পরিবেশ দূষণের ধারণা ও প্রকারভেদ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ২ নং ইউনিটের ২.২ নং পাঠ। সাধারণ কথায় বলতে গেলে প্রাকৃতিক পরিবেশে যে উপাদান বিদ্যমান নেই তার উপস্থিতি অথবা কোনো উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি যা মানুষ, উদ্ভিদ বা যে কোনো প্রাণীকূলের জন্য ক্ষতিকর তাকেই পরিবেশ দূষণ বলে। অন্য কথায় রাসায়নিক, ভৌতিক ও জৈবিক কারণে পরিবেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের যে কোনো পরিবর্তনের নামই হলো দুষণ। আরও সহজভাবে বলতে গেলে পরিবেশে মানুষ, উদ্ভিদ বা প্রাণীকূলের জীবন ধারণ বা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ক্ষতিকর যে কোনো বস্তুর আধিক্য বা অনুপ্রবেশকে পরিবেশ দুষণ বলে।
পরিবেশ দূষণের ধারণা ও প্রকারভেদ
দূষণের সংজ্ঞা
উপাদান এবং প্রাচুর্য পরিবর্তন দ্বারা সংঘটিত “। (“Environmental pollution is the unfavorable alteration of our surroundings, wholly or largely as a by-product of man’s actions, through direct or indirect effects of changes of energy patterns, radiation levels, chemical and :ysical constitution and abundance of organisms.”)
বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ই.পি. ওডাম (১৯৭১) পরিবেশ দূষণের যে সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন তা এরূপ,
“দূষণ হচ্ছে আমাদের বায়ু, মাটি ও পানির ভৌত, রাসায়নিক বা জৈবিক বৈশিষ্ট্যের অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন যা মানব জীবন বা কাঙ্খিত প্রজাতি,
আমাদের শিল্পজাত, জীবন এবং সাংস্কৃতিক অবয়বের জন্য ক্ষতিকর অথবা যা আমাদের কাঁচা সম্পদকে অপচয় বা অবনয়ন করে”। (“Pollution is an undesirable change in the :ysical, chemical or biological characteristics of our air, land and water that may or will harmfully affect human life, or that of desirable species, our industrial process, living conditions and cultural aspects or that may or will waste or deteriorate our raw material resources”).
দূষণের শ্রেণিবিন্যাস বিভিন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী নানাভাবে দূষণের শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। তবে বহুল ব্যবহৃত ও অনুসৃত পন্থাগুলো হচ্ছে —
১। পরিবেশগত শ্রেণিবিন্যাস :
যেমন: বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মৃত্তিকা দূষণ ইত্যাদি।
২। দূষণপদার্থভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস :
যেমন: দস্তা, পারদ, কার্বন—ডাই—অক্সাইড, কঠিন বর্জ্য ইত্যাদি দিয়ে সংঘটিত দূষণ সমূহ।
৩। তেজস্ক্রিয় দূষণ :
যেমন: পারমাণবিক কেন্দ্রের আবর্জনা ও বিস্ফোরণের ফলে উদ্ভুত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। এ সকল আইসোটপের মধ্যে— আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি উল্লেখযোগ্য। এসকল তেজস্ক্রিয় রশ্মি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহে তরল পদার্থের আয়নকরণ, জিন মিউটেশন এবং ক্রোমোজমের মিউটেশন ঘটায়। তাছাড়া পানিতে বসবাসকারী জীবদেহে সঞ্চিত হয়ে তাদের উপর নির্ভরশীল প্রাণীদের প্রভূত ক্ষতির কারণ ঘটায়।
৪। তাপীয় দূষণ :
যেমন: আণবিক চুল্লী শীতলকরণ কাজে ব্যবহৃত ভারি পানি, কল কারখানা থেকে নির্গত উত্তপ্ত পানি ইত্যাদি নদী বা জলাশয়ে মিশ্রিত হয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবকূল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫। শব্দ দূষণ :
যেমন: যন্ত্রযানের শব্দ, মোটর/রেলগাড়ির শব্দ, উড়োজাহাজের শব্দ, শিল্প কারখানার শব্দ, ইত্যাদি আরও বহুবিধ অবাঞ্চিত শব্দ মানুষের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যের উপর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে শ্রবন—ইন্দ্রিয়ের কার্যক্ষমতা হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, মাথাধরা, হৃদরোগ স্নায়ুবিক দূর্বলতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
৬।জৈবিক দূষণ :
যেমন: ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রোটোজোয়া, ফুলের রেণু ইত্যাদি জৈবিক উৎস মানুষ ও প্রাণীদেহে নানাবিধ রোগ বিস্তারের জন্য দায়ী।
বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ই.পি. ওডাম (১৯৭১) ইকোসিস্টেমের দৃষ্টিকোণ থেকে দূষণের দু’টো বুনিয়াদী শ্রেণিবিন্যাসের কথা বলেছেন। তা নিম্নরূপ —
(ক) অনিধনযোগ্য দূষক :
যেমন: অ্যালুমিনিয়াম পাত্র, পারদীয় লবণ, দীর্ঘ শিকলযুক্ত ফেনলিক দ্রব্য, ডি.ডি.টি. প্রভৃতি, যা সাধারণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না বা ধীরগতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এসকল দ্রব্যাদি প্রকৃতিতে চক্রাকারে আবর্তনের মাধ্যমে পরিবেশ রীতিতে ফিরে আসে না। বরং ক্রমশ স্তুপীকৃত হয়ে জীব—ভূ—রাসায়নিক চক্রে বা খাদ্যশিকলে (ঋড়ড়ফ ঈযধরহ) প্রবেশ করে মারাÍক জৈবিক সমস্যা সৃষ্টি করে। অবশ্য অনেক সময় এসব উপাদান পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের সাথে মিশে অতিরিক্ত বিষক্রিয়াও তৈরি করে।
(খ) জৈব নিধনযোগ্য দূষক :
যেমন: গৃহপালিত পশু বা সামাজিক প্রাণীর বর্জ্য যা প্রাকৃতিকভাবে বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দ্রুত পচনশীল। এগুলো প্রকৃতিতে চক্রাকারে আবর্তনযোগ্য। ফলে পচনক্রিয়া শেষ হলে এদের বিষাক্তকরণ ক্ষমতা লোপ পায়। অবশ্য পরিবেশে দূষক পদার্থের মাত্রা অত্যধিক হলে অর্থাৎ জৈব নিধন ক্ষমতা ছাড়িয়ে গেলে জৈব নিধনযোগ্য দূষণও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশ অঞ্চলসমূহের পরিচিতি – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ১ নং ইউনিটের ১.৬ নং পাঠ।
বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশ অঞ্চলসমূহের পরিচিতি
বিজ্ঞানসম্মত কৃষি ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য কৃষি পরিবেশ অঞ্চল সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান থাকা বাঞ্ছণীয়। তাই এ পাঠে বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশ অঞ্চলসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। সংযোজিত মানচিত্রে বাংলাদেশের ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের অবস্থান দেখানো হয়েছে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১ :
পুরাতন হিমালয় পাদভূমি পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাও জেলার অধিকাংশ স্থান এবং দিনাজপুর জেলার উত্তর পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে এ এলাকা গঠিত। এখানকার অধিকাংশ ভূমি উঁচু (৫৮%) বা মাঝারি উঁচু (৩৪%), বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ৭ ভাগ। মাটি বেলে—দোআঁশ থেকে দোআঁশ। জৈব পদার্থ কম, pH মান ৪.৫ থেকে ৫.৫। রবি মৌসুমে সবজি, গোলআলু, গম, বোরোধান, আখ প্রধান ফসল। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ ধান ও পাট এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমনের চাষ হয়।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২ :
সক্রিয় তিস্তা প্লাবন ভূমি নিলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর বিধৌত তীরবতীর্ সরু এলাকা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এ অঞ্চল মাঝারি উঁচু (৭২%) ধরনের ভূমি নিয়ে গঠিত। মাটি বেলে—দোআঁশ থেকে দোআঁশ। pH মান ৬.০ থেকে ৬.৫ পর্যন্ত। রবি মৌসুম অনাবাদি। খরিপ — ১ মৌসুমে বোনা আউশ এবং খরিপ — ২ মৌসুমে আমন প্রধান ফসল।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ৩ :
তিস্তা সর্পিল প্লাবন ভূমি বৃহত্তর রংপুর জেলার অধিকাংশ স্থান, পঞ্চগড়ের পূর্বাঞ্চল, দিনাজপুর, বগুড়ার উত্তরাঞ্চল এবং জয়পুরহাট, নওঁগা ও রাজশাহী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। অধিকাংশ ভূমি মাঝারি উঁচু (৫১%) থেকে উঁচু (৩৫%)। মাটি সাধারণত দোআঁশ। জৈব পদার্থের পরিমাণ কম। pH মান ৫.৪ থোক ৬.৫ পর্যন্ত । রবি মৌসুমে মূলত ডালজাতীয় ফসলের আবাদ হয়। খরিপ — ১ মৌসুমে বোনা আউশ এবং খরিপ — ২ মৌসুম অনাবাদি থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ৪ :
করতোয়া বাঙ্গালী প্লাবনভূমি বগুড়ার প র্বাঞ্চলের অর্ধাংশ এবং সিরাজগঞ্জ জেলার অধিকাংশ স্থান এ অঞ্চলের অš ভূর্ক্ত। ভূমি প্রধানত মাঝারি উঁচু (৪৪%) এবং উঁচু (২৩%) ধরনের। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ১৪ ভাগ। মাটির গঠন পলি—দোআঁশ থেকে পলি গঠিত কাঁদা—দোআঁশ। pH মান ৫.৪ থেকে ৫.৭ পর্যš । রবি মৌসুমে প্রধান ফসল মাসকলাই ও মশুর। খরিপ — ১ মৌসুমে বোনা আউশ এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ৫ :
নিম্ন আত্রাই বেসিন এ অঞ্চলের অধিকাংশ স্থান নওগাঁ ও নাটোর জেলায় অবস্থিত। কিছুটা ক্ষুদ্র অংশ রাজশাহী, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলা পর্যš বি¯ ৃত। এখানকার ভূমি ম লত মাঝারি নিম্ন ধরনের (৮৬%)। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ শতকরা ৪ ভাগ। মাটি কর্দমাক্ত। জৈব উপাদানের পরিমাণ মধ্যম। pH মান ৪.৮ থেকে ৬.০ পর্যন্ত। রবি মৌসুম অনাবাদি। খরিপ — ১ মৌসুমে বোনা আমন উৎপন্ন হয় এবং খরিপ —
২ অনাবাদি থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ৬ :
নিম্নপূর্ণভবা প্লাবন ভূমি নওগাঁ জেলার পশ্চিম প্রােš র অংশবিশেষ এবং নবাবগঞ্জ জেলার সর্ব উত্তর প্রােš র অংশবিশেষ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। অধিকাংশ স্থানই নিম্নাঞ্চল (৬০%) এবং কিছু এলাকা মাঝারি নিম্নাঞ্চল (১০%) ধরনের। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ। মাটি কর্দমাক্ত ও জৈব উপাদানের পরিমাণ মধ্যম ধরনের। pH মান ৪.৫। রবি মৌসুমে বোরোধানের চাষ হয়ে থাকে। খরিপ মৌসুমে জমি পতিত থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ৭ :
সক্রিয় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা প্লাবন ভূমি কুড়িগ্রাম জেলার প র্বাঞ্চল, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলা, শেরপুরের পশ্চিমাঞ্চল, জামালপুর, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ জেলা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এছাড়া ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এবং চাঁদপুর জেলাসম হের অংশবিশেষ এ অঞ্চলের অš র্ভ ক্ত। মাঝারি উঁচু জমির পরিমাণ ৩৭ শতাংশ, মাঝারি নিচু জমি ২০ শতাংশ এবং বসতবাড়ি ও জলাভ মি ৩০ শতাংশ। মাটির বুনট ম লত বেলে/পলিমাটি সমৃদ্ধ। pH মান ৭.৫ থেকে ৭.৯। মাঝারি উঁচু জমিতে রবি মৌসুম অনাবাদি অথবা গম, আলু, চীনা বাদাম, খরিপ — ১ মৌসুমে পাট ও বোনা আউশ এবং খরিপ — ২ সময়ে রোপা আমনের চাষ অথবা পতিত থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ৮ :
নতুন ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা প্লাবন ভূমি শেরপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলাসম হের পশ্চিমাঞ্চল, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলাসম হের অংশবিশেষ এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ সংলগ্ন ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। ভূমি মাঝারি উঁচু (৪২%), উঁচু (১৮%) এবং মাঝারি নিচু (১৯%) ধরনের। বাড়ি ও জলাশয় ১২ ভাগ। মাটি দোআঁশ। pH মান ৫.৫ থেকে ৬.৮। রবি মৌসুমে উঁচু জমি পতিত থাকে, কিন্তু মাঝারি উঁচু ধরনের জমিতে গোল আলু, সরিষা, মাসকালাই ও আমের চাষ হয়। খরিপ — ১ মৌসুমে উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে বোনা/রোপা আউশ এবং পাটের
চাষ হয। খরিপ — ২ মৌসুমে নিচু জমি পতিত এবং মাঝারি ও উঁচু জমিতে রোপা আমনের চাষ হয়।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ৯ :
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবন ভূমিশেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলাসম হের বি¯ ীর্ণ অঞ্চল এবং ঢাকা ও গাজীপুর জেলার কিয়দংশ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এখানকার ভূমি উঁচু (২৮%), মাঝারি উঁচু (৩৫%), মাঝারি নিচু (২০%) এবং নিচু (৭%) ধরনের। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ শতকরা ১০ ভাগ। মাটি পলি—দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম । pH মান ৪.৫ থেকে ৪.৯ পর্যš । উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমিতে রবি মৌসুমে গম, সরিষা ও ডালজাতীয় শস্য চাষ হয়। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ ও কিছু পাটের চাষ হয় এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমনের চাষ হয়।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১০ :
সক্রিয় গঙ্গা প্লাবন ভূমি নবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার গঙ্গা বিধৌত অঞ্চল থেকে বরিশাল ও লক্ষীপুর জেলার মেঘনা পর্যš এ এলাকা বি¯ ৃত। শতকরা ৩৩ ভাগ মাঝারি উঁচুভূমি এবং ১৮ ভাগ মাঝারি নিচু ভ মি নিয়ে এ এলাকা গঠিত। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ৩৩ ভাগ। মাটি দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৬.৯ থেকে ৭.৯। প্রধান উৎপন্ন ফসল রবি মৌসুমে খেসারি, মাসকলাই, সরিষা ও বোরো। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ, পাট, এবং খরিপ — ২ মৌসুম অনাবাদি থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১১ :
