Category Archives: কৃষি

কৃষি গুরুকুলের “কৃষি” সেকশন হলো জ্ঞানের ভাণ্ডার যেখানে কৃষির ইতিহাস, ঐতিহ্য, আধুনিক গবেষণা ও কৃষি বিষয়ক অথরিটি প্রবন্ধসমূহ প্রকাশিত হয়। এখানে পাঠকরা কৃষি সম্পর্কিত মৌলিক তথ্য, উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ও সমৃদ্ধ কনটেন্ট খুঁজে পাবেন।

মহিষের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য

মহিষের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য – কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের এই পাঠটি ১১ নং ইউনিটের ১১.৪ নং পাঠ। এই পাঠে আমরা বিভিন্ন ধরণের মহিষের জাত ও তদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো। মহিষ অন্যতম গৃহপালিত স্তন্যপায়ী। মহিষ মুখ্যত উত্তর গোলার্ধের এক প্রজাতি এবং চেহারায় গরুর সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে। উত্তর আমেরিকার বাইসনকে (bison) অনেক সময় মহিষ বলা হলেও প্রকৃত মহিষের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই।

 

মহিষের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের সব এলাকেতেই মহিষ পালন করা হয়ে থাকে। তবে বিশেষ নদীর চর, সমুদ্র উপকূল দ্বীপাঞ্চল এবং হাওর-বাঁওড় এলাকায় মহিষ পালন করা হয় বেশি। এদেশে গৃহপালিত মহিষের সংখ্যা প্রায় ১.৪৭ মিলিয়ন(বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৫-২০১৬)। মহিষ প্রধানত হালচাষ ও গ্রামীণ পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। তবে মহিষের দুধ ও মাংস উৎকৃষ্ট খাদ্য। এ ছাড়া মহিষের গোবর জৈব সার ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মহিষের হাড় পন্যসামগ্রী যেমন বোতাম, চিরুনি ইত্যাদি তৈরি এবং গবাদি প্রাণিখাদ্য ও সার হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

 

মহিষে জাতের শ্রেণীবিভাগ

গৃহপালিত মহিষের জাতগুলোকে আবাসস্থান ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি কওে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- জলাভূমি মহিষ বা কাদাপানির মহিষ (Swamp Buffalo) এবং নদী মহিষ বা পরিষ্কার পানির মহিষ (River Buffalo)।

 

জলাভূমির মহিষ (Swamp Buffalo ):

জলাভূমির মহিষের বুক সাধারণত চওড়া, দেহ মাংসল ও গোলাকৃতির যা দেখতে অনেকটা ব্যারেলের মতো। এদের শিং বেশ চওড়া, লম্বা ও চন্দ্রাকৃতির। ষাঁড় ও গাভীর ওজন সাধারণত যথাক্রমে ৫০০ ও ৪০০ কেজি। ষাঁড় ও গাভীর উচ্চতা

সাধারণত গড়ে ১৩৫ সে.মি, হয়ে থাকে। এদের পা খাটো এবং কপাল ও মুখমন্ডল চ্যাপ্টা। গায়ের রং গাঢ় ধূসর থেকে সাদা হয়। চামড়ার রঙ নীলচে কালো থেকে ধূষর কালো হয়ে থাকে। গলকম্বলের উপরিভাগ থেকে গলার পাদদেশে পর্যন্ত বক্রাকৃতির দাগ থাকে। এরা অত্যন্ত কম দুধ উৎপাদন করে, দৈনিক গড়ে ১ লিটারের মতো যা বাছুরের জন্যই যথেষ্ট নয়। এরা ৩৯৪ দিনে গড়ে মাত্র ৩৩৬ লিটার দুধ দিয়ে থাকে।

শারীরিক বৃদ্ধির হার কম, ফলে বয়: প্রাপ্তি বিলম্বে ঘটে; সাধারণত তিন বছরের পূর্বে পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে না। গর্ভকালে ৩২৫—৩৩০ দিন। সাধারণত নিচু কর্দমাক্ত জলাভূমিতে থাকতে পছন্দ করে, কাদায় গড়াগড়ি দেয় এবং জলাভূমি ও আইলের মোটা অঁাশজাতীয় ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এরা প্রধানত শক্তির কাজেই পটু। তাই হাল, মই ও গাড়ি টানার কাজে ব্যবহৃত হয়। দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম কিন্তু মাংসের জন্য ভালো।

 

জলাভূমির মহিষ

 

 

কোয়া কাম ও কোয়াইটুই (Kwua Cum and Kwaitui)

এই দু’জাতের মহিষ থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। কোয়াইটুই মহিষের দেহ দীর্ঘ ও প্রশস্ত। গায়ের রঙ কালো, চামড়া পুরু, মুখমণ্ডল লম্বা। গাভীর গলা সরু। উচ্চতা ও ওজন গড়ে যথাক্রমে ১৪০ সে.মি. ও ৪৫০ কেজির মতো।

কোয়াদুরে মহিষ (Kwa kui)

এরা আকারে তুলনামূলভাবে খাটো। দেহ ও গলা সরু, ঘাড় সরু, মুখমণ্ডল লম্বা। গায়ের রঙ হালকা ধূসর। উচ্চতা ও ওজন গড়ে যথাক্রমে ১৩০ সে.মি ও ৩৫০ কেজির মতো। এরা হাল-চাষ ও ভারবাহী জন্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

কোয়াইয়া (Quipra)

এই উপজাতের মহিষ ধাইল্যান্ডের মি সড টক (Mae Sod Tak) অঞ্চলে দেখা যায়। এরা আকারে ছোট। ওজন ৩০০-৩৫০ কেজির মতো। বন্য স্বভাবের কারণে এদের কদর তুলনামূলকভাবে কম।

ম্যারিড (Marid)

এই উপজাতের মহিষ মায়ানমারে দেখা যায়। মায়ানমারের সমতলভূমির মহিষ থেকে এরা আকারে ছোট। দেহের কালো লোমগুলো দীর্ঘ, সরু ও খাড়া। ধড় ও গাভীর ওজন গড়ে যথাক্রমে ৩০০ ও ৩২৫ কেজির মতো।

লাল মহিষ (Red Buffalo )

এই উপজাতের মহিষ থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে দেখা যায়। এদের দেহ ঘন ও লম্বা লাল রঙের লোমে আবৃত থাকে। তাই এদের নাম লাল মহিষ। এদের দৈহিক ওজন গড়ে সাধারণত ৩৫০ কেজি হয়ে থাকে। তবে, গায়ের রঙ, দেহের গঠন ও ব্যবহারর দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জলাভূমির মহিষের সঙ্গে ভারতের আসামের পশ্চিমাঞ্চলের মহিষের পার্থক্য দেখা যায়।

এদের গায়ের রঙ কালো। শিং অনেকটা কাস্ত্রের মতো থাকা। এরা প্রধানত দুধ উৎপাদনকারী জাত। বিজ্ঞানী মিলেণর ১৯৩৯ সালে এদেরকে নদীর মহিষ হিসেবে নামকরণ করেন। এদের উৎপত্তি ভারত ও পাকিস্তানে, কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চালেও এদের দেখতে পাওয়া যায়।

 

মনিপুরি মহিষ

 

মনিপুরি মহিষ

উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান

আসামের অন্তর্গত মনিপুর এদের আদি বাসস্থান। আসামের প্রায় সর্বত্র এবং বাংলাদেশের সিলেটে দেখতে পাওয়া যায়।

জাত বৈশিষ্ট্য:

এদের গায়ের রঙ ধূসর। এরা সুঠাম দেহের অধিকারী। মাথা অপেক্ষাকৃত ছোট। শিং বড় এবং ভেতরের দিকে বাঁকানো। এরা সব রকমের খাদ্যে অভ্যস্থ। এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ধাড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে প্রায় ৫০০ ও ৬০০ কেজি।

 

নদীর মহিষ:

নদীর মহিষের বুক প্রশস্ত, দেহ সাধারণত মাংসল ও অপেক্ষাকৃত কম গোলাকৃতির। শিংয়ের আকার ও আকৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে। ভারত এবং পাকিস্তানে নদীর মহিষের অনেকগুলো জাত দেখা যায়। মহিষ ষাড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে ৩০০-৭০০ ও ২৫০-৬৫০ কেজি হয়।

সাধারণত মহিষ ষাঁড় ও গাভীর উচ্চতা যথাক্রমে ১২০-১৫০ ও ১১৫-১৩৫ সে.মি. হয়। নদীর মহিষের দেহ তুলনামূলকভাবে লম্বা, বুকের বেড় কম, পা খাটো, মাথা ভারি, কপাল প্রশস্ত ও মুখাকৃতি লম্বা। নদীর মহিষের শিংয়ের আকার জলাভূমির মহিষের মতো নয় এবং শিংয়ের অবস্থান ঠিক কপালের একই জায়গায় নয়। এই মহিষের শিং দু’প্রকার। যথা- গোলাকৃতি ও সোজা। এরা সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র স্থানে বাস করতে পছন্দ করে এবং পানির মধ্যে দেহ ডুবিয়ে রাখে। বিভিন্ন জাতের নদীর মহিষের মধ্যে মুররা, নীলি, রাভি, সুরাটি, মেশানা, জাফরাবাদি ইত্যাদি প্রধান। এখানে নদীর মহিষের কয়েকটি জাতের উৎপত্তি, প্রাপ্তিস্থান ও বৈশিষ্ট্যাবলী উল্লেখ করা হয়েছে।

উন্নত জাতের মহিষের মধ্যে মুররা, নিলি রাভি, মনিপুরী, জাফরাবাদী, নাগপুরী, কুন্ডি, সুরাটি, টোডো, মন্ডা, সম্বলপুরী, টরাই, মেহসানা উল্লেখযোগ্য। মুররা, নিলি রাভি জাতের মহিষ সরকারী খামারে ( মহিষ প্রজনন খামার, বাগেরহাট) পালন করা হয়।

 

নীলি মহিষ :

এ জাতের মহিষের সাথে মুররা মহিষের বেশ মিল আছে। এদের অনেক বৈশিষ্ট্য প্রায় এক রকম। বিজ্ঞানীদের মতে মুররা জাত থেকেই এদের উদ্ভব হয়েছে। তবে আকার, মুখাকৃতি ও কপালের মধ্যে বেশ পার্থক্য বিদ্যমান। পাকিস্তানের মন্টগোমারি জেলার শতদ্রু নদীর উভয় পাশে এদের আদি বাসস্থান। ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নীলি জাতের মহিষ পাওয়া যায়। শতদ্রু নদীর নীল পানির বর্ণনায় এদের নামকরণ নীলি রাখা হয়েছে।

 

নীলি মহিষ

 

জাত বৈশিষ্ট্য:

এদের গায়ের ও পশমের রং কালো। কিন্তু ১০—১৫% বাদামি রঙেরও দেখা যায়। দেহাকৃতি মাঝারি ধরনের। কপাল, মুখ, থুতনি, পা এবং লেজের অগ্রভাগে সাদা চিহ্ন দেখা যায়। অনেকটা লম্বাকৃতির মাথার উপরিভাগ স্ফীত এবং দুচোখের মধ্যবর্তী স্থান একটু চাপা। ওলান এবং সিনায় মাঝে মাঝে পিঙ্গল চিহৃ দেখা যায়। শিং ছোট ও শক্তভাবে প্যাঁচানো ঘাড় লম্বা, চিকন ও মসৃণ। ওলান উন্নত লেজ লম্বা। ষাঁড় ও গাভী মহিষের গড় উচ্চতা যথাক্রমে ১৩৭ ও ১২৭ সে.মি. এবং দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১৫৭ ও ১৪৭ সে.মি.।

উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান

পাকিস্তানের মন্টগোমারি জেলার শতদ্রু নদীর উভয় পার্শ্বে এদের আদি বাসভূমি। ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নীলি জাতের মহিষ পাওয়া যায়৷ শতদ্রু নদীর নীল পানির বর্ণনায় এদের নামকরণ নীলি রাখা হয়েছে।

 

রাভি মহিষ

 

রাভি মহিষ :

এ জাতের মহিষ দুধের জন্য প্রসিদ্ধ। পাক—ভারতের অন্তর্গত রাভি নদীর উভয় পাশে^র্ এদের আদি বাসভূমি। এজন্য এদের নাম রাভি রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলা, ওকারা, মন্টগোমারি, ভারতের গুজরাট ও চিনাব নদীর উপতাকায় এবং ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে এদের পাওয়া যায়।

জাত বৈশিষ্ট্য:

রাভি মহিষ বৃহদাকৃতির দেহের অধিকারী। গাভীর মাথা মোটা ও ভারি। মাথার মধ্যভাগ উত্তল, শিং প্রশস্ত, মোটা ও কোকড়ানো। থুতনি স্পষ্ট, ওলান সুগঠিত। লেজ বেশ লম্বা এবং প্রান্তদেশে সাদা লোম আছে। গায়ের রং কালো, তবে কোনো সময় বাদামি রঙেরও হয়। ষাঁড় ও গাভী মহিষের উচ্চতা যথাক্রমে ১৩২ ও ১২৭ সেমি এবং দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১৫৪ ও ১৪৯ সেমি এবং ওজন যথাক্রমে ৬০০ ও ৬৪৫ কেজি।

 

মুররা মহিষ :

এ জাতের মহিষের উৎপত্তিস্থল ভারতের উত্তর—পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে, দিল্লির আশপাশ এলাকা। বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে এ জাতের মহিষ বেশি পাওয়া যায়। এটি দুগ্ধপ্রদানকারী বিশেষ জাত।

 

মুররা মহিষ

 

বৈশিষ্ট্য:

১. এদের দেহ আকারে বেশ বড় হয়।

২. শিং ছোট এবং বাঁকানো হয়।

৩. গায়ের রং সাধারণত কালো হয়।

৪. স্ত্রী মহিষের পিছনের তুলনায় সম্মুখ ভাগ হালকা হয়।

৫. এরা দুধের জন্য প্রসিদ্ধ।

৬. একটি গাভী মহিষ দিনে প্রায় ২২—২৭ লিটার দুধ দিয়ে থাকে।

৭. কপাল বড়, চওড়া ও উন্নত।

৮. পা খাটো, মোটা এবং ওলানগ্রন্থি খুব বড়।

৯. দেহের পশ্চাৎ ভাগ অপেক্ষাকৃত চওড়া ও ভারী।

১০. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন কম বেশি ৫৬৭ ও ৫৩০ কেজি।

১১. বলদ মহিষ হালচাষ ও গাড়ি টানার কাজে ব্যবহৃত হয়।

১২. বাঁট লম্বা, সামনের বাঁটের চেয়ে পিছনের বাঁট লম্বা। চিত্র ১১.৪.২ : মুররা

১৩. বাৎসরিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ২০০—৩০০০ লিটার।

 

জাফরাবাদি মহিষ

 

জাফরাবাদি মহিষ

জাফরাবাদি গাভী দুধ উৎপাদনকারী এবং ষাঁড় চাষাবাদ ও গাড়ি টানার জন্য বিখ্যাত।

উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের গুজরাট, গির অরন্য ও জাফরাবাদ শহরের আশেপাশে এই জাতের মহিষ দেখা যায়। জাফরাবাদের নামানুসারে এদেরকে জাফরাবাদি বলা হয়।

জাত বৈশিষ্ট্য

এরা আকারে বড়, দেহ গভীর ও সুগঠিত। কপাল স্ফীত, শিং ভারি এবং চ্যাপ্টা। গায়ের রঙ কালো তবে মুখ, পা এবং লেজে সাদা দাগ দেখা যায়। ঘাড় মাংসল, গলকম্বল ও ওলান সুগঠিত। এদের দেহ লম্বাটে, পা লম্বা ও সরু, লেজ খাটো। ষাঁড় ও গাভী মহিষের ওজন যথাক্রমে ৫৯০ ও ৪৫০ কেজি। গাভী দিনে গড়ে ১৫-২০ লিটার দুধ দেয়। দুধে চর্বির পরিমাণ খুব বেশি। ষাড় চাষাবাদ ও গাড়ি টানার কাজে ব্যবহৃত হয়।

 

মেশানা জাতের মহিষ

 

মেশানা মহিষ

উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান

গুজরাট প্রদেশের বারোদা অঞ্চল ও মেশানা জেলা এদের আদি বাসস্থান। মুররা এবং সুরাটি মহিষের সংকরায়নের মাধ্যমে মেনশানা জাতের উৎপত্তি ।

জাত বৈশিষ্ট্য

এরা মুররা এবং সুরাটি মহিষের মধ্যবর্তী, দেহে দু’জাতেরই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। গায়ের রঙ কালো, বাদামি বা ধূসর। মুখমন্ডল, পা এবং লেজের অগ্রভাগে সাদা দাগ আছে। দেহ লম্বা এবং সুগঠিত। কপাল প্রশস্ত্র, মাঝের অংশ কিছুটা নিচু, শিং কোকড়ানো এবং দেখতে কাস্ত্রের মতো কান মাঝারি এবং অগ্রভাগ চোখা।

ঘাড় মাংসল, সুগঠিত, গলকম্বল নেই। বুক প্রশস্ত, কাঁধ চওড়া এবং দেহের সাথে সুবিনাস্ত্র, পা মাঝারি আকারের। ওলান সুগঠিত ও উন্নত। ষাঁড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে ৪৫০ ও ৬৫০ কেজি। এই জাতের মহিষ ভারতের গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে দুধ ও ঘি সরবরাহের জন্য সুপরিচিত। দুধ উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। এরা নিয়মিত বাচ্চা প্রদানের জন্যও বিখ্যাত।

 

বাংলাদেশের মহিষ:

বর্তমানে বাংলাদেশে মহিষের সংখ্যা প্রায় ৬,২১,৪৭। এর মধ্যে প্রায় ৫৪,০০০ মহিষ শক্তির কাছে নিয়োজিত থাকে। তবে এদেশে মহিষের কোনো উল্লেখযোগ্য জাত নেই । উপকূলীয়, হাওর এবং আখ উৎপাদনকারী এলাকাসমূহে মহিষের বিস্তৃতি তুলনামূলক ভাবে বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের মহিষকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— নদী, জলাভূমি এবং নদী ও জলাভূমির মহিষের সংকর। দেশের পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যে সমতলভূমিতে নদীর মহিষ দেখা যায়। এরা প্রধানত ভারতের দক্ষিণ, মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের মহিষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। দেশের পূর্বাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় জলাভূমির মহিষ ও সংকর মহিষের অবস্থান।

