদা প্রতি ৩০ গ্রাম), ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ২০ গ্রাম), সমুদয় ম্যাগনেসিয়াম (মাদা প্রতি ৫ গ্রাম) চারা রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর ১ম বার ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম), ৩০-৩৫ দিন পর ২য় বার, ৫০-৫৫ দিন পর ৩য় বার ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে।

সারের নাম শতক প্রতি সার
কম্পোস্ট ৮০ কেজি
ইউরিয়া ৭০০ গ্রাম
টিএসপি ৭০০ গ্রাম
পটাশ ৬০০ গ্রাম
জিপসাম ৪০০ গ্রাম

 

চিচিঙ্গা চাষে পোকামাকড়ঃ
  • রেড পামকিন বিটল-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • সুড়ঙ্গকারী পোকা-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • জাব পোকা-হলুদ রং এর আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করুন।আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার / ২মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • ফলের মাছি পোকা-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

 

চিচিঙ্গা চাষে রোগবালাইঃ
  • ডাউনি মিলডিউ রোগ-ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ( যেমনঃ রিডোমিল গোল্ড ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে যেতে পারে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • পাতায় দাগ রোগ-কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক ( যেমনঃ ডিলাইট ২০ গ্রাম) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে যেতে পারে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • চিচিঙ্গার পাতা কুঁকড়ানো রোগ-বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ১০ মি.লি. ২ মুখ ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

 

চিচিঙ্গা চাষে সতর্কতাঃ

বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলুন। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যাবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করুন। বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যাবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না।

 

 

চিচিঙ্গা ফসল সংগ্রহ ও ফলন:

চারা গজানোর ৬০-৭০ দিন পর চিচিঙ্গার গাছ ফল দিতে থাকে। স্ত্রীফুলের পরাগায়নের ১০-১৩ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুই আড়াই মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে চিচিঙ্গার হেক্টর প্রতি ফলন ২০-২৫ টন (৮০-১০০ কেজি/শতাংশ)

 

চিচিঙ্গা সংরক্ষনঃ

ঠান্ডা ও বাতাস চলাচল করা জায়গাতে ফল ঘষা বা চাপ খায় না এমন ভাবে সংরক্ষণ করুন। বীজ বেশিদিন সংরক্ষণ করতে চাইলে নিমের তেল মিশিয়ে রাখতে পারেন। কিছুদিন পর পর বীজ হালকা রোদে শুকিয়ে নিবেন।

 

চিচিঙ্গা বা কইডা বা কুশি বা হইডা গ্যালারী:

পটল চাষে সফলতা পাবেন যেভাবে

পটল চাষে সফলতা নিয়ে আজকের আলোচনা। পটল একটি জনপ্রিয় উচ্চমূল্য সবজি। পটল খরিপ মৌসুমের সবজি হলেও বর্তমানে সারা বছর ধরেই পাওয়া যায়। গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে বাজারে যখন অন্যান্য সবজি কম পাওয়া যায় তখন পটল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের জলবায়ু ও আবহাওয়া পটল চাষের উপযোগী। দেশের সকল এলাকাতেই পটল চাষ করা সম্ভব।

পটল

 

পটল চাষে সফলতা পাবেন যেভাবে

যেভাবে পটল চাষে শতভাগ সফলতা পাওয়া যাবে:

পটলের জাত নির্বাচন:

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পটলের দুটি জাত আবিষ্কার করেছে। জাত দুটো উচ্চ ফলনশীল ও রোগবালাই সহ্য করতে পারে সেগুলো হলো ‘বারি পটল-১’ ও ‘বারি পটল-২’। হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০ থেকে ৩৮ টন।

বারি পটল-১:
  • আকার: ফল ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি লম্বা, বেড় প্রায় ১.৫ ইঞ্চি।
  • ওজন : প্রায় ৫৫ গ্রাম।
  • ফলন: প্রতি গাছে সর্বোচ্চ ২৪০টি ফল ধরে, যার মোট ওজন প্রায় ১০ কেজি। একর প্রতি ফলন: ১২১৪৫ কেজি বা প্রতি শতাংশে ১২০ কেজি।

 

পটল

 

 

বারি পটল-২:
  • আকার: ফল ৩.৫ থেকে ৪ ইঞ্চি লম্বা, বেড় ১.৫ থেকে ১.৭৫ ইঞ্চি।
  • ওজন: প্রায় ৫০ গ্রাম।
  • ফল: প্রতি গাছে সর্বোচ্চ ৩৮০ টি ফল ধরে, যার মোট ওজন ১৪ কেজি।
  • একর প্রতি ফলন: ১৫,৩৮৫ কেজি বা প্রতি শতাংশে ১৫০ কেজি।

 

পটলের বংশবিস্তার:

এটি কাণ্ড এবং টিউবারের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। শাখা কলমের ক্ষেত্রে পরিপক্ব কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। এদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাণ্ড মরে গেলেও শিকড় জীবিত থাকে। ফলে এই শিকড় থেকেই আবার গাছ জন্মে। রোপণের আগে পটোলের শিকড় গজিয়ে নিলে বেশি ভালো হয়।

 

পটল

 

পটল চাষের জন্য জলবায়ু ও মাটি:

উষ্ণ ও আদ্র জলবায়ু পটল চাষের জন্য বেশি তাপমাত্রা ও সূর্যালোকের প্রয়োজন। বন্যামুক্ত ও পানি জমে না এমন বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি পটল চাষের জন্য ভাল। নদীর তীরে পলিযুক্ত মাটিতেও পটল চাষ করা যায়।

পটল রোপণের সময়:

অক্টোবর থেকে নভেম্বর অথবা ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পটোল রোপণের উপযুক্ত সময়। পটোল চাষের কথা চিন্তা করলে অক্টোবর মাসের আগেই জমি তৈরি করতে হবে। মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকলে শাখা কলম শুকিয়ে মারা যায়।

পটল চাষের জন্য  জমি তৈরি ও চারা রোপণ:

প্রথমে মাটি ভালো করে চাষ দিয়ে প্রস্তুত করে নেওয়া উচিত। জমিকে ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমান করে নিতে হবে। বেড পদ্ধতিতে পটল চাষ করলে ফলন ভালো হয় এবং বর্ষাকালে ক্ষেত নষ্ট হয় না। সাধারণত একটি বেড ১.০-১.৫ মিটার চওড়া হয়। বেডের মাঝামাঝি এক মিটার থেকে দেড় মিটার বা দু’হাত থেকে তিন হাত পর পর মাদায় চারা রোপণ করতে হয়।

এক বেড থেকে আর এক বেডের মাঝে ৭৫ সেমি. নালা রাখতে হবে। মাদা বা পিট তৈরি মাদা বা পিটের আকার- দৈর্ঘ্য- ৫০ সেমি. প্রস্থ- ৫০ সেমি. গভীরতা- ৪০ সেমি. নালা- ৭৫ সেমি. মাদা থেকে মাদার দূরত্ব-১.০-১.৫ মিটার মাদায় গাছের দূরত্ব-৭.০-১০.০ সেমি. গভীরতা-৫০ সেমি. মোথার সংখ্যা ১০,০০০/হেক্টর স্ত্রী গাছপ্রতি ১০টি স্ত্রী গাছের জন্য ১টি পুরুষ গাছ সুষ্ঠু পরাগায়নের ক্ষেত্রে ১০% পুরুষ জাতের গাছ লাগানো উচিত এবং এসব গাছ ক্ষেতের সব অংশে সমানভাবে ছড়িয়ে লাগানো উচিত।

গোবর বা আবর্জনা সার ভালোভাবে পচানো দরকার। পটল দীর্ঘমেয়াদি সবজি ফসল, এ জন্য মে মাস থেকে ফসল সংগ্রহের পর প্রতি মাসে হেক্টরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি এবং ১৪ কেজি এমপি সার উপরি প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এতে ফলন বেশি হবে।

পটল চাষে সার প্রয়োগ:

মাদাপ্রতি ১.০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম খৈল, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৭০ গ্রাম টিএসপি, ১৩০ গ্রাম এমওপি, ২০ গ্রাম বোরন সার এবং ১৫০ গ্রাম জিপসাম সার রোপণের সময় প্রয়োগ করা হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফুল ধরা কমে গেলে সে ক্ষেত্রে মাদাপ্রতি ৫০০ গ্রাম গোবর সার, ৭০ গ্রাম ইউরিয়া, ৯০ গ্রাম টিএসপি, ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করলে ফলন অনেক বেড়ে যায়।

