Category Archives: কৃষি

কৃষি গুরুকুলের “কৃষি” সেকশন হলো জ্ঞানের ভাণ্ডার যেখানে কৃষির ইতিহাস, ঐতিহ্য, আধুনিক গবেষণা ও কৃষি বিষয়ক অথরিটি প্রবন্ধসমূহ প্রকাশিত হয়। এখানে পাঠকরা কৃষি সম্পর্কিত মৌলিক তথ্য, উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ও সমৃদ্ধ কনটেন্ট খুঁজে পাবেন।

মৗমাছি পালন ও মধু উৎপাদন

মৗমাছি পালন ও মধু উৎপাদন নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি ৫ নং ইউনিটের “বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি” ৫.৬ নং পাঠ।

মৗমাছি পালন ও মধু উৎপাদন

 

কীটপতঙ্গের নাম শুনলেই আমরা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে থাকি। ধারণা করে থাকি এরা খুব ক্ষতিকর। ইহা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ অনেক পোকা আছে যা আমাদের প্রভৃত উপকার করে থাকে। এর মধ্যে মৌমাছি অন্যতম।

কারণ মধু ও মোমের জন্য মৌমাছি সকলের নিকট খুবই প্রিয়। এছাড়াও এরা ফসলের পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে ফলন অনেক বাড়িয়ে দেয়। মধু ও মোম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে মৌমাছি পালন করার বিদ্যাকে মৌমাছি পালনবিদ্যা বলা হয়। সাধারণতঃ প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে মৌমাছি সংগ্রহ করে এনে মৌবাক্সে মৌচাকের উপযোগী কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন করাকে মৌমাছি চাষ বলা হয়। মৌমাছি একটি সামাজিক পোকা। এরা কলোনী তৈরি করে একসাথে বসবাস করে। এই পোকার মধ্যে শ্রমবিভাজন দেখা যায়। শ্রমবিভাজন অনুসারে এই পোকাদের ৩টি শ্রেণি বা কাস্টে বিভক্ত করা হয়। যথা :

(১) রাণী মৌমাছি

(২) কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি

(৩) পুরুস মৌমাছি।

১। রাণী মৌমাছি:

মৌমাছির যে কোনো কলোনীতে বা মৌচাকে প্রজনন কার্য সম্পন্ন করার জন্য একটি মাত্র স্ত্রী মৌমাছি দেখা যায়, একে রাণী মৌমাছি বলা হয়। রাণী মৌমাছি কলোনীর সব মৌমাছির তুলনায় আকারে বড়। সে কলোনীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং রাণী—প্রকোষ্ঠে বাস করে। যৌন সঙ্গম ও ডিম পাড়া ছাড়া রাণী অন্য কেনো কাজ করে না। সে তার জীবদ্দশায় পুরুষ মৌমাছির সাথে এক বা একাধিকবার মিলনে যেতে পারে। কলোনীর বাইরে কুমারী রাণীর সাথে পুরুষ মৌমাছির মিলন হয়। মিলনের বাসনায় কুমারী রাণী শুষ্ক আবহাওয়ায় মৌচাকের বাইরে এসে উড়তে শুরু করলে চাকের পুরুষ মৌমাছিরা তার পিছু ছুটতে থাকে।

পুরুষদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ চলার পর যে পুরুষটি যুদ্ধে জয়লাভ করে সর্বপ্রথম রাণীর কাছে পেঁৗছাতে পারে সে পুরুষ মৌমাছিটির সাথেই কুমারী রাণী মিলনে লিপ্ত হয়। মিলনের পর পুরুষ মৌমাছিটি মারা যায়।

মিলনের পর রাণী মৌমাছি গর্ভবতী হয়ে কলোনীতে ফিরে আসে এবং সময়মত ডিম দিতে শুরু করে। দেখা গেছে যে, একটি রাণী মৌমাছি তার দেহের জনন থলির মধ্যে প্রায় ২ কোটি শুক্রাণু জমা করে রাখতে পারে। একটি রাণী মৌমাছি গড়ে প্রতিদিন ৩০২১ টি করে ডিম দিতে পারে। এই রাণী মৌমাছি দু’ধরনের ডিম পেড়ে থাকে  ক) নিষেককৃত ডিম ও খ) অনিষেককৃত ডিম। নিষেককৃত ডিম থেকে কর্মী মৌমাছি এবং অনিষেককৃত ডিম থেকে পুরুষ মৌমাছি তৈরি হয়ে থাকে। মৌচাকের মধ্যে রয়েল জেলী থাকে।

এই রয়েল জেলী মৌমাছির লার্ভাকে ৬—৭ দিন খাওয়ালে তা রাণী মৌামাছি এবং ৩ দিন খাওয়ালে তা কর্মী মৌমাছিতে পরিণত হয়। একই মৌচাকে একাধিক রাণী মৌমাছি থাকলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং যুদ্ধে জয়ী রাণীই একমাত্র বেঁচে থাকে, বাকীরা মারা যায়। যে রাণী বেঁচে থাকে, কর্মী ও পুরুষ মৌমাছিরা তার নির্দেশ মেনে এবং তাকে অনুসরণ করে অন্যত্র কলোনী তৈরি করে। তবে স্বাভাবিকভাবে একটি রাণী মৌমাছি নির্দিষ্ট সংখ্যক ডিম দেওয়ার পর সে মারা যায় এবং নতুন রাণীর উদ্ভব ঘটে।

 

২। কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি:

কলোনীর সব মৌমাছির তুলনায় এরা আকারে সবচেয়ে ছোট। তবে খুবই শক্তিশালী ও পরিশ্রমী এবং এদের পেটের শেষ খন্ডাংশে একটি হুল থাকে। একটি কলোনীতে প্রায় ২০,০০০—৩০,০০০ কর্মী মৌমাছি থাকে। এরা বন্ধ্যা স্ত্রী মৌমাছি। এই মৌমাছির গায়ে লোম থাকে যা দেখতে চিরুনীর মত যা মধু ও পরাগ সংগ্রহে সহায়তা করে এবং এদের পিছনের দু’পায়ে পরাগ থলে থাকে। এদের কাজ হলো মৌচাক তৈরি করা, মৌচাক রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা, মৌচাক পরিস্কার করা ও পাহারা দেয়া, মধু অনুসন্ধান ও সংগ্রহ করা, রাণীকে খাওয়ানো ও রাণীর পরিচর্যা করা, বাচ্চাদের খাওয়ানো ও তাদের লালন পালন করা, মোম প্রস্তুত করা ইত্যাদি। একটি কর্মী মৌমাছি ৪২—১৮০ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

 

৩। পুরুষ মৌমাছি:

এরা আকারে কর্মী মৌমাছির চেয়ে বড়, কিন্তু রাণী মৌমাছির তুলনায় ছোট। এরা সাধারণতঃ কালচে রঙের হয় এবং এদের শরীর বেশ শক্ত ও মজবুত হয়। তবে এরা অত্যন্ত অলস প্রকৃতির। খাবারের জন্য এরা কর্মী মৌমাছির ওপর নির্ভরশীল। জীবনের অধিকাংশ সময়ই এরা মৌচাকের মধ্যে ঘুমিয়ে সময় কাটায়। বাকী সময় উজ্জ্বল রোদে মুক্ত বাতাসে উড়ে বেড়িয়ে জীবনকে উপভোগ করে। প্রতিটি কলোনীতে স্বল্পসংখ্যক পুরুষ মৌমাছি থাকে। মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে কর্মী মৌমাছিরা আক্রমণ করে এদেরকে মেরে ফেলে। পুরুষ মৌমাছির প্রধান কাজই হলো রাণীর সাথে যৌন সঙ্গমে মিলিত হয়ে রাণীকে গর্ভধারণ করানো। রাণীর সঙ্গে যৌন মিলন হওয়ার পর পরই পুরুষ মৌমাছিটি মরে যায়। একটি পুরুষ মৌমাছি সাধারণতঃ ৯০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

 

আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন:

পৃথিবীতে প্রায় ২০,০০০ বিভিন্ন প্রকার ভ্রমর জাতীয় মাছি (নবব) আছে। এদের মধ্যে সারাবিশ্বে চার প্রজাতির মৌমাছি অর্থনৈতিকভাবে পরিচিত। তা হলো— ভারতীয় মৌমাছি (অঢ়রং রহফরপধ), ইউরোপীয় মৌমাছি (অঢ়রং সবষষরভবৎধ), বৃহদাকার বা পাহাড়ী মৌমাছি ও ক্ষুদে বা ক্ষুদ্রাকৃতির মৌমাছি (অঢ়রং ভষড়ৎবধ)। ইউরোপীয় মৌমাছি ছাড়া বাকী তিন প্রজাতির মৌমাছি বাংলাদেশে দেখা যায়। তবে মধু উৎপাদনের জন্য ভারতীয় মৌমাছি সবচেয়ে বেশি উপযোগি।

এরা বেশ শান্ত স্বভাবের এবং খুব সহজে পোষ মানে। ফলে মৌমাছি পালকরা অনায়াসে এদের নিয়ে কাজ করতে পারে। কাঠ বা প্যাকিং বাক্স, কেরোসিনের টিন অথবা দেয়ালের কুঠুরীতে এদেরকে পালন করা হয়ে থাকে। এদেরকে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে কৃত্রিম বাসস্থান তৈরি করে সেখানে তাদের উপযোগি পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে পালন করাকেই আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন করা বোঝায়। নিচে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালনের ধাপসমূহ বর্ণনা করা হলো।

 

১। রাণী মৌমাছি সংগ্রহ :

চার উপায়ে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করা যায়। যথা—

(ক) রাণী, বেশ কিছু কর্মী ও পুরুষ মৌমাছিসহ মৌবাক্স কিনতে পাওয়া যায়।

(খ) মাঠ ফসল বা উদ্যান ফসলে ফুল ধরার সময় জাল দ্বারা রাণীসহ কর্মী মৌমাছি ধরা যায়। জালে আটকানো রাণী মৌমাছিকে কাপড় বা ন্যাকড়া দ্বারা আস্তে করে ধরে কৃত্রিম মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে ঢুকিয়ে আটকিয়ে দিতে হয়। রাণী মৌমাছি চেনার উপায় হলো— আকারে সবচেয়ে বড়, খয়েরী বর্ণের ছোট হুল যা দেখতে ছুরির মত, ডানা ছোট এবং বুক বড় হয়।

(গ) গাছের ডাল, বাড়ী—ঘর বা দালান—কোঠার আনাচে কানাচে, মাঠির গর্ত বা গুহায় প্রাকৃতিকভাবে মৌমাছি কলোনী বা চাক তৈরি করে। কোনো জ্বালানী দ্বারা আগুনের ধুঁয়া তৈরি করে মৌচাকে ধঁুয়া লাগাতে হবে। কারণ মৌমাছিকে ধঁুয়া দ্বারা কাবু করা যায়। এতে পুরুষ ও কর্মী মৌমাছি মৌচাক ছেড়ে কাছাকাছি স্থানে সরে যাবে, কিন্তু রাণী মৌমাছি সরবে না। এই অবস্থায় মৌচাক থেকে সাবধানে রাণী মৌমাছিকে ধরে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে আটকাতে হয়। সাধারণতঃ কম বা মাঝারী বয়সের মৌচাক থেকে রাণী সংগ্রহ করলে সহজে পোষ মানে। কিন্তু পুরাতন মৌচাকের রাণী সহজে পোষ মানে না।

(ঘ) আগুনের ধঁুয়া দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি মৌচাকের মৌমাছিকে সরাতে হয় অথবা শান্ত করতে হয়। পরে মৌচাকের অবস্থান বুঝে একটি কাঠি ঢুকিয়ে ছুরি বা চাকু দ্বারা মৌচাকের গোড়া কেটে দিয়ে চাককে আলাদা করা হয়। চাকের অপ্রয়োজনীয় ও পচা অংশ কেটে ফেলা হয়। চাকটি কাঠিতে এমনভাবে রাখতে হয় যেন ঝুলে থাকে। এই সময় রাণী মৌমাছি ঝাঁক হয়ে বসে থাকা মৌমাছিদের উপরে বা বাইরের দিকে থাকে। সেখান থেকে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে বসাতে হয়। কোনো কারণে রাণী মৌমাছিকে খঁুজে পাওয়া না গেলে ধঁুয়া বা হাত দ্বারা সকল মৌমাছিকে মৌবাক্সে ঢুকিয়ে দিতে হয়।

এতে সকল মৌমাছির সাথে রাণীর যাওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকে। রাণী মৌমাছি মৌবাক্সে না ঢুকে থাকলে কর্মী মৌমাছিরা রাণীকে নিয়ে ঝাঁক বেঁধে বসে থাকে। সেখান থেকেও রাণী মৌমাছিকে সংগ্রহ করে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে আটকানো যায়।

 

২। সংগ্রহকৃত রাণী মৌমাছি মৌবাক্সে স্থাপন :

উপরে বর্ণিত যে কোনো পদ্ধতিতে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করে রাণীকে কুঠুরী বা খাঁচায় আটকিয়ে মৌবাক্সের ফ্রেমের ভিতর রেখে কুঠুরীর ঢাকনা বা মুখ খুলে দিলে কুঠুরী থেকে বের হয়ে রাণী ফ্রেমের ভিতর থাকে, কিন্তু মৌবাক্স থেকে বের হতে পারে না। কারণ মৌবাক্সের ছিদ্র তার জাল দিয়ে আটকানো থাকে। রাণী মৌমাছির আকার বড় বলে তারজালের ছিদ্র দিয়ে বের হতে পারে না। কিন্তু কর্মী ও পুরুষ মৌমাছি রাণীর চেয়ে আকারে ছোট বলে তারা তারজালের ছিদ্র দিয়ে মৌবাক্সের ভিতর সহজে আসা—যাওয়া করতে পারে। রাণী মৌমাছির দেহ থেকে এক ধরনের সুগন্ধ নিঃসৃত হয়।

এই সুগন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কর্মী ও পুরুষ মৌমাছি ঝাঁকে ঝাঁকে মৌবাক্সের ভিতর প্রবেশ করে। এভাবে মৌবাক্সে রাণীকে ৪—৫ দিন আটকিয়ে রাখার পর কর্মী মৌমাছিরা কলোনী বা মৌচাক তৈরি করা শুরু করে। তারপর মৌবাক্সের ঢাকনা খুলে দিলেও রাণী মৌমাছি কোথাও চলে যায় না। মৌবাক্সের প্রবেশ পথে একটি পাত্রের মধ্যে চিনির সিরা রেখে দিলে তা খেয়ে মৌমাছিরা স্বাভাবিক ও শান্ত থাকে।

 

৩। মৌবাক্স উদ্যান বা ফসল মাঠে স্থাপন :

উদ্যান বা মাঠ ফসলের জমিতে ফুল ধরার আগে মৌবাক্সগুলোকে লোহা বা কাঠের তৈরি ৪ পায়া বিশিষ্ট ১.৫—২.০ ফুট উঁচু টুলের উপর স্থাপন করতে হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ফুলের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও সরিষা, তিল, তুলা, পিঁয়াজ, আম, জাম, লিচু, ভূট্টা প্রভৃতি ফুলের প্রতি মৌমাছির আসক্তি একটু বেশি। প্রতি হেক্টর সরিষার জমিতে ১০টি মৌবাক্স ১০০ মিটার দূরত্বে উত্তর—পূর্বমুখী করে বসাতে হয়। কারণ পূর্ব বা পশ্চিমমুখী করে বসালে রোদে মৌচাক নষ্ট হবে। আবার সোজা উত্তরমুখী করে বসালে শৈত্যপ্রবাহ এবং দক্ষিণমুখী করে বসালে বৃষ্টির পানিতে মৌচাকের ক্ষতি হবে। মৌবাক্সে স্থাপনের সময় মৌমাছি প্রবেশ পথের সামনে যাতে ফাঁকা জায়গা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এতে মৌমাছি সহজে চলাফেরা করতে পারে।

একটি উন্নত মৌবাক্স দু’টি অংশ নিয়ে গঠিত। মৌবাক্সের নিচের বড় কক্ষটি হলো বাচ্চার ঘর এবং উপরের ছোট কক্ষটি হলো মধু সঞ্চয়ের ঘর। বাক্সের সবার উপরে ঢাকনা ও সবার নিচে তলা থাকে। ঘর দুটোতে ৫—৭টি ফ্রেম থাকে এবং এই ফ্রেমেই মৌমাছিরা মৌচাক বাঁধে। বাচ্চা ঘরে ৭টি খোপ থাকে। এক খোপ থেকে পরবর্তী খোপের মাঝখানে ৮ মিলিমিটার ফাঁকা থাকে। খোপগুলোতে কাঠের ফ্রেম বসানো থাকে। রাণী মৌমাছি এই ফ্রেমে তৈরি করা চাকে ডিম পাড়ে ও বংশবিস্তার ঘটায়। বাচ্চা ঘর সবচেয়ে বড় ঘর।

মৌবাক্সটি এক ফালি পুরু কাঠের ওপর বসাতে হয়। বাক্সটি কাঠের ওপর বসানোর পর উক্ত কাঠের সামনের দিকে কিছুটা জায়গা বাড়ানো থাকে যাকে পাটাতন বলা হয়। এই পাটাতনের ওপর মাঝে মাঝে মৌমাছিদের কৃত্রিম খাবার দেয়া হয়।

৪। মৌবাক্স রক্ষণাবেক্ষণ :

কমপক্ষে প্রতি ৭ দিন পর পর মৌবাক্স পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তবে ঘন ঘন বাক্স খুললে বিশেষ করে বাচ্চার ঘর খুললে মৌমাছিদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। যদি শত্রু মথের আক্রমণ হয় তবে মৌচাক খুলে রোদে শুকাতে হয়। মৃত লার্ভা বা পিউপা বা বাক্সের তলায় মৌচাকের অন্য কোন ময়লা থাকলে তা পরিস্কার করে ফেলা উচিত। রাণীর ঘর তৈরি হলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে। নচেৎ মৌচাক ছেড়ে মৌমাছিদের চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বংশবৃদ্ধিকালে বাচ্চা ঘরে নতুন ফ্রেম লাগাতে হবে। কোনো পুরনো অকেজো চাক বাক্সে থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।

প্রয়োজনে বয়স্ক রাণীকে সরিয়ে নতুন রাণীর সংযোজন করতে হবে। তা না হলে মৌমাছিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যেতে পারে। মৌচাকে নবনির্মিত রাণী মৌমাছি, বাচ্চা ও পুরুষ মৌমাছিদের কঠুরীগুলো কেটে নষ্ট করে দিতে হবে। মৌমাছির বংশবিস্তার খুব বেশি হলে তাদেরকে একাধিক বাক্সে ভাগ করে দিতে হবে। আবার খাদ্য সংকটের কারণে মৌমাছির সংখ্যা কমে গেলে একাধিক বাক্সের মৌমাছি একত্র করে এক বাক্সে স্থানান্তর করা উচিত। প্রচুর ফুলযুক্ত স্থানে বাক্স স্থানান্তর করতে হয়। খাদ্য সংকট হলে চিনির সিরা তৈরি করে সরবরাহ করা উচিত।

সিরা কোনো পাত্রে রেখে এর ওপর একটি পাতা বা কাঠি স্থাপন করতে হয় যাতে পাতা বা কাঠির ওপর বসে মৌমাছিরা সিরা খেতে পারে। চিনির সিরা রাতের বেলায় দেয়া উচিত যাতে এক বাক্সের মৌমাছি অন্য বাক্সে গিয়ে মারামারি করতে না পারে। ঝড়—বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে মৌবাক্সটির প্রবেশ পথ বৃষ্টি ও বাতাসের বিপরীতমুখী করে শুষ্ক ও নিরাপদ স্থানে রাখা উচিত। বাক্সের ওপর পলিথিন শীট দিয়েও বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। প্রচন্ড শীতে মৌমাছিদের যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য শীতের রাতে চট বা ছালা দিয়ে বাক্স ঢেকে রাখতে হয়। বাক্সে মৌমাছি পালনের সবচেয়ে খারাপ সময় হলো বর্ষাকাল।

এজন্য এসময় খুব খেয়াল রাখতে হয়। বহু শত্রু আছে যারা মৌমাছির বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক উভয় অবস্থাতেই ক্ষতি করে। ওয়াক্স মথ, ওয়াক্স বিটল, বোলতা, পিঁপড়া, উইপোকা, তেলাপোকা, ব্যাঙ, ইঁদুর, টিকটিকি, রক্তচোষা ইত্যাদি মৌচাকের ক্ষতি করে থাকে। এছাড়াও নসিমা, একারাইন, সেপ্টিসিমিয়া ও প্যারালাইসিস রোগে মৌমাছিদের প্রচুর ক্ষতি হয়। এজন্য সময়মত যে কোনো কীটতত্ত্ববিদের পরামর্শ নিয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

 

 

৫। মধু আহরণ :

মৌচাকের শতকরা ৭৫ ভাগ কুঠুরী মধু দ্বারা ভরে গেলে মৌমাছিরা মোম দ্বারা কুঠুরীর মুখ বন্ধ করে দেয়। এজন্য মৌচাকের উপর সাদা মোমের স্তর পড়লে বা সাদা চিক চিক করলে বুঝতে হবে মৌচাক মধু দ্বারা পরিপূর্ণ হয়েছে। এবার জ্বালানী দিয়ে আগুনের ধঁুয়া মধু ঘরে লাগালে সব মৌমাছি চাক থেকে সরে পাটাতনের ওপর আসবে। তখন পুরো মৌচাকটি কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এরপর কাপড় একটু একটু করে সরিয়ে মধুঘর থেকে ফ্রেমসহ মৌচাক বের করতে হয়। চাকে মৌমাছি থাকলে ব্রাশ দিয়ে তাদেরকে বাচ্চা ঘরে ঢুকিয়ে দিতে হয়।

কোনো কোনো সময় মধু ঘরে মৌমাছি থেকে গেলে রাণীর কুঠুরীর সামনে মধু ঘর রেখে একটু নাড়াচাড়া বা বাতাস দিলে মৌমাছিরা বাচ্চা ঘরে ঢুকে যাবে। এই অবস্থায় মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্যে মধু আহরণ করা হয়। মধু ভর্তি চাক বালতি বা গামলায় রেখে চাকু দিয়ে মৌাচাকের মধু কোষের উপর থেকে মোমের সাদা স্তরটি কেটে ফেলতে হয়। এবার ফ্রেমসহ চাকটি মধু নিষ্কাশন যন্ত্রে রেখে আস্তে আস্তে যন্ত্রটির হাতল ঘুরালে ঐ যন্ত্রে মধু জমা হবে। এবার পরিষ্কার ছাকনি দিয়ে ছেঁকে মধু সংরক্ষণ করতে হবে। মৌমাছিরা তাদের প্রয়োজনে ফুল থেকে রস সংগ্রহ করে লালার সঙ্গে মিশিয়ে মধু থলিতে করে মৌচাকে নিয়ে আসে।

কর্মী মৌমাছিরা তাদের পাখা নেড়ে বাতাস সৃষ্টি করে সংগৃহীত রস থেকে পানি বাষ্পায়িত করে দেয়। খাঁটি মধু তৈরি হওয়ার পর সেগুলোকে চাকের নির্ধারিত প্রকোষ্ঠে জমা করে এবং মোম দিয়ে ঐ সমস্ত প্রকোষ্ঠের মুখ বন্ধ করে দেয়। এক পাউন্ড মধু উৎপাদন করতে একটি কর্মী মৌমাছিকে চাক থেকে বের হয়ে ৪০০০০—৮০০০০ বার ফুল থেকে ফুলে বিচরণ করতে হয়। হিসেবে দেখা গেছে যে, এজন্য একটি কর্মী মৌমাছিকে ৩২০০০—৪২০০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হয়।

 

 

মধু উৎপাদনের গুরুত্ব :

১। মধু মহৌষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাশয়, কানপাকা, জিহবার ঘা, জন্ডিস, অর্শরোগ, সর্দি, কাশি, শ্বাসরোগসহ বিভিন্ন রোগের উপশম ছাড়াও জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

২। মধু বলবৃদ্ধিকারক, পুষ্টিকর ও মিষ্টিদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

৩। মধুতে ভিটামিন—এ, ভিটামিন—বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন—সি রয়েছে।

৪। মধুতে বিদ্যমান ডেক্সট্রোজ শরীরের দীর্ঘস্থায়ী শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।

৫। মধু দেহের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে।

৬। দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ক, ঈধ, গম, ঝ, ঋব, ঈঁ, চ ইত্যাদি উপাদানের উৎস হিসেবে কাজ করে।

৭। বর্তমানে অনেক লোক মৌমাছি চাষের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এছাড়াও বনাঞ্চলের বহু মানুষ প্রাকৃতিক মধু সংগ্রহ করে তাদের জীবিকা চালাচ্ছে।

৮। মৌচাক থেকে প্রসেস করে মোম তৈরি করা হয়। এই মোম ক্রীমজাতীয় প্রসাধনীর প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৯। দরজা, জানালা, প্রাচীরের পুডিং তৈরিতে মোমের ব্যবহার হয়।

১০। জুতার কালি ও কার্বন পেপার তৈরিতে মোম ব্যবহৃত হয়।

১১। রৌপ্যকাররা বিভিন্ন কাজে মোম ব্যবহার করে থাকেন।

১২। বিভিন্ন শিল্প কর্ম ও বাটিকের কাজে মোম ব্যবহৃত হয়।

১৩। বিভিন্ন আসবাবপত্র, জ্বালানী তেল ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরিতেও মোমের ব্যবহার হয়।

১৪। রঙ, বার্ণিশ, সেভিং ক্রীম ও লিপস্টিক তৈরির কাঁচামাল হিসেবে মোম ব্যবহৃত হয়।

১৫। মৌমাছি পালনে মধু উৎপাদনের পাশাপাশি ফসলের পরাগায়ন ভালভাবে হওয়ায় ফলন প্রায় ২০—৩০% বেশি হয়।

১৬। মধু উৎপাদন করা খুব কঠিন নয়। একবার মৌবাক্স স্থাপন করলে সারা বছর মধু পাওয়া সম্ভব। একবার তৈরি করা বাক্স দিয়ে কয়েক বছর মধু পাওয়া যায়।

১৭। অন্য যে কোনো পেশার পাশাপাশি মধু উৎপাদন করে বাড়তি উপার্জন করা সম্ভব।

১৮। মধু উৎপাদনে কম পঁুজি খাটিয়ে বেশি লাভ করা সম্ভব।

১৯। বেকার লোকেরা মৌচাষ করে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে আত্ম—কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করে অনায়াসে স্বাবলম্বী হতে পারে।

২০। শস্য শ্যামল বাংলাদেশে মৌচাষ করে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।

মাশরুম চাষ

মাশরুম চাষ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি”, ৫ নং ইউনিটের ৫.৫ নং পাঠ।

 

মাশরুম চাষ

মাশরুম খুব সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি সবজি। এর ওষুধি বা ভেষজ গুণ রয়েছে। ছত্রাকবিদরা বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষা—নিরীক্ষার মাধ্যমে এ পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় দুই লক্ষেরও বেশি প্রজাতির ছত্রাক আবিষ্কার করেছেন। এই বিপুল সংখ্যক ছত্রাকের মধ্য থেকে অনেক যাচাই—বাছাই করে খাওয়ার উপযোগী প্রায় দুই হাজার ছত্রাক চিহ্নিত করেছেন যেগুলো মাশরুম হিসেবে গণ্য। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ প্রজাতির ছত্রাক মাশরুম হিসেবে উৎপাদন করা যায়। মূলতঃ মাশরুম হলো ভক্ষণযোগ্য মৃতজীবী ছত্রাকের প্রজনন অঙ্গ।

সুগন্ধ, রুচিসম্মত ও ভালো স্বাদের জন্য মাশরুম সকল মানুষের নিকট প্রিয় সবজি হিসেবে পরিচিত। পুষ্টিগুণ বিচারেও মাশরুম সেরা সবজির মধ্যে একটি। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যেসব উপাদান থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন, যেমন—আমিষ , খাদ্য প্রাণ ও খনিজ পদার্থ সেগুলো মাশরুমে উচ্চ মাত্রায় রয়েছে। মাশরুম চাষ করার জন্য কোনো উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না। এটি ঘরেই চাষ করা সম্ভব। এটি চাষ করার জন্য দরকারি কাঁচামাল সস্তায় ও সহজে পাওয়া যায়। বর্তমান বিশ্বে মাশরুম চাষে মানুষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে।

 

বাংলাদেশে চাষযোগ্য মাশরুম:

চাষযোগ্য মাশরুম আমাদের দেশে বর্তমানে যে সমস্ত মাশরুম চাষ হচ্ছে তার একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো :

১। স্ট্র মাশরুম

২। ওয়েস্টার মাশরুম

৩। মিল্কী মাশরুম

৪। ঋষি মাশরুম

৫। শিতাকে মাশরুম

৬। বাটন মাশরুম

৭। পপলার মাশরুম ইত্যাদি।

 

মৌসুমি মাশরুম:

মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে তিন শ্রেণির মাশরুম উৎপাদিত হয়। যথা :

 

১। গ্রীষ্মকালীন মাশরুম :

এ ধরনের মাশরুম শুধু গ্রীষ্মকালে চাষ করা যায়। যেমন— স্ট্র, মিল্কী ও ঋষি মাশরুম।

 

২। শীতকালীন মাশরুম :

এ ধরনের মাশরুম শুধু শীতকালে চাষ করা যায়। যেমন— বাটন, শিতাকে ও শিমাজী মাশরুম।

 

৩। উভয় মৌসুমী বা বছরব্যাপী মাশরুম :