উচ্চ গঙ্গা প্লাবন ভূমি নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনার দক্ষিণাংশ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর এবং খুলনা ও সাতক্ষীরার উত্তরাঞ্চল, এবং নওগাঁ ও নড়াইল জেলার সামান্য এলাকা এ অঞ্চলের অন্ত র্ভূক্ত। এখানে শতকরা ৪৩ ভাগ উঁচুভূমি, ৩২ ভাগ মাঝারি উঁচুভূমি, ১১ ভাগ বসতবাড়ি ও জলাভূমি এবং বাকি নিম্নভূমি। মাটি পলি—দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৬.১ থেকে ৭.৯। রবি মৌসুমে প্রধানত ডালজাতীয় ফসল, গম, সরিষা, গোল আলু, আম ইত্যাদি ভাল জন্মে। খরিপ — ১ মৌসুমে বোনা ধান ও পাট এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমনের চাষ হয়।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১২ :
নিম্ন গঙ্গা প্লাবন ভূমি নাটোর, পাবনা, গোয়ালন্দ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরিয়তপুর, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও নড়াইল জেলার প বার্ংশ, খুলনা ও বাগেরহাটের উত্তর—প র্বাংশ, বরিশালের উত্তরাংশ, এবং মানিকগঞ্জ, ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জের দক্ষিণ—পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে এ এলাকা গঠিত। এখানে শতকরা ১৩ ভাগ উঁচুভূুমি, ২৯ ভাগ মাঝারি উঁচুভূমি, ৩১ ভাগ মাঝারি নিম্নভূমি, ১৪ ভাগ নিম্নভূমি এবং বাকিটা বসতবাড়ি ও জলাভূমি। মাটি পলি—দোআঁশ থেকে কাদা—দোআঁশ। জৈব পদার্থ মধ্যম, pH মান ৬.২ থেকে ৭.৭ পর্যন্ত। রবি মৌসুমে প্রধানত ডালজাতীয় শস্য এবং সরিষার আবাদ হয়। খরিপ — ১ মৌসুমে বোনা আউশ ও পাট, আউশ + আমন এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন, বোনা আমন অথবা পতিত থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১৩ :
গঙ্গা জোয়ার প্লাবন ভূমি বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা এবং সুন্দরবনসহ বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এখানকার অধিকাংশ ভূমি (৭৮%) মাঝারি উঁচু ধরনের। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ১৮ ভাগ। মাটি দো—আঁশ, জৈব পদার্থ মধ্যম। pH মান ৬.৫ থেকে ৭.০ পর্যন্ত । রবি মৌসুমের প্রধান ফসল মাস ও মুগকলাই। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমনের চাষ হয়।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১৪ :
গোপালগঞ্জ খুলনা জলাভূমি মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর, বাগেরহাট ও খুলনা জেলার বিক্ষিপ্ত নিম্নাঞ্চল নিয়ে এ এলাকা গঠিত। এ এলাকার অধিকাংশ ভূমি মাঝারি নিচু (৪১%) থেকে নিচু (২৮%) ধরনের। মাটি কর্দমাক্ত ও দোআঁশ ধরনের। pH মান ৬.৫ থেকে ৭.০ পর্যন্ত । রবি মৌসুমে প্রধানত গম, সরিষা ও ছোলা জাতীয় ফসল ভাল জন্মে। খরিপ — ১ মৌসুমে অধিকাংশ এলাকা অনাবাদি অথবা আউশ জন্মে। খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন প্রধান ফসল।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১৫ :
আরিয়াল বিল মুন্সিগঞ্জ ও ঢাকা জেলার বিলাঞ্চল নিয়ে এ এলাকা গঠিত। এখানকার অধিকাংশ ভূমিই (৭৩%) নিচু। বাকিটা মাঝারি উঁচু ধরনের। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ শতকরা ১৪ ভাগ। মাটি কাদাময়, জৈব পদার্থ মধ্যম এবং pH মান ৫.৪। রবি মৌসুমে বোরো ও কিছু ডালজাতীয় ফসল জন্মে। কিন্তু খরিপ — ১ ও ২ অনাবাদি থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১৬ :
মধ্য মেঘনা প্লাবন ভূমি কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিলা, চাঁদপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলাসম হের অংশবিশেষ নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এখানকার অধিকাংশ ভূমি মাঝারি নিম্ন (২৯%) এবং নিম্ন (২৫%) ধরনের। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ শতকরা ২৭ ভাগ। মাটি দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৪.৯ থেকে ৫.৫ পর্যন্ত। রবি মৌসুমের প্রধান ফসল বোরো, সরিষা ও ডালজাতীয় শস্য। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ, আউশ + আমন এবং খরিপ — ২ পতিত থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১৭ :
নিম্ন মেঘনা প্লাবন ভূমি চাঁদপুর, লক্ষীপুর ও নোয়াখালী জেলা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এ এলাকায় তিন ধরনের ভূমি রয়েছে: উঁচু (১৪%), মাঝারি উঁচু (২৮%) এবং মাঝারি নিচু (৩১%)। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ শতকরা ২৭ ভাগ। মাটি পলি—দোআঁশ, জৈব পদার্থ মধ্যম, pH মান ৫.০ থেকে ৬.০। উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে রবি মৌসুমে সরিষা, পিয়াজ, মরিচ ইত্যাদি ফসল জন্মে অথবা অনাবাদি থাকে। মাঝারি নিচু জমিতে বোরো, গম, সরিষা ইত্যাদি প্রধান ফসল। খরিপ — ১ মৌসুমে প্রায় সব ধরনের জমিতে আউশ (বোনা/রোপা) এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন প্রধান ফসল।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১৮ :
নূতন মেঘনা মোহনা প্লাবন ভূমি চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনা এ অঞ্চলের অš র্ভ ক্ত। ভূমি মাঝারি উঁচু (৪৫%) ধরনের। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ৪৮ ভাগ। মাটি পলি—দোআঁশ, জৈব পদার্থ মধ্যম, pH মান ৬.১ থেকে ৬.৮ পর্যন্ত । রবি মৌসুমে খেসারি, সরিষা, ও বোরো প্রধান ফসল। খরিপ — ১ মৌসুমে প্রায়ই অনাবাদি অথবা সেচের মাধ্যমে বোরো চাষ হয়। খরিপ— ২ মৌসুমে সর্বত্র রোপা আমন হয়ে থাকে।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ১৯ :
পুরাতন মেঘনা মোহনা প্লাবন ভূমি কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিলা, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল জেলা নিয়ে এ এলাকা গঠিত। মাটি মাঝারি উঁচু (২৪%), মাঝারি নিচু (৩৩%) এবং নিচু (২১%) ধরনের। বসতবাড়ী ও জলাভূমির পরিমাণ ১৭ ভাগ। মাটি পলি—দোআঁশ, দোআঁশ ও কাদাময়। জৈবপদার্থ মধ্যম, pH মান ৫.০ থেকে ৬.৫ পর্যš । রবি মৌসুমে বোরো, সরিষা প্রধান ফসল। খরিপ — ১ মৌসুমে, আউশ, পাট এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা বা বোনা আমন প্রধান ফসল।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২০ :
পূর্ব সুরমা কুশিয়ারা প্লাবন ভূমি সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা নিয়ে অঞ্চল গঠিত। এখানে রয়েছে মাঝারি উঁচু জমি (২৫%), মাঝারি নিচু জমি (২০%) এবং নিচু জমি (৩৬%)। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ১৪ ভাগ। মাটি পলি—দোআঁশ ও কাদাময়, জৈব পদার্থ মধ্যম, pH মান ৪.৭ থেকে ৬.৯ পর্যš । রবি মৌসুমে বোরো অথবা অনাবাদি। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ, আউশ + আমন অথবা অনাবাদি এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন অথবা অনাবাদি।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২১ :
সিলেট বেসিন সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং বি. বাড়িয়ার বৃহত্তর এলাকা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এখানকার অধিকাংশ ভূমিই নিচু (৪৩%) বাকিটা মাঝারি নিচু (১৯%) এবং অতি নিচু (২৩%)। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ১১ ভাগ। মাটি দোআঁশ থেকে এটেল, জৈব পদার্থ উচ্চ, pH মান ৪.৭ থেকে ৪.৯ পর্যš । রবি মৌসুমে প্রধান ফসল বোরো ধান। খরিপ — ১ মৌসুমে বোনা আমন অথবা অনাবাদি। খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন অথবা অনাবাদি।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২২ :
উত্তর ও পূর্ব পাদভূমি শেরপুর, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, বি.বাড়িয়া ও কুমিলা জেলা নিয়ে এ এলাকা গঠিত। এখানে রয়েছে প্রধানত উঁচু জমি (৩৩%), মাঝারি উঁচু জমি (৩১%) এবং মাঝারি নিচু জমি (২৩%)। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ১০ ভাগ। মাটি বেলে—দোআঁশ, দোআঁশ এবং পলি— দোআঁশ। জৈব পদার্থ মধ্যম, pH মান ৪.৫ থেকে ৫.৮। রবি মৌসুমে ম লা, মাসকালাই, সরিষা ও বোরো অথবা অনাবাদি। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ (বোনা/রোপা), বোনা আমন অথবা অনাবাদি এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন/অনাবাদি।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২৩ :
চট্টগ্রাম উপকূল সমতল ভূমি ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার উপকূল সংলগ্ন এলাকা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এখানকার ভূমি প্রধানত মাঝারি উঁচু (৪৩%), উঁচু (১৭%) এবং মাঝারি নিচু (১৩%)। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ২৭ ভাগ। মাটি পলি—দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম এবং pH মান ৫.৬। রবি মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের সবজি, খরিপ — ১ মৌসুমে বোনা/রোপা আউশ এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২৪ :
সেণ্টমার্টিন্স কোরাল দ্বীপ সেণ্টমার্টিন্স কোরাল দ্বীপ নিয়ে এ এলাকা গঠিত। এখানকার ভূমি মাঝারি উঁচু (৬৩%) থেকে উঁচু (৩৩%) ধরনের। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ২ ভাগ। মাটি বেলে থেকে বেলে—দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৭.০ থেকে ৭.৫। রবি মৌসুমে প্রধান ফসল মশলা, পিঁয়াজ, রসুন/অনাবাদি। খরিপ — ১ মৌসুম অনাবাদি এবং খরিপ — ২ মৌসুম অনাবাদি/রোপা আমন।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২৫ :
সমতল বরেন্দ্র অঞ্চল দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ এবং নাটোর জেলা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। ভূমি ম লত মাঝারি উঁচু (৫৫%) থেকে উঁচু (৩০%)। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ৯ ভাগ। মাটি দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৫.০ থেকে ৫.৭। রবি মৌসুমে অনাবাদি/আম, গোল আলু, পিয়াজ, গম, সরিষা। খরিপ — ১ মৌসুম অনাবাদি/আউশ (বোনা/রোপা) এবং খরিপ — ২
মৌসুমে রোপা আমন।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২৬ :
উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী, নবাবগঞ্জ ও নওগাঁ এলাকা নিয়ে গঠিত। ম লত উচ্চ ভূমি (৯৩%)। বসতবাড়ি ও জলাশয়ের পরিমাণ ৬ ভাগ। মাটি দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৪.৮ থেকে ৫.৯। রবি মৌসুমে অনাবাদি/বোরো, আখ, গম, ডালজাতীয় ফসল। খরিপ — ১ মৌসুমে ম লত অনাবাদি অথবা বোনা আউশ এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২৭ :
উত্তর—পূর্ব বরেন্দ্র অঞ্চল দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, বগুড়া এলাকা নিয়ে গঠিত। ভূমি প্রধানত মাঝারি উঁচু (৫৬%) থেকে উঁচু। (৩৬%) বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ৭ ভাগ। মাটি দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৪.৮ থেকে ৫.৬। রবি মৌসুমে বোরো, সরিষা, মাসকালাই, সবজি, আখ। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ, মে¯ া পাট এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন/অনাবাদি।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২৮ :
মধুপুর গড় অঞ্চল ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং কিশোরগঞ্জ জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। ভূমি প্রধানত উঁচু (৫৩%) ও মাঝারি উঁচু (১৮%), মাটি দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৪.৮ থেকে ৫.৫। রবি মৌসুমে সরিষা, গম, আখ, বোরো। খরিপ — ১ মৌসুমে আউশ (রোপা/বোনা)/অনাবাদি এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন/অনাবাদি।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ২৯ :
উত্তর পূর্ব পাহাড়ী অঞ্চল প্রধানত খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি অঞ্চল এবং শেরপুর, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, বি.বাড়িয়া, কুমিলা ও ফেনী জেলার টিলাসমৃদ্ধ অঞ্চল। প্রধানত উঁচুভূমি (৯২%)। বসতবাড়ি ও জলাভূমির পরিমাণ ৫ ভাগ। মাটি দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৪.৮ থেকে ৫.৫। রবি মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের সবজি, মিষ্টি আলু, আখ ইত্যাদি চাষ হয়। খরিপ — ১
মৌসুমে সবজি, আউশ অথবা অনাবাদি এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমনের চাষ হয়।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল — ৩০ :
আখাউরা সোপান বি.বাড়িয়া এবং হবিগঞ্জের ক্ষুদ্র এলাকা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। ভূমি প্রধানত উঁচু (৫৫%) এবং মাঝারি উঁচু (১১%)। বসতবাড়ি ও জলাভুমির পরিমাণ ৬ ভাগ। মাটি দোআঁশ, জৈব পদার্থ কম, pH মান ৫.৫ থেকে ৬.৫। রবি মৌসুমের প্রধান ফসল আম, কলা, গম, সরিষা। খরিপ — ১ মৌসুমে রোপা আউশ, পাট, হলুদ এবং খরিপ — ২ মৌসুমে রোপা আমন অথবা অনাবাদি।
বাংলাদেশের পরিবেশ নীতি ও পরিবেশগত অবস্থা – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ১ নং ইউনিটের ১.৫ নং পাঠ।
বাংলাদেশের পরিবেশ নীতি ও পরিবেশগত অবস্থা
পরিবেশ নীতির প্রেক্ষিত আজ বিশ্বজুড়ে পরিবেশ অবক্ষয়ের নিদর্শনসমূহ সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। গোটা মানব জাতিকে আসন্ন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য তাই বিশ্বব্যাপী চলছে বিরামহীন প্রচেষ্টা। মানব সচেতনতা জাগিয়ে তোলার জন্য প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এছাড়া তথ্যের আদান—প্রদান ও ভবিষ্যত কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বহু সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের এ ক্রান্তি লগ্নে বাংলাদেশের অবস্থা আরও করুণ। এখানে দেখা দিচ্ছে উপর্যুপরি বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুময়তার প্রাথমিক লক্ষণাদি ইতোমধ্যেই অনুভূত হচ্ছে। নদ—নদীর নিম্নাংশে লবণাক্ততার প্রকোপ বাড়ছে। ভূমিক্ষয়, বনাঞ্চলের দ্রুত অবক্ষয়, জলবায়ু ও আবহাওয়ার অস্থিরতাসহ অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যাও বিদ্যমান রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম সমন্বয় করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় দেশের পরিবেশ দূষণ ও অবক্ষয় সংক্রান্ত সমস্যাদি চিহ্নিত করে ১৯৯২ সনে পরিবেশ নীতি প্রণয়ন করেছেন।