পটল চাষে ফসল সংগ্রহ:

কচি অবস্থায় সকাল অথবা বিকালে পটল সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত জাতভেদে ফুল ফোটার ১০-১২ দিনের মধ্যে পটল সংগ্রহের উপযোগী হয়।

এ ছাড়া পটলের পোকামাকড় রোগ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে হবে।

 

লেবু চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা

লেবু চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজকের আলোচনা। লেবু চাষ করা হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। লেবু সাইট্রাস জাতীয় ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ একটি ফল। খাবার টেবিলে এবং সালাদে লেবু ছাড়া তো ভাবাই যায় না। এর স্বাদ বৃদ্ধির ভূমিকা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিশেষ খাদ্যগুণ। বিশেষ করে পাতি লেবুকে ‘সি’ ভিটামিনের ডিপো বলা হয়ে থাকে। গরমে ঠাণ্ডা এক গ্লাস লেবুর সরবত মুহূর্তে ক্লান্তি দূর করে। ছোট-বড় সবার জন্য লেবু এক আশ্চর্য গুণসম্পন্ন সবজি এবং ভেষজ। আমাদের দেশে শতকরা ৯১ জন লোক ভিটামিন ‘সি’র অভাবে ভুগছেন। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক গড়ে ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ খাওয়া দরকার। ভিটামিন ’সি’ সমৃদ্ধ ফলের মধ্যে লেবুই একমাত্র ফল যা সারা বছর কম বেশি পাওয়া যায়।

লেবু চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা

পুষ্টি মূল্য:

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ।

ভেষজ গুণ:

লেবুর রস মধু বা আদা বা লবণের সাথে মিশিয়ে পান করলে ঠাণ্ডা ও সর্দি কাশি উপশম হয়।

উপযুক্ত জমি ও মাটি:

হালকা দোআঁশ ও নিকাশ সম্পন্ন মধ্যম অম্লীয় মাটিতে লেবু ভালো হয়।

লেবুর জাত পরিচিতি:

লেবুর অনেক জাত আছে। তন্মধ্যে পাতিলেবু, কাগজি লেবু, এলাচি লেবু, সিডলেস লেবু, সরবতি লেবু, বাতাবিলেবু, কমলালেবু ও মাল্টা লেবু উল্লেখযোগ্য। তবে কমলালেবু পাহাড়ি এলাকায় জন্মে। বাকিগুলো সমভূমিতেই জন্মে। এছাড়াও নিম্নে আরও কিছু জাতের কথা উল্লেখ করা হলো-

বারি লেবু-১ (এলাচি লেবু):

উচ্চ ফলনশীল লেবু বারি লেবু-১। ঘ্রাণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। গাছ আকারে বড়।পাতা বড় ও প্রশস্ত। পরিচর্যা পেলে গাছ বছরে দু’বার ফল দেয়। জুলাই-আগস্ট মাসে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। পূর্ণবয়স্ক গাছ ১৫০টি পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে। আকারে বড়, ডিম্বাকৃতি এবং প্রতিটি ফলের গড় ওজন ১৯৫ থেকে ২৬০ গ্রাম। বৃহত্তর সিলেট এবং আরও অনেক এলাকায় এলাচি লেবুর খোসা খাওয়া হয়।

বারি লেবু-২:

বারি লেবু-২ উচ্চ ফলনশীল জাত। মধ্যম আকৃতির ও ঝোপের মতো গাছ। সারা বছর প্রচুর ফল দেয়। ফল গোলাকার, মধ্যম ওজনের। ত্বক মসৃণ এবং বীজের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এই লেবু সারা দেশেই চাষাবাদের উপযোগী।

বারি লেবু-৩:

একটি দেরীতে হওয়া (নাবি) জাত বারি লেবু-৩। গাছ ও পাতা ছোট আকৃতির। ফল গোলাকার ও ছোট। ত্বক খুবই মসৃণ, খোসা পাতলা এবং বীজের সংখ্যাও কম ১৮-২২টি। রসের পরিমাণ খুব বেশি (৩৭.৭%)। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। সার ও পানির ব্যবস্থা করলে বছরে দু’বার ফল পাওয়া যায়। সারা দেশেই চাষাবাদের জন্য উপযোগী।

লেবুর চারা রোপণ:

গুটি কলম ও কাটিং তৈরি করে মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য আশ্বিন মাসে ২.৫ মিটার দূরে দূরে রোপণ করা হয়। মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য আশ্বিন মাস চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত।

সার ব্যবস্থাপনা: প্রতি গাছে টিএসপি সার ৪০০ গ্রাম, এমওপি সার ৪০০ গ্রাম, ইউরিয়া সার ৫০০ গ্রাম ও গোবর ১৫ কেজি প্রয়োগ করতে হয়। সার তিনভাগে যার প্রথম কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে, ২য় কিস্তি মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন মাসে এবং ৩য় কিস্তি মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য আষাঢ় মাসে প্রয়োগ করতে হয়।

অঙ্গ ছাঁটাই: প্রতি বছর মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে গাছের অবাঞ্ছিত শাখা ছাঁটাই করতে হয়।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা: খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ দেওয়া দরকার। পানি যাতে না জমে থাকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।

লেবুর পোকা মাকড় দমন ব্যবস্থাপনা

লেবুর প্রজাপতি পোকা:

ক্ষতির ধরন:

এ পোকার কীড়া পাতার কিনারা থেকে খেতে শুরু করে এবং সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে।

প্রতিকার:

ডিম ও কীড়াযুক্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটির নীচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হয়। আক্রমণ বেশি হলে ডাইমেক্রন ১০০ ইসি ১ মিলি অথবা সেভিন ৮৫ এসপি ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হয়।

লেবুর লাল ক্ষুদ্র মাকড়:

লক্ষণ:

মাইট লেবু গাছের পাতা ও ফলের সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ফলের গায়ে সাদা আবরণ দেখা যায়। পাতার নীচের দিকে লক্ষ্য করলে ক্ষুদ্র মাইট চলাচল করতে দেখা যায়।

প্রতিকার:

মাকড়সহ আক্রান্ত পাতা তুলে ধ্বংস করা। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ইথিয়ন ৪৬.৫ তরল বা নিউরন ৫০০ তরল মিশিয়ে লেবুর পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করা।

লেবুর ফসল সংগ্রহ:

ফল পূর্ণতা প্রাপ্তি হলে সবুজ থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করতে হবে।

লেবুর ব্যবহার:

লেবুর কদর সাধারণত তার রসের জন্য। এর শাঁস এবং খোসাও ব্যবহার হয় বিভিন্ন কাজে। কিন্তু প্রধানত সর্বত্র লেবুর রসই ব্যবহৃত হয়। লেবু পছন্দ করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

লেবুর অনেক আছে গুণ। ১০০ গ্রাম লেবুতে প্রায় ৫৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি বা এসকরিক এসিড পাওয়া যায়। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধকারী কোষের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। শরীরের কোনও অংশ কেটে গেলে বা ক্ষত হলে দ্রুতগতিতে কোলাজেন কোষ উপাদান তৈরি করে ক্ষত নিরাময়েও সাহায্য করে এই ভিটামিন সি।

লেবুর সাইট্রিক এসিড ক্যালসিয়াম নির্গমন হ্রাস করে পাথুরি রোগ প্রতিহত করতে পারে। জ্বরে কোনকিছুই যখন খেতে ভালো লাগে না তখন একমাত্র লেবুই ভরসা। লেবু হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। রূপচর্চায় লেবুর ব্যবহার অনেক আগে থেকেই।

কাপড়ে দাগ পড়লে লেবুর রস দিয়ে ঘষলে দাগ উঠে যায়। বয়সজনিত মুখের দাগ সারাতে লেবুর রস কার্যকরী। লেবুর রস ব্যবহারে মুখের ব্রণও সারে। লেবু দেহের ওজন কমায়। লেবুর মধ্যে এমন পদার্থ আছে যা কিনা শরীরের অতিরিক্ত মেদকে জ্বালিয়ে দেয়। ফলে রোগ সংক্রমণও কমে যায়।

বাড়ির ছাদ বা টবে লেবু চাষ:

বাড়ির ছাদ এমনকি বারান্দায় ছোট টবেও এর চাষ সম্ভব। দুইভাগ দোঁ-আশ বা বেলে দোঁ-আশ মাটির সাথে একভাগ গোবর মিশাতে হবে। একটি বার ইঞ্চি টবের জন্য ৫০ গ্রাম টিএসপি, ৫০ গ্রাম পটাশ, ১০ গ্রাম চুন এবং ১৫০ গ্রাম হাড়ের গুড়া একত্রে মিশিয়ে ১২-১৫ দিন রেখে দিতে হবে। তারপর একটি লেবুর কলমের চারা ঐ টবে রোপণ করতে হবে। লেবুতে সাধারণত ডাইব্যাক নামক এক ধরনের রোগ দেখা যায়। তাই কলমের চারাটি যাতে রোগাক্রান্ত না থাকে তা দেখে নিতে হবে। লেবু জাতীয় সকল গাছেই সাধারণত পানি খুব কম প্রয়োজন হয়। চারা লাগানোর প্রথমদিকে পানি আরও কম দিতে হয়।

লেবুর পরিচর্যা:

চারা লাগানোর পর প্রথম ২-৩ মাস পানি দেওয়া এবং আগাছা পরিষ্কার করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে হবে না। গাছ একটু বড় হলে ২০ দিন অন্তর অন্তর সরিষার খৈল পচা পানি হালকা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে লেবু গাছে ফল ধরবে। বর্ষা আসার পূর্বে সাতদিন অন্তর অন্তর কয়েকবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে ভাল হয়।

এ ছাড়াও বছরে তিন থেকে চার বার কোন ভাল কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। তবে লেবু গাছে ফুল থাকা অবস্থাতে কীটনাশক স্প্রে না করাই ভাল। গাছ লাগানোর দুই বছর পর থেকে প্রতি বছর বর্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে টবের গা ঘেঁষে দুই ইঞ্চি পরিমাণ প্রস্থে এবং ছয় থেকে আট ইঞ্চি গভীর করে মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিতে হবে। আমাদের দেশের আবহাওয়া লেবু চাষের উপযোগী। বিশেষ করে টবে লেবুর ফলন খুব ভাল হয় এবং অতি সহজেই।

লেবুতে কলম:

লেবুতে বিভিন্ন ধরনের কলম হলেও সাধারণত গুটি কলমই বেশি জনপ্রিয়। খুব সহজেই লেবুর গুটিকলম করা যায়। গুটিকলম করতে হয় বর্ষাকালে। গুটিকলমের জন্য একটি একবছর বয়সী পেন্সিলের মত মোটা ডাল নির্বাচন করতে হবে। ডালের ডগা থেকে এক ফুট নিচে একটা গাঁটের গোঁড়ায় এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাল ডাল থেকে তুলতে হবে। কাঠের মধ্যে যে পিচ্ছিল পদার্থ বিদ্যমান তা একটি শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলতে হবে।

পরবর্তীতে গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ঐ জায়গা ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। তবে মাটি অবশ্যই কাদামাটির মত নরম করে নিতে হবে। একটি মোটা পলিথিন দিয়ে ঐ জায়গাটুকু ভালোভাবে ঢেকে দুই দিকের মাথা সুতলি দিয়ে শক্ত করে এমনভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন ভেতরে আলো-বাতাস না ঢুকে। এক মাসের মধ্যেই শিকড় গজিয়ে যায়। কিন্তু কাটার উপযোগী হয় আরও এক মাস পর।

বায়োফ্লকে মাছ চাষে কম খরচে অধিক লাভ

বায়োফ্লকে মাছ চাষে কম খরচে অধিক লাভ , কমছে ভূমি, বাড়ছে মানুষ। ভূমি আর জনসংখ্যার এই ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্কের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানুষের ক্ষুধা, কমছে ভূমির সক্ষমতা।  ‘স্বল্প জমিতে অধিক উৎপাদন’ সফল করতে গিয়ে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানকে। বাড়তি মানুষের বাস্তুভিটার চাপ সামলাতে গিয়ে বন-জঙ্গল তো বহু আগেই কাটা গেছে; আধুনিক পৃথিবীতে হারাতে বসেছে গ্রামের সংজ্ঞায়নও। ভরাট হয়ে যাচ্ছে ফসলী জমি, খেলার মাঠ, খাল-বিল-পুকুর! রূপকথায় ঠাঁই পেতেছে গোলায় ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের সোনালী সময়টাও।

বায়োফ্লকে মাছ চাষে কম খরচে অধিক লাভ

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]

তবে, অধুনা যুগের কৃষি সংকটকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কার্যকর একটি উপায় হতে পারে বায়োফ্লক। মাছ চাষের জন্য পুকুর লাগবেই এমন কোনও কথা নেই। তার জন্য চাই কেবল উপযুক্ত জলাধার। বায়োফ্লকের ব্যাতিক্রমী এই ধারণাকে খাটিয়েই মাছ চাষ এখন ঢুকে গেছে মানুষের ঘরে। নির্দিষ্ট কলাকৌশল আর প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ঘরের ভিতর চৌবাচ্চাতে চাষ করা যাচ্ছে মাছ।

একদিকে খরচ কমে যাচ্ছে তিন ভাগের এক ভাগ, আরেকদিকে উৎপাদনও হচ্ছে ২০ গুণ বেশি। বাড়ির ভেতরে এ্যাকুরিয়ামে শখের বশে আমরা যে মাছ পালন করি, সেই এ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতিরই উন্নত সংস্করণ হচ্ছে নতুন এই প্রযুক্তি। ‘বায়োফ্লক’ ব্যবহার করে অল্প জমিতে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব।

প্রযুক্তিটির জনক ইজরায়েলি বিজ্ঞানী ইয়ান এভনিমেলেচ। এবার বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক, কি এই বায়োফ্লক আর কিভাবেই বা এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে সম্ভব অধিক লাভবান হওয়া।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]

বায়ো শব্দটি এসেছে গ্রীক বায়োস থেকে, যার অর্থ জীবন। আর ফ্লক অর্থ হচ্ছে আলতোভাবে লেগে থাকা কণার সমষ্টি। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে জৈব বর্জ্যের পুষ্টি থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য খাবার তৈরি করা হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বায়োফ্লক প্রযুক্তি মাছ চাষের একটি টেকসই এবং পরিবেশগত ভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি  পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চৌবাচ্চার পানিতে ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ও শৈবালের সমম্বয়ে পাতলা একটি আস্তরণ তৈরি হয়।

যা পানিকে ফিল্টার করে পানি থেকে নাইট্রোজেন জাতীয় ক্ষতিকর উপাদানগুলি শোষণ করে নেয় এবং এর প্রোটিন সমৃদ্ধ যে উপাদান গুলো থাকে সেগুলো মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অনুজীব মুলত দুটি প্রধান ভূমিকা পালন করে-

  • অণুজীব পানিতে বিদ্যমান নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ যৌগ গুলোকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিনে রূপান্তর করার মাধ্যমে পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখে।
  • এই প্রযুক্তি খাদ্য রূপান্তর হার এবং মাছ চাষে খাদ্য ব্যয় কমিয়ে চাষের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি করে।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]

একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক এই ব্যাতিক্রমী প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করতে গেলে অবশ্যই জানতে হবে কার্যকর উপায়ে ফ্লক তৈরির কলাকৌশল। আর এই ফ্লক তৈরিতে লাগবে চৌবাচ্চা বা ট্যাংক বা হাউজ, লোহার খাঁচা, ত্রিপল, আউটলেট, টিডিএস মিটার, পিএইচ মিটার, অ্যামোনিয়াম টেস্ট কিড, অক্সিজেনের জন্য মটর, বিদ্যুৎ, মাছের পোনা, খাদ্য ও প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি।

বায়োফ্লকের জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের ট্যাংকই চাইলে তৈরি করা যায়। ইট সিমেন্ট দিয়ে কিংবা স্টিলের পাত দিয়ে কিভাবে স্থায়ী ট্যাংক তৈরি করতে হয় সেটা সবাই জানেন। এখানে আমরা জানবো কিভাবে অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচে ত্রিপল দিয়ে অস্থায়ী ট্যাংক তৈরি করতে হয়। এর জন্য প্রথমে গ্রেড রড দিয়ে ট্যাংকের বৃত্তাকার খাঁচাটি তৈরি করতে হবে। তারপর যে স্থানে ট্যাংকটি স্থাপন করা হবে সেই জায়গাতে খাঁচার পরিধির সমান করে সিসি ঢালাই দিতে হবে। বৃত্তের ঠিক কেন্দ্রে পানির একটি আউটলেট পাইপ স্থাপন করতে হবে।