এ ধরনের মাশরুম সারা বছর ধরে চাষ করা যায়। যেমন— ওয়েস্টার, পপলার, ঝিনুক ও কান মাশরুম। মাশরুমের পুষ্টিগুণ পুষ্টিগুণ বিচারে মাশরুম নিঃসন্দেহে একটি সেরা সবজি। খাদ্য জগতে মাশরুমকে সবজি শ্রেণিতে ফেলা হয়, কিন্তু প্রায়োগিকভাবে এরা উদ্ভিদ নয়। এরা ছত্রাক জাতের অন্তভুর্ক্ত। সুস্বাদু খাবার হিসেবে এরা বেশ কিছু পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকে। এরা হৃৎপিন্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে।

এছাড়া মাশরুমে মৌলিক পুষ্টি উপাদান, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং কাইটিন ও বিটা—গ্লুকান জাতীয় উপকারী অঁাশ থাকায় দীর্ঘকালস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। মাশরুমে প্রোটিন, অঁাশ, নিয়াসিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন বি, ভিটামিন ডি, কপার, সেলেনিয়াম, পটাসিয়াম, অন্যান্য খনিজ যেমন— ফসফরাস, জিঙ্ক, ম্যাগেনেসিয়াম, কম পরিমাণ ফ্যাট, ক্যালরী ও সোডিয়াম বিদ্যমান থাকে।

এতে কোনো কোলস্টেরল নেই। পাতলা করে কাটা এক কাপ কাঁচা সাদা মাশরুমে ১৫ ক্যালরি, ০ গ্রাম ফ্যাট, ২.২ গ্রাম প্রোটিন, ২.৩ গ্রাম কার্বহাইড্রেট, ০.৭ গ্রাম অঁাশ ও ১.৪ গ্রাম সুগার থাকে। মাশরুমে কোন কোলস্টেরল থাকে না এবং প্রাকৃতিকভাবেই সোডিয়াম ও ফ্যাট কম থাকে বিধায় এটাকে কার্যকরী খাবার বলা হয়।

মাশরুম চাষের ধাপসমূহ :

মাশরুম চাষে সাধারণত: যে সমস্ত পন্থা অবলম্বন করতে হয় তা ধারবাহিকভাবে নিচে আলোচনা করা হলো :

১। চাষঘর তৈরি :

পরিচ্ছন্ন এবং পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে এমন ঘরে মাশরুম চাষ করতে হয়। মাশরুম চাষের পরিবেশ খুবই স্পর্শকাতর। কারণ কাঙ্খিত পরিবেশ তৈরি না হলে মাশরুম উৎপাদন হয় না। এর চাষে পাঁচটি পরিবেশ বা মূলনীতি মেনে চলতে হয় যেমন :

 

(ক) অক্সিজেন :

মাশরুম প্রধানত কাঠের গুড়া থেকে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। এই কাঠের গুড়া অক্সিজেনের উপিস্থিতিতে জারণ—বিজারণ প্রক্রিয়ায় মাশরুমের খাবার সহজলভ্য করে দেয়। ফলে মাশরুমের ঘরে অক্সিজেনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা জরুরী।

 

(খ) আলো :

মাশরুম ঘরটি হালকা বা আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে হবে। কারণ এই ধরনের আলো মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী।

 

(গ) তাপমাত্রা :

মাশরুম ২০—৩০০ সে. তাপমাত্রায় ভালো জন্মায়। এজন্য মাশরুম ঘরের তাপমাত্রা ২০—৩০০ সে. এর মধ্যে রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে মাশরুম উৎপাদন ব্যাহত হবে। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য ঘরে সিলিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

(ঘ) আর্দ্রতা :

মাশরুম আর্দ্র অবস্থা পছন্দ করে বিধায় ঘরে ৭০—৮০% আর্দ্রতা বজায় রাখা উচিত। এর চাষঘরে মাশরুম প্যাকেটের চারিদিকে উচ্চ মাত্রার আর্দ্রতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। মাশরুম বীজকে স্পন বলা হয়।

 

(ঙ) বায়ুপ্রবাহ :

চাষ ঘরে অক্সিজেন দ্বারা কাঠের গুড়া জারিত হওয়ার ফলে প্রচুর ঈঙ২ তৈরি হয় যা প্রজনন অঙ্গ বা ফুল তৈরিতে বাঁধা দান করে। এজন্য ঈঙ২ কে বের করে দেয়ার জন্য ঘরের নিচের অংশে বায়ুপ্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

২। প্যাকেট বা স্পন সংগ্রহ :

যাচাই—বাছাই করে ভালো মানসম্পন্ন মাশরুম স্পন যে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করতে হবে। যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যাবলী থাকলে মাশরুম স্পনকে ভালো স্পন বলা যায় তা নিম্নরূপ 

ক) প্রতিটি প্যাকেট সুষমভাবে মাইসেলিয়াম দ্বারা পূর্ণ ও সাদা হবে।

খ) মাইসেলিয়ামের রঙ হলুদ, লাল বা কালো হওয়া চলবে না।

গ) প্রতিটি প্যাকেটের গঠন টাইট বা শক্ত হবে।

ঘ) প্যাকেটের গায়ে জাতের নাম ও ইনোকুলেশনের তারিখ লেখা থাকবে।

 

 

৩। প্যাকেট বা স্পন পরিবহন :

সাধারণত: ঠান্ডা পরিবেশে প্যাকেট পরিবহন করতে হয়। দূরবর্তী কোনো স্থানে নেয়ার ক্ষেত্রে ট্রেন বা বাসের ছাদের ওপর রোদে বা ইঞ্জিনের ওপর গরম স্থানে রেখে বা বৃষ্টিতে ভিজিয়ে পরিবহন করা যাবে না। বাতাস চলাচল করতে পারে এমন কাটুর্ন বা বস্তায় ভরে প্যাকেট পরিবহন করতে হয়। কোনো কারণে যদি কয়েকদিন রেখে প্যাকেট কাটতে হয় সেক্ষেত্রে ২৫০ সে. তাপমাত্রায় অর্থাৎ ঠান্ডা ঘরে আলাদা আলাদাভাবে ১৫—২০ দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। তবে প্যাকেট সংগ্রহের পরপরই যত দ্রুত সম্ভব ঠান্ডা সময়ে প্যাকেট কেটে চাষ ঘরে বসানো উচিত।

 

৪। প্যাকেট বা স্পন কর্তন :

প্রতিটি প্যাকেট চাষ ঘরে স্থাপন করার আগে সঠিক পদ্ধতিতে কাটতে হবে। প্রত্যেক প্যাকেটে কোনাযুক্ত দুইটি কাঁধ থাকে। প্রতি কাঁধ বরাবর ২ ইঞ্চি লম্বা এবং ১ ইঞ্চি ব্যাস করে উল্টো ডি আকারে কাটতে হবে। প্রত্যেক প্যাকেটের দুই কাঁধে দুইটি উল্টো ডি আকারে কাটা থাকবে। প্রতি প্যাকেটের উভয় পার্শ্বের এ কাটা জায়গার সাদা অংশ ব্লেড দিয়ে চেছে ফেলতে হবে। এই কাটা ও চাছা প্যাকেট উপুড় করে ৫—১৫ মিনিট পানিতে চুবিয়ে নেয়ার পর ভালোভাবে পানি ঝরিয়ে চাষ ঘরের মেঝে অথবা তাকে সারি করে স্থাপন করতে হবে।

 

৫। প্যাকেট বা স্পন তাকে স্থাপন :

চাষ ঘরের মেঝে বা তাকের ওপর প্যাকেট থেকে প্যাকেটের দূরত্ব ২ ইঞ্চি এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ২ ইঞ্চি বজায় রাখলে ভালো ফলন হয়। প্যাকেটের চারিদিকে ৭০—৮০% আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য গরমের সময় দিনে ৪/৫ বার, শীতে ও বর্ষায় দিনে ২/৩ বার পানি ে¯প্র করা যেতে পারে যাতে প্যাকেট ও এর চারপাশে আর্দ্র অবস্থা বিরাজ করে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন প্যাকেটের কাটা জায়গার মাশরুম অঙ্কুরের ওপর ফেঁাটার আঘাতে অঙ্কুর ভেঙ্গে না যায় এবং পানি জমে না থাকে। পানি ে¯প্র করার সংখ্যা বা মাত্রা প্রয়োজনে কম বা বেশি হতে পারে। তবে সূর্য ওঠার আগে এবং সূর্য ডোবার পর পানি ে¯প্র করলে মাশরুমের ফলন বেড়ে যায়।

 

৬। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ :

সুতি কাপড় বা খবরের কাগজ ভিজিয়ে প্যাকেটের ওপরে একটু উঁচু করে রেখে চাষ ঘরের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। প্রয়োজনে ে¯প্র মেশিন দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি ে¯প্র করে চাষ ঘরের দেয়াল ও মেঝে কয়েকবার ভিজিয়ে দিয়ে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কাঙ্খিত মাত্রায় বজায় রাখা যায়।

 

৭। অন্যান্য পরিচর্যা :

মাশরুম একটি স্পর্শকাতর সবজি হওয়ায় চাষ ঘরের ভিতর ও বাহিরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্যাকেটে একসাথে অনেকগুলো অঙ্কুর দেখা গেলে সমআকারের স্বাস্থ্যবান মাশরুম পাওয়ার জন্য ছোট অঙ্কুরগুলো ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলতে হবে এবং প্রতি কাঁধ বা পাশের থোকায় ৮ থেকে ১২টি ফ্রুটিং বডি রাখতে হবে।

৮। মাশরুম সংগ্রহ :

প্রথমবার মাশরুম তোলার পর পাকেটকে ১ দিন বিশ্রাম অবস্থায় রাখতে হয়। পরের দিন পূর্বের কাটা অংশ পুনরায় চেছে ফেলে আগের মতো পানি ে¯প্র করতে হয়। একটি প্যাকেট থেকে ৫/৬ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যায়, তবে বাণিজ্যিকভাবে ২/৩ বারের বেশি সংগ্রহ করা উচিত নয়।

 

৯। মাশরুম সংরক্ষণ :

কাঁচা মাশরুমে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় সংরক্ষণকাল খুবই কম হয়। মাশরুম সংগ্রহ করার পরপরই এর রং এবং গঠনের দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। এজন্য সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে রং ও গঠন ঠিক রেখে বেশি দিন ব্যবহার করা সম্ভব হয়। কিছু নিয়ম মেনে চললে মাশরুম ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়। যেমন— পরিপক্ক অবস্থা বা সঠিক সময়ে মাশরুম সংগ্রহ করা, পরিস্কার—পরিচ্ছন্ন রাখা, ঠান্ডা ও বায়ুরোধী অবস্থায় সংরক্ষণ করা ইত্যাদি। মাশরুমকে তাজা ও শুকনো উভয় অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়। এ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :

 

(ক) তাজা মাশরুম সংরক্ষণ :

মাশরুম তোলার ১২ ঘন্টা আগ পর্যন্ত পানি ে¯প্র না করে তুললে তা ব্যাগে সিলিং করে ঘরের ঠান্ডা জায়গায় রেখে ২—৩ দিন পর্যন্ত খাওয়া যায়। এছাড়াও রেফ্রিজারেটরে ১০০ সে. তাপমাত্রায় নরমাল চেম্বারে সিলিং অবস্থায় ৭—৮ দিন রেখে খাওয়া যায়। তাছাড়া ব্লানচিং করে লবণ দ্রবণে ৫—৬ মাস রেখে মাশরুম খাওয়া যায়। ব্লানচিং করার নিয়ম হলো— শতকরা ২ ভাগ লবণযুক্ত ফুটন্ত পানিতে ২—৫ মিনিট মাশরুম সিদ্ধ করে পরিস্কার ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিয়ে তা ২% লবণ ও ১% সাইট্রিক এসিড মিশ্রিত দ্রবণে বায়ুরোধী করে সংরক্ষণ করা।

 

(খ) শুকনো মাশরুম সংরক্ষণ :

মাশরুম শুকানোর পর তা বায়ুরোধী প্যাকেটে ৫—৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এছাড়াও শুকানো মাশরুম ব্লেন্ডার মেশিন দিয়ে গুড়ো বা পাউডার করে বায়ুরোধী প্যাকেটে ৫—৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়। ভক্ষণযোগ্য মাশরুম বিভিন্ন পদ্ধতিতে আবাদ বা চাষ করা যায়। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে খড়দিয়ে এবং শীতকালে কম্পোস্ট দিয়ে যথাক্রম স্ট্র মাশরুম ও ওয়েস্টার মাশরুম চাষ করা হয়। নিচে স্ট্র মাশরুম ও ওয়েস্টার মাশরুম এর চাষ পদ্ধতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

 

স্ট্র মাশরুম চাষ পদ্ধতি প্রয়োজনীয় উপকরণ :

মাশরুম বীজ বা স্পন ধানের খড় ৬০ সে.মি.  ৪০ সে.মি. সাইেজের পাতলা পলিথিন ব্যাগথার্মোমিটার হাইগ্রোমিটার হ্যান্ড ে¯প্রয়ার ব্লেড বা চাকু জীবাণুনাশক বালতি কড়াই ছিদ্রমুক্ত কালো পলিথিন শীট ছিকা চাষ প্রক্রিয়া : এক কেজি ধানের খড় ২—৩ ইঞ্চি আকারে কেটে নিয়ে একটি বেড প্রস্তুত করা যায়। কাটা খড় বালতিতে পরিস্কার পানি নিয়ে তাতে ১২ ঘন্টা ডুবিয়ে রাখতে হয়। এরপর একটি বড় কড়াইয়ে প্রায় ৮৫০ সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে বালতির খড়গুলো ৩০ মিনিট ধরে সিদ্ধ করতে হয়।

 

 

এতে খড়ের মধ্যে থাকা জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। সিদ্ধ করা খড় কড়াই থেকে তুলে চাটাই বা পাকা মেঝের ওপর রেখে ঠান্ডা করতে হবে ও পানি ঝড়াতে হবে, কিন্তু শুকানো যাবে না। নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো মানের মাশরুম বীজ সংগ্রহ করে প্যাকেট থেকে বীজ বা স্পন বের করে এমনভাবে ছোট ছোট টুকরোয় ভাঙ্গতে হবে যাতে বীজযুক্ত প্রতিটি দানা পৃথক হয়ে যায়। প্রতি বেডের জন্য ১০০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। এখন ৪০—৫০ টি ছিদ্রযুক্ত একটি পলিথিন ব্যাগে পানি ঝড়ানো সিদ্ধ করা খড় ঢুকাতে হবে।

বায়ু চলাচলের সুবিধার্থে পলিথিন ব্যাগে ছিদ্র করা হয়। প্রথমে পলিথিন ব্যাগের ভিতর ৪—৫ ইঞ্চি উঁচু করে খড়ের স্তর দিয়ে তার ওপর ২৫ গ্রাম মাশরুম বীজ সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর এই ছড়ানো মাশরুম বীজের ওপর আবার ৪—৫ ইঞ্চি উঁচু করে খড়ের ¯র বিছিÍ য়ে পুনরায় ২৫ গ্রাম মাশরুম বীজ সমভাবে ছড়াতে হবে। এভাবে খড়ের ৪টি স্তরের ওপর ৪ বার মাশরুম বীজ ছড়ানোর পর পঞ্চমবার একইভাবে খড় বিছিয়ে পলিথিন ব্যাগের মুখ বেঁধে দিলেই একটি উপযুক্ত বেড প্রস্তুত হয়ে যাবে।

চাষঘরের তাপমাত্রা ২৫—৩০০ সে. এবং আর্দ্রতা ৮০—৯০% রাখা উচিত। পলিথিন শীট দিয়ে ঢেকে তাপ বাড়ানো যায়, আবার খুলে দিয়ে তাপ কমানো যায়। প্রস্তুতকৃত বেড চাষঘরের মাচার ওপর ১৪ দিন অন্ধকারে রেখে দিলে বীজ গজাবে এবং খড়ের চারিদিকে মাইসেলিয়াম দেখা যাবে। এ অবস্থাকে বীজ রানিং বলা হয়। এরপর অন্ধকার থেকে সরিয়ে নিয়ে পলিথিন ব্যাগ থেকে খড়ের বেড বের করে চাষ ঘরে মাচায় বা ছিকায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সাবধানে বেড বের করলে ঐ পলিথিন পুনরায় ব্যবহার করা যায়। পলিথিন বেড থেকে বেড বের করার ৭—১০ দিন পরই মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। এরকম বেড থেকে মোট ৩ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। এ ধরনের বেডে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে হ্যান্ড ে¯প্রয়ার দিয়ে পানি ে¯প্র করতে হয়।

বেডকে পোকামাকড় ও অন্যান্য আপদের হাত থেকে রক্ষা করতে হয়। উল্লেখ্য ১ কেজি ওজনের শুকনো খড়ের বেড থেকে ৬০০—৮০০ গ্রাম মাশরুম উৎপাদন সম্ভব। ওয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতি প্রয়োজনীয় উপকরণ : মাশরুম বীজ বা স্পন (রর) কম্পোস্ট তৈরির জন্য কাঠের গুঁড়া ও ধানের কুড়া প্লাষ্টিক গামলা অটোক্লেভ মোম লাগানো কাগজ ও তুলা চোষ কাগজ/চট তাক একটি সরু কাঠি পলিথিন ব্যাগ হ্যান্ড ে¯প্রয়ার।

 

চাষ প্রক্রিয়া :

একটি বড় প্লাস্টিকের গামলায় ৩/৪ ভাগ শুকনো কাঠের গুঁড়া, ১/৪ ভাগ ধানের কুড়া ও পরিষ্কার পানি নিয়ে এমনভাবে মিশাতে হবে যেন মিশ্রণে চাপ দিলে ২/১ ফোটা পানি ঝরে। পরিস্কার পলিথিন ব্যাগে এই ভিজানো গুড়ার ৫০০ গ্রাম ভরতে হবে। একটি সরু কাঠি দিয়ে পলিথিন ব্যাগের ভিতর মাঝখান থেকে তলার দিকে চাপ দিয়ে একটি গর্ত করতে হবে। ব্যাগের মুখ মোমযুক্ত কাগজ ও তুলা দিয়ে বন্ধ করতে হবে। এরপর অটোক্লেভ দ্বারা ১০০০ সে. তাপে ৩০—৪০ মিনিট ব্যাগগুলো শোধন করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

অটোক্লেভ থেকে ব্যাগ সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করার জন্য ২৪ ঘন্টা রেখে দিতে হবে। তারপর ব্যাগের ভিতর মাঝখানের ছিদ্র দিয়ে মাশরুম বীজ ঢুকিয়ে ব্যাগগুলো সঁ্যাতসঁ্যাতে ও অন্ধকার ঘরে ২০—২৫০ সে. তাপমাত্রায় তাকের ওপর ২০ দিন রাখতে হয়। এতে সাদা মাইসেলিয়াম দিয়ে ব্যাগ ভরে যাবে। এই অবস্থায় ব্যাগগুলোর কাঁধ বরাবর উল্টো উ আকৃতিতে কেটে নিতে হবে এবং প্রতিদিন ৪—৫ বার করে পানি ে¯প্র করতে হবে। এ সময় ঘরে আলো বাতাস থাকা জরুরী। এমতাবস্থায় ১০—১৫ দিনের মধ্যেই মাশরুম গজাবে। উপরের অংশ ছাই রঙের হলে মাশরুম সংগ্রহ করতে হয়। একটি ব্যাগ থেকে ৬—৭ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যায়।

 

মাশরুমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব :

১। মাশরুম সুস্বাদু ও পুষ্টিকার সবজি বিধায় নিয়মিত খেয়ে পুষ্টিহীনতা দূর করা যায়।

২। বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।

৩। মাশরুমে ভেষজ গুণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।

৪। আবাদী জমির প্রয়োজন হয় না। ফলে ভূমিহীন কৃষক তাকে তাকে সাজিয়ে একটি ঘরকে কয়েকটি ঘরের সমান ব্যবহার করতে পারে। অর্থাৎ মাশরুম চাষ স¤প্রসারণের মাধ্যমে এক একর জমির উৎপাদনকে বাড়িয়ে প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি করতে পারে।

৫। বাড়তি আয়ের উৎস। অন্য যে কোনো পেশার পাশাপাশি এটা চাষ করে একদিকে যেমন পরিবারের চাহিদা মেটানো যায়, অন্যদিকে বাড়তি আয়ও করা সম্ভব হয়।

৬। অল্প পুঁজি ও শ্রমের মাধ্যমে এটা চাষ করা যায়।

৭। মাশরুম চাষে বিনিয়োগকৃত অর্থ অতি দ্রুত তুলে আনা সম্ভব।

৮। চাষে সার ও বালাইনাশক ব্যবহৃত হয় না বলে মাশরুম স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব হয়।

৯। মাশরুম চাষে ব্যবহৃত প্যাকেট সর্বশেষে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

১০। এক কেজি মাশরুম উৎপাদন করতে ৪০ টাকা খরচ হয় অথচ ২০০ টাকা বিক্রি করা যায়। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ১৬০ টাকা লাভ হয়।

১১। এক হিসেবে দেখা গেছে যে, প্রতি হেক্টরে গরুর মাংস ও মাছ উৎপাদিত হয় যথাক্রমে ৭৮ কেজি ও ৬৭৫ কেজি। অথচ মাশরুম উৎপাদিত হয় ৬৫০০০ কেজি।

১২। চাষ শুরুর অল্প দিনের মধ্যে মাশরুম সংগ্রহ করা যায়, অথচ অন্য কোন ফসলে তা সম্ভব নয়।

১৩। মাশরুম চাষের মাধ্যমে দুঃস্থ মহিলা ও বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। ফলে সমাজ থেকে দারিদ্র্যতা দূর হবে।

১৪। সারা বছর মাশরুম চাষ করা যায়।

 

রেশম চাষ

রেশম চাষ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি ” বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি” বিষয়ের, ৫ নং ইউনিটের ৫.৪ নং পাঠ।

রেশম চাষ

রেশম পোকার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে ইড়সনুী সড়ৎর রেশম চাষে বেশি ব্যবহার করা হয়। এ পোকা তুঁত গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে বিধায় রেশম চাষীকে তুঁত গাছ চাষ করতে হয়। রেশম চাষ এর ইংরেজি হলো Sericulture। ল্যাটিন শব্দ ‘Serio’ থেকে Sericulture শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

রেশম পোকার খাদ্যের জন্য তুঁত গাছ চাষ করে এই পোকার লার্ভা পালন করে তাদের সৃষ্ট গুটি বা কোকুন থেকে রেশম সুতা আহরণ করার পদ্ধতিকে রেশম চাষ বলা হয়। তুঁত গাছ চাষ ও রেশম পোকার লার্ভা পালন ছাড়াও এ পোকার বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে অধিক উৎপাদনশীল রেশম পোকা উদ্ভাবন করা আধুনিক রেশম চাষের অন্তভুর্ক্ত। আমাদের দেশের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু রেশম চাষের জন্য বেশ উপযোগী।

 

রেশম চাষের ধাপসমূহ :

১। তুঁত গাছ:

চাষ বন্যামুক্ত ও সুনিষ্কাশিত দোঅঁাশ ও বেলে দোঅঁাশ মাটি তুঁত গাছ চাষ করার জন্য উত্তম। বাড়ির চারিদিকে, পুকুর পাড়ে, রাস্তা ও রেললাইনের পাশে এবং পতিত জমিতে তুঁত গাছ চাষ করা হয়। এস ১, এসভি ৫, সি ৭৭৬, এস ৭৯৯ ইত্যাদি জাতের তুঁত গাছের চারা রোপণ করা যেতে পারে। কারণ উন্নত জাতের চারা থেকে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বীজ, শাখা কলম, দাবা কলম, গুটি কলম ও কঁুড়ি সংযোজনের মাধ্যমে তুত গাছের বংশবিস্তার করা যায়।

তবে বাংলাদেশে শাখা কলমের মাধ্যমে তৈরি চারাই বেশি ব্যবহৃত হয়। আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে ও আগাছা পরিষ্কার করে জমি তৈরি করতে হয়। এক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় প্রতি বিঘা জমিতে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ কেজি ইউরিয়া, ৩০ কেজি টিএসপি ও ১৫ কেজি এমপি সার শেষ চাষের সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। তবে পুকুর পাড়, রাস্তা ও রেল লাইনের পাশে গর্ত পদ্ধতিতে লাগানোর বেলায় সারগুলোকে একত্রে মিশিয়ে পরিমাণমত প্রতিটি গর্তের মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়।

সাধারণত সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬—৬.৫ ফুট এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩—৪ ফুট রাখতে হয়। তুঁত গাছ লাগানোর আসল উদ্দেশ্যই হলো পাতা সংগ্রহ। ভালো জাতের তুঁত গাছ থেকে অধিক পাতা সংগ্রহ করা যায়। রেশম পোকার লার্ভা তুঁত গাছের কচি বা নতুন পাতা খেয়ে বড় হতে থাকে। একবার লাগালে তুঁত গাছ ২০—২৪ বছর পর্যন্ত পাতা দিতে থাকে।

নিয়মিত ডাল ছাঁটাই করা হলে নতুন ডাল ও পাতা গজায়। ধারালো দা বা চাকু দিয়ে পুরনো ডালের এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক অংশ কেটে ফেলতে হয়। সাধারণত চারা লাগানোর এক বছর পর বর্ষার শেষে তুঁত গাছের ডালপালা প্রথম ছাঁটাই করতে হয়। দুই থেকে আড়াই বছর পর নিয়মিতভাবে রেশম লার্ভার জন্য নতুন পাতা সংগ্রহ করা যায়। তুঁত গাছের গোড়ায় প্রতি বছর অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হয়। বৃষ্টি না হলে মাঝে মাঝে সেচ দিতে হয়। আবার কোনো কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা নিতে হয়। আগাছা বেশি হলে তা দমন করতে হয়।

তুঁত গাছে পোকা ও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পোকার মধ্যে উইপোকা, বিছাপোকা, লিফ হপার এবং রোগের মধ্যে লিফ স্পট, পাউডার মিলডিউ, মরিচা রোগ, শিকড় পচা রোগ ও নেমাটোড রোগ দেখা যায়। উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে এসব পোকা ও রোগ দমনের ব্যবস্থা নিতে হয়।

২। তুঁত পাতা সংগ্রহ

সকালে অথবা বিকালে তুঁত গাছের পাতা সংগ্রহ করতে হয়। সকালে এমন সময় পাতা সংগ্রহ করতে হয় যেন ভেজা না থাকে। প্রখর রৌদ্রের সময় পাতা সংগ্রহ করা উচিত নয়। নতুন বা কচি পাতা তোলার পর তা পলিথিন ব্যাগে রেখে ঠান্ডা স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। প্রয়োজনে পলিথিন ব্যাগে ভেজা স্পঞ্জ ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাগের ভিতর যাতে তাপ সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চব্বিশ ঘন্টায় লার্ভাকে বর্ষা মৌসুমে ৩ বার এবং শুষ্ক মৌসুমে ৫ বার পর্যন্ত খাবার দিতে হয়। লার্ভার বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়।

 

৩। রেশম পোকার লার্ভা বা পলু বা শুককীট:

রেশম পোকার লার্ভা বা পলু বা শুককীট সংগ্রহ সাধারণত রেশম বীজাগার থেকে রেশম পোকার লার্ভা সংগ্রহ করতে হয়। ৪—৫ দিন বয়সী সুস্থ ও স্বাভাবিক লার্ভা চাষিদের মধ্যে বিতরণ বা সরবরাহ করা হয়। সকালে বা বিকেলে অথবা দিনের যে কোনো ঠান্ডা সময় হার্ডবোর্ডের তৈরি ছিদ্রযুক্ত বাক্স বা নেটের বাক্সে লার্ভা পরিবহণ করতে হয়। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকলে বাক্সের চারিদিকে ভেজা কাপড় বা ন্যাকড়া জড়িয়ে লার্ভা পরিবহণ করা আবশ্যক।

এছাড়াও রেশম পোকার কোকুন বা গুটি সংগ্রহ করেও লার্ভা পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে রেশম পোকার কোকুন বা গুটি সাধারণ তাপমাত্রায় রেখে দিলে ১০—১২ দিন পর গুটি কেটে প্রতিটি কোকুন থেকে পুরুষ বা স্ত্রী মথ বের হয়ে আসবে। বের হবার পর পুরুষ ও স্ত্রী মথ যৌন সঙ্গমে মিলিত হবে। মিলনের ঘন্টা তিনেক পর পুরুষ মথটিকে সঙ্গমরত অবস্থা থেকে আলাদা করে নিতে হবে এবং স্ত্রী মথটিকে একটি কৌটার ভিতরে সাদা কাগজের ওপর রেখে তা ঢেকে দিতে হবে। স্ত্রী মথটি এ অবস্থায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাদা কাগজের ওপর ৩৫০০—৫০০০ টি পর্যন্ত ডিম পাড়বে।

এবার কৌটার ভিতরকার ডিম সম্বলিত সাদা কাগজ বের করে তা ডালাতে রাখতে হবে এবং অন্য একটি ডালা দিয়ে তা ঢেকে রাখতে হবে। ডিমের ঘরে ২৫০ সে. তাপমাত্রা ও ৭৫—৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা থাকা উত্তম। বর্ণিত অবস্থায় রেখে দিলে ৮—৯ দিনের মাথায় ডিমে কালো ছিট দাগ পড়বে এবং ৯—১০ দিনের মাথায় পুরো ডিম কালো রং ধারণ করবে। এ ডিমগুলো শোধন করার জন্য ২% ফরমালিন দ্রবণের মধ্যে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পানি দ্বারা ধুঁয়ে নিতে হয়। ডিম ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূলে থাকলে ২৪ দিনের মধ্যেই ৯০—৯৫ ভাগ ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়ে আসবে।

 