দূরপ্রাচ্যের জলাভূমির মহিষ ও আদি মহিদের সাথে এদের বেশ মিল রয়েছে। বাংলাদেশের জলাভূমির মহিষ মূলত শক্তির কাজে ব্যবহৃত হয়। এদের দুধ উৎপাদনের পরিমাণ খুব কম। দক্ষিণাঞ্চলে ছোট ছোট কৃষক পরিবারে ১-৪টি পর্যন্ত মহিষ দেখতে পাওয়া যায়। গাভী দিনে ১-৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। দুধ প্রধানত মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গরুর দুধের চেয়ে মহিষের দুধ বাজারে কম দামে বিক্রি হয়।

দুধে স্নেহের ভাগ বেশি। গবাদিপশুর মাংসের মধ্যে মহিষের মাংস বাজারে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গাড়ি টানা, ঘানি টানা, হালচাষ, সেচকার্য, ধান মাড়াই প্রভৃতি শক্তির কাছে এরা ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের মহিষ প্রধানত দেশী মহিষ হিসেবেই পরিচিত। দেহের আকার, পাড়েন এবং রঙের দিক থেকে এদের মধ্যে বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শিংয়ের আকার এবং পড়নও ভিন্নতর। প্রাণিজ আমিষজাতীয় খাদ্যের চাহিদা, পশুশক্তির ঘাটতি প্রভৃতি মেটানোর জন্য উন্নত প্রজনন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদেশের মহিষের উন্নতি অত্যাবশ্যক।

 

 

অনুশিলন:

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বিভিন্ন জাতের মহিষের বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা।

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • দেশী মহিষের আকার, আকৃতি বলতে পারবেন।
  • দেশী মহিষের সাথে উন্নত জাতের মহিষের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবেন।
  • গরু ও মহিষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন।

 

প্রাসঙ্গিক তথ্য

বাংলাদেশের সিলেট জেলায় মনিপুরি মহিষ দেখা যায়। এরা প্রধানত মাংস উৎপাদন, হালচাষ বা পরিবহণের জন্য উপযোগী। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো কোনো অঞ্চলে মুররা জাতের কিছু মহিষ দেখা যায়। মুররা ও মনিপুরি জাতের মধ্যে দৈহিক এবং উৎপাদনগত পার্থক্য নিরূপন করা যায়।

মহিষ ও গরুর মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি নয়। মহিষের গলকম্বল নেই, দেহে লোম খুব কম, জলাভূমির মহিষের শিং বড় ও অনেকটা কাস্ত্রের ন্যায়। তাছাড়া আকারে মহিষ সাধারণত গরু থেকে বড় হয়ে থাকে। এছাড়া বাকি সবগুলো বৈশিষ্ট্য মহিষের ক্ষেত্রে গরুর মতোই।

প্রয়োজনীয় উপকরণ

একটি মহিষ ষাড় বা গাভী, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।

কাজের ধাপ

  • প্রথমে একটি মহিষ দেখে তার অঙ্গপ্রতঙ্গের নাম জানুন ও খাতায় আঁকুন ।
  • যেসব কৃষকের বাড়িতে মহিষ আছে তাদের বাড়ি যান এবং প্রত্যক্ষভাবে মহিষের আকার,
  • আকৃতি ও দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করুন। মহিষের জাতসমূহের বৈশিষ্ট্যের সাথে আপনার দেখা মহিষের
  • বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে দেখুন এবং ব্যাবহারিক খাতায় লিখুন।
  • মহিষ দেখার পর তার জাত বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিপিবদ্ধ করুন।

 

সতর্কতা

প্রত্যক্ষভাবে মহিষ দেখার সময় সতর্কতার সাথে অগ্রসর হোন।

সারমর্ম :

বাংলাদেশের সিলেট জেলায় মনিপুরি মহিষ আছে যা প্রধানত মাংস উৎপাদন, হালচাষ বা পরিবহণের জন্য উপযোগী। এদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে মুররা জাতের মহিষও দেখা যায়। মহিষ ও গরুর মধ্যে পার্থক্য অল্প। মহিষের গলকম্বল নেই, দেহে লোম কম, জলাভূমির মহিষের শিং বড় ও কাস্তের ন্যায়। সাধারণত আকারেও এরা বড় হয়ে থাকে। এছাড়া বাকি বৈশিষ্ট্যগুলো গরুর মতোই।

 

গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য

গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো আজ। গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের ১১ নং ইউনিটের, ১১.৩ নম্বর পাঠ। গবাদি প্রাণির মধ্যে গরু প্রধান। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারে ২—৪ টি গরুপালন করতে দেখা যায়। এমনকি আজকাল শহর ও শহরতলিতেও গরু পালনের গুরুত্ব বেড়েছে।

লাল চট্টগ্রাম

 

গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য

 

বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের গরু পাওয়া যায়। গরুর জাতকে ২টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যথা — ক) উৎপত্তির ভিত্তিতে ও খ) উৎপাদন বা ব্যবহারের ভিত্তিতে।

উৎপত্তির ভিত্তিতে গরুর জাতভেদ:

  • দেশি জাতের গরু
  • বিদেশি উন্নত জাতের গরু
  • উন্নত সংকর জাতের গরু

 

দেশি জাতের গরু:

কখন, কীভাবে এদেশে গরুর গৃহপালিতকরণ (domestication) হয়েছিল তার কোনো সঠিক তথ্য জানা যায় নি। তবে, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল থেকেই সম্ভবত গরুর ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে যে গরু পালিত হয়ে আসছে এরা জেবু অর্থাৎ বস ইন্ডিকাস ( Bos indicus) প্রজাতিভুক্ত।

এদেশের আবহাওয়ার সাথে ভালোভাবে খাপ খেয়ে বেঁচে থাকা এদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বস ইন্ডিকাসের অনেকগুলো জাত ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ অঞ্চলে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তেমন কোনো গরুর জাত ছিল না। যা ছিল তার সবই দেশী গরু।

১৯৩৭ সালের দিকে ভারতের তদানিন্তন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো বর্তমান বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে বস ইন্ডিকাস প্রজাতির বিশুদ্ধ গরুর জাত, যেমন- হারিয়ানা, সিন্ধি, শাহিওয়াল আনেন (আলী, ১৯৮৫)। বস টরাস ( Bos taurus) প্রজাতির উন্নত জাতের গরু, যেমন- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, জার্সি প্রভৃতি আনা হয় ১৯৭৪ সালে (আলী, ১৯৮৫)।

নিয়মিত কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এসব জাতের ষাঁড়ের বীজ দেশী গাভীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করা হয় যা এখনও চলছে। এই সংকর জাতের গরুগুলো বর্তমানে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। এর উদ্দেশ্য উৎপাদন বাড়ানো। বর্তমানে বস টরাস ও বস ইন্ডিকাস ছাড়াও বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার ঘন জঙ্গলে মিথুন বা গয়াল অর্থাৎ বস ফ্রন্টালিস ( Bos frontalis) প্রজাতির গরু দেখা যায়। বস ফ্রন্টালিস একটি বন্য প্রজাতির গরু। এদের বংশধরদের এখনও পোষ মানানোর চেষ্টা চলছে।

বাাংলাদেশে আদিকাল থেকে যে জাতের গরু পালন করা হচ্ছে সেগুলোকে দেশি জাতের গরু বলা হয়া। দেশি জাতের গরু মূলত পরিশ্রমী জাত। এ জাতের বলদ কৃষিকাজ ও ভার বহনের কাজে বেশ উপযোগী। তবে চট্টগ্রাম, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর এবং ঢাকার কিছু এলাকায় বেশকিছু দেশি জাতের গরু আছে যেগুলো আকারে কিছুটা বড় হয় এবং এগুলো থেকে বেশি পরিমাণে দুধ পাওয়া যায়। দেশি জাতের গরুর মধ্যে পাবনাইয়া, লাল চাঁটগাঁ, ফরিদপুর দেশি ছোট গরু প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

 

বাংলাদেশের গরুর শ্রেণিবিন্যাস

উৎস অনুসারে বাংলাদেশের গরুকে নিম্নলিখিত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

ক) স্থানীয় – দেশী টাইপ এবং লাল চাঁটগেয়ে।

খ) বিদেশী – হারিয়ানা, শাহিওয়াল, সিদ্ধি, হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ও জার্সি।

গ) সংকর – দেশী গাভী X বা টরাস প্রজাতির গরু এবং

                  দেশী গাভী X মিথুন বা গয়াল

দেশী গরুর প্রথম বাচ্চা প্রসবের গড় বয়সকাল ৪৫ মাস। বর্তমানে মাত্র ২% গাভী কৃত্রিম প্রজননের আওতায় আনা গেছে। প্রতিটি গাভী গড়ে ১৩ কেজি দুধ দেয় এবং গড়পড়তা দোহনকাল (lactation period) সময় ৭-৮ মাস (বিবিএস, ১৯৯৪)।

 

দেশি জাতের বৈশিষ্ট্য:

১. আকারে ছোট, পরিশ্রমী, কুঁজ উচু।

২. প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর ওজন গড়ে ২৫০ কেজি।

৩. মাংস বেশ সুস্বাদু।

৪. গাভী হতে দৈনিক ১—৩ লিটার দুধ পাওয়া যায়।

৫. গাভীর গড়পড়তা দোহনকাল ৭—৮ মাস।

নিচে কয়েকটি দেশি জাতের গরুর বিবরণ দেওয়া হল।

 

লাল চট্টগ্রাম গরু:

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম লাল চাটগেয়ে গরুর আবাসভূমি। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্রই এদের পাওয়া যায়। এদের উৎপত্তি, উৎপাদন এবং দৈহিক বৈশিষ্ট্য প্রায় দেশী গরুর মতো, তবে আকারে বড়। এদের গায়ের রঙ, শিং ও ক্ষুর লাল বলে এরা লাল চাটগেয়ে (Red Chittagong) নামে পরিচিত। বাংলাদেশের গরুর মধ্যে এরা ভালো জাতের।

এরা আকারে মাঝারি, গায়ের রঙ হালকা লাল, শিং পাতলা এবং ভেতরের দিকে আংশিক বাঁকানো। গলকম্বল ছোট এবং ঘাড় চিকন। মুখমণ্ডল, থুতনি ও পেটের নিম্নাংশ আপেক্ষাকৃত হালকা রঙের। গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ২৫০-৩০০ ও ৩৫০-৪০০ কেজি। দৈনিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২-৫ লিটার। ওলানগ্রন্থি বেশ সুঠাম, তবে বাট আকারে ছোট। বাণিজ্যিক খামারের জন্য এ জাতের গরু মোটেও সুবিধাজনক নয়। তবে, পারিবারিক খামারে পালনের জন্য মোটামুটি ভালো।

বৈশিষ্ট্য:

১. গায়ের রঙ লাল, মুখ খাটো ও চওড়া।

২. গরু দেখতে ছোটখাটো, পেছনের দিক বেশ ভারি।

৩. চামড়া পাতলা, শিং ছোট ও চ্যাপ্টা।

৪. ওলানের শিরা বেশ স্পষ্ট এবং ওলান বেশ বড়।

৫. গাভী দৈনিক ২—৩ লিটার দুধ দেয়।

৬. পূর্ণবয়স্ক ষাড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে ৩৫০—৪০০ কেজি ও ২৫০—৩০০ কেজি।

৭. লেজ যথেষ্ট লম্বা এবং শেষ প্রান্তের চুলের গুচ্ছ লাল বর্ণের।

৮. গলকম্বল ছোট এবং ঘাড় চিকন।

৯. মাথা ছোট ও পোল উন্নত।

১০. দুধে চর্বির পরিমাণ ৪—৫%।

 

দেশি ছোট গরু:

এই ধরনের গরু বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা যায়। এরা আকারে ছোট, গায়ের রঙ সাদা, কালো, লাল, কাজলা বা বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ হতে পারে। গাভী ও ষাঁড়ের গড় দৈহিক ওজন যথাক্রমে ১৫০-২০০ ও ২২৫-২৫০ কেজি। এদের মাথা ছোট এবং অনেকটা বর্গাকৃতির।

কপাল চওড়া ও চ্যাপ্টা। শিং চোথা এবং সামনে ও উপরের দিকে বাঁকানো। কান ও চুট ছোট এবং উন্নত। গলকম্বল মাঝারি গড়নের। ষাঁড়ের প্রজননতন্ত্রের আবৃত চামড়া বা থলে আকারে ছোট। দেশী গরু খুবই কষ্টসহিষ্ণু এবং এরা প্রধানত শক্তির কাজে ব্যবহৃত হয়। এদের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। একেকটি গাভী গড়ে ০.৬ লিটার দুধ দেয়। এদেরকে দ্বৈত ব্যবহারোপযোগী পশু বলা হয়।

বৈশিষ্ট্য:

১. এরা আকারে ছোট এবং শান্ত প্রকৃতির।

২. গায়ের রঙ সাদা, কালো, লাল, কাজলা বা বিভিন্ন রঙ— এর মিশ্রণ হতে পারে।

৩. মাথা ছোট এবং অনেকটা বগার্কৃতির।

৪. কপাল চওড়া ও চ্যাপ্টা।

৫. শিং চোখা ও সামনে ও উপরের দিকে বাঁকানো।

৬. গাভী দৈনিক ০.৫—১ লিটার দুধ দেয়।

৭. দুধে চর্বির পরিমাণ কম।

 

মাঝারি আকারের দেশী গরু

মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও পাবনার শাহজাদপুরে বেশ কিছু উন্নত ধরনের গরু দেখা যায় যাদের উৎপাদন মোটামুটি ভালো। মাঝারি আকারের এ গরুগুলো অন্যান্য অঞ্চলের গরুর চেয়ে বড়। এ অঞ্চলগুলোতে এদেরকে দুধ উৎপাদনের গরু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

তবে, এরা কোনো জাত নয়। মূলত এরা দুধ উৎপাদন ও ভারবাহী পশু হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। বৃটিশ আমলে শাহিওয়াল, সিন্ধি ও হারিয়ানা জাতের কিছু ষাঁড় এসব অঞ্চলে আনার ফলেই এ অঞ্চলের গরুর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এ অঞ্চলগুলোতে প্রচুর ঘাস পাওয়া যায় বলে এদের উৎপাদন ক্ষমতা এখনও টিকে আছে।

 

বিদেশি উন্নত জাতের গরু:

আমরা জানি, প্রাণীর বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের বিভিন্নতা প্রাণীর জাত নির্ধারণ করে। এজন্য বিদেশী উন্নত গরুর জাত ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করার আগে এদের পূর্ব বংশধরদের কথা জানা উচিত। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানকালের গরুর পূর্বপুরুষ বা টরাস ও বস ইন্ডিকাস প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।

ইউরোপের সকল গরু বা টরাসের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রজাতির প্রধান শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের কোনো চুট নেই। যেমন- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, জার্সি, আয়ারশায়ার, ব্রাউন সুইস প্রভৃতি জাতের গরু। কা ইন্ডিকাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এদের চুট আছে এবং কোনো কোনো জাতের ক্ষেত্রে তা বেশ বড়। সিদ্ধি, শাহিওয়াল, হারিয়ানা এই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত ।

বাংলাদেশে যে সকল বিদেশি উন্নত জাতের গরু পাওয়া যায় সেগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা— ইউরোপীয় জাতের গরু এবং উপমহাদেশীয় গরু।

ইউরোপীয় জাতের গরুর মধ্যে হলস্টেন ফ্রিজিয়ান, জার্সি, ব্রাউন সুইস, আয়ারশায়ার উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশে হলস্টেন ফ্রিজিয়ান এবং জার্সি ষাঁড় প্রজননের কাজে ব্যবহার করা হয়। এদের কুঁজ নেই।

 

সারণি ১০ : বস টরাস ও বস ইন্ডিকাস গরুর মধ্যে পার্থক্য

 

 

প্রাণিজগতে গরুর শ্রেণিবিন্যাস

জগৎ (Kingdom)ঃ           প্রাণিজগৎ (Animalia)

পর্বঃ                                  মেরুদন্ডী প্রাণী (Cordata)

শ্রেণী (Class):                     স্তন্যপায়ী প্রাণী (Mammalia) যারা বাচ্চা প্রসব করে ও বাচ্চাকে দুধ পান করায়

বর্গ (Order):                      জোড় খুরবিশিষ্ট প্রাণী (Artiodactyla)

গোত্র (Family):                  বভিডি (Bovidae) – রোমন্থক প্রাণী যারা জাবর কাটে।

গন (Genus):                    বস (Bas) – চতুষ্পদ প্রাণী, বন্য এবং গৃহপালিত, শক্তিশালী দেহ।

প্ৰজাতি (Species)ঃ         Bos taurus, Bos indicus, Bos frontalis ইত্যাদি।

 

গরুর বিভিন্ন জাতকে তিন উপায়ে বিভক্ত করা যায়। যথা-

  • উৎপত্তি বা আকার অনুসারে
  • ব্যবহার বা কাজ অনুসারে
  • জাতির মৌলিকত্ব বা বিশুদ্ধতার পরিমাণ দিয়ে

 

 

উপত্তি ও আকার অনুযারী জাতের শ্রেণিবিন্যাস:

  • বস প্রমিজেনিয়াস (Bas promigenious) : উদাহরণ- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, আয়ারশায়ার ইত্যাদি।
  • বস লঙ্গিফ্রন্স (Bas longifrons) : উদাহরণ- ব্রাউন গুইস, জার্সি, ওয়েরেন্সি ইত্যাদি।
  • বস ফ্রন্টালিস (Bos frontalis) : উদাহরণ- সিমেন্টাল।
  • বস ব্র্যাকিসেফালাস (Bas brachycephalus) : উদাহরণ- কেরি, সাসেক্স, হারফোর্ড ইত্যাদি।

 

 

হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গরু

 

হলস্টেন ফ্রিজিয়ান গরু:

এই দুধাল জাতের গরুর উৎপত্তিস্থান হল্যান্ডের ফ্রিজল্যান্ড। বর্তমানে প্রথিবীর প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়।

জাত বৈশিষ্ট্য:

হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান দুধাল জাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের গরু। গাভীর গড়পড়তা ওজন ৭৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ১১০০ কেজি। শরীর বেশ পুষ্ট, পেছনের অংশ ভারি এবং ওলানগ্রন্থি বেশ বড়। পেছনের পা সোজা, লম্বা এবং অপেক্ষাকৃত সরু, মাথা ও শরীর পেশিযুক্ত। গাভী শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু ষাঁড়গুলো বদমেজাজি। গো-চারনের অভ্যাস মাঝারি ধরনের। এদের গায়ের রঙ সাদা, কালো মিশ্রিত। উভয় রঙের কোনো একটির প্রাধান্য হতে পারে। জন্মের সময় বাছুরের ওজন গড়ে ৪০-৪৫ কেজি হয়, বয়ঃপ্রাপ্তি দেরিতে ঘটে। এজাতীয় গাভী বছরে ৪৫০০-৯০০০ লিটার দুধ দিয়ে থাকে। দুধে চর্বির পরিমাণ মাত্র ৩.৫%। দুধ উৎপাদনকারী গাভীর মধ্যে এরা অধিক দুগ্ধদানের জন্য বিখ্যাত।

১. এ জাতের গরুর বর্ণ ছোট—বড় কালো—সাদা রঙে মেশানো হয়।

২. উন্নত জাতের গাভীর মধ্যে এরা আকারে সবচেয়ে বড় হয়।

৩. মাথা লম্বাটো হয়। অন্যান্য জাতের গরুর ন্যায় এদের কুঁজ হয় না।

৪. পূর্ণবয়স্ক ষাঁড়ের ওজন প্রায় ৮০০—১০০০ কেজি ও গাভীর ওজন প্রায় ৫০০—৬০০ কেজি হয়ে থাকে।

৫. গাভী দিনে প্রায় ৪০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।

৬. এ জাতের বকনা প্রায় দেড় থেকে দুই বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।

৭. দুধে চর্বি থাকে ৩.৫% থেকে ৪%।

৮. শরীর বেশ পুষ্ট, পিছনের অংশ ভারী এবং ওলানগ্রন্থি বেশ বড়।

৯. গাভী শান্ত প্রকৃতির কিন্তু ষাঁড়গুলো বদমেজাজি।

১০. জন্মের সময় বাছুরের ওজন গড়ে ৪০—৪৫ কেজি হয়।

১১. অধিক দুধ দানের জন্য এ জাত বিশ্ববিখ্যাত ।

১২. মাথা ও পেছনের পা বেশ সোজা।

১৩. এ জাতের গাভী পরবতীর্ বাচ্চা দেয়ার আগ পর্যন্ত একটানা দুধ দেয়।

১৪. এরা বছেও ৪৫০০—৯০০০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়।

 

জার্সি গরু

 

জার্সি গরু:

ইংল্যান্ডের জার্সি, ওয়েরেন্সি, অ্যালডারনি ও সার্ফ চ্যানেল দ্বীপসমূহে এদের উৎপত্তি। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার পূর্ব ও দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোতে এদের বিস্তৃতি রয়েছে।

বিদেশী দুধাল জাতের গাভীর মধ্যে জার্সির আকার সর্বাপেক্ষা ছোট। গাভীর ওজন ৪০০-৫০০ এবং ষাঁড়ের ওজন ৬০০-৮০০ কেজি। দেহের গঠন সুন্দর ও নিখুঁত, গুলানগ্রন্থি, বেশ বড় এবং সুগঠিত। শিরদাড়া সোজা এবং মাথা ও ঘাড় সামঞ্জস্যপূর্ণ। গায়ের রঙ ফিকে লাল (fawn)। জিহ্বা এবং লেজের রঙ কালো।

গো-চারনে অভ্যস্ত। জার্সির বাচ্চা আকারে ছোট ও দুর্বল হয়। তাই জন্মের পর বাচ্চা লালনপালন কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বাচ্চার জন্ম ওজন ২২-৩৩ কেজি পর্যন্ত হয়। অতি অল্প সময়ে জার্সি গাভী কয়প্রাপ্ত হয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত দুধ উৎপাদনে সক্ষম।

ভালো মান ও অধিক পরিমাণ দুধ উৎপাদনের জন্য জার্সি জাতের গরু বিখ্যাত। গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫০০-৪০০০ লিটার দুধে চর্বির গড় হার ৫%। জার্সি গরু মাংসল হয় না।

 

বৈশিষ্ট্য:

১. আকার তুলনামূলক ভাবে ছোট।

২. জন্মের সময় বাচ্চা দুর্বল ও ছোট হয়।

৩. গায়ের রঙ ফিকে লাল এবং গাঢ় বাদামি হয়।

৪. মাথা লম্বা, এদের কুঁজ হয় না, ফলে শিরদাড়া সোজা হয়।

৫. শরীরে মেদ কম থাকে, লেজের রঙ কালো।

৬. গাভীর ওলান বেশ বড় হয়, পা গুলো ছোট কিন্তু মজবুত।

৭. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪.—০০—৫০০ কেজি ও ৬০০— ৮০০ কেজি।

৮. একটি গাভী হতে বছরে ৩৫০০—৪৫০০ কেজি দুধ পাওয়া যায়।

৯. গরু স্বল্পসময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং দীর্ঘসময় ধরে বাচ্চা ও দুধ দেয়।

১০. শিং পাতলা ও সামনের দিকে কিছুটা বাঁকানো থাকে

১১. দৈনিক ১৫—২০ কেজি দুধ দেয়।

১২. দুধে চর্বিও পরিমাণ ৫% হয়।

২। উপমহাদেশীয় জাতের গরু Ñ এদের কুঁজ হয়।

 

আয়ারশায়ার গরু (Ayreshire):

আয়ারশায়ারের উৎপত্তি স্কটল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম আয়ারশায়ার প্রদেশে। এ জাতের গরু গ্রেট বৃটেন, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায়।

জাত বৈশিষ্ট্য ঃ

আয়ারশায়ার গাভীর ওজন ৫৫০-৭০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৮৫০-১১৫০ কেজি। এদের শিরদাড়া গোজা এবং শিং প্রসারিত ও থাকা। ওলানগ্রন্থি বেশ বড় ও সুগঠিত। গায়ের রঙ লালের মধ্যে সাদা ফোঁটা ফোঁটা। সাধারণত মাথা ও শরীরের সম্মুখভাগে গাঢ় রঙ দেখা যায়। গাভীর রঙ হালকা লাল, তবে ষাঁড়ের রঙ গাঢ় লাল।

গো-চারনে ভালোভাবে অভ্যস্ত। আয়ারশায়ার বয়ঃপ্রাপ্ত হয় ওয়েরেন্সির পরে কিন্তু হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান অপেক্ষা তাড়াতাড়ি। হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ানের বায়ুরের ন্যায় আয়ারশায়ারের বাছুর জন্মের সময় সতেজ ও সবল হয়। বাছুরের জন্ম ওজন (birth weight) ৩৫-৪০ কেজি। এরা দুধাল গাভী হিসেবে পরিচিত। দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় ৫০০০ লিটার। দুধে চর্বির হার ৪%।

 

শাহীওয়াল গরু

আদি বাসস্থান: শাহীওয়াল জাতের গরুর আদি বাসস্থান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মন্টগোমারী জেলা। এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই শাহীওয়াল জাতের গরু পাওয়া যায়। পাকিস্তান থেকে এ জাতের গরু আমাদের দেশে আমদানি করা হয়েছে।

 

শাহীওয়াল গরু

 

বৈশিষ্ট্য:

১. এ জাতের গরু আকারে বেশ বড় হয়।

২. এদের মাথা চওড়া, পা ছোট ্এবং শিং পুরু।

৩. গায়ের রং তামাটে লাল ।

৪. মাথা প্রশস্ত কিন্তু শিং ছোট ও মোট হয়।

৫. নাভীর চার পাশের চামড়া মোটা ও ঢিলা।

৬. ওলান বড় ও ঝুলন্ত।

৭. বলদ অলস প্রকৃতির ও ধীরগতি সম্পন্ন।

৮. গলকম্বল, কান ও নাভী সাধারণত ঝুলানো থাকে।

৯. পূর্ণবয়স্ক গাভীর ওজন প্রায় ৩৫০—৪৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন প্রায় ৫০০—৭০০ কেজি হয়ে থাকে।

১০. একটি গাভী দিনে প্রায় ১২—১৫ কেজি দুধ দেয় এবং বছেও ৩০০ দিন পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।

১১. শাহীওয়াল ষাঁড় ও দেশী গাভীর সংকরায়নে উৎপন্ন গরুর দুধ উৎপাদন ও হালচাষের জন্য ভাল।

১২. বকনা তিন থেকে সাড়ে তিন বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।

১৩. এদের লেজ লম্বা এবং প্রায় মাটি ছুয়ে যায়।

১৪. লেজের মাথায় একগোছা কালো লোম থাকে।

১৫. জন্মের সময় বাছুরের ওজন ২২—২৮ কেজি হয়।

 

লাল সিন্ধি গরু

 

লাল সিন্ধি গরু (Red Sindhi):

পাকিন্তানের সিন্ধু প্রদেশের করাচী, লাসবেলা ও হায়দারাবাদ, এ জাতের গরুর আদি বাসস্থান। এ জাতের গরু লাল বলে এদের লাল সিন্ধু বলা হয়। পাকিস্তান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও আফ্রিকাতে এ জাতের গরু পাওয়া যায়।

গাভীর ওজন ৩৫০-৪০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৪২৫-৫০০ কেজি। চুট উন্নত, গলকম্বল ও নাভীর চারদিকের চামড়া বেশ ঢিলা, কপাল বেশ প্রশস্ত ও উন্নত, শিং মাঝারি আকারের এবং কিছুটা ভেতরের দিকে বাঁকানো। কান মাঝারি আকারের, গুলান গ্রন্থি বড়। গায়ের রঙ গাঢ় লাল, কিন্তু কালচে হলুদ থেকে গাঢ় মেটেও হতে পারে।

বাছুরের জন্ম ওজন ২২-২৫ কেজি। এরা ভারতীয় উপমহাদেশে দুধাল গাভী হিসেবে পরিচিত। গিন্ধি গাভী বছরে গড়ে ২000 লিটার দুধ দেয়। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%। এ জাতের গরু আমাদের দেশের আবহাওয়ায় মোটামুটি ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারে। সিন্ধি বলদ একটু আলসে প্রকৃতির। কিন্তু ষাঁড় ও বাংলাদেশী গাভীর মিলনে সৃষ্ট বলদ হাল-চাষ ও গাড়ি টানার জন্য ভালো। বকনা তিন বছরেই গাভীতে পরিণত হয়। পরিমাণ ৪.৫%। বলদ সাধারণত অলস প্রকৃতির ও মন্থর গতিসম্পন্ন। শাহিওয়াল ধাড় ও দেশী গাভীর সংকরায়নে উৎপন্ন গরু দুধ উৎপাদন ও হালচাষের জন্য ভালো।

বৈশিষ্ট্য:

১. গায়ের রং গাঢ় লাল হয় এবং নাভী বড় ও ঝুলানো হয়।

২. কপাল প্রশস্ত ও উন্নত কান নিচের দিকে ঝুলানো হয়।

৩. দেহের অনুপাতে মাথা ছোট, নাকের চূড়া চওড়া।

৪. ওলানের বাটগুলো সুগঠিত এবং চার কোণায় সমদূরত্বে সমভাবে বসানো।

৫. শিং ভোতা, যা পাশে ও পিছনের দিকে বাঁকানো।

৬. গাভী দৈনিক ১০ লিটার পর্যন্ত এবং বছরের ৩৫০ দিন দুধ সিন্ধি দেয়।

৭. বকনা ৩ বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।

৮. বলদ বা ষাঁড় হালচাষ ও গাড়ি টানার কাজে বেশ উপযোগী।

৯. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৩৫০—৪০০ কেজি এবং ৪০০—৫০০ কেজি।

১০. গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫০০ লিটার।

১১. দুধে চর্বির ভাগ ৫%।

 

হারিয়ানা গরু

 

হারিয়ানা গরু:

ভারতের রোহটক, হিসার, গুরগাও, কার্নাল ও দিল্লি হারিয়ানার আদি বাসস্থান। ভারতের সব জায়গায় হারিয়ানা দেখা যায়। তাপ সহনশীলতা হারিয়ানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেজন্য ল্যাটিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিনাঞ্চলে এদের সাহায্যে বিভিন্ন প্রকার সংকর জাতের গরু উৎপাদন করতে দেখা যায়।

গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪০০-৫০০ ও ৬০০-১১০০ কেজি। উচ্চতা ১৪০-১৪৫ সে.মি। বাছুরের জন্ম ওজন ২২-২৫ কেজি। মাথা লম্বা ও অপেক্ষাকৃত গরু। শিং লম্বা, চিকন ও মসৃন। ওলান সুগঠিত ও আটোসাটো, গায়ের রঙ হালকা ধূসর বা সাদাটে। কোনো কোনো ষাঁড়ের খাড়, চুট, বুক প্রভৃতি স্থান গাঢ় ধূসর রঙের। হারিয়ানা অত্যধিক পরিশ্রমী ও শক্তিশালী গরু। এরা দৈত কাজ, যথা- দুধ উৎপাদন ও গাড়ি টানার উপযোগী। বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ২০০০ কেজি। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%। বকনা ৩-৪ বছরের মধ্যে গাভীতে পরিণত হয়।

বৈশিষ্ট্য:

১. গায়ের রং সাদা বা হালকা ধূসর।

২. এরা বেশ শক্তিশালী ও পরিশ্রমি হয়।

৩. সুগঠিত ও আঁটিসাঁট ও লাল হয়।

৪. শিং লম্বা, চিকন এবং মসৃণ হয়।

৫. মাথা লম্বা ও অপেক্ষকৃত সরু।

৬. নাভী শরীরের সাথে লাগানো।

৭. গাভী প্রায় ৩০০ দিন দুধ দেয় এবং বছরে ৩০০০—৩৫০০ কেজি দুধ দেয়।

৮. তাপ সহনশীলতা হারিয়ানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

৯. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪০০—৫০০ কেজি ও ৮০০—১০০০ কেজি।

১০. বকনার প্রথম বাচ্চা প্রসব করতে ৪ বছর সময় লেগে যায়।

১১. দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।

 

ধারপারকার গরু (Tharparkar )

উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ধারপারকার জেলায় এদের উৎপত্তি। সিন্ধু প্রদেশের সর্বত্র এবং পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে এদের পাওয়া যায়।

জাত বৈশিষ্ট্য:

থারপারকার বেশ শক্তিশালী গরু। গায়ের রঙ সাদা। এরা মধ্যম আকৃতির ও হারিয়ানার চেয়ে কম উচ্চতাসম্পন্ন। শিং ও চুট মধ্যম আকারের। গলকম্বল বর্ধিত কিন্তু শাহিওয়াল ও সিদ্ধির চেয়ে ছোট। দেহ সুঠাম ও সুন্দর। ধারপারকার হারিয়ানার ন্যায় দৈত উদ্দেশ্যে অর্থাৎ দুধ ও মাংস উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ২০০০ লিটার। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।

 

অমৃত মহল (Amrit Mahal )

উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :

এ জাতের গরুর উৎপত্তি ভারতের কর্ণাটক প্রদেশে। তবে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের খামারেও এদের দেখতে পাওয়া যায়।

জাত বৈশিষ্ট্য ঃ

দেহ সুগঠিত, পিঠ সোজা এবং পা দেহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মুখাকৃতি লম্বা ও কপাল উন্নত। শিং লম্বা ও প্রশস্ত, গলকম্বল ও চুট উন্নত এবং বড়। চামড়া বেশ আটোসাটো, লেজ মাঝারি লম্বা এবং লেজের গুচ্ছ কালো। গায়ের রঙ ধূসর, তবে মাথা, গলা, চুট ও পা কালো লোমে আবৃত। ভারতের শক্তি উৎপাদনশীল গরুর মধ্যে এরা উৎকৃষ্ট জাত। এরা অত্যন্ত কর্মক্ষম, তবে গাভীর দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কম৷

ব্রাহ্মণ গরু (Brahman)

উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :

এই জাতের গরুর উৎপত্তিস্থান ভারত। তবে, বর্তমানে আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই পাওয়া যায়। ভারতের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের গরুর সাথে ইউরোপ ও আমেরিকায় উন্নত টাইপের গরুর দীর্ঘ সংকরায়নের ফলে এই জাতের সৃষ্টি হয়েছে। ব্রাহ্মাণ সম্প্রদায়ের নামের সাথে মিল রেখেই এই জাতের গরুর নাম দেয়া হয়েছে ব্রাহ্মণ।

জাত ও বৈশিষ্ট্য ঃ

গায়ের রঙ ধূসর অথবা লাল। তবে, বাদামি, কালো, সাদা ও ফুটফুটে রঙেরও দেখা মেলে৷ মুখাকৃতি লম্বা, কান ঝুলন্ত, ছুট উঁচু, গলকম্বল পুরু ও মোটা চামড়ায় আবৃত। এরা মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু।

অ্যাঙ্গাস গরু (Angus )

উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :

এদের আদি বাসস্থান স্কটল্যান্ড, অ্যাবারডিন, অ্যাঙ্গাস, ঝিংকারডিন ও ফরফার-এর উত্তর পূর্বাঞ্চল।

জাত ও বৈশিষ্ট্য ঃ

এদের গায়ের রঙ কালো। কোনো শিং নেই। গায়ের চামড়া ও লোম মসৃণ। দেহ লম্বাকৃতির। এরা উন্নত এবং অধিক মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু।

 

উন্নত জাতের সংকর গরু:

উন্নত জাতের ষাড়ের সঙ্গে দেশী গাভীর মিশ্রণে যে জাতের গরু উৎপাদন করা হয় তাকে সংকর জাতের গরু বলে। সংকর জাত আসলে মিশ্রজাত। সংকর জাত সৃষ্টি করার প্রক্রিয়াকে সংকরায়ন বলে। আমাদের দেশে দেশী অনুন্নত গাভীকে বিদেশী উন্নত জাতের ষাঁড়ের মাধ্যমে সংকরায়ন করে তার থেকে উন্নত সংকর বাছুর উৎপাদন করা হচ্ছে।