পরিবেশ নীতির উদ্দেশ্যসমূহ:
পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা।
দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল থেকে মুক্ত রাখা।
সব ধরনের দুষণ ও অবক্ষয়মূলক কর্মকান্ড শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণ।
সর্বস্তরে পরিবেশসম্মত উন্নয়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা।
সকল জাতীয় সম্পদের লাগসই, দীর্ঘমেয়াদী এবং পরিবেশসম্মত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
পরিবেশসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে যথাসম্ভব সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকা।
পরিবেশ নীতিমালা
বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কতৃর্ক ১৯৯২ সনে প্রণীত পরিবেশ নীতি সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে প্রদত্ত হলো :
বনজ সম্পদের বিকল্প উদ্ভাবন ও তা ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান। বন্য প্রাণী ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ এবং এতদসংক্রান্ত গবেষণা ও জ্ঞান বিস্তারে সহায়তা প্রদান।
১। কৃষি নীতি :
কৃষি উন্নয়নের সকল প্রচেষ্টা ও প্রযুক্তি পরিবেশসম্মতভাবে করণ। কৃষি সম্পদের ভিত্তি সংরক্ষণ ও দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। মানুষ ও প্রাণীর উপর ক্ষতিকর প্রভাব রাখে এমন সব কৃষি উপকরণের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। পরিবেশ অনুকূল প্রাকৃতিক তন্তু যেমন: পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদির ব্যবহার উৎসাহিতকরণ।
২। শিল্পসংক্রান্ত নীতি :
পরিবেশ দূষণ করে এমন পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পস্থাপন নিষিদ্ধকরণ, স্থাপিত শিল্পসমূহ পর্যায়ক্রমে বন্ধকরণ এবং এ সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান কত্তর্ৃক উৎপাদিত পণ্যের পরিবেশ সম্মত বিকল্প পণ্য উদ্ভাবন। প্রচলনের মাধ্যমে ঐ সকল পণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণ। পরিবেশসম্মত লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদারকরণ।
৩। স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নীতি :
সকল ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কর্মকান্ড প্রতিরোধ করা। স্বাস্থ্য শিক্ষায় পরিবেশ বিষয়ক কারিকুলাম অন্তভূর্ক্তকরণ। শহর ও গ্রামাঞ্চলে সকলের জন্য পরিবেশসম্মত আবাস ও কর্মস্থলের ব্যবস্থাকরণ।
৪। জ্বালানি নীতি :
পরিবেশ দ ষণকারী জ্বালানিসম হের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণ। কম ক্ষতিকারক ও বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার উৎসাহিতকরণ। জ্বালানি সাশ্রয়কারী উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণকরণ। মজুত ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংরক্ষণ এবং এতদসংক্রান্ত নতুন প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে পরিবেশগত প্রভাব নিশ্চিতকরণ।
৫। পানি সম্পদ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ :
পানি সম্পদ উন্নয়ন ও সেচ ব্যবস্থাপনায় পরিবেশসম্মত ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। পানি সম্পদ উন্নয়নে ইতোমধ্যে গৃহীত ব্যবস্থার ত্রুটি দুরীকরণ এবং সকল জলাশয়কে দূষণমুক্ত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ। ভূ—গর্ভস্থ ও ভূ—উপরিস্থ পানির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই ও পরিবেশ সম্মতকরণ।
৬। ভূমি ব্যবস্থাপনা :
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা গ্রহণ। ভূমির ক্ষয়রোধ, উর্বরতা সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি, ভূমি পুনরূদ্ধার ও বিভিন্ন ইকোসিস্টেমের সঙ্গে সংঙ্গতিপূর্ণ ভূমি ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ। জমির লবণাক্ততা ও ক্ষারীয় প্রভাব রোধকরণ।
৭। বনজ সম্পদ সংক্রান্ত নীতি :
পরিবেশের ভারসাম্য ও আর্থসামাজিক প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে বন ও বৃক্ষাদি সংরক্ষণ এবং নতুন করে বনায়ন। বনজ সম্পদের বিকল্প উদ্ভাবন ও তা ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান। বন্য প্রাণী ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ এবং এতদসংক্রান্ত গবেষণা ও জ্ঞান বিস্তারে সহায়তা প্রদান।
৮। মৎস্য ও পশুসম্পদ :
মৎস্য সম্পদ উন্নয়নকল্পে জলাভূমির সংস্কার ও সংকোচন রোধকরণ। মৎস্য ও পশুসম্পদের উন্নয়ন কর্মসূচীতে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও অন্যান্য ইকোসিস্টেম যাতেহুমকির সম্মুখীন না হয় তা নিশ্চিতকরণ। মৎস্য সম্পদের জন্য ক্ষতিকারক পানি উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পসমূহের পূর্নমূল্যায়ন এবং মাছ চাষের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯। খাদ্য নীতি :
খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বণ্টন ব্যবস্থা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্মতভাবে নিশ্চিতকরণ। বিনষ্ট খাদ্য পরিবেশসম্মতভাবে নিষ্পত্তিকরণ এবং স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ খাদ্যদ্রব্যাদি আমদানি নিষিদ্ধকরণ।
১০। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পরিবেশ :
উপকূলীয় ও সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের পরিবেশসম্মত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ এবং এতদ উপলক্ষে গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণ। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক এলাকায় সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দূষণমূলক কর্মকান্ড প্রতিরোধকরণ। সংশিষ্ট এলাকায় মৃত মাছের পরিমাণ সহনশীল মাত্রায় রাখার ব্যবস্থাকরণ।
১১। যোগাযোগ ও পরিবহন :
স্থল, রেল, বিমান ও নৌপথ পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ। অভ্যন্তরীণ নৌ—বন্দর ও ডকইয়ার্ডসমূহ কর্তৃক পানি ও স্থল ভাগের দূষণকার্য নিয়ন্ত্রণকরণ।
১২। গৃহ ও নগরায়ন :
গৃহ ও নগরায়নের সকল পরিকল্পনা ও গবেষনায় পরিবেশগত চিন্তা সম্পৃক্তকরণ। শহর ও গ্রামাঞ্চলের আবাসিক এলাকায় পর্যায়ক্রমে পরিবেশসম্মত সুযোগসুবিধাদি সম্প্রসারণ এবং নিয়ন্ত্রণ। নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনে জলাশয়ের উপর গুরুত্ব প্রদান।
১৩। জনসংখ্যা সংক্রান্ত নীতি :
জনশক্তির সমন্বিত, সুপরিকল্পিত ও পরিবেশসম্মত ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। উন্নয়নমূলক কাজে মহিলাদের সম্পৃক্তকরণ এবং বেকার জনশক্তি ব্যবহার উৎসাহিতকরণ।
১৪। শিক্ষা ও গণ—সচেতনতা :
দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নিরক্ষরতা দূর করে শিক্ষিতের হার দ্রূত বৃদ্ধিকরণ। পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ব্যাপারে ব্যাপক গণ—সচেতনতা সৃষ্টিকরণ। প্রাতিষ্ঠানিক ও অ—প্রাতিষ্ঠানিক সকল শিক্ষা কার্যক্রমে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় অন্তভূর্ক্তকরণ।সরকারী, বেসরকারী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মকর্তা, কর্মচারি ও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে পরিবেশসংক্রান্ত বিষয় অন্তভূক্তর্করণ।
১৫। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা :
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতির আওতায় উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে পরিবেশ দষণ তদারক ও নিয়ূ ন্ত্রণের ব্যবস্থা আরোপকরণ। জাতীয় সম্পদের লাগসই, দীর্ঘস্থায়ী এবং পরিবেশসম্মত ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন উৎসাহিতকরণ।
বাংলাদেশের পরিবেশগত অবস্থা কোন দেশের পরিবেশগত অবস্থা নির্ভর করে তার ভৌগলিক অবস্থান, আবহাওয়ার তারতম্য, বনজসম্পদের পরিমাণ, মাটির প্রকৃতি, আর্থ—সামাজিক অবস্থান, জনসংখ্যা, শিক্ষার হার, শিল্পের অগ্রসরতা ইত্যাদির উপর। তবে বাংলাদেশের পরিবেশ অবক্ষয়ের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে :
১। জনসংখ্যার আধিক্য:
প্রায় এক লক্ষ চুয়ালিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান। এর জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১২ কোটি এবং বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ২.১ ভাগ। সীমিত জায়গায় বিপুল জনগোষ্ঠীর অবস্থান, তাদের দারিদ্র ও অশিক্ষা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
২। ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
বাংলাদেশ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রভৃতি নদী বিধৌত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব—দ্বীপ দেশ। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সীমিত পাহাড়িয়া উচ্চভূমি বাদে পুরো দেশটাই এক বিশাল সমভূমি। দেশের মাঝ দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করায় এ দেশ ক্রান্তীয় অঞ্চলভুক্ত। তবে সাগর সান্নিধ্য হওয়ায় এবং মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এখানে শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা প্রকট নয়। মানব সৃষ্ট কারণ ছাড়াও বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বাংলাদেশের পরিবেশ আর যেসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা হচ্ছে :
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অধিকাংশ ঘ ূর্ণিঝড়ই বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। বাংলাদেশে বিশেষ ধরনের মোচাকৃতির উপকূল রেখা থাকার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে।
(ক) ঘূর্ণিঝড় :
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ই বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। বাংলাদেশে বিশেষ ধরনের মোচাকৃতির উপকূল রেখা থাকার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের কারণে প্রচুর প্রাণহানি ও সম্পদের অবক্ষয় ঘটে। আবাদি জমিতে লোনা পানি ঢুকে উর্বরতা বিনষ্ট করে, ফলে স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়।
(খ) বন্যা :
পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ ছোট বড় বহু নদী বাংলাদেশের উপর দিয়ে বহমান। প্রায় সবগুলি নদীরই উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের বাইরে। বর্ষা মৌসুমে এসব নদী প্রচুর পানি ও পলি বহন করে মাঠ ঘাট ছাপিয়ে তুলে। এর সাথে যোগ হয় মৌসুমী বৃষ্টিপাত। ফলে সমভূমিতে দেখা দেয় বন্যা। মৌসুমভেদে বন্যার প্রকোপ খুবই তীব্রতর হয়। ফলে ভেসে যায় মাঠ, ঘাট, শহর, বন্দর, এবং গ্রাম—জনপদ। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটে মাঠ ফসলের এবং বাড়ি ঘরের। প্রাণহানি ঘটে মানুষ, গবাদিপশু ও অন্যান্য প্রাণীর। দূষিত হয়ে পড়ে পানিসহ পরিবেশের অন্যান্য উপাদান। ফলে প্রাদুর্ভাব ঘটে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয়সহ প্রাণঘাতী বহু রোগের।
(গ) কালবৈশাখী ও টর্নেডো :
প্রতিবছরই চৈত্র—বৈশাখ মাসে রদ্ররোষে আঘাত হানে ূ কালবৈশাখী। মৌসুমী—পূর্ব ঋতুর এমন ঝড়োবাতাস প্রধানত উত্তর পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। এই ঝড়ের সর্বোচ্চ বেগ ৬০ থেকে ১৩০ কি. মি. এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই ঝড়ের সাথে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং কখনো কখনো বজ্রসহ শিলা বৃষ্টিপাত ঘটে। কালবৈশাখীর বজ্র—মেঘ কখনো কখনো শক্তি সঞ্চয় করে মারাত্বক আকার ধারণ করে এবং হাতির শুঁড়ের আকৃতি সদৃশ মেঘ ভূমির দিকে নেমে আসে।
এর নাম টর্নেডো। স্বল্প সময়ের মধ্যে কোন স্থানের বায়ুর চাপ দ্রুত কমে ২৫ মিলিবারের নিচে নেমে আসলে ভয়াবহ টর্নেডোর আশঙ্কা থাকে। টর্নেডোর শুঁড়ের আওতায় থাকে প্রচন্ড ঘূর্ণি। যে এলাকার উপর দিয়ে এ ঝড় প্রবাহিত হয় সেখানে ঘরবাড়ি, গাছ—পালা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। প্রাণ হারায় অসংখ্য প্রাণী। অনেক সময় মাঠের ফসল পর্যন্ত জ্বলে পুড়ে যায়।
৩। জ্বালানি ও বনসম্পদ
দ্রূত গতিতে বাড়ছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। এই জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন বাসস্থান, আসবাবপত্র, জ্বালানি ইত্যাদি উপকরণ। আর এসবের সিংহ ভাগই আসছে বনসম্পদ থেকে। ফলে দেশের সীমিত বনসম্পদের উপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ৬ শতাংশ। সুতরাং বন উজাড়িকরণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে । ভূমি ক্ষয় ত্বরান্বিত হচ্ছে, নদীর ভাঙ্গন ও বৃদ্ধি পাচ্ছে । প্রভাব পড়ছে আবহাওয়ার উপর বাড়ছে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা। আবাসস্থল সংকুচিত হওয়ায় বিপন্নের মুখোমুখি বহু বন্যপ্রাণী।
৪। অপরিকল্পিত নগরায়ন
দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১২ ভাগ শহরাঞ্চলে বাস করে। বৃহৎ শহরগুলির মধ্যে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ৬০ লক্ষের উপরে এবং আগামী ২০০০ সালের মধ্যে হয়ত ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১২ ভাগ শহরাঞ্চলে বাস করে। বৃহৎ শহরগুলির মধ্যে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ৬০ লক্ষের উপরে এবং আগামী ২০০০ সালের মধ্যে হয়ত ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অন্যান্য বড় শহরগুলির জনসংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য যে নাগরিক সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন ছোট বড় কোন শহরেই তা পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেনি। শহরগুলিতে রয়েছে আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত আবাস গৃহ, সংকীর্ণ রাস্তা—ঘাট, ত্রুটিপূর্ণ পয়:প্রণালী ও ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থা, যত্রতত্র বস্তি এলাকা এবং আরও বহুবিধ সমস্যা। ফলে শহরের বাসিন্দারা প্রায়ই শ্বাসযন্ত্রের রোগ, যক্ষ্মা, কৃমি, ডাইরিয়া, আমাশয়, হেপাটাইটিস, এবং টাইফয়েডের মতো অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও দুষিত পানি সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
৫। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন
বাংলাদেশ শিল্পোন্নত দেশ নয়। তথাপি ছোট বড় বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখানে রয়েছে এবং নতুনভাবে গড়ে উঠছে। ভারী শিল্পের মধ্যে রয়েছে পাট, বস্ত্র, চিনি, কাগজ, সিমেণ্ট, সার এবং জাহাজ নির্মাণ। মাঝারী ও ক্ষুদ্র শিল্পের মধ্যে চামড়া, খাদ্য, তামাক, গার্মেণ্টস, ডিস্টিলারি শিল্পের নাম উলেখযোগ্য। অধিকাংশ শিল্প কারখানাগুলোর অবস্থান শিল্প এলাকার বাইরে, যেমন নদ—নদীর ধারে অথবা কোন আবাসিক এলাকায়। এসকল শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পরিশোধনের কোন্ ব্যবস্থা নেই। ফলে তা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।
পরিবেশের ওপর উদ্ভিদ ও বনায়নের প্রভাব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ১ নং ইউনিটের ১.৪ নং পাঠ।
পরিবেশের ওপর উদ্ভিদ ও বনায়নের প্রভাব
আবহাওয়াজনিত উপাদান, মাটি, পানি, জীবকূল সবকিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। জীবকূলের অন্যতম উপাদান উদ্ভিদ, যা একমাত্র প্রাথমিক উৎপাদনকারী হিসেবে বিবেচিত। আর অন্যসব প্রাণী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই উদ্ভিদকূলের উপরই নির্ভরশীল। সুতরাং পরিবেশ ও প্রাণিজগতের সাথে উদ্ভিদের রয়েছে নিগূঢ় সম্পর্ক।
সবুজ উদ্ভিদ ও স্থানীয় জলবায়ু :
স্থানীয় জলবায়ু সংরক্ষণে প্রতিটি সবুজ উদ্ভিদ ও গাছপালার একটি ভূমিকা রয়েছে, তা সে ছায়া দান করেই হোক অথবা বায়ু প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেই হোক। গাছপালা বহুলাংশে আঞ্চলিক জলবায়ু প্রভাবিত করে। সবুজ উদ্ভিদ প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প বায়ু মন্ডলে ত্যাগ করছে।এই জলীয় বাষ্প উপরে উঠে শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে ঘনীভবনের মাধ্যমে মেঘে পরিণত হয় এবং বৃষ্টিপাত ঘটায়। আমাজান উপত্যকার মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় অর্ধেকই স্থানীয় উদ্ভিদের প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে হয়ে থাকে। আর এই বৃষ্টির পানিতে CO2 ও নাইট্রোজেনযুক্ত হয়ে আসার ফলে ভূমির উর্বরতাও বৃদ্ধি পায়।
উদ্ভিদের প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বায়বীয় তাপ শোষণ করা। এক গ্রাম পানি বাষ্পীভবনের জন্য ৫৮০ ক্যালরি শক্তির প্রয়োজন। উদ্ভিদের পাতা ও পারিপার্শ্বিকতায় যে পরিমাণ সৌরশক্তি পতিত হয়ে তাপ শক্তিতে পরিণত হয় তার একটি বিরাট অংশই প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরঃসিত হয়। ফলে উদ্ভিদ ও তার পরিবেশ অতিরিক্ত তাপের প্রভাবমুক্ত থাকে। এ কারণেই আলোক
উজ্জ্বল গ্রীষ্মের দুপুরে মুক্ত এলাকা অপেক্ষা বৃক্ষতলে বেশি শীতলতা অনুভূত হয়।
সবুজ উদ্ভিদ ও বায়ুমন্ডল :
বেঁচে থাকার জন্য প্রাণীকূল বায়ুমন্ডল থেকে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে অক্সিজেন (ঙ২) গ্রহণ করে এবং কার্বন—ডাই—অক্সাইড (CO2) ত্যাগ করে। কিন্তু উদ্ভিদ প্রাণিকূলের বর্জ্য CO2 গ্রহণ করে সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতিতে তা আত্তীকরণ করে। কার্বন গ্রহণকারী গাছপালাকে একারণেই ‘কার্বন ধারক’ বলা হয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রতি হেক্টর সবুজ ভূমি থেকে উদ্ভিদ প্রায় ৯০০ কেজি কার্বন আত্তীকরণ করছে এবং বর্জ্য হিসেবে প্রায় ৬৫০ কেজি অক্সিজেন ত্যাগ করছে। বর্তমানে বায়ুতে CO2 এর পরিমাণ প্রায় শতকরা ০.০৩৫ ভাগ বা ৩৫০ পিপিএম।
কিন্তু ১৯৫৭ সালে তা ছিল ৩১৫ পিপিএম। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে অধিকহারে জ্বালানি ভস্ম দহনের কারণেই বায়ুমন্ডলে CO2 এর পরিমাণ বেড়ে চলেছে এবং তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া মানুষের বর্ধিত চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে সারাবিশ্ব জুড়ে নির্বিচারে বন নিধন চলছে।
এর ফলে পরিবেশ একদিকে হারাচ্ছে কার্বন আত্তীকরণের উৎস এবং অন্য দিকে অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রাকৃতিক কারখানা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) হিসেব মতে, উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে বাৎসরিক বন উজাড়ের পরিমাণ ১১.৪ বিলিয়ন হেক্টর। বিশ্বজুড়ে মানুষের কর্মকান্ডের কারণেই ১০ শতাংশ জমি ইতোমধ্যেই বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে এবং আরও ২৫ শতাংশ হুমকির সম্মুখীন। বন উজাড়িকরণে আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। ভারত বিভাগকালে ১৯৪৭ সালে এদেশে বনভূমির পরিমাণ ছিল ২৪ শতাংশ কিন্তু বর্তমানে তা কমে গিয়ে প্রায় ৬ শতাংশে দাড়িয়েছে।
১৯৮৩ সালে ইতালির রোম থেকে প্রকাশিত ‘জ্বালানির জন্য কাঠ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে গুরুতর বৃক্ষ সংকট তাড়িত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে এভাবে বন নিধন কার্য অব্যাহত থাকলে বায়ুমন্ডলে CO2 ও ঙ২ এর ভারসাম্যতা আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। ফলে বর্ধিত CO2 এর কারণে বেড়ে যাবে গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া। আর অনিশ্চিত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে বিশ্বের সকল প্রাণীকূল। তাই CO2 এর আত্তীকরণ প্রক্রিয়া বাড়ানোর জন্য একদিকে যেমন বন উজাড়িকরণ রোধ করা প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমনি আশু বনায়ন কর্মসূচী গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
উদ্ভিদ ও ভূমি সংরক্ষণ :
বৃক্ষরোপণ করে বৃক্ষের উচ্চতার ২০ গুণ পরিমিত জায়গা বায়ুক্ষয়জনিত প্রভাব থেকে রক্ষা করা সম্ভব। চীনে বৃক্ষ দ্বারা বায়ু প্রতিরোধী আশ্রয় বলয় সৃষ্টি করে শস্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়েছে। ভূমি সংরক্ষণে সবুজ উদ্ভিদ ও বনায়নের ভ মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বায়ু ও জলীয় ক্ষয়জনিত কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন মাটি ভূমির উপর থেকে অপসারিত হয়। এতে ভূমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, মাটি অনাবৃত হয়ে পড়ে এবং ভূমির উপর থেকে উদ্ভিদ আচ্ছাদন বিনষ্ট হয়। মাটি থেকে খাদ্যবস্তু অপসারিত হবার কারণে অথবা লবাণক্ততা বা জলাবদ্ধতার কারণে মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ে।
এসকল উপসর্গের বিরুদ্ধে উদ্ভিদ ও বনায়নই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। বায়ু প্রতিরোধী বৃক্ষরোপণ করে বৃক্ষের উচ্চতার ২০ গুণ পরিমিত জায়গা বায়ুক্ষয়জনিত প্রভাব থেকে রক্ষা করা সম্ভব। চীনে বৃক্ষ দ্বারা বায়ু প্রতিরোধী আশ্রয় বলয় সৃষ্টি করে শস্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়েছে। মরক্কোতে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বালিয়াড়ি স্থানান্তর প্রতিহত করে কৃষি ভূমিকে রক্ষা করা হয়। অবস্থানগত কারণে প্রতিবছর এদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘুর্ণিঝড় ও সাইক্লোনের প্রভাব থেকেই যাবে। এ অবস্থা মোকাবেলায় উপকূলীয় বনভূমি ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করতে পারে।
সবুজ উদ্ভিদ ও বনভূমি বৃষ্টিপাতের প্রভাবজনিত ভূমিক্ষয় সীমিত রাখে, বন্যাতাড়িত পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং ভূমিকে সংঘবদ্ধ রেখে ক্ষয়রোধ করে। উঁচু ঢালু উপত্যকায় উদ্ভিদের এ ধরনের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী। আন্ত—ফসল ও সাথী—ফসল (অষষবু পৎড়ঢ়ঢ়রহম) চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে শস্যের উৎপাদন ও ভূমির উর্বরতা উভয়ই বজায় রাখা হয়।
উদ্ভিদের পাতা ও বর্জ্য পচন ক্রিয়ার মাধ্যমে ভূমির হিউমাস ও উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। কোন কোন উদ্ভিদ বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন সরাসরি মাটিতে আবদ্ধকরণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সার সংগ্রহকারির ভূমিকা পালন করে। এসবের মধ্যে ডালজাতীয় ফসলের মুলে বসবাসকারী মিথোজীবি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আহরিত নাইট্রোজেনের নাম বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। অনেক ক্ষেত্রে আন্তফসল (ওহঃবৎ পৎড়ঢ়ঢ়রহম) ও সাথীফসল (অষষবু পৎড়ঢ়ঢ়রহম) চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে শস্যের উৎপাদন ও ভূমির উর্বরতা উভয়ই বজায় রাখা হয়।
উদ্ভিদ ও শক্তি :
যে কোন যন্ত্রযান পরিচালনার জন্য শক্তির প্রয়োজন। ঘড়ির কাটা কুন্ডলিত ি¯প্রং অথবা ব্যাটারিতে রক্ষিত শক্তি খরচ করে সময় নির্দেশ করে। জীবকেও গতিশীল বা কার্যক্ষম রাখার জন্য শক্তির প্রয়োজন। আর জীবের এই শক্তি আসে খাদ্য গ্রহণ ও তা বিপাকের মাধ্যমে। কিন্তু এই খাদ্যের জন্য পৃথিবীর সকল প্রাণীকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। সবুজ উদ্ভিদ ও গাছপালা পাতার ক্লোরোফিলের সাহায্যে সৌর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বায়ুমন্ডলের CO2 ও মৃত্তিকাস্থ পানির দ্বারা শর্করাজাতীয় খাদ্য তৈরি করে। তৃণভোজী প্রাণী প্রত্যক্ষভাবে এসব উদ্ভিদকে খাদ্য রূপে গ্রহণ করে। আবার মাংসাশী প্রাণীরা তৃণভোজী প্রাণীকে খাদ্য রূপে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে। সুতরাং খাদ্যরূপী জ্বালানির ধারক হিসাবে উদ্ভিদের কোন বিকল্প নেই। এ কারণে উদ্ভিদ ব্যতীত পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না।
উদ্ভিদ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি :
পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫৫০ কোটি এবং প্রতি বছর প্রায় ২% হারে তা বেড়ে চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৪০ বৎসরের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫৫০ কোটি এবং প্রতি বছর প্রায় ২% হারে তা বেড়ে চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৪০ বৎসরের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। পৃথিবীতে বর্তমানে যে আবাদযোগ্য জমি আছে তা দিয়ে এই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য যোগান দেয়া যাবে না। ফলে উদ্ভাবন করতে হবে আরও অধিক উফশীজাতের ফসল এবং উন্নততর উৎপাদন প্রযুক্তি।
আর এসব কিছুর সাথেই সম্পৃক্ত থাকে পরিবেশ দূষণের আশংকা। তবে খাদ্য যোগান প্রক্রিয়া বহুলাংশেই নির্ভর করবে কী পরিমাণ দক্ষতার সাথে সবুজ উদ্ভিদ সৌর শক্তিকে ব্যবহারযোগ্য খাদ্যশক্তিতে রুপান্তরিত করতে পারছে তার উপর। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে পৃথিবীতে যে পরিমাণ সৌর শক্তি সালোক—সংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য শক্তিতে পরিণত হয় তার শতকরা ৫০—৮০ ভাগই সাগরে সংঘটিত হয়। তাই বিকল্প খাদ্য হিসাবে প্রাণীকে ভবিষ্যতে সাগরের দিকেই হয়তো তাকাতে হবে। তবে সময় থাকতে জনসংখ্যা সীমিত রাখাই উৎকৃষ্ট পন্থা।
সবুজ উদ্ভিদ ও জ্বালানি :
সভ্যতার এ যুগে জ্বালানির প্রধান উৎস হচ্ছে কাঠ, কয়লা, ডিজেল, পেট্রোল, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি। এসবগুলোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদজাত উপাদান। সুদূর অতীতে মাটির নিচে চাপা পড়ে বড় বড় বৃক্ষ কয়লায় পরিণত হয়েছে। ভূগর্ভে মজুদ তেল ও গ্যাস প্রকারান্তরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ থেকেই সৃষ্ট পদার্থ। কাজেই বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতাকে উদ্ভিদই সচল রেখেছে। তবে উদ্ভিদজাত এসকল পদার্থই পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার উদ্ভিদই এর অনেকাংশ আত্তীকরণের মাধ্যমে পৃথিবীকে উপহার দিতে পারে নির্মল পরিবেশ।
মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, আসবাবপত্র, শক্তি বা জ্বালানি এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য আরও বহু উপকরণের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। এমনকি রোগের ঔষধ, নেশাজাত দ্রব্য এসবও উদ্ভিদের দান। শুধু মানুষই নয় পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীকূল উদ্ভিদ ছাড়া তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না। কারণ সব প্রাণীই খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল।