৪। রেশম পোকার লার্ভা পালন:

নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করে রেশম পোকার লার্ভা পালন করা যায়।

(ক) লার্ভা ঘর তৈরি :

মুক্ত আলো বাতাসযুক্ত উঁচু স্থানে লার্ভা ঘর তৈরি করতে হয়। এ ঘরের ক্ষেত্রফল ২২ ফুট  ১৬ ফুট হলে ভালো হয়। ঘরের দেয়াল মাটির ও ছাউনি খড়ের হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। বায়ু চলাচল নিশ্চিত করার জন্য ঘরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দরজা ও জানালা রাখতে হয়। মাছি যাতে রেশম পোকার লার্ভাকে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য দরজা ও জানালায় তার জাল বা বাঁশের চিক লাগাতে হয়। লার্ভা ঘর যাতে সঁ্যাতস্যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

(খ) লার্ভা পালনে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি :

লার্ভার ছোট অবস্থায় বাঁশের ছোট ডালা, বড় অবস্থায় বাঁশের বড় ডালা, ডালা রাখার জন্য কাঠ বা বাঁশের তাক, লার্ভার বেড বা ডালা পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত ছোট লার্ভার জন্য ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট জাল ও বড় লার্ভার জন্য বড় ছিদ্রবিশিষ্ট জাল, তাকের পায়ায় দেয়ার জন্য আলকাতরা বা পানির বাটি, তুঁত পাতা কাটার জন্য চাকু বা ছুরি, লার্ভার গা থেকে ছোপ পোকা ঝাড়ার জন্য পাখির পালক, গুটি করার জন্য বাঁশের চন্দ্রকী, ঘরের আর্দ্রতা বাড়ানোর স্পঞ্জ, শীতে ঘর গরম করার জন্য হিটার বা চুলা, ঘরের তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মোমিটার, আপেক্ষিক আর্দ্রতা মাপার জন্য আর্দ্রতা মাপক যন্ত্র, শোধন করার জন্য ফরমালিন, চুন ইত্যাদি সরঞ্জামাদি ব্যবহৃত হয়।

 

(গ) লার্ভা ঘর ও সরঞ্জামাদি শোধন :

রেশম পোকার লার্ভা পালন শুরুর ২—৩ দিন আগেই যে সব জিনিসপত্র ব্যবহৃত হবে তাসহ লার্ভা ঘর শোধন করে নিতে হয়। ঘরের মেঝেসহ সকল সরঞ্জামাদি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে কড়া রোদে শুকিয়ে নেওয়া উত্তম। এরপর ফরমালিন অনুমোদিত মাত্রা অনুযায়ী পানির সঙ্গে মিশিয়ে ে¯প্র মেশিন দিয়ে মেঝেসহ ঘরের ভিতর সব স্থানে ও সরঞ্জামাদির ওপর ে¯প্র করতে হয়। ে¯প্র করার পর উক্ত ঘর ২৪ ঘন্টা বায়ুরোধী করে বন্ধ রাখতে হয়।

 

(ঘ) লার্ভার পরিচর্যা :

রোগমুক্ত ও ভালো মানের লার্ভা সংগ্রহ করে রেশম চাষ শুরু করতে হয়। লার্ভা দেখতে পশমবিহীন ছাইয়া—ধূসর বা ক্রীম বর্ণের। লার্ভা প্রায় ৭—৯ সে.মি. লম্বা হয়। রেশম বা গুটি পোকার অনেকগুলো রেস (ৎধপব) আছে। বছরে একবার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে একচক্রী (ঁহরাড়ষঃরহব), বছরে দু’বার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে দ্বিচক্রী (নরাড়ষঃরহব) এবং বছরে বহুবার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে বহুচক্রী (সঁষঃরাড়ষঃরহব) রেস বলা হয়। আমাদের দেশে বহুচক্রী রেস চাষ হয়। পালনের সময় ডালাতে লার্ভার ছোট অবস্থায় তুঁত পাতা কেটে টুকরো করে দিতে হয় এবং লার্ভার বড় অবস্থায় আস্ত পাতা দিলেও কোনো সমসা হয় না। পালনের সময় লার্ভার পায়খানা ও পাতার অবশিষ্টাংশ ডালা অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা করে ফেলে।

এজন্য লার্ভার ছোট অবস্থায় ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট জালের ওপর টুকরো টুকরো তুঁত পাতা দিয়ে ঐ জালটি ডালার ওপর বিছিয়ে দিলে লার্ভাগুলো জালের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে জালের ওপর খাবার খাওয়ার জন্য চলে আসবে। এমতাবস্থায় লার্ভাসহ ঐ জালটি অন্য ডালায় রেখে নোংরা ডালাটি পরিস্কার করা সম্ভব হয়। এমনিভাবে বড় ছিদ্রবিশিষ্ট জাল দিয়েও বড় লার্ভাগুলো স্থানান্তর করে নোংরা ডালা পরিষ্কার করা যায়। লার্ভাগুলো এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার সময় দেহের খোলস বদলায়। এই খোলস বদলানোকে মোল্টিং (সড়ঁষঃরহম) বলা হয়।

খোলস বদলানোর সময় লার্ভাগুলো খাওয়া—দাওয়া বন্ধ করে দেয় ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। এই লার্ভাগুলোতে পাঁচটি ইনস্টার (রহংঃধৎ) পরিলক্ষিত হয়। ডিম থেকে বের হবার পর থেকে ১ম খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ১ম ইনস্টার, ১ম খোলস বদলানোর পর থেকে ২য় খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ২য় ইনস্টার, ২য় খোলস বদলানোর পর থেকে ৩য় খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ৩য় ইনস্টার, ৩য় খোলস বদলানোর পর থেকে ৪র্থ খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ৪র্থ ইনস্টার এবং ৪র্থ খোলস বদলানোর পর থেকে পিউপা বা পুত্তলী বা গুটি বা কোকুন তৈরির আগ পর্যন্ত সময়কে ৫ম ইনস্টার বলা হয়।

রেশম পোকা সাধারণত ২২—২৩ দিন লার্ভা অবস্থায় থাকে। ১ম ইনস্টারে ৩ দিন ও ১ম খোলস বদলাতে ২০ ঘন্টা সময় লাগে। ২য় ইনস্টারে ২ দিন ও ২য় খোলস বদলাতে ২০ ঘন্টা সময় লাগে। ৩য় ইনস্টারে ৩ দিন ও ৩য় খোলস বদলাতে ১ দিন সময় লাগে। ৪র্থ ইনস্টারে ৪ দিন ও ৪র্থ খোলস বদলাতে ১ দিন সময় লাগে। ৪র্থবার খোলস বদলানোর পর কোকুন বা গুটি তৈরির পূর্বে ৬—৭ দিন লার্ভা অবস্থায় থাকে। লার্ভার ১ম তকে ৩য় ইনস্টার পর্যন্ত ঘরের তাপমাত্রা ২৭০ সে. ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০—৮৫% রাখতে হয়।

আবার ৪র্থ ইনস্টার থেকে গুটি তৈরির আগ পর্যন্ত সময়ে ২৫—২৬০ সে. তাপমাত্রা ও ৭০—৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা রাখা বাঞ্চনীয়। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ বা খোলা রেখে এবং ডালার চার পাশে পানিতে ভেজানো স্পঞ্জ রেখে ঘরের তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা বাড়ানো বা কমানো যেতে পারে।

 

(ঙ) রেশম পোকার রোগ, পোকা, মাকড় ও কমি দমনৃ :

বিভিন্ন রোগ রয়েছে, যেমন— পেব্রিন রোগ, ফ্লাচারি রোগ, জন্ডিস রোগ, প্যাটিন রোগ, মাসকারডাইন রোগ ইত্যাদি। এছাড়া উজি মাছি, ডার্মাস্টিক বিটল, মাকড়, কৃমি ইত্যাদিও রেশম পোকার শত্রু। তবে এগুলোর মধ্যে প্রধান শত্রু হলো উজি মাছি। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী উজি মাছি লার্ভার গায়ে ডিম পাড়ে। ১—২ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে ম্যাগট বের হয়। এই ম্যাগটগুলো লার্ভার দেহের ভিতরে ঢুকে পেশিকলা খেয়ে ফেলে। ফলে লার্ভা মারা যায়। এভাবে একটি উজিমাছি প্রায় ২০০—৩০০ টি রেশম লার্ভা মেরে ফেলতে পারে। অনুমোদিত মাত্রায় ঔষধ ব্যবহার করে বা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ সমস্ত রোগ, পোকা, মাকড় ও কৃমি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

 

৫। রেশম গুটি সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ :

রেশম গুটি সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পঞ্চম ইনস্টার শেষ হবার পর লার্ভা যখন চুপচাপ ও নিস্তেজ হয়ে পড়বে, তখন ঐ লার্ভাগুলোকে বাঁশের চন্দ্রকীতে স্থানান্তর করতে হয়। ৬ ফুট লম্বা ও ৪ ফুট প্রস্থের একটি চন্দ্রকীতে প্রায় এক হাজার লার্ভা রাখা যায়। চন্দ্রকীতে রাখার পর এক পর্যায়ে লার্ভার মুখ থেকে তরল রেশমের ফোটা নিঃসৃত হয় যা সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে চন্দ্রকীতে আটকে যায়। শেষ পর্যায়ে লার্ভা নিজ দেহের চারিদিকে একটি আবরণ তৈরি করে যাকে কোকুন বা গুটি বলা হয়। চন্দ্রকীতে লার্ভা দেয়ার পর ঐ চন্দ্রকী লার্ভা ঘরের বাইরে বারান্দায় হেলানো অবস্থায় রাখতে হয়।

এতে করে রেশম গুটির গুণগত মান ভালো হয়। লার্ভা ঘরে চন্দ্রকী রাখা উচিত নয়। কারণ ঘরের অবশিষ্ট লার্ভার ক্ষতি হয়। ২৩—২৪০ সে. তাপমাত্রা ও ৭০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ভালো ও উন্নতমানের রেশম গুটি পাওয়া যায়।

রেশম পোকার লার্ভা রেশম গ্রন্থি থেকে যে লালা নিঃসরণ করে তা থেকে রেশম তৈরি হয়। রেশম গ্রন্থি দেহের দু’পাশে অবস্থিত দুটো লম্বা ও পুরু প্রাচীরের থলে দ্বারা গঠিত যাদের সাধারণ একটি ছিদ্রপথে রেশম লালা নিঃসৃত হয়। রেশম পোকার লার্ভা যখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় তখন থলে দু‘টো আঠালো তরল পদার্থে পূর্ণ হয়ে যায়। আর এই আঠালো তরল পদার্থ যখন বাইরে বেরিয়ে আসে তখন বাতাসের সংস্পর্শে তা শক্ত হয়ে গুটি বা কোকুনে পরিণত হয়। গুটি করা শেষ হলে লার্ভা পিউপায় বা মুককীটে রূপান্তরিত হয়।

পিউপায় রূপান্তরিত হবার ২/১ দিনের মধ্যেই চামড়া শক্ত হয়ে বাদামি রং ধারণ করে। পিউপার চামড়া শক্ত হবার পর চন্দ্রকী থেকে রেশম গুটি ছাড়াতে হয়। রেশম গুটি ছাড়ানোর আগে চন্দ্রকী ১ দিন রোদে ও বাতাসে রেখে দিলে ভালো হয়। এতে করে গুটির শেল শক্ত হয় এবং নষ্ট কম হয়। গুটি ছাড়ানোর পর তা পরিষ্কার করে সুতা তৈরি বা রিলিং  এর জন্য বিক্রি করা হয়।

৬। সুতা তৈরি:

রেশম গুটির ভিতরে পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ রেশম মথ বের হলে মথটি গুটির একদিকে কেটে বের হয়ে আসে। ফলে গুটির লম্বা সুতাটি অসংখ্য টুকরোয় পরিণত হয় এবং ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এজন্য গুটির অক্ষত লম্বা সুতাটি পাওয়ার জন্য পূর্ণাঙ্গ রেশম মথ বের হবার আগেই গুটিগুলো ৯০—৯৫০ সে. তাপমাত্রার প্রায় ফুটন্ত পানিতে ৩—৪ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হয়। এর ফলে গুটির ভিতরের পিউপা বা মুককীট মারা যায় এবং গুটিতে রেশম সুতার সাথে লেগে থাকা আঠালো পদার্থ গলে যায়।

এতে সুতা রিলে জড়ানোর উপযোগী হয়। এরপর গুটির মুখের সুতার প্রান্ত সুতা কাটা চরকি বা রিলের সাথে আটকিয়ে নিয়ে চরকির ঘূর্ণন অব্যাহত রাখলে গুটি থেকে সুতা মুক্ত হয়ে চরকি বা রিলের সাথে পেচাতে থাকে। চরকি বা রিলের মাধ্যমে গুটি থেকে সুতা উত্তোলনের এই পদ্ধতিকে রিলিং  বলে।

চরকি বা রিলের মাধ্যমে উৎপাদিত এ সুতাকে কাঁচা রেশম বলা হয়। পরবর্তীতে এ কাঁচা রেশমকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রসেস করে রেশম বস্ত্র বয়ন করা হয়। পূর্ণতার শেষ পর্যায়ে এসে একটি রেশম লার্ভা প্রতি মিনিটে প্রায় ছয় ইঞ্চি সুতা তৈরি করতে পারে এবং সম্পূর্ণ গুটি বা কোকুন তৈরি করতে ৩ দিন সময় নেয়। একটি রেশম গুটি থেকে প্রায় ১০০০—৩০০০ ফুট সুতা পাওয়া যায় এবং ১ পাউন্ড রেশম সুতা পেতে প্রায় ২৫ হাজার গুটির প্রয়োজন হয়।

 

রেশম পোকার জীবনচক্র:

রেশম পোকার জীবনে চারটি দশা বা ধাপ রয়েছে, যথা— ১। ডিম ২। লার্ভা বা শুককীট ৩। পিউপা বা মুককীট ও ৪। পূর্ণাঙ্গ মথ। এগুলো সম্পর্কে পূর্বে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

 

রেশমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:

রেশমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১। রেশম পোকা থেকে রেশমি সুতা পাওয়া যায়। এই রেশমি সুতা দ্বারা উন্নতমানের অতি মূল্যবান ও আরামদায়ক রেশমি কাপড় তৈরি হয়।

২। রেশম কাপড়ের দেশে ও বিদেশে যেমন চাহিদা রয়েছে তেমনি এর দামও বেশি।

৩। রেশম কাপড় বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।

৪। জাতীয় আয় বৃদ্ধিসহ গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৫। রেশম বস্ত্র কোমল ও নমনীয়। এই বস্ত্রে শতকরা ১১ ভাগ আর্দ্রতা বিদ্যমান থাকে। ফলে শীত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত সব ঋতুতেই এ কাপড় পরিধান করা আরামদায়ক হয়।

৬। অল্প মূলধন ও কম জায়গা কাজে লাগিয়ে রেশম চাষ করে অধিক অর্থ উপার্জন করা যায়। এত কম মূলধন ও জায়গা দিয়ে অন্য কোন ফসল চাষ বা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড করা সম্ভব হয় না।

৭। আত্মকর্মসংস্থান তথা বেকারত্ব দূরীকরণের একটি সহজ উপায়। রেশম চাষ করলে পরিবারের বেকার সব লোকের কর্মসংস্থান হয়। এতে পরিবার তথা সমাজের ওপর একটা পজিটিভ প্রভাব পড়ে।

৮। রেশম চাষে ঝঁুকি কম। অর্থাৎ প্রাকৃতিক দূর্যোগ, দাম কম হওয়া বা অন্য কোনো কারণে আর্থিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

৯। অধিক কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না বিধায় যে কেউ রেশম চাষ করে রেশম সুতা উৎপাদন করতে পারে।

১০। রেশম চাষে রেশম সুতার উৎপাদন খরচ কম, কিন্তু লাভ বেশি হয়।

১১। রেশম গুটি সিদ্ধ করে সুতা বা তন্তু ছাড়িয়ে নেয়ার পর মৃত পিউপা বা মুককীট হাঁস—মুরগি ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

১২। রেশম গুটি থেকে সুতা আহরণের পর উচ্ছিষ্ট ছোবড়া থেকে সার্টিন তৈরি করা যায়। এছাড়াও কোর্সি কাটা দ্বারা বিশেষ বুনন প্রক্রিয়ায় গুটি থেকে কাপড় তৈরি করা হয়। বয়নকালের বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার করে কার্পেট তৈরি করা যায়।

১৩। রেশম চাষে একই জমির তুঁত গাছ থেকে বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময় ৪—৫ বার তুঁত পাতা (তুঁত ফসল) পাওয়া যায় এবং তুঁত গাছ ২০—২৪ বছর বাঁচে বলে এক নাগাড়ে রেশম চাষ করে অনেক অর্থ উপার্জন করা যায়।

১৪। বাড়ির চারিদিকে, পুকুর পাড়ে, রাস্তা ও রেললাইনের পাশে এবং অনাবাদী ও পতিত জমিতে তুঁত গাছ আবাদ করে রেশম’ চাষ করা যায়। এতে ফসলী জমি নষ্ট হয় না।

১৫। তুঁত গাছ একবার লাগালে ২০—২৪ বছর বাঁচে বলে রেশম’ চাষে এর উৎপাদন খরচ কম হয়।

১৬। রেশম চাষের জন্য তুঁত গাছ আবাদে অধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়। এক হিসেবে দেখা গেছে যে, রেশম’ চাষের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে তুঁত বৃক্ষ আবাদ করলে বছরে ১২—১৩ জন লোকের কর্মসংস্থান হয় অথচ অন্য ফসলে বছরে ৪—৫ জন লোক হলেই চলে।

১৭। মরা তুঁত গাছ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তুঁত গাছের অতিরিক্ত পাতা গবাদি—পশুকেও খাওয়ানো যায়।

১৮। রেশম কীট থেকে আহরিত তেল সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও রেশম সুতা অপারেশনের পর সেলাই কাজে ব্যবহার করা হয়।

 

 

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ – পাঠটি বাউবির “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়র “বীজ উৎপাদন” অধ্যয়ের এর ইউনিট-৪ ,পাঠ-৪.৩। বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ বীজ শুকানো, পরিচারকরণ, বিভিন্ন আকা রে শ্রেণীবিন্যাসকরণ এবং ওষুধ প্রয়োগ করে শোধন ইত্যাদিকার্যাদির মাধ্যমে বীজকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করার পর বস্তাবন্দি করে বাজারজাতকরণ ও বিতরণ করা হয়। বীজ জমিতে পূনরায় বপন করার পূর্বে উক্ত কার্যাদি সম্পন্ন করতে হয়। বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়া কত নিপুণ ও কার্যকরভাবে করা হলো তার উপর নির্ভর করে বীজ বাজারজাতকরণ।

 

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ

 

প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি:

সদ্য মাড়াইকৃত বীজের মধ্যে খড়—কুটা, ভাংগা দানা, অন্য জাতের বীজ, আগাছা বীজ এবং পোকামাকড় থাকতে পারে। এছাড়াও বীজের মধ্যে পানি থাকে। বীজের পানির পরিমাণ ১২% বেশি হলে বীজ পোকা—মাকড় ও ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে। বীজের সাথে থেকে যাওয়া খড়—কুটা আবর্জনা, পোকামাকড় ও রোগ—জীবাণুর আবাসের ব্যবস্থা করে। এসব মিলিয়ে বীজের তাপ বেড়ে যায় এবং এভাবে কিছুদিন থাকলে বীজ জীবনশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। বীজের ভিতর থেকে খড়কুটা, আবর্জনা, অন্য বীজ, পোকামাকড় ইত্যাদি পরিষ্কার করে বেছে ফেলে বীজকে উত্তমরূপে শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে বীজ ভাল থাকবে।

ধান ও গমবীজের ক্ষেত্রে ১২% এবং অন্যান্য বীজের ক্ষেত্রে ১০% জলীয় ভাগের নিচে বীজ সংরক্ষণ করা উচিত। পরিষ্কার করা বীজ মাড়াই করার সাথে সাথে কুলা দিয়ে ঝেড়ে খড়—কুটা, ছোট দানা ইত্যাদি আলাদা করা হয়। তারপর চালুনি দিয়ে চেলে ছোট দানা, আগাছা ইত্যাদি চেলে ফেলে দেয়া হয়। প্রয়োজন হলে হাত দিয়ে বেছে বড় বড় খড়—কুটা বেছে ফেলে দেয়া হয়। বীজের মধ্যে যদি দাগ, ফ্যাকাশে রঙ বা কালচে রঙ থাকে তবে সেগুলোকেও বেছে ফেলা উচিত। বীজ পরিষ্কার করা এবং গ্রেডিং করার জন্য ইঞ্জিনচালিত বা হস্তচালিত যন্ত্র পাওয়া যায়।

বীজের আর্দ্রতা :

বীজের মধ্যে প্রধানত শুকনো পদার্থ ও পানি থাকে। যদি বাতাস শুষ্ক হয় তাহলে বীজ থেকে পানি বাতাসে চলে আসে। আবার বীজ শুকনা হলে বাতাস থেকে পানি বীজে ঢুকে পড়ে। বাতাস ও বীজ একই মাত্রায় শুকনা হলে বাতাস থেকে বীজে বা বীজ থেকে বাতাসে পানি চলাচল করে না। অন্যদিকে, বীজ ভেজা হলে পোকা মাকড় দিয়ে আক্রান্ত হয়, ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে এবং বীজের তাপ বেড়ে গিয়ে বীজ মরে যায়। বীজ ভেজা হলে বীজকে উত্তমরূপে শুকাতে হবে। শুকনা বীজ এমন পাত্রে রাখতে হবে যাতে বাতাসের সংস্পর্শে আসতে না পারে।

শুকানো রোদে পলিথিন সিট, মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে অথবা পাকা মেঝেতে বীজ শুকানো যেতে পারে। বীজ কখনোও মাটির উপর শুকাতে দেয়া উচিত নয়। খুব সকালে এবং পড়ন্ত বিকালে বীজ শুকানো উচিত নয়। সাধারণত সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত বীজ শুকানো ভাল। বীজ উত্তমরূপে শুকিয়ে ঠান্ডা করে গুদামজাত করতে হবে। বীজ শুকানো কি না তা দাঁত দিয়ে চেপে দেখতে হবে। কটকট শব্দ হলে সাধারণত ধারণা করা যায় যে, বীজ শুকিয়েছে। তবে সব থেকে ভালো উপায় আর্দ্রতামাপক যন্ত্র দিয়ে বীজের আর্দ্রতা মাপা হলো উত্তম পন্থা।

বীজ সংরক্ষণ:

শুকনো বীজ টিনের পাত্রে বা ড্রামে রাখলে ভাল থাকে। এছাড়া মোটা পলিথিন ব্যাগে বীজ রাখলেও বীজ ভালো থাকে। অন্যান্য পাত্র যেমন: মাটির পাত্র, বাঁশের ডোল ইত্যাদি বীজ সংরক্ষণের জন্য ভাল নয়, কারণ এগুলো বায়ু নিরোধী নয়। মোট কথা যে পাত্রে বীজ রাখা হবে তা অবশ্যই বায়ু নিরোধক হতে হবে।

 

বীজ সংরক্ষণকালীন পরিচর্যা:

বায়ু নিরোধ পাত্রে রক্ষিত বীজ মাঝে মাঝে খুলে দেখতে হবে যে পোকার আক্রমণ হয়েছে কিনা এবং বীজের মধ্যে হাত দিয়ে দেখতে হবে গরম লাগে কিনা। যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে পূর্বে বর্ণিত পদ্ধতিতে বীজ শুকাতে হবে। যদি পোকা থাকে তাহলে বীজ চেলে পোকামুক্ত করতে হবে। যদি এভাবে পোকামুক্ত না হয় তবে বীজের সঙ্গে ঔষধ মিশিয়ে পোকা মেরে ফেলে বীজ ঠান্ডা করে পুনরায় গুদামজাত করতে হবে। ফসফিন ঔষধ মিশিয়েও পোকা মারা যায়, তবে ঔষধ মিশ্রিত বীজ কোন ক্রমেই খাওয়া যাবে না।

 

বীজ এর প্যাকিং:

উপরে বর্ণিত পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করে সংরক্ষিত বীজ বিক্রয়ের জন্য ছোট ছোট প্যাকেট ভরে প্যাকেট এর গায়ে বীজের নাম, জাত, গুণগত মান ইত্যাদি লিখে প্রয়োজন মোতাবেক বাজারে সরবরাহ করা যেতে পারে। নিজে ব্যবহারের জন্য বীজ প্যাকিং করার প্রয়োজন নেই।

 

বীজ সংরক্ষণ:

অল্প সময়ের জন্য বস্তায় বীজ সংরক্ষনই উপযুক্ত পদ্ধতি। তবে বীজের বস্তা অবশ্যই পরিষ্কার, শুষ্ক এবং পোকামাকড় মুক্ত হতে হবে। বীজ ভর্তি প্রতিটি বস্তা যথাযথভাবে চিহ্নিত হতে হবে (যেমন: বীজের নাম, জাতের নাম, উৎপাদনের উৎস) ইত্যাদি। বস্তাগুলো সরাসরি মেঝের উপর না রেখে কাঠের মাচার উপর রাখা উচিত। গাদা করে গাদার উচ্চতা

দানা শস্য বীজের বেলায় ৩—৪ মিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়। বীজের বস্তা খুব সাবধানের নাড়াচাড়া করা উচিত যাতে কোন যান্ত্রিক ক্ষতের (গবপযধহরপধষ উধসধমব) সৃষ্টি না হয়। বীজের বস্তার উপর হাঁটা বা বীজের বস্তার উপর বসে থাকা মোটেও উচিত নয়। সাময়িক সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত গুদাম অবশ্যই পরিচ্ছন্ন, শুষ্ক, শীতল হতে হবে এবং ম্যালথিয়ন দ্বারা স্প্রে করে নিতে হবে।

পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে ফিউমিগেট করে নিতে পারলে ভাল হয়। ফসটকসিন প্যালেটস ফিউমিগেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আর্দ্রতা প্রতিরোধক যে কোন পাত্র যেমন: ধাতব টিন, ড্রাম ইত্যাদি বীজ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা অবশ্যই নির্ধারিত মাত্রায় থাকতে হবে এবং পাত্রটি বায়ুরোধক হতে হবে।

 

 

বীজ সংরক্ষণের অর্থ জীবনের সংরক্ষণ। অনুপযুক্ত অবস্থায় সংরক্ষণের ফলে বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটে থাকে। এমনকি বীজের জীবন অবসানও ঘটাতে পারে। নির্দিষ্ট সংরক্ষণ কালের পর বীজের তেজ ও মান নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহের পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে।

১। সংগ্রহকালে বীজের তেজ ও মান।

২। বীজের জাত।

৩। সংরক্ষণাগারে পারিপাশ্বিক অবস্থা বিশেষ করে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা।

৪। বীজের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার হার।

 

বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি:

বীজ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। সংরক্ষণকালে বীজের পারিপাশ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে বর্ণিত চার পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

১। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই খোলা অবস্থায় বীজ সংরক্ষণ:

এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণের জন্য ডোল, বস্তা, গোলা, টিন কিংবা মাটির পাত্র, কাঁচের বোতল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শুষ্ক ও ঠান্ডা মৌসূমে বীজ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। কিন্তু উষ্ণ ও আর্দ্র মৌসুমে অধিকাংশ সবজি বীজের জন্য এ সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করতে হলে পোকা দমন করার জন্য ফিউমিগেশন করা অথবা কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে সাধারণত সবজি বীজ এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। বীজকে রোদে শুকিয়ে উপরোল্লিখিত যেকোন পাত্রে রেখে দেয়া হয়।

এ পদ্ধতিতে বীজের জলীয় ভাগ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় না। কুমড়া জাতীয় সবজি, ডাটা, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, টমেটো ইত্যাদি বীজ এ পদ্ধতিতে অন্তত: ১ (এক) বৎসর সংরক্ষণ করা যায়।

অল্প পরিমাণ গম বীজ তেলের ড্রাম কিংবা কেরোসিন বা বিস্কুটের টিনে সংরক্ষণ করা যায়। তবে নিশ্চিত হতে হবে যে, পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার, পাত্রের গায়ে কোন প্রকার ছিদ্র নেই এবং পাত্রের মুখ বন্ধ করে দিলে ভিতরে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে অথাৎ পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে বায়ুরোধক হতে হবে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে অধিক পরিমাণ বীজ সংরক্ষণ করতে হলে কীটপতঙ্গমুক্ত পরিষ্কার ও শুকনা চটের বস্তায় এবং বীজ সংরক্ষণের উপযুক্ত গুদামে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

প্রতি তিন দিন পর হিমাগারের দরজা খুলে খুব সকালে মুক্তবাতাস দিতে হবে। সংরক্ষণ কালে অন্ততঃপক্ষে দু’বার বস্তা উল্টিয়ে দিলে বীজ ভালো থাকে এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে অঙ্কুরিত হয় না। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রনবিহীন হিমাগারে কোনক্রমেই সবজি বীজ খোলা অবস্থায় রাখা উচিত নয়। তবে বায়ুরোধক পাত্রে বীজ রেখে তা অনায়াসে এ জাতীয় হিমাগারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

 

২। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পন্ন হিমাগারে বীজ সংরক্ষণ:

এ ধরনের হিমাগারকে ডি—হিউমিডিফাইড কোল্ড স্টোরেজ বলে। উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ সংরক্ষনের জন্য এ হিমাগার অত্যন্ত
উপযোগী। এ হিমাগারের তাপমাত্রা সাধারণত ১০ সে: ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৫০% এর উপর রাখা হয় না। এ অবস্থায় রাখা বীজ ৩—৮ বৎসর পর্যন্ত সজীব ও সতেজ থাকে অবশ্য এই ধরনের হিমাগার স্থাপন ও পরিকল্পনা ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে বীজ গুদামের অভ্যন্তরে বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