সংকরায়নের জন্য আগে বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ধাড় আমদানি করা হতো। কিন্তু দেশের চাহিদার তুলনায় এত বেশি ষাড় আমদানি করা বায়বহুল। এজন্য কমসংখ্যক গাড় দিয়ে বেশিসংখ্যক গাভীকে প্রজনন করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অর্থাৎ কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা দেশে চালু হয়েছে। কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থায় উন্নত জাতের ধাড় থেকে সংগ্রহ করা বীর্য বা বীজ গাভীর জনন অঙ্গে সংস্থাপন করে ডিম্বাণু নিষিক্ত করা হয়। আমাদের দেশে এই পদ্ধতি খুব ধীরে ধীরে চালু হয়েছে। বর্তমানে গ্রাম ও শহর সর্বত্রই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বহু সংকর বাছুর উৎপাদিত হচ্ছে।

হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গরু

 

সংকর গরু সৃষ্টির উদ্দেশ্য

সংকর জাতের গরু সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য অনুন্নত জাতের গরুকে উন্নত করে অধিক হারে দুধ, মাংস ও শক্তি উৎপাদন করা। দুধ, মাংস ও শক্তি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত গরুর জাতগুলো বিক্ষিপ্তভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। যেমন- দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত জাতের গরু হলস্টেইন- ফ্রিজিয়ান ও জার্সির আদি বাস ইউরোপে।

শক্তি ও মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু অমৃত মহল, কৃষ্ণ ভেলি, হারিয়ানা, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি ভারতে পাওয়া যায়। মাংস উৎপাদনকারী জাত, যেমন- ব্রাহ্মণ, অ্যাঙ্গাস, হারফোর্ড প্রভৃতি আমেরিকায় পাওয়া যায়। এসব জাতের গরু অন্য দেশের আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। লালনপালনে অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয়। তারপরও অনেক সময় বাচানো কঠিন হয়।একদেশ থেকে অন্যদেশে এসব জাতের গরু স্থানান্তর করা ব্যয়বহুল।

ফলে গরুর ব্যবসায় লাভবান হওয়া যায় না। এসব অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে খুব সীমিত সংখ্যায় এ জাতের ষাড় বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর নিজ দেশের গাভীর সঙ্গে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাতের গাভী ও ষাড় উৎপাদন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের বাংলাদেশের কথা বলা যায়। সরকার বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ষাড় এনে সরকারী খামারে লালনপালন করেন। উক্ত ষাঁড় থেকে কৃত্রিম উপায়ে বীজ সংগ্রহ করে সারাদেশে বিভিন্ন কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। উক্ত বীজ  দিয়ে দেশী গাভীর প্রজনন করানো হয়। এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ দেশী গাভী থেকে সংকরায়নের মাধ্যমে সংকর গাভী সৃষ্টি করতে পারছে।

সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য

নিম্নে সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য দেয়া হলো-

  • দুধ, মাংস কিংবা শক্তির জন্য সৃষ্ট সংকর গরুর উৎপাদন দেশী গরুর থেকে বেশি হয়।
  • সংকরায়নের ফলে জিনের (gene) সংমিশ্রণ ঘটে বলে পরবর্তী প্রজন্মের রোগপ্রতিরোধ ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • দু’টি ভিন্ন জাতের গাভী ও ষাঁড়ের মধ্যে সংকরায়নের ফলে যে বাছুর উৎপন্ন হয় সে তার মাতা-পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বৈশিষ্ট্য পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। চিত্র ২৯-এ নিয়মটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।

একটি দেশী গাভীকে একটি হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়ের মাধ্যমে প্রজনন করানো হলে যে বাচ্চা জন্ম নেয় তার দেহে ৫০% দেশী ও ৫০% হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ানের রক্ত থাকে। এই বাছুর বরুনা হলে বড় হওয়ার পর হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের ষাড় দিয়ে তাকে প্রজনন করানো হলে বাচ্চার দেহের আদি দেশী মা গাভীর রক্ত আরও অর্ধেক কমে ২৫% হয়ে যাবে।

অর্থাৎ এটি ৭৫% উন্নত জাতের বৈশিষ্ট্য পাবে। এভাবে সংকর গাভী থেকে গাত পুরুষে তাত্ত্বিকভাবে ১০০% খাটি হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান আনা যায়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম বংশের গাভী বা ধাড়ই ৫০% দেশী ও ৫০% হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান রক্ত বৈশিষ্ট্য বহন করে বেশি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।

 

অনুশীলন (Activity) :

ধরুন, আপনার বাড়িতে একটি অনুন্নত দেশী গাভী আছে। উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে একে প্রজনন করালেন। উক্ত গাভীর পঞ্চম বংশধরের ক্ষেত্রে দেশী ও উন্নত ষাঁড়ের রক্তের শতকরা হার যথাক্রমে কত হবে?

সংকর গরুর উৎস

উন্নত জাতের গরু সংকর গরুর উৎস বা পূর্বপুরুষ। আমাদের দেশে দুধ উৎপাদন করার লক্ষ্যে হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ষাঁড়ের সাথে দেশী গাভীর কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। অনেকে শাহিওয়াল ষাঁড়ের সঙ্গেও দেশী গাভীর কৃত্রিম প্রজনন করে থাকেন। তবে বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ষাঁড়ের বীজ দিয়ে দেশী গাভীকে প্রজনন করিয়ে যে বাচ্চা পাওয়া যায় তা এদেশের আবহাওয়ায় বেশি উৎপাদন দিতে সক্ষম। শক্তি ও মাংসের জন্য বাংলাদেশ এখনও সংকর গাভী উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। আমাদের দেশে মাংস ও শক্তির চাহিদা যথেষ্ট। এই চাহিদা মেটানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

 

উৎপাদন ব্যবহারের ভিত্তি করে গরুর শ্রেণীবিভাগ:

দুধ ও মাংস উৎপাদন এবং কার্যকারিতর উপর ভিত্তি করে গরুর জাতকে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। যেমন—

দুধাল জাত:

এ শ্রেণীর গাভীগুলো সাধারণত অধিক পরিমাণে দুধ দিয়ে থাকে। যেমন—হলস্টেইনফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল, জার্সি, লাল সিন্ধি, ব্রাউন সুইস, আয়ার শায়ার, গুয়ারেন্সি ইত্যাদি।

মাংসল জাত:

মাংস উৎপাদনের জন্য এ জাতগুলো বেশি পরিচিত। যেমন— অ্যাঙ্গাস, বিফ মাষ্টার, ব্রাহ্মণ, ডেবন, সর্টহর্ন, হালিকার ইত্যাদি।

দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জাত:

এ শ্রেণীর গাভী মোটামুটি ভাল দুধ দেয় এবং এদেরকে কৃষিকাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন— হারিয়ানা, থাষ্টার্কার, রেডপোল,কাংক্রেজ,মিল্কিং সর্টহর্ন ইত্যাদি।

শ্রম বা ভারবাহী জাত :

এ জাতের বলদ গরুগুলো কৃষিকাজ এবং ভার বহনে বেশি উপযোগী। যেমন— অমৃত মহল, মালভি, হরিয়ানা, ধান্নি, কৃষ্ণভেলি, ভাগনারি ইত্যাদি।

 

 

দুগ্ধবতী গাভীর জাত নির্বাচন:

দুগ্ধবতী গাভীর জাত নির্বাচন – পাঠটি বাউবি “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয়ের ইউনিট – ১৪ , পাঠ – ১৪.১। ভূমিকা আমাদের দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধিতে, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও দারিদ্র দূরীকরণে দুগ্ধ খামারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দুগ্ধ খামার স্থাপনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই একই সুতোয় গাঁথা। খামার স্থাপনের পূর্বে যেমন বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করে কাজ করতে হয় ঠিক তেমনি খামার স্থাপনের পর খামারের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি দিতে হয়। দুগ্ধ খামারের মূল উৎপাদিত দ্রব্য হচ্ছে দুধ। তাই দুধ বাজারজাতকরনের ব্যবস্থা সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। খামার স্থাপনের উদ্দেশ্যই হলো তা থেকে মুনাফা অর্জন করা। সুতরাং দুগ্ধ খামারের আয় ব্যয়ের হিসেব সম্পর্কেও জানা আবশ্যক।

এ ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে দুগ্ধবতী গাভী ও মহিষের জাত নির্বাচন, গর্ভকালীন ও প্রসবকালিন গাভীর যত্ন, দুগ্ধবতী গাভীর যত্ন ও খাদ্য, নবজাত বাছুরের যত্ন, দুধ উৎপাদনে প্রভাবক বিষয়বসমূহ। বিশুদ্ধ দুধ উৎপাদন ও দুধ পরীক্ষা, দুধ সংরক্ষণ পদ্ধতি, বাণিজ্যিক ডেইরি ফার্ম পরিদর্শন ও প্রতিবেদন তৈরি, গর্ভবতী গাভী শনাক্তকরন নিয়ে তাত্বিক ও ব্যাবহারিকভাবে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

 

 

উন্নত জাতের গাভীর লক্ষণ (Sign of Hybrid Cow) একটি উন্নত জাতের দুধালো গাভীর লক্ষণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল:

১. উন্নত জাতের গাভী সামঞ্জস্যপূর্ণ নিখুঁত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সুন্দর ও আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হবে ২. পিছনের অংশ বেশি চওড়া এবং দাঁড়ানো অবস্থায় পিছনের পা দুটি বেশি ফাঁক থাকে।

৩. দেহের আকার অনুপাতে বুকের ও পেটের বেড় গভীর হয়।

৪. ভালজাতের গাভীর পাঁজরগুলো আলাদা এবং স্ফীত দেখায় ।

৫. দেহ বেশ বড় এবং দেহের আকার সামনের দিকে সরু এবং পিছনের দিকে ভারী হয়।

৬. চামড়া পাতলা ও মসৃণ প্রকৃতির হয়।

৭. ভালজাতের গাভীর শরীর ঢিলেঢালা ও নাদুশ-নুদুশ হয়।

৮. ওলান সুগঠিত নরম, আকারে বড়, চওড়া এবং ওলান শক্তভাবে শরীরের সাথে আটকানো থাকে ।

৯. ওলানের বাট চারটি সমান আকৃতির ও সমান দূরত্বে অবস্থিত হবে।

১০. দুধ দোহনের আগে ওলান শক্ত থাকে এবং দোহনের পর চুপসে যায়।

১১. ওলানের সামনে নাভীর দিকে সুস্পষ্ট ও উন্নত দুগ্ধশিরা স্পষ্ট দেখা যায়।

১২. উন্নত জাতের গাভীর নাকের ছিদ্র বড় ও খোলা হয়।

১৩. একটি উন্নত ও স্বাস্থ্যবান গাভীর স্বভাব অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির হয়।

 

 

সারসংক্ষেপ:

দেশী গাভী সংকরায়নের মাধ্যমে উন্নত জাতের গাভীর উদ্ভাবন করা হয়েছে। সুষম খাদ্য প্রদান ও স্বাস্থ্যসম্মত পালন ব্যাবস্থার মাধ্যমে একটি সংকর বা উন্নত জাতের গাভী হতে দৈনিক ২৫ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়। উন্নত জাতের গাভী সাধারনত ত্রিকোনাকৃতির হয়। এদের দেহের আকার অনুপাতে বুকের ও পেটের বেড় গভীর হয়।

 

গরুর জাতের ফটো গ্যালারী:

মুরগি পালন পদ্ধতি

মুরগি পালন পদ্ধতি – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি শিক্ষা ২য় পত্রের, ৯ নং ইউনিটের ৯.১ নং পাঠ।

মুরগি পালন পদ্ধতি

মুরগির ঘরের লাইট [ Lighting in a Poultry ]
প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে পদ্ধতিতেই ডিম ফোটানো হোক না কেন মুরগি থেকে সঠিক উৎপাদন পেতে হলে এদেরকে সঠিকভাবে লালন—পালন করতে হবে। খামারে একদিন বয়সের বাচ্চা তোলার পর থেকে উৎপাদন শেষে বাতিল করা পর্যন্ত এদের পুরো লালন—পালনকালকে দুটো প্রধান পর্বে ভাগ করা যায়।

যেমন:

১। বাচ্চা পালন পর্ব ও

২। বয়ষ্ক পোল্টি্র পালন পর্ব

 

১। বাচ্চা পালন পর্ব:

এ পর্বটিকে দুটো উপপর্বে ভাগ করা যায়। যেমন

 

ক. ব্রুডিং পর্ব:

এ পর্বটি মুরগির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ের সঠিক যত্নের ওপরই এদের ভবিষ্যত জীবনের উৎপাদন নির্ভর করে। এ পর্বটির স্থিতিকাল ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির যথাক্রমে ০—৪ ও ০—৫/৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত।

 

খ. গ্রোয়িং বা বৃদ্ধি পর্ব:

যেহেতু এটি বৃদ্ধি পর্ব তাই এ পর্বের সঠিক যত্নের ওপর এদের বৃদ্ধি ও ভবিষ্যত উৎপাদন অনেকাংশে নির্ভর করে। ব্রয়লার ও ডিমপাড়া বা লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে এর স্থিতিকাল যথাক্রমে ৫—৬/৮ ও ৪/৫১৮/২০ সপ্তাহ পর্যন্ত।

 

 

২। বয়ষ্ক পোল্টি্র পালন পর্ব:

এ পর্বটি ডিমপাড়া বা লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে ১৮/২০—৭২ সপ্তাহ পর্যন্ত।

লেয়ার বা ডিমপাড়া মুরগির জীবনে সবগুলো পর্ব আসলেও ব্রয়লার মুরগির পালন শুধু ব্রুডিং ও গ্রোয়িং পর্বেই সীমাবদ্ধ।

 

রেড জঙ্গল ফাউল [ Red jungle fowl Gallus gallus ]

মুরগি পালন পদ্ধতি:

মুরগি পালন পদ্ধতি আমাদের দেশে সাধারণত তিনভাবে মুরগি পালন করা হয়।

১। মুক্ত পদ্ধতি/ছেড়ে পালন।

২। আধাছাড়া বা অর্ধ—আবদ্ধ অবস্থায় পালন।

৩। আবদ্ধ অবস্থায় পালন।

 

মুক্ত/ ছেড়ে পালন পদ্ধতি:

এ পদ্ধতিতে সাধারণত গ্রামীণ পরিবেশে মুরগি পালন করতে দেখা যায়। এ পদ্ধিতে মুরগি দিনের বেলায় বাড়ির আঙ্গিনায় চারিদিক থেকে খাবার খুঁজে খায় এবং রাতের বেলায় ঘরে ফেরে। এই পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালনের উপযোগী নয় । এই পদ্ধতির সুবিধা হলো ফেলে দেওয়া এঁটো ভাত, চালের খুদ, পোকামাকড়, কচি ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি খায় ফলে খরচ নেই বললেই চলে।

 

অর্ধমুক্ত/ অর্ধছাড়া পদ্ধতি:

একটি নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে মুরগির চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত থাকে এই পদ্ধতিতে। মুরগি ঘরের সামনে ১.৫—২.০ ফুট উঁচু বাঁশ অথবা তারের জালি দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। এই ঘেরা জায়গার মধ্যে খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা হয়। মুক্ত পদ্ধতির তুলনায় এই পদ্ধতিতে উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে।

 

আবদ্ধভাবে পালন পদ্ধতি :

এক্ষেত্রে মুরগি সম্পূর্নভাবে ঘরে রেখে পালন করা হয়। এই পদ্ধতিতে জায়গা কম লাগে, খাদ্য খরচ বেশি হলেও লাভজনক। খামারিরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে লাভবান হতে পারেন ।

 

আবদ্ধভাবে পালনের আবার তিনটি পদ্ধতি রয়েছ। যথা—

১। লিটার পদ্ধতি ২। মাচা পদ্ধতি ৩। খাঁচা/ ব্যাটারি পদ্ধতি

 

লিটার পদ্ধাতিতে মুরগি পালন:

এ পদ্ধতিতে মুরগির পালনকালের প্রতিটি পর্বই ডিপ লিটারের উপর অতিবাহিত হয়। লিটার হলো ঘরের মেঝের উপর কাঠের ছিলকা, করাতের গুড়া, তুষ, বালি, ছাই ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা বিছানা। লিটার মলমূত্র শোষণ করে এবং মুরগির জন্য আরামদায়ক হয়। এই পদ্ধতিতে ৫.০ সেমি পুরু করে বিছানা তৈরি করতে হয়।

বিছানা বেশি নোংরা বা সঁ্যাতসেঁতে হলে তা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিবর্তন করে দিতে হয়। ২—৩ মাস পরপর মুরগির ঘরের লিটার পরিবর্তন করতে হয়। এ পদ্ধতিতে জায়গা বেশি লাগে। ব্রয়লার পালনের জন্য এটি ভালো পদ্ধতি। তবে, লেয়ার পালনের জন্যও এটি বহুল প্রচলিত। প্রতিটি পূর্ণবয়ষ্ক মুরগির জন্য ১.২—১.৫ বর্গফুট জায়গা দিতে হবে। লিটারের উপর খাবার ও পানির পাত্রে খাবার ও পানি সরবরাহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে মুরগির ঘরে আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছণীয়।

 

মাচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন:

এই পদ্ধতিতে ঘরের মধ্যে মেঝে থেকে ১.০—১.৫ ফুট উপরে বাঁশ বা কাঠ দিয়ে মাচা তৈরি করতে হয়। মাচার দুটি বাঁশ বা কাঠের প্লেটের মধ্যে ০.৫—১.০ ইঞ্চির বেশি ফাঁক হলে মুরগির পা ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাচা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে শুধু মুরগির মল নিচে পড়তে পারে। খাবার ও পানির পাত্র মাচার উপরে দিতে হবে। ডিম পাড়ার বাসা মাচার একপাশে নিরিবিলি স্থানে দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে ঘর পরিষ্কার থাকে এবং মুরগির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। সমন্বিত পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রে পানির উপর এভাবে ঘর তৈরি করে মুরগি পালন করা যায়। চিত্র ৯.১.১ : মাচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন

 

খাঁচায় মুরগি পালন:

এই পদ্ধতিতে এদের ব্রুডিং, গ্রোয়িং ও ডিমপাড়া প্রতিটি পর্বই বিশেষভাবে তৈরি খাঁচার ভিতর সম্পন্ন করা হয়। এ খাঁচাটি মুরগিা সংখ্যা ওপর নির্ভর করে ছোট বা বড় এবং একতলা বা বহুতলাবিশিষ্ট হতে পারে। খাঁচা পদ্ধতিতে তুলনামূলকভাবে জায়গা বেশকম লাগে। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে রোগজীবাণুর আক্রমণ কম হয়। ডিমপাড়া মুরগি পালনের জন্য এটি আদর্শ পদ্ধতি। নিচে খাঁচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

 

 

 

খাঁচার ধরন

১। এক তলাবিশিষ্ট খাঁচা:

যেসব জায়গায় গরম বেশি সেখানে একতলাবিশিষ্ট খাঁচা তৈরি করা ভালো। মুরগির সংখ্যা বেশি হলে এ ধরনের খাঁচা ব্যবহারে জায়গা বেশি লাগে। একটি টিন/ খড়ের চালার নিচে এই খাঁচা স্থাপন করতে হয়। এতে খাদ্য ও পানি প্রদান, ডিম সংগ্রহ এবং ময়লা পরিষ্কার তুলনামূলক সহজ।

২। দুই তলাবিশিষ্ট খাঁচা:

এক্ষেত্রে একটি খাঁচার উপর অন্য একটি খাঁচা এমনভাবে বসাতে হবে যাতে ময়লা সরাসরি নিচের তলার মেঝেতে পড়ে। উভয় তলার মধ্যবর্তী স্থানে টিনের বা প্লাস্টিকের ট্রে দেয়া হয়। ময়লা ট্রের উপর জমা হয়। সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন ট্রে পরিষ্কার করতে হয়। এক তলাবিশিষ্ট খাঁচার তুলনায় দুই তল বিশিষ্ট খাঁচায় মুরগি পালনে জায়গা কম লাগে।

 

৩। তিল তলাবিশিষ্ট খাঁচা:

এক্ষেত্রে একটি খাঁচার উপর অন্য একটি খাঁচা এমনভাবে বসাতে হবে যেমনটি সিঁড়ির ক্ষেত্রে দেখা যায়। এতে প্রতি তলার মুরগির মলমূত্র সরাসরি মেঝেতে পড়বে। বানিজ্যিকভাবে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে এই খাঁচা অত্যন্ত জনপ্রিয়। যাদের জায়গার অভাব কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালন করতে চান তারা এই পদ্ধতিতে মুরগি পালন করতে পারেন।

 

ব্যাবহারিক : ফরমালিন শনাক্তকারী কীট দ্বারা ফরমালিনযুক্ত মাছ শনাক্তকরণ

ব্যাবহারিক : ফরমালিন শনাক্তকারী কীট দ্বারা ফরমালিনযুক্ত মাছ শনাক্তকরণ – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয় এর ইউনিট – ৫ , পাঠ -৫.৪।

ব্যাবহারিক : ফরমালিন শনাক্তকারী কীট দ্বারা ফরমালিনযুক্ত মাছ শনাক্তকরণ

 

প্রাসঙ্গিক তথ্য:

ফরমালডিহাইড বা মিথানল গ্যাসের ৪০% জলীয় দ্রবণকে ফরমালিন বলে। ফরমালিন মূলত: জীবাণুনাশক রাসায়নিক তরল পদার্থ যা ল্যাবরেটরীতে নমুনাসমূহ বিকারের মধ্যে ফরমালিন দ্বারা সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া উদ্ভিদ বা প্রাণীর অংশ বিশেষ সংরক্ষণের জন্য এবং মৃতু প্রানী, মানুষ প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা অনেক সময় খাদ্যদ্রব্যে বা মাছে ফরমালিন মিশিয়ে দেয়। সুতরাং মাছে ফরমালিন দেয়া হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার ।

 

ভূমিকা:

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে অসংখ্য পুকুর ডোবা, খাল বিল, নদ—নদী, হাওর—বাওড় ও বিস্তীর্ণ প্লাবন ভূমি রয়েছে। বাংলাদেশের এ বিশাল জল রাশি অপরিমেয় মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ। এদেশের স্বাদু পানিতে রয়েছে ২৭২ প্রজাতির মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি এবং সামুদ্রিক উৎসে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ও ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি। মাছ পঁচনশীল দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম হওয়ায় মাছের পুষ্টিমান বজায় রাখার জন্য এবং পঁচন রোধ করার লক্ষ্যে মাছ আহরণের পর থেকেই সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হয়। মাছ ও চিংড়ি পঁচনশীল দ্রব্য তাই এদের আহরণের পর দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য সঠিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রক্রিয়ায় যে কোনো ধরনের ক্রটি বা অবহেলার জন্য একদিকে যেমন মাছ বা চিংড়ির পঁচন ধরে অপরদিকে এদের বাজারজাতকরণও বাধাগ্রস্ত হয়।

এ ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে মাছ ও চিংড়ি সংরক্ষণের ধারনা ও প্রয়োজনীয়তা, মাছ পঁচনের কারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি, মাছ পরিবহন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি, চিংড়ি পরিবহন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি, এবং ফরমালিন শনাক্তকারী কীট দ্বারা ফরমালিনযুক্ত মাছ শনাক্তকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে:

নিরাপদ মাছের (ফরমালিনমুক্ত) লক্ষণসমূহ :

* দেহে পিচ্ছিল পদার্থ থাকে।

* মাছ সহজে পঁচে যায়।

* মাছে মাছি পড়ে।

* মাছের স্বাভাবিক গন্ধ থাকে।

* ফুলকা লালচে বর্ণের থাকে।

* দেহ ভেজা থাকে।

* মাংশপেশি এবং অঁাইশ নরম থাকে।

* চক্ষু স্বাভাবিক থাকে।

 

ফরমালিনযুক্ত মাছের লক্ষণসমূহ :

* মাছের গায়ে মাছি বসে না।

* মাছ সহজে পঁচে না।

* ফরমালিনের হালকা কটু গন্ধ থাকবে।

* মাছ অসার বা শক্ত মনে হবে।

* মাছের শরীর অনেকটা রাবারের মত মনে হবে।

* মাছের দেহের স্বাভাবিক গন্ধ থাকবে না।

* মাছের ফুলকা কালচে এবং আইশ শুষ্ক মনে হবে।

* চক্ষু ফ্যাকাশে ও ভিতরের দিকে থাকে।

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ:

ক. ফরমালিন শনাক্তকারী কিট।

খ. একটি প্লেট বা ট্রে।

গ. ওয়াশ বোতল।

ঘ. বিকার।

ঙ. পাতিত পানি।

চ. মেজারিং সিলিণ্ডার।

 

পরীক্ষা পদ্ধতি :

১. প্রথমে বাজার থেকে সন্দেহযুক্ত মাছ সংগ্রহণ করে ট্রে—এর উপর রাখতে হবে।

২. এবার ওয়াশ বোতলের পাতিত পানি ব্যবহার করে মাছটি ধুয়ে ফেলতে হবে।

৩. ধোয়ার পর সেই পানি সংগ্রহ করে ৫ মিলি পানি একটি টেস্ট টিউবে রাখতে হবে।

৪. এবার ফরমালিন কীট থেকে দ্রবণ—১ এর ১৫ ফোটা, মাছ ধোয়া পানির মধ্যে ফেলতে হবে এবং ১৫ সেকেন্ড ঝাঁকাতে হবে।

৫. অতপর ফরমালিন কীটের দ্রবণ—২ একইভাবে ১৫ ফোটা উক্ত টেস্ট টিউবে মাছ ধোয়া পানির মধ্যে আবার ফেলতে হবে এবং ১৫ সেকেন্ড ঝাঁকাতে হবে।

৬. একইভাবে দ্রবণ—৩ উক্ত টেস্ট টিউবে আবার ১৫ ফোটা ফেলে ১৫ সেকেন্ড ঝাঁকাতে হবে এবং রঙ পরিবর্তন লক্ষ করতে হবে।

পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত :

১. যদি মিশ্রিত দ্রবণ সবুজাভ বর্ণ থেকে লালচে রং—এ পরিবর্তন হয় তবে মাছটিতে ফরমালিন ছিল।

২. যদি রং অপরিবর্তিত অথবা রংহীন হয় তাহলে বুঝতে হবে মাছে ফরমালিন ছিল না।

 

মাছ পরিবহন ও বাজারজাতকরণ

মাছ পরিবহন ও বাজারজাতকরণ – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয় এর ইউনিট – ৫ , পাঠ -৫.২। মাছ পরিবহন মাছ চাষের জন্য পোনা পরিবহনে দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাছ চাষে সফলতা আনার জন্য সুস্থ ও সবল পোনা অতীব প্রয়োজন। তাই মাছ চাষের ক্ষেত্রে পোনা পরিবহনের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক। রেণু পোনা মূলত: অঁাতুড় পুকুর, লালন পুকুর ও মজুদ পুকুরের জন্য পরিবহণ করা হয়ে থাকে। পোনা পরিবহনকালে অক্সিজেন ঘাটতি, শারীরিক ক্ষত, অ্যামোনিয়া, তাপমাত্রা ইত্যাদির উপর পোনার মৃত্যুর হার অনেকাংশ নির্ভর করে। তাই পোনা পরিবহনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পোনা মারা না যায় বা কম মারা যায় এবং আঘাত না পায়। পোনা পরিবহনের সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং পোনা পরিবহনের পূর্বে পোনাকে কন্ডিশনিং বা টেকসই করে নিতে হয়।

মাছ পরিবহন ও বাজারজাতকরণ

 

পোনা টেকসই বা কন্ডিশনিং পদ্ধতি :

পোনা পরিবহণের সময় যাতে মারা না যায় সেজন্য পোনাকে অবশ্যই টেকসই বা পরিবহনের উপযুক্ত করে নিতে হয়। যদি কাছাকাছি কোনো স্থানে পোনা পরিবহন করতে হয় তাহলে জালের মধ্যে পোনা রেখে চারদিকে পানির প্রবাহ দিতে হয়। এতে করে পোনা অল্প জায়গায় থাকতে অভ্যস্ত হবে আর পানির প্রবাহে অক্সিজেনের সরবরাহ হওয়ার সাথে সাথে পোনা ভয় পায় এবং তাড়াতাড়ি করে মলমূত্র ত্যাগ করে ও বমি করে পেট খালি করে ফেলবে। ফলে পরিবহনের সময় পোনা মলমূত্র ত্যাগ করে পানি দূষিত করতে পারে না।

আর পরিবহনের সময় যদি দীর্ঘ হয় তাহলে পোনাকে অধিকতর টেকসই করার প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে পোনাকে হাপায় রেখে অথবা চৌবাচ্চায় অল্প পানির প্রবাহে রেখে একদিন উপবাসে রাখতে হবে। পোনাগুলো তখন হাপাতে ছোটাছুটি করতে থাকে এবং তখন তাদের পেট প্রায় সম্পূর্ণ খালি হয়ে যায়। ফলশ্রম্নতিতে পরিবহনের সময় বমি বা মল ত্যাগ করে না এবং পরিবহনের পাত্র দূষিত হয় না। বাংলাদেশে পোনা পরিবহনের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। একটি সনাতন পদ্ধতি এবং অপরটি আধুনিক পদ্ধতি।

 

সনাতন পোনা পরিবহন পদ্ধতি :

অতি প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশে পোনা পরিবহনের জন্য মাটির পাত্র ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে অবশ্য ধাতব পাত্র যেমন কেরোসিনের টিন, কাসা বা অ্যালমুনিয়ামের পাতিল ব্যবহৃত হচ্ছে। ধাতব পাত্রের পানি তাড়াতাড়ি গরম হয়ে যায় ফলে পোনা মারা যেতে পারে। এ অবস্থায় ভেজা কাপড় বা চট পানিতে ভিজিয়ে পাত্রের গায়ে জড়িয়ে রাখলে পাত্র সহজে গরম হয় না। সাধারনত: ২০—২৪ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পাতিল দ্বারা ৩—৫ সে.মি. আকারের ৩০০৬০০ টি পোনা তিন থেকে চার ঘন্টার পথ পরিবহণ করা যায়।

মাটির পাতিলে বাষ্পীভবন খুব ভালো হয় বিধায় পানি ঠান্ডা থাকে। মাটির পাতিল বা হাড়ি দ্বারা পোনা পরিবহনকালে যেসব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত সেগুলো হলো— পোনা পরিবহনকালে পাতিল বা হাড়িতে বেশ জোরে এবং বেশি বেশি ঝাঁকনি দেয়া উচিত নয় কেননা এতে অনেক পোনা পাতিলের গায়ে ধাক্কা খেয়ে জখম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নলকূপের বা টেপের পানি দ্বারা পাতিল বা হাড়ির পানি বদলানো উচিত নয় কেননা এধরনের পানিতে ক্লোরিন থাকে যাতে পোনা মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সতর্কতার সাথে পানি বদলাতে হবে এবং পোনা পরিবহনের সময় পানি বদলানোর জন্য মগ, গামছা এবং বালতি ইত্যাদি সাথে রাখা উচিত।

সনাতন পদ্ধতিতে পোনা পরিবহনের সময় প্রধানত ঃ দুটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন—

ক. পোনা পরিবহনের সময় যেন অক্সিজেনের অভাব না হয়।
খ. পরিবহনের সময় পোনা যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।

 

পোনা পরিবহনের আধুনিক পদ্ধতি :

এ পদ্ধতিতে পোনা পরিবহনের জন্য অক্সিজেন পূর্ণ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতি অধিক নিরাপদ ও ঝামেলামুক্ত। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে পোনা পরিবহন বেশ সহজ। রেণু অথবা ধাণী পোনা পরিবহনের জন্য অক্সিজেনপূর্ণ পলিথিন ব্যাগই উত্তম। ব্যাগের অংশ পানি এবং অংশ অক্সিজেন দিয়ে পূর্ণ করতে হয়। ভর্তিকত অক্সিৃ জেনের ৬০ ভাগ হবে গ্রহণ যোগ্য অক্সিজেন। প্রথমে ব্যাগে পানি ভর্তি করে পরে সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন পূর্ণ করা হয়। চটের ব্যাগের পরিবর্তে কার্ডবোর্ড, কার্টুনও ব্যবহার করা যায়। পরিবহনের দূরত্ব, পরিবহন পাত্রের আকার বা পানি ধারণ ক্ষমতা ও পোনার আকারের ওপর ভিত্তি করে পোনার পরিমান নির্ণয় করতে হয়। একটি ৮—১০ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পরিবহন পাত্রে ১২—১৮ ঘন্টা পর্যন্ত নিচের সারণি অনুযায়ী রেণু পোনা পরিবহন করা সম্ভব।

সারণি: পোনার সাইজের পার্থক্যভেদে পরিবহণযোগ্য পোনার সংখ্যা

আধুনিক পদ্ধতিতে পোনা পরিবহনকালেও বেশ কতগুলো সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। যেমন—

ক. পোনা পরিবহনের জন্য পোনা সাধারণত প্রতিটি প্যাকেটের জন্য দুটি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে।

খ. সমান আকারের দুটি পলিথিন ব্যাগ একটির ভিতর আরেকটি ঢুকিয়ে ব্যাগে পরিণত করতে হবে।

গ. পোনা পরিবহনের সময় দূরত্বের উপর নির্ভর করে ব্যাগে পোনা পূর্ণ করতে হয়। দূরত্ব কম হলে পোনার সংখ্যা বেশি হবে আর দূরত্ব বেশি হলে পোনার সংখ্যা কম হবে।

ঘ. যাতায়াতের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পোনার বাক্স ছায়া ও নিরাপদ ¯া’ নে থাকে।

ঙ. কোনোভাবেই যেন ব্যাগ কেটে বা ছিঁড়ে না যায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।

চিত্র ৫.২.১ : অক্সিজেনযুক্ত পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহণ।

 

মাছ অর্থনীতিতে মাছ বাজারজাতকরণের গুরুত্ব:

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মাছ বাজারজাতকরণের গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো :

১. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি :

মাছ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হয়। কারণ মাছ ক্রয়—বিক্রয়, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, ব্যবসা প্রভৃতি কাজের জন্যে অনেক লোক নিয়োজিত থাকে। মাছ উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২. মৎস্য পণ্যের সুষম যোগান :

বাংলাদেশে এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে মাছ উৎপাদন হয় না। এই জন্যে বিভিন্ন এলাকার ভোগকারীগণ যাতে সব ধরনের মাছ ভোগ করতে পারে এবং সুষম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে এজন্যে মৎস্য পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত করতে হবে যাতে সঠিকভাবে সবাই যোগান পায়।

৩. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন :

বাংলাদেশে থেকে মাছ রপ্তানী করে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্যের স্থানানুসারে শ্রেণিবিভাগ ও নমুনাকরণ করা হলে বিদেশে আমাদের মাছের বাজার বিস্তৃত হবে এবং অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের মাছ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা প্রধানতঃ ২ প্রকার। যথা—  অভ্যন্তরীণ মাছ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা।

 

অভ্যন্তরীণ মাছ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা :

বাংলাদেশের মাছের চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান থাকার কারণে অভ্যন্তরীণ বাাজরে মাছ বিপণন খুবই সহজ। বাজারে বিভিন্ন স্তরের ক্রেতা থাকলে ছোট—বড় দামি ও কম দামি মাছ সহজে বিক্রি হয়ে যায়। মাছ ব্যবসায়ীরা মাছ আহরণ—পরবর্তী পরিচর্যার চেয়ে অধিক মুনাফা অর্জনে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিএফডিসি (বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন সংস্থা) আহরিত মাছ দেশের ভিতর ও বিদেশে উভয় বাাজারের জন্য বিপণন করে। নিচে মাছ বিপনন পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো :

১. আড়ৎদার : চালানীরা মাছ এনে জমা রাখে আড়তদারদের কাছে। আড়তদারগণ শুধু পাইকারী মূলে মাছ বিক্রি করে।

২. পাইকারি বিক্রেতা : আড়তদাররা নিলামের মাধ্যমে পাইকারি বিক্রেতার কাছে মাছ বিক্রয় করে। এরপর খুচরা বিক্রেতাগণ পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে ক্রয় করে।

৩. চালানী : চালানীরা পাইকারীদের কাছ থেকে মাছ ক্রয় করে বাক্স ভর্তি করে পরিবহনের মাধ্যমে শহরে আনে। মাছ বহনের জন্যে বর্তমানে বিভিন্ন ইঞ্জিন চালিত পরিবহন ব্যবহার করা হচ্ছে।