তাই প্রকৃতিতে উদ্ভিদ, প্রাণী ও পরিবেশের সাথে রয়েছে নিগুঢ় সম্পর্ক। প্রাণীর নিঃশ্বাসের সাথে গৃহীত ঙ২ উদ্ভিদের সালোক—সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার উপজাত। আবার প্রশ্বাসের সাথে নির্গত CO2 উদ্ভিদের সালোক— সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার অতি জরুরী উপাদান। সুতরাং বায়ুমন্ডলে CO2 ও ঙ২ এর ভারসাম্য রক্ষায় উদ্ভিদ ও প্রাণী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এছাড়াও বৃষ্টিপাত, বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা, বজ্রপাত, কল কারখানার ধেঁায়া ও শব্দ ইত্যাদি প্রতিহত করে পরিবেশকে স্বচ্ছ রাখতে উদ্ভিদের অবদান রয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ইকোসিস্টেম – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ১ নং ইউনিটের ১.৩ নং পাঠ।
বিভিন্ন ধরনের ইকোসিস্টেম
আলো, বাতাস, পানি, মাটি, উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব এবং এদের পারস্পরিক ক্রিয়া—বিক্রিয়া বিশেষণে গোটা পৃথিবীটাই একটি বিশাল ইকোসিস্টেম। কিন্তু বিশ্লেষণ ক্ষমতার বিচারে এত ব্যাপক একটি ইকোসিস্টেম পর্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনা করা খুবই দূরহ ব্যাপার। সে কারণেই ইকোসিস্টেমের শ্রেণিবিন্যাস প্রয়োজন যাতে করে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি একক হিসেবে তা পর্যবেক্ষণ করা যায়।
এদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ইকোসিস্টেম।
১। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম :
প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমগুলো মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রাকৃতিক পরিবেশে গতিময়তা বজায় রেখে চলে। বসতির (ঐধনর:ধ:) প্রকৃতি অনুযায়ী এরা দু’ধরনের হয়ে থাকে। যেমন:
যেমন: পুকুর, নদী, ঝরনা, খাল, হ্রদ ইত্যাদি স্বাদু পানির ইকোসিস্টেম এবং সাগর, মহাসাগর, মোহনা ইত্যাদি লোনা পানির ইকোসিস্টেম।
২। কৃত্রিম ইকোসিস্টেম :
এসব ইকোসিস্টেমের ভৌত রাসায়নিক পরিবেশ বহুলাংশে মানুষের নিয়ন্ত্রণে থেকে পরিচালিত হয়, যেমন: কৃষিজ ইকোসিস্টেম। উপাদানের দিক বিশ্লেষণে প্রতিটি ইকোসিস্টেমের ধরন প্রায় একই রকম। কারণ সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে স্ব—ভোজী ও পরভোজী উপাদান। কিন্তু যে সকল জীব নিয়ে উপাদানগুলি গঠিত তা ভিন্নতর। এখানে কয়েকটি প্রধান ইকোসিস্টেমের বর্ণনা দেয়া হ‘ল।
১। পুকুরের ইকোসিস্টেম :
পুকুরের ইকোসিস্টেম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পদ্ধতি। এর উপাদানগুলি নিম্নরূপে উপস্থাপন করা যায় :
(ক) জড় উপাদান :
জড় বস্তুর মধ্যে প্রধান জৈব ও অজৈব যৌগিক উপাদানগুলো হচ্ছে পানি, কার্বন—ডাই—অক্সাইড, অক্সিজেন, ক্যালসিয়াম, নাইট্রোজেন, ফসফেট, অ্যামিনো এসিড, হিউমিক এসিড ইত্যাদি। এগুলোর অধিকাংশই পুকুরের তলদেশে তলানী হিসেবে জমা থাকে এবং কিছু পরিমাণ উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে দ্রবণীয় অবস্থায় থাকে। পুকুরের ইকোসিস্টেমে দু’ধরনের প্রাথমিক উৎপাদনকারী পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রয়েছে সবুজ উদ্ভিদ ও কিছু সালোক—সংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া, আবার অন্যদিকে রয়েছে ফাইটোপ্লাংটন।
(খ) প্রাথমিক উৎপাদনকারী :
পুকুরের ইকোসিস্টেমে দু’ধরনের প্রাথমিক উৎপাদনকারী পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রয়েছে সবুজ উদ্ভিদ ও কিছু সালোক—সংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া, আবার অন্যদিকে রয়েছে ফাইটোপ্লাংটন। মাটির সঙ্গে সংযুক্ত অথবা ভাসমান সবুজ উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে, শাপলা, শালুক, কচুরীপানা, টোপাপানা, ক্ষুদিপান, হাইড্রিলা, ইলোডিয়া ইত্যাদি। ফাইটোপ্লাংটনগুলি সাধারণত ছোট ছোট মুক্ত ভাসমান নিম্নশ্রেণির শৈবালজাতীয় উদ্ভিদ ও ফ্ল্যাজিলেট। পুকুরে এদের বিস্তৃতি সাধারণভাবে যতদর গভীরতায় সূ ূর্যের আলো পেঁৗছে ততদূর পর্যন্ত। তবে পুকুরের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এরা গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
(গ) খাদক :
পুকুরের তলদেশে বাস এবং উদ্ভিদ অবশেষের উপর নির্ভরশীল বেনথনিক জীবগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মাছ, কীট—পতঙ্গ, ঝিনুক, শামুক, ক্রাস্টেশিয়ান ইত্যাদি। এসব তৃণভোজী ছাড়াও রয়েছে গৌণখাদক, যেমন: ছোট মাছ খেয়ে জীবন ধারণকারী বড় মাছ ও কীট—পতঙ্গ, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি এবং রটিফারজাতীয় জুপ্লাংটন।
(ঘ) বিয়োজক :
পুকুরের বিয়োজকদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ফ্ল্যাজিলেটস এবং ছত্রাকের প্রাধান্যই বেশি। এরা সমস্ত পুকুরে সুবিস্তৃত থাকলেও কর্দমাক্ত স্থানে
অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। এছাড়া পুকুরে কিছু সংখ্যক ট্রান্সফরমার ব্যাকটেরিয়াও থাকে।
২। সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম :
ভূ—পৃষ্ঠের প্রায় ৭০ ভাগ স্থান জুড়ে রয়েছে সাগর, মহাসাগরের বিস্তৃতি। সাগরের পানি লবণাক্ত হওয়ার কারণে এর রাসায়নিক পরিবেশ খুব স্থিতিশীল।
(ক) উৎপাদক :
সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের প্রধান উৎপাদক হচ্ছে ফাইটোপ্লাংটন। যেমন:সবুজ, নীলাভ—সবুজ, লোহিত এবং ধূসর শৈবাল আধিক্যই বেশি।
(খ) খাদক :
প্রাথমিক তৃণভোজী খাদকের মধ্যে ক্রাস্টেশিয়ান, মোলাক্স (শামুক, ঝিনুক), শাকাশী মাছ ইত্যাদি প্রধান। গৌণ খাদকের মধ্যে রয়েছে ঐবৎৎরহম, ঝযধৎশ, ঈড়ফ, গধপশবৎবষ ইত্যাদি মাংসাশী মাছসমূহ।
(গ) বিয়োজক :
সমুদ্রে মৃত জীবের বিয়োজক হিসেবে ব্যাকটেরিয়ার প্রাধান্যই মুখ্য। এছাড়াও রয়েছে কিছু ছত্রাক। সমুদ্রের ১ লিটার পানিতে ৫ লক্ষ পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া জীবের বর্জ্য ও মৃতদেহের উপর ক্রিয়া—বিক্রিয়া দ্বারা উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় অজৈব পদার্থ সৃষ্টি করে।
যেসব অঞ্চলে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি কিন্তু তাপমাত্রা বেশি নয় সেসব স্থানে বনভূমির সৃষ্টি হয়। আবহাওয়ার তারতম্যের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে।
৩। বনজ ইকোসিস্টেম :
যেসব অঞ্চলে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি কিন্তু তাপমাত্রা বেশি নয় সেসব স্থানে বনভূমির সৃষ্টি হয়। আবহাওয়ার তারতম্যের উপর নির্ভর করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। এসব বনাঞ্চলের নির্ধারিত ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় থাকলেও কর্ম পদ্ধতি প্রায় অবিচ্ছেদ্য।
(ক) উৎপাদক :
বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদই বনের মুখ্য উৎপাদক। অবশ্য বনাঞ্চলের প্রকৃতি অনুযায়ী বৃক্ষরাজির বিভিন্নতা ও স্তরবিন্যাসে পার্থক্য রয়েছে। যেমন: উষ্ণমন্ডলীয় বনভূমি পত্রঝরা প্রকৃতির হওয়ায় সেখানে কিছু ছায়া প্রেমিক গুল্ম ও বীরুতজাতীয় গাছও জন্মে; আবার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলীয় বনভূমিতে পত্রঝরা, চিরহরিৎ, কনিফার ধরনের অরণ্য সৃষ্টি হয়।
(খ) খাদক :
প্রাথমিক খাদক হচ্ছে তৃণভোজী প্রাণী, যেমন: পোকা—মাকড়, হরিণ, বাদুর, বিভিন্ন ধরনের পাখি, কাঠবিড়ালি, ইঁদুর, হাতি ইত্যাদি। আবার গৌণ খাদকের মধ্যে রয়েছে, সাপ, পাখি, গিরগিটি, শিয়াল ইত্যাদি এবং টার্সিয়ারি খাদকের মধ্যে রয়েছে— কিছু পাখি, বাঘ, সিংহ হায়েনা প্রভৃতি।
(গ) বিয়োজক :
বনজ ইকোসিস্টেমের বিয়োজকের মধ্যে রয়েছে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, নেমাটোড, এনেলিডা, মিলিপেড, সেণ্টিপেড, ফ্ল্যাটওয়ার্ম, কেঁচো, শামুক, পিপড়া, উঁইপোকা ইত্যাদি।
পৃথিবীর এক বিস্তির্ণ এলাকা ( প্রায় ১৩ মিলিয়ন বর্গ মাইল) তৃণদ্বারা আচ্ছাদিত। এখানে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫—৭৫ সে. মি. যার ফলে প্রচুর ঘাস জন্মে এবং এধরনের ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে।
৪। তৃণভূমির ইকোসিস্টেম :
পৃথিবীর এক বিস্তির্ণ এলাকা (প্রায় ১৩ মিলিয়ন বর্গ মাইল) তৃণদ্বারা আচ্ছাদিত। এখানে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫—৭৫ সে. মি. যার ফলে প্রচুর ঘাস জন্মে এবং এধরনের ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য তৃণভূমির মধ্যে কানাডার বিস্তির্ণ সমতলভূমি, যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেণ্টিনা, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত তৃণভূমি রয়েছে।
(ক) প্রাথমিক উৎপাদক :
এৎধসরহবধব ও ঈুঢ়বৎধপবধব পরিবারের উদ্ভিদের প্রাধান্যই বেশি। তবে কিছু কিছু গুল্ম ও বিরুৎকেও প্রাথমিক উৎপাদক হিসেবে দেখা যায়।
(খ) খাদক :
তৃণভোজী প্রাণী বিশেষ করে স্তন্যপায়ী জীব, পাখি, পোকা—মাকড় ও সরীসৃপ তৃণের উপর মূখ্য খাদক হিসেবে নির্ভরশীল। গৌণ খাদকের মধ্যে রয়েছে শিয়াল, সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, পাখি ইত্যাদি।
(গ) বিয়োজক :
বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও মোল্ড, ইত্যাদি উলেখযোগ্য। বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে কম (সাধারণভাবে ২৫ সে.মি.—এর নিচে) এবং যেখানে তাপের আধিক্য রয়েছে সেখানে মরুজ ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে। পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ১৭ ভাগ এলাকাই মরুময়।
৫। মরুজ ইকোসিস্টেম :
বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে কম (সাধারণভাবে ২৫ সে. মি.এর নিচে) এবং যেখানে তাপের আধিক্য রয়েছে সেখানে মরুজ ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে। পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ১৭ ভাগ এলাকাই মরুময়।
(ক) প্রাথমিক উৎপাদক :
প্রধান উৎপাদকের মধ্যে রয়েছে গুল্ম, ঝোপ—ঝাড়, ক্যাকটাস, মস, লাইকেন, কিছু ঘাস ও বৃক্ষ, নীলাভ—সবুজ শৈবাল ইত্যাদি। এ সকল উদ্ভিদের মুল অসংখ্য শাখা প্রশাখাযুক্ত এবং মাটির সামান্য নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে সামান্য বৃষ্টিপাত হলে খুব সহজেই পানি সংগ্রহ করতে পারে। প্রস্বেদনের হার কমানোর জন্য এদের পাতা, কান্ড ও শাখাগুলো বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়ে থাকে।
(খ) খাদক :
এই ইকোসিস্টেমে উৎপাদন কম হওয়ার কারণে খাদকের সংখ্যাও কম। মরু খাদকের মধ্যে সরীসৃপজাতীয় প্রাণী ও কীট—পতঙ্গ প্রধান। এছাড়া রয়েছে মরু—জাহাজ বলে খ্যাত উট, মেষ, মরু ব্যাঙ, ইঁদুর, পেঁচা, টিকটিকি ইত্যাদি প্রাণী।
(গ) বিয়োজক :
মরুজ ইকোসিস্টেমে তুলনামুলকভাবে বিয়োজকের সংখ্যাও খুব সীমিত। ফলে মৃতদেহ পঁচে হিউমাস তৈরি হবার পরিবর্তে অত্যধিক তাপে তা শুকিয়ে যায়। একারণেই সেখানে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় না। তবু তাপ সহ্যকারী কিছু সংখ্যক ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া সেখানে বিয়োজক হিসেবে কাজ করে।
কৃষিজ ইকোসিস্টেম :
এটি মানব সৃষ্ট একটি কৃত্রিম ইকোসিস্টেম। এখানে মানুষ তার চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ফসলের সর্বোচ্চ উৎপাদন বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক, সেচের ব্যবস্থা, আগাছা অপসারণ ইত্যাদি কার্যক্রম চালু রাখে। ফলে এখানে উৎপাদনই মুখ্য বিষয়।
(ক) জড় উপাদান :
স্থানীয় জলবায়ু, মৃত্তিকার ধরন ও খনিজ পদার্থের পরিমাণ, ব্যবহৃত জৈব ও অজৈব সার ইত্যাদি মিলেই কৃষিজ ইকোসিস্টেমের জড় উপাদান।
(খ) উৎপাদক :
চাষকৃত উদ্ভিদই শস্য ক্ষেত্রের মুখ্য উৎপাদক। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের আগাছা যা শস্য ক্ষেত্রে জন্মে তারাও উৎপাদক হিসাবে বিবেচিত।
(গ) খাদক :
প্রাথমিক স্তরে খাদকের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পোকা, শশক, ইঁদুর, পাখি, গবাদি পশু, মানুষ ইত্যাদি। গৌণ খাদকের মধ্যে রয়েছে ব্যাঙ, সাপ, বিভিন্ন ধরনের পাখি যারা পোকা—মাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে।
(ঘ) বিয়োজক :
প্রধান বিয়োজককারীরা হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অপ:রহড়সুপব:বং. এদের পঁচনক্রিয়ার ফলেই মাটিতে উৎপাদকের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ মজুত থাকে।
ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ইকোসিস্টেম , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ১ নং ইউনিটের ১.৫ নং পাঠ।
ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ইকোসিস্টেম
কোন জীবই পৃথিবীতে অবিমিশ্র অবস্থায় বাস করতে পারে না। প্রায় সকল জীবই একদিকে তার পরিবেশ অন্যদিকে অন্যান্য জীবের সাথে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। বিভিন্ন জাতের জীবের এরূপ সমষ্টিগত বসবাসরীতিকে জীব—স¤প্রদায় বলে। আবার জীব—সম্প্রদায় এবং অজৈব পরিবেশের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া—বিক্রিয়া দ্বারা একটি অবিচ্ছেদ্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয় যার নাম ইকোসিস্টেম। এ.জি. টেনসলি (১৯৩৫) নামে একজন বৃটিশ পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। পরে সুকাচেভ নামক একজন রুশ পরিবেশ বিজ্ঞানী এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ইকোসিস্টেম হচ্ছে একটি গতিময় পদ্ধতি যেখানে জীব ও জড় উপাদানের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়াবিক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের গঠন ও কার্যের পরিবর্তন ঘটছে।
ইকোসিস্টেমের সংজ্ঞা :