 

৩। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ:

এ পদ্ধতিতে শুকনা বীজকে বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। আর্দ্র মৌসূমে বীজ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষনের জন্য বায়ুরোধক টিন, এলুমিনিয়াম, কাঁচ কিংবা প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও মোটা পলিথিনের ব্যাগ এলুমিনিয়াম ফয়েল সংযুক্ত কাগজের ব্যাগ এবং বার্ণিশ করা বা বিটুমিনের প্রলেপ দেয়া মাটির পাত্র ও ব্যবহার করা চলে। তবে পাত্রের মুখ এমনভাবে বন্ধ করে দিতে হবে যাতে ভিতর দিয়ে কোন বাতাস চলাফেরা না করে। অল্প পরিমাণ বীজ হলে তা ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড কিংবা সিলিকাজেল সমেত ডেসিকেটর বা বীজ জারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

 

আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণবিহীন হিমাগারে বীজ সংরক্ষণ:

অধিকাংশ হিমাগারে সাধারণতত: ৮০% এর উপর আর্দ্রতা রাখা হয়। এসব হিমাগার আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি উচ্চ জলীয়ভাগ সম্পন্ন কৃষিজাত দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বীজ আলু হিমাগারে নেয়ারপূর্বে ২৪—২৮ ঘন্টা কাল ১৬—১৮০ সে. তাপমাত্রায় প্রিকুলিং (চৎব—পড়ড়ষরহম) করতে হয়। অতঃপর বস্তা হিমকক্ষে তাকের উপর খাড়াভাবে রেখে আস্তে আে¯ Í তাপমাত্রা কমিয়ে ৪ ০ সে. এ নামিয়ে আনতে হয়। হিমাগারের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০% বা তার বেশি হওয়া দরকার।

সারাংশ :

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বাজারজাত ও ভবিষ্যতের ব্যবহারে উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করা হয়। বীজের প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে হবে। অনুপযুক্ত অবস্থায় বীজ সংরক্ষণ করা যাবে না। এতে বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটে।

 

 

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মৎস্য, গবাদিপশু ও পোলট্রি

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মৎস্য – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “গবাদিপশু ও পোলট্রি” বিষয়ের, ১.৩ নং পাঠ।

 

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মৎস্য, গবাদিপশু ও পোলট্রি

 

মৎস্য :

মৎস্য উৎপাদন কৃষি ব্যবস্থার একটি গুরত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এ উৎপাদন ব্যবস্থার ভৌত পরিবেশ হচ্ছে নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, বাঁওর, পুকুর, ডোবা, দীঘি, হ্রদ, নদ-নদী এবং সমুদ্র ইত্যাদি। এছাড়াও বর্তমানে পতিত জমি ও ফসলের জমি খনন করে এবং ঘের তৈরী করেও মাছের চাষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ফসলের পরেই মাছের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ৬০ ভাগ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করে মাছ।

 

মৎস্য প্রজাতি ও এর চাষ (Fish species and cultivation):

মাহ শীতল রক্ত বিশিষ্ট জলজ মেরুদন্ডী প্রাণী। এদের দেহে জোড় বক্ষ শ্রেণি পাখনা থাকে। প্রতিটি পাখনার মাঝে কাঁটা থাকে। এরা ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়। মৎস্য বলতে সকল জলজ প্রাণী যেমন-মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, ডলফিন ইত্যাদিকে বোঝায়। মাছের প্রজাতির সংখ্যা ২০,০০০ এর মত। বাংলাদেশে স্বাদু ও লোনা পানিতে মাছের প্রজাতির সংখ্যা যথাক্রমে ২৯৬ ও ৫১১ (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)।

 

মৎস সম্পদের অবকাঠামো:

বাংলাদেশে মৎস্য হ্যাচারীর সংখ্যা ৯০২টি। এর মধ্যে সরকারি ৮৯টি এবং বেসরকারি ৮১৩টি। গলদা হ্যাচারি ৩৬টি (সরকারি ১৭টি, বেসরকারি ১৯টি) এবং বাগদা হ্যাচারি ৪৯টি (বেসরকারি)। বাংলাদেশে মৎস্য। চিংড়ি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৬টি, মৎস্য প্রশিক্ষণ একাডেমি ১টি, মৎস্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট ৪টি, চিংড়ি প্রদর্শনী খামার ২টি। মৎস্য হ্যাচারি/মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার ১৩৬টি। চিংড়ি আহরণ ও সেবা কেন্দ্র ২০টি। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) ৯টি এবং মৎস্য গবেষণার জন্য উপকেন্দ্র ১০টি।

 

মাছ উৎপাদনের গুরুত্ব:

বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনের জন্য খুবই অনুকুল এবং পানি সম্পদে সমৃদ্ধ। ১৯৮০ সালে প্রথম বাংলাদেশে বিদেশী মৎস্য প্রজাতির চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়। এ সময় থেকে পতিত জমি, ধান ক্ষেত, ডোবা, নালা ও হাজামজা পুকুরকে মাছ চাষের উপযোগী করে তোলা হয়। বিভিন্ন ধরনের বিদেশী মৎস্য প্রজাতি যেমন কার্প, সিলভার কার্প, পাঙ্গাশ, মিরর কার্প, থাই সরপঁুটি, তেলাপিয়া ইত্যাদি বাংলাদেশে ব্যপক হারে চাষ হয়। এতে মাছের বাজারমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে এবং টাটকা মাছ বাজারে পাওয়া যায়। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক সফলতা লাভ করেছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন ৪র্থ স্থান দখল করেছে। মানুষের আমিষের ঘাটতি কমে আসছে এবং মাথাপিছু মাছ খাবার পরিমান বেড়ে গেছে। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২০১৫—১৬ অর্থবছরে ৩.৬৫%।

 

 

মাছ উৎপাদনে পারিবারিক ও জাতীয় উন্নয়নে ভুমিকা :

১। মাছ বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস।
২। মাছ উৎপাদন, পরিচর্যা, বাজারজাতকরণ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপনন ইত্যাদি বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে।
৩। মাছের উপজাত থেকে প্রস্তুুতকৃত ফিস মিল, জৈব সার ও পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৪। ফসল—গাভী, হাঁস, মুরগী ও মাছের সমন্বিত চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
৫। মাছের তেল, সাবান, ঔষধ, গ্লিসারিন, বার্নিশ প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহার হয়।
৬। মাছের কাঁটা, দাঁত, লেজ ইত্যাদি থেকে সৌখিন দ্রব্য প্রস্তুুত করা হয়।
৭। বাংলাদেশ হিমায়িত মাছ, চিংড়ি, শুটকি, লবণজাত মাছ এবং অন্যান্য মৎস্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
৮। মৎস্যজাত শিল্প কারখানা যেমন বরফ তৈরী, জাল বুনন ও মেরামত, মাছ ধরার অন্যান্য উপকরণ তৈরি শিল্প গড়ে উঠেছে।

 

মাছের প্রতিবেশ :

মাছের প্রতিবেশ দু’ধরনের:

১। আভ্যন্তরীন জলাশয় ২। উন্মুক্ত জলাশয়

১। আভ্যন্তরীন জলাশয়:

দেশের স্থুলভাগে যে সমস্ত জলাশয় রয়েছে তাই আভ্যন্তরীণ জলাশয়। আভ্যন্তরীন জলাশয়ের প্রকারভেদ:

 

১. মুক্ত জলাশয়:

নদী, সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, বিল, হাওর ইত্যাদি। এই মুক্ত জলাশয়ের জমির পরিমাণ প্রায় ৩৯১৬৮২৮ হেক্টর ( কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)।

 

২. বদ্ধ জলাশয়:

পুকুর, ডোবা ও দীঘি। মোট আয়তন ৭৮২৫৫৯ হেক্টর।

 

৩. বাঁওর:

নদীর প্রবাহ বাধা প্রাপ্তির জন্য নদীর কিছু অংশ বদ্ধ জলাশয়ের সৃষ্টি করে, একেই বাঁওর বলে। এদেশে বিভিন্ন আকারের প্রায় ৮০ টি বাঁওর আছে। কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও সিলেট জুড়ে এই বাঁওরগুলোর অবস্থান এবং আনুমানিক মোট আয়তন ৫.৪৮৮ হেক্টর।

 

৪. চিংড়ির ঘের প্রতিবেশ:

জোয়ারের পানি আটকিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা যেমন খুলনা, বাগেরহাট সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামে বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের খামারগুলো অবস্থিত। অধিকাংশ ঘের দেশীয় পদ্ধতিতে করা হয়। ঘের চাষের মোট আয়তন ১৭৫২৭৪ হেক্টরের মত। গলদার ফলন ৫০০—৬০০ কেজি এবং বাগদার ফলন ২৫০—৩০০ কেজি হেক্টরে। ( কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)

 

৫. লেক বা হ্রদ:

কৃত্রিম বা স্বাভাবিক বৃহৎ আকারের বদ্ধ জলরাশিকে লেক বা হ্রদ বলে। যেমন ফয়েজ লেক, কাপ্তাই লেক।

 

 

 

উন্মুক্ত জলাশয় (আয়তন ৩৯১৬৮২৮ হেক্টর)।

 

গবাদি পশু:

বাংলাদেশের কৃষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল গবাদি পশু। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বলিত পশু গৃহে স্থায়ীভাবে লালন পালন করে আসছে, এদেরকে গবাদি পশু বলা হয়। বাংলাদেশে গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, মহিষ,
ছাগল, ভেড়া প্রধান।

গবাদি পশু হতে প্রাপ্ত উপজাত দ্রব্যসমূহ :

গবাদি পশু জবাইয়ের পর বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল খাদ্য অনুপযোগী দ্রব্য জমা হয় সেগুলোকে গবাদিপশুর উপজাত দ্রব্য বলা হয়। এগুলো হল বর্জ্য মাংস, হাঁড়, রক্ত, নাড়িভূড়ি, মলমূত্র ইত্যাদি। এ উপজাতদ্রব্যগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে বিভিন্ন কাজে লাগানো যেতে পারে। আবার এগুলো যথাযথ সংরক্ষণের পরিবেশ ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায়। উপজাতগুলো দিয়ে উৎকৃষ্ট জৈব সার ও মাছের খাদ্য তৈরি করা যায়। হাড় ও শিং বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্য তৈরিতে কুটির শিল্পে ব্যবহৃত হয়।

 

গবাদি পশুর গুরুত্ব :

আমাদের জীবনে গবাদি পশুর গুরুত্ব অনেক। নিম্নে গবাদি পশুর নানাবিধ গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:

১. জমি চাষ করতে গরু—মহিষ ব্যবহৃত হয়।

২. শস্য মাড়াই করতে গরু মহিষ ব্যবহার করা হয়।

৩. পণ্য পরিবহনের জন্য গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়।

৪. তেলের ঘানি, আখ মাড়াই মেশিন ইত্যাদি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় শক্তি গরু মহিষের মাধ্যমে পাওয়া যায়।

৫. প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হল গবাদি পশুর মাংস ও দুধ।

৬. গবাদি পশু এবং তাদের মাংস ক্রয়—বিক্রয় করে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।

৭. কোন কোন গবাদি পশু যেমন ছাগল ও ভেড়া পালনে মূলধন কম লাগে।

৮. দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রি করে প্রচুর আয় করা হয়।

৯. গবাদিপশুর চর্বি সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

১০. জ্বালানি হিসেবে গোবর ব্যবহৃত হয়।

১১. গবাদিপশুর মলমূত্র (গোবর) উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহৃত হয়।

১২. গোবর থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানি ও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা যায়।

১৩. গবাদিপশু বিক্রয় করে এককালীন অনেক অর্থ পাওয়া যায়।

১৪. ভেড়া—ছাগলের পশম দ্বারা দামী শীতবস্ত্র তৈরি করা হয়।

১৫. গবাদিপশুর চামড়া, পশম, হাড় ইত্যাদি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়।

 

পোলট্রি:

বাংলাদেশে কৃষির একটি অন্যতম ক্ষেত্র হল পোল্টি্র বা গৃহপালিত পাখি। যে সকল জীবের পাখনা আছে, যারা উড়তে পারে এবং ডিম দেয় তাদেরকে পাখি বলা হয়। আবার অর্থনৈতিক প্রয়োজনে মানুষ যেসব পাখি গৃহে পালন করে তাদের গৃহপালিত পাখি বলে্। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গৃহপালিত পাখি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বাংলাদেশে গৃহপালিত পাখি যেমন হাঁস—মুরগী, কবুতর উল্লেখযোগ্য।

সাধারণত গ্রামের প্রতিটি পরিবারেই গৃহপালিত পাখি পালন করা হয়। এগুলো একদিকে যেমন পরিবারের ডিম ও মাংসের চাহিদা মেটায় তেমনি বাড়তি অংশ বিক্রয় করে অর্থনৈতিভাবে লাভবান হওয়া যায়। গ্রামের পরিবারে সাধারণত দেশীয় জাতের পোল্টি্র পালন করা হয়। তবে বর্তমানে অনেকেই পোল্টি্র শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এজন্য নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং বিদেশ থেকেও উন্নত জাত আমদানি করা হয়েছে। যেমন ’জাপানি কোয়েল’ নামক এক প্রকারের পাখি বাংলাদেশে পালন করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকারি গবেষণা কেন্দ্রে প্রাণীবিজ্ঞানীরা ’শুভ্রা’ নামে একটি ডিম পাড়া মুরগীর জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ জাতের মুরগী বছরে ২৮০—২৯৫ টি ডিম দেয়।

 

পোল্টি্র ও পোল্টি্র বিজ্ঞানের ধারণা:

অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বলিত যে সব পাখি মানুষের তত্ত্বাবধানে থেকে মুক্তভাবে বংশবৃদ্ধি করে এবং যাদেরকে পারিবারিক বা খামার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিকভাবে পালন করা হয় তাদেরকে গৃহপালিত পাখি বা পোল্টি্র বলে। যেমন হাঁস, মুরগী, কোয়েল, কবুতর ইত্যাদি।
বিজ্ঞানের যে শাখায় গৃহপালিত পাখি নিয়ে গবেষণা করা হয় বিশেষ করে পাখির খাদ্য, প্রজনন, বিভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে তাদের অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে আালোচনা করা হয় তাকে পোল্টি বিজ্ঞান বলে।


পোল্টি্র শিল্পের ধারনা:

বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নত ব্যবস্থাপনায় উন্নত জাতের হাঁস মুরগী ও কোয়েল পালন করা হচ্ছে। এ কৃষি ক্ষেত্রের গুরুত্ব বিবেচনা করে এটিকে বাণিজ্যিকভাবে একটি শিল্পের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এদেশের অনেক বেকার যুবকযুবতী তাদের শ্রম দিয়ে নতুন নতুন পোল্টি্র শিল্প গড়ে তুলছে এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে দেড় লক্ষের কিছু কম পোল্টি খামার চালু আছে। ২০০৯—১০ অর্থ বছরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের পোল্টি্র খামারের সংখ্যা ১৪৮৯৩৩ এবং এই খাত থেকে নির্বাহকারী মানুষের সংখ্যা হল ২২৩৩৯৯৫ জন।

 

পোল্টি্রর (মুরগী) শ্রেণীবিন্যাস:

জাত, উপজাত ও স্ট্রেইন মিলিয়ে প্রায় ২০০ প্রকারের মুরগী আছে। এদেরকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

১। উৎপত্তিভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ

২। উৎপাদনভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ

১। উৎপত্তি স্থানের উপর ভিত্তি করে মুরগীর জাত ৪ প্রকার যথা:

(ক) আমেরিকান শ্রেণীর—যেমন রোড আইল্যান্ড রেড, নিউ হ্যাম্পাশায়ার, প্লাইমাউথ রক ইত্যাদি।
(খ) ভূ—মধ্যসাগরীয় শ্রেণী: যেমন, লেগহর্ণ, মিনর্কা, অ্যানকোনা ইত্যাদি।
(গ) ইংলিশ শ্রেণী: যেমন, অস্ট্রারলর্প, কার্ণিশ, সাসেক্স ইত্যাদি।
(ঘ) এশিয়া শ্রেণী: যেমন: ব্রাহমা, কোচিন, আসিল ইত্যাদি।

 

২। উৎপাদনভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ

ডিম ও মাংস উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে মুরগীর বিশুদ্ধজাত গুলোকে ৩ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।

(ক) ডিম উৎপাদনকারী জাত:

এ জাতের মুরগী আকারে ছোট ও ওজনে তুলনামূলকভাবে হালকা হয়ে থাকে। তবে এরা বেশ বড় আকারের ডিম দেয়। বছরে ২৫০—৩০০ টি বা তার চেয়ে বেশি ডিম ও দিতে পারে। যেমন, লেগহর্ণ, মিনর্কা, স্টারক্রস সাদা, ইসাব্রাউন ইত্যাদি।

(খ) মাংস উৎপাদনকারী জাত:

এ মুরগী আকারে বেশ বড় ও ওজনে খুব ভারী। এদের শারীরিক বৃদ্ধি খুব বেশি হয় তবে এরা ডিম কম দেয়। এরা ৬—৮ সপ্তাহে ১.৫—২.০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে এবং পূর্ণবয়সে ৪ কেজি পর্যন্তও হয়। এদের মাংস অত্যন্ত নরম ও সুস্বাদু হয়ে থাকে। এদের খাদ্যকে মাংসতে রুপান্তরিত করার ক্ষমতা (১.৮:১) অর্থাৎ এরা গড়ে ১.৮ কেজি খাদ্য গ্রহন করে ১ কেজি মাংস উৎপাদন করতে সক্ষম।

(গ) ডিম ও মাংস উৎপাদনকারী বা দ্বৈত জাত:

এ জাতের মুরগীর আকার মাঝারি ও ওজনে মোটামুটি ভারী, এরা মাঝারি পরিমান ডিম ও মাংস দেয়। উদাহরণ: রোড আইল্যান্ড রেড, নিউ হ্যাম্পশায়ার, অস্ট্রালপ ইত্যাদি।

 

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
পোল্টি্রর অর্থনৈতিক গুরুত্ব :

মানুষের খাদ্য সরবরাহ, পুষ্টির চাহিদাপুরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি নানাবিধ ক্ষেত্রে পোল্টির গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে পোল্টি্রর অর্থনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো।

১। পোল্টি্রর মাংস ও ডিমের চাহিদা থাকায় এগুলো বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করা যায়।

২। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অল্প সময়ে অনেক মুরগী পালনের মাধ্যমে বেশী অর্থ উপার্জন করা যায়।

৩। হাঁস মুরগীর খামার করে অনেক বেকার জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়।

৪। পোল্টি্রর শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্প যেমন: পোল্টি্রর খাদ্য ও ঔষধ ইত্যাদি শিল্প গড়ে ওঠে এবং অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

৫। পোল্টি্র পালন করে পরিবারে বাড়তি আয় করা যায়।

৬। হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা ব্যায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

৭। পোল্টি্রর মাংস ও ডিম মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে অনেক ভূমিকা রাখে।

৮। পোল্টি্রর বিষ্ঠা ও লিটার থেকে উৎকৃষ্ট জৈব সার তৈরি করা হয়।

৯। পোল্টি্রর উপজাত দ্রব্য যেমন রক্ত, নাড়িভুড়ি বিশেষ ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াজাত করে পাখির ও মাছের খাদ্য তৈরী করা যায়।

১০। বিনোদন: অনেক পাখিই মানুষের বিনোদনের খোরাক যোগায়। যেমন: মোরগের লড়াই, কবুতরের ডাক ইত্যাদি।

 

সারাংশ :

মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট জলজ মেরুদন্ডী প্রাণী। বাংলাদেশ মৎস্য প্রতিবেশ ও মৎস্য উৎপাদনের জন্য খুবই অনুকুলে এবং মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ৪র্থ স্থান দখল করেছে। যেসব পশু গৃহে পালন করা হয় তাদেরকে গবাদি পশু বলা হয়। গবাদি পশুর মাংস, দুধ খাদ্য ও আমিষের উৎস হিসেবে এবং গবাদি পশু হতে প্রাপ্ত উপজাত বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পোল্টি্র শিল্পের ভূমিকা ব্যপক। সাধারণত গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই গৃহপালিত পাখি ও পোল্টি্র পালন করা হয় এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর ভূমিকা অপরিহার্য।

 কৃষি যন্ত্রপাতি

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কৃষি যন্ত্রপাতি। এই আর্টিকেলে আমরা কৃষি যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জানতে পারবো ।

 কৃষি যন্ত্রপাতি

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। গবেষণা করে দেখা গেছে যে, জমিতে শক্তির ব্যবহার বাড়লে উৎপাদন বাড়ে। তাই জমিতে শক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবং বাংলাদেশের কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন ফসলের জন্য লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

বর্তমানে ডিজেল ইঞ্জিনের দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় এবং দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও পাওয়ার টিলার পাওয়া যায় বলে শক্তি-চালিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে একদিকে পাওয়ার টিলারের বহুমুখী ব্যবহার বেড়েছে, অন্যদিকে কৃষকগণ অল্প খরচে শক্তি-চালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারছেন। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে ।

উৎপাদিত শস্য ঠিকমত প্রক্রিয়াজাতকরণ না করলে শস্য সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে এর বড় একটা অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে যা ব্যবহার করে ফসলের পরিমাণগত ও গুণগত মান বাড়ানো যায় ৷

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত অনেকগুলি কৃষি যন্ত্রপাতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত প্রস্তুতকারকগণ উৎপাদন ও বিপণন করছে। ফলে এসব কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এবং যন্ত্রপাতিগুলির চাহিদাও বাড়ছে। বারি কর্তৃক এ যাবৎ যত আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে তার কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো ।

 

 

হাই স্পিড রোটারি টিলার

প্রচলিত পাওয়ার টিলার দিয়ে শুকনা জমি চাষ করতে যেখানে ৫-৬টি চাষের প্রয়োজন হয়, হাই স্পিড রোটারি টিলার দিয়ে সেখানে ১-২টি চাষ যথেষ্ট। হাই স্পিড রোটারি টিলার এসব পাওয়ার টিলার অপেক্ষাও উন্নত মানের শুকনা জমি চাষের যন্ত্র।

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • ১/২টি চাষ দিয়ে স্বল্প সময়ে জমি তৈরি করে জমিতে ফসল আবাদ করা যায় ।
  • যন্ত্রের রোটারি ব্লেড শ্যাফট উচ্চ গতিতে ঘুরে বিধায় জমির ঢেলা খুব ছোট হয় ও মাটি ভাল গুঁড়া বা মিহি হয়।
  • হাই স্পিড রোটারি টিলারে প্রচলিত টিলারের তুলনায় ৫০% সময় ও আর্থিক সাশ্রয় হয়।
  • প্রতি ঘণ্টায় ০.১ হেক্টর (২৪ শতাংশ) জমি চাষ করতে পারে।
  • যন্ত্রটি দিয়ে প্রতি হেক্টর জমি চাষ করতে মাত্র ৩৪০০ টাকা খরচ হয়।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৫০,০০০ টাকা ।

 

 

পাওয়ার টিলার চালিত ইনক্লাইন্ড প্লেট সিডার

সারিতে বীজ বুনলে কম বীজ লাগে, সহজে আগাছা পরিষ্কার করা যায়, গাছ বেশি আলো বাতাস পায় এবং সর্বোপরি উৎপাদন বাড়ে। সারিতে ও নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং গভীরতায় সহজে বীজ বোনার জন্য পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ যন্ত্র দিয়ে চাষ করা জমি ছাড়াও চাষবিহীন অবস্থায় বেলে ও বেলে দোআঁশ মাটিতে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, তৈলবীজ ও ডাল শস্য সারিতে বোনা যায় ।

পাওয়ার টিলার চালিত ইনক্লাইভ প্লেট সিডার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যন্ত্রটি পাওয়ার টিলার চালিত
  • এ যন্ত্র বীজকে নির্দিষ্ট স্থানে ও সঠিক গভীরতায় সুষমভাবে বপন করে।
  • বীজের মান ভাল হলে ভাল অঙ্কুরোদগম এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক চারাগাছ নিশ্চিত করা যায়।
  • এটি ব্যবহার করে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ১০-৪০ শতাংশ বীজ কম লাগে। এবং ফলনও ১০-১৫% বৃদ্ধি পায় ।
  • সারিবদ্ধভাবে বীজ বপনের ফলে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। ফলে আগাছা দমন, কীটনাশক প্রয়োগসহ অন্যান্য আন্তঃপরিচর্যা করার জন্য প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ২৫% সময় ও খরচ কম লাগে।
  • বপন খরচ প্রতি হেক্টরে ৬০ টাকা (প্রতি ঘন্টায় ১৩ টাকা)
  • প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ০.১৮ হেক্টর (৪৫ শতাংশ) জমিতে বীজ বপন করা যায় ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৫০,০০০ টাকা ।

বেড প্লান্টার

আমাদের দেশে আলু, ভুট্টা, মরিচ, সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল বীজ ফারো বা বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করা হয়। বেড পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করলে বাতাস সহজেই গাছের শিকড়ের নিকট যেতে পারে। ফলে গাছ বাতাস থেকে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান গ্রহণ করতে পারে। বেড পদ্ধতিতে নালায় পানি সেচ দিলে সহজেই অল্প সময়ে অনেক জমিতে পানি সেচ দেওয়া যায়। এতে পানির পরিমাণ ও প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় কম লাগে। এই পদ্ধতিতে শুকনা বা রবি মৌসুমে পানি যেমন কম লাগে তেমনি বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে নালা দিয়ে সহজেই পানি বের হয়ে যায়।

 

বারি বেড প্লান্টার

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • বেডে ফসল ফলালে উৎপাদন খরচ কমে, মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও দুষণমুক্ত পরিবেশ পাওয়া যায়।
  • এ যন্ত্রের দ্বারা ১-২টি চাষে বেড তৈরি, সার প্রয়োগ ও বীজ বপনের কাজ একই সঙ্গে করা যায়।
  • বেড প্লান্টার দ্বারা গম, ভুট্টা, আলু, মুগ, তিলসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি বীজ সফলভাবে বপন করা সম্ভব।
  • স্থায়ী বেডেও বীজ বপন করা যায় ।
  • বেডে ফসলের অবশিষ্টাংশ রেখেই বিনা চাষে বীজ বপন করা যায়।
  • স্থায়ী বেডে কেঁচো বাস করে বিধায় জমির উর্বরতা বাড়ে ।
  • স্থায়ী বেডে কয়েক বছর চাষ করলে জমিতে জৈব সারের পরিমাণ বাড়ে।
  • বেডে ফসল করলে ইঁদুরের উৎপাত কমে।
  • বেডে ফসল করলে সেচ খরচ ও সময় ২৫% কমে।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ০.১১ হেক্টর জমিতে বেড তৈরি করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির (মডেল-১) বাজার মূল্য ৪০,০০০ টাকা (পাওয়ার টিলার ছাড়া)।
  • যন্ত্রটির (মডেল-২) বাজার মূল্য ৭০,০০০ টাকা (পাওয়ার টিলার ছাড়া)।

গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্ৰ

নাইট্রোজেন উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম। ধান ক্ষেতে ৬-৭ সেমি কাদা মাটির নিচে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করে সার অপচয় নিয়ন্ত্রণ করে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা যায়। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের সুবিধা থাকা সত্বেও মাঠে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহারে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম হলো হাতে একটি একটি করে গুটি সার প্রয়োগ করা।

ধানের চারা গাছের মাঝে উপুড় হয়ে হাত দিয়ে কাদার নির্দিষ্ট গভীরে সার প্রয়োগ যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনি কষ্টকর। অন্যদিকে নিরস ও কষ্টকর এ কাজের জন্য প্রয়োজন দক্ষ শ্রমিক, যার অভাব দেশের সর্বত্রই। ধান চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের অসুবিধাসমূহের কথা অনুধাবন করে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র দ্বারা ধানের জমিতে ইউরিয়া প্রয়োগ করা হচ্ছে

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যন্ত্রটি দেশীয় কাঁচামাল দ্বারা স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরি করা যায় ।
  • এমএস বার দ্বারা তৈরিকৃত ফ্রেমে মিটারিং ডিভাইস বসানো থাকে ।
  • মিটারিং ডিভাইসের পাত্র ও ডিস্ক প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি ।
  • যন্ত্রের দুই পার্শ্বের দুটি এমএস সিট দ্বারা তৈরি নৌকাকৃতির স্কিড থাকে যা কাদার উপর যন্ত্রকে ভাসিয়ে রাখে।
  • স্কিডের নিচে দুইটি ৬ সেমি দৈর্ঘ্যের ফারো ওপেনার আছে। • প্রতিটি ফারোকে বন্ধ করার জন্য দুটি করে ফারো ক্লোজার আছে।
  • ১.৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি হ্যান্ডেল আছে যা চালকের দৈর্ঘ্যের সাপেক্ষে বিভিন্ন কোণে স্থাপন করা যায়। হ্যান্ডেলে ধাক্কা দিয়ে যন্ত্রটি চলানো হয়।
  • যন্ত্রটি ২-৫ সেমি দাঁড়ানো পানিতে ভাল চলে ।
  • মানুষের সাধারণ হাঁটার গতিতে (১-১.৫ কি.মি./ঘন্টা) যন্ত্রটি চালানো যায় ।
  • যন্ত্রটি সম্মুখ গতিতে ৮০ সেমি প্রস্থ জমিতে সার প্রয়োগ করে ।
  • যন্ত্রটির ওজন ৯ কেজি।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ০.১০ হেক্টর জমিতে সার প্রয়োগ করতে পারে।
  • যন্ত্রটির চালনা খরচ প্রতি হেক্টরে ৭০০ টাকা।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৩,৫০০ টাকা ৷