এরপর খাঁচাটিকে ঢালাই মেঝের উপর স্থাপন করে মাটিতে গেঁথে দিতে হবে। মেঝের মাটি শক্ত ও সমান হলে ঢালাইয়ের পরিবর্তে পরিধির সমান করে পুরু পলিথিন বিছিয়েও মেঝে প্রস্তুত করা যায়। এরপর উন্নতমানের তারপুলিন বা ত্রিপল দিয়ে সম্পূর্ণ খাঁচাটি ঢেকে দিতে হবে। তার উপর পুরু পলিথিন দিয়ে আচ্ছাদিত করে তাতে পানি মজুদ করতে হবে।

জানা জরুরী ৩০০০ লিটার পানি ধারনের জন্য ট্যাংকের সাইজ হবে ৬ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ৫০০০ লিটারের জন্য ৮ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ৭৫০০ লিটারের জন্য ১০ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ১০০০০ লিটারের জন্য ১৩ ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা।

তারপর ট্যাংকের সঙ্গে এয়ার পাম্পের সংযোগ ঘটাতে হবে পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য। প্রতি ১০ হাজার লিটার পানির জন্য ৭০ থেকে ৮০ ওয়াটের এয়ার পাম্প লাগবে; সেইসঙ্গে ৮ থেকে ১০টি এয়ার স্টোন প্রয়োজন হবে।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]

স্থায়ী বা অস্থায়ী; যেমন ট্যাংকই হোক না কেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের পরবর্তী ধাপ শুরু হয় চাষের ট্যাংকে পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। প্রথমে ট্যাংক ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এর পর নির্বাচিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পানি প্রবেশ করাতে হবে। এরপর পানিতে আয়রনের মাত্রা ০.২ পিপিএম এর বেশি হলে পানি থেকে আয়রন দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। আয়রন দূর করার জন্য প্রতি টন পানিতে ২৫- ৩০ পিপিএম হারে ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগের পর ১০ – ১২ ঘন্টা একটানা বাতাস সরবরাহ করতে হবে।

তারপর ৫০ পিপিএম হারে ফিটকিরি প্রয়োগ করে আরও ১২ ঘন্টা পানিতে অনবরত বাতাস সরবরাহ করতে হবে। ২৪ ঘন্টা পর পানিতে ১০০  হারে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ( CaCO3) চুন প্রয়োগ করে বাতাস সরবরাহ নিয়মিত করতে হবে। এরপর নির্বাচিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পানি প্রবেশ করাতে হবে। এসময় পানির যে গুনাবলীর দিকে নজর রাখতে হবে সেগুলো হলো-

  • তাপমাত্রা থাকতে হবে ২৫ – ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে
  • পানির রং – সবুজ, হালকা সবুজ, বাদামী হলে চলবে
  • দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান প্রতি লিটারে ৭- ৮ মিলিগ্রাম থাকতে হবে
  • পিএইচ হতে হবে ৭.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে
  • ক্ষারত্ব থাকতে হবে প্রতি লিটারে ৫০ – ১২০ মিলিগ্রাম
  • খরতা প্রতি লিটারে ৬০ – ১৫০ মিলিগ্রাম
  • ক্যালসিয়াম প্রতি লিটারে ৪ – ১৬০ মিলিগ্রাম
  • অ্যামোনিয়া প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম
  • নাইট্রাইট প্রতি লিটারে ০.১ – ০.২ মিলিগ্রাম
  • নাইট্রেট প্রতি লিটারে ০ – ৩ মিলিগ্রাম
  • ফসফরাস প্রতি লিটারে ০.১ – ৩ মিলিগ্রাম
  • হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S) প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম
  • আয়রন প্রতি লিটারে০.১ – ০.২ মিলিগ্রাম
  • পানির স্বচ্ছতা ২৫ – ৩৫ সে.মি.
  • পানির গভীরতা – ৩ থেকে ৪ ফুট
  • ফলকের ঘনত্ব – ৩০০ গ্রাম / টন
  • টিডিএস প্রতি লিটারে ১৪০০০ – ১৮০০০ মিলিগ্রাম
  • লবণাক্ততা – ৩ – ৫ পিপিটি

এ তো গেল মাছের জন্য জলাধার নির্মাণের খেলা। এবার তার বাঁচা ও বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত জলজ পরিবেশ, অর্থাৎ ফ্লক তৈরির পালা। পানিতে ফ্লক তৈরির জন্য প্রথমে চাষ ট্যাংকের ১২ ভাগের ১ ভাগ পানি নিয়ে সেই পানিতে ১০০০ পিপিএম হারে আয়োডিনবিহীন লবণ প্রয়োগ করতে হবে। লবণ প্রয়োগের পর টিডিএস পরীক্ষা করে নিতে হবে। বায়োফ্লকের জন্য ১৪০০ – ১৮০০ পিপিএম, টিডিএস থাকা ভাল।

যদি লবণ প্রয়োগের পর কাঙ্খিত টিডিএস পাওয়া না যায়, তা হলে কম পরিমাণ লবণ প্রয়োগ করে আদর্শ মাত্রায় টিডিএস রাখতে হবে। এরপর প্রথম ডোজে ৫ পিপিএম প্রেবায়োটিক, ৫০ পিপিএম চিটাগুড়, ৫ পিপিএম ইস্ট, পানি প্রতি টনের জন্য ১ লিটার, একটি প্লাস্টিকের বালতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে ৮- ১০ ঘন্টা কালচার করে প্রয়োগ করতে হবে। ২য় দিন থেকে ১ পিপিএম প্রোবায়োটিক, ৫ পিপিএম চিটাগুড়, ১ পিপিএম ইস্ট, প্রতি টনের জন্য ১ লিটার পানি দিয়ে কালচার করে প্রতি দিন প্রয়োগ করতে হবে।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]

পানিতে যথাযথ পরিমাণ ফ্লক তৈরি হলো কিনা সেটা বুঝতে কিছু ব্যাপার নজরে রাখতে হবে। যেমন-

  • পানির রং যেন সবুজ বা বাদামী দেখায়।
  • পানিতে যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ কণা দেখা যায়।
  • পানির অ্যামোনিয়া পরীক্ষা করলে যেন পানি অ্যামোনিয়া মুক্ত দেখায়।
  • প্রতি লিটার পানিতে ফ্লকের ঘনত্ব যেন ০.৩ গ্রাম পাওয়া যায়।
  • ক্ষুদেপানা দেওয়ার পর তাদের যেন ঠিকঠাক বংশবিস্তার হয়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]

এইভাবে বায়োফ্লক তৈরি করে চাষ করা যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ । কিন্তু আমাদের দেশে সচরাচর যেসব মাছ চাষ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা, চিংড়ি প্রভৃতি। তবে, যারা বায়োফ্লক প্রযুক্তিটি প্রথমবারের মত ব্যবহার করতে যাচ্ছেন তারা অবশ্যই প্রথমে তেলাপিয়া, শিং ও মাগুর মাছ দিয়ে চাষ শুরু করবেন। অন্যান্য দেশে অবশ্য তেলাপিয়া ও চিংড়িই মূলত বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। বায়োফ্লকে চাষকৃত মাছের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছটির নাম  চিংড়ি।

বায়োফ্লকে পুকুরের চেয়ে মাছের খাদ্য খরচ ৩০ শতাংশ কম লাগে। মাছ চাষে মুলত শতকরা ৬০ ভাগ খরচই খাবারের জন্য ব্যয় হয়। এই পদ্ধতিতে সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া ট্যাংকেই অণুজীব প্রোটিন তৈরি করে, তাই এ পদ্ধতিতে অন্যান্য সিস্টেমের চেয়ে অনেক কম খাবার লাগে। ফলে চাষের খরচ কমে যায় এবং লাভ হয় বেশি। তাছাড়া পুকুরের সমপরিমাণ জায়গায় বায়োফ্লকে অন্তত ২০ গুণ বেশি মাছ চাষ করা যায়। অর্থাৎ কম জায়গা ব্যবহার করে অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন সম্ভব এই পদ্ধতিতে।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]

বায়োফ্লকে মাছের রোগবালাই হয় খুবই কম। এই পদ্ধতিতে প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপকারি ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া) ব্যবহার করা হয় বলে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে পুরো সিস্টেমকে প্রদান করা সম্ভব হয় উচ্চ বায়োসিকিউরিটি। ফ্লকে ব্যবহৃত এসব উপকারি ব্যাকটেরিয়া মাছের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে বৃদ্ধি পেতে বাধা প্রদান করে

 