৪. খুচরা বিক্রেতা : খুচরা বিক্রেতারা স্টলে বা বাজারে বসে ভোক্তাদের কাছে মাছ বিক্রি করে এবং বড় বড় শহরে ভ্যান ও মাথায় করে মাছ বিক্রি করে বেড়ায়।

৫. আন্তর্জাতিক মাছ বাজার ব্যবস্থা : বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত মাছ বিদেশে রপ্তানী করা হয়। এ সকল মৎস্যজাতপণ্য অধিকাংশই সমুদ্রপথে রপ্তানি হয়। মোট রপ্তানিকৃত মৎস্যজাত পণ্যের ৯০% চিংড়ি ও বাকি ১০% অন্যান্য মাছ। হিমায়িত মৎস্য পণ্যের প্রধান বাজার হলো আমেরিকা, ইউরোপীয় দেশসমূহ, জাপান এবং জার্মানি।

বাংলাদেশ থেকে যে সকল মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে তার মান নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শনের দায়িত্ব মৎস্য অধিদপ্তরের পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের। এছাড়া কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ এ সকল পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করে।

 

চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ

চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয় এর ইউনিট – ৩ , পাঠ -৩.৪।

চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ

 

পুকুরে খাদ্য সরবরাহ :

পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণ না থাকলে অধিক পরিমাণে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হয় এবং প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি পরিমাণ থাকলে কম পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। পুকুরের পানির গুণাগুণের সাথে সাথে খাবারের পরিমাণের সম্পর্ক রয়েছে।

পুকুরে যেসব খাদ্য সরবরাহ করা হয় তার সবটুকু মাছ সরাসরি খাদ্য হিসেব গ্রহণ করতে পারে না। খাদ্যের কিছু অংশ পানিতে মিশে পানির গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। এতে করে অনেক সময় পানির গুণাগুণ খারাপ হতে পারে, ফলে মাছের মৃত্যুও হতে পারে। পুকুরের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখার কোন সুব্যবস্থা না থাকলে প্রতি একরে ১৫ কেজির বেশি খাবার দেয়া ঠিক না। সেক্কি ডিস্কের পাট ১০ সে.মি. এর কম হলে পুকুরে খাবার সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে। সেক্কি ডিস্কের পাট পুনরায় ২০ সে. মি.বা তার অধিক হলে আবার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।

 

ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি :

খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি : পুকুরে গলদা চিংড়ির পোনাকে তাদের ওজনের শতকরা ৩—৫ ভাগ দৈনিক ২ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় খাবার দেয়া ভাল। খাদ্য পিলেটগুলোকে পুকুরের পাড়ের চারপাশে ছিটিয়ে দিলে ভালো হয়। সন্ধ্যায় সমস্ত চিংড়ি পুকুর পাড়ের নিকট দিয়ে খাদ্যের সন্ধানে ঘোরাফেরা করে।

ছোট ছোট ভাসমান খাঁচা বা নাইলন জাল পাতলা পুরাতন কাপড় দিয়ে তৈরি করা যায়। ৩  ২  ১ বাঁশের খাঁচা তৈরি করে নিচে সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল বা কাপড় দিতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি খাদ্য খেয়েছে কি না জানা যায়। সরবরাহকৃত খাদ্য যদি চিংড়ি গ্রহণ না করে তাহলে পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়। চিংড়ির খাদ্য তৈরির পর এদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে দেখার প্রয়োজন। সাধারণত খাবার ও চিংড়ির দেহের বৃদ্ধির অনুপাত ২ ঃ ১ হলেই চিংড়ির ভাল ও উপযোগী খাবার বলে গণ্য করা হয়।

 

খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি :

১. চিংড়ি সাধারনত: রাতে খাবার গ্রহন করে। তাই চিংড়ির খাবারকে সন্ধ্যা বা রাত্রিতে প্রয়োগ করতে হবে।

২. চিংড়ির দেহ ওজনের অনুপাতে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাবার দিতে হবে।

৩. পিলেট জাতীয় খাবার পুকুরের চারিদিকে পাড়ের কাছাকাছি ছিটিয়ে দিতে হবে।

৪. বাঁশের খাঁচায় খাদ্য সরবরাহ করা হলে ৩২১ মিটার আকৃতির বাঁশের খাঁচা তৈরী করে তাতে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে।

৫. মাঝে মাঝে ঘের/পুকুরে জাল টেনে চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে খাবার প্রয়োগের অনুপাত কম—বেশী করতে হবে।

খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি মাছ চাষের ক্ষেত্রে খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাদ্য প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য হলো মাছের অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা। মাছের খাদ্যভাস ও মাছ চাষ পদ্ধতির ওপর খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি নির্ভরশীল। মাছ চাষ নিবিড় না আধা নিবিড় তার ওপর নির্ভর করে খাদ্যের প্রয়োগ মাত্রা। প্রয়োগকৃত খাবারের সবটুকু মাছ গ্রহণ করলেই কেবল অধিক লাভ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। মাছের খাদ্য গ্রহণ মাছের আকারের ওপর নির্ভরশীল। মাছের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে খাবার গ্রহণের পরিমান ও মাত্রা কমতে থাকে। পানির তাপমাত্রা ও দ্রবীভূত অক্সিজেনের ওপরও মাছের খাদ্য গ্রহণের মাত্রা নির্ভরশীল। পানির তাপমাত্রা বাড়লে খাদ্য গ্রহণের মাত্রা বাড়ে। তবে মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রায় খাবার প্রয়োগের মাত্রা কমিয়ে দিতে হবে।

 

নমুনায়নের মাধ্যমে মাছের গড় ওজন ঠিক করে মাছের খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা নির্ণয় করতে হয়। সাধারণত মাছের দেহের ওজনের ৩—৫% খাবার প্রয়োগ করা হয়। ছোট আকারের মাছের জন্য খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা বড় মাছের তুলনায় ঘন ঘন হতে হবে। মাছকে প্রধানত: তিন ভাবে খাদ্য প্রয়োগ করা যায় যথা—

১। হাত দিয়ে খাওয়ানো

২। চাহিদা অনুযায়ী খাওয়ানো এবং

৩। স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

আমাদের দেশে এখনো হাত দিয়ে খাওয়ানো পদ্ধতিই বহুল প্রচলিত। অন্য ২টি পদ্ধতি বানিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনেক দেশে ব্যবহৃত হয়।

হাত দিয়ে খাবার প্রয়োগ শ্রম সাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। তথাপি এ পদ্ধতির কতগুলো সুবিধা রয়েছে। এ পদ্ধতিতে খাবারের প্রতি মাছ কিরূপ সাড়া দেয় তা খাদ্য প্রয়োগকারী স্বচক্ষে দেখতে পারে যা মাছ চাষে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভিজা খাবার প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাত ছাড়া অন্য পদ্ধতি কষ্টসাধ্য। একই ব্যক্তি হাত দিয়ে প্রতিদিন খাবার প্রয়োগ করলে মাছগুলো ঐ ব্যক্তির উপস্থিতিতে পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে উঠে। সাধারণত পুকুরের কোন নির্দিষ্ট স্থানে মাছকে খাবার দিতে হয়। এর ফলে মাছ অল্প দিনের মধ্যে জেনে যায় পুকুরের কোন জায়গায় গেলে সহজে খাবার পাওয়া যাবে।

কিছু দিন একস্থানে খাবার প্রয়োগের পর আবার অন্য স্থানে কিছুদিন খাবার দেয়া ভালো। একই স্থানে সবসময় খাবার দিলে অব্যবহৃত খাবার জমে পঁচে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হতে পারে। তাই কিছুদিন পর পর পরীক্ষা করে দেখতে হবে মাছ সব খাবার খেয়েছে কিনা। উপরের অংশ খোলা এরূপ বাক্সে বা পাত্রেও খাবার প্রয়োগ করা যায় । এতে মাঝে মাঝে দেখা যায় মাছ সমস্ত খাবার খেয়েছে কি না। একদিনের খাবার একবারে না দিয়ে সকালে ও বিকালে অথবা সকালে, দুপুরে ও বিকালে (৩ বারে) দেওয়া উত্তম।

নার্সারি পুকুরে পোনা মাছের ক্ষেত্রে পাউডার বা দানাদার খাদ্য মাছের দেহের ওজনের ১০—১৫% হারে প্রতিদিন ৩—৪ বার পুকুরের চার পাশে ৩—৪টি নির্দিষ্ট স্থানে ছড়িয়ে দিতে হবে। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে দানাদার খাদ্য মাছের দেহের ওজনের ৩—৫% হারে প্রতিদিন ২—৩ বার পুকুরের চার পাশে ৩—৪টি স্থানে ছিটিয়ে দিতে হবে।

সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি পুকুর বা জলাশয়ে মজুদকৃত মাছের দৈহিক ওজন অনুযায়ী খাবার দিতে হয়। মাছ কী পরিমান খাবার গ্রহণ করেছে তার পরিমাণ নির্ধারণ করে সঠিক মাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। কার্প জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাদ্য গোলাকার পিন্ড আকারে এবং মাংসাশী ও রাক্ষুসে মাছের ক্ষেত্রে পিলেট আকারে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। একই সাথে পুকুরের বিভিন্ন স্থানে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্য দ্রব্য সরাসরি ছিটিয়ে না দিয়ে ডুবন্ত খাবার ট্রে বা পাটাতনে দিতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য দিতে হবে।

প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্য একবারে না প্রয়োগ করে কয়েকবারে ভাগ করে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সম্ভব হলে ভাগ করে তিন বারে দিলে ভালো। অল্প পরিমানে ও বেশিবার খাবার প্রয়োগ করলে খাবারের অপচয় হয় না। খাদ্য দিনের আলোতে দিতে হবে। সূর্যোদয়ের আগে বা সূর্যাস্তের পরে খাদ্য দেওয়া ঠিক নয়।

মাছের খাদ্য স্বভাব বিভিন্ন প্রজাতির মাছের খাদ্য স্বভাব বিভিন্ন ধরনের। বাংলাদেশে চাষযোগ্য প্রজাতির মাছগুলো পুকুরে বা জলাশয়ের প্রধানত: তিনটি স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে। উপরের স্তর, মধ্যের স্তর এবং নিচের স্তর। উপরের স্তরে যেসব মাছ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে সেগুলো হলো কাতলা, সিলভার কার্প। রুই মাছ মাঝের স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে। মৃগেল, মিরর কার্প ও কমন কার্প (কার্পিও) নিচের স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে। গ্রাস কার্প ও সরপঁুটি বিভিন্ন স্তুরের খাবার গ্রহণ করে থাকে।

কাতলা মাছ কিশোর ও পূর্ণ বয়স্ক উভয় ক্ষেত্রেই প্রাণিজ প্ল্যাঙ্কটন খায়। তবে কিছু কিছু শৈবালও খেয়ে থাকে। রুই মাছ পানির মধ্যভাগের খাবার গ্রহণ করে বিধায় একে কলাম ফিডার বলা হয়। রুই মাছ উদ্ভিদভূক্ত মাছ। এরা ছোট অবস্থায় শুধু প্রাণিজ প্ল্যাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় প্ল্যাঙ্কটন ও পঁচনশীল জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে। মৃগেল মাছ বয়স্ক অবস্থায় সাধারণত তলদেশের জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে। তবে এরা প্লাঙ্কটনও খেয়ে থাকে। সিলভার কার্প ছোট অবস্থায় রোটিফার নামক জুওপ্লাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় ফাইটোপ্লাঙ্কটন খেয়ে থাকে। গ্রাস কার্প ছোট অবস্থায় প্রাণিজ প্লাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় জলজ আগাছা খেয়ে থাকে।

কমন কার্প বা কার্পিও মাছ সর্বভূক। এরা পুকুরের তলদেশের খাবার খেয়ে থাকে। এরা ১০ সে.মি. লম্বা হলেই এক বিশেষ খাদ্যভ্যাস গ্রহণ করে। এরা গব গব করে কাদা মুখে নেয় এবং উহার জৈব অংশ ছেকে নিয়ে বাকীটুকু ফেলে দেয়। ফলে কার্পিও মাছ যে পুকুরে চাষ করা হয় সে পুকুরের পানি সব সময় খোলা থাকে। তেলাপিয়া মাছ কিশোর অবস্থায় সর্বভূক্ত। এরা ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও জুপ্লাঙ্কটনকে প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। শোল, গজার, বোয়াল, আফ্রিকান মাগুর এগুলো রাক্ষুসে মাছ বিধায় এদের খাদ্য স্বভাব ভিন্ন হয়।

এরা ছোট অবস্থায় জুপ্লাঙ্কটন খেয়ে থাকে বড় অবস্থায় শামুক, কীটপতঙ্গ ও ছোট ছোট মাছ খেয়ে থাকে। তাছাড়াও ফিশ মিল, সরিষার খৈল, চালের কুড়া, গমের ভূষি প্রভৃতি সম্পূরক খাদ্যও এরা গ্রহণ করে থাকে।

 

প্রদর্শিত মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) শনাক্তকরণ ব্যবহারিক

প্রদর্শিত মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) শনাক্তকরণ ব্যবহারিক – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি শিক্ষা ২য় পত্রের, ১ নং ইউনিটের ১.৭ নং পাঠ।

 

প্রদর্শিত মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) শনাক্তকরণ ব্যবহারিক

 

রাজপুটি

 

মূলতত্ত্ব :

মাছ আমিষ জাতীয় খাদ্য। আমাদের দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাতে মাছের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে মাছ শনাক্ত করতে পারে সে দিকে বিবেচনায় রেখেই এই পাঠের অবতরণা।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবহমানকাল থেকেই এদেশের মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে মাছ। আর এজন্যই বলা হয় “মাছে ভাতে বাঙালী। বিপুল জলসম্পদের এই দেশে অগনিত মানুষ মৎস্য আহরণ, চাষ ও বেচা—বিক্রিসহ এ সংক্রান্ত নানা কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে প্রাণীজ আমিষের উত্তম উৎস হিসেবে মাছের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার্জনের পাশাপাশি মৎস্য চাষ করে অনেক বেকার যুবকযুবতী স্বাবলম্বী হচ্ছে।

 

নাইলোটিকা মাছ

 

যার ফলে দেশের আর্থ—সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ত্বরাম্বিত হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার মৎস্য খাতের সার্বিক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনাগত উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। সময়োপযোগী ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছসহ অন্যান্য জলসম্পদের উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নানা কার্যকর উদ্যোগ। ফলে দেশের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪—১৫ অর্থবছরে ৩৬ লক্ষ ৮৪ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যেই শেখ হাসিনা সরকারের সুযোগ্য নেতৃত্বে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার মালিকানা অর্জন করেছে।

এখন জাতিসংঘ ঘোষিত “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এস.ডি.জি)” অর্জনে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের পাশাপাশি সামুদ্রিক বিশাল জলজসম্পদকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে।
এ ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে মাছ চাষের ইতিহাস, মাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, মাছের বাসস্থানসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

 

পাঙাশ মাছ

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ:

*নমুনা মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) রর.. মাছ রাখার জন্য ট্রে/পাত্র ররর. ফরসেফ বা চিমটা রা. ফরমালিন, খাতা, কলম ইত্যাদি।

 

কার্যপদ্ধতি:

১. প্রথমে বাজার থেকে চারটি নমুনা মাছ জোগাড় করুন। এবার চারটি মাছকে পৃথক পৃথক ট্রেতে রাখুন। ররর. মাছগুলো যাতে তাড়াতাড়ি পচে না যায় তার জন্য সামান্য পরিমাণ ফরমালিন ব্যবহার করুন। রা. এবার চিমটা দিয়ে নমুনা মাছগুলো ভালোভাবে নেড়েচেড়ে বহিরাকৃতি পর্যবেক্ষণ করুন। ব্যবহারিক নোটবুকে ট্রেতে রাখা মাছ চারটির চিহ্নিত চিত্র অংকন করুন এবং তাদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য লিখুন। ক্লাস শেষে মাছগুলো গ্লাসজারে ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষণ করুন।

 

 

নমুনা— রাজপুটি শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য:

১. রূপালি আঁইশে আবৃত দেহ দেখতে অনেকটা দেশী সরপঁুটির মত। তবে শরীর পাশ্বীর্য়ভাবে বেশ চ্যাপ্টা ও পাতলা। রর. দেশী সরপুঁটি তুলনায় এর মাথা ছোট।
২. দেহের সামনে ও পিছনে চাপা এবং মাঝখানে বেশ চওড়া।
৩. মাছটির পিঠের দিকে হালকা মেটে এবং পেটের পাখনার রং হালকা হলুদ।

নমুনা : নাইলোটিকা শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য:
১. মাছটি দেখতে ধুসর—নীলাভ থেকে সাদা লালচে।
২. পৃষ্ঠ পাখনা কালো বর্ণের মার্জিনযুক্ত এবং পুচ্ছ পাখনা সাদা বর্ণের সরু ও লম্বা দাগযুক্ত । ররর. পৃষ্ঠ ও পায়ু পাখনায় শক্ত কাঁটা আছে।

 

 

নমুনা : কই শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য:

১. দেশী কই—মাছ ছোট অবস্থায় কালচে ধরনের এবং পরিপক্ক অবস্থায় পিঠের দিকে বাদামী সবুজ আর পেটের দিকে হালকা হলুদ রঙের হয়। থাই/ভিয়েতনামী কই—এর দেহ হালকা ফ্যাকাশে ধরনের। দেহের উপরিভাগে ছোট ছোট
কালো দাগ থাকে এবং পাখনাগুলো হালকা হলুদ রঙের হয়। রর. দেশী কই—এর কানকোর পিছনে কালো দাগ থাকে কিন্তু পুচ্ছ পাখনার গোড়ায় কালো দাগ থাকে না। থাই কইয়ের  কানকোর পিছনে এবং পুচ্ছ পাখনার গোড়ায় কালো দাগ থাকে। ররর. দেশী কই—এর মুখ কিছুটা চোখা (চড়রহঃবফ) এবং থাই কই এর মুখটা ভেঁাতা (ইষঁহঃ)। রা. উভয়েরই পৃষ্ঠ পাখনায় ১৬ থেকে ২০টি এবং পায়ু পাখনায় ৯—১১ টি শক্ত কাঁটা থাকে। া. মাথার উপরেও আঁইশ বিদ্যমান।