 

স্বচালিত শস্য কর্তন যন্ত্র

বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকদের ধান ও গম চাষে যে সমস্যাগুলি রয়েছে তার মধ্যে ধান/গম কাটা একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। ধান বা গম কাটার মৌসুমে কৃষককে বেশ কয়েকটি কাজ একসাথে করতে হয়। যেমন- ফসল কাটা, মাড়াই করা, ঝাড়াই করা, শুকানো এবং পরবর্তীকালে ফসলের জন্য জমি তৈরি, বীজতলা তৈরি ইতাদি। কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় এসময় শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এ সমস্যা দূরীকরণে স্বচালিত যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

স্বচালিত ধান ও গম কর্তন যন্ত্র

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যন্ত্রটি দিয়ে ধান ও গম কাটা যায় ।
  • কিছুটা হেলে পড়া ধান বা গমও কাটা যায় ।
  • জমিতে কিছুটা পানি থাকলেও যন্ত্রটি দিয়ে ফসল কাটা যায় (এঁটেল মাটি ছাড়া)।
  • কাটা ধান বা গম ডান পাশে সারিবদ্ধভাবে পড়ে যাতে সহজে আঁটি বাঁধা যায় ।
  • প্রতি ঘণ্টায় জ্বালানি খরচ মাত্র ০.৬ লিটার (ডিজেল)।
  • প্রতি হেক্টর ধান ও গম কাটতে প্রায় ১২০০ টাকা খরচ হয়।
  • একজন লোক সহজেই যন্ত্রটি চালাতে পারে এবং এটি সহজে স্থানান্তর করা যায়।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ০.১৪-০.২০ হেক্টর (৩৫-৫০ শতাংশ) ধান এবং ০.১৮-০.২৪ হেক্টর (৪৫-৬০ শতাংশ) গম কাটতে পারে।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ১,৬০,০০০ টাকা।

শক্তি চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র

বর্তমানে দেশের অনেক এলাকায় ব্যাপকভাবে ভুট্টা চাষ করা হচ্ছে। শক্তি-চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র দিয়ে বেশি পরিমাণ ভুট্টা মাড়াই করা সম্ভব নয়। এ বিবেচনায় অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তি-চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। বর্তমানে এ যন্ত্রটি সারাদেশে ব্যাপকভাবে তৈরি ও ব্যবহার হচ্ছে।

 

শক্তি চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • এ যন্ত্রটির নির্মাণ কৌশল সহজ।
  • যন্ত্রটি পরিচালনা করা খুবই সহজ।
  • এর মেরামত করার প্রয়োজনীয়তা কম ।
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৪ জন লোকের দরকার হয় ।
  • যন্ত্রটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় মাড়াই খরচ খুবই কম ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য (বড়) : ৪৫,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া)।  (ছোট): ৩৫,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া) ।

শক্তি চালিত শস্য মাড়াই যন্ত্র

বাংলাদেশের সব এলাকায় সাধারণত কৃষক ধান কাটার পর হাতে পিটিয়ে বা গরুর সাহায্যে (মলন) মাড়াই করে থাকে। এতে অনেক বেশি শ্রমিক লাগে বলে মাড়াই খরচ বেড়ে যায়। বৃষ্টির সময় সনাতন পদ্ধতিতে মাড়াই করা যায় না বলে প্রচুর ধান ও গম নষ্ট হয় এবং গুণগতমান কমে যায়। ফলে বাজার মূল্য হ্রাস পায়। দেশে ধান ও গমের উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সনাতন পদ্ধতিতে বা পা-চালিত মাড়াই যন্ত্র দিয়ে মাড়াই করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। সে জন্য শক্তি চালিত শস্য মাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

শক্তি চালিত শস্য মাড়াই যন্ত্র দ্বারা গম মাড়াই

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • এ যন্ত্র দিয়ে ধান, গম ও ডাল শস্য মাড়াই করা যায়।
  • এ যন্ত্রটি দিয়ে ৫০-৭০ সেমি দৈর্ঘ্যের, শস্য মাড়াইয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল ফল পাওয়া যায়।
  • কম আর্দ্রতা সম্পন্ন ফসল মাড়াইয়ে ব্যবহার করলে যন্ত্রটির মাড়াই ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • যন্ত্রটি উচ্চ মাত্রায় শ্রম এবং অর্থ সাশ্রয়ী।
  • মাড়াই ক্ষমতা পা-চালিত মাড়াই যন্ত্রের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেশি।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ৯৩০ কেজি ধান ও ৩৪০ কেজি গম মাড়াই করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৪৫,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া)।

 

আলু উত্তোলন যন্ত্ৰ

বাংলাদেশে আলু একটি অর্থকরী ফসল। অধিকাংশ স্থানে কৃষকগণ কোদাল দিয়ে আলু ওঠান। কোন কোন এলাকায় হাত বা বলদ দিয়ে লাঙ্গল টেনে আলু ওঠানো হয়। উভয় পদ্ধতিতেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু মাটির নিচে থেকে যায় যা আবার ওঠানো দরকার হয়। ফলে সময় বেশি লাগে এবং অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয় যা ব্যয়সাপেক্ষ। সময়মতো আলু ওঠাতে না পারলে বৃষ্টিতে প্রচুর আলু নষ্ট হয় যা কৃষকের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। এসব অসুবিধা দূর করার জন্য অল্প সময়ে কম খরচে মাটির নিচ থেকে আলু ওঠানোর জন্য আলু উত্তোলন যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

আলু উত্তোলন যন্ত্র

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অল্প সময়ে, কম খরচে মাটির নিচ থেকে আলু ওঠানো যায়।
  • যন্ত্রটি যে কোন পাওয়ার টিলার দিয়ে চালানো যায় ।
  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে যন্ত্রটি তৈরি করা যায় ।
  • যন্ত্রটি দিয়ে ৫৫-৬০ সেমি দূরত্ব বিশিষ্ট সারির আলু তোলার জন্য ব্যবহার করা যায় ৷
  • যন্ত্রটি মাটির নিচ থেকে ১০০% আলু উঠিয়ে মাটির ওপরে রেখে দেয়।
  • যন্ত্রটি ঘণ্টায় ০.০৭ হেক্টর (১২ শতাংশ) জমির আলু উত্তোলন করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৩০,০০০ টাকা ।

 

শক্তি চালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র (মডেল-১)

বাণিজ্যিকভাবে এবং কৃষক পর্যায়ে বীজ সংরক্ষণ ও বাজারে বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন সাইজে আলু ভাগ করতে হয়। বর্তমানে আলু গ্রেডিং এর কাজটি কোল্ড স্টোরের শ্রমিক ও কৃষকগণ হাতের সাহায্যে বিভিন্ন সাইজে ভাগ করে থাকেন। এর জন্য প্রচুর শ্রমিক লাগে এবং অনেক সময় ব্যয় হয়। সেজন্য গ্রেডিং এর কাজে খরচ পড়ে অনেক বেশি। কম খরচে, অল্প সময়ে আলু বিভিন্ন সাইজে ভাগ করার জন্য দুই ধরনের শক্তিচালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

শক্তি চালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র (মডেল-১)

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লোহার সামগ্রী দিয়ে এ যন্ত্রটি তৈরি করা যায়।
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৩/৪ জন লোকের দরকার হয়।
  • স্বল্প সময়ে ও কম খরচে আলুকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ করা আলু সরাসরি বস্তায় জমা হয়।
  • যন্ত্রটি দুটি লোহার চাকার উপর বসান থাকে যাতে সহজে স্থানান্তর করা যায়।
  • যন্ত্রটি ঘণ্টায় ১.৬ টন আলু বাছাই করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৪০,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া)।

 

শক্তি চালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র (মডেল-২)

 

শক্তি চালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র দ্বারা আলু বাছাইকরণ

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লোহার সামগ্রী দিয়ে এ যন্ত্রটি তৈরি করা যায় ।
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৩ জন লোকের দরকার হয়।
  • স্বল্প সময়ে ও কম খরচে আলুকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
  • ভাগ করা আলু সরাসরি বস্তায় জমা হয় । • যন্ত্রটি চারটি চাকার উপর বসান থাকে যাতে সহজে স্থানান্তর করা যায়।
  • যন্ত্রটি ঘণ্টায় ১.৩ টন আলু বাছাই করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৪০,০০০ টাকা (ইঞ্জিন/মটর ছাড়া)।

 

শক্তি চালিত শস্য ঝাড়াই যন্ত্র

আমাদের দেশের কৃষক শস্য মাড়াই করার পর পরিষ্কার করার জন্য প্রাকৃতিক বাতাসের উপর নির্ভর করেন। পর্যাপ্ত বাতাসের অভাবে অনেক শস্য অপরিষ্কার অবস্থায় স্তূপাকারে রাখার ফলে অপচয় হয়। শস্যের গুণগতমান ও দাম কমে যায়। এ সমস্যা দূরীকরণে শক্তি চালিত শস্য ঝাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

শক্তি চালিত শস্য ঝাড়াই যন্ত্র দ্বারা ধান ঝাড়াই

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • ঘরোয়া পরিবেশে এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ব্যবহার করা যায়। • অল্প সময় ও খরচে ঝাড়াই ও পরিষ্কার করা সম্ভব ।
  • যে কোন মহিলা/পুরুষ যন্ত্রটি সহজে চালাতে পারেন।
  • স্থানীয় কারখানায় এটি সহজে তৈরি করা যায় ।
  • যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ৮০০ কেজি ধান এবং ১০০০ কেজি গম ঝাড়াই করতে পারে ।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ২০,০০০ টাকা ।

 

আম পাড়া যন্ত্র

আম পাড়ার জন্য বাংলাদেশে বাঁশের চটার তৈরি গোলাকৃতি কোটা ব্যবহৃত হয় যার সাথে পাটের/নাইলনের রশির তৈরি জাল লাগানো থাকে। কোটাটি একটি চিকন বাঁশের মাথায় লাগিয়ে ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে বোঁটা থেকে আম আলাদা হয় বলে বোঁটা পচা রোগ হয়। ফলে আমের সংরক্ষণকাল কমে যায় এবং কৃষক আমের মূল্য কম পায়। তাই বোঁটাসহ আম পাড়ার জন্য এ যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। আম রপ্তানিকারক দেশে যন্ত্রের সাহায্যে বোঁটাসহ আম পাড়া হয় বলে সাধারণত রোগ হয় না।

 

আম পাড়া যন্ত্র

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • এ যন্ত্র দিয়ে বোঁটাসহ আম পাড়া যায়।
  • প্রচলিত আম পাড়া কোটার চেয়ে ২০% দ্রুত আম পাড়া যায় ।
  • যন্ত্রটি ঘণ্টায় ২০০-৪০০ কেজি আম পাড়তে পারে।
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৪৫০ টাকা ।

 

আম শোধন যন্ত্র

আম একটি দ্রুত পচনশীল ফল। সংগ্রহ মৌসুমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা উভয়ই বেশি থাকে বলে আম পচা ত্বরান্বিত হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট আমের ২০ থেকে ৩০% সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নষ্ট হয়। প্রধানত বোঁটা পচা ও এ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণে আম নষ্ট হয়। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, জাতের উপর নির্ভর করলে বোঁটা পচা রোগ ও এ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমন করা যায়। এভাবে আম নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতি কাজে লাগানোর জন্য গরম পানিতে আম শোধন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

আম শোধন যন্ত্র

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • ২ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৮টি বৈদ্যুতিক ওয়াটার হিটারের মাধ্যমে পানিকে গরম করা হয়।
  • তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক ব্যবহার করা হয় ।
  • আম ভর্তি প্লাস্টিক ব্রেন্ট বহনের জন্য মটর চালিত কনভেয়ার রোলার ব্যবহার করা হয়।
  • যন্ত্রটি দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে আম শোধন করা যায় ।
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৬ জন লোকের প্রয়োজন হয়।
  • এ যন্ত্র দ্বারা আমকে সুষমভাবে ৫২-৫৫° সে. তাপমাত্রার পানিতে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করা হয় ।
  • গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখা আমের গায়ে লেগে থাকা পচনে সাহায্যকারী জীবাণু মারা যায়।
  • শোধনকৃত আম ৫-৬ দিনের পরিবর্তে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত টাটকা থাকে এবং
  • আমের রং উজ্জ্বল হয়। যন্ত্রটি পরিচালনা করা খুবই সহজ।
  • যন্ত্রটি দিয়ে ঘণ্টায় ১০০০ কেজি আম শোধন করা যায়।
  • উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় প্রতি কেজির শোধন খরচ মাত্র ৫০ পয়সা। যন্ত্রটির বাজার মূল্য ১,৩৫,০০০ টাকা।

হাইব্রিড ড্রায়ার

সূর্যের তাপে বা রোদে শস্য শুকানোর পদ্ধতি অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশে এখনও রোদে শস্য শুকানো বহুল প্রচলিত পদ্ধতি । খোলা রোদে শস্য শুকানো সহজ এবং খরচও অনেক কম। কিন্তু, রোদে শস্য শুকানোর গতি অনেক কম এবং শস্য শুকাতে অনেক জায়গার প্রয়োজন হয়।

সূর্যের আলো কখনও কম থাকে আবার কখনও বেশি হয়। তাছাড়া মেঘলা আবহাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের ও আশঙ্কা থাকে যার ফলে শস্যের গুণগত মান বজায় থাকে না। শস্য শুকানোর সময় ধূলিকণা, পোকামাকড়, পশু-পাখি ও অণুজীবের দ্বারা শস্য আক্রান্ত হয়। শস্য সংগ্রহকালীন সময়ে অনবরত কয়েক দিন বৃষ্টিপাত হলে শস্যের বিরাট অংশ নষ্ট হয়ে যায় এমনকি সমস্ত শস্যও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের কৃষকের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এ হাইব্রিড ড্রায়ার উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি হাইব্রিড ড্রায়ার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • সৌরশক্তি ও বৈদ্যুতিক শক্তির সমন্বয়ে এটি চালনা করা হয়। তাছাড়া রিফ্লেক্টর ব্যবহার করে সৌরশক্তির মাত্রাকে প্রায় ৫০% বৃদ্ধি করা হয় ।
  • বিভিন্ন ধরনের শস্য বীজসহ ফল, শাক-সবজি, ঔষধি গাছ ইত্যাদি এই ড্রায়ারে শুকানো যায়। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা ও ট্রের সেটিং ভিন্ন করা হয়।
  • সূর্যের আলো না থাকলেও বৃষ্টি বা মেঘলা আবহাওয়ায় এটি ব্যবহার করা যায় ।
  • স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রায়ারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা আছে। ফলে কম তাপমাত্রার দরুন শস্যের পচন ও বেশি তাপমাত্রায় শস্যের গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না ।
  • নির্গত গরম বাতাসকে পুনরায় ব্যবহার করে তাপশক্তির সাশ্রয় করা যায় ।
  • চাকা থাকার দরুন ড্রায়ারকে স্থানান্তর করা সহজ এবং ড্রায়ারকে ঘুরিয়ে এবং রিফ্লেক্টর উঁচু ও নিচু করে সর্বাধিক সৌর রশ্মি ড্রায়ারে আপতিত করা যায় ।
  • ড্রায়ারের প্রত্যেকটা অংশ খোলা ও ফিটিং করা যায়। ফলে ড্রায়ারের যন্ত্রাংশগুলো
  • খুলে সহজে পরিবহণ করা যায় এবং পরে এগুলো সংযোজন করা যায় ।
  • ড্রায়ার তৈরির মালামালগুলি বাজারে সহজলভ্য এবং স্থানীয় ওয়াকর্শপে এটি তৈরি করা যায়।
  • ড্রায়ারের তাপমাত্রা ৪০-৬০° সে. (নিয়ন্ত্রণযোগ্য)।
  • ড্রায়ারের ক্ষমতা: ধান (২৫০-৩০০ কেজি) ১৭ ঘণ্টা, গম (২৫০ কেজি) ১২ ঘণ্টা, ভুট্টা (৩০০-৩৫০ কেজি) ১৬ ঘণ্টা, বাদাম (২০০ কেজি) ২০ ঘণ্টা, ফল (৮০-১০০ কেজি) ২০-২৫ ঘণ্টা, সবজি (৪০-৬০ কেজি) ১২-১৫ ঘণ্টা
  • ড্রায়ারের বাজার মূল্য ১,০০,০০০ টাকা ।

কম্পোস্ট সেপারেটর

ভার্মিকম্পোষ্ট এমন এক ধরনের সার যা ব্যবহারে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত সাশ্রয় করা সম্ভব। ভার্মিকম্পোষ্ট বা কেঁচো সার তৈরিতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য কাজ হলো কম্পোস্ট থেকে কেঁচো আলাদা করা ও হেঁকে নির্দিষ্ট সাইজের গুঁড়া প্যাকেটজাত করণের জন্য আলাদা করা।

চালনীর মাধ্যমে হাতে চেলে কাঙ্ক্ষিত আকারের সার পাওয়ার জন্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। হাতে চেলে কেঁচো আলাদা করা যেমন কষ্টের তেমনি কেঁচোর স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। তাছাড়া এভাবে সার কমপক্ষে ২ বার হাতে চালতে হয়। কিন্তু এই যন্ত্রের দ্বারা একই সাথে কেঁচো আলদা করা সহ একবারেই কাঙ্ক্ষিত সার পাওয়া সম্ভব ।

 

বারি কম্পোস্ট সেপারেটর দ্বারা ভার্মিকম্পোস্ট চালা হচ্ছে

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা যায়।
  • মাত্র ০.৫ অশ্ব শক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দ্বারা চালানো সম্ভব।
  • সার থেকে কেঁচোকে পুরোপুরি আলাদা করতে পারে।
  • অল্প সময় ও স্বল্প খরচে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কেঁচো সার তৈরির সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ কাজ করা যায় ।
  • ট্রাইকোকম্পোস্টকেও সহজেই চালা যায় ।
  • ট্রাইকোকম্পোস্ট চালার জন্য ঘূর্ণন গতি বাড়ানোর ব্যবস্থা আছে।
  • মহিলা/পুরুষ এটা সহজেই চালাতে পারেন ।
  • যন্ত্রটি চালাতে ৩ জন লোকের প্রয়োজন হয়।
  • যন্ত্রটি দ্বারা ৫ মিমি এর চেয়ে কম ব্যসার্ধের চা পাতার মত সার সহজেই পাওয়া যায়।
  • যন্ত্রটি দ্বারা ঘণ্টায় ১৫০০ কেজি ভার্মিকম্পোস্ট বা ১০০০ কেজি ট্রাইকোকম্পোস্ট চালা যায় যেখানে হাতে চাললে ৩ জন লোকে ঘন্টায় ২৪০ কেজি ভার্মিকম্পোস্ট বা ১০০ কেজি ট্রাইকোকম্পোস্ট চালতে পারে।
  • যন্ত্রটির চালনা খরচ প্রতি কেজিতে ০.০৭ টাকা (ভার্মিকম্পোস্ট) এবং ০.১৫ টাকা (ট্রাইকোকম্পোস্ট)
  • যন্ত্রটির বাজার মূল্য ৩৫,০০০ টাকা ।

বারি কফি গ্রাইন্ডার

কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় উপজাতি কৃষকদের উদ্যোগে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার পাহাড়ী এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বিগত তিন দশক ধরে কফির চাষ হয়ে আসছে। উৎপাদিত কফির সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কিত জ্ঞান এবং ভাল বিপণন ব্যবস্থার অভাবে অত্যন্ত লাভজনক এ ফসলটির চাষ জনপ্রিয় হয়নি।

কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ একটি জটিল এবং যন্ত্রপাতি নির্ভর প্রক্রিয়া। এ কাজটি স্থানীয় কফি উৎপাদনকারীরা হামান দিস্তার সাহায্যে হাতে গুড়া করে থাকে। কাজটি যেমন শ্রম সাপেক্ষ তেমনি এভাবে উৎপাদিত কফির গুণগতমান বহুলাংশে কমে যায়। কফির গুণগতমান ঠিক রেখে ভাজা কফিকে গুড়ো করার কাজটি সহজে এবং দ্রুত করার জন্য বারি কফি গ্রাইন্ডার যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি কফি গ্রাইন্ডার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা যায় ।
  • এ যন্ত্রটি চালানোর জন্য অল্প জায়গার প্রয়োজন হয়।
  • মাত্র ০.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে চালানো যায় ৷
  • এ যন্ত্র ব্যবহারের ফলে উৎপাদন সময় ও খরচ কম লাগে।
  • এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য হওয়ায় এটি দিয়ে যে কোন কাঙ্খিত ধরণের কফি গুঁড়ো পাওয়া যায়।
  • একজন মানুষ অতি সহজেই এ যন্ত্র চালাতে পারে ।
  • মাপ : ৫৬০ ৪৫০ ৭৪০ সেমি।
  • ওজন : ২৫ কেজি।
  • কার্যমতা : ১১.৫ কেজি/ঘণ্টা ৷
  • মূল্য : ২৫,০০০ টাকা (মোটরসহ)।

বারি বাদাম মাড়াই যন্ত্ৰ

বাংলাদেশের চরাঞ্চলে বাদামের চাষ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিস্তৃত এলাকায় বপনের জন্য প্রয়োজনীয় বাদামের খোসা ছাড়াতে ও মাঝারি ধরনের কনফেকশনারির জন্য হস্তচালিত বাদাম মাড়াই যন্ত্র যথেষ্ট নয়। এ বিবেচনায় শ্রম সাশ্রয়ী শক্তিচালিত বাদাম মাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি বাদাম মাড়াই যন্ত্ৰ

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যন্ত্রটি স্থানীয় প্রকৌশল কারখানায় তৈরি করা যায় ৷
  • যন্ত্রটি চালানোর জন্য একজন লোকই যথেষ্ট।
  • যন্ত্রটি একই সাথে মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের সাথে সাথে মাড়াইকৃত বাদাম থেকে অমাড়াইকৃত বাদাম আলাদা করে দেয় ৷
  • মাত্র ০.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে চালানো যায় ।
  • যন্ত্রের মাপ ১০৬ ৪১ ১০১ সেমি।
  • হপারের ধারণ ক্ষমতা : ৬-১০ কেজি।
  • যন্ত্রের ওজন ৭৫ কেজি।
  • মাড়াই ক্ষমতা : ১২০-১৫০ কেজি/ঘণ্টা।
  • দানা ভাঙ্গার হার : ১-২%।
  • ঝাড়াই দক্ষতা : ১০০% ।
  • বাছাই দক্ষতা : ৯৫%।
  • মূল্য : ৩০,০০০ টাকা (মোটরসহ)।

বারি হলুদ পলিসার

বাংলাদেশের হলুদ গুণগত দিক থেকে বিখ্যাত। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের হলুদের কদর থাকায় হলুদের উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হলুদ সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন ধাপগুলো হলো পরিষ্কার করা, বাছাই করা, সিদ্ধ করা, শুকানো, পলিস করা এবং গুঁড়া করা।

হলুদ পলিস করা বলতে বুঝায় শুকানো হলুদের চামড়া, শিকড় এবং অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত অংশ সরিয়ে উজ্জ্বল, মসৃণ এবং হলুদাভ কন্দ পাওয়া। এ কাজটি সাধারণত বস্তায় ভরে হাত দিয়ে পিটিয়ে করা হয়ে থাকে যা সময় সাপেক্ষে, কষ্টসাধ্য এবং শ্রমনির্ভর। কৃষকের কষ্ট লাঘব করার জন্য একটি শক্তিচালিত হলুদ পলিসার যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।

 

বারি হলুদ পলিসার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে যন্ত্রটি তৈরি করা যায় ।
  • মাত্র ০.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে যন্ত্রটি চালানো যায় ।
  • একজন মানুষ অতিসহজেই এ যন্ত্র চালাতে পারে।
  • রৌদ্র তাপে শুকিয়ে গরম অবস্থায় পলিস করলে ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও গুণাগুণ ভাল হয়।
  • ঘূর্ণায়মান ষড়ভুজাকৃতির ড্রামের দৈর্ঘ্য ৬১০ মিমি ।
  • বাহিরের ব্যাস ৬৯ সেমি।
  • ভেতরের ব্যাস ৫৯ সেমি।
  • যন্ত্রের মাপ: ১০৪×৮৫×১৪৫ সেমি।
  • প্রতি ব্যাচে হলুদের ওজন: ৩০ কেজি।
  • যন্ত্রের ওজন: ৯০ কেজি।
  • কার্যক্ষমতা : ৬৫-৯০ কেজি/ঘণ্টা।
  • মূল্য : ৩০,০০০ টাকা (মোটরসহ)।

বারি কফি রোস্টার

কফি প্রক্রিয়াজাতকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে সবুজ কফিকে উচ্চ তাপে ভাজা বা রোস্টিং করা। এটি একটি তাপ রাসায়নিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সবুজ কফিতে অবস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থগুলি পরিবর্তিত হয়ে সুগন্ধ, রং ও স্বাদ প্রাপ্ত হয়। আমাদের দেশের খাগড়াছড়ি বা বান্দরবনের কফি চাষীরা কফি রোস্টিং বা ভাজার কাজটি সাধারণ চুলায় খোলা পাত্রে বা কড়াইতে করে থাকে।

পর্যাপ্ত তাপমাত্রার অভাবে কফির সুষমভাবে ভাজা হয় না। ফলে স্বাদ, রং ও ঘ্রাণের দিক দিয়ে এ কফি খুবই নিম্নমানের হয়। উৎকৃষ্ট মানের কফি প্রস্তুত করার জন্য কফি রোস্টার মেশিনের কোন বিকল্প নেই। এ ধরণের মেশিন কফি উৎপাদনকারী দেশগুলোতে সহজলভ্য হলেও আমাদের দেশে এখনও সহজলভ্য নয়। বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষকে উৎসাহিত করার জন্য কফি রোস্টার যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে।

 

বারি কফি রোস্টার

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • স্থানীভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা যায়।
  • ০.২৪ অশ্বশক্তির (০.১৮ কিলোওয়াট) বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে যন্ত্রটি চালানো যায় ।
  • এ যন্ত্রটি প্রাকৃতিক গ্যাসচালিত হওয়ার ফলে উৎপাদন সময় ও খরচ কম লাগে।
  • এটি তাপ নিয়ন্ত্রণযোগ্য হওয়ায় এটি দিয়ে যে কোন কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ভাজা কফি পাওয়া যায় ।
  • একজন মানুষ অতি সহজেই এ যন্ত্র চালাতে পারেন ৷
  • জ্বালানী : প্রাকৃতিক গ্যাস । মাপ : ৭১০×৪০০x৬১০ সেমি।
  • ওজন : ১৫ কেজি।
  • কার্যক্ষমতা : ৪.৫ কেজি/ঘণ্টা ।
  • মূল্য : ২০,০০০ টাকা (মোটরসহ)।

বারি সোলার পাম্প

জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা ও অনিশ্চয়তা সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে ১৭.৫ লক্ষ সেচ যন্ত্র রয়েছে যার মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ ডিজেল চালিত। প্রতিবছর ডিজেলের দাম বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে সৌর আলোক শক্তির মাত্রা প্রতিদিন প্রতি বর্গমিটারে ৪.০ থেকে ৬.৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং প্রখর সূর্যালোক প্রতিদিন ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা। তাই বাংলাদেশের বিদ্যুৎবিহীন এলাকাতে ফসল উৎপাদনে ক্ষুদ্র পরিসরে সেচের জন্য সৌর পাম্প বিকল্প হতে পারে।

কৃষিতে সৌর পাম্প সেচ পদ্ধতি ডিজেল চালিত সেচ পাম্পের বিকল্প, দূষণমুক্ত ও পরিবেশ বান্ধব। ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি সেচের জন্য এক অশ্বশক্তির একটি সৌর পাম্প উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাম্পটি ৯০০ ওয়াট ক্ষমতার প্যানেল দিয়ে চালনা করা হয়। এক অশ্বশক্তির ভিসি মোটরের সাথে পাম্পের সরাসরি কাপলিং করে সৌর পাম্প তৈরি করা হয়েছে। এ পাম্পে কোন ব্যাটারী লাগেনা। ফলে শুধুমাত্র সূর্যালোকের সময় পাম্প চলবে। রাতে বা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলে পাম্প চলবে না ।

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • এই পাম্প দিয়ে ৬ মিটার (২০ ফুট) গভীরতা থেকে পানি তোলা যায় ।
  • রাতে বা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলে পাম্প চালনো যায় না।
  • সৌর সেচের মাধ্যমে সবজি চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ।
  • তবে সৌর সেচের মাধ্যমে ধান চাষ অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক ।

 

বারি সোলার পাম্প

 

  • পানি উত্তোলন উপযোগিতা : ভূ-পৃষ্ঠস্থ
  • পাইপের ব্যাস : ৩৮ মিমি (১.৫ ইঞ্চি)।
  • মোটরের শক্তি : ১ অশ্বশক্তি।
  • মোটরের প্রকৃতি : ডিসি ।
  • প্যানেল শক্তি : ১০০ ওয়াট।
  • বিভব পার্থক্য : ৬০ ভোল্ট।
  • গড় পানি নির্গমন ক্ষমতা : প্রতি মিনিটে ১৪০ লিটার।
  • সৌর পাম্পের মোট মূল্য : ১,০০,০০০ টাকা।