ইকোসিস্টেম (Ecosystem) একটি ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা প্রতিশব্দ বাস্তুতন্ত্র। বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম হচ্ছে জৈব, অজৈব পদার্থ ও বিভিন্ন জীবসমন্বিত এমন প্রাকৃতিক একক যেখানে বিভিন্ন জীবসমষ্টি পরস্পরের সাথে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে।
ই. পি. ওডামের মতে:
ইকোসিস্টেম বলতে জীব, প্রকৃতি ও তাদের আনুষঙ্গিক উপাদানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিক্রিয়ার মূল কার্যকর একককে বুঝায়। কিন্তু, এস. মাথাভান (১৯৭৪) এর মতে, জীব ও তার পরিবেশ নিজেদের মধ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া—বিক্রিয়ার পদ্ধতিকে ইকোসিস্টেম বলে।
ইকোসিস্টেমের কার্য পদ্ধতি :
ইকোসিস্টেমে উদ্ভিদ, প্রাণী ও তাদের পরিবেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত সম্পদ সৃষ্টি ও বিনিময় ঘটছে। এই প্রক্রিয়াকে সম্পদের আবর্তন (ঈুপষরহম ড়ভ সধঃবৎরধষং) বলে। এই আবর্তন প্রক্রিয়ায় সকল শক্তির উৎস সূর্য। একমাত্র সবুজ উদ্ভিদ সৌর শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম। এভাবে সঞ্চিত শক্তি খাদ্য হিসেবে এক জীব থেকে অন্য জীবে স্থানান্তর হয় এবং সেখান থেকে আবার অন্য জীবে স্থানান্তরিত হতে থাকে। প্রতিটি খাদ্য স্থানান্তরের ধাপকে খাদ্য স্তর (ঞৎড়ঢ়যরপ ষবাবষ) বলে। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরেই অবশ্য কিছুটা শক্তির অপচয় ঘটে। এই সমগ্র পদ্ধতির নাম শক্তির প্রবাহ (ঋষড়ি ড়ভ বহবৎমু)। ইকোসিস্টেমে জীব ও জড়ের মধ্যে শক্তি প্রবাহ বহমান থাকায় একে গতিশীল বলে মনে করা হয়।
ইকোসিস্টেমের উপাদান :
কার্যপ্রণালির দিক বিবেচনায় ইকোসিস্টেমের উপাদান সম হকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এর এক দিকে রয়েছে অটোট্রফিক বা স্বভোজী যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপন্ন করতে সমর্থ, যেমনঃ সবুজ উদ্ভিদ। আবার অন্যদিকে আছে হিটারোট্রফিক বা পরভোজী যারা খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না বলে খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল, যেমনঃ মানুষসহ অন্যান্য সকল প্রাণী। কিন্তু গঠনগত দিক বিবেচনায় ইকোসিস্টেমের উপাদানগুলিকে জড় ও জৈবিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
১। জড় উপাদান:
ইকোসিস্টেমের জড় উপাদানগুলো সাধারণত দু’ধরনের হয়ে থাকে। এর একদিকে রয়েছে মাটি, পানি, খাদ্য, কার্বন—ডাই—অক্সাইড, নাইট্রেজেন, ফসফরাস, প্রভৃতি মৌলিক ও যৌগ দ্রব্যসমূহ এবং অন্যদিকে রয়েছে আলো, তাপ ইত্যাদি শক্তিসমূহ। এগুলি উদ্ভিদ দ্বারা গৃহীত হয় এবং সূর্যালোকের সাহায্যে খাদ্যে রূপান্তরিত হয়। আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীবের সাহায্যে মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ পঁচনের ফলে পুনরায় মাটি ও বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়াকে জীব—ভূ—রাসায়নিক চক্র (ইরড়মবড়পযবসরপধষ পুপষব) বলা হয়। তবে প্রতিটি উপাদানেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং স্থান—কালভেদে পরিবর্তনশীল যা জীবের প্রাচুর্য ও বিস্তৃতিকে প্রভাবিত করে।
২। জৈবিক উপাদান:
পরিবেশের জৈবিক উপাদানসমূহকে চারটি প্রধান অংশে ভাগ করা যায়, এরা হচ্ছে উৎপাদক, খাদক, বিয়োজক ও রূপান্তরক।
(ক) উৎপাদক
এরা সাধারণভাবে নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে পারে। এজন্য এদরেকে বলা হয় স্বভোজী (অঁঃড়ঃৎড়ঢ়যং)। সবুজ উদ্ভিদ পত্রস্থ ক্লোরোফিলের সাহায্যে সৌর শক্তিকে পানি ও কার্বন—ডাই—অক্সাইডযোগে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে জৈব খাদ্য উৎপাদন করে। এই খাদ্য উদ্ভিদ নিজে ব্যবহার করে এবং অন্যদের খাদ্যের যোগান দেয়। সবুজ উদ্ভিদ ছাড়াও কিছু কেমোসিনথেটিক ব্যাকটেরিয়া এবং বেগুনি রংএর ক্যারোটিনযুক্ত ব্যাকটেরিয়া সূর্যালোক ও যৌগিক পদার্থের উপস্থিতিতে নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে। এজন্য এদেরকেও প্রাথমিক উৎপাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
(খ) খাদক
যে সকল জীব নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে না বরং খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎপাদকের উপর নির্ভরশীল তাদেরকে খাদক বলে। যে সকল প্রাণী একমাত্র উদ্ভিদকেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদেরকে প্রাথমিক খাদক বলে। যেমনঃ ফড়িং, প্রজাপতি, কীট—পতঙ্গ, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হরিণ, খরগোশ ইত্যাদি। আবার কিছু প্রাণী আছে যারা সরাসরি খাদ্য হিসেবে উদ্ভিদ গ্রহণ না করে তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে। সেইজন্য এদেরকে দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদক বা গৌণ খাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যেমনঃ ব্যাঙ, সাপ, কাক, চিল ইত্যাদি প্রাণী। আবার কিছু কিছু মাংসাশী প্রাণী আছে যারা অন্য প্রাণীকতৃর্ক খাদ্যরূপে গৃহীত হয় না। এদেরকে সর্বোচ্চ খাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেমনঃ বাঘ, সিংহ, বাজপাখি, কুমির, হাঙ্গর ইত্যাদি। কিছু কিছু প্রাণী আছে যারা অবশ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়কেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে থাকে। এদেরকে বলা হয় সর্বভূক প্রাণী, যেমনঃ মানুষ।
(গ) বিয়োজক
যে সকল অণুজীব মৃত জীবদেহে অবস্থিত জৈব পদার্থগুলিকে ধাপে ধাপে ভেঙ্গে সরল পদার্থে রূপান্তরিত করে তাদেরকে বিয়োজক বলে। যে সকল অণুজীব মৃত জীবদেহে অবস্থিত জৈব পদার্থগুলিকে ধাপে ধাপে ভেঙ্গে সরল পদার্থে রূপাš রিত করে তাদেরকে বিয়োজক বলে। ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া বিয়োজকের পর্যায়ভুক্ত। এদের প্রভাবেই প্রাণীদেহের জৈব পদার্থগুলি উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী অজৈব পদার্থে রূপাš রিত হয়। বিয়োজকদেরকে অনেক সময় খাদক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কেননা জৈব পদার্থকে সরল পদার্থে পরিণত করার সময় এরা জৈব পদার্থ থেকে শক্তি সঞ্চয় করে থাকে।
(ঘ) রূপান্তরক
যে সকল ব্যাকটেরিয়া পঁচনের ফলে উৎপন্ন বস্তুর উপর ক্রিয়ার দ্বারা সেগুলিকে জৈব ও অজৈব পদার্থে রূপান্তরিত করে তাদেরকে রূপান্তরক বা ট্রান্সফরমার বলে। বিয়োজক ও ট্রান্সফরমারগুলো ইকোসিস্টেমের গতিময়তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এদের ক্রিয়া—কর্মের ফলেই জৈব ও অজৈব উপাদানসমূহ জৈব—ভূ—রাসায়নিক চক্রের মাধ্যমে আদি অবস্থানে ফিরে যায়। অন্যথায়, পৃথিবীর সকল ইকোসিস্টেমই মৃত জৈব উপাদানের আধিক্যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেত।
খাদ্য – শিকল
প্রকৃতিতে একমাত্র সবুজ উদ্ভিদই নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে অর্থাৎ তারা স্বভোজী। অন্যসব জীবকে খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপরই নির্ভর করতে হয়। উদ্ভিদ যে খাদ্য তৈরি করে তার কিছু অংশ নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করে, বাকি অংশ তার দেহে সঞ্চিত করে রাখে। এই সঞ্চিত খাদ্যই তৃণভোজী প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার মাংসাশী প্রাণীরা তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এভাবে সকল জীব খাদ্য ও খাদক সম্পর্ক স্থাপন করে ইকোসিস্টেমে শক্তি প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখে এবং এর মধ্য দিয়ে উৎপাদক ও সর্বোচ্চ খাদক পর্যন্ত খাদ্যের যে ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয় তার নাম খাদ্য—শিকল ।
একটি খাদ্য—শিকলে উৎপাদকের সাথে কয়েকটি পর্যন্ত খাদক স্তর থাকতে পারে, তবে সর্বোচ্চ খাদককে কোন প্রাণী খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে না। প্রকৃতিতে সাধারণত তিন ধরনের খাদ্য—শিকল দেখা যায়—
(১) শিকারজীবী শিকল :
এই খাদ্য—শিকলে উৎপাদক থেকে প্রথমে ছোট প্রাণী, পরে ক্রমান্বয়ে বড় প্রাণী যুক্ত হয়। যেমনঃ
ঘাস
ফড়িং
ব্যাঙ
সাপ
(২) পরজীবী শিকল :
এখানে বড় জীব থেকে ক্রমান্বয়ে ছোট জীবের মধ্যে খাদ্য—শিকল গড়ে উঠে, যেমনঃ
মানুষ
মশা
ম্যালেরিয়ার জীবাণু
(৩) মৃতজীবী শিকল :
এখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃতদেহের উপর ভিত্তি করে খাদ্য—শিকল গড়ে ওঠে, যেমনঃ
মৃতদেহ
ছত্রাক
কেঁচো
খাদ্য – জাল
প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমে খাদ্য—শিকলগুলো সকল সময় সরল পথে চলে না অর্থাৎ প্রয়োজনবোধে প্রাণীর খাদ্য স্তরের পারস্পরিক বিনিময় ঘটে। যেমনঃ একটি কাক সরাসরি গাছের ফলকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে অথবা তৃণভোজী কীট—পতঙ্গকে খাদ্য হিসেবে বেছে নিতে অথবা কীট—পতঙ্গকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণকারী অন্য কোন প্রাণীকেও তার খাদ্য—সামগ্রীর অšর্Íভূক্ত করতে পারে। এভাবে একটি ইকোসিস্টেমে বিভিন্ন খাদ্য—শিকলের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় ও সংযুক্তির মাধ্যমে যে জটিল সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার নাম খাদ্য—জাল। সাধারণত খাদ্য—জালে উৎপাদকের সংখ্যা অধিক থাকলেও খাদকের সংখ্যা প্রতিস্তরে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে থাকে।
চিত্র ১.২—২ খাদ্য—জাল
যে কোন ইকোসিস্টেমে প্রাথমিক উৎপাদক প্রথম স্তরের খাদক, দ্বিতীয় স্তরের খাদক, তৃতীয় স্তরের খাদক এবং এভাবে সর্বোচ্চ খাদকের সংখ্যা ভর এবং শক্তির মধ্যে কোন না কোন ভাবে একটি সম্পর্ক বজায় থাকে। খাদ্যস্তরগুলির মধ্যে এই সম্পর্ককে লৈখিক চিত্র অঙ্কন দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব, যা ইকোলোজিক্যাল পিরামিড নামে পরিচিত। ইকোলোজিক্যাল পিরামিডগুলো তিন ধরনের হয়ে থাকে (ক) সংখ্যার পিরামিড, (খ) জীবভরের পিরামিড এবং (গ) শক্তির পিরামিড। সংখ্যা ও জীবভরের পিরামিডের আকৃতি খাড়া বা উল্টানো অথবা অন্য কোন ধরনের হতে পারে, কিন্তু শক্তির পিরামিড সর্বদাই খাড়া আকৃতির হয়ে থাকে।
ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মঙ্গলের জন্যই ইকোসিস্টেম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। সবুজ উদ্ভিদ ঈঙ২, পানি, খাদ্য উপাদান ইত্যাদি ব্যবহার করে সূর্যালোকের সাহায্যে শ্বেতসারজাতীয় খাদ্য উৎপাদন করছে। এই উৎপাদনের ফলেই উদ্ভিদের আঙ্গিক ও দৈহিক বৃদ্ধি ঘটছে। মানুষসহ সকল প্রাণীর জীবনচক্র চালু রাখার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খাদ্য হিসেবে উদ্ভিদকর্তৃক উৎপাদিত উপাদানের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়। এ কারণেই সব ধরনের ইকোসিস্টেম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা এত তাৎপর্যপূর্ণ।
পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা- নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ১ এর ১.১ নং পাঠ।
পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা
পরিবেশের ধারণা পরিবেশ কথাটি বহুলভাবে ব্যবহৃত, যেমনঃ সামাজিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি আরও অনেক পরিবেশ। তবে পরিবেশ বিজ্ঞান জীব বিজ্ঞানেরই একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ও আধুনিকতম সংকলন যেখানে জীবের সাথে তার পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিজ্ঞানের যে শাখা জীবের পারিপার্শি¦কতার সাথে জীবকূলের প্রতিটি পারস্পরিক ক্রিয়া—বিক্রিয়া নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করে তাই পরিবেশ বিজ্ঞান।
পরিবেশের সাথে প্রাণীজগতের সম্পর্ক নিয়ে আলোচিত বিদ্যাকে ইকোলজি বলা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী পরিবেশের নানাবিধ সংজ্ঞা দিয়েছেন। যার উৎপত্তি ও বিস্তৃতি ব্যাপক বিধায় স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে বহুল প্রচলিত ও সমাদৃত কয়েকটি সংজ্ঞা এখানে দেওয়া গেল।
পরিবেশ বিজ্ঞানের সংজ্ঞা :
(১) জৈব ও অজৈব পরিবেশের সাথে প্রাণীর অনাবিল সম্পর্ককেই পরিবেশ বিজ্ঞান বলে, হেকেল, ১৮৬৯।
(২) পরিবেশের সাথে জীবের সম্পর্ক নিয়ে যে বিজ্ঞান অনুসন্ধান চালায় তাই পরিবেশ বিজ্ঞান। এটি জ্ঞানের এমন একটি দর্শন যেখানে জীবজগতকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার আলোকে ব্যাখ্যা করা হয় উডবারি, ১৯৫৫।
(৩) জীবক লের প্রাচুর্য ও বিস্তার সম্পর্কিত সুনিদিষ্ট গবেষণাই পরিবেশ বিজ্ঞান এন্ড্রিয়ার্থা, ১৯৬১।
(৪) পরিবেশ বিজ্ঞান হচ্ছে পরিবেশের আন্তঃক্রিয়াদির অধ্যয়ন যা জীবের বিস্তার, উৎপাদন প্রাচুর্য ও অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে এবং মঙ্গল সাধন করে পেট্রিডিস, ১৯৬৮।
(৫) প্রকৃতির গঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে অধ্যয়নই হচ্ছে পরিবেশ বিজ্ঞান ওডাম, ১৯৭১।
(৬) জীবের প্রাচুর্য ও বণ্টন নির্ণয়কারী আন্তঃক্রিয়াদির বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনাই হচ্ছে পরিবেশ বিজ্ঞান ক্রেব, ১৯৭২।
উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর সার সংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, আমাদের চার পাশে যা কিছু আছে এবং যা কিছুই আমাদের জীবনধারাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তাই আমাদের পরিবেশ।
পরিবেশের উপাদান :
সাধারণভাবে পরিবেশ বলতে জীবের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেই বুঝায়। তবে পরিবেশ আসলে একটি জটিল পদ্ধতি যা বহুবিধ উপাদানের সমষ্টি নিয়ে গঠিত। বাহ্যিক যে সকল বস্তু বা উপাদান জীবকে ঘিরে রেখেছে এবং যা জীবকে তার বিকাশ ও বিস্তারে প্রভাবিত করে তাই পরিবেশের উপাদান। এই উপাদানগুলো সজীব ও জড় উভয়বিধই হতে পারে। পরিবেশের মৌলিক উপাদানসমূহকে পরবতীর্ পৃষ্ঠায় ছকে দেখানো হলো।