 

 

নমুনা : পাঙ্গাস (থাই) শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য:

১. পাঙ্গাসের দেহে কোন আঁইশ থাকে না।
২. পাঙ্গাস দেখতে রুপালি—সাদা, পিঠের দিকটা নীলাভ—কালচে বর্ণের হয়। ররর. পিঠে ৯টি ও কানের পাশে ২টি শক্ত কাঁটা থাকে।
৩. এদের ছোট গোঁফ এবং পিঠে এডিপোজ ফিন থাকে।

 

রাজপুটির চাষ পদ্ধতি

রাজপুটির চাষ পদ্ধতি – কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের এই পাঠটি ১ নং ইউনিটের ১.৩ নং পাঠ। আজ রাজ রাজপুটির চাসের পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হবে।

রাজপুটির চাষ পদ্ধতি

 

রাজপুটি মাছ পরিচিতি:

রাজপুটি একটি দ্রুত বর্ধনশীল মিঠাপানির চাষোপযোগী মাছ। দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (যেমনথাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি) এ মাছ চাষ করা হয়। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Barbonymus gonionotus. মাছটির আগের নাম ছিল Punitius Gonionotus যা এখন আর ব্যবহৃত হয় না।

১৯৭৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে মাছটিকে প্রথম আমাদের দেশে আনা হয়। মাছটি দেখতে অনেকটা দেশী সরপঁুটি মাছের মত। তবে দেশী সড়পুটির তুলনায় এদের দেহ বেশ চেপ্টা ও পাতলা। মাছটিকে অনেকে থাই সরপঁুটিও বলে থাকে। মাছটির পিঠের উপরের দিক হালকা মেটে, শরীরের বর্ণ উজ্জ্বল রূপালি, লেজ খাঁজ কাটা, পেটের পাখনার রং হালকা হলুদাভ। পোনা অবস্থায় এরা ফাইটোপ্ল্যাংকটন ও জুপ্ল্যাংকটন খায়। পরিণত বয়সে এরা বিভিন্ন ধরণের জলজ উদ্ভিদ/আগাছা, ক্ষুদিপানা এবং ছোট ছোট অমেরুদন্ডী প্রাণিও খেয়ে থাকে। চাষের অবস্থায় এরা চালের কঁুড়া, সরিষার খৈল ইত্যাদি খেয়ে থাকে। রাজপুটি প্রায় এক বছরেই প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। এরা নদী বা খালের ে¯্রাতশীল পানিতে প্রজনন করে থাকে।

চিত্র ১.৩.১: রাজপুটি মাছ

 

রাজপুটি মাছের বৈশিষ্ট্য/চাষের সুবিধা:

(১) উচ্চ ফলনশীল এবং সুস্বাদু মাছ।

(২) প্রায় সব ধরনের খাদ্যই খায়। তবে ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ এদের প্রিয় খাদ্য।

(৩) যে কোনো প্রকার পুকুর, ডোবা বা পতিত জলাশয়ে চাষযোগ্য।

(৪) রুইজাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষ সম্ভব।

(৫) অল্প সময়ে এবং স্বল্প ব্যয়ে সহজেই মাছটি চাষ করা সম্ভব।

(৬) দ্রুত বর্ধনশীল এ মাছ ৪—৬ মাসের মধ্যে আহরণযোগ্য।

(৭) খাদ্যের জন্য বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হয় না।

(৮) সহজ চাষ ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে ঘোলা পানিতে ও ধান ক্ষেতে সমন্বিতভাবে চাষ করা সম্ভব।

 

রাজপুটি মাছের একক চাষ পদ্ধতি:

রাজপুটি মাছের একক চাষ পদ্ধতি রাজপুটি চাষ করতে হলে নিম্নোক্ত কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে করা প্রয়োজন।

 

১। মজুদ পকুর ব্যবস্থাপনা:

পুকুর প্রস্তুতি:

পুকুর প্রস্তুতির উপর মাছ চাষের সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করে। সে কারণে পোনা মজুদের পূর্বে অবশ্যই পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। সাধারণত: ১০—৩০ শতাংশ আয়তনের যে কোনো মৌসুমী পুকুর যেখানে পানির গভীরতা ১.০—১.৫ মিটার থাকে এমন পুকুর রাজপুটি চাষের জন্য উপযোগী। পুকুর প্রস্তুতির ধাপগুলো হলো:

(ক) পাড় ও তলা ঠিক করা:

পুকুরের পাড় ভালোভাবে মেরামত করতে হবে যাতে বন্যার পানি বা বৃষ্টির পানি পুকুরে ঢুকতে না পারে। জাল টানার সুবিধার্থে পুকুরের তলা সমান করতে হবে। তলায় জমা অতিরিক্ত পচা কাদা অপসরণ করতে হবে নতুবা পানিতে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হবে। পুকুর পাড়ে বড় গাছপালা থাকলে ডালপালা ছেটে দিতে হবে নতুবা গাছের পাতা পানিতে পড়ে পচে পুকুরের পরিবেশ নষ্ট করবে।

(খ) ক্ষতিকর আগাছা দমন:

জলজ আগাছা হিসেবে পুকুরে কচুরীপানা, টোপাপানা ও তন্তুজাতীয় শেওলা দেখা যায়। মাছের পোনা মজুদের পূর্বে এই সমস্ত জলজ আগাছা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। শিকড়যুক্ত আগাছা থাকলে শিকড়সহ তুলে ফেলতে হবে। পুকুরে আগাছা থাকলে মাছ চাষে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি করে। যেমন—

* পুকুরে সূর্যালোক পেঁৗছাতে বাঁধা দেয়

* রোগজীবাণু ও পরজীবীর বাসস্থান হিসেবে কাজ করে

* মাছের চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়

* রাত্রে এবং মেঘলা দিনে পানিতে অক্সিজেনের অভাব ঘটায় ক্স পানিতে দ্রবীভূত পুষ্টি উপাদানের অভাব ঘটায়।

(গ) রাক্ষুসে মাছ অপসরণ:

পুকুরের রাক্ষুসে মাছ দু’ভাবে অপসারণ করা যায়।
জাল টেনে বা পুকুরে শুকিয়ে মাছের পোনা মজুদ করার পূর্বে ঘন ঘন জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ যেমন— শোল, টাকি, চিতল, বোয়ল ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। যদি জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করা না যায় তবে পুকুর শুকিয়ে ফেলে কাজটি করা যেতে পারে।

ওষুধ প্রয়োগ করে

রোটেনন –

প্রতি ফুট পানির গভীরতার জন্য ৩০ গ্রাম/শতাংশ হারে রোটেনন প্রয়োগ করতে হবে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে রোটেনন প্রয়োগ করে পানি ওলটপালট করে দিলে তাড়াতাড়ি কাজ করে।

ফসটক্সিন ট্যাবলেট –

১ মিটার পানির গভীরতার জন্য ৩টি ট্যাবলেট/শতাংশ হারে ব্যবহার করা যাবে। সমস্ত পুকুরে ট্যাবলেট সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে পানি ওলটপালট করে দিতে হবে। ১—২ ঘন্টা পর মাছ ভাসতে শুরু করলে তুলে ফেলতে হবে। (বি:দ্র: পুকুরে ফসটক্সিন ব্যবহার করা অনেক সময় অনুমোদন করা হয় না। কারণ, ফসটক্সিন থেকে উৎপন্ন গ্যাস মানুষও গবাদি পশুর জন্য খুবই ক্ষতিকর।)

(ঘ) চুন ও সার প্রয়োগ:

পুকুরের ঘোলা ও বিষাক্ত পানি শোধন ও প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য যথাক্রমে চুন ও সার প্রয়োগ করতে হয়। রাক্ষুসে মাছ অপসারনের ১—২ দিন পর ১ কেজি/শতাংশ হারে চুন পানিতে গুলে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। চুন ক্ষতিকর রোগ জীবাণু ধ্বংস করে, মাটি ও পানির গুণাগুণ ঠিক রাখে, মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। চুন প্রয়োগের ৩—৪ দিন পর ৩—৪ কেজি/শতাংশ হারে গোবর (জৈব সার) অথবা ২ কেজি/শতাংশ হারে হাঁস—মুরগির বিষ্ঠা প্রয়োগ করতে হবে। এর ৬—৭ দিন পর অজৈব সার হিসেবে ১০০—১৫০ গ্রাম ইউরিয়া/শতাংশ এবং ৫০—৭৫ গ্রাম টি.এস.পি/শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হবে।

অজৈব সার পানিতে গুলে সারা পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়। সার প্রয়োগের ৪—৫ দিন পর পানির রং সুবজাভ হলে বুঝতে হবে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে। তখন মাছের পোনা ছাড়তে হবে।

 

২। মাছের পোনা মজুদ:

*নিকটবর্তী কোনো সরকারি বা নির্ভরযোগ্য বেসরকারি খামার থেকে প্রয়োজন অনুসারে রাজপুটি মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হবে। আধুনিক পদ্ধতিতে পলিথিন ব্যাগে ১/৩ ভাগ পানির সাথে ২/৩ ভাগ অক্সিজেন সহকারে পোনা সংগ্রহ করা উত্তম। পোনা পরিবহনের কাজটি সকালে করা শ্রেয়।

* সংগৃহিত পোনা (৫—৭ সে.মি আকারের) ৭০—৮০টি/শতাংশ হারে মজুদ করা যেতে পারে। সকাল বেলা পোনা মজুদ করার উত্তম সময় কারণ এসময় তাপমাত্রা কম থাকে। ফলে তাপমাত্রাজনিত কারণে পোনা মৃত্যুর হার কম হয়।
ক্স সংগৃহিত পোনা সরাসরি মজুদ করা যাবে না। প্রথমে ব্যাগের পানির তাপমাত্রা মজুদ পুকুরের পানির তাপমাত্রার সমতায় আনতে হবে। এজন্য পোনা ভর্তি ব্যাগ কিছুক্ষণ পুকুরের পানিতে রাখতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে কাত করলে ব্যাগের পানি পুকুরে এবং পুকুরের পানি ব্যাগে যাবে। এভাবে রাখলে পোনাও আস্তে আস্তে পুকুরে চলে যাবে।

 

৩। সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ:

* পোনা মজুদের পরের দিন থেকে মাছের দেহ ওজনের শতকরা ৪—৬ ভাগ হারে চাউলের কঁুড়া (৮০%) ও সরিষার খৈল (২০%) এর মিশ্রণ খাদ্য হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। নিচের সারণি অনুসরণ করেও সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে।

সারণি ১। প্রতি শতাংশে পোনা ছাড়ার পর থেকে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের পরিমান।


* সকালে ও বিকালে প্রতিদিন দু’বার নির্দিষ্ট জায়গায় খাবার দিতে হবে।
* সম্পূরক খাদ্যের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য ২ সপ্তাহ অন্তর অন্তর পুকুরে ৪—৬ কেজি/শতাংশ হারে গোবর ছিটিয়ে দিতে হবে।

 

৪। মাছের স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি পরীক্ষণ:

প্রতি মাসে অন্তত একবার জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। মাছের নমুনা সংগ্রহ করে ওজন পরীক্ষা করতে হবে। যদি রং উজ্জ্বল হয়, গায়ে পিচ্ছিল স্বচ্ছ পাদার্থ থাকে, কোনো ক্ষত চিহ্ন না থাকে, পাখনাগুলো ভালো থাকে এবং দেখতে বেশ তাজা মনে হয় তবে বুঝতে হবে মাছের স্বাস্থ্য ভালো আছে। রাজপুটি মাছ বেশ শক্ত প্রকৃতির হওয়ায় রোগ বালাই তেমন হয় না। তবে শীতকালে কখনও কখনও ক্ষত রোগ হতে পারে। শীতের শুরুতে ১ কেজি/শতাংশ হারে চুন প্রয়োগ করে পানি শোধন করলে রোগ বালাই থেকে মুক্ত থাকা যায়।

 

৫। রাজপুটি আহরণ ও উৎপাদন/আয়:

  •  উল্লেখিত পদ্ধতিতে ৫—৬ মাস চাষ করার পর মাছের ওজন ১৫০—১৭০ গ্রাম হয়ে থাকে। এমন ওজনের মাছ বিক্রির জন্য ধরা যেতে পারে।
  • পুকুর থেকে খুব সকালে মাছ ধরতে হবে, যাতে জীবিত বা তাজা অবস্থায় বাজারে বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায়।
  • পুকুর না শুকিয়ে বেড় জাল টেনে সমস্ত মাছ আহরণ করা যায়।
  • আধা—নিবিড় পদ্ধতিতে রাজপুটি মাছ চাষ করে ৫—৬ মাসে প্রতি শতাংশে ১০ থেকে ১২ কেজি ফলন পাওয়া সম্ভব। একক চাষ পদ্ধতিতে সমস্ত উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে প্রতি শতাংশ হতে ৬ মাসে ৫০০—৬০০ টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।

 

 

৬। রাজপুটির রোগ ব্যবস্থাপনা:

সাধারণত: শীতকালে মাছ কম খায় ফলে শারীরিকভাবে কিছুটা দূর্বল থাকে। রাজপুটি মাছও এর ব্যতিক্রম নয়। আর ঐ সময়টাই সুযোগ সন্ধানী রোগ জীবাণুর জন্য আদর্শ। তাই শীতকালে মাছ রোগক্রান্ত হতে পারে। রাজপুটি মাছের ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ, আঁইশ খসে পড়া ইত্যাদি রোগ হতে পারে। রাঁজপঁুটি মাছের রোগ ব্যবস্থাপনার করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

(১) পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ মাছ চাষের উপযোগী রাখতে হবে।

(২) পুকুরে গুণগতমানসম্পন্ন ভাল জাতের পোনা মজুদ করতে হবে।

(৩) পুকুরটি হতে হবে খোলামেলা ও আগাছা মুক্ত।

(৪) পুকুরে যাতে কোনো অবাঞ্ছিত বা ক্ষতিকর প্রাণি ঢুকতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

(৫) পুকুরটি বন্যামুক্ত স্থানে হওয়া বাঞ্চনীয়।

(৬) মাত্রাতিরিক্ত সার ও সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৭) পানির গুণাগুণ মাছ চাষের উপযোগী রাখার জন্য নিয়মিত চুন ও সার প্রয়োগ করতে হবে।

(৮) শীত মৌসুমের পূর্বেই মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

(৯) নমুনায়নের সময় আক্রান্ত মাছ পেলে তা সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে হবে।

(১০) আক্রান্ত পুকুরে ব্যবহৃত উপকরণ (জাল) অন্য পুকুরে ব্যবহার করা যাবে না। কড়া রৌদ্রে শুকিয়ে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা যেতে পারে।

(১১) পুকুরে মাছের ক্ষতরোগ দেখা দিলে প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হবে।

(১২) মজুদ মাছের সংখ্যা ও পুকুরের ধারণ ক্ষমতার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে হবে অর্থাৎ অতিরিক্ত পোনা মজুদ করা যাবে না।

 

মৎস্য চাষের গুরুত্ব

মৎস্য চাষ ও মাছ চাষ পদ্ধতির ধারণা – কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ বিষয়ের একটি পাঠ। এই পাঠটি ১ নং ইউনিটের ১.৪ নং পাঠ। মৎস্য চাষ ও মাছ চাষ পদ্ধতির ধারণা বাংলাদেশে মাছ চাষের ইতিহাস খুব বেশী দিনের নয়। তবে নাজির আহমেদ (১৯৪৭—১৯৬০) নতুনভাবে এদেশে মাছ চাষের গোড়া পত্তন করেন। স্বল্প ব্যয়ে ও স্বল্প পরিশ্রমে প্রচুর মাছ উৎপাদন এবং মাছের ব্যবসা হতে আর্থিক আয়ের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় কালক্রমে এ অঞ্চলে পুকুরে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। দেশে বর্তমানে মাছের চাষ পদ্ধতিতে বেশ উন্নতি সাধিত হলেও এখনও বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্প হিসেবে এটি গড়ে ওঠেনি।

 

মৎস্য চাষের গুরুত্ব

 

মৎস্য বা মাছ বলতে শীতল রক্ত বিশিষ্ট (ectothermic= cold blooded) জলজ মেরুদন্ডী প্রাণিকে বোঝায় যারা অভ্যন্তরিন ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য পরিচালনা করে এবং জোড় বা বিজোড় পাখনার সাহায্যে পানিতে চলাচল করে। তবে সব মাছই যে শীতল রক্তবিশিষ্ট এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। কিছু মাছ আছে যেমন—White shark এবং Tuna মাছ তাদের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে। অর্থাৎ পরিবেশের তাপমাত্রার তারতম্যের সাথে তাদের দেহের তাপমাত্রার তারতম্য হয় না।

Fish Base এর তথ্য মতে অক্টোবর, ২০১৬ পর্যন্ত পৃথিবীতে ৩৩,৪০০ প্রজাতির কথা জানা যায়। তবে অনেক প্রজাতি আছে যাদের সস্পর্কে এখনও বর্ণনা করা হয়নি অথবা এখনও অজানা। জানা মাছের প্রজাতির সংখ্যাটি মেরুদন্ডী প্রাণির অন্যান্য সকল শ্রেণীর (স্তন্যপায়ী, উভচর, সরীসৃপ ও পাখী) সম্মিলিত যোগফলের চাইতেও বেশী।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যখন আমরা মাছ বা মৎস্য বলি তখন শুধুমাত্র মাছকেই বোঝানো হয়। আর যখন মাৎস্য বলি তখন মাছের সাথে সাথে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন সকল জলজ প্রাণীকে বোঝায়।

জীববিজ্ঞানের যে শাখায় মাছের বিভিন্ন দিক যেমন— শ্রেনীবিন্যাস, মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনা, মাছের প্রজনন, প্রতিপালন, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণন, রোগতত্ত্ব তথা মাছ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে মৎস্যবিজ্ঞান বলে। বর্তমানে মাছ চাষের সাথে অন্যান্য অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলজ প্রাণি যেমন— চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ, ব্যাঙ ইত্যাদি চাষ করা হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় মাছ চাষকে বলা হয় একোয়াকালচার (Aquaculture)।