কলা ও পেঁয়ারার উন্নতমানের বারি কার্টন

আম, কাঁঠাল, কলা ও পেঁয়ারা বাংলাদেশের প্রধান ফল। বাংলাদেশে কলা ও পেঁয়ারা যথেষ্ঠ জনপ্রিয় ফল। কলা সাধারণত সারা বছর পাওয়া যায়। কলা সংগ্রহের ৭/৮ দিন পরেই পচন শুরু হয়। পেঁয়ারা সাধারণত জুলাই-আগস্ট মাসে পাওয়া যায় । এটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল। পেঁয়ারা সংগ্রহের ২/৩ দিন পরে গায়ের রং হলুদ হয়ে যায় ।

এদের গা নরম হওয়ায় প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিবহনের কারণে গায়ে প্রচুর দাগ পড়ে ও অনেক ফল ক্ষত হয়ে যায়। ফলে এদের গুণগতমান কমে যায় ও অপচয় হয়। যে কারণে বাজার মূল্য হ্রাস পায়। কলা ও পেঁয়ারার গুণগতমান বজায় রেখে অক্ষত অবস্থায় পরিবহন ও বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে কলা ও পেঁয়ারার উন্নতমানের কার্টন উদ্ভাবন করা হয়েছে। কার্টন ব্যবহার করে ফল ব্যবসায়ী ও কৃষকগণ ফলের অপচয় রোধ করে অধিক লাভবান হবেন। তদুপরি এসব কার্টন ব্যবহার করে জনপ্রিয় এ ফলগুলো সুপার মার্কেটে বিক্রয় ও বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।

 

 

বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • কার্টুনটি করোগেটেড ফাইবার বোর্ড দিয়ে তৈরি ।
  • কার্টন হালকা বিধায় ফল-ফলাদি পরিবহন ও স্থানাস্তর করা সহজ।
  • ইহা ফলকে অক্ষত অবস্থায় ভোক্তাদের নিকট পৌছাতে সহায়তা করে ।
  • এর পায়ে ৮ টি ছিদ্র থাকায় ভিতরে রক্ষিত ফলের শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করে।

কলার ক্ষেত্রে

  •  ৪০×৩২×৩০.৫ সেমি, ৭ প্লাই
  • ধারণ ক্ষমতা : ১০-১২ কেজি কলা
  • শক্তিবহন ক্ষমতা (লোড বিয়ারিং ক্যাপাসিটি) : ৭০-৮০ কেজি
  • মূল্য: ৪৫ টাকা।

পেঁয়ারার ক্ষেত্রে

  • ৫১.৩×৩০×৩০ সেমি, ৭ প্লাই
  • ধারণ ক্ষমতা ১৮-২০ কেজি
  • শক্তিবহন ক্ষমতা (লোড বিয়ারিং ক্যাপাসিটি) : ৭০-৯০ কেজি
  • মূল্য: ৬০ টাকা ।

জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা ২০২০

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা ২০২০।

জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা ২০২০

 

 

১ ভূমিকা

১.১ : অধিকতর দক্ষতা এবং শ্রম ও সময় সাশ্রয়ী উপায়ে কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে মানুষ ও প্রাণীশক্তির ব্যবহার হ্রাস করে অধিক পরিমাণে যন্ত্রশক্তি ব্যবহারের প্রযুক্তি ও কলাকৌশল প্রয়োগের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলা হয়।

যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষি কাজে ব্যবহৃত উপকরণ, সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হয়। সেই সঙ্গে ফসল আবাদের দক্ষতা, নিবিড়তা, উৎপাদনশীলতা ও শস্যের গুণগতমান বৃদ্ধি পায় এবং কৃষি কাজ লাভজনক ও কর্মসংস্থানমুখী হয়। এছাড়াও প্রতিকুল পরিবেশে যন্ত্রের ব্যবহারে উৎপাদন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

১.২ : বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সূচনা হয় কৃষকদের মাঝে সরকারিভাবে যন্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে। ১৯৫০ দশকের প্রথম দিকে যান্ত্রিক চাষাবাদ শুরু হয় এবং সরকারি উদ্যোগে কৃষকদের মাঝে ট্রাক্টর, শক্তিচালিত পাম্প এবং স্প্রেয়ার বিতরণের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে কৃষিযন্ত্রের প্রচলন করা হয়। ১৯৭০ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গবাদি প্রাণীর ব্যাপক প্রাণহানির পরিপ্রেক্ষিতে উপদ্রুত এলাকায় চাষাবাদের জন্য সীমিত সংখ্যক ট্রাক্টর এবং পাওয়ার টিলার বিতরণ করা হয়।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালে দ্রুততম সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো নামমাত্র মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো লিফ্ট পাম্প, ২ হাজার ৯ শত গভীর নলকূপ এবং ৩ হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। আধুনিক কৃষিযন্ত্র সম্প্রসারণে এটি ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

১.৩ : ১৯৮৮ সালের সারা দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ফসল ও প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিযন্ত্র আমদানির উপর শুল্ক প্রত্যাহার, আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রপাতির মান পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা শিছিল ও এককভাবে সরকারি খাতে আমদানি করার পরিবর্তে বেসরকারি যাতে আমদানিকারকদের উৎসাহিত করা হয়। ফলে ব্যক্তিখাতের আমদানিকারকগণ ব্যাপকভাবে ছোট ইঞ্জিন ও পাওয়ার টিলার আমদানি করা শুরু করেন, যা দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়াকে গতিশীল করে তোলে।

১.৪ : বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় একদিকে শ্রমসংকট অন্যদিকে কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় বলে কৃষকদের স্বল্প শিক্ষিত সন্তানেরাও প্রচলিত কায়িক শ্রম নির্ভর কৃষি কাজের প্রতি আগের মতো উৎসাহ পান না। ফলে গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত তরুণরা কৃষিতে আগের মতো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এ তরুণদের কৃষির প্রতি আরো আগ্রহী করে তোলা সম্ভব। এ জন্য সরকারের অগ্রণী ভূমিকার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকিং যাতকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

১.৫ : চিরায়ত খোরপোশ কৃষি থেকে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক কৃষির রূপান্তরে যান্ত্রিকীকরণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাণিজ্যিক কৃষির অগ্রযাত্রায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রসার এখন একটি সময়ের দাবী। ইতোমধ্যে গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য কৃষি স্ত্রপাতি মেরামত কারখানা বা সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে এখন জমি কর্ষণ, সেচ, ফসল মাড়াই ও কীটনাশক ছিটানো প্রায় পুরোটাই যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়।

তবে রোপণ, বপন, সার প্রয়োগ, ফসল কর্তন, ঝাড়াই- বাছাই ইত্যাদি কাজ এখনও পুরোপুরি যন্ত্রের সাহায্যে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, যদিও অনুকূল নীতি সমর্থনের ফলে আমাদের হেক্টর প্রতি যন্ত্রশক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এক্ষেত্রে শক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির আরো সুযোগ রয়েছে। যন্ত্র সরবরাহ এবং সহজলভ্যতার ফলে কৃষি যন্ত্রপাতির প্রতি কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে যা অব্যাহত রাখা এবং আরো গতিশীল করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

১.৬ : এ নীতিমালায় ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বিধায় মূল্য সংযোজিত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সেড বিষয়াদি এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

২.০ কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালার ভিশন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

২.১ ভিশন

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে দক্ষ, লাভজনক ও বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থায় উত্তরণ এবং টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

২.২ লক্ষ্য

২.২.১ : কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, খামারের ক্ষুদ্র আয়তন ও খণ্ডিত জমি এবং মাটির প্রকারভেদ অনুযায়ী কৃষক বান্ধব কৃষি যন্ত্রপাতির প্রচলন উৎসাহিত করা।

২.২.২ : বৈচিত্রপূর্ণ কৃষি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় রেখে কৃষি কর্ম ও পেশাকে অধিকতর দক্ষ, ঝুঁকিমুক্ত ও সহজসাধ্য করা।

২.২.৩ : লাভজনক, বাণিজ্যিক ও টেকসই কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ গতিশীল করা।

২.৩ উদ্দেশ্য

১) কৃষক পর্যায়ে ব্যয় সাশ্রয়ী ও মুনাফা বৃদ্ধিকারী কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ত্বরান্বিত করা।

২) কৃষি শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।

৩) শস্যের ফলন বৃদ্ধির জন্য জমিতে যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো।

৪) শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করা যাতে সার্বিকভাবে ফসলের উৎপাদন বাড়ে।

৫) কৃষি যন্ত্রপাতির উপর গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করা।

৬) স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারকদের উৎসাহিত করা ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য সহায়তা প্রদান করা।

৭) কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য আমদানিকারক, প্রস্তুতকারক, ভাড়ায় যন্ত্র সেবা প্রদানকারী ও কৃষকদের সহজ ও বিশেষায়িত ঋণ সুবিধা সহজলভ্য করা।

৮) স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারক কর্তৃক সরবরাহকৃত কৃষি যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশের মান ঘোষণা ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান থেকে মান নির্ধারণের সুযোগ নিশ্চিত করা।

৯) মাঠ ফসল ছাড়াও উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল চাষে যান্ত্রিকীকরণ জোরদার করা।

১০)কৃষি যন্ত্রপাতির সেবা প্রদান, প্রশিক্ষণ, বহুমুখী ব্যবহার এবং মেরামত ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।

৩.০ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের চ্যালেঞ্জ

৩.১ ছোট খামার ও খন্ড খন্ড জমি

বাংলাদেশে খামারের গড় আয়তন ছোট এবং খন্ডে খন্ডে বিভক্ত। ফলে খণ্ডিত জমিতে চাষ, বপন, রোপণ, কর্তন ইত্যাদিতে যন্ত্রের ব্যবহার বেশ কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এমনকি ছোট ও মাঝারি আকারের কৃষিযন্ত্রের পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

৩.২ কৃষি যন্ত্রপাতি ক্ররে কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা

বিশ্বব্যাপী ধাতব কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক এবং কৃষিযন্ত্রের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অধিকাংশের নিজ অর্থায়নে ব্যয়বহুল কৃষিযন্ত্র (যেমনঃ ধান রোপণ, বপন, কর্তন ও মাড়াই যন্ত্র) ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ করার সামর্থ্য সীমিত এবং স্থানীয় পর্যায়ে ঋণ প্রাপ্তি সহজ নয়। ফলে আধুনিক কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে কৃষকদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

৩.৩ কৃষিযন্ত্রের বিক্রয়োত্তর সেবার অপ্রতুলতা

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে মানসম্মত সেবা প্রদানকারী (মেকানিক ও কারখানা) ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। ফলে, ফসল মৌসুমে কৃষিযন্ত্রের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাগণ ক্ষতিগ্রস্থ হন। কিছু কৃষিযন্ত্রের আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। তাছাড়া যন্ত্রসমূহ মৌসুম ভিত্তিক হওয়ায় বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় অব্যবহৃত থাকে এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেড়ে যায়।

৩.৪ কৃষি যান্ত্রিকীকরণে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকান্ডের সীমাবদ্ধতা

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কার্যক্রম আধুনিক কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কৃষক পর্যায়ে যন্ত্র প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞান ও দক্ষতা পৌঁছে দেয়ার মতো প্রশিক্ষিত জনবল প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত গড়ে ওঠেনি।

৩.৫ স্থানীয়ভাবে কৃষিযন্ত্র ও খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনে আধুনিক মূলধনী যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের অভাব

বিগত কয়েক দশকে স্থানীয় পর্যায়ে বিকশিত হওয়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশের উৎপাদন কারখানায় মূলত পুরনো মূলধনী যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কর্মরত বিষয় ভিত্তিক জনবলের (অপারেটর, টেকনিশিয়ান, মেকানিক ইত্যাদি) কারিগরি দক্ষতার অভাব রয়েছে। এমনকি তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত। ফলে মানসম্মত যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের উৎপাদন ব্যাহত হয়।

৩.৬ আমদানিকৃত ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতির গুণগত মান ঘোষণা ও নির্ধারণ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি

বর্তমানে আমদানিকৃত ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতির মান ঘোষণা ও নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে, অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় ও ব্যবহারের কারণে কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাগণ ক্ষতিগ্রস্থ ও নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

৩.৭ আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহার উপযোগী গ্রামীণ অবকাঠামোর অভাব

সকল অঞ্চলে কৃষিযন্ত্র মাঠ পর্যায়ে চলাচল উপযোগী রাস্তাঘাট সুবিধা ও খামার রাস্তা অপ্রতুল।

৩.৮ প্রাকৃতিক দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, আকস্মিক বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে হাওর ও দক্ষিণ অঞ্চলে প্রায়ই ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এসব অঞ্চলে কৃষি যন্ত্রপাতির প্রাপ্যতা ও ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশ কষ্টসাধ্য।

৩.৯ এলাকা ভিত্তিক মাটির ভারবহন ক্ষমতার ভিন্নতা

এলাকাভিত্তিক মাটির ধরনের পার্থক্যের কারণে সকল অঞ্চলে সমভাবে যন্ত্রের ব্যবহার করা যায় না।

 

 

৪.০ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সহায়ক পরিবেশ

৪.১ : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার যান্ত্রিকীকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ উদ্ভাবিত যন্ত্র সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

৪.২ : সরকারি, বেসরকারি ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহ স্থানীয় পর্যায়ে সেবা প্রদানকারী গ্রুপ তৈরি ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কৃষি যন্ত্রপাতির সেবাদানকারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে ওঠায় ন্যূনতম খরচে ফসল উৎপাদনে কৃষিযন্ত্র সেবা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষক ও সেবাদানকারী উভয়েই লাভবান হচ্ছেন।

৪.৩ : দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কৃষিযন্ত্র মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয় মেরামত কারখানা গড়ে ওঠায় আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার বান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠছে। ইতোমধ্যে স্থানীয়ভাবে কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও বিপণনে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।

৪.৪ : কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশের আমদানি, বিপণন ও বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদানে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে।

৪.৫ : কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার জনপ্রিয়করণ ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

৪.৬ : কৃষি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ ২০২১, ২০৩১ ও ২০৪১ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ প্রণয়ন করেছে।

৫.০ নীতিমালা প্রণয়নে অনুসৃত মূলনীতি

এ নীতিমালা প্রণয়নে কৃষি ও কৃষকের কল্যাণ বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং কৃষক সমবায় সংগঠনকে সহায়তা প্রদানে অগ্রাধিকার, টেকসই পরিবেশ, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার, নিরাপদ ও মানসম্পন্ন কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং সকল অংশীজনের মাঝে সমতা (Equity) বজায় রাখার মূলনীতি অনুসৃত হয়েছে |

 

 

৬.০ কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কৌশল

৬.১ কৃষিযন্ত্র জনপ্রিয়করণ ও সম্প্রসারণ

৬.১.১. উপযুক্ত কৃষিযন্ত্র চিহ্নিত ও বাজারজাতকরণ

কৃষক, কৃষক সমবায় সংগঠন ও সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা এবং খামার আকৃতি বিবেচনায় নিয়ে মানসম্পন্ন ও টেকসই উপযুক্ত যন্ত্র সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হবে। পাশাপাশি প্রতিকূল পরিস্থিতি (কাদা মাটি ও ফসলের নুয়ে পড়া অবস্থা ইত্যাদি) অনুযায়ী উপযুক্ত যন্ত্র সহজলভ্য করতে উৎসাহ প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দেশি বিদেশি আধুনিক যন্ত্রের মাঠ প্রদর্শন ও জনপ্রিয়করণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে।

৬.১.২ কৃষিযন্ত্র সরবরাহ ও ব্যবহার সম্প্রসারণে সরকার কর্তৃক প্রণোদনা প্রদান

কৃষিযন্ত্র সরবরাহ ও সম্প্রসারণে চলমান প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হবে এবং ক্ষেত্র বিশেষে প্রণোদনার পরিধি বাড়ানো হবে।

সরকারি প্রণোদনা প্রদানে নিম্নরূপ নীতি গ্রহণ করা হবেঃ

  • প্রাথমিকভাবে শুধু কৃষক ও কৃষক গ্রুপ/কৃষক সমবায় সংগঠন পর্যায়ে পরিচিতি ও জনপ্রিয়করণে এ প্রণোদনা নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রদান করা হবে। প্রণোদনা অবশ্যই মানসম্পন্ন / প্রত্যয়নকৃত কৃষিযন্ত্রের উপর প্রযোজ্য হবে। বছরে স্বপ্ন সময়কালে ব্যবহার্য অথচ অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হবে।
  • বেসরকারি উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে যন্ত্রের চাহিদা ও সরবরাহ সমন্বয়ের মাধ্যমে কৃষিযন্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতে সরবরাহ বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে প্রণোদনার হার ও ব্যবস্থাপনার পুনর্গঠন করা হবে।
  • প্রণোদনা প্রদান ব্যবস্থা অধিকতর স্বচ্ছ ও তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর করা হবে; যাতে উপযুক্ত কৃষক, কৃষক সমবায় সংগঠন ও কৃষি যন্ত্রপাতির সেবা প্রদানকারীর মাঝে সরবরাহ নিশ্চিত হয়।
  • প্রণোদনা প্রদানের ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় জোরদার করা হবে।

৬.১.৩ কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ঋণ প্রদান

কৃষক ও যন্ত্র সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তাদের কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে উৎসাহিত করতে সরকারি বাণিজ্যিক, এনজিও ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে সহজে কৃষিযন্ত্রে কৃষি ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। বছরের স্বল্প সময়ে ব্যবহার্য বাপন, রোপণ, কর্তন, শুকানো, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ক কৃষিযন্ত্র ক্রয়ের জন্য কৃষক/সেবা প্রদানকারীদেরকে ন্যুনতম সুদে বা যন্ত্র বিশেষে সুদবিহীন ঋণ প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে সুদের অংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে পরিশোধ করতে পারে।

এছাড়া কৃষক বা কৃষক গ্রুপ/কৃষক সমবায় সংগঠন যাতে ডাউন পেমেন্টসহ কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করে কৃষিযন্ত্র ক্রয় করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হবে।

৬.১.৪ কৃষিযন্ত্র আমদানি ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিযন্ত্র বাজারজাতকরণে শুল্ক নির্ধারণ

  • আমদানিকৃত এবং স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত কৃষিযন্ত্র বিপণনে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা বজায় রাখা হবে।
  • বর্তমানে বিভিন্ন কৃষিযন্ত্র, যেমন- পাওয়ার টিলার, পাওয়ার থ্রেসার, পাওয়ার রিপার ও পাওয়ার সিডার উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রাংশ/ কাঁচামাল আমদানির উপর আরোপিত শুল্কের পরিমাণ ১% এবং সমুদয় রেগুলেটরি ডিউটি, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর হতে অব্যাহতি প্রাপ্ত। কিন্তু এতে ট্রান্সপ্লান্টার ও কম্বাইন হারভেস্টার অন্তর্ভুক্ত নেই। ভবিষ্যতে সকল প্রকার কৃষিযন্ত্রের দেশীয় উৎপাদনে কাঁচামাল বা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হার আরো হ্রাস অথবা যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে।
  • কৃষিকার্যে ব্যবহৃত সকল প্রকার স্প্রেয়ার ও পাওয়ার টিলারের আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে আরোপীয় সমুদয় মূল্য সংযোজন কর (আগাম কর ব্যতীত) অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। উক্ত নীতি চলমান রাখাসহ এই তালিকায় ট্রান্সপ্লান্টার ও কম্বাইন হারভেস্টারও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এছাড়া সকল কৃষিযন্ত্রের বিক্রয় শুল্কসহ অন্যান্য শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে।
  • দেশে উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে এমন সব যন্ত্রের প্রতিরক্ষণ ও সার্ভিসিং সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত প্রণোদনা দেয়া হবে।

৬.১.৫ সকল স্তরে কৃষিবল্প সম্প্রসারণে কারিগরি সহায়তা নিশ্চিতকরণ

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়নের জন্য কৃষক/কৃষক সমবায় সংগঠন ও কৃষিযন্ত্রের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, তথ্য ও সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা থেকে সকল উচ্চতর স্তরে এবং অন্যান্য সংস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি প্রকৌশল জ্ঞান সম্পন্ন আলাদা জনবল কাঠামো তথা কৃষি যান্ত্রিকীকরণ উইং প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হবে। মাঠ পর্যায়ে খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য করাসহ দক্ষ মেরামত সেবা উৎসাহিত করা হবে।

৬.২ কৃষিযন্ত্র সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা বৃদ্ধি

৬.২.১ : কৃষিযন্ত্রের ভাড়ায় ব্যবহার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। কৃষকগণ ব্যক্তিগতভাবে কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে বিনিয়োগ না করেও ভাড়ায় কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। কৃষিযন্ত্র সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালু করা হবে। কৃষিযন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার, যন্ত্র চালনা, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবসা পরিচালনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।

৬.২.২ : কৃষিযন্ত্রের সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা, প্রস্তুতকারক, আমদানিকারক, ডিলার, মেকানিক এবং কৃষক/কৃষক সমবায় সংগঠকদের উদ্বুদ্ধ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হবে।

৬.২.৩ : কৃষিযন্ত্র সেবা প্রদানের লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যন্ত্র ভাড়া, মেকানিক সার্ভিস বিষয়ক সেবাকেন্দ্র স্থাপন উৎসাহিত করা হবে।

৬.২.৪ : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ও অন্যান্য সংস্থার আওতায় তৃণমূল পর্যায়ে এবং কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন কারখানার জনবলের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

৬.২.৫ : ক্ষুদ্র কৃষিযন্ত্র সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা, কৃষক ও কৃষক সমবায় সংগঠন, মেকানিক, মেরামতকারী কারখানা শ্রমিকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সেই সঙ্গে গবেষক, সম্প্রসারণকর্মী ও সংশ্লিষ্টদের বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে।

৬.২.৬ : কৃষিযন্ত্র ভাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে ভাড়া প্রদানকারী, কৃষক ও জমির মালিকের মধ্যে উৎপাদিত ফসল হতে প্রাপ্য লভ্যাংশের অংশ যৌক্তিক হারে নির্ধারণ করা হবে।

৬.৩  কৃষিযন্ত্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহারে চাষযোগ্য জমির সমন্বয় ও সমন্বিত ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা প্রবর্তন

দেশে চাষাবাদযোগ্য জমির আকার ছোট ও খন্ড খন্ড হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রের সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয় না। ভাড়া ব্যবস্থায় কৃষিযন্ত্র সেবার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্থানীয়ভাবে কৃষকদের সংগঠিত করে সমন্বিত ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থ বজায় রেখে জমি লিজ ও চুক্তিভিত্তিতে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা হবে। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত কর্মপদ্ধতি পরবর্তীতে নির্ধারণ করা হবে।

৬.৪ গবেষণা ও উন্নয়ন

অঞ্চল ও ফসলভেদে লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন ও আত্তীকরণের জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন অপরিহার্য। খামার পর্যায়ে স্থানভেদে উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি প্রযুক্তি উদ্ধাবন ও উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা, শিক্ষা এবং স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা হবে।

৬.৪.১ : অঞ্চল ও ফসলভেদে আধুনিক ও লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণাকে উৎসাহিত করা হবে।

৬.৪.২ : গবেষণার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে।

৬.৪.৩ : কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্রভাবে গবেষণা পরিচালনা করে থাকে; অনেক ক্ষেত্রে একই যন্ত্র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবন করছে। এসব গবেষণা সমন্বিতভাবে পরিচালনার জন্য উৎসাহিত করা হবে। স্থানীয় যন্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে গবেষণা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা হবে।

৬.৪.৪ : মাঠ ফসলের পাশাপাশি উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহণের জন্য উপযুক্ত যন্ত্র ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

৬.৪.৫ : গবেষণালব্ধ উদ্ভাবনসমূহের মেধাস্বত্ব প্রদান উৎসাহিত করা হবে।

৬.৪.৬ : কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন শিল্প ও বিপণন উদ্যোক্তাদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা হবে। সংশ্লিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করা হবে।

৬.৪.৭ : কৃষি যন্ত্রপাতির মান উন্নয়ন সংক্রান্ত গবেষণা, মান নির্ধারণ ও প্রশিক্ষণের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

৬.৪.৮ : কৃষি যন্ত্রপাতি গবেষণায় যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও চালকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

৬.৪.৯ : কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের সাথে প্রযুক্তি হস্তান্তরে সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করা হবে।

৬.৪.১০ : কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ATI), পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (PTI), ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (VTI), টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজসমূহের (TSC) কৃষি প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হবে।

৬.৪.১১ : রাসায়নিক সার ও বালাই নাশক এবং সেচের পানির পরিমিত প্রয়োগ/ব্যবহারের লক্ষ্যে আধুনিক কৃষিযন্ত্র/পদ্ধতি উদ্ভাবন, প্রচলন ও ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

৬.৪.১২ : কৃষিযন্ত্রের উপর গবেষণা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রণয়নের লক্ষ্যে নির্ভরযোগ্য কৃষি যন্ত্রপাতির তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা হবে।

৬.৪.১৩ : কৃষিযন্ত্রের উপর গবেষণার ফলাফল মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

৬.৫ কৃষিযন্ত্র উৎপাদন শিল্পের সম্প্রসারণ

স্থানীয় পর্যায়ে কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশের উৎপাদন ব্যবস্থার প্রসার ও মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা হবে।

৬.৫.১ : কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী শিল্পকে কৃষি ভিত্তিক শিল্প হিসেবে গণ্য করার উদ্যোগ নেয়া হবে।

৬.৫.২ : কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতির উপর যুক্তিসঙ্গত হারে প্রণোদনামূলক আমদানি কর নির্ধারণ করা হবে।

৬.৫.৩ : কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী ও সংযোজন শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে। এই শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনার ভিত্তিতে কর রেয়াত সংশ্লিষ্ট তালিকার যন্ত্রাংশের সংখ্যা প্রয়োজনের নিরিখে সম্প্রসারণ করা হবে।

৬.৫.৪ : কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী শিল্পকে শিল্পনীতিতে উচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ শিল্পের বিকাশের স্বার্থে কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন অনুসারে রেয়াতি সুবিধা প্রদান করা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী শিল্পে আমদানিকৃত কাঁচামালের উপর বিধিবদ্ধ শুল্ক বিদ্যমান থাকায় কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ বিক্রয় ও সরবরাহের ক্ষেত্রে ভ্যাট রেয়াতি সুবিধার বিষয় বিবেচনা করা হবে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রাংশের উৎপাদন খরচ ও উদ্যোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে।

৬.৫.৫ : দেশে কৃষি যন্ত্রপাতি সংযোজন শিল্পকে উৎসাহিত করা হবে। এক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী যৌথ বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে। সংযোজন শিল্পে দেশীয় উৎপাদিত যন্ত্রাংশের একটি অংশ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।

৬.৫.৬ : উচ্চ মূল্যের নতুন কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন, কম্বাইন হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ইত্যাদি আমদানির পাশাপাশি পুনঃসংযোজিত (refurbish) কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানির সুযোগ থাকবে। তবে এ সকল যন্ত্রপাতির পুনঃসংযোজন কর্তৃপক্ষ ও আমদানিকারক কর্তৃক মান ঘোষণা করতে হবে।

৬.৫.৭ : কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী শিল্পাঞ্চলসমূহে কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী জোন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ শিল্পের উন্নয়নে বিশেষায়িত উৎপাদন প্রতিষ্ঠানসমূহে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উচ্চতর সেবাকেন্দ্র” প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করা হবে।

৬.৫.৮ : স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিসমূহ কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী শিল্প কাঁচামাল (বিভিন্ন প্রকার স্টিল) সুলভ মূল্যে প্রাপ্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

 

৭.০ প্রিসিশন এগ্রিকালচার

মৃত্তিকার স্বাস্থ্য রক্ষা করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকল্পে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর প্রয়োজন মাফিক উপকরণ ব্যবহারে প্রিসিশন এগ্রিকালচারের চর্চা আগামী দিনের যান্ত্রিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রিসিশন এগ্রিকালচার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণ ও পরিমাপক যন্ত্র প্রসারের লক্ষ্যে নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

৭.১ : প্রিসিশন এগ্রিকালচারে সহায়ক যন্ত্রপাতির উপর আমদানী শুল্ক হ্রাসের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

৭.২ : সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণের আওতায় প্রিসিশন এগ্রিকালচার সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের কলাকৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

৮.০ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার

সরকার ২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট শক্তি চাহিদার ১০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ শক্তি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস (সৌর, বায়োগ্যাস, বায়ু ইত্যাদি) হতে পুরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা হবে।

৮.১ : ফসল উৎপাদনে সোলার সেচ পাম্প ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হবে।

৮.২ : সবজি ও ফল শুকানোর জন্য সোলার ড্রায়ার ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হবে।

৮.৩ : সোলার সিস্টেম’ ব্যবহারের মাধ্যমে খামার পর্যায়ে কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ উৎসাহিত করা হবে।

৮.৪ : ‘সোলার-সিস্টেম’ ব্যবহারের মাধ্যমে “গ্রিন-হাউজ” পদ্ধতিতে উচ্চ মূল্যের লাভজনক ফসল উৎপাদন সম্ভাবনাকে উৎসাহিত করা হবে।

৮.৫ : কৃষি ও শিল্পের বর্জ্য থেকে জৈব সার ও বায়োগ্যাস উৎপাদন ও ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করা হবে।

৮.৬ : সৌর ও বায়োগ্যাস শক্তি সম্মিলিতভাবে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন তথা খামার/কমিউনিটি মিনি গ্রিড গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা হবে।

৯.০ সংরক্ষণশীল কৃষি (কনজারভেশন এগ্রিকালচার)