পরিবেশের উপাদানসমূহের আন্তঃক্রিয়া:
প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশেষ কোন একক উপাদানের চেয়ে উপাদানসমুহের সমষ্টিগত প্রভাব জীবের উপর বেশি অবদান রাখে। এর কারণ এই যে, উপাদানগুলো পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। পরিবেশের কোন একটি উপাদানের তারতম্য ঘটলে অন্য উপাদানের ক্রিয়াকান্ডও তাদ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায় যা ঐড়ষড়পড়বহড়ঃরপ প্রভাব বলে খ্যাত। যেমনঃ সূর্যালোকের প্রখরতা বাড়লে উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার বৃদ্ধি পায়। প্রস্বেদন হার বাড়লে বিপাকীয় কাজ প্রভাবিত হয় ইত্যাদি।
বিভিন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী পরিবেশের উপাদানগত শ্রেণিবিন্যাস বিভিন্নভাবে দিয়ে থাকলেও অধিকাংশের মতে চারটি ভাগের উপরই প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে।
১। জলবায়ুগত উপাদান
(ক) আলো :
এ পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবনকে কার্যকর রাখার জন্য সকল শক্তির উৎস সৌর শক্তি। সবুজ উদ্ভিদ পত্রস্থ ক্লোরোফিলের সাহায্যে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আলোকশক্তি শোষণ করে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে এবং শর্করাজাতীয় খাদ্য উৎপাদন করে তাকে সালোক—সংশ্লেষণ বলে।
সালোক—সংশ্লেষণ বিবর্জিত উদ্ভিদের অস্তিত্ব যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি উদ্ভিদ ছাড়া অন্য প্রাণীর জীবন ধারণও প্রায় অসম্ভব। আর এসবই হচ্ছে আলোক শক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সালোক—সংশেষণ ছাড়াও উদ্ভিদের গঠন, আকৃতি, পত্রবিন্যাস, পাতার পুরুত্ব, ক্লোরোফিলের পরিমাণ, প্রস্বেদন, পুষ্পায়ন এবং আরও বহুবিধ জৈবিক কার্যাবলী আলো দ্বারা সংঘটিত বা প্রভাবিত হয়। পৃথিবীতে পতিত আলোক রশ্মির তীব্রতা ও স্থায়ীত্ব, ঋতুভেদ, অক্ষাংশ, ভূমির ঢাল ও দিক, বায়ুমন্ডলের স্বচ্ছতা, আর্দ্রতা, কুয়াশা, মেঘ ইত্যাদি উপকরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
যে সকল উদ্ভিদ তীব্র আলোতে ভাল জন্মে (যেমনঃ ধান, পাট, গম, আম, তূলা ইত্যাদি) তাদেরকে আলো পছন্দকারি উদ্ভিদ বা হেলিওফাইট বলে। আবার যে সকল উদ্ভিদ ছায়াযুক্ত স্থানে জন্মানো পছন্দ করে (যেমনঃ ফার্ণ, পান, বনের নিম্নস্তরের লতাগুল্ম ইত্যাদি) তাদেরকে ছায়া পছন্দকারি উদ্ভিদ বা সাইওফাইটস বলে।
(খ) তাপমাত্রা :
উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে তাপমাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সকল বিপাকীয় কার্যক্রম, যেমনঃ সালোক—সংশ্লেষণ, শ্বসন, পরিশোষণ, অঙ্কুরোদগম, প্রস্বেদন, অভিস্রবন ইত্যাদি পরিবেশীয় তাপমাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাপমাত্রা কম বা বেশি হলে বিপাকীয় কার্যাবলীর উপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বেঁচে থাকার জন্য সকল উদ্ভিদের একটি সর্বোচ্চ শ্বসণ , পরিমিত ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রয়েছে, যাকে কার্ডিনাল তাপমাত্রা বলা হয়। কোন আবাসস্থলে উদ্ভিদের বিস্তৃতি তার কার্ডিনাল তাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
যেমনঃ ধান গাছের অভিযোজন সর্বোচ্চ ৪০০ সে. এবং সর্বনিম্ন ৫০ সে. তাপমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ কিন্তু পরিমিত বা অনুকূল তাপমাত্রা ২০—৩০০ সে. এর মধ্যে। তাই উদ্ভিদের ভৌগলিক বিস্তৃতি তাপমাত্রার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাপমাত্রার তারতম্যের উপর নির্ভর করে উদ্ভিদসম হকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ঃ
(১) মেগাথার্ম — যে সকল উদ্ভিদ অতি উচ্চ তাপমাত্রা সম্পন্ন অঞ্চলে জন্মায়।
(২) মেসোথার্ম — এরা মূলত উষ্ণ প্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ। তবে বাৎসরিক ঋতুভেদে অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতাও সহ্য করতে পারে।
(৩) মাইক্রোথার্ম — এরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উদ্ভিদ বলে বছরের বেশির ভাগ সময়ই অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতা সহ্য করতে পারে।
(৪) হেকিস্টোথার্ম — এরা মেরু অঞ্চলের উদ্ভিদ, সারা বছর নিম্ন তাপমাত্রা সহনশীল।
অনুশীলন ঃ আলো ও তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাস করুন। আপনার পরিচিত উদ্ভিদগুলোকে উল্লিখিত শ্রেণিবিন্যাসে বিভক্ত করুন।
বায়ুতে অবস্থিত ঈঙ২ গ্যাস উদ্ভিদের সালোক—সংশ্লেষণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে এর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য
দায়ী।
(গ) বায়ু :
বায়ু প্রবাহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিস্তৃতি প্রভাবিত করে। অনেক উদ্ভিদের বীজ একস্থান হতে অন্যস্থানে বায়ু দ্বারা স্থানান্তরিত হয়ে উদ্ভিদের বংশ বিস্তার ঘটায়। বহু উদ্ভিদের পরাগায়ণ বায়ুর মাধ্যমে হয়ে থাকে। মৃদু বায়ুতে উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার কম। কিন্তু প্রবল বায়ুতে তা বৃদ্ধি পেয়ে উদ্ভিদের পানির চাহিদা বাড়িয়ে তোলে। প্রবল বায়ু দ্বারা সংঘটিত জটিলতার মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের আকৃতিগত বিকৃতি, ভেঙ্গে পড়া, ঘর্ষণজনিত ক্ষতিসাধন, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি। এ ছাড়া বহু রোগের জীবাণু বায়ুবাহিত হয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর রোগের কারণ ঘটায়। বায়ুতে অবস্থিত ঈঙ২ গ্যাস উদ্ভিদের সালোক—সংশ্লেষণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে এর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য দায়ী।
(ঘ) বায়ুর আর্দ্রতা :
বায়ুর জলীয় আর্দ্রতাকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। কোন বায়ুতে অবস্থিত জলীয়—বাষ্পের বর্তমান অবস্থা এবং একই বায়ু সম্পৃক্ত হলে কতটুকু জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা রাখে তার অনুপাতকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বলে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা শতকরা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা কম—বেশির সাথে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও কম—বেশি হয়। উষ্ণতা বাড়লে আপেক্ষিক আর্দ্রতা কমে। আবার উষ্ণতা কমলে আপেক্ষিক আপেক্ষিক আর্দ্রতা উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার নিয়ন্ত্রণ করে বলে কোন্ অঞ্চলে কী ধরনের উদ্ভিদ জন্মাবে তা সে অঞ্চলের আপেক্ষিক আর্দ্রতার ওপর বহুলাংশে ি নর্ভরশীল।
আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার নিয়ন্ত্রণ করে বলে কোন্ অঞ্চলে কী ধরনের উদ্ভিদ জন্মাবে তা সে অঞ্চলের আপেক্ষিক আর্দ্রতার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। অনেক উদ্ভিদ আছে যারা শুষ্ক আবহাওয়ায় সংবেদনশীল কিন্তু আর্দ্র আবহাওয়ায় সহজেই জন্মাতে পারে। এদেরকে হাইগ্রোফাইটস বলে। যেমনঃ রাস্না, ঢেঁকিশাক ইত্যাদি।
(ঙ) বৃষ্টিপাত ও পানি :
উদ্ভিদ জীবনে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় যাবতীয় কার্যক্রম পানির মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। পানি সালোক—সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার অন্যতম উপাদান। পানির অবর্তমানে উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া চলতে পারে না। আর খাদ্য উৎপাদন ছাড়া উদ্ভিদের বেঁচে থাকার কথাই ভাবা যায় না। একারণেই পরিবেশীয় অন্যান্য উপাদান অপেক্ষা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদ বিস্তারের ক্ষেত্রে পানির তাৎপর্য অনেক বেশি।
কোন স্থানে উদ্ভিদের ধরন, ি বকাশ, বিস্তৃতি, ইত্যাদি নির্ভর করে সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ও পানির প্রাপ্যতার ওপর। কোন স্থানে উদ্ভিদের ধরন, বিকাশ, বিস্তৃতি, ইত্যাদি নির্ভর করে সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ও পানির প্রাপ্যতার উপর। আবার কোন এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নির্ভর করে অনেকটা উক্ত এলাকা সাগরের কতটা নিকটবর্তী, সাগর থেকে ভূমির দিকে প্রবাহিত বায়ুর গতিধারা, বায়ুতে জলীয় বাষ্পের প্রাচুর্যতা, অক্ষাংশ ইত্যাদির উপর। নিরক্ষীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বাধিক, পক্ষান্তরে মেরুঅঞ্চলের বৃষ্টিপাত সর্বনিম্ন।
উদ্ভিদ বাসস্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পানির প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে উদ্ভিদকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় :
(১) জলজ উদ্ভিদ :
যে সকল উদ্ভিদ জলজ পরিবেশে আংশিক বা সব সময় জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে জলজ উদ্ভিদ বলে। এরা নিমজ্জিত বা ভাসমান, মুক্ত বা নোঙ্গরাবদ্ধ হতে পারে, যেমনঃ কচুরীপানা, হাইড্রিলা, শেওলা, শাপলা ইত্যাদি। উভচর উদ্ভিদও জলজ উদ্ভিদের গোত্রেই পড়ে, যেমনঃ কলমী শাক এদের মূলকান্ড সুগঠিত নয়। অভিস্রবন চাপও খুব কম।
(২) সাধারণ উদ্ভিদ :
যে সকল উদ্ভিদ মাটিতে পরিমিত পানি থাকা অবস্থায় জন্মে তাদেরকে সাধারণ উদ্ভিদ বলে। এদের জীবন ধারণের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর প্রয়োজন। এদের জন্য জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা কোনটাই সহনীয় নয়, যেমনঃ গম, সরিষা, আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি। এদের মূল, কান্ড, শাখা—প্রশাখা সুগঠিত। অভিযোজন চাপ স্বাভাবিক।
(৩) মরুজ উদ্ভিদ :
যে সকল উদ্ভিদ শুষ্ক মাটিতে অথবা খুব কম বৃষ্টিপাত সম্পন্ন অঞ্চলে জন্মে তাদেরকে মরুজ উদ্ভিদ বলে। কম বৃষ্টিপাতসম্পন্ন এলাকায় জন্মে বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের পাতা, কান্ড, মূল, অভ্যন্তরীণ ও শারীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে প্রচুর রূপান্তর হয়ে থাকে। এদের উদাহরণ হচ্ছে — ফণিমনসা, ক্যাকটাস, করবি, খেজুর, ঝাউ, ঘৃত কুমারী ইত্যাদি।জোয়ার ভাটা বিধৌত সমুদ্রতীরবর্তী এ ধরনের উদ্ভিদকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলে, যেমনঃ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনের সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, গোলপাতা ইত্যাদি।
(৪) লোনা মাটির উদ্ভিদ :
যে সকল উদ্ভিদ লবণাক্ত পানি বা মাটিতে জন্মে তাদেরকে লোনা মাটির উদ্ভিদ বলে। এ সকল উদ্ভিদের পাতা প্রায়ই রসালো এবং ভূগর্ভস্থ মল ূ থেকে মাটির উপরে খাড়াভাবে শ্বাস—মূল দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জরায়ুজ—অঙ্কুরোদগম ঘটে এবং উচ্চ অভিস্রবন চাপ বিদ্যমান। জোয়ার ভাটা বিধৌত সমুদ্র তীরবর্তী এ ধরনের উদ্ভিদকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলে, যেমনঃ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনের সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, গোলপাতা ইত্যাদি।
২। মৃত্তিকাগত উপাদান
পরিবেশের মৃত্তিকাগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলী। মাটির গঠন, বুনট ইত্যাদি ভৌত গুণাবলী এবং মাটির অম্লত্ব, ক্ষারত্ব, লবণাক্ততা, খাদ্য উপাদান ইত্যাদি রাসায়নিক উপাদান দ্বারা উদ্ভিদের বর্ধন, বিকাশ ও বিস্তৃতি বহুলভাবে প্রভাবিত। মাটির পানি ধারণক্ষমতা তার ভৌত গুণাবলীর উপর নির্ভরশীল। অপরপক্ষে উদ্ভিদের খাদ্য সরবরাহের পরিমাণ মাটির রাসায়নিক গুণাবলীর উপর নির্ভরশীল। তাই সব মাটিতেই সব
উদ্ভিদ ভাল জন্মে না যেমনঃ ভারি মাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী, অপর দিকে হালকা দো— অঁাশ মাটি আখ, গম, সরিষা, ইত্যাদি চাষের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত।
৩। স্থান সংক্রান্ত উপাদান
স্থান সংক্রান্ত উপাদানের মধ্যে রয়েছে
(ক) ভূমির উচ্চতা ও বন্ধুরতা
(খ) অক্ষাংশ এবং
(গ) ভূমির ঢাল ও দিক।
(ক) ভূমির উচ্চতা ও বন্ধুরতা ঃ সাগর—পৃষ্ঠ থেকে ভূমি কত উচ্চতায় অবস্থিত অথবা ভূমির উপরিভাগের বন্ধুরতার ধরন উদ্ভিদ জীবনকে প্রভাবিত করে। কারণ এ দ্বারা আলো ও পানির প্রাপ্যতা এবং স্থানীয় জলবায়ু বহুলাংশে নির্ভরশীল।
(খ) অক্ষাংশ ঃ অক্ষাংশের অবস্থান, স্থানীয় জলবায়ু, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আলোর পরিমাণ ইত্যাদি আবহাওয়াগত উপাদানের নির্দেশক এবং এসবকিছু দ্বারাই উদ্ভিদ ও প্রাণী বিস্তার প্রভাবিত হয়। পৃথিবীর নিম্ন অক্ষাংশের মরু অঞ্চল উচ্চ তাপ ও পানির অভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী। আবার উচ্চ অক্ষাংশের মেরু অঞ্চল তীব্র শীত ও বরফজনিত কারণে বসবাসের অনুপযোগী।
(গ) ভূমির ঢাল ও দিক ঃ ভূমির ঢাল ও দিকের প্রভাব উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর বেশি অনুভূত হয় মধ্য ও উচ্চ অক্ষাংশে। নিম্ন অক্ষাংশে এর তেমন কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। কারণ সূর্য সারা বৎসরই এখানে লম্বভাবে কিরণ দিয়ে থাকে। ভূমির ঢালের মাত্রাও এখানে গুরুত্বপর্ণ, কারণ ু ঢালের পরিমাণ বেশি খাড়া হলে পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে তা উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য অনুকল নয়।
জৈবিক উপাদান
জীবকূলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রভাবকেই জৈবিক কারণ বলে। পরিবেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সকল প্রাণীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় বায়ুর যে ঈঙ২ গ্রহণ করে তা প্রাণীর শ্বসনজাত। পক্ষান্তরে প্রাণী নিঃশ্বাসের সাথে যে ঙ২ গ্রহণ করে তা উদ্ভিদের সালোক—সংশেষণ প্রক্রিয়ার উপজাত। প্রকৃতিতে উদ্ভিদ কর্তৃক ব্যবহৃত নাইট্রোজেনঘটিত খাদ্য ব্যাকটেরিয়া ও নীলাভ—সবুজ শৈবাল দ্বারা মাটিতে ধারণকৃত। তাছাড়া জীবকূলের মধ্যে রয়েছে সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা, মিথোজীবীতা, পরজীবীতা, পরাশ্রয়ীতা, ইত্যাদির মতো আরও অনেক ক্রিয়া কর্ম যা জীব সম্পর্কীয় উপাদানেরই অংশবিশেষ।
বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.৫ নং পাঠ।
বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ
বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের হার বাড়ানো প্রয়োজন। আর সেজন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি ও সময় মত কৃষকের নিকট লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর।
কৃষিক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি যোগ হতে থাকলে কম সময়ে স্বল্প পরিসর আবাদী জমিতে অধিক ফসল ফলিয়ে অধিক পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের হার বাড়ানো প্রয়োজন। আর সেজন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি ও সময় মত কৃষকের নিকট লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর। উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষ ও নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বিগত কয়েক বৎসরে অধিকাংশ ফসলেরই উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিক বিবেচনায় আনলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন সে তুলনায় বাড়েনি, তাই এ ঘাটতি পূরণের জন্য অধিকাংশ কৃষি পণ্যই আমাদের বিদেশ হতে আমাদানি করতে হয়।
প্রয়োজনের তুলনায় আমরা কী পরিমাণ কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করি এবং কতটুকু ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত্ব তার পরিসংখ্যান নিম্নে (ছক — ১) দেয়া হলো:
ছক — ১ ঃ কৃষি পণ্যের প্রয়োজন, উৎপাদন ও ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত্বের পরিমাণ (১৯৯২—৯৩) [‘০০০’ কেজি]
উপরের ছক হতে দেখা যায় বাংলাদেশে ধান উৎপন্ন হয় ১৮৩.৪১ লক্ষ টন এবং প্রয়োজন ১৮৩.৭১ লক্ষ টন। এ হিসেবে ঘাটতির পরিমাণ ৩০ হাজার টন। তবে খাদ্য হিসেবে ধানের (চাল) পরিবর্তে আমরা বেশি করে গম আমদানি করে থাকি। দেশে বর্তমানে ১১.৭৬ লক্ষ টন গম উৎপন্ন হয় এবং বিদেশ হতে আমদানি করা হয় ১০.৩৩ লক্ষ টন যা মোট প্রয়োজনের ৪৭ শতাংশ। দেশে গমের মোট প্রয়োজন ২২.০৯ লক্ষ টন। দেশে চিনির প্রয়োজন প্রায় ৮.২৪ লক্ষ টন এবং উৎপন্ন হয় প্রায় ৭.৫১ লক্ষ টন। প্রয়োজনীয় বাকী ৭৩ হাজার টন চিনি বিদেশ হতে আমদানি করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হয় অর্থাৎ চাহিদার প্রায় ৮১ শতাংশ চিনি আমরা উৎপন্ন করি।
দেশে ডালের উৎপাদন ৫.১৯ লক্ষ টন অথচ আমাদের প্রয়োজন ৫.৭৬ লক্ষ টন। বর্তমানে দেশে ডালের ঘাটতি ৫৭ হাজার টন। এ ঘাটতি মোট প্রয়োজনের ১০ শতাংশ। তৈল বীজ হতে আমরা যে তৈল পাই (তৈল বীজে ৩৩% তৈল ধরে হিসেবে করা হয়েছে) এর পরিমাণ প্রায় ১.৫৩ লক্ষ টন। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থাৎ প্রায় ৪.১২ লক্ষ টন।
তৈলের ঘাটতি ২.৫৯ লক্ষ টন যা আমরা বিদেশ হতে আমদানি করে থাকি এবং এর পরিমাণ প্রয়োজনের প্রায় ৬৩ শতাংশ। আমাদের প্রয়োজনীয় কৃষি পণ্যের মধ্যে তৈলের ঘাটতিই সবচেয়ে বেশি। মশলা, গোল আলু, শাকসব্জি ইত্যাদির প্রয়োজন যথাক্রমে ৩.১২, ১৩.৮৫ এবং ১২.৬২ লক্ষ টন এবং আমাদের দেশে এদের উৎপাদনের পরিমাণ যথাক্রমে ৩.০২, ১৩.৮৪ এবং ১১.৯৮ লক্ষ টন। যে সকল কৃষি পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি আছে সেগুলো আমদানি করে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হয়। প্রয়োজনের তুলনায় বিভিন্ন কৃষি পণ্যের ঘাটতির পরিমাণ শতকরা ০.০৫৬২.৯৮ ভাগ।
আমাদের সব কৃষি পণ্যেরই যে উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে তা নয় বরং কোন কোন পণ্য আমরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি উৎপন্ন করে থাকি। এ ক্ষেত্রে চা, পাট এবং তামাকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে । চায়ের বাৎসরিক উৎপাদন ৫০.৮ হাজার টন। এ উৎপাদন থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে আমরা ২৯.৬২ হজার টন বিদেশে রপ্তানি করে থাকি যা মোট উৎপাদনের ৫৮.৩ শতাংশ। দেশে পাটের মোট উৎপাদন প্রায় ৯.১৮ লক্ষ টন এবং এখান হতে প্রায় ৪.৩৩ টন বিদেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে এবং এটা মোট উৎপাদনের ৪৭.১৭ শতাংশ। বর্তমানে দেশে প্রয়োজনের চেয়ে ১ হাজার টন বেশি তামাক উৎপন্ন হয়।
তামাকের মোট উৎপাদন ৩৬.০০ হাজার টন এবং প্রয়োজন ৩৪.৯২ হাজার টন। উৎপাদিত অতিরিক্ত এক হাজার টন তামাক আমরা বিদেশে রপ্তানি করে থাকি যা মোট উৎপাদনের তিন শতাংশ। উৎপাদিত কৃষি পণ্যের মধ্যে শতকরা হিসেবে চা—ই আমরা বেশি রপ্তানি করে থাকি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে চা, পাট ও তামাকের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত্বের পরিমাণ যথাক্রমে ৫৮.৩, ৪৭.২ এবং ৩ শতাংশ ।
বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের তালিকা ও পরিমাণ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.৫ নং পাঠ।
বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের তালিকা ও পরিমাণ
আমদানিকৃত পণ্য বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের মাটি ও জলবায়ু ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। কিন্তু অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে দেশ আজ ভারাক্রান্ত এবং যে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয় তা এ বাড়তি
জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই প্রতি বছরই আমাদের বিদেশ হতে খাদ্য আমদানি করে এ ঘাটতি পুরণ করতে হয়। শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও বেশ কিছু পণ্য বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। বস্ত্র শিল্পের জন্য প্রতি বছরই আমাদের তুলা আমদানি করতে হয়। শিশুখাদ্য হিসেবে বিদেশ হতে প্রচুর পরিমাণে গুঁড়া দুধ আমদানি করতে হয়। প্রধান প্রধান কৃষি পণ্য যেগুলো বিদেশ হতে আমদানি করতে হয় তার খতিয়ান নিম্নে (ছক — ১) দেয়া হলো:
ছক — ১ ঃ আমাদানিকৃত প্রধান প্রধান কৃষি পণ্যের তালিকা।
রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্য
আমরা যে শুধু কৃষি পণ্য বিদেশ হতে আমদানি করি তা নয়, কিছু কিছু পণ্য আমরা বিদেশে রপ্তানিও করে থাকি। এক সময় একচেটিয়া পাট রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এক নম্বরে ছিল। বর্তমানেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সিংহভাগ আসে পাট ও চা রপ্তানি খাত হতে। তাছাড়া আমরা শুকনা ও হিমায়িত মাছ, চামড়া, তামাক ও তামাক জাত দ্রব্য ইত্যাদি বিদেশে রপ্তানি করে থাকি। প্রধান প্রধান কৃষি পণ্য যেগুলো আমাদের দেশ হতে বিদেশে রপ্তানি করা হয় তাদের নাম ও পরিমাণ নিম্নে (ছক — ২) দেয়া হলো:
ছক — ২ ঃ পরিমাণসহ রপ্তানিযোগ্য প্রধান প্রধান পণ্যের তালিকা।
উপরিউক্ত রপ্তানি পণ্য তালিকার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে কিছু কিছু রপ্তানি পণ্য যেমন হিমায়িত মাছ, চা, চামড়া ইত্যাদির রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। পাট ও পাটজাত দ্রব্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও এর রপ্তানির পরিমাণ ১৯৯২—৯৩ সনে কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে এবং উন্নত মানের পাট ও পাটজাত সামগ্রীর রপ্তানি বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
রপ্তানি আয়ের বেশ একটা ভাল অংশ আসে চামড়া থেকে যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। চায়ের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে এবং সে সঙ্গে বাড়ছে এর রপ্তানির পরিমাণ এবং দেশের রপ্তানি আয়। হিমায়িত ও শুকনা মাছ রপ্তানির পরিমাণও ক্রমান¦য়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে আমদানির পরিমাণ রপ্তানির তুলনায় বেশি। জাতীয় আয়ের বিরাট অংশ ব্যয় হয় খাদ্য আমদানির জন্য। যে বছর দেশে বন্যা, খরা, বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ আঘাত হানে সে বছরই খাদ্যশস্য ফলনের উপর এদের বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে ফলন কমে যায় এবং তখনই বিদেশ হতে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষিকেই প্রধান্য দিতে হবে বেশি। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে পারলেই দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
সারমর্ম
বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের আমদানির পরিমাণ রপ্তানির তুলনায় বেশি। আমাদানিকৃত প্রধান প্রধান কৃষি পণ্য হলো গম, চাল, চিনি, গুঁড়াদুধ, সয়াবিন তৈল, পাম্প ওয়েল, বিভিন্ন ধরনের মশলা, ডাল, ফল এবং ঔষধ ও প্রসাধনী শিল্পের কাঁচামাল। সবচেয়ে বেশি আমদানি করতে হয় গম, চাল ও ভোজ্য তেল। বাংলাদেশ হতে যে সব পন্য বিদেশে রপ্তানি হয় সেগুলোর মধ্যে উলেখযোগ্য হলো হিমায়িত ও শুকনো মাছ, চা, চামড়া, পাট ও পাটজাত দ্রব্য ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে।
বাংলাদেশের খাদ্যের বর্তমান অবস্থা – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.৩ নং পাঠ।
বাংলাদেশের খাদ্যের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি উন্নয়নে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, জমির খহুবিখন্ডতা, প্রশস্ত রাস্তা ঘাটের অভাব এবং কৃষকের সকল ধরনের উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির ক্রয় ক্ষমতা না থাকায় এদেশে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব নাও হতে পারে। যে সকল কৃষি যন্ত্রপাতি আমাদের আবহাওয়ায় মানানসই এবং ফসল উৎপাদনে একান্তই প্রয়োজন সেগুলো দিয়ে বর্তমানে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। সেই সাথে হাঁস—মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য খামারে তাদের উন্নতির জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতিও ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশে খরিপ মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। ফলে এসময় বন্যায় অনেক ক্ষয়—ক্ষতি হয়। শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে পানির অভাবে রবি ফসলের আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। বন্যা নিয়ন্ত্রন ও সেচ প্রদানের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প রয়েছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্ণ নয়। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ যা উৎপন্ন হয় তা নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন খাদ্যশস্য, দুধ ইত্যাদি আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ কম তাই অধিকাংশ পণ্যই আংশিক আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান পেশা হলো কৃষি যেখানে মোট শ্রমশক্তির ৬৮.৫% নিয়োজিত।
দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ৩৫% আসে কৃষজাত দ্রব্য থেকে। এদেশের জমি উর্বর হলেও কৃষক দরিদ্র। নতুন নতুন প্রযুক্তি, উন্নত বীজ ও কৃষি উপকরণ ব্যবহারে পশ্চাদপদ থাকায় প্রতি একক জমিতে উৎপাদন সন্তুোষজনক নয়। ধান, গম, পাট, আখ, তামাক, চা, তৈলবীজ, ডাল, শস্য এবং আলু এদেশের প্রধান ফসল। বিভিন্ন ধরনের শাকসব্জি এবং মশলা জাতীয় ফসলের চাষও এদেশে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে কী পরিমাণ খাদ্য শস্য উৎপন্ন হয় তা নিম্নে (ছক — ১) দেয়া হলো:
উপরোক্ত ছক হতে দেখা যায় যে ধান, গম, ডাল ফসল, মশলা জাতীয় শস্য, গোল আলু এবং শাকসব্জির ফলন ১৯৯১—৯২ সনের তুলনায় ১৯৯৩—৯৪ সনে বেড়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ। নিকট অতীতেও এখানকার অভ্যন্তরীণ জলাশয় মাছে ভরপুর ছিল। দেশের মৎসজীবি সম্প্রাদায় অভ্যন্তরীণ প্লাবন ভূমিতে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ও সেখানে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদ গত তিন দশকে মারাত্বক হ্রাস পেযেছে।
সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ এবং বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অভ্যন্তরীন মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন হ্রাস পেলেও সামুদ্রিক মৎস্য ও উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জলজ সম্পদ হতে প্রাপ্ত মৎস্য সম্পদের উৎপাদন ধরা হয়েছে প্রায় ১২ লক্ষ মেট্রিক টন যা নিম্নের ছকে (ছক — ২) দেখানো হলো:
মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদন দেশে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে (ছক — ৩ দ্রষ্টব্য)। ১৯৯১—৯২ সনে যেখানে মাংস ও দুধের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৩৭,৬,০০০ ও ৯,৫৪,০০০ মেট্রিক টন, ১৯৯৪—৯৫ সনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫,০৪,৭০২ ও ১৪,১১,৯৫৯ মেট্রিক টনে। ডিমের উৎপাদনও এসময়ে ১,৫৭৭ মিলিয়ন হতে বেড়ে ২,৫৩০ মিলিয়ন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টা ও সরকারী পৃষ্টপোষকতায় গবাদিপশু ও হাঁস—মুরগির খামার প্রতিষ্ঠাই সম্ভবত এই উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ।
কৃষি, কৃষি শিক্ষা, কৃষি প্রশিক্ষণ, কৃষি শিল্প, কৃষি গবেষণা