ফলে ঐসব ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ থেকে রক্ষা পায় মাছ। তাই উন্নত এই প্রযুক্তিতে মৎস্য খামারকে রক্ষা করা সম্ভব হয় রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে। শুধু কি তাই? এটি স্বীকৃতভাবে পরিবেশবান্ধব একটি মাছ চাষ পদ্ধতি। কারণ এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন নেই বললেই চলে।

মাশরুম চাষে হতে পারেন সফল

জমি না থাকলেও মাশরুম চাষে হতে পারেন সফল , প্রকৃতি আমাদের উদ্ভিদ আকারে অনেক ধরনের খাদ্য উপাদান দিয়েছে। মাশরুম তার মধ্যে অন্যতম। খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ অত্যন্ত স্বাস্থ্যপ্রদ একটি খাবার ছত্রাক জাতীয় এই উদ্ভিদটি।

মাশরুম চাষে হতে পারেন সফল

মাশরুমের পুষ্টিমান তুলনামূলকভাবে অত্যধিক এবং এর প্রোটিন অতি উন্নতমানের ,যা মানব দেহের জন্য অতিশয় দরকারি। একটি পরিপূর্ণ  প্রোটিনের পূর্বশর্ত হলো মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ৯টি অ্যাসিডের  উপস্থিতি। মাশরুমে অতীব প্রয়োজনীয় এই ৯টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের সবকটিই বিদ্যমান মাশরুমের মধ্যে। পাশাপাশি এর আছে নানা ঔষধি গুণাগুণ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের মতো জটিল বহু রোগের মহৌষধ প্রাচীন এই উদ্ভিদটি।

যে কারণে স্বাস্থ্যসচেতন লোকদের খাবারের তালিকায় একেবারে শীর্ষে থাকে মাশরুমের নাম। মাত্র বছর কয়েক আগেও একে বিদেশি একটি খাবার মনে করা হলেও স্বাদ, পুষ্টি ও ঔষধিগুণের জন্য আমাদের দেশেও দিন দিন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বহু ভেষজ গুণসম্পন্ন খাবারটি। দেশেই এখন চাষ হচ্ছে কয়েক প্রজাতির উন্নত জাতের মাশরুম।

শুধু কি পুষ্টিগুণই মাশরুমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির একমাত্র কারণ? বাংলাদেশে জমির অপ্রতুলতা, বেকারত্ব, পুষ্টিহীনতা, মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বহুমুখী বিষয় বিবেচনায় সম্ভাবনাময় একটি ফসল এই মাশরুম । এদেশের আবহাওয়াও মাশরুম চাষের জন্য অত্যান্ত উপযোগী। ছাত্রাক জাতীয় এই উদ্ভিদটি চাষের জন্য কোনো উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় দেশে মাশরুম উৎপাদন যতই বাড়ানো হোক না কেন তাতে কোনো ফসলেরই উৎপাদন কমার সম্ভাবনা নেই।

এক প্রকারের ছত্রাক হওয়ায় অন্যান্য উদ্ভিদের মতো নিজের খাবার তৈরির জন্য সূর্যের আলোর প্র্যোজন পড়ে না মাশরুমের। ফলে ঘরের ভেতরেও এর চাষ করা যায়।  যার মোটেই চাষের জমি নেই তিনিও বসত ঘরের পাশের অব্যবহৃত জায়গায় অনেক পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করতে পারেন। এজন্য ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে  মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষই চাষ করতে পারেন এটি। গ্রাম-গঞ্জে, শহরে এমনকি অতিমাত্রায় বিলাসিদের প্রাসাদেও সহজেই স্থান করে নিতে পারে খাবারটি।

মাশরুম চাষ করতে বেশি টাকা খরচ করতে হয়না। ছোট একটু জায়গাতেও এর চাষ করা সম্ভব। সঠিক ভাবে মাশরুম উৎপাদন পদ্ধতি জানা থাকলে এই চাষ এবং ব্যবসা করে প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব। কেননা দেশের বাজারে মাশরুমের চাহিদা এখন অনেক বেশি।

তাই কেউ যদি একজন কৃষিপ্রেমী হয়ে থাকেন এবং কম টাকা বিনিয়োগ করে লাভজনক ব্যবসা শুরু করতে চায়, মাশরুম চাষ হতে পারে তার জন্য ভালো একটি অপশন।

 

 

মাশরুম প্রকৃত অর্থে কোন উদ্ভিদ বা বনস্পতি গাছ নয়। যদিও সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে একে উদ্ভিদজাতীয় প্রজাতি হিসাবেই ধরা হয়ে থাকে কিংবা ধরা যায়। অনেক সময় কিছু স্যাঁতসেঁতে ছায়াযুক্ত স্থানে ছাতার আকৃতির সাদা ও বাদামী রঙের এক ধরণের ছত্রাক জন্মাতে দেখা যায়। এগুলোকেই মাশরুম বলা হয়ে থাকে, যদিও এইগুলো খাওয়ার যোগ্য হয়না। খাওয়ার জন্য যে মাশরুম রয়েছে সেটা আলাদা এবং সেই খাওয়ার মাশরুম বিশেষভাবে চাষ করেই উৎপাদন করতে হয়।

বর্তমান সময়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে মাশরুমের অনেক চাহিদা রয়েছে, বিশেষ করে বিদেশি বাজারে এর চাহিদা প্রচুর। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, চাইনিজ-ইতালিয়ানসহ বিভিন্ন ডিসে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করার জন্য মাশরুমের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই গ্রাহকদের খাওয়ার উপযোগী করে তোলার জন্য এবং গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করার জন্য আলাদা রকমের মাশরুম উৎপাদন করা হয়।

পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির ছত্রাক দেখতে পাওয়া যায় । সেগুলোর মধ্যে যেসব ছত্রাক মানুষের খাওয়ার জন্য উপযোগী, বিষমুক্ত এবং পুষ্টিকর সেগুলোকেই মাশরুমের শ্রেণীতে ধরা হয়ে থাকে। সে হিসেবে ওয়েস্টার, মিল্কি, বাটন, শীতাকে, পেডিস্ট্রও নামক মাত্র পাঁচ প্রজাতির মাশরুম কৃত্রিমভাবে চাষের উপযোগী। আমাদের দেশের জলবায়ুতে তিনটি প্রজাতিকে অধিক উপযুক্ত মানা হয়ে থাকে এবং সেগুলো হলো ওয়েস্টার মাশরুম, মিল্কি মাশরুম এবং বাটন মাশরুম।

মাশরুম চাষে প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ

 এমনিতে চাইলে মাশরুমের চাষ যে কেউ চাইলে নিজের ঘর থেকেও শুরু করতে পারবেন। এটা একটি অনেক লাভজনক ঘোরোয়া ব্যবসার আইডিয়া। সাধারণত প্রতি বর্গ মিটারে ১০ কেজি মাশরুম চাষ করা যায়। ঘরের ছাদে বা ছায়াযুক্ত কোনো খালি ঘরে মাশরুম উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।

এছাড়া বড় স্তরে এর চাষ শুরু করতে চাইলে জমিতে বা ঘরের বাইরে মাশরুমের চাষ হতে পারে। সেক্ষেত্রে সেখানে কাঠ এবং ছন বা বাঁশের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করে নিতে হবে এবং হাওয়া বাতাস যাতে ঢুকতে না পারে তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারণ সূর্য্যের আলো পড়লে কিংবা বাইরের হাওয়া বাতাস ঢুকলে মাশরুম খারাপ হয়ে যাবে।

মাশরুম চাষে খরচ

কেউ যদি ছোটস্তরে মাশরুমের চাষ শুরু করতে চান তাহলে তার ১৫-৩০ হাজার টাকার প্রয়োজন হবে। আগ্রহী চাষি যদি ঘর থেকে শুরু করেন এবং সেই ঘর গ্রাম এলাকায় হয় তাহলে এক্ষেত্রে খরচ আরও কিছুটা কম হবে।

কারণ মাশরুম চাষ করার জন্য ব্যবহার হওয়া বাঁশ, ছন, গমের ভুসি, শুকনো খড়, কাঠ ইত্যাদি সামগ্রীগুলো গ্রাম এলাকায় সহজেই পাওয়া যায়। এছাড়াও বড়স্তরে মাশরুম উৎপাদন শুরু করতে চাইলে এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে সক্ষমতা অনুযায়ী বিনিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে।