সংরক্ষণশীল কৃষি পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা ও আর্দ্রতা রক্ষা, ফসল উৎপাদনের খরচ ও সময় সাশ্রয়, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃস্বরণ হ্রাস এবং ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা যায়। এ লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

৯.১ : ফসল ও মাটি ভেদে বিনাচাষ বা স্বল্পচাষের মাধ্যমে ফসল কাটার পর ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটির সাথে মিশিয়ে চাষ করার পদ্ধতিকে জনপ্রিয় এবং এ লক্ষ্যে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

৯.২ : সংরক্ষণশীল কৃষি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এর সঙ্গে সম্পর্কিত কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার বিষয়ে কৃষক ও কৃষিযন্ত্র সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ প্রদান করা হবে।

৯.৩ : কৃষি পরিবেশ রক্ষায় শস্য কর্তন পরবর্তী সময়ে ফসলের অবশিষ্টাংশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

৯.৪ : মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি ও ভূমি ক্ষয়রোধে সংরক্ষণশীল কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হবে।

৯.৫ : সংরক্ষনশীল কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে আর্থিক প্রণোদনা, ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি ও উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা হবে।

৯.৬ : পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং পানি পরিমাপের জন্য ডিজিটালাইজড্ পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে।

১০.০ বিশেষ অঞ্চলভিত্তিক যান্ত্রিকীকরণ

১০.১ হাওর অঞ্চল

আকস্মিক পাহাড়ি ঢল, বন্যা, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতের কারণে শস্যহানির ঝুঁকি বিদ্যমান। সময়মতো শস্য আহরণ ও চাষাবাদের সময়কাল হ্রাসকল্পে হাওর অঞ্চলে দ্রুত কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১০.১.১ : শস্য বীজ বপন, ফসলের চারা রোপণ, শস্য কর্তন, মাড়াই ও শুকানো যন্ত্রের দ্রুত সম্প্রসারণের নিমিত্ত অধিক হারে সরকারি উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা হবে।

১০.১.২ : কৃষকের সুবিধার্থে ফসল মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণে সেবা অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হবে।

১০.১.৩ : যন্ত্রপাতি ও কৃষি পণ্য চলাচল সুগম করার লক্ষ্যে উপযুক্ত পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে।

১০.১.৪ : হাওর অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিয়ে যন্ত্র সেবার উদ্যোক্তা সৃষ্টির ব্যবস্থা নেয়া হবে।

১০. ২ উপকূলীয় ও চর অঞ্চল

ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, মাটি ও পানির লবণাক্ততা এবং জলমগ্নতার কারণে এ এলাকার কৃষি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। এ এলাকার শস্য বিন্যাস অনুযায়ী উপযুক্ত যন্ত্র নির্বাচন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১০.২.১ : এলাকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উপযুক্ত যন্ত্র উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১০.২.২ : যন্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনে এ এলাকায় বর্ধিত হারে উন্নয়ন সহায়তা বা প্রণোদনা প্রদান করা হবে।

১০.২.৩ : ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমি একত্রিত করে বৃহৎ খামার তৈরির উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হবে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম হারে ঋণ সুবিধা, পরামর্শ ও প্রণোদনা প্রদান করা হবে।

১০.২.৪ : চর ও উপকূলীয় অঞ্চলের উপযোগী মুগ, তিল, সূর্যমুখী, ভুট্টা, সয়াবিন, তরমুজ ইত্যাদি ফসলের জন্য লাগসই যন্ত্রপাতি প্রচলন উৎসাহিত করা হবে।

১০,২.৫ : এ অঞ্চল দূর্গম হওয়ায় কৃষি কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি চলাচল উপযোগী রাস্তাঘাট নির্মাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হবে।

১০.৩ পাহাড়ী ও বরেন্দ্র অঞ্চল

মাটির প্রকৃতি ও সেচ পানির উৎসের ভিন্নতার কারণে এ সকল অঞ্চলে চাষাবাদের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে তেমনি সম্ভাবনাও প্রচুর। এ বিবেচনায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১০.৩.১ : এলাকাভেদে মাটির উর্বরতা, বন্ধুরতা ও সেচ পানির প্রাপ্যতা অনুযায়ী উপযোগী ফসলের জন্য লাগসাই কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

১০.৩.২ : দূর্গম অঞ্চলে কৃষি কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি হিসেবে সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে।

১০.৩.৩ : এ সকল এলাকায় ফসল উৎপাদনের জন্য ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে লাগসই সেচযন্ত্র ও পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি (ড্রিপ সেচ, স্প্রিংকলার সেচ ইত্যাদি) ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করা হবে।

১০.৩.৪ : বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে যথাযথ প্রযুক্তির মাধ্যমে সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য গুরুত্বারোপ করা হবে।

১০.৩.৫ : পাহাড়ি অঞ্চল দূর্গম হওয়ায় কৃষি কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি চলাচল উপযোগী রাস্তাঘাট নির্মাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হবে।

১০.৩.৬ : অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি অঞ্চলের কৃষকের সুবিধার্থে ফসল মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সেবা অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হবে।

১০.৩.৭ : পাহাড়ি ও দূর্গম অঞ্চলে যন্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনে বর্ধিত হারে উন্নয়ন সহায়তা বা প্রণোদনা প্রদান করা হবে।

১০.৩.৮ : উদ্যান ফসল স্থাপন, বৃহৎ খামার তৈরির উদ্যোগকে উৎসাহিত করে ন্যূনতম হারে ঋণ সুবিধা, পরামর্শ ও প্রণোদনা প্রদান করা হবে।

১০.৩.৯ : দুর্গম অঞ্চলে ছড়া/ঝর্ণায়/ক্রিক বাধ দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিতকল্পের গ্রেভিটিফ্লোর এর মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্যান ফসল এবং জমিতে সেচ প্রদান করা হবে।

১১.০ মান পরীক্ষা ও প্রত্যয়ন

ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতির সর্বোত্তম আয়ুষ্কাল ও কার্যকারিতা প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত হলো গুণগতমান সম্পন্ন যন্ত্র ব্যবহার। যন্ত্র প্রস্তুতকারী, বাজারজাতকারী এবং ব্যবহারকারী সকলের জন্যই যন্ত্রের মান নির্ধারণ সুবিধা সহজলভ্য করা খুবই জরুরি।

বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্য, নির্মাণ সামগ্রী ইত্যাদির মান নির্ধারণ ও প্রত্যয়নের ব্যবস্থা চলমান থাকলেও বর্তমানে কৃষি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে মান নির্ধারণ ও প্রত্যয়নের সুযোগ নেই। দেশে গুণগত মানসম্পন্ন যন্ত্রের প্রসার নিশ্চিতকল্পে মান নির্ধারণ অবকাঠামো ও প্রত্যয়নের ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত নীতি গ্রহণ করা হবে।

১১.১ : কৃষি যন্ত্রপাতির মান নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি ও সরঞ্জামাদি সহজলভ্য করতে এবং দক্ষ জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে সহায়তা প্রদান করা হবে।

১১.২ : সরকারি সেবা প্রদানকারী সংস্থা কর্তৃক কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক, আমদানিকারক ও ব্যবহারকারীর চাহিদা অনুযায়ী মান নির্ধারণ সেবা প্রদান করা হবে। পাশাপাশি গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ল্যাব সুবিধা বৃদ্ধি করে মান পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে মান নির্ধারণ ও প্রত্যয়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইন, বিধি ও পদ্ধতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।

১১.৩ : মান নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা, সুবিধা ও সুফল সম্পর্কে যন্ত্র প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী ও ব্যবহারকারী পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে প্রচারণা ও সচেতনতা সৃষ্টিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১২.০ সমন্বয় ও সহযোগিতা

উপযুক্ত কৃষি যন্ত্রপাতি চিহ্নিতকরণ, প্রস্তুতকরণ, সম্প্রসারণ, সমন্বিত, সমলয়ে ও সমবায় ভিত্তিক চাষাবাদ চর্চা, ঋণ প্রাপ্তি, শুল্ক/কর প্রণোদনা ইত্যাদি কার্যক্রম সহজে ও স্বল্প সময়ে সম্পাদনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় অপরিহার্য। এ ব্যবস্থার উন্নয়নে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১২.১ : কৃষি যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন, প্রোটোটাইপ তৈরি, মাঠ পর্যায়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিতকরণ ও সংশোধন ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

১২.২ : যন্ত্র সংশ্লিষ্ট গবেষক, প্রস্তুতকারক, সম্প্রসারণ কর্মী, কৃষক ও কৃষক সমবায় সংগঠন, সেবাদানকারী, কৃষক ও মেকানিকদের মধ্যে সমন্বয়, পারস্পরিক সহযোগিতা ও তথ্য বিনিময়ের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে।

১২.৩ : কৃষিযন্ত্রের প্রস্তুতকরণ শিল্প স্থাপন, যন্ত্র আমদানি, বিপণনের উপর শুল্ক কর আরোপ ও ঋণ প্রদানে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় বৃদ্ধি করা হবে।

১২.৪ : সেবা প্রদানের প্রয়োজনে ভারী কৃষি যন্ত্রপাতি রাস্তায় চলাচল ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা হবে।

১৩.০ যুবশক্তির অংশগ্রহণ

গ্রামের শিক্ষিত যুবকদের যন্ত্র সেবা উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি এবং যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে যুব সম্প্রদায়ের অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত নীতি গ্রহণ করা হবে।

১৩.১ : যন্ত্রপাতির বিক্রোয়োত্তর সেবা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত সেবা নিশ্চিতকরণে এলাকাভিত্তিক সার্ভিসিং ওয়ার্কশপ এবং যন্ত্র সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় যুব সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করা হবে।

১৩.২ : কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার যুবকদের যন্ত্র সেবা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ সহায়তা ও ব্যাংক ঋণ প্রদানে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

১৪.০ নারীর অংশগ্রহণ

কৃষি যন্ত্রপাতি পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি যন্ত্রিকীকরণে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১৪.১ : সচেতনতা বৃদ্ধি ও নিরাপদ যন্ত্র ব্যবহারে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উৎসাহিত করা হবে।

১৪.২ : নারীদের কৃষি যন্ত্রপাতি সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে উৎসাহ প্রদান করা হবে।

১৫.০ নিরাপদ ব্যবস্থাপনা

কৃষি যন্ত্রপাতি চলাচলে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, অদক্ষ যন্ত্র চালনা এবং অসতর্কভাবে ঘূর্ণায়মান অংশের সংস্পর্শে আসার ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। কৃষি যন্ত্রপাতির নিরাপদ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১৫.১ : ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত সকল কৃষি যন্ত্রপাতি অনায়াসে ব্যবহার উপযোগী বিশেষত নারীবান্ধব ও নিরাপদ হিসেবে প্রস্তুত করতে উৎসাহিত করা হবে।

১৫.২ : যন্ত্র বিক্রয়ের সময় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি সরবরাহ নিশ্চিত করতে উৎসাহিত করা হবে।

১৫.৩ : যন্ত্রের নিরাপদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

 

১৬.০ বিনিয়োগ

কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকরণ শিল্প, যন্ত্র মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কারখানা, ভাড়ায় যন্ত্র সেবা প্রদানকারী, কৃষক গ্রুপ ও ব্যক্তি পর্যায়ে কৃষকদেরকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকরণ শিল্প থেকে অর্জিত মুনাফার উপর আরোপিত আয়কর রেয়াতি সুবিধা যুক্তিসঙ্গত হারে প্রদান করা হবে |

১৭.০ ব্যাংক ঋণ

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে কৃষক, যন্ত্র সেবা প্রদানকারী ও স্থানীয় কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারক পর্যায়ে মূলধনের অপ্রতুলতা রয়েছে। এ বিনিয়োগ ও মূলধন প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১৭.১ : কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারকদের মূলধনী যন্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি বিশেষায়িত ঋণ স্কিমের আওতায় ন্যূনতম হারে ঋণ প্রদান চালু করা হবে।

১৭.২ : কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কর্মকান্ড কৃষি খাতের মোট ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে নির্ধারণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

১৮.০ নীতিমালা বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, মনিটরিং ও সমন্বয়

নীতিমালাটি অনুমোদন শেষে এর বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের প্রয়োজন হবে। অতঃপর প্রণীত নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সমন্বয় ও মনিটরিং এর কাঠামো তৈরি করত: তা সুষ্ঠু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 

 

১৯.০ উপসংহার

গ্রামীণ শ্রমিকের বহুমুখী কর্মক্ষেত্র তৈরি ও অধিক আকর্ষণীয় পেশায় স্থানান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দিনের কৃষিযন্ত্র নির্ভর বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। টেকসই যান্ত্রিকীকরণের এই পথ পরিক্রমায় সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে কাঙ্খিত সফলতা অর্জন সম্ভব।

এক্ষেত্রে সরকারের এ নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ প্রেক্ষাপটে প্রণীত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালার আলোকে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ ও যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।

ছাগলের রোগ ব্যবস্থাপনা

ছাগলের রোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয়ের ১৩ নং ইউনিটের ১৩.৬ নং পাঠ। ছাগলের রোগ ব্যবপনা একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে মুক্তভাবে ছাগল প্রতিপাল নের তুলনায় আবদ্ধ অবস্থায় ছাগল পালন অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যবস্থায় বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা ও প্রযুক্তির সমন্নয় না ঘটালে খামারীকে বিস্তর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটা একটি বাস্তব উপলব্ধি। এজন্য ছাগলের সুখ সাচ্ছন্দ্য ও স্বাস্থার প্রতি খামারীকে স্বতন্ত্র ভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। ছাগলের খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই বিভিন্ন রোগ দমনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে খামার থেকে লাভের আশা করা যায় না।

ছাগলের রোগ ব্যবস্থাপনা

 

খামারে ছাগল আনার পর থেকে প্রতিদিনই প্রতিটি ছাগলের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথম পাঁচ দিন সকাল ও বিকালে দুবার থার্মোমিটার দিয়ে ছাগলের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। হঠাৎ কোনো রোগ দেখা মাত্রই গবাদি প্রাণি চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তীব্র শীতের সময় ছাগী বা বাচ্চাদের গায়ে চট পেঁচিয়ে দেয়া যেতে পারে। মাচার নিচ এবং ঘর প্রতিদিন সকালে পরিস্কার করতে হবে এবং কর্মসূচি অনুযায়ী জীবাণুনাশের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সুস্থ ছাগলের বৈশিষ্ট্য সুস্থ ছাগলের নাড়ীর স্পন্দন প্রতি মিনিটে ৭০—৯০ বার, শ^াস প্রশ^াস প্রতি মিনিটে ২৫—৪০ বার এবং তাপমাত্রা ৩৯.৫০ সেঃ হওয়া উচিত। সুস্থ ছাগল দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে, মাথা সবসময় উঁচু থাকে, নাসারন্ধ্র থাকবে পরিস্কার, চামড়া নরম, পশম মসৃণ ও চকচকে দেখাবে এবং পায়ু অঞ্চল থাকবে পরিচ্ছন্ন।

ছাগল সুস্থ রাখতে যেসব ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা আবশ্যক সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:কর্মসূচি অনুযায়ী টিকা প্রদান: ভাইরাসজনিত রোগ যেমন এনথ্রাক্স ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি খুবই মারাত্মক বলে এগুলোর বিরুদ্ধে যথারীতি টিকা প্রদান করতে হবে। যেসব ছাগীকে পূর্বে পিপিআর, গোটপক্স, একথাইমা, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি টিকা দেয়া হয়নি তাদেরকে গর্ভের ৫ম মাসে উক্ত ভ্যাকসিনগুলি দিতে হবে। বাচ্চার বয়স যখন ৫ মাস তখন তাকে পিপিআর ভ্যাকসিন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দিতে হবে।

কৃমিনাশক ঔষধ প্রয়োগ:

সকল ছালকে নির্ধারিত মাত্রায় বছরে দুইবার কৃমিনাশক ঔষধ প্রদান করতে হবে। কমিনাশক ৃ কর্মসূচি অনুসরণের জন্য গবাদি প্রাণি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

ছাগলের খামারের জৈব নিরাপত্তা খামার এলাকায় বেড়া বা নিরাপত্তা বেস্টনী এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে যাতে সেখানে অনাকাঙ্খিত ব্যক্তি, শেয়াল— কুকুর ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী প্রবেশ করতে না পারে। প্রবেশপথে ফুটপাতে বা পা ধোয়ার জন্য ছোট চৌবাচ্চায় জীবাণুনাশক মেশানো পানি রাখতে হবে। খামারে প্রবেশের আগে খামারে গমনকারী তার জুতা/পা ডুবিয়ে জীবাণু মুক্ত করবেন। খামারের জন্য সংগৃহিত নূতন ছাগল সরাসরি খামারে পূর্বে বিদ্যমান ছাগলের সাথে রাখা যাবে না। নতুন আনীত ছাগলদের স্বতন্ত্র ঘরে সাময়িক ভাবে পালনের ব্যবস্থা করতে হবে।

এ ধরনের ঘরকে পৃথকীকরণ ঘর বা আইসোলেশন শেড বলে। অন্ততপক্ষে দুই সপ্তাহ এই শেডে রাখা বিশেষ জরুরি। এসব ছাগলের জন্য প্রাথমিক কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে এদেরকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। এজন্য বহিঃপরজিবী এবং আন্তঃপরজিবীর জন্য কার্যকর কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে। চর্মরোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি ছাগলকে ০.৫% ম্যালাথিয়ন দ্রবণে গোসল করাতে হবে। আইসোলেশন শেডে ছাগল রাখার পর ১৫ দিনের মধ্যে যদি কোনো রোগ না দেখা দেয় তাহলে প্রথম পিপিআর রোগের এবং সাত দিন পর গোটপক্সের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। শেষ টিকা প্রদানের সাত দিন পর এসব ছাগলকে মূল খামারে নেয়া যেতে পারে।

প্রদিদিন সকাল এবং বিকালে ছাগলের ঘর পরিষ্কার করতে হবে। কোনো ছাগল যদি অসুস্থ হয় তাহলে তাকে আলাদা করে আইসোলেশন শেডে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কোনো ছাগল মারা যায় তবে অবশ্যই তার কারণ শনাক্ত করতে হবে। ল্যাবরেটরিতে রোগ নির্ণয়ের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মৃত ছাগলকে খামার থেকে দূরে নিয়ে মাটির গভীরে পুঁতে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত ছাগলের ব্যবহার্য সকল সরঞ্জামাদি ও দ্রব্যাদি সঠিকভাবে জীবানু মুক্ত করতে হবে।

 

গরু, মহিষ ও ছাগলের বাসস্থান

গরু, মহিষ ও ছাগলের বাসস্থান – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” ইউনিট – ১২ , পাঠ – ১২.১। গরুর বাসস্থান গরুর বাসস্থানকে সাধারণত গোশালা বা গোয়াল ঘর ব লে যা গরু কে ঝড়-বৃষ্টি, রোদ, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, গরম এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিরূপ পরিবেশ থেকে রক্ষা করে। দু’টি উপায়ে গরু পালন করা হয়, যেমন- ক) চারণভূমিতে গরু চরানোর মাধ্যমে ও খ) গোশালায় বেঁধে রেখে খাদ্য পরিবেশন মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের দেশে এ পদ্ধতিগুলোর কোনোটিই বৈজ্ঞানিকভাবে বিকাশ লাভ করেনি। এদেশে গরু পালনের পদ্ধতি হিসেবে গোশালা বা গোয়াল ঘর ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বাড়ির কাছাকাছি একটি উঁচু জায়গায় গোশালা নির্মাণ করা উচিৎ। এর ফলে দুর্গন্ধ ও গরুর মলমূত্র পাশাপাশি বসবাসকারী কোন মানুষের সমস্যার সৃষ্টি করবে না।

গরু, মহিষ ও ছাগলের বাসস্থান

গরুর আদর্শ গোশালার স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথাযথ নর্দমা ও পয়ঃপ্রনালীর ব্যবস্থা, লোকালয় থেকে দূরে, উত্তরদক্ষিণমুখী ঘর এবং চারণভূমির সুবিধার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। গরুর বাসস্থান নির্মাণের জন্য কতিপয় বিষয় বিবেচনা করা উচিৎ। যেমন—

* গোশালাটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে সহজেই প্রচুর আলো—বাতাস চলাচল করতে পারে।

* গোশালা শুষ্ক ও উচু জায়গায় তৈরি করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে না পারে।

* ঘরের মেঝে পাকা ও ইট বিছানো হলে ভালো হয়।

* মেঝের পিছনের দিকে একটু ঢালু রাখতে হবে যাতে গোবর ও মূত্র খুব সহজেই নালায় চলে যেতে পারে।

* গোশালা যেন সহজেই পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন করা যায় এবং পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা থাকে।

* গোশালার চারিদিকে ঝোপজঙ্গল থাকা ঠিক নয়।

* বিশ্রাম করার জন্য গোশালায় প্রয়োজনীয় জায়গার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

* গোশালা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা গরুর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়।

* গোশালায় একই সাথে খাদ্য পরিবেশন, মলমূত্র নিষ্কাশন, আরাম—আয়েস, যত্ন ও পরিচর্যার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বাসস্থান নির্মাণ

গরুর বাসস্থান নিমার্ণের ক্ষেত্রে যেসকল বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত তা হলো— * গোশালার উচ্চতা ৯—১০ ফুট বা ২.৭৫—৩.০ মিটার হতে হবে।

* খাদ্য সরবরাহের জন্য চাড়ি এবং পানির পাত্র থাকতে হবে।

* প্রতিটি চাড়ি ও পানির পাত্রের পরিমাপ যথাক্রমে ৩ ফুট  ৪ ফুট এবং ১ ফুট  ২ ফুট হওয়া উচিত।

* প্রতিটি গরুর জন্য আড়পাতা থাকতে হবে যাতে করে গরু বেঁধে রাখা যায়।

* খাবারের চাড়ি পাকা কনক্রিট ও আড়পাতা মসৃণ লোহার রড বা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা করতে হবে। * মেঝে কোনক্রমেই পিচ্ছিল হওয়া চলবে না।

* প্রতিটি গরুর জন্য ৫ বর্গ মিটার জায়গাই যথেষ্ট।

 

ছাগলের বাসস্থান:

অন্যান্য প্রাণীদের মতো ছাগলেরও রাত্রি যাপন, নিরাপত্তা, ঝড়বৃষ্টি, ঠান্ডা, রোদ ইত্যাদির কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাসস্থানের প্রয়োজন রয়েছে। তবে, এদেশের গ্রামাঞ্চলে পারিবারিক পর্যায়ে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে বাসস্থানের জন্য তেমন কোনো আলাদা ব্যবস্থা দেখা যায় না। গোয়াল ঘর বা গোশালায় গরু মহিষের পাশাপাশি, ঘরের বারান্দা, রান্নাঘর প্রভৃতি স্থানে ছাগলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ছাগলের বাসস্থান বা ঘর তৈরির পূর্বশর্তগুলো হচ্ছে— * শুষ্ক পরিবেশ ও আবহাওয়ায় ঘর তৈরি করতে হবে।

* ঘরটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে সহজেই প্রচুর আলো—বাতাস চলাচল করতে পারে ।

* ঘর কোনোক্রমেই স্যাঁতস্যাঁতে হওয়া চলবে না।

* ঘরটি মজবুত ও আরামদায়ক হওয়া চাই।

* ঘর যেন সহজেই পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন করা যায় এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকে।

ছাগলের ঘর:

ছাগল পালনের জন্য বিভিন্নভাবে ঘর তৈরি করা যায়। যেমন— ১. ভূমির উপর স্থাপিত ঘর ও ২. খঁুটির উপর স্থাপিত ঘর। ভূমির উপর স্থাপিত ঘরে গ্রামের সাধারণ গৃহস্থরা ছাগল পালন করে থাকেন। এই ধরনের ঘরের মেঝে কাঁচা অথার্ৎ মাটি দিয়ে, আধা পাকা অথার্ৎ শুধু ইট বিছিয়ে অথবা সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে তৈরি করা যায়। খুঁটির উপর স্থাপিত ঘর সাধারণত মাটি থেকে ৩.৩—৪.৯ ফুট (১.০—১.৫ মিটার) উচ্চতায় খুঁটির উপর তৈরি করা হয়। এ ধরনের ঘর ছাগলকে মাটির স্যাঁতস্যাঁতে ভাব, বন্যার পানি, নালা—নর্দমা থেকে চোয়ানো পানি প্রভৃতি থেকে রক্ষা করে।

ছাগলের ঘরের মেঝে বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে মাঁচার মতো করে তৈরি করা হয়। দু’ধরনের ঘরই একচালা, দোচালা বা চৌচালা হতে পারে এবং ছাগলের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে তা ছোট বা বড় হতে পারে। ছাগলের বয়স এবং আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। একটি পূর্ণ প্রাপ্ত বয়স্ক ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের জন্য ২.৫ ফুট  ১৪.৭৫ ফুট  ১৫.৭৫ ফুট জায়গার প্রয়োজন হয়। প্রতিটি পাঠার জন্য খোপের মাপ হলো ৭.৯ ফুট  ৫.৯ ফুট। গর্ভবতী ছাগলের জন্য আলাদা প্রসূতি কক্ষের ব্যবস্থা থাকা উচিত।

মহিষের বাসস্থান মহিষ পালনের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের প্রয়োজন। পারিবারিকভাবে মহিষ পালনের ক্ষেত্রে বাসস্থান বা ঘরের ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। তবে খামারভিত্তিতে একসঙ্গে অনেক মহিষ পালন করতে হলে ঘর তৈরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহিষের ঘর গরুর ঘর তৈরির মতোই। তবে ঘর তৈরিতে মজবুত অথচ দামে কম এরূপ জিনিসপত্র ব্যবহার করা উচিত।

একমাস বয়সি একটি বাছুরের জন্য ১.০ মিটার  ১.৫ মিটার জায়গার প্রয়োজন হয়। গ্রামাঞ্চলে বকনা মহিষ অন্যান্য মহিষের সঙ্গে একই ঘরে বা গোয়ালে রাখা হয়। তবে সাধারণত প্রতিটি অগর্ভবতী বকনা মহিষের জন্য ৫—৬ বর্গ মিটার উদোম/ছাদবিহীন স্থান; ১.০—১.৫ বর্গ মিটার ছাদযুক্ত স্থান ও ৪০—৫০ সে.মি. দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট চাড়ি প্রয়োজন। প্রতিটি গর্ভবতী বকনার জন্য ৮—১০ বর্গ মিটার উদোম/ছাদবিহীন স্থান; ৩—৪ বর্গ মিটার ছাদযুক্ত স্থান ও ৫০—৭৫ সে.মি. দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট চাড়ি প্রয়োজন। অনুরূপভাবে একটি পূর্ণবয়স্ক ষাঁড় মহিষের জন্য ১০—১২ বর্গ মিটার আয়তনবিশিষ্ট ছাদযুক্ত ঘরের প্রয়োজন। মহিষের ঘর তৈরিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা উচিত।

* ঘর স্বাস্থ্যসম্মত ও আরামপ্রদ হবে।

* ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকবে।

* মেঝে মজবুত হবে তবে তাতে পিচ্ছিল ভাব থাকবে না। * উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে।

 

ছাগলের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য

ছাগলের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য – কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের এই পাঠটি ১১ নং ইউনিটের ১১.৫ নং পাঠ। এই পাঠে আমরা বিভিন্ন ধরণের ছাগলের জাত ও তদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো।

ছাগলের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য

 

 

ছাগলের জাত ও বৈশিষ্ট্য ছাগল গৃহপালিত প্রাণি । বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ছাগল পালন বেশ লাভজনক। গ্রামে-গঞ্জে প্রায় ৬০% পরিবার ছাগল পালন করে থাকে। ছাগলকে গরিবের গাভী বলা হয়। এরা ছোট প্রাণি বলে দাম কম, তাই অল্প খরচে পালন করা যায়। তাছাড়া মূলধন বিনিয়োগ কম।

এরা ছোবড়া ও নিকৃষ্ট মানের খাদ্য গ্রহণ করে পুষ্টিসাধন করে থাকে। যার গাভী কেনার ও পালনের সামর্থ নেই সে অল্প পুঁজিতে দুটি ছাগল কিনে অধিক লাভবান হতে পারে। যে বেকার সেও ছাগল পালন করে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। গাভী থেকে একটি বাহুর পেতে এক বছরের বেশি সময় লাগে। কিন্তু ছাগল হুমাসে একই সঙ্গে কমপক্ষে দুটি বাচ্চা দেয়। এ হিসেবে দুটি ছাগল থেকে বছরান্তে ন্যূনতম আটটি বাচ্চা পাওয়া সম্ভব। এদের লালন-পালন খরচ অনেক কম। ছাগলের মাংস ও চামড়া দুই ই উৎকৃষ্ট। শুধু চামড়া রপ্তানি থেকে বছরে আয় হয় কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের দেশে বর্তমানে ২৫.১২ মিলিয়ন ছাগল আছে। (এআইএস, ২০১৩)।

ছাগলের জাতের শ্রেণীবিভাগ:

ছাগলের জাতকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যেমন—

১. উৎপত্তি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ

২. দেহের আকৃতিভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ

৩. উৎপাদনভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ

৪. জন্মগত ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ

৫. শিংয়ের গঠনের ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ

 

এদের আকার, আকৃতি, স্বভাব ও উৎপাদন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ছাগলকে সাধারণত দুধ, মাংস, চামড়া ও লোম উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। তাই এগুলোর ওপর ভিত্তি করে পশু বিজ্ঞানীরা ছাগলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-