Aquaculture শব্দটি Latin শব্দ Aqua’ যার অর্থ “পানি” এবং English শব্দ ‘culture’ যার অর্থ “চাষ” নামক দু’টি শব্দের সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ Aquaculture অর্থ পানিতে চাষ অথবা মাছ চাষ। অন্যভাবে, নিয়ন্ত্রিত বা অনিয়ন্ত্রিতভাবে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলজ জীবের চাষকে একোয়াকালচার বলে। একে অয়ঁধভধৎসরহম ও বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ: মাছ চাষ (Fish farming/culture), চিংড়ি চাষ (Shrimp farming/culture), ওয়েস্টার চাষ (Oyster farming/culture), সীউঈড চাষ (Seaweed farming/culture) ইত্যাদি।

 

 

মাছ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic improtance of fish culture) :

পরিবেশিক ও প্রাকৃতিক কারণে মৎস্য চাষে বাংলাদেশ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। “মাছে ভাতে বাঙালি”— প্রবাদ বাক্যটি বাংলাদেশের মৎস্য ঐতিহ্যেরই ইঙ্গিত বহন করে। মাছ এদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে। পুষ্টিমান উন্নয়ন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার্জন, আর্থ—সামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাছ চাষের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।

 

(১) পুষ্টিমান উন্নয়ন:

পুষ্টিগত দৃষ্টিকোন থেকে দেহগঠনে আমিষের ভূমিকা ব্যাপক। তুলনামূলক বিচারে প্রাণিজ আমিষ দেহের জন্য ভালো উচ্চ মূল্যের কারণে এদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ দৈনন্দিন খাবারের সাথে প্রাণিজ আমিষ বিশেষ করে গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদির মাংসের সংস্থান করতে পারে না। এই শ্রেণির মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নে মৎস্য আমিষের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য।

সস্তায় পওয়া যায় এমন মাছ খেয়ে এদের দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা মিটে। শুধু এরাই নয়, এদেশের প্রায় সব শ্রেনির সব মানুষের কাছেই মাছ সমানভাবে প্রিয়। সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক যে পরিমান প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ করে তার প্রায় ৬০% ই আসে মাছ এবং চিংড়ি থেকে। গুণগত মানে অন্যান্য আমিষের চেয়ে মৎস্য আমিষ ভালো।

পর্যাপ্ত পরিমান মাছ খেলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ে, রোগের ঝঁুকি কমে এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়। মিঠা ও লোনা পানির মাছে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় যা মানুষের শরীরের জন্য বেশ উপকারি। এছাড়া আয়রণ ও জিংকের ভালো উৎস হলো ছোট মাছ। কাজেই মানুষের দৈনিক খাবারের সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ খাওয়া উচিত। ২০১৫—১৬ অর্থবছরে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, এদেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমান ৬০ গ্রামে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

(২) কর্মসংস্থান সৃষ্টি:

দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক বা ১ কোটি ৮৫ লক্ষ লোক হ্যাচারি পরিচালনা, মৎস্য চাষ, মৎস্য আহরণ, বিক্রি, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি কাজের সাথে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশগ্রহণ করে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে প্রায় ১৫ লক্ষ নারী মৎস্যখাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মৎস্য সেক্টরে বেকার পুরুষ ও নারীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে প্রচলিত হ্যাচারির ব্যবহার আধুনিকায়ন করে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও চাহিদা—মাফিক মানসম্পন্ন পোনার উৎপাদন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করত: সম্ভাব্য সকল জলাশয়কে আধুনিক চাষ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। একই সাথে উৎপাদিত মৎস্য বিপণন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে করে মাছের গুণগত মান ঠিক থাকে এবং মাছ ও মাছজাত পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এসকল ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বেকার নর—নারীদেরকে খাতওয়ারী প্রশিক্ষণের আওতায় এনে দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

(৩) বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন:

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দিনে দিনে এ সেক্টরের অবদান ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে মৎস্য খাতে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ।কাজেই, এখাতের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

 

(৪) আর্থ:

সামাজিক উন্নয়ন: বাংলাদেশে গ্রামে গঞ্জে অসংখ্য পুকুর ডোবা ছড়িয়ে আছে। এসব পুকুরের সিংহভাগ মাছ চাষের আওতায় আনা হলেও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও পতিত। পতিত বা আপাত মাছ চাষ অযোগ্য এসব পুকুরের মালিকানা দেশের প্রান্তিক চাষী বা বিত্তহীনদের হাতে। সংস্কারের মাধ্যমে এ সমস্ত পুকুরে মাছ চাষ করে বিত্তহীন লোক এবং বেকার যুবকদের আর্থ—সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

 

(৫) হাঁস:

মুরগির খাদ্য:

বাংলাদেশে হাঁস—মুরগির চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।

সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে এদের খাদ্যের চাহিদা। মাছের অব্যবহৃত অংশ যেমন—আঁইশ, কাটা, নাড়িভঁুড়ি ইত্যাদি এবং ফিসমিল (ঋরংযসবধষ) দ্বারা হাঁস—মুরগির জন্য উত্তম সুষম খাদ্য তৈরী করা সম্ভব। এসব আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য হাঁস—মুরগিকে খাওয়ালে ডিম ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

 

(৬) পতিত জমির সদ্ব্যবহার:

পতিত/অব্যবহৃত জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করলে পারিবারিক মাছের চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে আর্থিকভাবেও কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে।

কাজেই উপরের আলোচনা থেকে এটা বলা যায় যে, বাংলাদেশে মাছ চাষের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

 

 

কচ্ছপ চাষ

আজকের আলোচনার বিষয় কচ্ছপ প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা। কচ্ছপ মাংসাশী ও তৃণভোজী উভচর জাতীয় প্রাণী। মানুষের খাদ্য হিসাবে কচ্ছপের ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকায় অতিরিক্ত আহরণ ও পরিবেশের বিপর্যয়ের দরুন বাংলাদেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়াও কচ্ছপ রপ্তানী পণ্য বিধায় প্রতি বছর এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। কচ্ছপের বাসস্থানের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও ভারসাম্যপূর্ণ আহরণ নিশ্চিত করতে না পারলে শীঘ্রই এদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়বে।

কচ্ছপ চাষ

কচ্ছপের প্রজাতিসমূহ:

পৃথিবীতে কচ্ছপের ৩৪০টি প্রজাতি রয়েছে যাদের ভৌগোলিক বিস্তৃতি অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। তবে এদের মধ্যে ১১টি প্রজাতি মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় যার ৪ টি বিদেশে রপ্তানী করা যায়।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজতিগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো (সারনি ২):

ক্রম ইংরেজী নাম বৈজ্ঞানিক নাম আঞ্চলিক নাম
০১ রুফড টার্টল

(Roofed turtle)

কাচুগা টেনটোরিয়া

(Kachuga tentoria)

মাজহারি কাইট্টা
০২ স্পটেড ফ্ল্যাপ-শেল টার্টল

(Spotted flap shell turtle)

লাইসেমিস পাঙ্কটাটা

(Lissemys punctata)

শুনধি কাসিম
০৩ পিকক্ সফ্ট শেল টার্টল

(Peacok soft shell turtle)

অ্যাসপিডেরেটেস হুরুম

(Aspideretes hurum)

ধুম কাসিম
০৪ এশিয়াটিক সফ্ট শেল টার্টল

(Asiatic soft shell turtle

চিত্রা ইনডেকা

(Chitra indica)

সিম কাসিম

 

কচ্ছপের বাস ও বাসস্থান:

কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজতি সাগর থেকে শুরু করে নদী-নালা, ডোবা ও স্থলে বাস করে। এদের দেহের ওজন অত্যন্ত অল্প থেকে শুরু করে কয়েকশত কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

 

 

কচ্ছপের প্রাকৃতিক প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল:

কচ্ছপের ডিম-ধারণ ক্ষমতা:

কচ্ছপের বয়স ও আকার অনুসারে ডিম-ধারণ ক্ষমতার তারতম্য হয়ে থাকে। সাধারণত এদের ডিম ধারণ ক্ষমতা ২-২০টি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিশেষ এক ধরণের সামুদ্রিক কচ্ছপ ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কচ্ছপের ডিম-ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কচ্ছপ জলাশয়ের পাড়ে ডাঙ্গাঁয় এসে ডিম দেয়। ডিম দেয়ার পূর্বে স্ত্রী কচ্ছপ পিছনের পা দিয়ে নরম মাটি বা বালিতে গর্ত করে প্রতিটি গর্তে একটি করে ডিম ছাড়ে।

ডিম ছাড়ার শেষ হলে সংরক্ষণের জন্য স্ত্রী কচ্ছপ মাটি দিয়ে ডিম ঢেকে রাখে। কচ্ছপের ডিম গোলাকার থেকে শুরু করে ক্যাপসুল আকারের হয়। ডিমের খোলস অত্যন্ত শক্ত এবং সাদা বর্ণের। কচ্ছপের প্রজনন সাফল্য, তথা ডিম পরিস্ফুপনের হার প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন, মাটিতে তাপমাত্রা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে । ডিম ছাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত বা অতিরিক্ত গরম বা শীতে ডিম নষ্ট হয়ে যায়।

 

কচ্ছপের পোনা উৎপাদন কৌশল:

নরম খোলসধারী কচ্ছপের বৈজ্ঞানিক নাম ট্রায়নিক্স সাইনেনসিস উইজমেন( Trionyx sinenisis Weigmann ) সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় এ প্রজাতির কচ্ছপের চাষ করা হয়। এ কচ্ছপ ২-৩ বছর বয়সে ডিম দেয়। সাধারণত ২০০ বর্গমিটার বা অপেক্ষাকৃত বড় প্রজনন পুকুরে ৩:১ অনুপাতে স্ত্রী ও পুরুষ কচ্ছপ মজুদ করে ভাল ফল পাওয়া যায়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এর সারা বছর ডিম দেয়। এ প্রজাতি পর্যায়ক্রমে ১০-১৫টি ডিম ছাড়ে। পুকুরের এক পাড়ে ১.৫-২.৫ বর্গমিটার স্থানে ১৫-২৫ সে.মি.পুরু বালি বিছিয়ে তার ১.০-১.২ মিটার উপরে ছাউনি দিয়ে প্রজননের স্থান তৈরি করা হয়। কচ্ছপ প্রজনন স্থানে সহজে উঠার জন্য পানি হতে প্রজননের স্থান পর্যন্ত কাঠের তৈরি ঢালু সিঁড়ি স্থাপন করা হয়।

প্রজননের স্থানে কচ্ছপের পায়ের দাগ ও গর্তের চিহ্ন দেখে প্রত্যহ সকালে বালির নীচ থেকে ডিম সংগ্রহ করে কাঠের বাক্সে ১-২ দিন রেখে দিলে নিষিক্ত ও অনিষিক্ত ডিম সনাক্ত করা যায়। নিষিক্ত ডিমের মাথায় সাদা মুকুট তৈরি হয়। অন্যদিকে অনিষিক্ত ডিমের খোলসে সাদা দাগ দেখা যায়। অতঃপর নিষিক্ত ডিমগুলোর সাদা মুকুট উপরের দিকে রেখে হ্যাচারীতে রাখা বালির স্তুপে প্রতিটি ১-২ সে.মি. দূরত্বে বসিয়ে ৫ সে.মি.পুরু বালি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ডিমের সাদা মুকুট উপরের দিকে না রাখলে ডিম ফোটার হার কমে যায়।

ডিম ফোটার স্থানে সরাসরি সূর্যালোক ও বৃষ্টি পড়তে না দেয়া বাঞ্ছনীয়। সাধারণত ২৫ডিগ্রী-৬০ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় ৪৫-৬০দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। ডিম ফোটার স্থানের এক প্রান্তে অল্প গভীরতায় পানি রাখলে ডিম থেকে বাচ্চ বেরিয়ে গিয়ে পানিতে আশ্রয় নেয়। সদ্য প্রস্ফুটিত বাচ্চার দেহের দৈর্ঘ্য ২-৩ সে.মি. এবং ওজন ২-৪ গ্রাম হয়ে থাকে।

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কচ্ছপের বাচ্চা লালনের কৃত্রিম খাদ্য পাওয়া যায়। কৃত্রিম খাদ্য ছাড়াও মাছ, কেচোঁ ও মুরগির মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এরা আট সপ্তাহে ৪-৫ সে.মি. লম্বা ও ৯-১৯ গ্রাম ওজনের হয়। এদের দৈহিক বৃদ্ধির হার পানির গুণাগুণ, মজদ ঘনত্ব এবং খাদ্যের গুণগতমানের উপর নির্ভর করে। বাচ্চার দৈহিক আকারে তারতম্য দেখা দিলে বড়গুলোকে আলাদাভাবে লালন করতে হয়। তা না হলে এদের মধ্যে স্বখাদকতা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বাচ্চার দৈর্ঘ্য ১০-১২ সে.মি. হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লালন পুকুরে মজুদ রাখা হয়।

 

 

মজুদ পুকুরে কচ্ছপ চাষ কৌশল

উন্নত ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে মজুদ পুকুরের আকার ২০০-১০০০ বর্গমিটার এবং পানির গভীরতা ৫০-৭০ সে.মি. হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুকুরের পাড়ে বেড়া দিয়ে কচ্ছপের বহির্গমন পথ বন্ধ করতে হয়। পুকুর শুকিয়ে তলায় চুন প্রয়োগ করে পানি সরবরাহ দিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ৮-১২ টি পোনা মজুদ করা যায়।

 

কচ্ছপের সম্পূরক খাদ্য

কচ্ছপের খাদ্যে কম চর্বি এবং কমপক্ষে ৪৫-৫৫% প্রোটিন থাকা বাঞ্ছনীয়। ছোট মাছ, মরগির মাংস ও নাড়ী-ভুড়ি কচ্ছপের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। পুকুরে প্রতিদিন এক থেকে দুবার খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।

 

পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা

কচ্ছপ চাষের পুকুরকে তন্তুজাতীয় শেওলা ও আগাছা হতে মুক্ত রাখতে হয়। কেননা কচ্ছপ অধিকাংশ সময় পুকুরের তলায় কাদার ভিতরে বাস করে বিধায় পুকুরে জৈবিক পদার্থের পচন ক্রিয়া বেশী হলে অক্সিজেনের অভাব ঘটে কচ্ছপের ব্যাপক মৃত্যু ঘটার আশাংকা থাকে। সেজন্য পানির স্বচ্ছতা ১৫-৩০ সে.মি. রাখা বাঞ্ছনীয়।

 

কচ্ছপের উৎপাদন

বাংলাদেশে কচ্ছপ চাষের কলাকৌশল উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা এখনও তেমন পরিচালিত হয়নি। ফলে কচ্ছপের বাণিজ্যক উৎপাদন এবং মুনাফা সম্পর্কিত তথ্যাদি অত্যন্ত অপ্রতুল। উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নরম খোলসধারী কচ্ছপ চাষকালে বছরে এদের দেহের ওজন ৫০০-৬০০ গ্রাম হয়ে থাকে।

 

চাষকালীন সতর্কতা

কচ্ছপ পরিণত বয়সের পুরুষ ও স্ত্রীকে আলাদা করে রাখতে হয়। অন্যথায় পুরুষ কচ্ছপ স্ত্রীকে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। পুকুরে জাল টেনে বা পুকুর শুকিয়ে কচ্ছপ আহরণ করে জীবিত অবস্থায় বাজারজাত করা হয়।

 

 

সংরক্ষণের সুপারিশ

কচ্ছপ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থকরী সম্পদ। পরিবেশের বিপর্যয় এবং মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে এর জীববৈচিত্র্য আজ বিলুপ্তির পথে। পরিবেশে এদের ভারসাম্যপূর্ণ মজুদ বজায় রেখে আহরণ ও চাষ পদ্ধতির উন্নয়নে দ্রূত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরী। নিম্নে এতদসংক্রান্ত কতিপয় সুপারিশ উল্লেখ করা হলো:

  • প্রাকৃতিক পরিবেশে কচ্ছপের প্রাচুর্য্য নিরুপনের জন্য বিভিন্ন পরিবেশগত অঞ্চলে জরিপ পরিচালনা করা প্রয়োজন।
  • কচ্ছপের যে সমস্ত প্রজাতির বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে,সেগুলোকে সনাক্ত করে এদের প্রজনন আচরণ, খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস এবং চাষ পদ্ধতি উন্নয়ন সংক্রান্ত নিবিড় গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন।
  • কচ্ছপের বাস ও বাসস্থানের উন্নয়নের জন্য যথাযথ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
  • সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কচ্ছপের বাণিজ্যিক চাষ হয় । সে সমস্ত দেশে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে বাংলাদেশে মৎস্য হবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ণ এবং বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। এর ফলে কচ্ছপ চাষ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থপনা কলাকৌশল উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরী করা যাবে।
  • বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কচ্ছপ চাষ অনেকাংশে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত বাচ্চা ও সম্পূরক খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। তাই এ চাষ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কচ্ছপের কৃত্রিম প্রজনন, ব্যাপক পোনা উৎপাদন ও সম্পূরক খাদ্য তৈরীর কৌশল বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।
  • প্রাকৃতিক পরিবেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নিমিত্ত জাতীয় পর্যায়ে টাস্ক ফোর্স গঠন বা এ জাতীয় অন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

কচ্ছপ একটি বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন অপ্রচলিত রপ্তানী পণ্য । বিশ্ববাজারে মানুষের উপাদেয় খাদ্য হিসেবে কচ্ছপের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজাতিসমূহের মধ্যে নরম খোলসধারী কচ্ছপ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কচ্ছপের ভারসাম্যহীন আহরণ এবং চাষাবাদের মাধ্যমে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারায় দেশে কচ্ছপের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশাংকা দেখা দিয়েছে।

দেশের বিভিন্ন পরিবেশগত অঞ্চলে এর প্রাচুর্য্য নিরূপন ও আবাসস্থলের উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদের সংরক্ষণ করা যায়। তাছাড়া প্রণোদিত প্রজনন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করে কচ্ছপের প্রাচুর্য্য বৃদ্ধি করা যায় । এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনা করা আবশ্যক । কচ্ছপের সংরক্ষণ , প্রজনন ও চাষ কার্যক্রম হাতে নেওয়ার জন্য সহায়ক পুস্তিকা হিসাবে এ ম্যানুয়েলটি প্রণয়ন করা হলো।