মাশরুম চাষের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়  সামগ্রী – 

১. গমের ভুসি

২. মাশরুম বীজ

৩. খড় ভেজানোর জন্য ড্রাম বা মাটির গামলা

৪. ধানের শুকনো খড়

৫. পলিথিন ব্যাগ

৬. মাশরুম কাটার ছুরি

৭. জলের স্প্রে

কম্পোস্ট তৈরির পদ্ধতি

 মাশরুম চাষ করার জন্য প্রথমে কম্পোস্ট খাদ তৈরি করে নেওয়া আবশ্যক।

কেননা এই চাষ সঠিক এবং সফল ভাবে করার জন্য কম্পোস্ট খাদ এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কম্পোস্ট বানানোর জন্য ধানের শুকনো খৈল, গমের ভূসি, শস্যের খৈল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

কপোস্ট তৈরি করার জন্য  একটি বড় পাত্রে বা ড্রামে ১৫০০ লিটার পানিতে ১.৫ কেজি ফরমালিন এবং ১৫০ গ্রাম বেভিস্টিন মেশাতে হবে। এরপর এক কুইন্টাল এবং ৫০ কেজি গমের ভূষি ও ধানের ভূষি ভিজিয়ে দিয়ে ভালো করে মেশাতে হবে এই মিশ্রনে।

তারপর মিশ্রনটিকে কিছু সময় প্লাস্টিকের ত্রিপাল দিয়ে ভালো করে ঢেকে রাখতে হবে যাতে মিশ্রণটি জীবাণুমুক্ত হয়ে থাকে এবং বাইরের হাওয়া বাতাস ঢুকে রাসায়নের গুণাগুণ নষ্ট করতে না পারে।

মাশরুমের বীজ সংগ্রহ

 এমনিতে মাশরুমের বীজ গুলোকে Mushroom Spawnও বলা হয়। আজকাল অনলাইনে বিভিন্ন ই-কমার্স মার্কেটপ্লেসগুলোতে সহজেই মাশরুমের বীজ কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া বীজের দোকান কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মাশরুম বীজ কিনতে পাওয়া যায়। প্রতি কেজি মাশরুম বীজের দাম ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা হতে পারে।

মাশরুমের বীজ রোপণের প্রক্রিয়া

 ভূষির মিশ্রণ তৈরি করার পর বীজ লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাশরুম রোপন করার আগে ভেজানো ভূষি বাইরের বাতাসে কোনো খোলা জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হয় যাতে ভুষিতে সিক্তভাব না থাকে। এরপর পলিথিন ব্যাগের ভিতরে প্রথমে ভূষি ভরতে হয়। তারপর মাশরুমের বীজ ভালো করে ছড়াতে হয়। এবার আবার ছড়ানো বীজের ওপরে কিছু ভূষি দিয়ে দিতে হবে এবং তার ওপরে মাশরুম এর বীজ  আবার ছড়াতে হবে।  এই প্রক্রিয়াটি অন্তত ৪ বার করতে হয়। মাশরুম উৎপাদনের জন্য প্রতি ৩ কেজি ভূষির মিশ্রনে ১০০ গ্রাম বীজ লাগানো যায়। এরপর পলিথিন ব্যাগে ১৫-২০টি ছিদ্র বানিয়ে দিতে হয় যাতে অতিরিক্ত জল ঝরে পড়ে যেতে পারে। যে জায়গায় মাশরুম উৎপাদন করতে চাচ্ছেন সে স্থানে পলিথিন ব্যাগ গুলো রেখে দিতে হয়।

মনে রাখতে হবে, পলিথিন ব্যাগগুলো এমন একটি জায়গায় রাখা দরকার যেখানে হাওয়া বাতাস লাগার সুযোগ অনেক কম। যতদিন এই ছত্রাক তৈরি হয়ে কাটার উপযোগী না হয় ভূষির সিক্তভাব বজায় রাখার জন্য পানি স্প্রে করে যেতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকারের মাশরুমের রোপন পদ্ধতিতে সামান্য পার্থক্য থাকে।

মাশরুমকে হাওয়া বাতাস থেকে বাঁচানোর উপায়  

 মাশরুম চাষের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ বিষয়ে সতর্কতা খুবই জরুরী। মাশরুম যেহেতু একধরনের ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ তাই  চাষের স্থানটি ছায়াযুক্ত হওয়া দরকার। সে স্থানে যাতে বাইরের কোনো রকম হাওয়া বাতাস কিংবা সূর্য্যের আলো না ঢুকে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

তাই চাষের শুরুর দিকে হাওয়া বাতাস থেকে বাঁচানোর জন্য ভূষি ভরা পলিথিন ব্যাগগুলো ঘরে ১৫ -২০ দিনের জন্য রুদ্ধ অবস্থায় রাখতে হবে।

১৫ দিন পর হাওয়া লেগে থাকলেও কোনো ভয় নেই। তাই ১৫ দিন পরেই ঘরের দরজা খোলা যাবে।

১৫-২০ দিন যাওয়ার পর ঘরটি খুলে দিলে দেখা যাবে ভূষির উপর সাদা রঙের ছত্রাকের জাল ছড়িয়ে রয়েছে। এই সময় মাশরুম উৎপাদনের স্থানে যেন হাওয়া দেওয়া যায় তাই একটি ফ্যান এর ব্যবস্থা করে রাখা দরকার।

মাশরুম এর ফসল কাটার সময়

 এমনিতে মাশরুম এর ফসল সম্পূর্ণভাবে তৈরি হতে ৩০ থেকে ৪০ দিনের সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে ফসল কাটার জন্য তৈরি হয়ে যাবে।

মাশরুম চাষ করে কতটা লাভ করা যাবে

 এমনিতে ভালো করে মাশরুম উৎপাদন করতে পারলে এবং সঠিক সময়ে ফসল কেটে সেগুলোকে বিক্রি করতে পারলে দুই থেকে তিন গুণ লাভ করা সম্ভব।

এই ব্যবসাতে লাভের পরিমান অনেক বেশি। তবে এর জন্য সঠিকভাবে মাশরুমগুলোকে বিক্রি করার কৌশল জানতে হবে। যত অধিক পরিমানে মাশরুম এর উৎপাদন করতে পারবেন ততটাই অধিক মুনাফা আপনার হবে। তাই সবকিছুর আগে মাশরুম চাষ পদ্ধতি সঠিক ভাবে জেনে একটি ভালো এবং সঠিক জায়গাতে মাশরুম উৎপাদন করতে জানতে হবে।

তৈরি হওয়া মাশরুম গুলোর মার্কেটিং করুন

ভালো ফসল ফলিয়েও লাভ নেই যদি না যথোপযোক্ত মার্কেটিং করা না যায়।  তাই,  সঠিক মার্কেটিং পন্থা অবলম্বন করে উৎপাদিত মাশরুমগুলোকে বিক্রি করার চেষ্টা করতে হবে।

এমনিতে শহরে মাশরুম এর চাহিদা অনেক বেশি, তাই শহরে অনেক তাড়াতাড়ি এগুলোকে বিক্রি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে শহরে এসে মার্কেটিং অবশ্যই করতে হবে।

যদি তৈরি হওয়া মাশরুম গুলো ৭ দিনের অধিক সময় চাষির কাছেই থাকে তাহলে সেগুলো নষ্ট হওয়া শুরু হবে। তাই কম সময়ের মধ্যেই মাশরুমগুলো বিক্রি করতে হবে।

  • আসে পাশের শহর গুলোতে গিয়ে সেখানে থাকা বড় বড় দোকান গুলোর সাথে যোগাযোগ করুন।
  • খাবারের হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির সাথে যোগাযোগ করুন।
  • মার্কেটিং এর জন্য দু-চার জন ছেলে রেখে তাদের মাধ্যমে বিক্রি করাতে পারবেন।
  • কোনো বড় খাদ্যপণ্য ডিস্ট্রিবিউটারের সাথে যোগাযোগ করুন।
  • অনলাইন ডিজিটাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে প্রচার বা মার্কেটিং করুন।
  • মাশরুম বিক্রি করার নিজের ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করতে পারেন।

মাশরুম চাষের  জন্য প্রশিক্ষণ  জরুরি

মাশরুম এর চাষ করাটা একটি অনেক জটিল প্রক্রিয়া। কেবল অনলাইনে আর্টিকেল পড়ে সবটা বুঝা সম্ভব না। মাশরুম চাষে সফল হতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ জরুরি। তাই ব্যবসা শুরুর আগে দেশের মধ্যে থাকা বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা কৃষির সাথে জড়িত সংগঠন গুলোর সাথে যোগাযোগ করে সঠিক ভাবে মাশরুম চাষ করার পদ্ধতি শিখে ও জেনে নেয়া উচিত।

এমন না যে, ভালো করে প্রশিক্ষণ না নিয়ে মাশরুম এর চাষ করা যাবে না। কিন্তু সফলতার সম্ভাবনা বেড়ে যায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেয়া থাকলে।