  • দুধ উৎপাদনকারী জাতের ছাগল- এরা অধিক দুধ উৎপাদন করে। যেমন- সানেন, বারবারি, টোগেনবার্গ ইত্যাদি।
  • বাচ্চা উৎপাদনশীল জাতের ছাগল- এরা অধিক বাচ্চা উৎপাদন করে। যেমন- ব্ল্যাক বেঙ্গল, কাজাং ইত্যাদি।
  • চামড়া উৎপাদনকারী জাতের ছাগল- এরা উত্তমমানের চামড়া উৎপাদন করে। যেমন- ব্ল্যাক বেঙ্গল, মারাডি ইত্যাদি।
  • মাংস উৎপাদনকারী জাতের ছাগল- এরা উন্নতমানের মাংস উৎপাদন করে। যেমন- ব্ল্যাক বেঙ্গল, মা-টু ইত্যাদি।

 

উৎপাদন বৈশিষ্ট্য, উৎপত্তি ও আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে ছাগলের জাতের শ্রেণিবিন্যাস

 

 

 

উৎপত্তি অনুসারে শ্রেণিবিভাগ :

 

১। দেশি জাতের ছাগল ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল :

বাংলাদেশ, ভারতের আসাম ও মেঘালায়ে এ ছাগল দেখতে পাওয়া যাায়। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব জাত। এ জাতের ছাগলের মাংস সুস্বাদু ও জনপ্রিয়। ছাগল সাধারণত কালো রঙের হয়ে থাকে, তবে সাদা ও বাদামি রঙের ছাগলও দেখা যায়।

এরা সাধারণত আকারে ছোট হয়। এদের কান সোজা ও খাড়া। শিং পিছনের দিকে বাঁকা থাকে। গায়ের রং সাধারণত কালো, তবে ধুসর, বাদামি বা সাদা বা কালো মিশ্রিতও হয়ে থাকে।

গায়ের লোম ছোট ও মসৃণ। এ জাতের ছাগলের মাংস ও চামড়া অত্যন্ত উন্নতমানের। এদের দুধ খুবই অল্প হয়। তবে এরা বছরে দুই বার এবং প্রতিবারে অন্তত দুইটি বাচ্চা দেয়। এদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এ জাতের একটি পুর্ণ-বয়স্ক পাঠার ওজন ২৫-৩০ কেজি এবং ছাগীর ওজন ১৫-২০ কেজি হয়ে থাকে।

 

অর্থনৈতিক দিক থেকে এই জাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উৎকৃষ্টমানের চামড়া ও মাংস উৎপাদন, অধিক সংখ্যক বাচ্চা দেয়া এবং প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতার জন্য এরা সুপরিচিত। বছরে দু’বার এবং একরে ২- ৬টি বাচ্চা দেয়ার দৃষ্টান্ত এদের রয়েছে। দ্রুত বংশ বিস্তারে এই ছাগলের জুড়ি নেই। এদের চামড়া বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়।

চামড়ায় তৈরি জুতো ও অন্যান্য সামগ্রী অত্যন্ত আকর্ষণীয়, আরামদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী বলে স্বীকৃত। এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে বেশি। এরা আকারে ছোট, ছুট বরাবর উচ্চতা মাত্র ১৫ সেমি। পূর্ণব্যস্ত ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে গড়ে ১৩ ও ৯ কেজি। দেহের লোম খাটো, সুবিন্যাস্ত্র, রেশমি ও কোমল। এরা দ্রুত বয়প্রাপ্ত হয়। এদের পা খাটো, কান খাড়া। শিং আকারে ছোট ও কালো এবং ৫-১০ সে.মি. লম্বা হয়।

১৫ মাস বয়সে প্রথমবার বাচ্চা দেয়। এদের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম, দুয়ের অধিক বাচ্চা হলে দুধের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে বাচ্চা অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগে ও মারা যায়। এদের উৎপত্তি সম্বন্ধে তেমন কোনো তথ্য জানা যায় নি। তবে, স্মরণকাল থেকেই এরা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশে এরা কালো ছাগল বলে পরিচিত। এক মাসের দোহনকালে ছাগী ২৫-৩০ লিটার দুধ দেয়। এই দুধ শিশু ও দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য খুবই উপকারী।

 

বৈশিষ্ট্য:

১. ছাগী বছরে দুবার এবং প্রতিবারে দুই বা ততোধিক বাচ্চা দেয়।

২. দেহের গড়ন আঁটোসাঁটো, পা খাটো।

৩. কান ছোট, সোজা এবং কিছুটা উপরের দিকে থাকে।

৪. ছাগলের মাংস এবং চামড়া উন্নত মানের হয়।

৫. শিং ছোট ও কালো এবং ৫—১০ সেমি লম্বা হয়।

৬. শিং ওপর দিক হতে পিছনে বাঁকানো থাকে।

৭. পুরুষ ও স্ত্রী ছাগলের ওজন যথাক্রমে ২৫—৩৫ কেজি এবং ২০— ৩০ কেজি।

৮. সুষম খাদ্য ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ০.৫—১.০ লিটার দুধ পাওয়া যায়।

৯. প্রথম বাচ্চা প্রসব করার বয়স হচ্ছে ১৩—১৪ মাস।

১০. লোম মসৃণ এবং মোলায়েম।

 

 

২। বিদেশি জাতের ছাগল :

বাংলাদেশে যেসব বিদেশি জাতের ছাগল পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে— যমুনাপাড়ি, বিটল, সানেন, টোগেনাবার্গ, অ্যালপাইন ও অ্যাংলোনোবিয়ান উল্লেখযোগ্য। বিটল জাতের ছাগল পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছে। অ্যাংলোনোবিয়ান জাতের ছাগল ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ থেকে আনা হয়েছে। সানেন ও অ্যালপাইন এর উৎপত্তিস্থল সুইজারল্যান্ড।

যমুনাপাড়ি ভারতের গঙ্গা, যমুনা ও চম্বল নদীর মধ্যবতীর্ এটাওয়া জেলায় এ জাতের ছাগলের আদি বাসস্থান। এরা রামছাগল নামেই বেশি পরিচিত। এটি দুধ উৎপাদনকারী জাত। আমাদের দেশের সীমান্তবতীর্ এলাকায় এ জাতের ছাগল দেখা যায়। এরা খোলা জায়গায় থাকতে পছন্দ করে।

 

বৈশিষ্ট্য:

১. গায়ের রঙ সাদা, কালো, হলুদ, বাদামি বা বিভিন্ন রঙের মিশ্রণযুক্ত হয়।

২. শরীরের গঠন বেশ হালকা—পাতলা ও লম্বাকৃতির।

৩. পা লম্বাটে এবং পিছনের পায়ে লম্বা ঘন লোম থাকে।

৪. পুরুষ ছাগলের দাড়ি থাকে, স্ত্রী ছাগলের কদাচিৎ থাকে।

৫. এরা মাঠে চরে জীবনধারন করতে পছন্দ করে।

৬. পেছনের পায়ের দিকটায় লম্বাটে চুল থাকে।

৭. লেজ ছোট ও সরু এবং কান লম্বা, চ্যাপ্টা, বাঁকা ও ঝুলন্ত।

৮. শিং ছোট ও চ্যাপ্টা এবং লেজ ছোট ও পাতলা।

৯. বছরে একবার এবং ১টি করে বাচ্চা দেয়।

১০. দৈনিক ১.৫—২.০ লিটার দুধ পাওয়া যায়। চিত্র ১১.৫.২ : যমুনাপাড়ি

১১. পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ৬৫—৯০ কেজি এবং ৪০—৬০ কেজি।

১২. ঘাড় ও মুখমন্ডলে হালকা বাদামি বর্ণের ছোপ থাকে।

১৩. ওলান বেশ বড় এবং বাটগুলো মোটা, লম্বা, সুসজ্জিত এবং সম আকারের।

১৪. দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।

 

যমুনা পাড়ি ছাগল বা রামছাগল

ভারতের যমুনা ও চম্বল নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এদের উৎপত্তি। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এ ছাগল পালন করা হয়। এদের শরীরের রঙ সাদা-কালো, তামাটে বা বাদামী রঙের হয়। এর আকারে বেশ বড়।

এদের শরীরের গঠন হালকা ও লম্বাটে। কান লম্বা ঝুলানো ও বাঁকা। এদের শরীরের লোম লম্বা হয়। এ ছাগল বছরে একবার এবং একটি করে বাচ্চা দেয়। এ জাতের ছাগল দুধের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এরা দৈনিক ২-৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। এ জাতের একটি পূর্ণ বয়স্ক পাঠা ৫০-৬০ কেজি এবং ছাগী ৪০-৫০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে ।

এরা ভারতের একটি জনপ্রিয় ছাগল যা দুধের জন্য ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিচিত। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহে আজকাল এই জাতের কিছু ছাগল দেখা যায়। এরা আকারে বড়, কান লম্বা ও ঝুলন্ত। এদের দেহের রঙ সাদা, কালো, হলুদ, বাদামি বা বিভিন্ন রঙের মিশ্রণযুক্ত হতে পারে। ওলোনগ্রন্থি সুবিন্যস্ত এবং বড় ও লম্বা বাটমুক্ত।

পা খুব লম্বা; পেছনের পায়ের পেছন দিকে লম্বা লোম আছে। দেহের অন্যান্য স্থানের লোম সাধারণত ছোট। এরা অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু ও চঞ্চল বছরে একবার এবং একটির বেশি বাচ্চা দেয় না। পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ৬৮-৯১ ও ৩৫-৬০ কেজি। এদের শিং খাটো, চ্যাপ্টা ও ২৫-৩০ সে.মি. লম্বা।

ছাগল ও ছাগীর উচ্চতা যথাক্রমে ১১-১২৭ ও ৭৬-১০৭ সেমি। দুধ উৎপাদন ২১৬ দিনে সর্বোচ্চ ১৩৫ লিটার। দৈনিক উৎপাদন গড়ে ৩২ লিটার। ভারতে এদেরকে গরীবের গাडী বলা হ থাকে। এই ছাগলের মাংস ও চামড়া তেমন উন্নতমানের নয়। এরা চরে খাওয়ার জন্য খুবই উপযোগী। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তাদের নিজস্ব ছাগলের সঙ্গে সংকরায়নের জন্য ভারত থেকে যমুনাপারি ছাগল আমদানি করেছে।

 

সানেন ছাগল :

সানেন জাতের ছাগলের উৎপত্তি সুইজারল্যান্ডের পশ্চিমাংশে। পৃথিবীর যেকোন দেশের আবহাওয়া এবং পরিবেশ এ জাত খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

 

সানেন ছাগল

 

এদের দেহ সাদা বা উজ্জ্বল সাদা খাটো লোমে আবৃত। গলা, কান ও ওলানে কালো দাগ থাকে। সাধারণত শিং থাকে না। এদের পা ছোট, কান সোজা ও সম্মুখমুখী এবং ওলান বড়। ছাগলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে এরা সর্বোচ্চ পরিমাণ দুধ দেয়। পৃথিবীর বহু দেশ, যেমন- অস্ট্রেলিয়া, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, ভারত, ফিজি, ঘানা, কেনিয়া, কোরিয়া, ইসরাইল, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে এই জাতের ছাগল আমদানি করা হয়েছে। পৃথিবীর যে কেনো অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে এরা নিজদের খাপ খাওয়াতে পারে। এরা দৈনিক ৩.০-৩.৫ লিটার দুধ দেয়। এক দোহনকালের ৩৩৬ দিনে ১৯০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিতে সক্ষম।

জাতের ছাগল সুইজারল্যন্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাওয়া যায়। এরা আকারে বেশ বড়। গায়ের রঙ বাদামি বা চকোলেট হয়। দু’পায়ের হাটুর নিচ ও মুখমণ্ডলে সাদা দাগ থাকে। গলা লম্বা, হালকা ও সোজা, কান কালো রঙের কিন্তু ঘাড়ের দিকে সাদা। ছাগল ও ছাগী কারোই শিং থাকে না। ছাগী দৈনিক ৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। ভারত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে দুধের জন্য এদের পালন করা হয়। এরা মাঠে চরে খেতে পছন্দ করে। পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ৬০-৬৫ ও প্রায় ৭০ কেজি হয়।

 

বৈশিষ্ট্য:

১. দেহ সাদা বা উজ্জল সাদা লোমে আবৃত।

২. গলা, কান ও ওলানে কালো দাগ থাকে।

৩. সাধারণত শিং থাকে না থাকলেও ছোট।

৪. এদের পা ছোট, কান সোজা এবং ওলান বড়।

৫. ছাগলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে এরা সবোর্চ্চ পরিমাণে দুধ দেয়।

৬. পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে এরা খাপ খাওয়াতে পারে।

৭. এরা দৈনিক ৩.০—৩.৫ লিটার দুধ দেয়।

৮. ওলান গ্রন্থি বেশ বড় হয়।

৯. দুধে চর্বির পরিমাণ ৩.৫%।

১০. পূর্ণবয়স্ক ছাগল ৬০—৭০ কেজি।

১১. কান সোজা এবং সম্মুখ মুখি।

১২. বছরের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কমবেশি ৯৯০ লিটার।

 

বিতাল / বিটল ছাগল :

বিটল ভারত ও পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাগলের জাত। এরা দেখতে অনেকটা যমুনাপাড়ির মতো। এটি দুগ্ধ উৎপাদনকারী জাত। এ জাত আবদ্ধ ঘরে পালনের জন্য উপযোগী এবং এরা সহজেই বিভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে। ভারতের পাঞ্জাব, শিয়ালকোট, গুরুদাসপুর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোর এবং বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে পালন করা হয়।

এ জাতের ছাগল কালো, সাদা, বাদামি বা একাধিক রঙের হতে পারে। এদের কান লম্বা হয়। শিং পিছনের দিকে বাঁকা। পূর্ণ বয়সে পাঁঠার ওজন ৫০-৭০ কেজি এবং ছাগী ৪০-৫০ কেজি হয়ে থাকে। এ জাতের ছাগল থেকে দৈনিক ৪-৫ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়।

এই ছাগলের গায়ের রঙ প্রধানত লাল; তবে, লালের মধ্যে সাদা দাগ দেখা যায়। তাছাড়া কালো রঙের ছাগলও ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং অন্ধ্র প্রদেশে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়। এদের নাক বাঁকা ও কান লম্বা। ছাগলের দাড়ি আছে, ছাগীর নেই। শিং পেছনের দিকে বাঁকানো। ছাগী দৈনিক গড়ে ৪৫ লিটার এবং এক দোহনকালের ১৩৩ দিনে ৩২০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিতে সক্ষম। এরা মাংস উৎপাদনের জন্যও বিখ্যাত। প্রতি বছর বাচ্চা দেয়। এই জাতের ছাগল খুব কষ্টসহিষ্ণু এবং প্রতিকূল পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।

 

 

বৈশিষ্ট্য

১. গায়ের রং প্রধানত লাল, তবে লালের মধ্যে সাদা দাগ দেখা যায়।

২. আকারে বড় হয়, তবে যমুনাপাড়ির চেয়ে কিছুটা ছোট।

৩. পা লম্বা হয়, কান লম্বা এবং ঝুলানো থাকে।

৪. ছাগল বছরে একবার এবং ১ জোড়া বাচ্চা দেয়।

৫. এরা দুধ বেশি দেয়। একটি ছাগী হতে দৈনিক ৩—৪ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়।

৬. পুরুষ ছাগলের দাড়ি থাকে কিন্তু ছাগীর দাড়ি নেই।

৭. এরা ২০—২২ মাস বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।

৮. পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ৬৫ কেজি ৪৫ চিত্র ১১.৫.৩ : বিটল কেজি।

৯. এদের নাক বাঁাকা এবং শিং পেছনের দিকে বাঁকানো।

 

কাশ্মীরি ছাগল :

কাশ্মীরি ছাগল  ভারতের কাশ্মীর এদের আদি বাসস্থান। এরা বেশ বড় ও কষ্টসহিষ্ণ হয়। এ জাতের ছাগল লোম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এদের শরীর ১০-১২ সে.মি. লম্বা লোমে ঢাকা থাকে। এদের ওজন ৫০-৬০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের লোম দিয়ে উন্নতমানের পশমী কাপড় তৈরি হয়। ছাগলের বাসস্থান অন্যান্য প্রাণীর মত ছাগলেরও বাসস্থানের প্রয়োজন।

 

 

কাশ্মীরি ছাগল

 

বৈশিষ্ট্য:

১. গরম আবহাওয়া সহ্য করতে পার না।

২. গায়ের রঙ সাধারণত সাদা, তবে ধূসর ও বাদামি বর্ণের ছাগল দেখা য়ায়।

৩. শিং লম্বা এবং পেছনের দিকে বাঁকানো। কান ছোট, খাড়া, ফানেলের মতো।

৪. দেহ মোলায়েম সিল্কজাতীয় লোমে আচ্ছাদিত থাকে। এ লোমের নিচে ছাই রঙের পশমিনা থাকে। এ পশমিনা মোটা কম্বল ও শাল তৈরির কাজে লাগে।

৫. এরা ২২ মাস বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।

 

অ্যাংগোরা বা অ্যাঙ্গোরা ছাগল:

অ্যাংগোরা ছাগল এদের আদি বাসস্থান তুরস্ক। তবে কোন কোন সোর্স বলে আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া এদের আদি বাসস্থল। লোম ও মাংস উৎপাদনের জন্য এরা সুপরিচিত। এদের শরীর লম্বা লোমে ঢাকা থাকে। এটি উন্নতমানের পশম উৎপাদনকারী জাতের ছাগল। এর পশমকে মোহেয়ার বলা হয়। এই জাতের ছাগলের উৎপত্তি মধ্য এশিয়ায়। ১৩০০ শতাব্দিতে তুরস্কের অ্যাংগোরা প্রদেশে এই ছাগল আনা হয়। ফলে ঐঐ প্রদেশের নামানুসারে এর নামকরণ হয় অ্যাংগোরা। ১৮৩৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ১৮৪৯ সালে আমেরিকা এই ছাগল তুরস্ক থেকে আমদানি করে তাদের দেশে নিয়ে যায় এবং মূল্যবান মোহেয়ারের শিল্প গড়ে তোলে। তুরস্কের সুলতান ১৮৮১ সালে এই জাতের ছাগল যাতে বিদেশে রপ্তানি না হয় সেজন্য এক আইন পাশ করেন।

বর্তমানে নিজস্ব জাতের সাথে সংকরায়নের জন্য ভারত, পাকিস্তান, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এই জাতের ছাগলের বিস্তৃতি ঘটেছে অ্যাংগোরা ছোট আকারের ছাগল। উচ্চতায় ৫৪ সেমি, কান কিছুটা ঝুলন্ত। ছাগল ও ছাগী উভয়ই দেখতে খুব চকচকে ও গুচ্ছ লোমযুক্ত। এরা নিয়মিত বাচ্চা দেয়; তবে, বছরে একবার এবং সাধারণত দু’টির বেশি নয়। ছাগল ও ছাগীর দৈহিক ওজন যথাক্রমে ৬৫-৮৫ ও ৪০-৪৫ কেজি। প্রতি দোহনকালে ছাগী ২০-২৫ লিটার করে দুধ দেয়। এরা বছরে ১৫-২০ কেজি পশম উৎপাদন করে। তবে, কোনো কোনো ছাগল ৩ কেজির বেশিও উৎপাদন করে থাকে। এই পশম বছরে দু’বার সংগ্রহ করা হয়।

 

অ্যাঙ্গোরা ছাগল

 

বৈশিষ্ট্য:

১. এদের লোম বেশ বড়, প্রায় ১৩—২৫ সেমি লম্বা ও উজ্জ্বল।

২. দুধ উৎপাদন কম, গড়ে দৈনিক ৪০০মিলি।

৩. দুধে চর্বিও পরিমাণ ৫.৭%।

৪. এরা প্রতিবারে ১টি বাচ্চা দেয়।

৫. এদেরকে লোমের জন্য প্রধানত পালন করা হয়।

 

দেহের আকৃতিভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ:

ছাগলের স্কন্ধ পর্যন্ত উচ্চতার ভিত্তিতে ছাগলের জাতকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—

১. বড় জাতের ছাগল: যেমন— অ্যাংগোরা, বিটল, যমুনাপাড়ি ইত্যাদি।
২. ছোট জাতের ছাগল: যেমন কিলিস, ফিজি ইত্যাদি
৩. বামন জাতের ছাগল: যেমন— সুদান, ব্ল্যাক বেঙ্গল ইত্যাদি

 

বারবারি ছাগল :

এটি আফ্রিকা মহাদেশের ছাগল। তবে বর্তমানে ভারতীয় উপ মহাদেশেও এ জাতের ছাগল পাওয়া যায়। মাংস ও দুধের জন্য এরা যমুনা পাড়ি ছাগলের অনুরূপ।

 

বারবারি ছাগল

 

আলপাইন ছাগল:

সানেন এটি উজ্জ্বল সাদা সাদা লোমে ঢাকা ইউরোপীয় জাতের ছাগল। এদের শিং আকারে বেশ বড় হয়। এ জাতের ছাগল দৈনিক ৪-৫ লিটার দুধ দিয়ে থাকে। এটি অধিক দুধ উৎপাদনকারী জাতের ছাগল। এদের উৎপত্তিস্থল সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতের পাদদেশে। ইউরোপের সর্বত্র এই জাতের ছাগল দেখতে পাওয়া যায়। এরা আবদ্ধাবস্থায় খামারে পালনের জন্য খুবই উপযোগী এবং যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে সহজেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।

এদের দেহের রঙ কালো তবে সাদা ডোরাকাটা দাগ বা সাদা, কালো ও বাদামি ইত্যাদি রঙের মিশ্রণও হতে পারে। বর্তমানে ভারত, মরিসাস, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ঘানা, মাদাগাস্কার, ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রভৃতি দেশে এই ছাগল খামারে প্রতিপালিত হচ্ছে। ছাগী দৈনিক ৪-৫ লিটার দুধ দেয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এসব ছাগলের দুধ থেকে বহুবিধ দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হয়।

 

 

আলপাইন ছাগল

 

 

এংলো নুবিয়ান ছাগল :

এটি একটি সংকর জাতের ছাগল। যমুনা পাড়ি ও মিশরীর জেরিবাই সাথে সংমিশ্রনে এ জাতের উৎপত্তি। ভারতের যমুনাপারি ও মিশরের জারাই বাই জাতের ছাগল হতে এই জাতের উৎপত্তি। চেহারা ও দুগ্ধ উৎপাদনে এদের জুড়ি নেই। দেহের রঙ সাদা, কালো, বাদামি বা মিশ্র হতে পারে। কান ঝুলন্ত এবং সাধারণত শিং থাকে না।

পা লম্বা ও ওলান বড়। সুইজারল্যান্ডে উদ্ভাবিত নুবিয়ান ছাগলের চেয়ে এরা বেশি দুধ দিয়ে থাকে। অ্যাংলো নুবিয়ান থেকে দুধ ও মাংস দু’টোই অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। এরা চরে খেতে ভালোবাসে কিন্তু আবদ্ধ অবস্থায় পালন করার জন্যও বিশেষ উপযোগী। এরা অতি সহজে পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। ছাগী দৈনিক ২-৩ লিটার দুধ দেয়। বাচ্চার জন্ম ওজন ২-৪ কেজি। ছাগী ২৪৭ দিনের দোহনকালে প্রায় ২২১ লিটার দুধ দিতে সক্ষম।

 

এংলো নুবিয়ান ছাগল

 

 

মারাডি ছাগল (Maradi)

এটি আফ্রিকার একটি উন্নত জাতের ছাগল। এদের গায়ের রঙ ঘন লাল। ছাগল ও ছাগী কারোরই শিং নেই। গায়ের লোম ছোট, কান খাটো এবং সমান্তরাল। এরা ছোট আকারের, ওজন গড়ে ২৫-৩০ কেছি। এরা শুষ্ক অঞ্চলে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। এদের বিস্তৃতি আফ্রিকার মধ্যেই। এই ছাগলের চামড়া উন্নতমানের ও মূল্যবান। অধিক মাংস উৎপাদনের জন্য এই ছাগল পরিচিত। এমনিতে দৈনিক গড়ে ৭.৫ কেজি ও উন্নত ব্যবস্থাপনায় ১৫ কেজি দুধ দেয়। সাধারণত দু’বছরে ৩- ৪ বার বাচ্চা দেয়। দোহনকালের ১০০ দিনে প্রায় ১৫০ লিটার দুধ দেয়। এরা সারাবছরই প্রজননক্ষম থাকে।

 

 

বোয়ার ছাগল:

এই জাতের পুরুষ ছাগলের ওজন ১০০ থেকে ১৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই জাতের স্ত্রী ছাগলের ওজন ৯০ থেকে ১২০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এই জাতের ছাগলের ওজন প্রতি সপ্তাহে প্রায় দুই কেজি করে বাড়ে। বাংলাদেশে এই জাতের ছাগল খুব একটা দেখা যায় না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে এই ছাগল অধিক পরিমানে পালন করা হয়।

 

মা-টু ছাগল (Ma-Tou)

এটি মধ্য চীনের দুপেছ প্রদেশের একটি উন্নত জাতের ছাগল। অধিক সংখ্যায় বাচ্চা উৎপাদন এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতি ১০০টি ছাগী বছরে প্রায় ৪৫০টি বাচ্চা দিয়ে থাকে। এরা বছরে দু’বার বাচ্চা দেয়। এর মধ্যে ২১.৭% ক্ষেত্রে একটি বাচ্চা, ৭০% ২-৩টি বাচ্চা এবং ৮.৩% ৪টি বাচচা দেয়।

এই জাতের ছাগল দুধ ও মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ২৫-৫৫ ও ২০-৪৫ কেজি। ছাগীর দৈনিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ১.৫ লিটার। এদের পশমের রঙ সাদা, এগুলো লম্বা বা খাটো হতে পারে। এদের পা খুবই লম্বা এবং ছাগল বা ছাগী কারোই শিং নেই।

 

উৎপাদনভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ :

উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে ছাগলের জাতকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—

১. মাংসল জাতের ছাগল: যেমন— ব্ল্যাক বেঙ্গল

২. দুধের জাতের ছাগল: যেমন— যমুনাপাড়ি

৩. পশম জাতের ছাগল: যেমন— গাড্ডি, অ্যাংগোরা

৪. দ্বৈত জাত: যেমন— ব্ল্যাক বেঙ্গল

৫. চামড়া উৎপাদক জাত: যেমন— ব্ল্যাক বেঙ্গল

 

জন্মগত ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ :

জন্মস্থানের ওপর ভিত্তি করে ছাগলের জাতকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়।

১. এশিয়ান ছাগল: যেমন— যমুনাপারি

২. আফ্রিকান ছাগল: যেমন— মারাডি

৩. ইউরোপিয়ান ছাগল: যেমন— সানেন

৪. ওরিয়েন্টাল ছাগল: যেমন— মালাবার

 

 

বিভিন্ন জাতের ছাগলের বৈশিষ্ট্যগুলো জানার ব্যবহারিক পাঠ:

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বিভিন্ন জাতের ছাগলের বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের আকার, আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বলতে পারবেন।
  • ব্ল্যাক বেঙ্গল এবং যমুনাপারি ছাগলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন।

 

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্যসমূহ

প্রাসঙ্গিক তথ্য

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশের একটি অমূল্য সম্পদ। উন্নতমানের মাংস ও চামড়া উৎপাদন এবং ঘন ঘন ও অধিক সংখ্যায় বাচ্চা উৎপাদনের জন্য এই ছাগলের সুনাম বিশ্বজোড়া। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কান খাড়া, শিং ছোট ও কালো, চামড়া মোটা, লোমের গোড়া চামড়ার কম গভীরে প্রবিষ্ট।

প্রয়োজনীয় উপকরণ

একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।

কাজের ধাপ

  • একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেখে প্রথমে এর দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম জেনে নিন।

১. মাথা, ২. গলা ও ঘাড়, ৩ পিঠ, ৪. পাজর, ৫. পেছনের পার্শ্বদেশ বা ফ্ল্যাঙ্ক, ৬. পাছা, ৭ ওলানগ্রন্থি, ৮. পেছনের পা ও হাঁটু, ৯. দুধের বাট, ১০. ওলানের সম্মুখভাগ, ১১. দুগ্ধশিরা, ১২. সামনের পা, ১৩ চোয়াল।

  • এই নামগুলো পাঠ্যবইয়ে উল্লেখিত ছবির সাথে মিলিয়ে নিন।
  • এই জাতের ছাগলের আকার, আকৃতি, ওজন, বয়স প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করুন ও খাতায় লিখুন।
  • ব্যবহারিক খাতায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ছবি এঁকে এর দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিহ্নিত করুন।
  • ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও পুরো পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিখুন এবং শিক্ষককে দেখান।

 

ব্ল্যাক বেঙ্গল ও যমুনাপারি ছাগলের মধ্যে পার্থক্যকরণ

প্রাসঙ্গিক তথ্য যমুনাপারি ছাগল দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই জাতের ছাগলের কান লম্বা ঝুলন্ত, পা খুব লম্বা, পেছনের পায়ে লম্বা লোম আছে, শরীরের অন্যান্য স্থানের লোম ছোট।

প্রয়োজনীয় উপকরণ

একটি যমুনাপারি ও একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।

কাজের ধাপ

প্রথমে একটি যমুনাপারি ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেখে এদের দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম জেনে নিন।

  • এই দু’জাতের ছাগলের আকার, আকৃতি, ওজন, বয়স প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করুন ও খাতায় লিখুন।
  • যমুনাপারি ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্যসমুহের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য যাচাই করুন। ব্যবহারিক খাতায় পাশাপাশি যমুনাপারি ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ছবি এঁকে এদের দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিহ্নিত করুন।
  • দু’জাতের ছাগলের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও পুরো পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিখুন এবং শিক্ষককে দেখান।