 

পেঁপে চাষের পদ্ধতি ,যেভাবে পেঁপে চাষে মিলবে দ্বিগুণ ফলন

পেঁপে চাষের পদ্ধতি ,যেভাবে পেঁপে চাষে মিলবে দ্বিগুণ ফলন, গ্রামের বাড়ির উঠানে পেঁপে গাছ পরিচিত ছবি। পেঁপের রয়েছে অনেক ভেষজ গুণ। এটি দারুণ জনপ্রিয় ফল হলেও সবজি হিসেবেও সর্বত্র সমাদৃত। লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন পেঁপে। আর আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করলে দ্বিগুণ ফলন পাওয়া সম্ভব।

পেঁপে চাষের পদ্ধতি ,যেভাবে পেঁপে চাষে মিলবে দ্বিগুণ ফলন

পেঁপে স্বল্পমেয়াদী ফল, চাষের জন্যও বেশি জায়গার প্রয়োজন পড়ে না। বাড়ির আঙিনায় কয়েকটি গাছ লাগালে সেটা থেকে সারাবছর সবজি-ফল পাওয়া যায়।

জেনে নেওয়া যাক পেঁপে চাষের পদ্ধতি-

পেঁপে গাছ মোটেও জলাবদ্ধতা সহনশীল নয়। পেঁপে চাষের জন্য জলাবদ্ধতামুক্ত এবং সেচ সুবিধাযুক্ত জমি নির্বাচিত করতে হবে। জমি একাধিকবার চাষ ও মই দিয়ে ভালোভাবে তৈরি করতে হবে। দ্রুত পানি নিষ্কাষণে ‘বেডপদ্ধতি’ অবলম্বন করা ভালো। পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ২০ সেন্টিমিটার গভীর নালা থাকবে। নালাসহ প্রতিটি বেড ২মিটার চওড়া এবং জমি অনুযায়ী লম্বা হবে।

১৯৯২ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট শাহী নামের একটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে। জাতের বৈশিষ্ট্য হলো- এটি একলিঙ্গী। গাছের উচ্চতা ১.৬ থেকে ২ মিটার। কাণ্ডের খুব নিচু থেকে ফল ধরে। ডিম্বাকৃতি ফলের ওজন হয় ৮০০-১০০০ গ্রাম। আর ফলপ্রতি বীজ হয় ৫০০-৫৫০টি। ফল বেশ মিষ্টি ও সুস্বাদু। রং গাঢ় কমলা থেকে লাল। গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৪০-৬০টি। এ জাত দেশের সব জায়গায় চাষ উপযোগী।

পদ্ধতি

পেঁপের চারা বীজতলা ও পলিথিন ব্যাগে তৈরি করা যায়। চারা তৈরির ক্ষেত্রে ১০-১৫ সেন্টিমিটার সারি করে প্রতিটিতে ৩-৪ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করতে হবে। বপনের ১৫-২০ দিন পর চারা বের হয়। আর ৪০-৫০ দিন পর তা রোপণের উপযোগী হয়।

২.২ মি দূরত্বে পেঁপের জন্য গর্ত তৈরি করতে হবে। প্রতি গর্তে ৩টি করে চারা রোপণ করলে হেক্টরপ্রতি চারা লাগবে ৭৫০০টি। এসব সুস্থ-সবল চারা পেতে ৪০০-৫০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন। তবে হাইব্রিড পেঁপের জন্য ১০০-১৫০ গ্রাম বীজ যথেষ্ট।

চারা রোপণের ১৫-২০ দিন আগে বেডের মাঝ বরাবর ২ মিটার দূরত্বে তৈরি করতে হবে গর্ত। এর সাথে গর্তপ্রতি ১৫ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ২০ গ্রাম বরিক এসিড এবং ২০ গ্রাম জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মেশাতে হবে। সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্ত পূরণ করে সেচ দিতে হবে।

আশ্বিন এবং পৌষ মাস উন্নত পদ্ধতিতে পেঁপে চাষে সফলতা পেতে বীজ বপন ও চারা রোপণের সময়। বপনের ৪০-৫০ দিন পর অর্থাৎ মাঘ-ফাল্গুন মাসে চারা রোপণের উপযোগী হয়।

 

 

চারা রোপণের আগে গর্তের মাটি ভালোভাবে ওলট-পালট করে নিতে হবে। প্রতি গর্তে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে ত্রিভুজ আকারে ৩টি করে চারা রোপণ করতে হবে। বীজতলায় উৎপাদিত চারার উন্মুক্ত পাতাগুলো ফেলে দিলে রোপণ করা চারার মৃত্যুহার হ্রাস পায়। এ ছাড়া চারা দ্রুত বড় হয়।

পলিব্যাগে উৎপাদিত চারার ক্ষেত্রে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। পলিব্যাগটি দেখেশুনে অপসারণ করতে হবে, যাতে মাটির বলটি ভেঙে না যায়। পড়ন্ত বিকেলে চারা রোপণের জন্য উত্তম সময়। লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে চারার গোড়া বীজতলা বা পলিব্যাগে মাটির যতটা গভীরে ছিল তার চেয়ে বেশি নিচে না যায়।

ভালো ফলন পেতে হলে পেঁপে গাছে সময়মতো সুষমমাত্রায় সার দিতে হবে। প্রতি গাছে ৪৫০-৫০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৪৫০-৫০০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে। চারা রোপণের এক মাস পার হলে প্রতিমাসে গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হয়। গাছে ফুল আসার পর এই মাত্রা দ্বিগুণ করতে হবে। মাটিতে রসের অভাব হলে পানির ব্যবস্থা করতে হবে।

উন্নত পদ্ধতিতে পেঁপে চাষে অবশ্যই পরিচর্যার দিকে শতভাগ খেয়াল রাখতে হবে। জমি সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। বর্ষা মৌসুমে আগাছা দমন করতে গিয়ে মাটি যাতে বেশি আলগা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি সেচ দিতে হবে। সেচের ও বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সে জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

চারা লাগানোর ৩-৪ মাস পর গাছে ফুল আসলে প্রতি গর্তে একটি করে সুস্থ-সবল স্ত্রী গাছ রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলতে হবে। তবে সুষ্ঠু পরাগায়ন ও ফল ধারণের জন্য বাগানের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে শতকরা ৫টি পুরুষ গাছ থাকা দরকার।

পেঁপের অধিকাংশ জাতের ক্ষেত্রে একটি পত্রক থেকে একাধিক ফুল আসে। এর থেকে ফল ধরে। ফল কিছুটা বড় হওয়ার পর প্রতি পত্রকক্ষে সবচেয়ে ভালো ফলটি রেখে বাকিগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে। দ্বিতীয় বা তার পরবর্তী বছরে যে পেঁপে হয় সেগুলো ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে। ফলে ঠিকমতো বাড়তে পারে না এবং এদের আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ছোট ফলগুলো ছাঁটাই করতে হবে।

 

 

পেঁপের ভাইরাসঘটিত পাতা মোড়ানো রোগ: এই রোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো পাতা নিচের দিকে বা ভিতরের দিকে গুটিয়ে যায়। অন্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- পত্রশিরা মোটা হয়ে যাওয়া, মাঝেমধ্যে বাইরের দিকে পত্রশিরার স্ফীতি প্রভৃতি দেখা যায়। পাতা চামড়ার মতো খসখসে ও ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং পত্রবৃন্ত বিকৃত হয়ে পাকিয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। গাছের ওপরের দিকের পাতাকেই বেশি আক্রমণ করে। রোগের পরবর্তী পর্যায়ে পত্রমোচন ঘটে। গাছের বৃদ্ধি রোধ হয় এবং গাছে ফুল ও ফল ধরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি ফল ধরেও তবে তা ছোট, আকারে বিকৃত হয় এবং অকালেই ঝরে পড়ে।

এই রোগের ভাইরাসের প্রধান বাহক হলো বেসমিসিয়া ট্যাবাসি (Bemisia tabaci) নামক সাদা মাছি। এই মাছি এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে গিয়ে এই রোগের ভাইরাসের বিস্তারে সাহায্য করে। বাহকের শরীরে ভাইরাস সক্রিয় অবস্থায় থাকাকালে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছড়িয়ে যায়।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: রোগ প্রতিরোধী উদ্ভিদের জাত রোপণ করার চেষ্টা করুন। পেঁপে গাছের আশেপাশে এই রোগের জীবাণুকে পরাশ্রয় প্রদান করে এমন ধরনের উদ্ভিদ বেড়ে উঠতে দেবেন না। উপকারী পোকামাকড় যাতে অত্যধিক কীটনাশকের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। আক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলে নষ্ট করে দিন। ফসল তোলার পরে উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ যাতে জমিতে পড়ে না থাকে সেদিকে নজর রাখুন।

 

করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল

করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল , করলা দেশের অন্যতম প্রধান সবজি। স্বাদে তিক্ত হলেও এটি প্রিয় সবজি হিসেবেই পরিচিত। আর সঠিক পদ্ধতিতে করলা চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। করলা চাষে অধিক ফলন পেতে সঠিক পদ্ধতি জানা জরুরি।

করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল

করলা চাষে মাটি:

যে জমিতে পানি জমে থাকে না, এ ধরনের প্রায় সব রকম মাটিতেই করলার চাষ সম্ভব। আর জৈব পদার্থযুক্ত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটিত করলা চাষে অধিক উপযোগী।

করলা চাষের জন্য জলবায়ু:

করলা চাষের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ সবজি ভালো জন্মে। তবে ফুল আসার সময় অধিক বৃষ্টিপাত ফল ধরাতে সমস্যার করে।

করলার জাত:

দেশে করলার বেশ কয়েকটি উচ্চ ফলনশীল জাত রয়েছে। এর মধ্যে বারি করলা-১ এবং বিএডিসির গজ করলা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আরও কয়েক রকমের হাইব্রিড জাত রয়েছে। কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কৃর্তক উদ্ভাবিত বারি করলা-১ উচ্চফলনশীল জাত। এ জাতের একটি গাছে ২০-৩০টি করলা ধরে। হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০ টনের কাছাকাছি।

আরেকটি উচ্চ ফলনশীল করলার জাত হলো বিএডিসির গজ করলা। এ জাতের একটি গাছে ১৫-২০টি ফল ধরে। হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫ টনের কিছুটা কম।

করলার আরও যে কয়টি হাইব্রিড জাত আছে, তার মধ্যে বুলবুলি, টিয়া, প্যারট, কাকলি, তাজ-৮৮, গ্রিনস্টার, গৌরব, প্রাইড-১, প্রাইড-২, গ্রিন রকেট, হীরক, মানিক, জয়, রাজা, প্রাচী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

করলার জীবনকাল:

করলার মোট জীবনকাল প্রায় ৪ থেকে সাড়ে চার মাস। তবে জাত-আবহাওয়া ভেদে সময় কম বেশি হতে পারে।

করলার উৎপাদন মৌসুম:

ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের যে কোনও সময় করলার বীজ বোনা যেতে পারে। অনেকে জানুয়ারি মাসেও বপন করে থাকেন। কিন্তু এসময় তাপমাত্রা কম থাকায় গাছ দ্রুত বাড়তে পারে না। এ কারণে আগাম ফসল উৎপাদনে তেমন সুবিধা হয় না।

করলা চাষের জন্য জমি তৈরি ও বপন:

হেক্টরপ্রতি করলা ও উচ্ছের জন্য যথাক্রমে ৬-৭.৫ ও ৩-৩.৫ কেজি বীজ লাগবে। উচ্ছে ও করলার বীজ সরাসরি মাদায় (৪০x৪০x৪০ সে.মি) বোনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি মাদায় কমপক্ষে ২টি বীজ বপন অথবা পলিব্যাগে উৎপাদিত ১৫-২০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। উচ্ছের ক্ষেত্রে সারিতে ১.০ মিটার এবং করলার জন্য ১.৫ মিটার দূরত্বের মাদা তৈরি করতে হবে। মাদা বীজ বুনতে বা চারা রোপণ করতে হলে অন্তত ১০ দিন আগে নির্ধারিত সার প্রয়োগ করে তৈরি করে নিতে হবে।

 

 

করলা চাষের জন্য সেচ ও নিষ্কাশন:

ক্ষেতে খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। পানির অভাবে গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন ধাপে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন প্রাথমিক অবস্থায় চারার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া। পরবর্তীতে ফল ঝরে যাওয়া। জুন-জুলাই মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আর সেচের প্রয়োজন হয় না। জমির পানি নিষ্কাশনের জন্য বেড ও নিকাশ নালা সর্বদা পরিষ্কার করে রাখতে হবে। করলার বীজ উৎপাদনের সময় ফল পরিপক্ব হওয়া শুরু হলে সেচ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। বাউনির ব্যবস্থা করা করলার প্রধান পরিচর্যা। চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মি. উঁচু মাচা তৈরি করতে হবে।

 

করলার রোগ বালাই ও দমন:

করলার মাছি পোকা:

স্ত্রী মাছি কচি ফলের নিচের দিকে ওভিপজিটর ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার স্থান থেকে পানির মত তরল পদার্থ বেড়িয়ে আসে যা শুকিয়ে বাদামী রং ধারণ করে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের শাস খেতে শুরু করে। এরপর ফল হলুদ হয়ে পচে ঝরে যায়।

দমন ব্যবস্থা: আক্রান্ত ফল বা ফুল সংগ্রহ করে ধ্বংস করা বা পুড়ে ফেলা। ভালোভাবে জমি চাষ করে পোকার পুত্তলি পাখিদের খাবার সুযোগ করে দেওয়া। ক্ষেতের মাঝে মাঝে কাঁঠালের মোথা দেওয়া। এতে করলার পরিবর্তে স্ত্রী মাছি কাঁঠালের মোথায় ডিম পাড়বে। ফলে ক্ষতির পরিমাণ কমে আসবে। প্রথম ফুল আসামাত্র ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করা। প্রতি ১০ শতাংশের জন্য ৩টি। আম বা খেজুরের রসে সামান্য বিষ মিশিয়ে তা বোতলে রেখে জানালা কেটে দিয়ে ক্ষেতের মাঝে মাঝে স্থাপন করা।

 

করলার সাদা মাছি পোকা:

স্ত্রী মাছি কচি ফলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো ফলের শাস খায়। ফল পচে অকালে ঝরে পড়ে।

দমন ব্যবস্থা: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ। আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার। বিষটোপের জন্য থেঁতলানো ১০০ গ্রাম পাকা মিষ্টি কুমড়ার সাথে ০.২৫ গ্রাম সেভিন ৮৫ পাউডার মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়। বিষটোপ ৩-৪ দিন পরপর পরিবর্তন করতে হয়।

করলা চাষের জন্য সার ব্যবস্থাপনা

 

সারের নাম মোট পরিমাণ
(হেক্টর প্রতি)
মোট পরিমাণ (শতাংশ প্রতি) জমি তৈরির সময় (শতাংশ প্রতি) চারা রোপণের ৭-১০
দিন পূর্বে
চারা রোপণের ১০-১৫
দিন পর
চারা রোপনের ৩০-৩৫
দিন পর
চারা রোপনের ৫০-৫৫ 
দিন পর
চারা রোপনের ৭০-৭৫ 
দিন পর
পচা গোবর ২০ টন ৮০ কেজি ২০ কেজি ৫ কেজি
টিএসপি ১৭৫ কেজি ৭০০ গ্রাম ৩৫০ গ্রাম ৩০ গ্রাম
ইউরিয়া ১৭৫  কেজি ৭০০ গ্রাম ১৫ গ্রাম ১৫ গ্রাম ১৫ গ্রাম ১৫ গ্রাম
এমপি ১৫০ কেজি ৬০০ গ্রাম ২০০ গ্রাম ২০ গ্রাম ১৫ গ্রাম
জিপসাম ১০০ কেজি ৪০০ গ্রাম ৪০০ গ্রাম
দস্তা সার ১২.৫ কেজি ৫০ গ্রাম ৫০ গ্রাম
বোরাক্স ১০ কেজি ৪০ গ্রাম ৪০ গ্রাম
ম্যাগনেশিয়াম ১২.৫কেজি ৫০ গ্রাম ৫ গ্রাম

 

করলা ফসল সংগ্রহ:

চারা গজানোর ৪৫-৪৫ দিন পর উচ্ছের গাছ ফল দিতে থাকে। করলার বেলায় লেগে যায় প্রায় ২ মাস। স্ত্রীফুলের পরাগায়নের ১৫-২০ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুমাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে উচ্ছে ও করলার হেক্টর প্রতি ফলন যথাক্রমে ৭-১০ টন (৩০-৪০ কেজি/শতাংশ) এবং ২০-২৫ টন (৮০-১০০ কেজি/শতাংশ) পাওয়া যায়।